You dont have javascript enabled! Please enable it!

ক্যাডার প্রশিক্ষণ প্রশ্নে মুসলিম লীগের
আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও শেখ মুজিব
১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গােড়াপত্তনের সময় যারা এর উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ মুসলিম সামন্ত জমিদার আর কেউ কেউ ছিলেন উঠতি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব। মুসলিম বুর্জোয়ারা ঐতিহাসিক কারণে তখনাে শিল্প বুর্জোয়া কিংবা জাতীয় বুর্জোয়ারূপে আত্মবিকাশ ঘটাতে পারেননি। তাঁরা ছিলেন মুখ্যত কমপ্রেডর বুর্জোয়া বা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া। ইংলন্ডের শিল্প মালিকদের বিভিন্ন পণ্যের জন্য ভারতে বাজার সৃষ্টি করে তার মাধ্যমে দালালি বা কমিশন অর্জনই ছিল এদের ব্যবসায়ীরূপে আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। সামন্ত জমিদার যাঁরা তাঁদের সকলেই ব্রিটিশ সরকারকে সেবার পুরস্কাররূপেই পেয়েছিলেন জমিদারি, হয়েছিলেন জমিদার। জন্মলগ্ন থেকেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের আত্মিক সম্পর্ক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে। এ কারণে তার মধ্যে ছিল হীনম্মন্যতার বীজ।
যুগটি ছিল বঙ্গভঙ্গের যুগ। আসাম পার্বত্য ত্রিপুরা এবং মালদহ জেলার সঙ্গে বঙ্গদেশের তিনটি বিভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর সমগ্র এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। রাজধানী দুইটি। প্রধান রাজধানী ঢাকা আর তার অধীনস্থ দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। ১ লক্ষ ৬ হাজার ৮৪০ বর্গমাইল সীমানায় নবগঠিত প্রদেশের লােকসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১০ লক্ষ। ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলমান। ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু। বাদবাকী অন্যান্য সম্প্রদায়ের। নবগঠিত প্রদেশের হাইকোর্ট থাকে কলকাতায়। অবশিষ্ট বাংলার সাথে ছােট নাগপুরের পাঁচটি হিন্দুপ্রধান দেশীয় রাজ্য এবং সম্বরপুর ও তার সাথে যুক্ত করা হয় উড়িষ্যার অপর পাঁচটি দেশীয় রাজ্য। আয়তন ১ লক্ষ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল। লােকসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লক্ষ। হিন্দু ৪ কোটি ২০ লক্ষ এবং মুসলমান ১০ লক্ষ। পার্টিশন অব বেঙ্গল’ নামে এই ঘােষণাটি ১৯০৫ সালে ৬ই জুলাই তারিখে সিমলা থেকে ভারতের, বিশেষ করে
পৃষ্ঠাঃ ১৩

কলকাতার, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা টিকতে পারেনি তুমুল প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের মুখে। অবশেষে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় বটে, কিন্তু পলাশী এবং প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে পুনর্জীবিত হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বহুলাংশে বিপর্যস্ত হবার উপক্রম দেখা দেয়।
ঢাকার নবাব সলিমুল্লা বাহাদুরের নেতৃত্বে ঢাকা শহরেই মুসলিম লীগ গঠিত হয় বিধায় তার উপর নবাব পরিবারের সম্পর্ক ছিল মালিক মােক্তারের। উপরােক্ত পটভূমিকায় আমরা যে সময়ের কথা নিয়ে আলােচনায় প্রবৃত্ত সেই ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লার জ্যেষ্ঠপুত্র নবাব হাবিবুল্লা বাহাদুর এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। জনাব এ. কে. ফজলুল হক তখন স্বায়ত্তশাসিত বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি নিজে মুসলিম লীগার নন, প্রজা পার্টির নেতা। সরকারে ছিল ছােটখাট উপদল, ব্যক্তিবিশেষ এবং লীগ ও প্রজা পার্টির সদস্যদের নিয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা। এই বছরেই অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্ণৌতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশন। বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে জনাব ফজলুল হক সম্মেলনে যােগদান করেন। লক্ষ্ণৌতে তাঁর বক্তৃতায় ফজলুল হক বলেছিলেন যে কংগ্রেস সরকার যদি ভারতের অন্যত্র কোথাও মুসলমানদের উপর নির্যাতন করে তাহলে তিনি বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ গ্রহণে দ্বিধাবােধ করবেন না। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে বাংলার অমুসলিমলীগার প্রধানমন্ত্রী ও প্রজা পার্টির নেতা এ. কে. ফজলুল হকের কণ্ঠে এরূপ বাক্য উচ্চারিত হওয়ায় বিশাল সম্মেলনের নানা প্রান্ত থেকে বিপুল আনন্দধবনি ও হর্ষোৎফুল্ল অভিনন্দন বার্তা উত্থিত হয়। সবার কণ্ঠে স্লোগান ‘শেরে বাংলা ফজলুল হক জিন্দাবাদ। সেদিন থেকে বাংলার আবুল কাসেম ফজলুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগে যােগদানের ফলে তিনি শুধু প্রজা পার্টি-লীগ কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি হলেন মুসলিম লীগের প্রধান কর্ণধারও। লক্ষ্ণৌতে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ যিনি তখনও ‘কায়দে আজম’ হননি। শেরে বাংলা ফজলুল হককে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। উল্লেখ্য ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে হক সাহেবও ছিলেন, কিন্তু মােহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ছিলেন না। মাঝখানে কখনাে চাকরির কারণে কখনােবা অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে হক সাহেব সক্রিয় রাজনীতি থেকে ছিলেন দূরে দূরে।
ইতিমধ্যে কংগ্রেসের অসহযােগ ও ‘মুসলিম ভারতের’ খেলাফত আন্দোলনের ভিন্নধারা সংযুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভূত হলেন মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ। তিনি কংগ্রেসের নেতা, খেলাফত
পৃষ্ঠাঃ ১৪

আন্দোলনেরও নেতা। তার হাতিয়ার ছিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার পেশা। সঙ্গে রাজনীতি।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রায় কোন মানুষই দোষত্রুটির উর্ধ্বে নয়। সে কথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা না করেও জোরের সঙ্গে বলা যায় মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার সমকালীন আলেমদের অনেকের চেয়েই ছিলেন সংস্কারমুক্ত। ধর্মীয় পরিমণ্ডলে তাঁর ছিল গােড়ামিমুক্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গি। আর পান্ডিত্যের গভীরতা অনেকের কাছেই ছিল শ্রদ্ধার বস্তু। কলকাতায় সাংবাদিক জগতের তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তির নায়ক। মাত্র পাঁচ আনা পয়সা সম্বল করে অসীম সাহস, দূরদৃষ্টি, অধ্যবসায় ও ব্যবসায়িক বুদ্ধি প্রয়ােগ করে তিনি ধীরে ধীরে শুধু সার্থক সম্পাদক নন, সাপ্তাহিক মােহাম্মদী, সাহিত্যপত্র মাসিক মােহাম্মদী এবং তৎকালীন ‘বঙ্গ-আসামের একমাত্র মুসলিম দৈনিক আজাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মালিক হবার মতাে দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছিলেন। দৈনিক আজাদের প্রচার সংখ্যা অসাধারণভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফলে তিনি রােটারি প্রেস স্থাপন করে তদানীন্তন কলকাতার বৃহৎ প্রকাশ ভবনগুলাের অন্যতম হবার যােগ্যতা অর্জন করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক প্রদত্ত দৈনিক আজাদকে সরকারী তহবিল থেকে এককালীন ত্রিশ হাজার টাকার অনুদান মওলানা সাহেবের ছাপাখানা ও ব্যবসা প্রসারের যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। আনন্দবাজার ও অন্যান্য অমুসলিম প্রেস মালিকেরা এর বিরুদ্ধে অনেক সমালােচনা ও বিদ্রুপ করেছেন। পরে এক পর্যায়ে সাপ্তাহিক মােহাম্মদী তার জ্যেষ্ঠপুত্র খায়রুল আনাম খাঁর মালিকানা ও সম্পাদনায় ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজে শুধু সাহিত্যপত্র মাসিক মােহাম্মদীর সম্পাদক থাকেন। দৈনিক আজাদের সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল খ্যাতনামা সাহিত্যিক সমালােচক ও কলামিস্ট জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীনের উপর। লােয়ার সার্কুলার রােডের একটি পুরাতন গৃহে স্থাপন করেছিলেন তার প্রেস ও পত্রিকার অফিস। অফিসের মধ্যখানে ছিল একটি হলরুম। সেটা সভা সমিতির কাজে ব্যবহার করার অনুমতি দিতেন সমমনা সকলকে। কলকাতার মতাে একটি বিশাল রাজধানী শহর ও বাণিজ্যিক নগরে এরূপ সুযােগ লাভ তখনকার দিনে কঠিন ছিল। দাতার পক্ষেও ছিল উদারতার পরিচায়ক। উদ্দেশ্য তার যাইই থাকুক, ধীরে ধীরে আজাদ পত্রিকার অফিস হয়ে দাঁড়ালাে তৎকালীন মুসলিম বাংলার রেনেসার। প্রাণকেন্দ্র। আন্দোলনের ও তার প্রচার প্রচারণার কেন্দ্রও ছিল আজাদ অফিস। এসব কারণে সমগ্র বাংলায় তাঁর অপরিসীম ক্ষমতা, অপ্রতিহত প্রভাব।
১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার জারিকৃত ভারত শাসন আইনে সীমিত পর্যায়ে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের ব্যবস্থা হয়। পূর্ণ স্বাধীনতার পথে প্রাপ্ত
পৃষ্ঠাঃ ১৫

সীমিত সুযােগের সদ্ব্যবহার করার পক্ষে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ব্যারিস্টার মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ লন্ডনে তাঁর স্বনির্বাসিত জীবন পরিত্যাগ করে ছুটে আসেন স্বদেশের মাটিতে এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের কাজে করেন আত্মনিয়ােগ। তিনি কলকাতায়ও এলেন। কিন্তু উঠলেন বুর্জোয়া শ্রেণির জবরদস্ত প্রতিনিধি ইস্পাহানিদের ক্যামাক স্ট্রীটের প্রাসাদে। সেখানেই ডাকলেন বাংলার সামন্ত বুর্জোয়াদের সকল মাতব্বরকে। ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহকে সভাপতি ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে সাধারণ সম্পাদক মনােনীত করে তিনি গঠন করে দিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কমিটি। এ ঘটনার প্রায় ত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯০৬ সালে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লার নেতৃত্বে নবাব হেদায়েতউল মূলক, নবাব মহসিনউল মূলক, আগা খান, আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রমুখকে নিয়ে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গােড়াপত্তন হলেও বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে লীগ সম্পর্কে তেমন প্রাণচাঞ্চল্য কিংবা সাড়া জাগেনি।
মুসলিম লীগের বন্ধ্যাত্বের অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু একটি কথা সকল দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল মহল একবাক্যে স্বীকার করতেন যে, বিজ্ঞানসম্মত কোনাে আর্থ-সামাজিক দাবি ও কর্মসূচি ছাড়া শুধু ইসলাম বিপন্ন জিগীর কিংবা অনুরূপ সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দাবি-দাওয়া নিয়ে কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠান হালে পানি পেতে পারে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকৃষক শ্রমিক কামার কুমার বােপা নাপিত জেলে তাঁতী- এরা খেটে খাওয়া মানুষ, মেহনতী মানুষ। ভূমিহীন কৃষক চায় জমি কিংবা কাজ। নিরক্ষর চায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যহীন চায় স্বাস্থ্য এবং বেকার চায় চাকরি; তার সঙ্গে সবার জন্য চাই ভাত কাপড় বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা দানের কর্মসূচি ও অঙ্গীকার। দলের কর্মসূচিতে এরূপ আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি না থাকলে এইসব সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত জনগণ কোন ভুয়া কথা ও বাগাড়ম্বরে আস্থা রাখতে পারে না। তদুপরি যুগটি ছিল জমিদার মহাজনদের প্রবল দাপটের যুগ, ঋণের দায়ে খাতক কিংবা কৃষককে ভিটেছাড়া ও সহায় সম্বলহীন করার যুগ। কাজেই নবাব-সুবা দেখলেই তাদের মনে সৃষ্টি হয় ভীতি। কখনােই সহজভাবে শ্রদ্ধাভক্তি জাগ্রত হয় না। নবাব হাবিবুল্লা বাহাদুরও সেই শােষক সামন্ত শ্রেণির শক্তিমান প্রতিনিধি এবং আমলা ও বুর্জোয়াদের খয়েরখা ব্যক্তি। আর আগাখানীদের মতাে বুর্জোয়া শােষকরা বন্যা দুর্ভিক্ষ খরার সময় খাদ্য মূল্য বিপুল চড়িয়ে নিজেদের অবাধ মুনাফা লুণ্ঠন করে থাকে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। এটা তাদের ব্যবসা। কাজেই তাদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নির্বাচনী বৈতরণী পার হবে সেকথা চিন্তা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অতএব নির্বাচনের প্রাক্কালে
পৃষ্ঠাঃ ১৬

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পুনর্গঠনের প্রয়ােজন দেখা দেয়। পুনর্গঠিত সংগঠনের সভাপতি মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মেদিনীপুরের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও পেশায় তিনি একজন ব্যারিস্টার, খেটে খাওয়া বুদ্ধিজীবী। তাঁর বসে খাওয়ার অবকাশ ছিল না। তাঁর জীবনে ‘নাে ওয়ার্ক নাে পে’। কোর্টে না গেলে পয়সা নাই। তদুপরি তিনি ছিলেন খিদিরপুর ও মেটিয়াবুরুজের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও তাদের নেতা। সেদিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ডি-ক্লাসড না হলে সংগ্রাম ও সংগঠনের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের একজন। অর্থাৎ ওয়ার্কিং ক্লাস লীডার নন হয়েছিলেন মাস লীডার (mass leader)।
লীগ নেতৃত্বের এই জুটি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৩ সালের ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত একটানা সংগঠনের কাণ্ডারিরূপে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কিছু কিছু জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হন। কিন্তু যতটা আশা করা গিয়েছিল ততটা হয়নি। যা হয়েছে তাকে সম্বল করে নির্বাচন করা চলে, তবে সুফলের আশা উজ্জ্বল নয়। তার প্রধান কারণ দুটি। এক, আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচির অভাব। যে কর্মসূচি এদেশের কৃষক শ্রমিক, ছাত্র যুবক ও সকল মেহনতী মানুষের প্রাণে আশার সঞ্চার করবে, মানুষ নিজের এবং অনাগত দিনের ভবিষ্যত সম্পর্কে ভরসা পাবে। শুধু সাম্প্রদায়িকতার ট্যাবলেট দিয়ে সমস্যা জর্জরিত সাধারণ মানুষের জীবনে প্রেরণা সৃষ্টি করা যায় না, সৃষ্টি করা যায় না উত্তম উদ্দীপনা। দুই. মুসলিম লীগ গণমুখী কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হওয়ার সুযােগে এ. কে. ফজলুল হক কৃষক-প্রজার প্রাণের দাবি ঋণসালিসী বাের্ড বাতিল, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের স্লোগান এবং সর্বোপরি দেশের মেহনতী জনগণের কল্যাণকামী কথাবার্তা, বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে তাঁদের প্রাণে আশার সঞ্চার করেন। তিনি সুফলও পেলেন। নির্বাচনে তাঁর প্রজা পার্টি অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। সাফল্যের কারণ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমউদ্দিন এবং হক সাহেবের ছিল ‘ডালভাতের প্রতিশ্রুতি। সাশ্রনয়নে তিনি লক্ষ মানুষের সম্মুখে কথা দিয়েছিলেন নির্বাচিত হলে ক্ষুধার্তদের জন্য অন্ততপক্ষে ডালভাতের আয়ােজন করবেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ভারতের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদী সামন্ত-বুর্জোয়া মুসলিম লীগের মাঝখান দিয়ে তাঁর প্রজা পার্টির বিজয় এদেশের ভােটারদের শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণি সচেতনতার একটি উৎসাহব্যঞ্জক প্রমাণ। জনাব ফজলুল হকের সে বিজয় বাংলার সুদীর্ঘকালের শ্রেণি সংগ্রামের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের পূর্বাভাস। তাঁর বিজয়ে ভারতের সকল সামন্ত ও
