অসামরিক প্রতিরক্ষা
কামান বা রাইফেল প্রভৃতির গােলা হতে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি
কিছুদিন যাবত ত্রিপুরার সীমান্ত এলাকাগুলােতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গােলাগুলি এসে পড়ছে এবং এর ফলে ঐসব অঞ্চলের অধিবাসীগণের জীবন ও সম্পত্তি হানির আশঙ্কা ঘটছে। এসব আক্রমণ হতে আত্মরক্ষার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা অবলম্বন করা যেতে পারে: ১. কামান বা রাইফেল আক্রমণের কোনাে সংকেত পূর্বাহ্নে পাওয়া সম্ভব নহে। গােলাগুলির শব্দ শুনে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। সাধারণত কামানের গােলার দুটি শব্দ হয়। একটি শব্দ হয় কামান দাগার সঙ্গে সঙ্গে এবং অপর শব্দটি হয় কামানের গােলা লক্ষ্যবস্তুর উপর পড়ে বিস্ফোরিত হবার সময়, দুটি শব্দের ব্যবধান প্রায় অর্ধ মিনিট। প্রথম শব্দ শােনামাত্র উপযুক্ত আশ্রয় গ্রহণ করলে ঐ গােলার আঘাত হতে আত্মরক্ষা সম্ভব। প্রথম শব্দ না শুনলে গােলার আসার শিস-এর শব্দ (Whishtling sound) শুনে আত্মরক্ষা করতে পারেন। ২. আত্মরক্ষার জন্য কোনাে দেয়ালের পেছনে বা পরিখায় আশ্রয় গ্রহণ করা নিরাপদ। অন্যকোনাে উপায় না থাকলে বড় গাছের পিছনে বা টিলার আড়ালে আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। ৩. আপনার বাড়ির কাছাকাছি যদি ভােলা জায়গা থাকে তাহলে ৮ ফুট x ২ ফুট এবং ৪ ফুট গভীর [অথবা যে কোনাে সুবিধাজনক আকারে] পরিখা [Trench ট্রেঞ্চ কেটে রাখুন, এতে চারজন লােক আশ্রয় নিতে পারবেন। এই পরিখার আকার ইংরেজি ‘z’ অক্ষরের মতাে হওয়া উচিত। ৪. পাক দেওয়াল বা মাটির দেওয়ালযুক্ত ঘর আশ্রয় হিসেবে অনেকটা নিরাপদ। ঐসব ঘরের ভিতরে পরিখা খনন করে আশ্রয় গ্রহণ অধিকতর নিরাপদ। অন্য সুবিধা না থাকলে বালির বস্তা দ্বারা বা মাটির দ্বারা ২টি সমান্তরাল দেওয়াল প্রস্তুত করে তার মধ্যে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গােলার আঘাত হতে আত্মরক্ষার জন্য বাঁশের ঘর নিরাপদ নয়। ৫. আপনার বাড়ির কাছাকাছি পরিখা [ট্রেঞ্চ] খনন করার উপযুক্ত জায়গা না থাকলে আপনার বাড়ির ভিতর দিকে (নিচের তলায় করলেই ভালাে হয়) একটা কোঠা আশ্রয় কক্ষ হিসেবে ঠিক করে নিন। ৬. এইঘরে আশ্রয়কক্ষে) যদি কোনাে জানালা থাকে তাহলে সম্ভাব্য বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাটি বা বালির বস্তা অথবা বাড়ির বাকসগুলাে সাজিয়ে রেখে জানালাগুলাে বন্ধ করে দিন। ৭. আপনার ঘরে সর্বদা যথেষ্ট পরিমাণ পানীয় জল, ৩/৪ দিনের প্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য, প্রাথমিক চিকিৎসার সাজসরঞ্জাম, একটা টর্চলাইট এবং কিছু মােমবাতি সঞ্চিত রাখা উচিত। ৮. কামানের গােলায় ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা কম। ৯. আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আপনার বাড়িঘর পরিত্যাগ করবেন না। আশ্রয়স্থল ছেড়ে ছুটাছুটি করলে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা অধিক। গােলাগুলি কিছু সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আপনার এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কাজকর্ম চালু রাখতে সর্বপ্রকার চেষ্টা করুন। ১০. বিপদের সময় আপনার প্রতিবেশীকে যথাসম্ভব সাহায্য করুন। গ্রাম প্রধানগণ খনিজ এলাকার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করুন যাতে আহত ব্যক্তিগণকে অতিসত্ত্বর নিকটবর্তী চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানাে যায়। আপনার এলাকার তহশিলদার ও গ্রামসেবক, বি.এ.ও এবং এস.ডি.ও’র সঙ্গে যােগাযােগ রাখুন এবং তাদের পরামর্শ নিন।
গােলা বিফোরণের শব্দ শুনলে
আপনি যদি বাইরে থাকেন কী করা উচিত?
১. যদি কোনাে নিচু জায়গা পাওয়া যায় তাহলে সেখানে অথবা মাটিতে মুখ নিচে রেখে শুয়ে পড়ুন। ২. কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে বুকটা মাটি থেকে একটু উঁচুতে রাখুন। ৩. তুললা বা কাপড় দিয়ে কান ঢেকে রাখুন। ৪. রুমাল বা কাপড় ভাজ করে দাঁতে কামড়ে রাখুন।
কোনাে বাড়ির কাছে থাকেন
৫. কাছাকাছি আশ্রয়স্থলে বা বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার সময় থাকলে দৌড়ে চলে যান, অন্যথা বাইরে থাকলে যা করা কর্তব্য তাই করুন। ৬. রাস্তা থেকে সরে যান।
যদি বাড়ির মধ্যে থাকেন
৭. ভেতরের দিকের কোনাে দেয়ালের কাছে থাকুন, বাইরের দিকে নয়। ৮. দুটি দেয়ালের কোণে থাকলেই ভালাে হয়।
যদি কোনাে বাস বা গাড়িতে থাকেন
৯. বাস, মােটরগাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থাকলে যা কর্তব্য তাই করুন।
যদি সিনেমায় থাকেন
১০. আপনার আসনে বসে থাকুন।
কী করা উচিত নয়
১. সময় না থাকলে আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করবেন না। ২. গােলাগুলি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কোনােক্রমেই আশ্রয়স্থল হতে বাইরে আসবেন না। ৩. আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। ৪. সােজাসুজি দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকবেন না। ৫. দরজা বা জানালার সােজাসুজি থাকবেন না। ৬. জানালা বা দরজার কোনাে কাচ অরক্ষিত রাখবেন না। ৭. দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
উদ্ধার কার্য কী করা উচিত?
১. শান্ত থাকুন। ২. উদ্ধার কার্য শুরু করার আগে ভালাে করে চতুর্দিকে দেখে শুনে নিন। ৩. ক্ষতিগ্রস্ত সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করার সময় যতটুকু সম্ভব দেয়ালের কাছ ঘেসে যান। ৪. আহত ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া থেকে ধ্বংস স্তুপ অপসারণের সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন। ৫. ওপর থেকে ইট কাঠ পড়ে আহত ব্যক্তির আরও ক্ষতি না হয় সে জন্য টিন বা ত্রিপল দিয়ে তাঁকে ঢেকে দেন। ৬, আহত ব্যক্তির যাতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট না হয় সে জন্য নাক ও মুখের কাছ থেকে ধুলােবালি সরিয়ে দিন। ৭. আঘাত যদি কঠিন না হয় তাহলে আহত ব্যক্তিকে উৎসাহ দিন এবং তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। ৮. সমস্ত জামাকাপড় আলগা করে দিন, রােগীকে শুইয়ে দিন এবং শরীর উত্তপ্ত রাখুন। ৯. প্রয়ােজন হলে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস করান, যদি রক্তপাত হতে থাকে তাহলে যতখানি সম্ভব তা নিয়ন্ত্রণ করুন। অস্থায়ীভাবে কাঠের টুকরাে ইত্যাদি বেঁধে দিয়ে ভাঙা হাত পায়ের বালা উপশম করতে চেষ্টা করুন। ১০. আহতের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য নিকটবর্তী প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের সঙ্গে অবিলম্বে যােগাযোগ করুন।
উদ্ধার কার্য কী করা উচিত নয়?
১. আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। ২. ধ্বংসপ থেকে নির্বিচারে কাঠ, খুঁটি টানবেন না তাতে বাড়ি ধসে পড়ার সম্ভাবনা আরও বাড়তে পারে। ৩. খােলা বৈদ্যুতিক তার ছোঁবেন না। ৪. ধ্বংসস্তুপের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাবেন না অথবা নিত্যন্ত বাধ্য না হলে ভেঙে পড়া বাড়ির কিছু নাড়াচাড়া করবেন না।
সূত্র: ত্রিপুরা
৩ নভেম্বর, ১৯৭১
১৬ আশ্বিন, ১৩৭৮