পাকিস্তানি সেনাদের মনােবিকৃতির ধরন
একাত্তরে এদেশের মাটিতে নারীর প্রতি যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার সাথে টীনের নানজিং-এ জাপানি সেনা কর্তক ধর্ষণ, রাশিয়াতে নাৎসিদের বলাৎকার এবং আর্মেনিয়ায় নারী নির্যাতনের যথেষ্ট সাযুজ্য রয়েছে। অত্যাচারী পাকিস্তানি সৈন্যদের ভয়ঙ্কর মনােবিকৃতি, Sadism ও Paranoia নামক মনােবিকারের প্রকাশ বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন। যতই তারা যুদ্ধে পরাভূত হচ্ছিল এবং বাঙালি জাতিকে বশীভূত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল ততই তাদের নানাবিধ নির্যাতন প্রচণ্ড ও ব্যাপক হয়ে উঠছিল। সিদ্দিক সালেক তাঁর Witness to Surrender গ্রন্থে নিয়াজির নারী লাভের কথা উল্লেখ করেছেন। তার শত নারী ভােগের কাহিনী সমর্থিত হয়েছে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্টেও। যতই সে রণক্ষেত্রে পরাভূত হচ্ছিল এবং বাঙালিদেরকে পদানত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, ততই সে বন্দি নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়ে বিজয় লাভের বিকৃত চেষ্টা করছিল। শুধু নিয়াজিই নয়, ‘৭১-এর পুরাে ন’মাস ধরে বহু পাকিস্তানি সেনা অফিসার বাঙালি নারীদেরকে অপহরণ করে আটক রেখে দিনের পর দিন একক কিংবা সমষ্টিগতভাবে গণধর্ষণ করেছে। অনেককে তারা পরিণত করেছে তাদের যৌনদাসীতে। এই মেয়েদের অনেককে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কার, বিভিন্ন ক্যাম্প, ক্যান্টনমেন্ট ও কারাগার থেকে উদ্ধার করা হয়। অনেক মেয়েকে তারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। কয়েদি | হিসেবে কয়েকজনকে সঙ্গেও নিয়ে যায়। কিছু মেয়ে নিজেদের লজ্জা ও সন্ত্রম ঢাকতে বন্দি পাকিস্তানি সেনাদের অনুগামী হন। বর্বর পাকিস্তানিদের নৃশংস অত্যাচার ও যৌন নিপীড়নের কারণে অনেক নির্যাতিতা প্রথম সুযােগেই আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে ভারত ও অন্যান্য দেশে দেশান্তরী হয়েছেন নিজেদের সম্মান ও সম্রম বাঁচানাের জন্য। অনেকে দেশের মধ্যেই স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়েছেন। আমাদের সংগৃহীত তথ্য মতে অনেকে ভয়ঙ্কর আত্মগ্লানিতে নিমজ্জিত হয়ে স্বেচ্ছায় গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পূর্বাপর বিবেচনা না করে অনেক নির্যাতিতা নারী নিজেদেরকে সমর্পণ করেছেন নারী পাচারকারীদের কাছে। লিঙ্গভিত্তিক গণহত্যার ৮০ ভাগ লক্ষ্যস্থল ছিল ১৫ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বয়স্ক পুরুষ। বাকি ২০ ভাগ লক্ষ্যবস্তুর অন্তর্ভুক্ত ছিল নারী এবং শিশু, যাদের সংখ্যা ছয় লক্ষ। এর মধ্যে যে সমস্ত মহিলা নিহত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই মৃত্যুপূর্ব যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এ ছাড়া রােমেল-এর Death by Government বইয়ের তথ্য অনুযারী ধর্ষিতা বীরাঙ্গনার সংখ্যা চার লক্ষ হলেও আমাদের ‘৯৯-এর জুলাই থেকে ২০০০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত তদন্তে ধর্ষিতা বীরাঙ্গনার সংখ্যা সাড়ে চার লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। ধর্ষণ ও আনুষঙ্গিক কারণে মৃত্যুর হিসাবটি আলাদাভাবে করায় এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এই সাড়ে চার লক্ষের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ধর্ষিতা হবার পর নিহত হয়েছেন। ধর্ষিতাদের এক বিরাট অংশ নিজেদের সম্মান ও সম্ভ্রম বাঁচানাের জন্য আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। অনেকে বিভিন্ন এনজিও’র সহায়তায় পাশ্চাত্য বিশ্বে আশ্রয় নিয়েছেন। ধর্ষিতাদের মধ্যে যারা গর্ভবতী হয়েছেন তাঁদের অনেকের গর্ভপাত ঘটানাে হয় ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি ক্লিনিক ও সরকারি হাসপাতালে-দেশী-বিদেশী এনজিও’র সহায়তায়। এর মধ্যে যুদ্ধশিশুদের প্রতিপালন ও পরিচর্যার জন্য ছিল মাদার তেরেসা পরিচালিত ‘শিশুভবন’ বা ‘বেবী হােম’। মাদার তেরেসার নির্দেশে নাটোরের রাজবাড়িতে ২৫০ কক্ষবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল খােলা হয়। সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ঢাকার নিউ ইস্কাটনে একটি অ্যাবরশন ক্লিনিক স্থাপন করে। যে সমস্ত শিশু জীবিত জন্মায় তাদেরকে “শিশুভবনে’ রাখা হয়। কোর (CORR), আইএসএস এজেন্সি নিউইয়র্ক, কেয়ার, কারিতাস প্রভৃতি সংস্থার সহায়তায় বেশকিছু যুদ্ধশিশুকে দত্তক হিসাবে নিয়ে যায় ইউরােপ আমেরিকার বহু পরিবার। পাকিস্তানিদের লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের একটি উল্লেখযােগ্য দিক ব্যাখ্যা করতে যেয়ে ব্রাউমিলার তাঁর গ্রন্থের ৮৩ পাতায় লিখেছেন, ‘Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty, girls of 8 and grand mother of 75 had been sexually assaulted. Pakistani Soldiers had not only violated Bengalee women on the spot, they abducted tens of hundred and held them by force in their military barracks for nightly use. Some women have been raped as many as 80 times in a night.’ যেহেতু অনেক নারী ধর্ষিতা হবার সাথে সাথে নিহত হয়েছেন ও নিজেদেরকে অন্তর্গত করেছেন সামগ্রিক শহীদের সংখ্যার মধ্যে এবং অনেকেই নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছেন নামহীন, পরিচয়হীন অন্ধকারের ব্যক্তিত্ব হিসেবে-তাই ধর্ষিতাদের প্রকৃত পরিসংখ্যানটি পাওয়া খুব কঠিন। যেহেতু ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এই নারী নির্যাতন, দাসত্ব ও ধর্ষণের বিষয়টি যথাযথভাবে বিশ্বমানবতার মনােযােগ আকর্ষণ করতে পারেনি, তাই এটি মানবাধিকার, নারী অধিকার ও বিশ্বনারী নির্যাতনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ কৃষ্ণ অধ্যায় হিসেবে রয়ে যাবে। বন্দি মেয়েদের ওপর এদের যৌন নির্যাতনের প্রকৃতি এতটা ভয়ঙ্কর ও বিকারগ্রস্ত ছিল যে, তার সাথে বিশ্ববিখ্যাত মনােরোগ বিশেষজ্ঞ ও নিউরােলজিস্ট রিচার্ড ভন ক্রাফট-ইবিং-এর ‘Psychopathia Sexualis’ গ্রহের কেসস্টাডিগুলােরই কেবল তুলনা চলে। এ কারণে নির্যাতনে সিদ্ধহস্ত, বিকৃতমনস্ক ঐ সমস্ত পাকিস্তানি সেনা অফিসার ও অন্যান্যদের মনােবিশ্লেষণ এবং জেনেটিক এনালাইসিস করে তাদের ক্রিমিনাল ট্রেইট নির্ধারণ করা তাদের অঞ্চলের জনগণের সুস্থতা ও সভ্যতার জন্যই প্রয়ােজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া নৃশংস অত্যাচার, পৌনঃপুনিক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত, বংশগত ও গােষ্ঠীগত জেনেটিক্যালি ক্রিমিনাল ট্রেইট নির্ধারণ একটি জরুরি বিষয় হয়ে পড়েছে। কেননা একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতা, অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের হাজারাে মর্মন্ত ঘটনা ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। এই ঘটনাগুলাে বিশ্ব বিবেককে এমনভাবে বিস্মিত করছে যে, প্রতিটি সংঘাতময় অঞ্চলে এ ধরনের বিশ্লেষণের বিষয়টি গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে।
হত্যাকাণ্ডের সময় ও তৎপূর্বে পাকিস্তানি বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনের ধরন
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানি সেনারা যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাপূর্ব শারীরিক নির্যাতন চালায় তার ধরনগুলাে নিম্নরূপ ১. সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখামাত্র গুলি করা ২, শক্তসমর্থ, তরুণ ও যুবকদেরকে রাস্তা কিংবা বাড়িঘর থেকে বন্দি করে এনে চোখ বেঁধে সমষ্টিগতভাবে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর শারীরিক নির্যাতন করা এবং পরিশেষে পেছনে হাত বেঁধে কখনও এককভাবে কখনও কয়েকজনকে একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে নদী, জলাশয় বা গর্তে ফেলে দেয়া। ৩, কখনও সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা । ৪, কখনও নিকটজনের সামনেই বন্দিদেরকে এক এক করে জবাই করা এবং দেহ টুকরাে টুকরাে করা। ৫. সকলের সামনে বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা বিভিন্ন অঙ্গে গুলি করে হত্যা করা। ৬. চোখ উপড়ে ফেলা। ৭. উলঙ্গ অবস্থায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলা। ৮. ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করা এবং মুখ থেতলে ফেলা। ৯, বস্তায় ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা অথবা বস্তাবন্দি | অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া। ১০. দড়ি দিয়ে বেঁধে লাথি, ঘুষি ও অন্যান্য আঘাতের দ্বারা থেঁতলে রক্তাক্ত করে। | মেরে ফেলা। ১১. বাঁশ এবং রােলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চিপে ধরে থেতলে দেয়া এবং শেষে হত্যা। ১২. বেয়নেট ও ধারালাে অস্ত্র দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে, কখনও পেটের সমস্ত নাড়িভুড়ি বের করে কিংবা বুক চিরে হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলা। ১৩. দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা। ১৪, পানি, অগ্নিকুণ্ড কিংবা বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা ইত্যাদি।
পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ধরন।
পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ধরন সভ্যতাবিবর্জিত মানুষের। নির্মমতা এবং নৃশংসতার চেয়েও জঘন্য ছিল। যে সমস্ত প্রক্রিয়ায় তারা নির্যাতন চালাত তা ছিল নিম্নরূপ ১, অকথ্য গালাগালি করা, মুখ ও শরীরে থুথু নিক্ষেপ করা, পানির বদলে প্রস্রাব খাওয়ানাে, মল-মূত্রের মধ্যে মুখ চেপে ধরা ইত্যাদি, ২. সিগারেটের আগুনে ছ্যাকা দেয়া, | ৩, মলদ্বার ও আশেপাশের স্থানে বরফ ও উত্তপ্ত লােহা ঢুকিয়ে দেয়া, ৪. চোখের সামনে লাইট জ্বালিয়ে আলাে দিয়ে চোখ ঝলসে দেয়া, ৫. গায়ে ও মলদ্বারে ইলেকট্রিক শক দেয়া, ৬. লাথি, ঘুষি, পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়া, ৭. আঙুলে সূচ ফোটানাে, ৮, নখ উপড়ে ফেলা, ৯. চোখ উপড়ে ফেলা, ১০. শরীর ছিলে ফেলে লবণ, মরিচ লাগিয়ে দেয়া, ১১. ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে গিটগুলাে জমাট করা, ১২. ছেলেদের অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ থেঁতলে দেয়া, ১৩, মেয়েদের যৌনাঙ্গে লাঠি, রাইফেলের নল, ধারালাে বােতল জাতীয় জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া, ১৪. ‘বাশ ডলা’ দেয়া, ১৫. বরফের চাঙরের উপর শুইয়ে দিয়ে পেটানাে, ১৬. চামড়ার তৈরি পাঞ্জা পানিতে ভিজিয়ে পেটানাে, ১৭. গরম পানি ভর্তি বােতল দিয়ে পেটানাে ইত্যাদি।
Ref: ৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ – ডা. এম এ হাসান