পৃষ্ঠাঃ ১৭

বুর্জোয়া শ্রেণির হৃৎকম্প শুরুহয়। আর ব্রিটিশ সরকার তীক্ষ দৃষ্টি স্থাপন করে। তাঁর কথাবার্তা, চালচলন ও গতিবিধির উপর।
এখানে উল্লেখ থাকে যে খাজা নাজিমউদ্দিন তাঁর নিজের ঢাকা শহর ও ঢাকা জেলার আটটি নির্বাচনী কেন্দ্র নবাব পরিবারের সদস্যদের জন্য ছেড়ে দিয়ে বরিশাল জেলার পটুয়াখালী থেকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি মনে করেছিলেন ঢাকা শহর কিংবা ঢাকা জেলার যে কোন আসনের চেয়ে পটুয়াখালীর নিজ জায়গীরদারী থেকে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাই তার বেশি। তদুপরি বাংলার ছােটলাট স্যার জন এন্ডারসন খাজা নাজিমউদ্দিনকে সমর্থন দান করেন প্রকাশ্যে। তিনি সকল শ্রেণির সরকারী কর্মচারীর প্রতি এরূপ নির্দেশ জারি করেন তাঁরা যেন খাজা নাজিমউদ্দিনকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে অবশ্যই জয়ী করেন। ঢাকার আটটি আসন থেকে পরিবারের যে আটজন প্রার্থী নির্বাচিত হলেন তাঁদের নাম নবাব হাবিবুল্লাহ, খাজা নসরুল্লাহ, খাজা শাহাবুদ্দিন, তার স্ত্রী ফরহাদ বানু, সৈয়দ সেলিম, সৈয়দ আবদুল হাফিজ, সৈয়দ সাহেবে আলম এবং খাজা নুরুদ্দিন। জনাব ফজলুল হক তাঁর নিজ হাতে গড়া চাখার-পিরােজপুর আসনে দাঁড়াতে পারতেন। তা না করে তিনি মুসলিম লীগের জবরদস্ত জমিদার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে নিজ নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করেন। সেদিন সারা বাংলার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল পটুয়াখালীর উপর। একদিকে সামন্ত-বুর্জোয়া-আমলা সমর্থিত প্রার্থী খাজা নাজিমউদ্দিন। অপরদিকে ডালভাতের প্রতিশ্রুতি এবং জমিদার-মহাজনের হাত থেকে কৃষক ও খাতককে নিস্কৃতি দানের ওয়াদা দিয়ে ফজলুল হক মােকাবিলা করেন মুসলিম লীগের জমিদার প্রার্থীকে।
সাবধানী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তার সুনিশ্চিত দুটি নির্বাচনী এলাকা থেকে এবং উভয় এলাকায় তিনি জয়ী হন। নির্বাচনের পরে তিনি নিজের একটি আসন ত্যাগ করে উপনির্বাচনে উক্ত আসন থেকে খাজা নাজিমউদ্দিনকে জয়ী করে নিয়ে আসেন। সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ কিংবা প্রজা পার্টি উভয় দলই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। অতএব সরকার গঠনে উভয় দলের মধ্যে কোয়ালিশন গঠন ছিল অপরিহার্য। এ ব্যাপারে নেপথ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়। লীগ সভাপতি ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ বাহাদুর ছিলেন উদ্যোক্তাদের অন্যতম। তাঁর গৃহেই মুসলিম লীগ সংসদীয় দল ও কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে অনুষ্ঠিত ঐক্যসভায় নবাব হাবিবুল্লাহকে মন্ত্রিত্বের আসন দিয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদটি জনাব ফজলুল হকের জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়। এইভাবে একদিকে মুসলিম সংহতির প্রতিষ্ঠা, অপরদিকে অর্জিত হয় ফজলুল হকের বিরাট রাজনৈতিক বিজয়।
পৃষ্ঠাঃ ১৮

ইতিমধ্যে বেধে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধের পদধ্বনিতে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কারণ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনবলে ভারতের হিন্দুপ্রধান প্রদেশ মাদ্রাজ উড়িষ্যা বিহার উত্তর প্রদেশ মধ্য প্রদেশ মহারাষ্ট্রে গঠিত হয়েছিল কংগ্রেস সরকার। মুসলিম প্রধান উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুতে গঠিত হয় কংগ্রেস সরকার, পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট সরকার এবং একমাত্র বাংলায় প্রজা পার্টি-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার।
ব্রিটিশ সরকার যদি ১৯৩৫ সালে বুঝতে পারতাে যে ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে মহাযুদ্ধ শুরু হবে, তবে ভারতের স্বায়ত্তশাসন আইনটি আদৌ জারি হতাে কিনা এবং হলেও তা কার্যকরী করা হতাে কিনা এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ইতিমধ্যে অনেক ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সালে লীগের পক্ষ থেকে লাহাের প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমের মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রনিচয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। ইতিপূর্বে প্রথম প্রজা পার্টি কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভেঙে গেলে লীগ-প্রজা পার্টি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। মূলত তার ফলেই ফজলুল হকের দ্বারা পাকিস্তান প্রস্তাব হয় উত্থাপিত। আর সেই প্রস্তাবের মধ্যে রয়ে গেল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বীজ। তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে যুদ্ধের পক্ষে টেনে আনার জন্যে দিল্লিতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে ওয়ার ক্যাবিনেট গঠন করেন। উক্ত ওয়ার ক্যাবিনেটে জনাব ফজলুল হকও যােগদান করেন। ওয়ার ক্যাবিনেটে যােগদানের প্রশ্নে হক-জিন্না প্রবল মতবিরােধ দেখা দেয়। পরিণামে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন জনাব ফজলুল হক। মুসলিম লীগ রাজনীতিতে এই নিয়ে সৃষ্টি হলাে এক নতুন সঙ্কট, এক নতুন। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ওদিকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন, নেতাজী সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সহযােগিতায় ফ্যাসিবাদী জাপানের ভারত আক্রমণ সব মিলে এক জটিল পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে সারা বাংলাব্যাপী দেখা দিল সর্বগ্রাসী মন্বন্তর। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তখন স্যার নাজিমউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্বে সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী। দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধে ব্যর্থ হওয়ায় সকল দুর্নামের বােঝা চাপে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের স্কন্ধে। এই নিয়ে মুসলিম লীগ মহলে তুমূল অন্তর্দ্বন্দ্ব। বঙ্গীয় আইনসভায় তখন বিরােধী দলের নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তিনি দুর্ভিক্ষের জন্য সাধারণভাবে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের লীগ সরকার এবং বিশেষভাবে ‘খাদ্যমন্ত্রী’ সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণাত্মক প্রচারাভিযান পরিচালনা করেন। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে
পৃষ্ঠাঃ ১৯

কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে শুরু হয়েছে ত্রাণ কাজ, স্থাপিত হয়েছে লঙ্গরখানা, চলছে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ অভিযান। উভয় সংগঠনের দরদী কর্মীরা দলে দলে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছেন দুর্গত মানবতার সেবায়।
১৯৪৩ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে মন্ত্রী বা পার্লামেন্টারি কোন পদে অধিষ্ঠিত নেতারা মুসলিম লীগ পার্টি সংগঠনে কোন পদে বহাল থাকতে পারবেন না। বাংলায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি স্থির করলেন মন্ত্রিত্ব রাখবেন পার্টি সম্পাদকের পদ ছাড়বেন। এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সেদিন এইভাবে শূন্য হলাে।
এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে গ্রহণযােগ্য প্রার্থীরূপে খাজা পরিবার যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়, তাঁদের মধ্যে খাজা শাহাবুদ্দীন, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী মােহন মিয়া, আবদুল্লা আল মাহমুদ, ডাক্তার এস.এ. মালেক, আবুল কাশেম- এই নামগুলাে বহুল আলােচিত হয়। আত্মীয়তার জন্যে নয় বরং পান্ডিত্য ও সাংগঠনিক ক্ষমতার গুণেই শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁর পরিত্যক্ত পদে আবুল হাশিমের নামই চূড়ান্ত রূপে গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে সােহরাওয়ার্দীর এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করার জন্যে ঢাকার নবাব পরিবার একটি সিক্রেট লবী সৃষ্টি করেছিলেন বলে শােনা যায়। খাজা শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই লবীর নিকট কোন অবস্থাতেই সােহরাওয়ার্দী প্রস্তাবিত আবুল হাশিমের নাম গ্রহণযােগ্য ছিল না। তারা প্রচার করতেন জনাব হাশিম একজন কমিউনিস্ট অথবা কাদিয়ানী।
এরূপ পরস্পরবিরােধী রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পরিস্থিতিতে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ডাকা হলাে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। তারিখ ৬ ও ৭ই নভেম্বর, ১৯৪৩ সাল। খাজা নাজিমউদ্দিন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে বাংলার সদস্য। লীগ সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নার নমিনেশনে নিখিল ভারত লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়ে থাকে। শহীদ সােহরাওয়ার্দী কয়েকবার চেষ্টা তদ্বির করেছিলেন ঐ পদটি পাওয়ার জন্য; কিন্তু যে কোন কারণেই হােক পাননি। এক্ষেত্রে কলকাতার অবাঙালি সিদ্দিকী ইস্পাহানিরাও তাঁকে সমর্থন দেননি। তাঁদের সমর্থন ছিল খাজা নাজিমউদ্দিনের প্রতি। খাজা নাজিমউদ্দিন সেই সুবাদে হাশিম সাহেবকে ঠেকাবার জন্যে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কিন্তু দুর্ভিক্ষের কারণ দেখিয়ে নবাবজাদা বাংলার মুসলিম লীগ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিরাপদ মনে করলেন না। তিনি এই অজুহাত দেখালেন যে, মুসলিম লীগের জন্যে সময়টা খুবই নাজুক।
