ত্রিপুরার খাদ্য পরিস্থিতি
আগরতলা, ২৩ জুন, ১৯৭১ ইং: আজ বিধানসভায় ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ ত্রিপুরার খাদ্য পরিস্থিতির উপর এক বিবৃতি দেন। বিবৃতির পূর্ণ বয়ান নিম্নে দেয়া হলাে:
১৯৭০ সালে ত্রিপুরার খাদ্য পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, বণ্টন ব্যবস্থা সুসংগঠিত ও কার্যকর ছিল, চালের বরাদ্দ বাড়ানাে হয়েছিল ও পূজা-পার্বনের সময় অতিরিক্ত রেশনও দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের প্রথম তিন মাস পর্যন্ত এই সন্তোষজনক খাদ্য পরিস্থিতি বজায় ছিল। যেসব খাদ্যশস্য পরিবহন করা হচ্ছিল সেগুলােসহ ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল ত্রিপুরায় সমস্ত খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩,০০০ মে. টন। তাছাড়া ১৬,৫০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ হয়েছিল ও সেগুলাে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। তা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ত্রিপুরার ছয় মাসেরও বেশি চাহিদা মেটাবার মতাে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত ছিল।
এই সভা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন যে, দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলীর ফলে মার্চ (১৯৭১) মাসের শেষ দিক আকস্মিক ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এভাবে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর স্রোত অব্যাহতভাবে আসতে থাকবে তা আগে আশঙ্কা করা যায়নি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে এবং আজ এই ১৬ লক্ষ মানুষের ত্রিপুরাকে আরাে ১৩ লক্ষ লােকের অন্ন-সংস্থান করতে হচ্ছে। সরকারের উপর কতটা দায়িত্ব এসে পড়েছে তা এই সভা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন।
প্রশাসন অবিলম্বে বরাদ্দকৃত বাকি খাদ্যশস্যের আমদানির জন্য দ্রুত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটি কারণে খাদ্য আমদানির কাজ ব্যাহত হতে থাকে। এই কারণ দুটি হলাে:
ক. রেলওয়ে আউট এজেন্সির অপ্রতুল কর্মক্ষমতা এবং খ. ধর্মঘটের ফলে রেলপথে মালপত্র আটক এবং পথের বিভিন্ন স্থানে ওয়াগন আটক।
আউট এজেন্সির ভূমিকা নিয়ে অবিলম্বে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়; কিন্তু তাতে আউট এজেন্সির ক্ষমতার উন্নতি হয়নি। ইতিমধ্যে ধর্মনগরে মালপত্র আটক হতে থাকে। স্থানীয় ট্রাকগুলাে সংগ্রহ করে মালপত্র আনার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়; কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় মাল খালাস করার পক্ষে এই ট্রাকগুলাের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল না। জরুরি ভিত্তিতে এই অবস্থার মােকাবিলা করতে হয়েছে। ত্রিপুরা সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের যানবাহনের সংখ্যা বাড়িয়ে পরিবহন ব্যবস্থার অভাব দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সামরিক বাহিনীর গাড়ি পাঠানাের জন্য ভারত সরকারকে অনুরােধও করা হয়েছিল। সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সাড়া দেন এবং পরিবহনের জন্য আমাদের হয়ে ট্রাক নিযুক্ত করেন। ধর্মনগরে জমে যাওয়া মাল খালাস করার ব্যাপারে এটা প্রভূত সাহায্য করে।
ইতিমধ্যে রেল বিভাগ প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য বিধিনিষেধ আরােপ করায় সরকারের গতি বাধাপ্রাপ্ত হলেও বর্তমানে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য আসতে শুরু করেছে এবং আমাদের মজুত ভাণ্ডার দ্রুত পূর্ণ করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে সর্বপ্রকার খাদ্যশস্যের সরবরাহের মাসিক গড় হিসাব ছিল প্রায় ১৩০০ মেট্রিক টন। গত এপ্রিল মাস থেকে সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে মাসিক গড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। ক্রমবর্ধমান প্রয়ােজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার চাল ও আটার সরবরাহ বাড়িয়ে যথাক্রমে ৪০,৫০০ টন ও ১১,০০০ টন করেছেন এবং আরও আশ্বাস দিয়েছেন যে, আমাদের ভবিষ্যত চাহিদা পূরণ করা হবে। ধর্মনগর ও চোরাইবাড়ি থেকে মাল খালাস যাতে দ্রুততর হয় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শরণার্থীদের স্থানান্তর করার কাজে যেসব বিমান ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলাের মাধ্যমে খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। দ্রুত সরবরাহ করার এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমরা নিশ্চিতভাবে খাদ্যশস্যের ঘাটতি হবে না বলে আশ্বাস দিতে পারে। আমাদের আয়ত্তের বাইরে হওয়ায় যদি সময়ে সময়ে সড়ক যােগাযােগ বা রেল চলাচল বিপর্যস্ত হয় তাহলে হয়তাে সাময়িকভাবে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যদি কোনাে সাময়িক অসুবিধা দেখা দেয়, আমি আশা করি, এতে বিপুল পরিমাণের খাদ্যশস্য আনয়নের দ্রুত ও বৃহৎ কাজের গুরুদায়িত্বের কথা বিবেচনা করে ত্রিপুরার জনগণ সহমর্মিতার মনােভাব নিয়ে তা গ্রহণ করবেন।
আমার বিশ্বাস আছে যে, ত্রিপুরাবাসী পূর্বে অনেক অসুবিধাই সাহসের সাথেই মােকাবিলা করেছেন; আর ভবিষ্যতেও তারা যে কোনাে অসুবিধাই সাহসের সাথেই মােকাবিলা করবেন। ১১ জুন (১৯৭১) যে সপ্তাহ শেষ হয়েছে সেই সপ্তাহের ত্রিপুরার বড় বড় বাজারের চালের দরের একটি তুলামূলক হিসাব আমি বিধানসভায় পেশ করেছি। অন্যান্য জিনিসপত্রাদি যেমন ডাল, লবণ, চিনি এবং তেলের দাম বেড়েছে। বাজারে অত্যধিক চাহিদাই এসব জিনিসের দাম বাড়বার একমাত্র কারণ নয় বরং নিয়ন্ত্রিত মাল চলাচল এবং যেখান থেকে এই জিনিসপত্র আনা হচ্ছে, সেখানে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিও অন্যতম কারণ। সর্বোচ্চ গুরুত্বের ভিত্তিতে জিনিসপত্র আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকার ৩ হাজার মেট্রিক টন ডাল, ৬০ মেট্রিক টনের কিছু বেশি তেল, ২,১০০ মেট্রিক টন লবণ এবং ১ হাজার মেট্রিক টন চিনির বরাদ্দ দিয়েছেন। এসব জিনিস আরও বেশি সরবরাহের আদেশও দেয়া হবে।
উদ্বাস্তুদের খাদ্যশস্যের রেশনের পরিমাণ সাময়িকভাবে ৪০০ গ্রাম থেকে কমিয়ে ৩০০ গ্রাম করা হয়েছে। ত্রিপুরার জনসাধারণ ন্যায্য মূল্যের দোকান মারফত যা পান তার চালের পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যাবে যে, উদ্বাস্তুদের হ্রাস করা রেশনের পরিমাণ তার চেয়েও বেশি। তরিতরকারি ইত্যাদি সরবরাহ করে রেশনের যে পরিমাণ কমানাে হয়েছিল তা পূরণ করা হয়েছে। তাছাড়া উদ্বাস্তুদের মধ্যে শীঘ্রই গম বা। ভাঙ্গা গম সরবরাহ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর থেকে তাঁরা ভালাে খাবার তৈরি করতে পারবেন।
গত ২১ জুন আমি যে বিবৃতি দিয়েছি তাতেই বলা হয়েছে যে, খাদ্য পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন এবং পরিস্থিতির মােকাবিলায় সম্ভাব্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে, আগামী কয়েক সপ্তাহে যদি আমরা কোনাে অসুবিধার সম্মুখীন হই তবে জনসাধারণের পূর্ণ সহযােগিতায় আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারবাে।
সূত্র: ত্রিপুরা
১ জুলাই, ১৯৭১
১৬ আষাঢ়, ১৩৭৮