বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২২শে সেপ্টেম্বর, রোববার, ৬ই আশ্বিন, ১৩৮০
ধোঁকাবাজির রাজনীতি
যা করবে তা বলবে না আর যা বলবে তা করবে না -ধোঁকাবাজি রাজনীতির সনাতন সূত্রটি পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বেশ ভালোভাবেই ইস্তেমাল করেছেন। তাই তিনি ম্যাপনেতা আলী খানের ভাষায় ‘কখন কি করেন আর বলেন তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।’ স্বাভাবিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে, সিমলা চুক্তির আগের আর পরের ভুট্টো এক নয়। দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হবার আগের ভুট্টো সাহেবের বক্তব্য আর এখনকার বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী।
দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হবার আগে পর্যন্ত ভুট্টো সাহেব বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য করেননি, সুবোধ বালকের মতোই মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দিল্লী চুক্তিতে যা বলা হয়েছে মোটামুটি ভাবে গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ যুক্ত ঘোষণায় তাই বলা হয়েছিল। ভুট্টো সাহেব এ কথা জানেন না জানতেন না তা নয়। জানা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে সময়ের অপচয় করেছেন। অসীম ধৈর্য নিয়ে প্রতীক্ষা করেছেন যে, নব্বুই হাজার যুদ্ধবন্দীর আহার বাসস্থানের খরচ যোগাতে গিয়ে ভারত সরকার কত টাকা কাহিল হয়েছেন তা দেখার জন্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ভারতীয় জনগণ বা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোন কথাই উপস্থাপিত হয়নি। শেষমেষ ভুট্টো সাহেব দেখলেন যে, ফাটা বাঁশে লেজ পড়ার মত অবস্থা। তাই তিনি একেবারে নাটকীয় ভাবে দিল্লি চুক্তি মেনে নিলেন। দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হবার পর সকলে আশা করেছিল এতদিন পর হয়তো এ উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাগুলি সমাধানের পর স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান নিজস্ব স্বার্থেই একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে। পারস্পরিক লেনদেন চলবে। ভাবের আদান-প্রদান হবে। অন্তত ভুট্টো সাহেবের ওয়াশিংটন যাত্রার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এটাই সকলে আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু না। ভবি ভুলবার নয়। ভুট্টো সাহেবের রাজনীতি এ কথা কোনদিন বলেনি এবং ভবিষ্যতেও বলবে বলে মনে হচ্ছে না।
একদিকে সিমলা ও দিল্লি চুক্তি অন্যদিকে ইরানের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ। মার্কিন মুল্লুকে অস্ত্র ভিক্ষার জন্য যাত্রা সবই দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক ভিত্তিতে সমস্যা ও সংকট সমাধানের সম্পূর্ণ বিপরীত। ভুট্টো সাহেব মার্কিন মুল্লুকে পৌছেই ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের সাথে তার দেশের সম্পর্কের উন্নতি হবে বলে ঘোষণা করা সত্বেও গত ২০শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক একশ’ পঁচানব্বুই জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত পাকিস্তান জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে যাবে। ভুট্টো সাহেবের চেয়ে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে জনাব আজিজ আহমদ বলেছেন যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রশ্নে চীন যাতে আবার বিরোধিতা করে সেই অনুরোধই তিনি করবেন।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ভুট্টো সাহেব অতীতের সব কথা ভুলে গিয়ে আবার নতুন খেলায় মেতেছেন। ভুট্টো সাহেবকে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য করা হবে না বলে মার্কিন মহল থেকে বলা হলেও ইরানের কাছ থেকে ভুট্টো সাহেব অস্ত্রশস্ত্র ঠিকই পাবেন এবং পাচ্ছেনও। তাই ভুট্টো সাহেব নতুন সুরে কথা বলতে আরম্ভ করেছেন। স্বাভাবিক কারণেই ভুট্টো সাহেব সিমলা ও দিল্লি চুক্তির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। অথচ সিমলা চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল এ সম্পর্কিত বিষয়াদি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আলোচনা করা হবে।
জাতিসংঘের ভুট্টো সাহেবের ভাষণের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বলেছেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী আর কাশ্মীর প্রশ্ন তুলে দিল্লী চুক্তির উপর আঘাত হেনেছেন।
ভুট্টো সাহেব যাই বলুন আর করুন না কেন আমরা একথা বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের শান্তিকামী জনসাধারণ তার এ ধোঁকাবাজির রাজনীতিকে সহজভাবে মেনে নেবে না। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে না এটা পাকিস্তানের জনসাধারণ বেশ ভালোভাবেই বোঝে। ভুট্টো সাহেবের শত সহস্র ডিগবাজী সত্ত্বেও এটাই হলো আশা ও আনন্দের কথা।
বাংলাদেশ-জিডি আর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চুক্তি
গত পরশু বাংলাদেশ ও পূর্ব জার্মানির (জি,ডি,আর) মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উক্ত চুক্তি অনুসারে দুই দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান বিষয়ে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। উভয় দেশ শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ছাত্র ও প্রতিনিধি বিনিময় এবং এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। এছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিত্রকলা, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও তথ্য বিনিময়ের সুযোগও এই যুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, দুই দেশের এই সহযোগিতা ও মতামত বিনিময় সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে পূর্ব জার্মানির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল এবং সে কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আমরা তাদের নৈতিক সমর্থন পেয়েছি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যে দেশগুলো প্রথম পর্যায়ে স্বীকৃতি দিয়েছে পূর্ব জার্মানি ও তাদের মধ্যে রয়েছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনকাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পূর্ব জার্মানি যুদ্ধকালে এগিয়ে এসেছে এবং আমাদের জরুরী প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান ও সহযোগিতা দান করেছে এবং এখনো অব্যাহত রেখেছে।
সম্প্রতি বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব উৎসবে যোগদানকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদেরকেও তারা বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে। এমনিভাবে যখন তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে সেই মুহূর্তে উল্লিখিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চুক্তি উভয় দেশের বন্ধুত্বকে নিঃসন্দেহে আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। এবং এর ফলে আধুনিক বিজ্ঞানে ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক দেশ জার্মানির শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, চিত্রকলা সম্পর্কে অধিক জ্ঞান লাভের সুযোগ ঘটলো। ফলে বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ়ই হবেনা, উভয় দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ইত্যাদির ক্ষেত্রে আরো উন্নতি সাধিত হবে বলেও আমরা দৃঢ়মত পোষণ করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক