You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.21 | মতলব কী? | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মতলব কী?

রাজ্যসভায় কমিউনিস্ট সদস্য শ্রীসরদেশাইয়ের চাপে পড়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীশরণ সিং যখন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনাে তদন্ত কমিশন গঠনের ব্যাপারে ভারত সরকার অন্য কোনাে সরকারের কর্তৃত্ব স্বীকার করবেন না, ঠিক তখনই সংবাদে প্রকাশ আগামী ২৪ নভেম্বর মার্কিন সিনেটের আটজন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল কলকাতায় আসছে। এটি নাকি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল। এই প্রতিনিধি দলের আসার উদ্দেশ্য ঠিক জানা না গেলেও, যে পটভূমিতে তাদের আগমন তা উদ্বেগজনক সন্দেহ নেই। খবর পাওয়া গেছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন ছ’জন সদস্য নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলােচনার জন্য তারা ভারতে আসবেন। তারই। পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সিনেটের এই প্রতিনিধি দলকে পাঠানাে অসম্ভব নয়।
নিক্সনের প্রস্তাবিত তদন্ত কমিশনের উদ্দেশ্য শ্রীসরদেশাই ফাঁস করে দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশ সদস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে নীতিগতভাবে মৌখিক মতৈক্য দেখাবে, কিন্তু কার্যত এই বলে বায়না ধরবে যে, ভারত যেন বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে। এই কুমতলবে আলােচনা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারলে মার্কিন সরকার বিশ্ব জনমতের কাছে এমন একটা ধারণা সৃষ্টির আশা রাখেন যে, ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে যথার্থই হস্তক্ষেপ করছে।
দ্বিতীয়ত, কমিশন খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে। দুর্বল স্থানগুলাে খুঁজে বের করে তারা চেষ্টা করবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টি করতে। এছাড়া জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকেও যাতে এনে বসানাে যায় তারও চেষ্টা চলবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করা এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করে রাখার জন্যই এটা একটা মার্কিন ফাদ।
এই বিষম ফাঁদে ভারত কখনােই পা বাড়াতে পারে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রীশরণ সিং বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনাে কমিশন গঠন সম্বন্ধে নীতিগত আপত্তির কথা ঘােষণা করলেও কোন রুদ্ধপথে শনি ঢুকবে বলা যায় না। প্রথম প্রশ্ন, নিক্সন তেমন কোনাে কমিশন পাঠালে ভারত সরকার তাদের কীভাবে গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের সঙ্গে আদৌ কোনাে আলােচনায় বসবেন কি না। শ্ৰীমতী গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে সেখানকার রাষ্ট্রপতি ও প্রশাসন কর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশদ আলােচনা করে এসেছেন। যেখানে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া খানের উপর সরাসরি চাপ দেয়া
দরকার সেখানে তা না করে আলােচনার জন্য নিক্সনের কোনাে কমিশনকে ভারতে পাঠাবার উদ্দেশ্যটাই অভিসন্ধিমূলক। সুতরাং এ ধরনের কোনাে কমিশনকে আমলই দেয়া উচিত নয়।
গােড়ায় মার্কিন কর্তারা চেষ্টা করেছেন বিবাদের সূত্রটা ভারত ও পাকিস্তানের মাঝখানে টেনে আনতে। তারই জন্য তারা বার বার পীড়াপীড়ি করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলােচনা বৈঠক বসাতে। তেমন একটা বৈঠক বসাতে পারলেই মার্কিন উদ্দেশ্য সফল হতাে- লােকে জানতাে বিরােধটা ভারত ও পাকিস্তানেরই মধ্যে। ইয়াহিয়া খানের বর্বরতা ও তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চাপা পড়তাে তাহলে। সেই দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হওয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা এখন নতুন পথ খুঁজছে। নিক্সনের তদন্ত কমিশন গঠন যে সেই উদ্দেশে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ভারতের বুকে বসে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে আলােচনার সুযোেগ মার্কিন কমিশন পেলে নিক্সনের পূর্ব উদ্দেশ্য অনেকাংশে সফল হবে।
নিক্সন কোনাে কমিশন গঠন করে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে পাঠালে তা ঠেকাবার উপায় আমাদের নেই। কিন্তু এ ধরনের কোনাে কমিশনকে ভারতের মাটিতে না আসতে দেয়াই উচিত। সিনেটের যে প্রতিনিধি দল আসছেন তারাও নিক্সনেরই মনােনীত কি না জানা নেই। যদি বেসরকারি প্রতিনিধি দলও হন, তবু তাঁদের সীমান্ত অঞ্চলে যাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা বিদেশিদের দৃষ্টিগােচর হতে দেয়া নির্বুদ্ধিতা মাত্র। বড় জোর শরণার্থীদের শিবিরে তাঁদের যেতে দেয়া চলে। যে প্রতিনিধি দলই আসুক, বাংলাদেশের। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তাদের সঙ্গে ভারত সরকার আলােচনায় বসলে দেশবাসীর মনে যেমন সরকারি মতিগতি সম্পর্কে সন্দেহ জাগবে তেমনি বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যেও সংশয় দেখা দেবে।

সূত্র: কালান্তর
২১.১১.১৯৭১