বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি অভিনন্দন
লােকসভায় দশরথ দেবের ভাষণ
নয়াদিল্লী, ২৪ ডিসেম্বর- গত ১৮ ডিসেম্বর সংসদের কেন্দ্রীয় হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানানাে হয়। সেখানে সংসদের সিপিআই(এম) দলে ডেপুটি লিডার দশরথ দেব যে ভাষণ দেন। এখানে তা প্রকাশ হলাে:
এই উপমহাদেশের ইতিহাসে ঘটনার গতি যখন একটা ঐতিহাসিক মােড় নিয়েছে, উভয় সভার সদস্যবৃন্দ তখন আমাদের এখানে সমবেত হয়েছি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এ দেশকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় সাম্রাজ্যবাদের সে চাল একেবারে পরাস্ত হলাে এবং ধর্মভিত্তিক দুই জাত তত্ত্ব মারাত্মক আঘাত খেল।
এই মােড় ফেরায়, প্রথমেই আমাদের অভিনন্দন জানাতে হবে বাংলাদেশের বীর জনগণকে। পাকিস্তানি জঙ্গিচক্র গণতান্ত্রিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া সত্ত্বেও গত বিশ বছর ধরে, অকথ্য অত্যাচারের মুখে ও তারা গণতান্ত্রিক অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বারবার বিদ্রোহে মাথা তুলেছেন।
গত মার্চ মাস থেকে পাকিস্তানি জঙ্গি নায়ক যে গণহত্যা চালিয়েছে, তাতে দশ লক্ষাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ, যুবকরা পাক ফৌজের বর্বরতার মুখেও নিঃশঙ্ক থেকে নিজেদের মুক্তিবাহিনীতে সংগঠিত করলেন, অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন এবং অসম সাহসে লড়লেন ইয়াহিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে।
সাম্রাজ্যাবদ বিরােধী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতায় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের জনগণ তাঁদের সংগ্রামের পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ালেন।
স্বভাবতই আমরা খুশি যে, ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, স্বাধীনতার সংগ্রামীদের সাহায্য করেছে এবং ইয়াহিয়া যখন আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তখন ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশে এগিয়ে গেছে। দ্রুত বিজয় লাভ সম্ভব হয়েছে এ জন্যই যে, বাংলাদেশের সমগ্র জনগণ তাদের পেছনে ছিলেন, এটা ছিল ন্যায় সংগ্রাম আর পাক ফৌজ ছিল দখলদার বাহিনী।
আমরা খুশি যে, ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ, হুমকি ও ব্ল্যাক মেইলিং-এর কাছে নতি স্বীকার করেনি। প্রধানমন্ত্রীর একতরফা যুদ্ধ বিরতির ঘােষণাকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। যেমন স্বাগত জানিয়েছি আমরা তার এই ঘােষণা যে পাকিস্তানের কোনাে অংশ গ্রাসের আমাদের কিছুমাত্র ইচ্ছা নেই, সীমান্ত রক্ষা এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য আমাদের উদ্দেশ্য।
ভালাে যে পাকিস্তানে শেষ পর্যন্ত বুঝেছে যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিরর্থক, যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সমগ্র জনগণের সঙ্গে আমরাও আনন্দিত আশা করি এখন থেকে পাকিস্তানের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হবে। এই বিজয়ােল্লাসের মুহূর্তেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে সাম্রাজ্যবাদের কূটকৌশলের বিরুদ্ধে যাতে আমরা তা ব্যর্থ করতে পারি। যারা এই মহৎ আদর্শের জন্য জীবনপাত করেছেন, আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তারা সব সময়ই আমাদের মনে জাগরুক থাকবে।
সূত্র: দেশের ডাক
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
১৫ পৌষ, ১৩৭৮