You dont have javascript enabled! Please enable it!

সমাজতান্ত্রিক বাংলার আন্দোলন ও শেখ মুজিব

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শ্ৰী শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৭ সালের ২৩শে মে তারিখে কলকাতায় এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন : ‘বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হলে সেটি একটি সাধারণতন্ত্র হবে। সেই সাধারণতন্ত্রের প্রকৃত চরিত্র এবং বিশেষত্ব হবে সমাজতান্ত্রিক। বাংলায় যদি কখনাে নিজস্ব সংবিধান। বিধায়ক পরিষদ গঠিত হয় তবে তখন সেখানেই স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা সাধারণতন্ত্রের বিস্তারিত রূপরেখা স্থির করা হবে। গত পাঁচ মাস ধরে আমি যাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেছি তাঁদের সঙ্গে মূল প্রশ্নগুলােতে আমার কোনাে মতপার্থক্য হয়নি। আমি বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যত্র সকলকে বােঝাতে চাই যে, সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা নিরসন করা যায় না। একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বলিষ্ঠতর দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমস্যাটির মােকাবিলা করতে হবে। উপরােক্ত সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের জরুরী প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় এ কারণে যে তার আগের দিন ২২শে তারিখের পত্রপত্রিকায় এই মর্মে একটি খবর বের হয় যে, বাংলার ভবিষ্যৎ, তার স্বাধীন রাষ্ট্রীয় রূপরেখা, শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে ও নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী নিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কোনাে কোনাে প্রখ্যাত নেতার মধ্যে ফলপ্রসু আলােচনা শেষে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সংবাদ পরিবেশক এসােসিয়েটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া, তখনকার দিনে রয়টারের ভারতীয় প্রতিনিধি। সংবাদদাতা খবরটি বিশ্বস্ত সূত্রে সংগ্রহ করেছেন বলে দাবি করেছেন। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কংগ্রেস নেতা শ্ৰী শরৎচন্দ্র বসু, মুসলিম লীগ নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মধ্যে কয়েক দফা গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সােহরাওয়ার্দী তখন যুক্ত বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী। তাঁদের আলােচ্য বিষয় ছিল ভারত বিভাগের মুখে বাংলাকে অবিভক্ত রাখার প্রয়াস এবং স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলায় সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপায় উদ্ভাবন। কাজেই ‘বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদটি যে আনুমানিকভিত্তিক নয়, তার পশ্চাতে যে সত্যতার ভিত্তি রয়েছে সে সম্পর্কে সজাগ শরৎ বসু গুজব সৃষ্টির সুযােগ না দিয়ে প্রকৃত তথ্য নিয়ে দেশবাসীর।
পৃষ্ঠাঃ ২৬

সম্মুখে সংবাদপত্র মারফত হাজির হলেন। কাজেই তার এই সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের আয়ােজন।
এখানে ইতিহাসের পাতা উলটিয়ে কিছুটা পিছনে যেতে হয়।
১৯৪৩ সালের ৭ই নভেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে বর্ধমানের জাতীয়তাবাদী নেতা জনাব আবুল কাশেমের পুত্র আবুল হাশিম সাধারণ সম্পাদক এবং মওলানা আকরম খাঁ সভাপতি নির্বাচিত হন। সমাজ সংস্কাররূপে মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। দীর্ঘদিন কংগ্রেস ও খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তিনি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় গােড়ামিমুক্ত ছিলেন। সুসাহিত্যিক ও খ্যাতিমান সাংবাদিকরূপেও তাঁর যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী, আদর্শবাদী নন। পক্ষান্তরে আবুল হাশিম বামপন্থী চিন্তাধারায় অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন বলে তাঁর কথাবার্তায় ও ধ্যানধারণায় গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চেতনার স্বাক্ষর ছিল সুস্পষ্ট। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হবার পর তিনি দেশবাসীর সম্মুখে কতিপয় গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল কর্মসূচি দিয়ে জেলায় জেলায় কর্মীদের সাথে ব্যক্তিগত যােগাযােগ স্থাপন শুরু করেন। সমগ্র বাংলার মুসলমান তরুণেরা অল্পদিনের মধ্যে তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দলে দলে তার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকেন। এতাে দ্রুত তার পেছনে এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র যুবকের সমাবেশে তিনি বিমুগ্ধ হলেন বটে, কিন্তু তাঁদের কাজ দিবেন কি? সময়টা ছিল বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগময়। একদিকে সর্বগ্রাসী বিশ্বযুদ্ধজনিত অনিশ্চয়তা, অপরদিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর দরুণ সারা বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এরূপ অবস্থায় যে কোনাে দেশপ্রেমিকের প্রধানতম রাজনৈতিক কর্তব্য দুস্থ মানুষের পাশে দাড়ানাে ও তাদের উপযুক্ত সেবা করা। উল্লেখ থাকে যে, কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা ও অস্থায়ী হাসপাতাল চালু করে বাংলার দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের সেবায় আত্মনিয়ােগ করেছেন। আবুল হাশিম কালবিলম্ব না করে সমগ্র বাংলার কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে দুঃস্থ মানবতার পাশে দাঁড়াতে। প্রধানত তারই উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ কমিউনিস্ট ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যৌথভাবে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিরােধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন বাংলায় খাজা নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের একটি বড় দল
পৃষ্ঠাঃ ২৭

হাশিম-সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশে দুর্ভিক্ষ মহামারী প্রতিরােধ আন্দোলনে কাজ করতে যান। ফলে সেবাকাজের মধ্য দিয়ে তারা কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। এইভাবে মুসলিম ছাত্র ও তরুণদের বিরাট একটি অংশ ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতাবাদ সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও ধনবাদবিরােধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন।
মুসলিম লীগ শ্রেণিগতভাবে ছিল একটি সামন্ত-আমলা-বুর্জোয়া-সংগঠন। ধনিক-বণিক ও জোতদার-জমিদার-মহাজনরা তার মাথায়, তার নেতৃত্বে। আর শ্রেণি স্বার্থের তাগিদেই তারা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের তকমা আঁটা সেবাদাস মাত্র। আবুল হাশিম ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে লীগ সংগঠনে তারুণ্যের অপ্রতিরােধ্য প্রবাহের সৃষ্টি হয়। অভ্যুদয় ঘটে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত এক দুর্জয় কর্মী বাহিনির। শ্রেণি চেতনায় সমৃদ্ধ ছাত্র-যুবকদের এই অংশ হয়ে উঠে শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া মেহনতী শ্রেণির সংগ্রামী সাথী ও অকৃত্রিম বন্ধু।
একদিকে হাশিম-সােহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ উৎসাহ অপরদিকে মুসলিম ছাত্রতরুণদের মধ্যেকার প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ ধীরে ধীরে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ এবং নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ এই দুইটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের মধ্যে একটি বামপন্থী চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটায়। এবং সমগ্র বাংলার মুসলিম সমাজে জন্ম নেয় একটি প্রগতিশীল গ্রুপ। আবুল হাশিম এই গ্রুপের জন্যেও ৩ ওয়েলেসলি ফার্স্টলেনে প্রশিক্ষণের আয়ােজন করেন। তাতে যােগ দিয়েছিলেন তরুণ সাংবাদিক ও ছাত্রনেতা প্রেসিডেন্সি কলেজের জাহুরুল হক, ইসলামিয়া কলেজের খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, প্রেসিডেন্সি কলেজের কাজী আনােয়ারুল ইসলাম, সাংবাদিক কাজী মােহাম্মদ ইদরিস, গােলাম কুদুস প্রমুখ। এঁরাই ছিলেন লীগের সংবাদ মুখপত্র সাপ্তাহিক মিল্লাতের সাংবাদিক। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর বাংলার হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরে শহীদ সােহরাওয়ার্দী আন্দামানসহ দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে রাজবন্দিদের মুক্তির নির্দেশ দান করেন। তিনি স্বয়ং আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে যেয়ে রাজবন্দিদের ফুলের মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। এইসব রাজবন্দির অধিকাংশ ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রথমে আবুল হাশিম ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী কমিউনিস্ট নেতা বঙ্কিম মুখার্জী ও সােমনাথ লাহিড়ী প্রমুখের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন বলে জানা যায়। আরাে পরে কংগ্রেস নেতা শ্ৰী শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণ শঙ্কর রায়ও কমিউনিসট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হয়ে যুক্ত বাংলার রূপরেখার প্রশ্নে আলােচনা
পৃষ্ঠাঃ ২৮

করেন। কখনাে দ্বিপক্ষীয়, কখনােবা ত্রিপক্ষীয় এসব বৈঠকে গ্রেটার বেঙ্গল প্রসঙ্গটি আলােচনায় প্রাধান্য পায়। কারণ সীমান্ত সংলগ্ন বিহার উড়িষ্যা ও আসামের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করলে যে বিশাল একটি অঞ্চল বিপুল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্ভাবনা। নিয়ে মানসপটে ভাস্বর হয়ে ওঠে তারই নাম গ্রেটার বেঙ্গল বা বৃহত্তর বাংলাকেউবা বলেছেন অখণ্ড বাংলা। তার উত্তর সীমানায় হিমালয় পর্বত ও তার লােকালয় দার্জিলিং, যার হৃদয়ের বাকেবাকে সুগন্ধি চা আর বিশ্বের অতুলনীয় কমলালেবু। দক্ষিণে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের রােমাঞ্চকর আবাসস্থল সুন্দরবন, বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় সমুদ্রতট আর ততােধিক সম্ভাবনাময় জলপথ ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর। পূর্বে চা ও কমলালেবুর সমাবেশ, ধাতব ও খনিজ পদার্থের মজুদ, সুবাসিত চন্দনকাঠ আর তেজপাতার হাতছানি, কাঠ-বাঁশ-বেতের সমাহার। পশ্চিম সীমানায় পাথুরে কয়লা। এছাড়া গ্রেটার বেঙ্গলে সর্বত্র রয়েছে অফুরন্ত মৎস্য সম্পদ, অযুত বনজসম্পদ অপরিমিত খনিজ সম্পদ। আধুনিক শিল্প বিজ্ঞানে কয়লা, তেল, গ্যাস প্রভৃতি জ্বালানী সম্পদ স্বাধীন ও জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের প্রাণশক্তি, রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি। সে অমূল্য সম্পদ গ্রেটার বেঙ্গলের ছিল অঢেল। সিমেন্ট, জলবিদ্যুৎ ও গ্যাস কমপ্লেক্স বিকাশের সুযােগ ছিল অবারিত। কাজেই বিশেষজ্ঞরা যথার্থ দাবি করেছিলেন যে, স্বল্পকালের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা সাধারণতন্ত্র বিশ্বের একটি অনন্যসাধারণ সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হতে পারতাে।
দৃশ্যত কাঠখােট্টা মনে হলেও রাজনীতিতে মুজিব ছিলেন আমাদের মধ্যে অসাধারণ রােমান্টিক। তিনি মাঝে মাঝেই গ্রেটার বেঙ্গলের স্বপ্নে হতেন বিভাের। বলতেন : এ বাংলায় কী না আছে?
বাংলা কবির দেশ কবিতার দেশ।
বাংলা বিপ্লবীর দেশ বিপ্লবের দেশ।
বাংলা ভাবুকের দেশ ভাবনার দেশ।
বাংলা শিল্পীর দেশ শিল্পের দেশ।
বাংলা সােনার দেশ রূপার দেশ।
বাংলা ঐতিহ্যের দেশ ইতিহাসের দেশ।
কাজেই গ্রেটার বেঙ্গল বা সমাজতান্ত্রিক বাংলা সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষভাবে সাড়া জাগায়। এ সম্পর্কিত ছিটেফোঁটা খবরও যেন ছিল আশার আলােকবির্তকা।
পৃষ্ঠাঃ ২৯

তারই সূত্র ধরে আমাদের মানসনেত্র কল্পনার দিগন্ত প্রসারিত করবার সাধু প্রয়াস অহরহ। আর শেখ মুজিব তখন অনেকেরই সংবাদের উৎস। কারণ তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নিকটতম ও ঘনিষ্ঠ। আমি সাংবাদিক। কাজেই খবর আমার কাছেও থাকতাে। শেখ মুজিবও তাই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতেন।
লীগ-কংগ্রেস, লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস-কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে অনুষ্ঠিত আলােচনার সূত্র ধরে কলকাতার রাজনৈতিক মহলে নানারূপ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে একটি প্রধান গুজব হলাে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কোনাে কোনাে পত্রিকা এই গুজবের সমর্থনে স্কুপ সংবাদও প্রকাশ করে। আরেকটি গুজব ছিল বসু-সােহরাওয়ার্দী ফর্মুলার ভিত্তিতে গােপন চুক্তি সম্পর্কিত। এই চুক্তির সত্যতা সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিক শ্ৰী শরৎ বসুর মতামত জানতে চান। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন : ভারত এবং তার অন্তর্গত প্রদেশগুলাের ভবিষ্যত শাসতন্ত্র কী হবে সে সম্বন্ধে আমি গত কয়েক বছর ধরে যথেষ্ট চিন্তা করেছি। ১৯৪৪ সালের ২৯শে জানুয়ারি জেলে বসে আমি আমার ধারণাগুলােকে যেভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলাম তা হলাে ভারতবর্ষ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের ইউনিয়ন হিসেবে গড়ে উঠবে এক প্রকার মিলনভূমিরূপে। এর অন্তর্গত সকল জাতি ও উপজাতির বৈশিষ্ট্যগুলাে তার মধ্যে এমনভাবে মিশে যাবে যার ভিতর দিয়ে জন্ম নেবে এক নতুন বিশ্ব। এবং যার মধ্যে জাতি, শ্রেণি অথবা ভৌগােলিক সীমানার কোনাে আড়াল। থাকবে না, সব ঐক্যবদ্ধরূপে একক সত্তায় আবির্ভূত হবে। শ্রী শরৎ বসু আরাে বলেন : গত ২৬শে জানুয়ারি ১৯৪৭ সাল বেলগাছিয়া ভিলায় আহূত এক অভ্যর্থনাসভায় আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারবৃন্দ ও অন্যদের কাছে এক ভাষণে আমি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একথা বলেছি যে, স্বায়ত্তশাসিত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রসমূহের একটি ইউনিয়ন হিসেবে ভারত গড়ে উঠুক আমি বরাবরই এই মত পােষণ করে এসেছি। আমার বিশ্বাস প্রদেশগুলােকে যদি ভাষার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যস্ত করে স্বয়শাসিত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রে পরিণত করা হয়, সেই সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রগুলাে সানন্দে পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে একটি বিশাল সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের ভারতীয় ইউনিয়ন গড়ে তুলবে।
তখন থেকে বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে আমার ধারণাগুলাে নিয়ে যে আলােচনা হয় তার থেকে কিছু বাস্তব প্রস্তাবের উদ্ভব
পৃষ্ঠাঃ ৩০

হয়েছে। আমরা আস্থার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছি। সফলতা সম্পর্কে আমরা আশাবাদী। শ্ৰী শরৎ বসু আশা প্রকাশ করেন যে, কংগ্রেস হাই কমান্ড যদি তার পরিকল্পনা মেনে নেন, তাহলে কার্যত তার পরিকল্পনারই অনুরূপ সােহরাওয়ার্দী পরিকল্পনা স্বীকার করে নিতে লীগ হাই কমান্ডকে রাজি করানাে সহজ হবে। শ্রী বসু বলেন, আমার পরিকল্পনায় আমার আস্থা আছে এবং শেষ পর্যন্ত আমি এতে অনড় থাকবাে। আমি অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করবাে এবং বাংলা বিভাগ প্রতিরােধ করার জন্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে দেখবাে। স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিয়ে মহাত্মা গান্ধী ও মােহাম্মদ আলী জিন্নার সঙ্গে শ্ৰী শরৎ বসু ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পত্রালাপ হয়। এক পর্যায়ে সােহরাওয়ার্দী যান জিন্নাহর সঙ্গে আলাপ করতে আর শরৎ বসু যান গান্ধীজীর কাছে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে নাকি বলেছিলেন যে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবের প্রতি তার সম্মতি আছে। তবে সে কথা জানতে পারলে কংগ্রেস হাইকমান্ড বেঁকে বসবেন এবং সরাসরি তাঁরা এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করবেন। কাজেই আগে মিস্টার গান্ধী উক্ত প্রস্তাব সমর্থন করুন, পরে তিনি তার সম্মতির কথা ঘােষণা করবেন। কিন্তু কংগ্রেস হাই কমান্ড শরৎচন্দ্র বসুর স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বলে গান্ধী-বসু আলােচনা আর অগ্রসর হয়নি, কোন সুফলও বয়ে আনতে পারেনি। এর দিন কয়েক পরে গান্ধীজী তার একটি প্রার্থনাসভার ভাষণে বলেন যে, শরৎ বাবুর প্রস্তাব সমর্থন করায় কংগ্রেস হাই কমান্ডের নিকট তাকে তিরস্কৃত হতে হয়েছে। এ ঘটনা ১৯৪৭ সালের জুন মাসের।
আমি তখন যুক্ত বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রতিষ্ঠিত ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকার যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। আমার সঙ্গে অপর বার্তা সম্পাদক ছিলেন ‘লালকোর্তা’ নামে খ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। জনাব আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেহাদের প্রধান সম্পাদক। হাশিম-সােহরাওয়ার্দী গ্রুপ পরিচালিত মুসলিম লীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকাও আমাদের করায়ত্ত। কাজী মােহাম্মদ ইদরিস, জাহুরুল হক, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী নজরুল ইসলামের চাচাতাে ভাই কাজী আনােয়ারুল ইসলাম মিলে খেটেখুটে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করেন। কাজী মােহাম্মদ ইদরিস তার সম্পাদক, কিন্তু স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলার সমর্থক বলে আমাদের বিরুদ্ধে মওলানা আকরম খাঁ পরিচালিত আজাদের ছিল তীব্র আক্রোশ। তার সমালােচনার জবাব আমরাও দেই।
পৃষ্ঠাঃ ৩১

গ্রেটার বেঙ্গল কিংবা সভরেন বেঙ্গল কিংবা অখন্ড বাংলা কিংবা স্বাধীন বাংলা। কিংবা সমাজতান্ত্রিক বাংলা- শিরােনাম যাই-ই হােক, ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এই পরিকল্পনার ছিলেন ঘাের বিরােধী। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় ছিল সরদার প্যাটেল ও পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর বৈরী মনােভাব। বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখন ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, মওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাজিমউদ্দিন ও এম.এ.এইচ. ইস্পাহানি প্রমুখ পরিচালিত প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরােধিতার কথা অল্পবিস্তর সবাই জানেন। অপরপক্ষে শরৎ বসু, সােহরাওয়ার্দী, হাশিম ও বঙ্কিম মুখার্জী পরিচালিত প্রগতিশীলদের স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন। তাঁদের আবেদন ভারত ভাগ হলেও বাংলাকে ভাগ করা চলবে না। অখণ্ড বাংলার রাষ্ট্রীয় কাঠামাে। সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের জন্য সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রগতি অনিবার্য ছিল। কিন্তু সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতাদের কূটকৌশল কর্মীদেরকে নিরাশ করে। তারই সুযােগে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবৃন্দ গােপনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে এরূপ একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে তােলেন যে শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক যুক্ত বাংলার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষ থেকে প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে হুমকি ও শক্তি প্রদর্শনের মহড়াও শুরু হয়।
এমনিভাবে সেদিন প্রতিক্রিয়ার যুপকাষ্ঠে প্রগতির হলাে বলি। অপরিসীম সম্ভাবনাময় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের স্থলে এলাে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা বাংলার একাংশ হিন্দুস্থান অপরাংশ পাকিস্তান। রবীন্দ্র-নজরুল হলেন দ্বিখন্ডিত। বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার শৌর্য-বীর্য-ইতিহাস-ঐতিহ্য হলাে দ্বিখন্ডিত। খন্ডিত হলাে সহস্র সহস্র বৎসরের বাংলার শােণিত ধারা। আর সেই খন্ডিত শােণিত ধারায় অবগাহন করে রক্তাক্ত খগড়হস্তে ইতিহাসের। আঙ্গিনায় খুনীরূপে দাঁড়িয়ে রইলাে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তিন প্রতিভূ-প্রতিক্রয়াশীল কংগ্রেস, প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ, প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু মহাসভা। শেখ মুজিবের জীবনদর্শন ও অভিধানে সাহসিকতা দুঃসাহস প্রেম-প্রীতিভালবাসা রাগ-বিরাগ-অনুরাগে বাৎসল্য-অনুভূতি-সহানুভূতি প্রভৃতি অসংখ্য শব্দের ভিড় চোখে পড়ে। শুধু চোখে পড়ে না একটি শব্দ- নৈরাশ্য। আশ্চর্যের বিষয় সেদিনও তিনি নিরাশ হলেন না। বাংলা খন্ডিত হবার কিছুদিন পর তিনি আমাদেরকে ডাকলেন কলকতার এক সভায়। স্থান সিরাজউদ্দৌলা হােস্টেল,
পৃষ্ঠাঃ ৩২

পার্ক রােড। সভায় যােগদান করেন কাজী মােহাম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লা কায়সার, কে.জি. মুস্তাফা, মােয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, নূরুল আলম, শরফুদ্দিন আহমদ, আখলাকুর রহমান প্রমুখ সাংবাদিক ও যুব মুসলিম লীগ কর্মী। তাদের কেউ কেউ ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সভার আলােচনায়ও অংশ নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের কথাগুলাে আজও বিশেষভাবে যেন কানে বাজে… শােষকদের হাতে আমরা পরাজিত হয়েছি। কিন্তু এ পরাজয় সাময়িক। চলুন পাকিস্তানে যাই, শােষিত-নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করি। পূর্ব বাংলায় কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষকে সংগঠিত করতে হবে। শােষকদেরকে পরাজিত করতে শােষিত জনগােষ্ঠী নিজেরাই যথেষ্ট। তারাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে নিজেদের সরকার, নিজেদের গণতন্ত্র, নিজেদের সমাজব্যবস্থা- শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সেদিন আমার দুঃখী মানুষের মুখে ফুটবে হাসি। সােনার বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হবে শােষিতের গণতন্ত্র, শােষিত-নিপীড়িত জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার। এই তাে আমরা চাই। এই তাে আমাদের স্বপ্ন।

রেফারেন্স – প্রসঙ্গ শেখ মুজিব, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!