You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.04.02 | বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র | ২ এপ্রিল ১৯৭২ ঠাকুরগাঁও - সংগ্রামের নোটবুক

ঠাকুরগাঁওয়ের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

২ এপ্রিল ১৯৭২

ঠাকুরগাঁও

মাননীয় সভাপতি সাহেব,  আমার ঠাকুরগাঁর বোনেরা ভায়েরা,

আমার মনে পড়ে গণআন্দোলোনের পূর্বে আমি এখানে এসেছিলাম। পঞ্চগড় থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত অনেক সভায় আমি বক্তৃতা করেছিলাম। আমাকে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের জালেমরা ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভুমিতে নিয়ে যায় আমি জানতাম না যে আপনাদের কাছে আবার ফিরে আসব। আমি জানতাম না আমার সোনার বাংলাকে আমি আবার দেখব। আমি জানতাম না আমার বাংলাদেশের মানুষের সোনার মুখ আমি দেখব। যে বাংলার মাটিকে আমি ভালোবাসি আর যে বাংলার মাটি আমাকে ভালোবাসে – যে বাংলার মানুষকে আমি ভালোবাসি যে বাংলার মানুষ আমাকে ভালাবাসে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম আমি জানতাম আমার আত্মবিশ্বাস ছিলো ফাঁসির কাষ্ঠে আসামী হিসাবেও জেলের মধ্যে আমার পাশে কবর রাখা সত্বেও আমি জানতাম যে আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে এবং দুশমনদের হাত থেকে আমার বাংলাকে রক্ষা করবে। (জনতার করতালি।) আমি আমার ৭ কোটি লোকরে যাবার বেলায় কিছুই দেবার পারি নাই। তাদের হাতে আমি অস্ত্র তুলে দেবার পারি নাই। তাদের দিয়েছিলাম নীতি তাদের দিয়েছিলাম আদর্শ তাদের দিয়েছিলাম নির্দেশ – বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ জাতী ধর্ম নির্বিশেষে দল মত নির্বিশেষে আমার পুলিশ বাহিনী আমার পুরানো ইপি আর আমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা আমার বাংলাদেশের ছাত্র যুবক কৃষকরা বিনা অস্ত্রে সেই পাষণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। এবং আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু বড় রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা পাওয়া গেছে। এতো রক্ত দুনিয়ার কোন দেশ কোন জাত স্বধীনতার জন্য দেয় নাই যা আমার বাংলার মানুষ দিয়েছে। মানুষ যে এতো পশু হতে পারে মানুষ যে এতো অসভ্য হতে পারে মানুষ যে এতো অমানুষ হতে পারে তা পশ্চিমা খানসেনাদের মতো দুনিয়ার কোথাও এরম পয়দা হয় নাই। আমার লক্ষ লক্ষ মা বোনকে হত্যা করেছে আমার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে আমার দুধের বাচ্চাকে হত্যা করেছে আমার ধানের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে আমার পোর্ট ও রেললাইন ভেঙ্গে দিয়েছে আমার টাকা আত্মসাৎ করেছে আমার বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়েছে আমার মানুষকে ধরে ধরে নির্দয়ের মতো ধরে অত্যাচার করেছে হত্যা করেছে। মানুষ দুনিয়ার মানুষ দেখে নাই যে কী অত্যাচার আমার দেশে করেছে। কিন্তু টিকতে পারে নাই খানসেনারা। টিকতে পারে নাই পশ্চিমা শোষক গোষ্ঠী। ২৩ বচ্ছর ২৪ বচ্ছর পর্যন্ত আমার বাংলার পাটের টাকা আমার বাংলার চিনির টাকা,   আমার বাংলার মানুষের খাজনার টাকা আমার বাংলাদেশে যা কিছু ছিলো সব লুটপাট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলেছে। এর বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বার বার এদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছি,  বাংলার মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে। আমি বেইমানদের কাছে মাথা নত করি নাই। যাতে আমার বাংলার মানুষ দেখে যে তাদের নেতা মরতে পারে সে মরবে সরাসরি মরবে মাথা নত করবে না। (জনতার করতালি।)

