You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সাথে ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার

এই সেই অতিমানবী যিনি প্রায় অর্ধশত কোটি লােককে শাসন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরােধিতার মুখে একটি যুদ্ধে বিজয়লাভ করেছেন। তাকে দেখেই কেউ ভাববে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিজয়ী হওয়ার কারণে কেউ তাকে আসনচ্যুত করতে পারবে না। অনেকে বলে, তিনি বিশ বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। আমি তাকে পছন্দ করতাম একটি নজীর হিসেবে যে একজন ভালাে নারী যখন দেশ শাসন করে তখন তিনি কেমন হতে পারেন। আমি তার প্রশংসা করতাম। যারা তাকে সন্দেহ করে আমাকে সতর্ক করতাে আমি তাদেরকে তার মেধা ও সাফল্যের কারণে ঈর্ষাকাতর ভাবতাম।
১৯৭৫ এর বসন্তকালে তিনি গণতন্ত্র পরিত্যাগ করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন। তিনি তার পিতার ভূমিকা বিস্মৃত হয়েছিলেন। তার বিচার হয়েছিল, সাজা হয়েছিল নির্বাচনী অভিযানে বাড়াবাড়ি করার অভিযােগে। এক পর্যায়ে তাকে পদত্যাগ করার বিষয়ও বিবেচনা করতে হয়েছিল। পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল তবু তিনি পদত্যাগ করেননি। নিক্সন যা করেছিলেন তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা থেকে স্বেচ্ছাচারী ইন্দিরায় পরিণত হন। রাতারাতি সব বিরােধী নেতাকে গ্রেফতার করেন, সংবিধান লংঘন করেন এবং স্বাধীনতাকে হত্যা করেন।
অনেকে তাকে পছন্দ করতাে না। অনেকে তার অন্ধভক্ত ছিল। আমি পছন্দ করতাম, কারণ ভারতের মতাে একটি জটিল দেশ শাসন সন্ন্যাসীর পক্ষে সম্ভব নয়। ক্ষমতা সম্পর্কে হেনরী কিসিঞ্জার যাই বলুন না কেন (“একজন রাষ্ট্র প্রধানের জন্যে বুদ্ধিমত্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে যােগ্যতা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের থাকা জরুরী তা হলাে শক্তি। সাহস, ধূর্ততা এবং শক্তি”) ভারতের মতাে একটি দেশ শাসন যিনি করবেন তাকে অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হবে। ইন্দিরা গান্ধী খাটি সন্ন্যাসী ছিলেন না। জীবনের পেয়ালা থেকে কি পান করতে হবে সে বােধ তার পুরােপুরিই ছিল। তাকে বুঝার চেয়ে তার সাক্ষাতকার গ্রহণ সহজতর। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গেও তিনি স্বতঃস্ফুর্ত। তিনি কিছুই গােপন করেন না। তার কণ্ঠে যাদু, মুখটাও সুন্দর। আয়ত সুন্দর চোখে যেন একটু বেদনার ছায়া। তার চেহারাকে কারাে সাথে মিলানাে যায় না।
তিনি খুব সাধারণ মহিলা নন। প্রথমত তিনি জওয়াহের লাল নেহেরুর কন্যা। দ্বিতীয়ত তিনি মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর শিষ্য। তাদের ছায়ায় তিনি বড় হয়েছেন, শিক্ষালাভ করেছেন এবং নিজেকে গঠন করেছেন। নেহেরু পরিবার, বংশপরম্পরায়

পৃষ্ঠাঃ ১৯
রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তার ঠাকুর্দা কংগ্রেস পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার পিসী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত একমাত্র মহিলা যিনি জাতিসংঘে সভানেত্রীত্ব করেছেন। ইন্দিরা যখন শিশু তখন শুধু মহাত্মা গান্ধীর কোলেই নয়, যারা ভারতের জন্ম দিয়েছেন সেইসব সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কোলে বসেছেন।
তার চোখের সামনে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। এমন গল্পও আছে যে, বন্ধুদের জন্য বাড়ির দরজা খুলে তাকে বলতে হতাে, “দুঃখিত বাড়িতে কেউ নেই। আমার বাবা মা, ঠাকুর্দা, ঠাকুরমা, পিসী সবাই জেলে।” এ অবস্থার কারণে মাত্র আট বছর বয়সে পড়াশােনার জন্য তাকে সুইজারল্যাণ্ড পাঠানাে হয়। কিন্তু তের বছর বয়সে দেশে ফিরে এসে তিনি খুদে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তারা বার্তা বহন করতাে-কখনাে কখনাে বৃটিশ ব্যারাকে হানা দিতাে। জেল থেকে নেহেরু তাকে লিখতেন, “তােমার কি মনে পড়ে যখন প্রথম জোয়ান অব আর্কের গল্প পড়ে তুমি কতটা উৎসুক হয়েছিলে এবং তােমার লক্ষ্যও অনেকটা তার মতাে ছিল।…….ভারতে আজ আমরা ইতিহাস গড়ছি। এবং তুমি ও আমি ভাগ্যবান যে এ ইতিহাস সৃষ্টি হবে আমাদের চোখের সামনে।”
তিনি জেলে গেছেন-তের মাস। অক্সফোর্ডে পড়াশােনার সময় বােম্বের তরুণ আইনজীবী ফিরােজ গান্ধীর সাথে তার সাক্ষাত হয়। ১৯৪২ সালে দিল্লীতে তাদের বিয়ে হয়। এর ছ’মাস পর বৃটিশ সরকার দু’জনকেই গ্রেফতার করেন এবং তাদের অসুখী দাম্পত্য জীবন শুরু এখানেই। ১৯৪৭ সালে নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হলে ইন্দিরা পিতার সাথে বসবাস করতে থাকেন। বিপত্নীক পিতার পাশে একজন নারীর উপস্থিতি তিনি অনুভব করছিলেন। ফিরােজ গান্ধী ১৯৬০ সালে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইন্দিরার এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেননি। পিতা-কন্যা একত্রে ভ্রমণ করতেন, রাষ্ট্রপ্রধানদের অভ্যর্থনা জানাতেন। ১৯৬৪ সালে পিতার মৃত্যুর পর ইন্দিরা তার স্থলাভিষিক্ত হলেন।
আমি সরকারী প্রাসাদে তার অফিসে সাক্ষাত করলাম। এ অফিসে তার পিতাও বসতেন-বিশাল শীতল ও মসৃণ। একটি শূন্য ডেস্কের পিছনে তিনি বসেছিলেন। আমি প্রবেশ করতেই তিনি উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। পুনরায় আসনে গিয়ে বসার পর তাকালেন, মনে হলাে তিনি বলছেন, তােমার প্রথম প্রশ্ন শুরু কর, সময় নষ্ট কর না। নষ্ট করার মতাে সময় আমারও ছিল না। প্রথমে বেশ সতর্কতার সাথে উত্তর। দিচ্ছিলেন। এরপর ফুলের মতাে নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন এবং আমাদের আলােচনার আর বাধা রইলাে না। দুই ঘণ্টার উপর আমরা একত্রে ছিলাম। সাক্ষাতকারটি যখন শেষ হলাে, তিনি আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেয়ার জন্য রাস্তা পর্যন্ত এলেন। আমার হাতটা ধরে রেখেছিলেন তিনি যেন আমার পূর্ব পরিচিত।
আটচল্লিশ ঘণ্টা পর আমি সাক্ষাতকারে কিছু অসঙ্গতি দেখে আবার তার সাথে দেখা করতে চাইলাম। এবং কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তার বাড়িতে গেলাম। এটা একটা মাঝারি মানের বাংলাে। দুই ছেলে রাজীব ও সঞ্জয়ের সাথে এখানে থাকেন তিনি। এখানে তার সাথে সাক্ষাত করা খুব সহজ। সকালে তার কাছে বহুলােক আসে

পৃষ্ঠাঃ ২০
দরখাস্ত, প্রতিবাদ, ফুলের তােড়া নিয়ে। কলিং বেল বাজাতে সেক্রেটারি দরজা খুললাে। জানতে চাইলাম প্রধানমন্ত্রী আমাকে আর আধ ঘণ্টা সময় দিতে পারবেন। কিনা? সেক্রেটারি ভিতরে গেলাে এবং ইন্দিরা তার সাথে এলেন। আমরা বসলাম এবং আরাে এক ঘণ্টা আলাপ করলাম। প্রশ্নের উত্তর ছাড়াও তিনি আমাকে ছেলে রাজীব সম্পর্কে বললেন, সঞ্জয় সম্পর্কেও বললেন। শেষে তিনি ছােট্ট বালককে ডেকে বললেন, “এ হচ্ছে আমার নাতি, একেই আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালােবাসি।”
ওরিয়ানা ফ্যালাচি : মিসেস গান্ধী আপনার জন্য আমার বহু ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রশ্ন রয়েছে। ব্যক্তিগত প্রশ্নগুলাে পরেই করবাে
এখনকার প্রশ্ন হচ্ছে, বহু লােক কেন আপনাকে ভয় করে এবং বলে আপনি খুব শীতল, বরফের মতাে, কঠোর…..।
ইন্দিরা গান্ধী : তারা বলে, কারণ আমি নিষ্ঠাবান। আমি শুধু সুন্দর কথা বলে সময় নষ্ট করিনা, ভারতের লােকজন সাধারণত যা করে-প্রথম-আধঘণ্টা ব্যয় করে সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যমে, আপনি কেমন আছেন, ছেলেমেয়ে কেমন আছে, নাতিনাতনিরা কেমন ইত্যাদি। আমি এসব এড়িয়ে চলি। আসল কাজ করার পর সৌজন্য বিনিময় হতে পারে। কিন্তু ভারতের লােকেরা এই দৃষ্টিভঙ্গি হজম করতে পারে না। যখন আমি বলি, তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আস। তখন তারা আহত হয় এবং ভাবে আমি অত্যন্ত শীতল, কঠোর। আমি যা সেভাবেই আমি সকলকে বুঝতে দেই। যদি আমি সুখী হই, তাহলে আমাকে সুখীই দেখা যায়। রাগান্বিত হলেও তা আমি প্রকাশ করি। অন্যদের তাতে কি প্রতিক্রিয়া হয় সে ব্যাপারে আমি তােয়াক্কা করিনা। আমার মতাে কঠোর জীবন যাকে কাটাতে হয় তার পক্ষে অন্যের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে ভাবা সম্ভব নয়।
ও ফা : আমি কঠিন একটি প্রশ্ন শুরু করবাে। আপনি একটি যুদ্ধ জয় করেছেন, জয়ের চেয়েও অধিক। কিন্তু আমাদের খুব কম লােকই এটাকে বিপজ্জনক বিজয় বলে মনে করেন। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ আপনার কাঙ্ক্ষিত মিত্র হবে? বরং তার বদলে এক অস্বস্তিকর বােঝায় পরিণত হতে পারে বলে কি আপনি ভীত নন?
ই গা : দেখাে, জীবন সবসময় বিপদে পরিপূর্ণ এবং আমি মনে করিনা যে, কারাে পক্ষে বিপদ এড়ানাে সম্ভব। যা সঠিক মনে হয়, একজনের তাই করা উচিত এবং সেই। যথার্থ কাজ করতে যদি বিপদ আসে তাহলে বিপদের ঝুঁকি অবশ্যই নিতে হবে। এটাই আমার সবসময়ের দর্শন। আমি পরিণতির কথা ভেবে কোন পদক্ষেপ নেই না। পরিণতিগুলাে পরে পরীক্ষা করে দেখি। যখন কোন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, আমি তা মােকাবেলা করি। তুমি এই বিজয়কে বিপজ্জনক বলছাে, কিন্তু আমি বলছি, কেউ এ যাবত এটাকে বিপজ্জনক বলেনি এবং ঝুঁকিও আমি দেখিনা। যদি ঝুঁকি বাস্তবে পরিণত হয় তাহলে সে বাস্তবতার আলােকেই পদক্ষেপ নেব। আমি তােমার প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিতে চাই। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ ও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত

পৃষ্ঠাঃ ২১
হবে। অবশ্যই তা একতরফা বন্ধুত্ব হবে না। প্রত্যেকের কিছু দেবার ও নেবার থাকে। আমরা যদি বাংলাদেশকে কিছু দিতে চাই তাহলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ আমাদের কিছু দিতে চাইবে এবং বাংলাদেশ কেন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে না। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সম্পদে পরিপূর্ণ এবং নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। রাজনৈতিকভাবে আমার মনে হয় দেশটা যােগ্য লােক দ্বারা পরিচালিত। শরণার্থী, যারা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল তারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে……।
ও ফা : তারা কি আসলে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে?