পৃষ্ঠাঃ ২০

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরে জনাব আবুল হাশিম দুই ধরনের কর্মসূচি কতিপয় আশু কর্মসূচি এবং কিছু চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘােষণা করেন। উভয় কর্মসূচি যুগপৎ চলে। তাঁর আশু কর্মসূচির মধ্যে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনি গড়ে তােলা। যাঁরা হবেন পার্টির ‘এ্যাকটিভিস্ট এবং প্রগতিশীল কর্মী ও ভাবী নেতা। তার চূড়ান্ত কর্মসূচির মধ্যে ছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তােলা, সংগঠনে নতুন রক্ত প্রবাহের সৃষ্টি করা, একটা সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন দপ্তর প্রতিষ্ঠা, সংগঠনের নিজস্ব একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র প্রকাশ এবং সংগঠনের একটি সম্মানজনক তহবিল গঠন।
প্রশিক্ষণের কথা শুনে মুসলিম লীগের সামন্ত বুর্জোয়া নেতৃত্ব প্রথমে চমকে ওঠেন। পরে তাঁদের চোখ লাল হয়। রুদ্ররােষে যেন ফেটে পড়বেন এরূপ অবস্থা। তারা বললেন : আমাদের কর্মীবাহিনি আছে, ছােরা-ড্যাগার চালাতে জানে, বুকে হিম্মৎ রাখে, দু-চার-দশ-বিশটা খুনে একটুও হেলে না। আবার ক্যাডার কেন? ক্যাডার-ফ্যাডার কমিউনিস্টরা বানায়, পরের ধন লুট করার জন্যে। কংগ্রেস বানায় ইংরেজ মারার জন্যে। আমাদের অমন কোন খারাবী করার এরাদা নাই।
যাদের মুখে এসব কথা উচ্চারিত হয় তাদেরকে আবুল হাশিম ও তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী নেতা ও কর্মীদের চিনতে ভুল হয়নি। আবুল হাশিম অটল, অনড়। তিনি বললেন : মুসলিম লীগ এ দেশের শুধু মুসলমানের প্রতিষ্ঠান নয়- সকল দুঃখী মানুষের প্রতিষ্ঠান। কোরানে দুঃখী ও নিপীড়িত মানুষকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে তাদের ক্ষুধার যন্ত্রণা আলাদাভাবে দেখায়নি, ক্ষুধার্তকে অন্ন দিতে বলেছে। এমনকি প্রতিবেশী খেয়েছে কিনা সে খবর নিয়ে তবে নিজেকে খাবার অনুমতি দিয়েছে। তদুপরি রয়েছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সামাজিক এবং প্রশাসনিক দিক সুষ্ঠু ও বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব। তার জন্য কর্মী চাই- চাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী বাহিনি- যার ইংরেজি নাম ক্যাডার। এই ক্যাডার তৈরি করাই এই মুহূর্তে সংগঠনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ঢাকার এক সামন্ত নেতা প্রশ্ন তুলেছিলেন : আপনার ক্যাডাররা যদি প্রশিক্ষণ লইয়া জেলায় জেলায় মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি হবার চায়, নেতা হবার চায়- তখন কি অইব? আমাদের সাথে আপনি বেশ ঝগড়া-ফ্যাসাদ বাধাবার ফিকিরে আছেন দেখতাছি।
পৃষ্ঠাঃ ২১

মুসলিম সামন্ত জমিদার ও বুর্জোয়াদের দ্বারা গঠিত মুসলিম লীগ এতােদিন তাদের স্বার্থে তাদের হাতেই লালিত হয়েছে। লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় মুসলিম আমলাদের একটি শক্তিশালী অংশ। এই তিন শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত প্রভাবশালী চক্র প্রথমে গােপনে, পরে প্রকাশ্যেই বিরােধিতা করে আবুল হাশিমের নতুন সাংগঠনিক কর্মসূচি-ক্যাডার সৃষ্টি ও তাদের প্রশিক্ষণ দান। কংগ্রেস ফরােয়ার্ড ব্লক ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের সঙ্গে মুসলিম লীগের যুব কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ কমিটি গঠন ও সেবাকার্য পরিচালনা তাদের মনঃপূত হয়নি। এ সম্পর্কে কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই চক্র এক পর্যায়ে সিভিল সাপ্লাই বিভাগের মন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তারা জানে না তিনি ইতিমধ্যেই নির্ভরযােগ্যসূত্রে খবর পেয়ে গেছেন যে বাংলার প্রতিটি জেলায় মুসলিম লীগের মধ্যে খাজাদের নেতৃত্ব অটুট রাখা ও হাশিম-সােহরাওয়ার্দী গ্রুপকে কোণঠাসা করার চক্রান্ত চলছে।
শহীদ সােহরাওয়ার্দী চিন্তাক্লিষ্ট। তার মাথায় ঘুরছে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ আন্দোলন। জেলায় জেলায় লঙ্গরখানা। মৃতদেহের সৎকার। মানবতার সেবা লীগ-কংগ্রেস-কমিউনিস্ট যৌথ উদ্যোগ। ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি! হক সাহেবের অভিযােগ- বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীই দায়ী! তার বিরুদ্ধে এরূপ গুজব ছড়াবার চেষ্টা করা হয় যে তিনি নাকি এক বিলেতি কোম্পানিতে মানুষের হাড়ি সরবরাহের অর্ডার পেয়েছেন! বিপুল অর্থের অর্ডার! এ ধরনের আজগুবি কথাও তখন বাজারে চালু। দরজায় খটখট আওয়াজ।
সােহরাওয়ার্দী সাহেব মাথা তুললেন। বিস্ময় নিয়ে দেখলেন তার সম্মুখে পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত তাঁরই প্রিয় কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান দাঁড়িয়ে। মুজিব বললেন : স্যার খবর আছে। ফরিদপুরে ইউসুফ আলী চৌধুরী মােহনমিয়া, ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়া এবং আবদুস সালাম খান গয়রহকে মাঠ ছাইড়া দেই নাই, ঠ্যাকাইয়া দেছি।
: থ্যাংক ইউ মুজিব। এই মুহূর্তে আমি তােমার মতাে একজনকেই মনে মনে খুঁজছিলাম। আবুল হাশিম বলছিল ফরিদপুরে তােমার খুব টাফ টাইম গেছে এবং তুমি জয়ী হয়েছে। ময়মনসিংহের খবর ভাল। নুরুল আমিনকে সভাপতি করে যে কমিটি গঠিত হয়েছে তাতে আমরা বিপুল মেজরিটি হয়েছি। চট্টগ্রামে ফজলুল কাদের চৌধুরী জয়ী হয়েছেন। খােদ ঢাকায় আহসন মঞ্জিল পরাভূত। মানিকগঞ্জের আওলাদ হােসেনকে সভাপতি ও মুন্সিগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমদকে সেক্রেটারি করে ঢাকায় জিলা মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছে খাজাদের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করে। কমিটিতে আছেন কামরুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দিন
পৃষ্ঠাঃ ২২

আহমদ, খান সাহেব ওসমান আলী, শওকত আলী, শামসুল হক, ইয়ার মােহাম্মদ খান, কাজী মােহাম্মদ বশীর, আলমাস আলী, আবদুল আউয়াল প্রমুখ। লাবু সিদ্দিকীরাও আমাদের সমর্থনে রয়েছে।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে জনাব আবুল হাশিম দেখেন যে, দলীয় কোন তহবিল, কোন দলিল দস্তাবেজ, কোনাে সাংগঠনিক তৎপরতার স্বাক্ষরবহনকারী সার্কুলার এমনকি দলীয় রশিদ বই পর্যন্ত নেই। অফিসটি দপ্তর সম্পাদক জানব ফরমুজল হক পাহারা দিয়ে চলেছেন। অফিসের মধ্যখানে হলরুম, চারপাশে সাত আটটা কক্ষ। তাতে আইনসভার কয়েকজন সদস্য বাসস্থানরূপে ব্যবহার করে আসছেন। কোথাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার নিশানা পর্যন্ত নেই। আর এই হলাে সরকারী দল বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিসের অবস্থা। যেন আজিয়ান আস্তাবল আর কি। নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যকে মাসিক পাঁচ টাকা হারে চাঁদা দিতে হতাে। দেখা গেল কেউ এক পয়সা চাঁদা দেননি। এমনকি খাজা নাজিমউদ্দিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ চাঁদার অর্থ বাকী ফেলে দিব্যি মুসলিম লীগের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। হাশিম সাহেব দলীয় চাঁদার অর্থ আদায়ের জন্য সার্কুলার দিতে থাকেন প্রত্যেক স্তরের সংগঠন, কমিটি ও নেতৃবৃন্দকে।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কোনাে সদস্য আছেন কিনা, থাকলে কতােজন আছেন তার কোনাে হিসাব পত্র ছিল না। রশিদ বইয়ের মুড়ি পর্যন্তও গায়েব। কাজেই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পরে যে কাজগুলােতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে হাত দেন তার মধ্যে প্রধান কাজ ছিল সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি। কর্মী সৃষ্টি এবং তাঁদেরকে ‘থিওরি এ্যান্ড প্র্যাকটিস’-এর ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দান। পাশাপাশি গঠন করেন মুসলিম লীগ দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কমিটি। গুরুত্বপূর্ণ জরুরী এই ত্রাণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে যাকে নিয়ােগ করা হয় তিনি হলেন ফরিদপুরের মােহনমিয়ার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মােয়াজ্জেম হােসেন চৌধুরী লাল মিয়া। জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী মােহন মিয়া মুসলিম লীগে হাশিম-সােহরাওয়ার্দী গ্রুপের ঘাের বিরােধী। কিন্তু লালমিয়াকে ত্রাণ কমিটির সম্পাদক নিয়ােগের পশ্চাতে যতটুকু রাজনীতি ছিল তা হলাে উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে উপযুক্ত কাজের দায়িত্ব অর্পণ। কোন পারিবারিক দ্বন্দ্ব কিংবা ভাইয়ে ভাইয়ে ভুল বােঝাবুঝির রাজনীতি এটা ছিল না। দুস্থ মানুষের সেবার জন্য সংগ্রহ করা প্রয়ােজন ছিল বিপুল অর্থ, খাদ্য সামগ্রী, তবু ও বস্ত্রসম্ভার প্রভৃতি।
এ কাজে লালমিয়ার আগ্রহ ও যােগ্যতা দুটোই প্রশ্নাতীত। তদানীন্তন বাংলায় বিশেষ করে কলকাতায় সকল মহলে তার গতিবিধি অবাধ, পরিচিতিও
পৃষ্ঠাঃ ২৩

ব্যাপক। তিনি লীগ কংগ্রেস কমিউনিস্ট সবার কাছে গ্রহণযােগ্য, সবার লালভাই, সবার লালদা, সবার আস্থাভাজন। অতি অল্প দিনের মধ্যেই তিনি তার যােগ্যতার প্রমাণ দিলেন বিপুল অর্থসামগ্রী সংগ্রহ করে। জনাব আবুল হাশিম ত্রাণকার্যের পাশাপাশি ক্যাডার প্রশিক্ষণের তৎপরতায় আত্মনিবেশ করলেন। ক্যাডারদের উদ্দেশ্যে তিনি কতিপয় মূলনীতি আলােচনা প্রসঙ্গে বললেন : থিওরি এ্যান্ড প্র্যাকটিস কর্মী নির্মাণের মূল হাতিয়ার। মুসলিম লীগ নামে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। কিন্তু উন্নত মানসিকতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক নিষ্ঠা সৃষ্টি করা গেলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রয়ােগিক পর্যায়ে দেখা যাবে যে মানুষে মানুষে কোনাে ভেদাভেদ নেই। সব মানুষ সমান। সবাই মিত্র। সবাই ভাই-বন্ধু। সাম্প্রদায়িক বিভেদ শাসক-শােষকদের শ্রেণিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য সৃষ্ট। ক্ষেত্রবিশেষে তারা। সফলকামও হয়েছে। ক্যাডারদের সামনে তিনি চারটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পেশ করলেন। এক, নিজেদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করুন। দুই. সমাজে মিত্র অন্বেষণ করুন। তিন. যাদেরকে মিত্র হিসেবে পাবেন না তাদেরকে নিউট্রালাইজ করুন, দলনিরপেক্ষ করুন। চার. এভাবে শত্রুপক্ষকে হীনবল করে সরাসরি তাদেরকে পরাজিত করুন।
হাশিম সাহেব বলেন, বিদ্বেষের উপর প্রতিষ্ঠিত যে কোনাে আন্দোলনে তাৎক্ষণিক উপকারিতা লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু তা জনগণের কল্যাণের জন্য স্থায়ী সুফল বয়ে আনে না। আমি মুসলিম লীগ কর্মীদেরকে ভালবাসার যােগ্য করে তুলতে চাই। সে ব্যাপারে ধর্ম এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য নির্বিশেষে তাদেরকে সকলের জন্য সমাজসেবার কাজে নিয়ােজিত থাকার উপদেশ দিতাম, আহ্বান জানাতাম।
ক্যাডার প্রশিক্ষণের পদ্ধতি ছিল ঘরােয়া পরিবেশে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আন্তরিকভাবে আলাপ আলােচনা করা। তার মধ্যে দিয়েই অতি সহজে অনেক কঠিন তত্ত্ব আলােচিত হতাে। নােট বই সঙ্গে রাখার কথা ছিল, কিন্তু সব ক্যাডার তা বহন করতেন না। এই আলােচনায় প্রায়শ অংশ নিতেন হাশিম সাহেব নিজে। আর নিতেন মওলানা আজাদ সােবহানী, কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন উর্ধ্বতন নেতা। ক্যাডার তালিকায় ছিলেন পিরােজপুরের নূরউদ্দিন আহমদ, বাগেরহাটের একরামুল হক, ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, রাজশাহীর আতাউর রহমান, মােজাম্মেল হক ও মােহাম্মদ মাহবুব উল হক, খুলনার শেখ আবদুল আজিজ, বর্ধমানের নুরুল আলম ও শরফুদ্দিন, যশােরের আবদুল হাই ও মােশাররফ খান, পাবনার খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, বরিশালের সালেহ আহমেদ ও আবদুর রহমান,
পৃষ্ঠাঃ ২৪

বগুড়ার বি.এম. ইলিয়াস ও শাহ আবদুল বারি, রংপুরের আবুল হােসেন, নদীয়ার ফকির মােহাম্মদ ও মােহাম্মদ সােলায়মান, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সহসভাপতি শাহাবুদ্দিন এবং কলকাতার জহীরউদ্দীন। ঢাকার কামরুদ্দিন আহমদ, কাজী মােহাম্মদ বশীর, ইয়ার মােহাম্মদ খান, শামসুদ্দিন আহমেদ, মােহাম্মদ শওকত আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, কুমিল্লার খােন্দকার মােশতাক আহমদ, নােয়াখালীর মােহাম্মদ তােয়াহা ও নজমুল করিম প্রমুখ। ঢাকা-ময়মনসিংহ-কুমিল্লা-নােয়াখালীর ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ হতাে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ কেন্দ্রে। মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতার ওয়েলেসলি ফার্স্ট লেনে।
দেশের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয়ে সম্যক জ্ঞান, দলের গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অনুধাবন ও তার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা সৃষ্টি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে গভীরভাবে সজাগ ও সচেতন কর্মীরাই অধুনা বিশ্বের কোনাে দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দলের কর্মী বা নেতা হবার যােগ্য। এর অন্যথা ঘটলে শুধু যে দলীয় বিকাশ ও অগ্রগতি ব্যাহত হয় তাই নয়, দেখা গেছে দল ক্ষমতায় এসেও তা ধরে রাখতে পারে না, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও চর্চার অভাবে। দলের জন্যে চাই দলীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্যসমৃদ্ধ কর্মীবাহিনি। কাজেই দলীয় প্রশিক্ষণের কোনাে বিকল্প নেই। তার গুরুত্ব অপরিসীম, প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য, অপরিহার্য।
শেখ মুজিবুর রহমান হাশিম সাহেবের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে গভীর আগ্রহী ও মনােযােগী ছিলেন। তেমনি ছিল তার নিষ্ঠা। কিন্তু তাঁর কাজের বিস্তৃতি ছিল এতাে ব্যাপক যে কখনাে কখনাে সময় মতাে ক্যাডার প্রশিক্ষণ ক্লাসে যােগ দিতে পারতেন না। মাঝে মাঝেই অনিয়মিত হতেন কিংবা অনুপস্থিত থাকতেন। কখনাে সংগঠনের কাজ, কখনাে ছাত্র রাজনীতির দলাদলির মীমাংসা, কখনাে কখনাে মফস্বল থেকে আগত কোনাে কর্মীর ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান তাে ছিলই। তদুপরি ছিল সােহরাওয়ার্দী সাহেবের নিজস্ব কিছু কিছু রাজনৈতিক কাজ, আর কিছু ব্যক্তিগত ফরমায়েশ। সব ব্যাপারে মুজিব, কনিষ্ঠদের মুজিব ভাই। প্রশিক্ষণ ক্লাস চলতাে সাধারণত রাতেরবেলায় খাবার পরে। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত কাজের চাপে পরিশ্রান্ত মুজিব মনােযােগের সঙ্গে আলােচনা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। তখন তাকে আমরা পাঠিয়ে দিতাম বিশ্রামের জন্যে। পরদিন আলােচিত বিষয়গুলাে একে একে তাকে বুঝিয়ে বলা হতাে। তিনি নিবিষ্ট মনে শুনতেন এবং একবার যা শুনতেন তা আর ভুলতেন না। অসাধারণ ছিল তার মেধা, অনন্যসাধারণ তাঁর স্মরণশক্তি, অত্যাশ্চর্য তাঁর ধীশক্তি।

রেফারেন্স – প্রসঙ্গ শেখ মুজিব, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!