আমি যদি স্বাধীনতা না দেখে যাই যেমন আমার ৩০ লক্ষ ভাই বোনকে হত্যা করেছে তারা এই স্বাধীনতা দেখে নাই। তারা জীবনে আর মায়ের কোলে ফিরে আসবে না। আপনার জানেন না আমার মনের অবস্থা কী? আমি যখন সকাল বেলা বের হই  তখন আমার ছেলেহারা মা পুত্র হারা বাপ স্বামীহারা একজন মহিলা আমার দুয়োরের কাছে আসে – বাবা আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে মেরেছে – বাবা আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে – বাবা আমি বিধবা কিী করব? ত্রিশ লক্ষ লোক,  একজন-দুইজন নয়। এক পয়সার একটা সোনা পর্যন্ত বাংলাদেশে রেখে যায় নাই। বৈদেশিক মুদ্রা না হলে দুনিয়ার কোথা থেকে কোনও জিনিস কেনা যায় না। বিশ্বাস করেন যেদিন আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেইকা ফিরা আইসা,  আমার ইচ্ছা ছিল না যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই। আমি প্রধানমন্ত্রী হইয়া কী হবে আমার? যে দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রাণ খুলে ভালোবাসে একটি লোককে তার কাছে প্রধানমন্ত্রিত্বের কী দরকার আছে? (অস্পষ্ট)  প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে আমি কী করবো? আমি দেখলাম যে এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রা নাই। কোথা থেকে আমি খাবার আনবো? কী করে আমার মানুষের মুখে আমি খাবার দেবো? কোথা থেকে আমি জিনিসপত্র কিনে আনবো,  কী দিয়ে আমার মানুষকে আমি চাল দেবো? কোথা থেকে আমি অর্থ পাবো? যা দিয়ে আমি আমার মানুষকে সাহায্য করবো। আমার তো আর কিছু নাই,  আমার তো আর আলাদিনের চেরাগ নাই। সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আমি বললাম,  আমি কাপুরুষ হলে চলবে না। আমাকে এদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এদের যেভাবে মৃত্যু হয় ঐভাবেই আমার মৃত্যু হওয়া প্রয়োজন। ওদের দুঃখে আমি দুঃখি। ওদের সুখে আমি সুখি। ওরা আমার ভাই আমি ওদের ভাই। দেখি কী করা যায়। চল দুহাত তুলে চেষ্টা করে দেখি। আমার নিতে হয়েছে। কী করব?

বাংলার মানুষ,  যেদিনকে এক কোটি লোক এই বাংলাদেশ থেকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল – একজন-দুইজন নয়,  এক হাজার-দুই হাজার  নয় – এক লক্ষ দুই লক্ষ নয় – এক কোটি লোক বাংলা থেকে মতা,  মাতৃভূমি ত্যাগ করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার হাত ধরে – দৌড়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতবর্ষের বুকে। শ্রীমতী গান্ধী মাতৃরূপে তাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন। ভারতের জনসাধারণ তাদের সাহায্য করেছিলেন,  তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন,  তাদের খাবার দিয়েছিলেন,  তাদের স্থান দিয়েছিলেন। আমরা বাঙ্গালিরা অকৃতজ্ঞ নই। নিশ্চয়ই আমরা তাদের মোবারকবাদ জানাবো এবং ধন্যবাদ দেবো। (জনতার করতালি।)  স্বাধীনতার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাঁচ লক্ষ টন খাবার দেবেন এবং খাবার দেওয়া শুরু করলেন আমার বাংলার ভুখা মানুষকে খাওয়ার জন্য। তিনি কিছু টাকা দিলেন যা দিয়ে সরকার চালাতে শুরু করা হলো। তিনি কিছু মালপত্র দিলেন,  যা দিয়ে কারখানা করতে আরম্ভ করলাম,  তিনি কিছু লোক দিলেন যা দিয়ে রেললাইনগুলোকে চালু করা হলো। বলেন তো তার কাছে অকৃতজ্ঞ কী করে হই? আমি তো মানুষ। বাঙ্গালি নিমক হারাম নয়।

