You dont have javascript enabled! Please enable it!

লিঙ্গ ও ধর্মভিত্তিক গণহত্যা এবং নির্যাতনের প্রকৃতি ও ধরন

যুদ্ধের প্রথম থেকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিল অল্প বয়সী স্বাস্থ্যবান যুবকেরা, যাদেরকে সম্ভাব্য মুক্তিযােদ্ধা বলে ধারণা করা হত। তরুণ। সক্ষম যুবা পুরুষ ছিল নির্বিচার হত্যার লক্ষ্যবস্তু। রােমেল তার ‘Death by. Government’ বইয়ে উল্লেখ করেন, নির্বিচারে তরুণদেরকে ঝেটিয়ে তুলে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এরপর এদের আর কাউকে পাওয়া যায়নি। মাঠে, ঘাটে, নদীর বাঁকে, জলাভূমিতে এবং সেনা ক্যাম্পগুলাের পাশে হাত-পা বাঁধা তরুণদের মরদেহ ছিল তখনকার প্রাত্যহিক দৃশ্য। কারণ একাত্তরে যে বিপুল সংখ্যক নিরীহ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের প্রায় ৮০ ভাগকে বিভিন্ন পতিত জমি, খাল-বিল-জলা, নদী ও সমুদ্র উপকূলে ফেলে দেয়া হয়। এর ফলে আমরা দেশের মধ্যে mass grave এর পরিবর্তে marsh grave আবিষ্কার করেছি। পাকিস্তানি বাহিনী অবাঙালি দোসররা বাঙালি নিধনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তলােয়ার, ছুরি, রড ও বিভিন্ন ধারালাে অস্ত্র ব্যবহার করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আমাদের নিরীহ জনগণকে হাত বেঁধে ধারালাে অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে। কিংবা তলােয়ার দিয়ে মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, কখনও টুকরাে টুকরাে করে নিকটবর্তী কুয়াে, ড্রেন, ম্যানহােল, ডােবা ও অন্যান্য গর্তে নিক্ষেপ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব অবাঙালিরা অফিস আদালত, যানবাহন এমনকি ঘরের কোণ থেকে যুবা ও পুরুষ সম্প্রদায়কে ধরে নিয়ে কখনও নিজেরা হত্যা করেছে, কখনও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় তারা। বাঙালি মেয়েদেরকেও পৌছে দিয়েছে পাকিস্তানি নরখাদকদের গুহায়। তাদের আচরণে প্রমাণিত হয়েছে, যে পদ্ধতিতে একদা তারা অত্যাচারিত হয়েছিল নিজ বাসভূমি বিহার ও অন্যান্য স্থানে, সেই একই পদ্ধতি তারা প্রয়ােগ করেছে এদেশের বাঙালি নিধনযজ্ঞে। অত্যাচারীর মনােভাবকে আত্মস্থ করে তারা। নিজেদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ও মনােবিকারকে বিকশিত করেছে। এই অত্যাচারের প্রকৃতির সাথে নাজিবাহিনী কর্তৃক ইহুদিদের অত্যাচারের প্রচণ্ড সামঞ্জস্য ছিল। একাত্তরের হিন্দুধর্মাবলম্বী হওয়া ছিল মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অপরাধ। এর জন্য পথে পথে পুরুষদের যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করা হত-খাৎনা করা হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য। এই লিঙ্গ ও ধর্মভিত্তিক অযােদ্ধাদের ঘেরাও, গুম ও হত্যার সাথে নাৎসী বর্বরতার প্রচণ্ড মিল পাওয়া যায়। পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরের নয় মাসে ছেলে-বুড়াে, নারী-শিশু সবাইকেই ঝাড়ে-মূলে নিধন করার চেষ্টা করেছে। এই হত্যার জন্য কেবল পাকিস্তানি বাহিনীর তরুণ অফিসার ও সাধারণ সৈনিকরাই দায়ী ছিল না। এটাও মনে করার কারণ নেই যে, ধর্মান্ধতা ও প্রতিহিংসার কারণে আপন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিচু পর্যায়ের অফিসার ও তাদের সহযােগীরা এদের হত্যা করেছে। বরং এটা ছিল সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নীল নকশা অনুযায়ী একটি জাতিগত নিধন। এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, বিগ্রেডিয়ার আরবাব, জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ অনেকেই। ন’মাসব্যাপী যুদ্ধে সম্মুখ সমরে যতাে না বাঙালি জনসাধারণ আত্মাহুতি দিয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ নির্বিচার গণহত্যা, গুম, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে কেবল ঢাকা শহরেই সাত হাজার এবং পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ত্রিশ হাজার লােক পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হন। বলে সুইডেন ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে জানা যায়। যেহেতু ঐ সময় কোন বিদেশী সাংবাদিকের পক্ষে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না এবং পরবর্তীতে বাড়ি ও এলাকাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যানও নেয়া যায়নি, তাই কিছু পরিসংখ্যান অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। ইদানিংকালে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির পক্ষ থেকে ‘৯৯ এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০০০ পর্যন্ত অনুসন্ধানী কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন সংক্রান্ত একটি প্রায় ১• সংখ্যা বের করা হয়েছে। ২৫ থেকে ২৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত তেইশ থেকে ৮ হাওর লােককে কেবল ঢাকা শহরেই হত্যা করা হয়। এছাড়া পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টঙ্গী থেকে বুড়িগঙ্গা হয়ে জিঞ্জিরা এবং মিরপুর ব্রিজ থেকে আদমজী পর্যন্ত প্রায় নব্বই হাজার লোেক বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করে। এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরের অর্ধেক লােক যে যেখানে পারে পালিয়ে যায়। একই অবস্থা ছিল চট্টগ্রামেও। এপ্রিলের মধ্যে এক কোটি লােক ভারত ও সীমান্ত বর্তী এলাকায় শরণার্থী হয়। এরই মধ্যে ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭১ সনে কিশােরগঞ্জের বরইতলা নামক স্থানে সংঘটিত গণহত্যাযজ্ঞের যে নৃশংসতা পরিলক্ষিত হয় গণহত্যার বিশ্ব ইতিহাসে তার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক সকালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর সহযােগী দালালরা প্রায় পনেরােশ পুরুষকে বরইতলা গ্রামের রেল লাইনের পাশে জড়াে করে। প্রলােভন দেখানাে হয় যে তাদেরকে আইডেনটিটি কার্ড দেয়া হবে, যাতে তারা কোনরকম ক্ষতির শিকার না হন। এঁদেরকে দিয়ে জোরপূর্বক পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করানাে হয়। তারপর এই লােকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেককে উপস্থিত দালালরা আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত ইত্যাদি বলে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ইতিমধ্যে জোহরের নামাজের জন্য কিছু লােক নিকটস্থ মসজিদে প্রবেশ করেন। এই সময় হঠাৎ খবর আসে মুক্তিযােদ্ধারা একজন পাকিস্তানি আর্মিকে হত্যা করেছে (কিন্তু খবরটা সত্য ছিল না, ঐ পাকিস্তানি আর্মি পরে সেখানে ফিরে এসেছিল)। এই খবর আর্মি ক্যাপ্টেনকে উন্মাদ করে তােলে। তারা উপস্থিত লােকদের একজনের বহু অন্যের সঙ্গে বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তারপর হুকুম দেয় ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করার। কিন্তু এত লােককে এভাবে হত্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না। শেষে তাদেরকে রেল লাইনের ওপর বসিয়ে দেয়া হয় এবং  ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ ধরনের শাবলের আঘাতে একে একে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা হয় প্রত্যেকের মাথা। এরপর মৃতদের ওপর ব্রাশফায়ার করা হয়। এত কিছুর পরও যাদের দেহ একটু আধটু নড়াচড়া করছিল তাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করা হয়। ঐদিন বরইতলায় পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরােচিত হত্যাকান্ডের নির্মম শিকারে। পরিণত হন ৩৬৬ জন গ্রামবাসী, মারাত্মক আহত হন আরও ১৩৪ জন। ময়মনসিংহ মুকুল নিকেতনের অধ্যক্ষ আমির আহমেদ চৌধুরী ‘৭১ সনে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। ক’জন পাকিস্তানি আর্মি ও দালাল তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্টে দু’জন সেনা অফিসার তার হাত-পা বেঁধে সরু গভীর একটি গর্তে ফেলে