You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.09 | সাম্রাজ্যবাদের ভাঁড় | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সাম্রাজ্যবাদের ভাঁড়

মার্কিন-চীনা দ্বৈত নৃত্য কেবল পিং পং খেলার মধ্যেই শেষ হয়নি, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও তা দস্তুরমতাে জমে উঠেছে। চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সদস্য সেজে যে ভাড়ামি করেছেন তা আমাদের দেশের গােপাল ভাঁড়কেও হার মানিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘে মহাচীন সবে আসন পেয়েছে। অনেকেই আশা করেছিল একটু রয়েসয়ে সে তার স্বরূপ প্রকাশ করবে। কিন্তু মহাবিপ্লবীদের তর সইল না। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতকে এতাে কাছে পেয়ে সে কি এক হাত না নিয়ে পারে! তাই একেবারে বেসামাল হয়ে নির্লজ্জের মতাে সাম্রাজ্যবাদীদের পাছা দোহার সেজে উলঙ্গ নৃত্য।
বাংলাদেশের সমস্ত ঘটনার জন্যই নাকি সােভিয়েত ইউনিয়ন আর ভারত দায়ী! শরণার্থী সমস্যাটাও নাকি ভারতের সৃষ্টি। চীনা প্রতিনিধির মস্তিষ্ক উর্বর বলতে হবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দালালি করতে গিয়ে দিনকে রাত বলতেও তার মুখে আটকায়নি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকেই কি সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত জাদুমন্ত্রে ভুলিয়ে রেখেছিল যে, তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্যই এ দু’দেশের প্ররােচনায় চোখ-কান বুজে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বসিয়েছিল? অবশ্য জনগণের রায় বিশ্বভ্রাতার ভেকধারী চীনা নায়কদের কাছে কিছুই নয়। কারণ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্বজা তুলে তারা মাও-নীতির বিরােধী বহু গণসংগঠনকেই ভেঙে দিয়েছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ভিটেয় ঘুঘু চরিয়েছিলেন। সামরিক কর্তৃপক্ষকে তারা এমনভাবে মাথায় চড়ান যেটা এখন আরব দৈত্যর মতাে চীনের গােটা শাসনযন্ত্রটাকেই গ্রাস করতে চাইছে। স্বদেশে গণতন্ত্রের আদ্যশ্রাদ্ধ করে বিদেশে তারা স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্রকে মূল্য দিতে পারেন না। চীনা নেতারা সামরিক বলে দেশের গণশক্তিকে হত্যা করেছেন বলেই ইসলামাবাদের সামরিক চক্রের জল্লাদপনা ও মার্কিন জঙ্গিবাদ তাঁদের সমর্থন পায় আর বাংলাদেশের গণরায় তুচ্ছ হয়ে যায়।
সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যুগল-নৃত্যে নেমে চীনা প্রতিনিধি যখন নিরাপত্তা পরিষদে সােভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ আখ্যায় ভূষিত করেন তখন একমাত্র কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষই না হেসে থাকতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদীদের ভূমিকা আর একবার ভারত ও বিশ্বের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। মূল সমস্যা এড়িয়ে ঘাতক পাকিস্তান আর মানবতার রক্ষক ভারতকে একই বন্ধনীর মধ্যে ফেলে শান্তির ললিতবাণী শােনানাে যে পাক জঙ্গিশাহীকে টিকিয়ে রাখার সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি এটা কে না ববাঝে? তা না বােঝার মতাে অবােধ বালক চীনও নয়। বােঝে বলেই সে আজ সাম্রাজ্যবাদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে এই আশায় যে, সাম্রাজ্যবাদীদের স্তাবকতা করে সেও নানান দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হবে। সুপার পাওয়ার হবার উদগ্র লালসাই চীনকে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে ঠেলে দিয়েছে আর তাকে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী শিবিরের শত্রু করে তুলেছে।
একটা দেশের নেতৃত্বের যখন অধঃপতন ঘটে তখন তার এমন বিপরীত বুদ্ধিই হয়। অসংলগ্ন প্রলাপ তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। না হলে তিব্বত থেকে আগত শরণার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থীদের তুলনা করেন কেমন করে হুয়াং হুয়াঃ ইয়াহিয়া খানের মতাে নৃশংসতাই কি চীনা নেতারা করেছিলেন তিব্বতে? এভাবে তুলনা করতে গিয়ে চীনা বিপ্লবের আদর্শের ঘাড়েই যে তিনি বেকে বানরের মতাে কোপ মেরে বসেছেন সে হুঁশও তার নেই। ইয়াহিয়ার গণহত্যা দেখে প্রাণভয়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে ছুটে এসে শরণ নিয়েছে। চীনের বিপ্লবী নেতারাও কি তিব্বতে সেভাবেই গণহত্যা চালিয়েছিলেন? কেউ এ প্রশ্ন করলে হুয়াং হুয়া তাকে কী জবাব দেবেন?
চীনা মহানায়করা যে সাম্রাজ্যবাদীদের ঘাটাতে চান না তার প্রমাণ তাইপে ও হংকং। বিপ্লবের বাইশ বছর পরও এ দুটি স্পর্শ করার সাহস দেখাননি তারা। চীনা ভাষা অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদের দালাল’ হয়েও কিন্তু ভারত ও তার ফৌজ পাঠিয়েই পর্তুগীজ উপনিবেশ কেড়ে নিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্যই ভারত স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে নির্ভয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে আর সােভিয়েত ইউনিয়ন তা সমর্থন করেছে। কে সাম্রাজ্যবাদের দালাল? ভারত অথবা সােভিয়েত ইউনিয়ন? না মহাবিপ্লবের মূলাধার’ মহাচীন?
বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শত গুণ’- চীনের নেতাদের হয়েছে আজ সেই দশা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরও যে কথা বলতে হয়তাে মুখে একটু আটকায়, চীনা নেতারা সে কথাই সগর্বে গলা ফাটিয়ে বলেন। সাম্রাজ্যবাদী ভাড়ামিতে চীন সার্কাস পার্টির ভড়কেও ছাড়িয়েছে।

সূত্র: কালান্তর
৯.১২.১৯৭১