ত্রিপুরা বিধানসভায় স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে আলােচনা
গত ২৯ মার্চ ত্রিপুরা বিধান সভায় সদস্যগণ পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে আলােচনার দাবি উত্থাপন করিলে অধ্যক্ষ তাহাতে সম্মত হন। প্রথমে অধ্যক্ষের আহ্বানে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির উপর বিবৃতিতে বলেন, মাননীয় অধ্যক্ষ মহােদয়, আমাদের সীমান্তের ওপারে যে পাশবিক শক্তি প্রয়ােগ চলছে তাহার পরিপ্রেক্ষিতে আমি একটি বিবৃতি দিতে চাই।
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে এই সভার সদস্যগণের ভাবাবেগ আমি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিতেছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনে আমাদের দেশবাসী পুনরায় গণতন্ত্রের প্রতি তাহাদের অবিচল আস্থা এবং শ্রীমতী গান্ধীকে বিপুল সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া তাঁহার নেতৃত্বের প্রতিও গভীর আস্থা প্রকাশ করিয়াছেন।
গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলে পাকিস্তানে যে গণতান্ত্রিক কার্যপদ্ধতি চালু হইয়াছিল তাহার পূর্ণতা প্রাপ্তির পক্ষে পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিঘ্নস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং সেখানকার জনগণ গণতন্ত্রে তাহাদের আস্থার জন্য চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়াছেন। তাই আমাদের দেশের জনসাধারণ যে পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিবেন তাহা স্বাভাবিক।
আমরা যে গণতান্ত্রিক জীবনধারার সমর্থক ইহা সুবিদিত; যাহারাই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করিবেন তাহারা সর্বদাই আমাদের নৈতিক সমর্থন পাইবেন। পৃথিবীর যে কোনাে অংশে আধুনিক সেনাবাহিনীর পাশবিক শক্তি প্রয়ােগ করিয়া নিরস্ত্র নাগরিকদের নির্বিচার হত্যাকে আমরা সর্বদাই নিন্দা করিয়া আসিয়াছি। পূর্ববঙ্গের জনগণের এই চরম পরীক্ষার দিনে তাঁহাদের প্রতি আমরা সহানুভূতি জ্ঞাপন করিতেছি। আমরা এই আশাই পোেষণ করি যে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের ভবিষ্যত বংশধরগণ গর্বভরে বলিবেন যে, তাহাদের পূর্বপুরুষগণ চরম পরীক্ষার দিনেও তাহাদের প্রতি ন্যস্ত আস্থার অমর্যাদা করেন নাই। এই বিষয়ে আপনারা সকলেই যে আমার সঙ্গে একমত তাহাতে আমার কোনাে সন্দেহ নাই।
আমি পুনরায় উল্লেখ করিতেছি যে, আমরা গণতন্ত্র ও সমাজবাদের সমর্থক এবং পৃথিবীর যে কোনাে অংশে এই সকল আদর্শের পরিপন্থী যে কোনাে শক্তিকে আমরা নিন্দা করিব।
মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দানের পর সভায় এই বিষয় লইয়া সকল দলের বিভিন্ন সদস্য বক্তব্য রাখেন। দুই ঘণ্টা কাল এই আলােচনা চলে।
সমস্ত দলের সদস্যগণই পূর্ব বাংলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া জঙ্গি শাসক কর্তৃক গণহত্যার নিন্দা করেন এবং শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীনে সংগ্রামরত জনতাকে অভিনন্দন জানান। মুক্তি সংগ্রামে নিহত বীর বাঙালিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অধিকাংশ সদস্যই ভারত সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংঘকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য দাবি জানান এবং কোনাে কোনাে সদস্য ভারত সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলা সরকারকে স্বীকৃতি দান ও সাহায্য দানের প্রস্তাব রাখেন। সদস্যগণের বক্তব্য হইল গণতন্ত্রীরা পূর্ব বাংলার ঘটনায় নীরব দর্শক হইয়া থাকিতে পারে না। আলােচনায় পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই কম বেশি বক্তব্য রাখেন।
সূত্র: ত্রিপুরা
৩১ মার্চ, ১২৯৭১
১৭ চৈত্র, ১৩৭৭