দেয়। তারপর ইট ও ঢিল ছুঁড়ে তাকে নির্যাতন করে। সারাদিন পর মুমূৰ্থ অবস্থায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার কাদির খানের সামনে হাজির করা হয়। পায়ে দড়ি বেঁধে মাথা নিচের দিকে দিয়ে তাঁকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। ঐ অবস্থায় তার হাত বেঁধে দেয়া হয় বুকের সাথে। এরপর লাঠি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বুক ও পিঠ রক্তাক্ত করে। এভাবে প্রায় ছ’ঘন্টা অতিবাহিত হবার পর তাকে ব্ৰহ্মপুত্র নদের পাড়ে সারারাত খালি গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। অথচ দাঁড়িয়ে থাকার মতাে অবস্থা তার ছিল । সকালে আবার তাকে কেলানাে হয় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে এবং দুটি বাঁশ দিয়ে তৈরি বাঁশকল’ নামের এক বিশেষ যন্ত্র দিয়ে চিপে চিপে তার বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ থেতলে দেয়া হয়। এরপর আমির আহমেদ চৌধুরীকে মাটির নিচের  একটি গােপন কক্ষে রাখা হয়। ঐ কক্ষটি শুধুমাত্র অত্যাচার করার কাজেই ব্যবহৃত হত। প্রায় সারাক্ষণই কালাে কাপড় দিয়ে তার চোখ বেঁধে রাখা হত। এভাবে আরও আট দিন ক্রমাগত নির্যাতনের পর ক’জন কাবুলীওয়ালা হানাদারদের সঙ্গে দেনদরবার করে তাকে মুক্ত করে। আমির আহমেদ চৌধুরী তার ওপর পরিচালিত ঐ দুর্বিষহ অত্যাচারের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে কী নির্মমভাবে কত নিরপরাধ লােককে ধরে এনে ওখানে হত্যা করা হয়েছে। তিনি দেখেছেন, হানাদাররা হত্যা করার আগে নিরপরাধ মানুষগুলােকে পিটিয়ে অর্ধমৃত করে ফেলত; তারপর জবাই ও গুলি করে হত্যা করে উল্লাস করত। ধারালাে ছুরি ও তলােয়ার দিয়ে বালির ওপর জবাই করা | হত, যাতে নিমেষে বালি সব রক্ত শুষে নিতে পারে। তারপর ঐসব হতভাগ্যের লাশ ফেলে দেয়া হত ব্রহ্মপুত্র নদের গভীরে, আর সেগুলাে ভাসতে ভাসতে চলে যেত দূর অজানায়। ‘৭১ সনে পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যাযজ্ঞের লেলিহান থাবা বিস্তৃত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলােতেও। এসব গ্রামের এমন সব সাধারণ লােককে তারা সপরিবারে হত্যা করেছে, যাদের সঙ্গে যুদ্ধের কোনরকম প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। রাজধানী থেকে বহু দূরে নদীবহুল অঞ্চল বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার রাজিহার এরকম একটি গ্রাম। একাত্তর সনে ঐ গ্রামের কমলিনী হালদারের পরিবারের নয় জন সদস্য পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিনিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বৃদ্ধা কমলিনী হালদার উল্লেখ করেন: চৈত্র মাসের প্রথম দিনে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়িতে আগুন দেয়। মিলিটারি এলে সে সময় সাধারণ লােকজন স্বাভাবিক কারণেই ভয়ে পালিয়ে থাকতেন। এ গ্রামটি ছিল খ্রিস্টান অধ্যুষিত। ফাদার তাদেরকে সান্ত্বনা দিতেন, “বাইবেল ও ক্রুশ সাথে রাখাে, মিলিটারি তােমাদের কিছু বলবেনা।’ কিন্তু ওরা ঐ গ্রামে হানা দেয় নবার। একবার আষাঢ় মাসে দুটো স্পিড বােটে ১৫-১৬ জন মিলিটারি ও রাজাকাররা আসে। ওরা বলে, “খালে একটি নৌকা আটকে পড়ায় স্পিড বােট যেতে পারছেনা, ক’জন লােক দরকার। তােমাদের কোন ভয় নাই।” এভাবে মিথ্যে বলে ওরা কমলিনী হালদারের বাড়ির নয়জন পুরুষ সদস্যকে ধরে নিয়ে যায় এবং হাটের পাশে গুলি করে পানিতে ফেলে দেয়। পরে এদের মধ্যে দু’জনকে বাঁচানাে সম্ভব হলেও বাকিরা পানির মধ্যে ছটফট করতে করতে মারা যান। ঐ একই গ্রামে সত্তর বছরের বৃদ্ধ শরৎ বাবু উঠানে বসে খই খাচ্ছিলেন। তাঁর গায়ে ছিল ভীষণ জ্বর। মিলিটারি আসতে দেখে ভয়ে দৌড় দেন। আরও দু’জন তরুণের সঙ্গে এই বৃদ্ধ শরৎ বাবুকেও পাকিস্তানি সেনারা ধরে এনে তারই উঠানের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। এরপর নিথর দেহ নিয়ে শরৎ বাবু হা করে তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে, তার মুখের মধ্যে তখনও সাদা সাদা খই। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের ভয়ানক হিংস্র করে তুলত। অথচ যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধচলাকালে এই স্লোগানটি ছিল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির প্রতীক। মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্ত নি শাসকচক্র তাই ‘জয়বাংলা’র উপর তাদের হিংস্র থাবা বিস্তার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকার তেজগাঁও-এ পাকিস্তানি বাহিনীর এরকম একটি নৃশংস ঘটনা ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে। ‘৭১-এর এক সকালে তেজগাঁয়ে নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক শিশু বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়। রাস্তায় টহলরত পাকিস্তানি বাহিনী সেই স্লোগান শুনে সাথে সাথে ছেলেটির বাসার মধ্যে ঢুকে যায় এবং পতাকার লাঠিটি তার মাথার তালুতে সজোরে সেঁধিয়ে দেয়। এরপর বাসায় অবস্থানরত ছেলেটির বাবা ও দাদাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাদের সামনেই মা ও দাদীকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে হতভাগ্য দাদা ও বাবাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে চলে যায়। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের কারণে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা এমন অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটায়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা সবচেয়ে বর্বরােচিত এবং নৃশংস গণহত্যা চালায় সৈয়দপুর শহরের কাছে গােলাহাটে। বিহারি অধ্যুষিত সৈয়দপুর ২৩ মার্চ থেকেই কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমান যেখানে পুলিশ ফাড়িটি অবস্থিত, একাত্তর সনে সেখানে চেকপােস্ট বসানাে হয়। কোন বাঙালিকেই এই চেকপােস্ট পেরিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। এমনকি বাসের মধ্যে কাউকে পেলেও তাঁকে নামিয়ে ফাঁড়ির মধ্যে নিয়ে হত্যা করা হত। এভাবে এখানে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে অসংখ্য বাঙালিকে। ১৩ জুন পাকিস্তানি আর্মিরা বাঙালিদেরকে বিশেষ করে হিন্দুদেরকে মিটিংয়ে বসার নাম করে ডেকে পাঠায়। প্রায় ১৫০ জন পুরুষ লােককে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। গাদাগাদি করে তালাবদ্ধ অবস্থায় তাদেরকে রাখা হয় তৎকালীন | আইয়ুব খান হাউজিং প্রজেক্টের তিনটি কক্ষে। আলাদা আলাদা করে সবাইকে ডেকে নিয়ে বাড়ির সম্পদ, অলঙ্কার, টাকা-পয়সার খবর নেয়া হয়। এসব সূত্র ধরে লুটতরাজ চলে একটানা সাতদিন। এরপর তাদেরকে ভারতে পৌছে দেয়ার নাম করে স্টেশনে নেয়া হয়। কৌশলে কয়েকজনকে বাড়িতে পাঠিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদেরকেও স্টেশনে আনা হয়। স্টেশনে একটি ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগানাে চারটি বগি এই বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ-শিশুদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পেছনের বগি দুটোতে উঠানাে হয় নারী ও শিশুদের এবং বাকি দুটোতে পুরুষদের। জানালা দরজা বন্ধ করে চারিদিকে সশস্ত্র পাকিস্তানি আর্মি ও বিহারিদের কড়া প্রহরা বসানাে হয়। একসময় ট্রেন চলতে শুরু করে। দু’কিলােমিটার যাবার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। তারপরই শুরু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ । একজন একজন করে নামানাে হয় আর খােলা তলােয়ারের কোপে দুখস্ত করে ফেলা হয় তাঁদের দেহ। জানালা ভেঙে যাঁরা পালাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা।  হয়। গােলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকাণ্ড থেকে সেদিন কয়েকজন পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও একজন নারী কিংবা শিশুও পালাতে পারেনি। উপর্যুপরি ধর্ষণ শেষে ঐ নারীদেরকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রকাশিত এক। তালিকা থেকে দেখা যায়, ঐদিন গােলাহাটে নিহত হন ৪১৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে সবসময় হত্যার জন্যই হত্যা করা হয়েছে। এমন নয়। বিপুলসংখ্যক বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোেকদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের সম্পদ লুট করবার জন্য। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় দুঃখজনক তথ্য উঠে এসেছে যে, ঐ সময় এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকদের অনুগত কিছু বাঙালি পুলিশও এ লুটপাটে অংশগ্রহণ করে। অনেক অবাঙালি যুদ্ধাপরাধী এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ এদেরই সহযােগিতায় পরবর্তীতে দেশত্যাগ করে। যাবার সময় তাদের সম্পদের বিরাটাংশ তুলে দেয় যুদ্ধাপরাধী ও তাদের নতুন সহযােগীদের হাতে। যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী যুদ্ধের সময় দেশত্যাগ করেছিলেন, যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে তারা তাদের সম্পদের কিছুই আর খুঁজে পাননি। স্বাধীনতার পরপরই এ অঞ্চলের রাজাকার ও অন্যান্য দালালদের হঠাৎ করে বড়লােক হয়ে ওঠার এটি একটি অন্যতম কারণ। হত্যা ও নির্যাতনের দ্বারা সম্পদ আহরণের মাধ্যমে এই রাজাকার ও দালালরা পরবর্তীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে। বর্তমান নির্বাচন  প্রক্রিয়ায় নগদ নারায়নের ভূমিকা প্রধান হওয়ায় এই ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র ক্ষমতায় আসবার কারণে এবং বিচারহীনতার বিষয়টি গ্রহণযােগ্য হবার কারণে সমাজে ন্যায়, যুক্তি ও সুবিচারের অধিকার অদৃশ্য হয়েছে। সমাজ নিপতিত হয়েছে সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুরতার অন্ধ গুহাভ্যন্তরে। সভ্যতার আলাে, স্বাধীনতার আলাে সবকিছু আজ অদৃশ্য। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং বীভৎসতম নারী নির্যাতন শিশু ও নারীদের প্রতি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের যে ইতিহাস সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’র গবেষণার মাধ্যমে। প্রকাশিত হচ্ছে তা সমগ্র বিশ্ব বিবেককে চমকে দিয়ে এক ভয়ঙ্কর অক্ষমতার গ্লানিতে নিপতিত করবে। বাঙালি নারীদের প্রতি পাকিস্তানি সেনাদের সহিংসতা শুধু হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমাদের হিসাব অনুযায়ী প্রায় সাড়ে চার লাখ নারীকে শহর-বন্দর-গ্রামে ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করা হয়। এই মেয়েদের। অনেককে তাদের স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মাসহ পরিবারের সকলের সম্মুখে নির্বিচারে ও পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। তারা সর্বসমক্ষে এই ধরনের পাশবিক অত্যাচার চালায় কেবলমাত্র ঐ মেয়েদেরকে অপমানিত ও নির্যাতন করার জন্যই নয়, বরং সমস্ত পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে মানসিকভাবে আহত ও পঙ্গু করার জন্যও। ‘৭১-এ এরকম হাজার হাজার নির্যাতিতা চরম দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন তাদেরকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে দুঃসহ অপমান ও  অত্যাচারের স্মৃতি। ‘৭১-এ পশুর অধম পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরােচিত নির্যাতনের শিকার হন টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের ছাব্বিশা গ্রামের ভানু বেগম। পাকিস্তানি বাহিনী ঐ গ্রামে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত একটি যুদ্ধের পর। ঐ সময় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওরা গ্রামের মধ্যে নির্বিচারে হত্যা ও অগ্নিসংযােগ শুরু করে। ধর্ষণ করে আনুমানিক ২০ জন নারীকে। ভানু বেগমের বাড়িও গ্রাস করে নেয় আগুনের লেলিহান শিখা। এক পর্যায়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ভানু বেগমকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি প্রতিবাদ করেন। তখন ঐ সেনারা তার এক বছরের শিশুসন্তানকে প্রজ্বলিত আগুনে ছুড়ে ফেলতে উদ্যত হয়। ফলে ভানু বেগম ঐ পশুদের পাশবিক বাসনার নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়। তবু সেখানেই শেষ হয়নি অসহায় | ভানু বেগমের উপর বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম নির্যাতন। ধর্ষণ শেষে জ্বলন্ত আগুনে চেপে ধরে নরপশুরা ঝলসে দেয় তার শরীরের অংশ। এরকম আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন ব্রাউমিলার তার ‘Against Our Will’ গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় ।। একাত্তরে দু’জন পাকিস্তানি সৈন্য জোরপূর্বক এক নবদম্পতির ঘরে প্রবেশ করে। অন্যান্য সৈন্য তখন পরিবারের সদস্যদেরকে বন্দুকের মুখে পাহারা দেয়ার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে। পরিবারের সদস্যরা সবাই নবদম্পতির আর্তচিৎকার এবং সেইসঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের হুংকারে দিশেহারা। তারপর নীরবতা এবং এরপর নববধূর করুণ আর্তচিৎকার। এরপর পুনরায় নীরবতা। ক্ষণে ক্ষণে গােঙানির যে আওয়াজ এতক্ষণ আসছিল একসময় তাও থেমে যায় এবং তারপর নেমে আসে অনন্ত নীরবতা। তারপর একজন সৈন্য বেরিয়ে আসে এলােমেলাে পােশাক নিয়ে। অন্যদেরকে দেখিয়ে সে দন্ত বিকশিত করে হাসে। এরপর একে একে ছয়জন পাকিস্তানি  সৈন্য গ্রামের এই নিস্পাপ নববধূকে পালাক্রমে ধণ করার পর অস্ত্র উচিয়ে। বেরিয়ে যায়। তখন মেয়ের বাবা ঘরে প্রবেশ করে কন্যাকে খাটিয়ার উপর নিথর ও রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেন। জামাইকে দেখতে পান নিজ বমির উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের নিমর্ম ও বীভৎস ধর্ষণ ক্রিয়ার বর্ণনা করেছেন সুইপার রাবেয়া খাতুন। পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় শহরগুলাের অভিজাত এলাকা থেকে বহু কিশােরী যুবতী মেয়েকে ধরে এনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে বন্দি করে রাখে এবং প্রতিদিন এদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। যেসব ব্যারাকে মেয়েদের আটক রাখা হয় পাকিস্তানি সেনারা কুকুরের মতাে জিভ চাটতে চাটতে, নানা অঙ্গভঙ্গি করে, বিকৃত উল্লাসের মধ্যে সেখানে প্রবেশ করত। তারা ব্যারাকে ব্যারাকে প্রবেশ করে প্রতিটি যুবতী মহিলা ও বালিকার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করার পর মাটিতে লাথি মেরে ফেলে দিত। তারপরই শুরু করত বীভৎসতম ধর্ষণযজ্ঞ। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ধর্ষণ শুরু করে দিত। ধর্ষণ শেষে ঐ পশুরা ধারালাে দাঁত বের করে মেয়েদের স্তন ও গালের মাংস কামড়ে রক্তাক্ত করে দিত। এতে অল্প বয়সী অনেক মেয়ের। স্তনের ত্বকসহ বুকের মাংস উঠে আসত। যুবতীদের গাল, পেট, বক্ষ, ঘাড়, পিঠ ও কোমরের অংশ রক্তাক্ত হয়ে যেত। যারা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করত ছোঁ মেরে তাদের স্তন টেনে ছিড়ে ফেলে দিত তারা। যােনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট, ধারালাে ছুরি ইত্যাদি ঢুকিয়ে বীভৎস প্রক্রিয়ায় কষ্ট দিয়ে ঐসব মেয়েদেরকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে বন্দি মেয়েদের ওপর এমন অনেক নির্যাতনের ঘটনা জানা যায়। এখানে অল্প বয়সী বেশ কয়েকটি মেয়েকে উলঙ্গ অবস্থায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ঐ অবস্থায় কিছুসংখ্যক মাতাল পাকিস্তানি আর্মি অফিসার ও সেপাই তাদের বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করতে এই মেয়েদের বাধ্য করে। পাশবিক নির্যাতনের যন্ত্রণায় এই মেয়েরা যখন।  