যখন উনি এবার আসলেন ঢাকায়,  আমি যখন তাকে বললাম,  শ্রীমতি গান্ধী তুমি তো আমাকে পাঁচ লক্ষ টন খাবার দিচ্ছ। কিন্তু যে আমার যে আরও খাবার দরকার। আমি কোথার থেকে আনবো? তুমি কী আমাকে আরও কিছু দেবার পারো না? কাইল যখন আমি খুলনার থেকে ফিরে আসলাম আমি তার কাছে থেকে চিঠি পেলাম যে তোমাকে আমি আরো ২ লক্ষ ৫০ হাজার টন খাবার দেবো। (জনতার করতালি।)। আমি আপনাদের সকলের পক্ষ থেকে ভারতের জনসাধারণ এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীকে মোবারকবাদ জানাই। কী যে করব বলেন? আইসে দেখলাম মানুষের কিচ্ছু নাই। ওরা খাজনা দেবার পারবে না। ওদের যদি খাজনা দেবার বলি তা ওদের তো শেষ হয়ে যাবে। আমি বললাম,  যাও কোনো প্রয়োজন নাই,  বকেয়া খাজনা সব মাফ করে দাও। (জনতার করতালি।)।

বলেন তো,  না লবণের ট্যাক্স সব মাফ করে দেও। দিলাম। অসুবিধা নাই। যেখান থেকে হয় ভিক্ষা করে আমি আনবো। দিয়ে দেও। ১৮ কোটি টাকা। টেস্ট রিলিফ করার জন্য। মানুষ কাজ করে পয়সা দেই – কাজে খাক। গরু-ছাগল কিনতে পারে না,  কোথায় পাবো? দাও দশ কোটি টাকা যেখান থেকে পারি আমি ভিক্ষা করে আনবো। দিয়ে দাও। টাকা আমি দেব। (জনতার করতালি।)।

পশুর দল যে সব লুট করে নিয়ে গেছে। আমি দিবো কোথ থেকে? খাজনা না দিলে গভর্নমেন্ট বা সরকার কী দিয়ে পয়সা দিবে আমাকে বুঝাইয়া বলেন। কে দেবে? কোত্থেকে দেয়া হবে? সবই মাফ করে দিয়েছি। পয়সা কোত্থেকে আসবে? পাট চালান দেবো,  আমাদের যেগুলো পোর্ট আছে,  চট্টগ্রাম,  চালনা পোর্ট,  জাহাজ আসতে পারে না ভালোভাবে। জাহাজগুলো দস্যুর দল ডুবাইয়া দিয়া গেছে নদীর মুখে যাতে জাহাজ না আসতে পারে। আর কী লাগবে আমার? সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আছে,  আমার হাতে কিছু নাই। না খেয়ে মরে যাবো কিন্তু গোলামের গোলামি করবো না। (জনতার করতালি।)। তোরা চলে যা এদেশ থেকে। জীবনের তরে চলে যা,  সুখে থাক – আশির্বাদ করি – আর জীবন ভরে পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর। যা তোরা বাংলার বুকে করে গেছিস,  কিন্তু মনে রাখিস যারা যারা পাপ করেছে। যারা আমার মা-বোনকে হত্যা করেছে যারা আমার মা-বোনকে পাশবিক অত্যাচার করেছে,  ওদের বিচার হবে বাংলার বুকে।  (জনতার করতালি)।

আমি যাবো রাশিয়া,  ভিক্ষা দাও। আমি যাবো ভারতবর্ষে,  ভিক্ষা দাও। আর চোরের দল এখান থেকে বর্ডার পাস করে দেয়। আপনারা আমার কথায় অস্ত্র ধরেছেন। আমার কথায় ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছেন,  আমার কাছে ওয়াদা করেন,  যে চোরাকারবারি,  দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি দিতে হবে। রাজি আছেন কি না? আর জিনিসের দাম বাড়াবা না। তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি- মুজিবর রহমান ভালো মানুষ সত্য কথা,  নরম দেহের সত্য কথা। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললে,  মেশিনগান চালাইয়া দেবার হুকুম দেবার জন্য একমুহূর্ত দেরি করিবে না। (জনতার করতালি)। আপনারা মেহেরবানি করিয়া জিনিসের দাম কমান। জিনিস পাওয়া যায়,  দাম বাড়বে কেন? আমি হাত দিচ্ছি না। কারণ আপনারা দেখেছেন যে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনা হয়েছে। রক্তর দিকে একটু খেয়াল রাখেন। ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হলেন তার আর কী লাগে? কোথায় পাবো? কে দেবে? কার কাছে পাবো? আমি আজকে আড়াই মাস হলো জেল থেকে বেরিয়ে এসেছি,  আড়াই মাস। আমি একটা দিন বিশ্রাম নিতে পারি নাই। বিশ্রাম কারে কয় আমি জানি না। আমি চিন্তা করছি। আমি কেবল শিহরিয়া উঠি। কী করে আমার দুঃখি মা-বোনের মুখে হাসি ফুটাবো। আর চোরা কারবারি বদমাইশি বাংলাদেশে বাস কইরা ফটর ফটর চোরকারবারি আর দাম বাড়াইয়া দেওয়া হয়। আমার কর্মী ভাইয়েরা,  আমার বাংলার জনসাধারণ,  আমার ঠাকুরগাঁয়ের জনসাধারণ,  তোমরা আমাকে ভালোবাসো কিনা? যদি ভালোবাসো এই চোরাকারবারিদের শেষ করতে হবে। যেমনি আমার কথায় অস্ত্র ধরেছিলা। দরকার হলে তোমাদের এবার আমি লাঠি ধরতে বলবো। কিন্তু চোরাকারবারির গোষ্ঠী আমি বাংলা থেকে বিনাশ করে দেবো। কী মনে করেছে কী? আপনারা সাহায্য না করলে পারবো না। আমার শতকরা ৬০ জন পুলিশকে মাইরে থুইয়ে গেছে। আমার শতকরা ৬০ জনের মতো,  আমার বাংলাদেশ রাইফেলের জোয়ানদের মেরে ফেলে গেছে। আমার মিলিটারিদের মেরে দিয়া গেছে। আমি মিলিটারি দিয়ে দেশ শাসন করতে চাই না। আমি পুলিশ দিয়ে দেশ শাসন করতে চাই না। আমি চাই বাংলার জনগণের সাহায্য নিয়ে দেশ শাসন করতে। (জনতার করতালি)।

ওরা থাকবে,  ওরাও এই বাংলার সন্তান,  কিন্তু আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে আগে এবং আপনার মহানুভব কাজ করতে হবে। আপন – আরে দুনিয়ার এমন আমি মানুষ দেখি নাই। আশ্চর্য হয়ে যাই,  এরা তো মানুষের তো – মানুষতো বুঝা উচিত যে এত রক্তের পরে স্বাধীনতা এসেছে আজ চোরাকাবারি। ঠাকুরগার ভাইয়েরা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কাছে,  যারা অন্যায় করেছে নিশ্চয়ই তাদের সাজা দেওয়া হবে। কিন্তু যারা নিরপরাধ,  যা আপনাদের ঠাকুরগাঁয়ে একটা প্রবলেম হয়ে গেছে। কিছু লোক এখানে এসে বাসিন্দা হয়েছিল,  আমি জানি,  তারা কিছু কিছু লোক খান সেনাদের সঙ্গে মিশে আপনাদের অত্যাচার করেছিল। তাদের বিচার করা হবে,  তাদের গ্রেফতার করা হবে। (জনতার করতালি)।

কিন্তু যারা নিরপরাধ,  ঘরবাড়ি ত্যাগ করে চলে গেছে তাদের আসতে দিতে হবে। রাজি? (জনতা একসাথে – ‘রাজি’)। ওরম হবে না,  হাত তুলে বলতে হবে। (জনতা একসাথে – ‘হ্যাঁ’)। আমি কী করে তাদের সরাবো? তারা,  দেখা গেছে চাপাইনবাগঞ্জে,  ৫০ হাজার লোক নেই,  শহরের লোকসংখ্যা ঠাকুরগায় যদি ৫০ হাজার লোক আইসা বসে তা সেই ঠাকুরগাঁর লোক কি বাঁচবে? সেখানে ৫০ হাজার লোক চলে গেছে। এখন তারা আইসা আমার কাছে কান্দে। আমরা কী করে খাওয়াবো? আমরা না খাইয়া মরতেছি। এরা কী করবে? ঘর-বাড়ি আসেনা। আমি কী করবো? ওদের আনতে দিতে হবে। আর যারা বদমাইশি করেছে তাদের আমি বলে যাচ্ছি ঐ জেল ছোট হলেও আরেকটা জেল করে ওইখানে বন্দি হবে। কোন চিন্তার কারণ নাই। যারা অন্যায় করছেন,  অন্যায় থামান। আপনারা ভাবেন,  কিন্তু নিরপরাধ,  নিরাশ্রয় যারা আপনার ভাই,  তাদের মাটিতে,  তাদের দেশে আসতে দিবেন এটাই আমি আশা করি।

ভাইয়েরা আমার বোনেরা আমার,  দেশ শুধু একজনের নয় আপনাদের কিছু উন্নতি করতে হবে। ৭ কোটি লোক ১০ কোটি টাকা দিচ্ছি আমি তাকাবি লোণ। ওর মধ্যে থেকে কষ্ট-মষ্ট করে কিনা চালাইতে হবে। আধপেটা খাইয়া যদি চালাইতে পারেন এটা করে চালাইতে হবে,  দেবার পারবো না,  আপনারা মজিবর রহমানকে জানেন –  মিথ্যা কথা বলবে না। মিথ্যা ধোঁকা দেয় না  গদি-ফদি আমি চাই না। আমি মিথ্যা কথা বলে মানুষকে ধোকা দেবার পারবো। যা অবস্থা খান সেনারা বাংলায় করে গেছে,  সেই জাগায় ফিরে আসতে হলে,  আমার কমসে কম ১০ বৎসর লাগত। কিন্তু আমি আশা করি তিন বৎসরে সে জায়গায় ফিরে আসতে পারবো। (জনতার করতালি)।

এই তিন বৎসর আমি কেউরে কিছু দেবার পারবো না। যদি পান মনে করবেন যে কেসমতের জোরে পাইছেন। যদি বলেন যে দিতে হবে,  আমি বলবো সালামুলাইকুম। আমি কিছু দেবার পারবো না। আমি খাজনা মাফ করে দিছি,  যেডা আমার হাতে আছে সেডা মাফ। কিন্তু যা নাই দেবার ক্ষমতা নাই। স্বাধীনতার অর্থ বিশৃঙ্খলা নয়। যুবক ভাইরা শৃঙ্খলা শেখো। যুবক ভাইয়েরা গ্রামে-গ্রামে যাও। আর ছাত্র ভাইয়েরা লেখাপড়া শেখো। এট্টু এট্টু লেখাপড়া শেখো। জিন্দাবাদ দেও আর মুর্দাবাদ দেও – আমার আপত্তি নাই। এট্টু লেখাপড়া শেখো।  তোমাদের ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ভবিষ্যতে তোমাদের বড় বড় কর্মচারি হতে হবে।  দেশ তোমার,  তাকে গড়তে হবে। লেখাপড়ার দিকে একটু নজর দাও।

আর আপনারা জানেন,  যে এই যে বড় বড় ব্যাংক যা বাংলাদেশে ছিল আজ বাংলার সাড়ে ৭ কোটি লোকের সম্পত্তি। এখন আর দুই-চার জনের সম্পত্তি নয়। যাকে বলা হয় ব্যাংক জাতীয়করণ। এখন এই যে ব্যাংকগুলো যার মধ্যে চাবি। যা দিয়ে ভুড়িওয়ালারা আরও ভুঁড়ি পয়াদা করে আর গরিব গরিব হয় – এই জাগায় আমি প্রথম আঘাত করছি। তারা কিন্তু বসে থাকবে না। তারা কিন্তু বসে থাকবে না। এটাকে বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র করবে। আপনাদের হুঁশিয়ার হতে হবে। আমি আপনাদের সাথে আপনারা আমার সাথে। যদি ভুড়িওলারা পয়সা দিয়ে অতিবিপ্লবী কথা কয় কেমন করে দমন করতে হয় বাংলার মানুষ জানে। জানেন না? (জনগণ একসাথে – ‘জানি’)।  একটু ভালো করে রেডি হইয়ে থাকেন আমি হুকুম দিয়ে বসতেও পারি – আমার বলা যায় না। আমি লোকটা আবার একটু সোজা মানুষ। আবার বড় বড় কল কারখানা ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা ছিল সেগুলোকে জাতীয়করণ করে ৭ কোটি লোকের সম্পত্তি করেছি। যতগুলো চটকল ছিল সব এখন বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সম্পত্তি। যতগুলো চিনি কল ছিল,  সব বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সম্পত্তি। যতগুলো কাপড়ের কল ছিল তা এখন সমস্ত সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সম্পত্তি। আমি জাতীয়করণ করে বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছি। ফসল উৎপাদন করেন,  চেষ্টা করেন। আমারে বলে পাম্প নাই? আমি বললাম যে পাম্প নাই? শক্তি নাই। গর্ত কর। পানি উঠাও,  সাহায্য কর। ফসল উৎপাদন করতে হবে। ভিক্ষুকের জাত হয়ে আমি বাঁচতে চাই না। আমি মাথানত করে কারো কাছে ভিক্ষা চাই না। আমি চাই আমার মানুষ ভবিষ্যৎ বংশধর যেন গোলাম না হয়ে থাকে। পেট ভরে ভাত খায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমার ভাইয়েরা আমার,  আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। রৌদ্রের মধ্যে আপনারা কষ্ট করতেছেন। আসুন আমার সঙ্গে আপনারা একটা মোনাজাত করেন যে সমস্ত ভাইয়েরা আমার শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। বসেন আপনারা,  বসে মোনাজাত করি।

ভাইয়েরা আমার,  ওরা আর মায়ের কোলে ফিরে আসবেনা। কিন্তু ওদের রক্ত যেন বৃথা না যায় সেটাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। আগের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম,  এবারের সংগ্রাম হবে দেশ গড়ার সংগ্রাম। বাংলার মানুষ যদি পেট ভরে ভাত খায়,  বাংলার মানুষ যদি শান্তিতে বাস করে,  বাংলাদেশের দুর্নীতি নষ্ট হয়ে যায়,  বাংলায় যদি শোষণহীন সমাজ গঠন হয়,  তাহলে আমি বিশ্বাস করি যারা শহীদ হয়ে মারা গেছে ওদের আত্মা শান্তি পাবে। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ যে আপনারা সকলে কাজ করেন দেশকে গড়ে তোলেন। আমি বলে দিচ্ছি পরিষ্কার কথা – কিচ্ছুই আপনারা আশা করবেন না যে তিন বচ্ছরের মধ্যে আমি দেবো। আপনাদের নিজেদের কাজ করে খেতে হবে। আমি ভিক্ষা করে আনি যা পারি নিশ্চয়ই আপনাদের পৌছাবো। যাতে চাটার দল চাইটে না খাইতে পারে সে দিকে খেয়াল রাখবেন। আবার আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে ঠাকুরাগার ভাইদের ধন্যবাদ দিয়ে,  জানি আমি ঠাকুরগা সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি জানি। ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি।

খোদা হাফেজ।

জয়বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা।’)

জয়বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা।’)

জয়বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা।’)

Reference:

বঙ্গবন্ধুর অডিও ভাষণ, পিপলস ভয়েস, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান

বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক