You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.02 | মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ত্রিপুরায় অভূতপূর্ব জনজাগরণ | দেশের ডাক - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ত্রিপুরায় অভূতপূর্ব জনজাগরণ

আগরতলা, ২৭ মার্চ- ওপারে পূর্ব বাংলায় জনগণের স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে স্তব্ধ করার জন্য করাচির সামরিক ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খা পূর্ব বাংলার বুকের উপর দিয়ে যে জঙ্গি শাসনের বর্বরতা চালিয়েছেন, তার প্রতিবাদে সীমান্তের হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ক্রোধে ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
ভাের হবার সাথে সাথেই আগরতলা স্বতঃস্ফুর্ত বন্ধ চলছে। রাজধানী আগরতলার দোকানপাট, স্কুলকলেজ, অফিস-আদালত অচল। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা সীমান্ত পার হয়ে ওপারে সংগ্রামী মানুষকে সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপন করতে এগিয়ে গেল। দুপক্ষের সীমান্ত পুলিশ নীরব সমর্থকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে রইল। ছাত্র, যুবক এমনকি মহিলারাও পূর্ব বাংলার সংগ্রামের খবর জানবার জন্য মাইলের পর মাইল ভেতরে হেঁটে গেছেন। ইয়াহিয়া চক্রের দখলদারী বাহিনীর আক্রমণে ঢাকা, কুমিল্লা ও অন্যান্য শহরে সংগ্রামী জনতার রক্ত স্নান। একদিকে তাদেরকে যেমন বেদনার্ত করেছে অন্যদিকে শত্রুর মােকাবিলায় পূর্ব বাংলার বীর জনগণের প্রতিরােধে সংগ্রামের খবরে তাদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেতু উড়িয়ে দিয়ে, পােলের লাইন তুলে, রাস্তা কেটে পূর্ব বাংলার সর্বত্র ব্যারিকেড গড়ে তােলা হয়েছে। পুলিশ ও ইস্ট-পাকিস্তান রাইফেলের বাঙালি সৈনিকরা সংগ্রামী জনতার পক্ষ নিয়েছে। সীমান্ত থেকে বহু ইস্ট-পাকিস্তান রাইফেলের ইউনিট তুলে নিয়ে সামরিক বাহিনীর ছেড়ে দেয়া অঞ্চলগুলােতে বসানাে হয়েছে।
ওপারের ছাত্র-যুবকরা এপারের ছাত্র-যুবকদের সমর্থনকে অভিনন্দিত করল। আলােচনা চলাকালেই ইয়াহিয়া খা কীভাবে আওয়ামী লীগ প্রধানকে প্রতারণা করেছে আলােচনা বৈঠক আড়ালে ইয়াহিয়া খার গােপন ষড়যন্ত্রই লুকানাে ছিল এসব কথাও বলল। আলােচনা বৈঠকের সুযােগ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কয়েক হাজার সৈন্য নামাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম অবস্থায় স্বেচ্ছাবাহিনী সৈন্যদের বন্দরে নামতে দেননি, কিন্তু যে মাত্র খবর পাওয়া গেল ইয়াহিয়া খাঁ শেখ মুজিবরের প্রায় অধিকাংশ দাবি মেনে নিয়েছেন, তখন তার সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করে নিলেন আর সাথে সাথে ইয়াহিয়া খাঁর হাজার হাজার পাক হানাদার বাংলাদেশে মাটিতে নামল। কিন্তু এই ঘটনা পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতাকে এতটুকু বিমর্ষ করতে পারেনি, ছাত্রসমাজ ঘঘাষণা করল, কোনাে শহর বা গ্রামাঞ্চলে সামরিক বাহিনীকে ঢুকতে দেয়া হবে না। আরাে জানা গেল, আওয়ামী লীগ মওলানা ভাসানির জাতীয় আওয়ামী পার্টি ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ বাংলাদেশের জনগণের এই মুক্তি সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।
পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপনের জন্য সীমান্ত পার হয়ে অগণিত মানুষের রাস্তা যখন ওপারে ভেঙে পড়ছে, তখনই আগরতলা শহরের রাস্তাঘাট ছাত্র-যুবকদের মিছিলে মুখর। রাস্তার মােড়ে মােড়ে ইয়াহিয়া’র কুশপুত্তলিকা পােড়ানাে চলছে। মিছিলে মিছিলে স্লোগান উঠছে পূর্ব বাংলার গণহত্যা বন্ধ কর, ইন্দিরা সরকার পূর্ব বাংলার অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দাও, মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র দাও, রসদ দাও।
প্রতিটি রেডিওর সামনে লােকে লােকারণ্য। পূর্ব বাংলার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসায় মুখর জনতার কেউ কেউ তথাকথিত নকশালী বিপ্লবী(?)দের সন্ত্রাস সম্পর্কে কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য করতেও ছাড়েনি। এই ইন্দিরা সরকারের নপুংসক ভূমিকায় অনেকে উম্মা প্রকাশ করেছেন। অথচ কয়েক বছর আগে তিব্বতের আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রতিক্রিয়ায় পাণ্ডা দালাইলামাকে নিয়ে ভারত সরকার কি নাচানাচিই না করেছেন। সেখানকার সংগ্রামের সাথী কিছু কিছু ছাত্র-যুবক মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে এসে রাজ্য কমিটির সাথেও দেখা করেন। সম্পাদক তাদেরকে অভিনন্দন জানান এবং পূর্ব বাংলার এই সংগ্রামে পার্টির অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা বলেন। তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, পার্টি এই সংগ্রামের স্বপক্ষে সমস্ত প্রকার শক্তি সমাবেশ করে পূর্ব বাংলায় করাচির হিটলারি ঘাতকদের হাতে গণহত্যা বন্ধ, ইন্দিরা সরকার যাতে এই সংগ্রামে অস্ত্র, রসদ, আশ্রয় নিয়ে এগিকে আসেন- সেসব দাবি তুলবেন। তিনি যুব ছাত্রদেরকে বলেন, পূর্ব বাংলার সংগ্রামের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সংগ্রামের অনেক দিক থেকে সাদৃশ্য আছে। তিনি বলেন, আমরা পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী সীমান্তের দুপারের হাজার হাজার মানুষের মনে যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়েছে তা দুই দেশের জনগণের শত্রুকে আতঙ্কগ্রস্ত করবে। এই সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হবেই- এই সংগ্রামে চাই সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ, শােষিত জনগণই তার নেতৃত্ব দিতে পারে, আর গ্রামাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ কৃষক, জনতা এই সংগ্রামে সামিল না হলে জমিদার ও শােষক শ্রেণীর তাঁবেদার প্রতিক্রিয়ার পাণ্ডাদের হিংস্র আক্রমণের মুখে দাঁড়ানাে শক্ত হবে।
আগরতলা শহরের রাস্তার মােড়ে মােড়ে জনতা ওপার থেকে আগত ছাত্র-যুবক-জনতা মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিনন্দন জানান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভুলে গিয়ে সহযােদ্ধাদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। এই দৃশ্য ভােলা যায় না। সবার মুখে এক কথা, শ্ৰেণী শত্রুদের বিরুদ্ধে এই সশস্ত্র সংগ্রামে কীভাবে দেশ-বিদেশের গণসমর্থন আদায় করা যায়। যদিও চরিত্রগতভাবে ভিয়েতনাম ও পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রাম ভিন্ন, পূর্ববঙ্গের সংগ্রাম মূলত জাতীয়তাবাদী, শুধু জনতা একে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং ভিয়েতনামী মানুষের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা পূর্ব বাংলার জনগণের দেশপ্রেমী সংগ্রামকে প্রভাবিত করছে।
ত্রিপুরার সমস্ত গণতান্ত্রিক গণসংগঠনগুলাে এরই মধ্যে পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। গত ২৭ মার্চ ছাত্রদের ডাকে আগরতলা বন্ধ হয়ে গেল। বিভিন্ন মহকুমার ছাত্র-যুবকদের ডাকে আঞ্চলিক বন্ধ পালিত হয়েছে। গত ২১ মার্চ, ৬ ফেব্রুয়ারি কমিটির আহ্বানে দশ সহস্রাধিক ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কর্মচারীর এক দৃপ্ত মিছিল থেকে দাবি তােলা হয়েছে। পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধ কর, ইন্দিরা সরকার পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র দাও, রসদ দাও, অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দাও। মােটর শ্রমিক ও ২ এপ্রিল রাজ্যব্যাপী বন্ধের ডাক দিয়েছেন। ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (এস.এফ.আই) গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন, মিন্টু এরই মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এগিয়ে এসেছে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য কমিটি তার বিভিন্ন ইউনিটগুলােকে এই গণঅভ্যুত্থানের স্বপক্ষে, করাচির সামরিক প্রভুদের নির্দেশে পূর্ব বাংলায় এই ফ্যাসিস্ট বর্বরতা বন্ধের দাবিতে জনসমাবেশ সংগঠিত করার জন্য বলেছে। পূর্ব বাংলার বীর যােদ্ধা যারা পূর্ববঙ্গের গ্রাম ও শহরে হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় বড় সেতু, রেল, রাস্তা উড়িয়ে দিয়ে স্থানে স্থানে ব্যারিকেড গড়ে স্লোগান তুলেছেন ‘ইয়াহিয়া খাঁর হিটলারি ঘাতকদের এক তিলও এগুতে দেবে না। তাদের সমর্থনে আগরতলা সফরে ২ এপ্রিল এক সমাবেশের আয়ােজন করেছে কমিটি।

সূত্র: দেশের ডাক
০২ এপ্রিল, ১৯৭১