কাঁদছিল, বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন জাতিগত গর্বে বিজয়ের উল্লাস করছিল। এমনি একটি মুমূর্ষ মেয়ে যখন পানি চাচ্ছিল তখন ঐ নরপশুরা তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। যতক্ষণ না একটি মেয়ের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত চলছিল তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন। এই পাশবিক অত্যাচারে কত নারী অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা বাঙালি নারী সম্প্রদায়ের ওপর চালিত ধর্ষণ ও অত্যাচারের সময় বিশেষ কতকগুলাে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। ১. মার্চ-এপ্রিলে দিনগুলােতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু মেয়েদেরকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। কখনও কখনও ধর্ষণের পর তাদেরকে রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য দোসরদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ধর্ষণ ও ভােগ। শেষে হত্যা করার জন্য। মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েদেরকে (যাদের সংখ্যা মােট নির্যাতিতার শতকরা ৮০ ভাগ) যেখানে পেয়েছে সেখানেই ধর্ষণ করেছে, বিশেষ করে একাত্তরের এপ্রিল থেকে। কখনও তাদের বাসস্থলে, এককভাবে কিংবা পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন ও নিকটজন বিশেষ করে স্বামীসন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মায়ের সামনেই ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের এই বর্বর প্রক্রিয়াটি ব্যবহৃত হয়েছিল ধর্ষিতা এবং তাদের আত্মীয়স্বজনসহ বাঙালি সম্প্রদায়ের অহঙ্কার ও অস্তিত্বকে আঘাত করার জন্য। সেই সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর বিকারগ্রস্ত প্রকৃতি চরিতার্থ করবার জন্য।  ৩, কখনও তারা বাঙালি মেয়েদেরকে তাদের ক্যাম্পে বন্দি রেখে ভােগ্যপণ্য ও যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করেছে। ৪, কখনও একক সম্পদ ও দাসী হিসাবে মেয়েদেরকে তারা এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে কিংবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে। ৫. প্রাথমিক অত্যাচারের সময় অথবা দীর্ঘভােগের পর পালিয়ে যাবার সময় পাকিস্তানি বাহিনী এই মেয়েদের স্তন, উরু, যৌনাঙ্গসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের অংশ কেটে নিয়ে গেছে অদ্ভুত এক fetichistic crisis ও মনােবিকারে আক্রান্ত হয়ে। এই নির্যাতিত নারীদের অনেকে ধর্ষণজনিত চরম আঘাতের কারণে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে ধর্ষণজনিত কারণে Pelvic Inflamatory Diseases ও অন্যান্য যৌনরােগে আক্রান্ত হয়ে চিরবন্ধ্যাত্ব এবং অন্যান্য জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছেন। নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে অনেকে চিরবিষণ্ণতা, ন্দ্রিাহীনতা, আত্মগ্লানি ও ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছেন কিংবা নিঃশেষ হয়ে গেছেন। যে সমস্ত বিবাহিতা নারী যুদ্ধশেষে আমাদের সমাজে গৃহীত হতে পেরেছেন, অনেকক্ষেত্রে তাদের সন্তানসন্ততি, স্বামী ও পরিবার প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কটু মন্তব্য ও রূঢ় আচরণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তবু বাস্তবতা হল, অপহৃতা, ধষিতা ও যৌনদাসীতে পরিণত হবার পরও আমাদের অনেক পরিবার প্রবল সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যেও এই নির্যাতিত, অপমানিত নারীদেরকে গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুও এদের সম্মান রক্ষার্থে এদের নাম দেন বীরাঙ্গনা। তবে এতে তাদের সম্মান রক্ষা হয়নি। অত্যাচারী পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিচারের ব্যবস্থা করা গেলে হয়ত তাঁদেরকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা যেত ও তাদের অহঙ্কারকে ফিরিয়ে দেয়া যেত, কিন্ত তা এখনও আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

Ref: ৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ – ডা. এম এ হাসান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!