ই গা : হ্যাঁ, ২০ লাখ ইতিমধ্যেই ফিরে গেছে।
ও ফা : এক কোটির মধ্যে ২০ লাখ। খুব বেশি নয়।
ই গা : তা বেশি নয়, একটু সময় দাও। তারা দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। দ্রুততার সাথে। এতে আমি সন্তুষ্ট। আমার ধারণার চেয়ে বেশি।
ও ফা : মিসেস গান্ধী, আপনার বিজয়ের বিপদ বলতে আমি শুধু বাংলাদেশকে বুঝাইনি। আমি পশ্চিমবঙ্গকেও বুঝাতে চেয়েছি। যেটা ভারতের অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গ এখন স্বাধীনতার কথা বলছে। কোলকাতায় আমি নকশালীদের কথা শুনেছি…..এবং লেনিনের একটা কথা আছে, “সাংহাই ও কোলকাতা দিয়ে আন্তর্জাতিক বিপ্লব অতিক্রম করবে।”
ই গা : না, এটা সম্ভব নয়। বলতে পারাে, কেন? কারণ ভারতে একটি বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। সবকিছু বদলে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিকভাবে। এখানে কমিউনিজমের আতঙ্ক নেই। এ বিপদ থাকতাে আমার বদলে একটা দক্ষিণপন্থী সরকার থাকলে। যখন জনগণ ভেবেছে যে আমার পার্টি দক্ষিণ ঘেঁষা হচ্ছে তখন কমিউনিস্টরা শক্তি অর্জন করেছে। কিন্তু এখন জনগণ অনেক সচেতন। আমাদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে তারা দেখছে আমরা সমস্যার সমাধান করছি। কমিউনিস্টরা তাদের শক্তি হারাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে নকশালীদের তৎপরতা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশেও এ ধরনের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। আমি কোন বিপদ আশঙ্কা করছি না।
ও ফা : ইতিমধ্যেই তারা আপনার কিছু অসুবিধা করেছে। স্বাধীনতার পর ঢাকায় আমি ভীতিকর হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।
ই গা : প্রথম পাঁচদিন এসব ঘটেছে এবং অপর পক্ষের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় তা সামান্য। অপরপক্ষের দশ লক্ষ মানুষ হত্যার তুলনায় খুব কম। এটা সত্য যে, কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে এবং আমরা তা ঠেকাতে চেষ্টা করেছি। তুমি কি জানাে, আমরা কত লােকের প্রাণ রক্ষা করেছি? আমরা তাে সর্বত্র যেতে পারি না, সবকিছু দেখতে পারি না। সকল সমাজে কিছু গ্রুপ থাকে, যারা অশিষ্ট। তাদেরকেও বুঝতে হবে। যথার্থ বুঝতে হলে প্রথম ক’দিনের মধ্যে কি ঘটেছে তা বিবেচনা করলে চলবে। তারা বহু দিন, বহু মাস ধরে দেখেছে এবং দুর্ভোগ সহ্য করেছে।

পৃষ্ঠাঃ ২২
ও ফা : মিসেস গান্ধী, আপনি তাে এ অভিযােগ সম্পর্কে অবগত যে, আপনারা ভারতীয়রা যুদ্ধের প্ররােচণা দিয়েছেন এবং আপনারাই প্রথম হামলা করেছেন। এ অভিযােগের প্রেক্ষিতে কি বলবেন?
ই গা :তুমি যদি পিছনের দিকে যেতে চাও, তাহলে একথা স্বীকার করে উত্তর। দেবাে যে, আমরা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছি। সেই শুরুর মুহূর্ত থেকে ধরলে বলতে হয়, আমরাই শুরু করেছি। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। আমরা এক কোটি শরণার্থীকে আমাদের ভূখণ্ডে রাখতে পারি না, আমরা একটা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে এ ধরনের একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সহ্য করতে পারি না। শরণার্থীর ঢল কখনাে বন্ধ হতাে না। একটা চূড়ান্ত বিস্ফোরণ পর্যন্ত এটা চলতেই থাকতাে। এসব লােকের আগমন রােধ করা অসম্ভব হয়ে পড়তাে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এটা করতে হতাে। একথাটাই আমি মি. নিক্সন এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে বলেছিলাম যুদ্ধ এড়াবার লক্ষ্যে।
কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধ সূচনার দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে পাকিস্তানীরাই হামলা করেছিল। আমাদের উপর বিমান নিয়ে আক্রমণ করেছিল। বিকেল পাঁচটায় আগ্রায়। প্রথম বর্ষিত হয়। আমরা খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। একমাত্র সপ্তাহান্তেই আমরা সরকারের দায়িত্বশীলরা দিল্লী ছাড়তে পারি না। প্রায় কেউই দিল্লী ছিল না। আমি গিয়েছিলাম কোলকাতায়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন পাটনায় এবং সেখান থেকে তার বাঙ্গালােরে যাওয়ার কথা। অর্থমন্ত্রী গিয়েছিলেন বােম্বে এবং সেখান থেকে তিনি পুনা যেতে প্রস্তুত। সশস্ত্র বাহিনী প্রধানও অন্যত্র ছিলেন। আমাদের সকলকে তড়িঘড়ি দিল্লী ফিরতে হলাে। এর ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাল্টা আঘাত হানার পরিবর্তে আমাদের বাহিনী পরের দিন আঘাত হানলাে। এজন্যে পাকিস্তানীরা কিছু এলাকা দখলে সফল হয়েছিল। আমরা প্রস্তুত ছিলাম, জানতাম কিছু একটা ঘটবে। আমরা শুধু বিমান হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তা নাহলে পাকিস্তানীরা আমাদের পরাভূত করতাে।
ও ফা :মিসেস গান্ধী, আপনি বলেছেন, যুদ্ধ এড়ানাের জন্য ইউরােপ ও আমেরিকা সফর করেছেন। আপনি কি সত্যি বলবেন কি ঘটেছিল? নিক্সনের সঙ্গে কি আলােচনা হয়েছিল?
ই গা :আমি জেনে শুনেই সফুরে বেরিয়েছিলাম যে আমার অবস্থা শিশুর মতাে, গর্তে অঙ্গুলি প্রবেশ করাচ্ছি এবং সেখানে কি আছে আমি জানি না। সত্যটা হলাে, আমি স্পষ্টভাবে নিক্সনকে বলেছি সেই একই কথা যা আমি হীথ, পম্পিডাে, ব্রাটকে বলেছি। আমি বলেছি, আমাদের পিঠের উপর এক কোটি শরণার্থী নিয়ে আমরা আর পারছি না এবং এ ধরনের একটা অসহনীয় পরিস্থিতি আর সহ্য করা যায় না। মি. হীথ, মি. পম্পিডাে এবং মি. ব্রাট আমার কথা ভালােভাবেই উপলব্ধি করলেন; কিন্তু নিক্সন বুঝলেন না। অন্যেরা যা বুঝে নিক্সন তা বুঝেন না। আমি সন্দেহ করেছিলাম নিক্সন পাকিস্তানের সমর্থক অথবা বলা যায়, আমি জানতাম, আমেরিকানরা সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিরুদ্ধে।

পৃষ্ঠাঃ ২৩
যা হােক, সাম্প্রতিককালে আমার মনে হচ্ছে, আমেরিকানরা বদলাচ্ছেপাকিস্তানের প্রতি সমর্থন কমছে তা নয়, ভারত বিরােধিতা কমছে। আমার ধারণা ভুল ছিল। নিক্সনের সাথে সাক্ষাতে আর যাই হােক যুদ্ধ এড়ানাে যায়নি। এতে আমারই ভালাে হয়েছে। অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যখন কেউ তােমার বিরুদ্ধে কিছু করে, তাহলে তােমার পক্ষে কিছু সুবিধা চলে আসে। এটা জীবনের বিধান। আমি গত নির্বাচনে কেন বিজয় লাভ করেছি, জানাে? কারণ জনগণ আমাকে ভালবাসে, আমি কঠোর পরিশ্রম করি। আরাে একটা কারণ হলাে, বিরােধী দল আমার প্রতি ন্যক্কারজনক আচরণ করে। যুদ্ধে কেন জিতেছি, জানাে? কারণ আমার সশস্ত্র বাহিনী বিজয়ে সক্ষম ছিল এবং আমেরিকানরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
ও ফা : তার মানে?
ই গা : বলছি, শােন। আমেরিকা সবসময় ভেবেছে যে তারা পাকিস্তানকে সাহায্য করছে। আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে সাহায্য না করতাে, পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হতাে।
গণতন্ত্রের সামান্য নমুনাকে অস্বীকার করে এমন একটি সামরিক জান্তাকে সমর্থন করার অর্থ একটি দেশকে সাহায্য করা নয়। পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে তার সামরিক জান্তা। এই জান্তা আমেরিকানদের সমর্থনপুষ্ট। কখনাে কখনাে বন্ধুরাই বিপজ্জনক। বন্ধুদের সাহায্য সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত।
ও ফা : চীনাদের সম্পর্কে? চীনারাও তাে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এবং আমার যদি ভুল না হয় তাহলে চীনারাই ভারতের সবচেয়ে বড় ও বিপজ্জনক শত্রু।
ই গা : না, চীন ও ভারত কেন শত্রু হবে, তা আমি বুঝিনা। আমরা তাদের শত্রু হতে চাই না। তারা যদি শত্রু হতে চায়, তাহলে আমরা কি করতে পারি। কারণ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাবে যে এই শত্রুতায় তাদের কল্যাণ নেই। এই যুদ্ধে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে….মনে হয়, আমেরিকানদের চেয়ে তার দক্ষ এবং পাকিস্তানের জন্য আরাে বেশি করতে পারতাে। আমেরিকানরা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, চীনারা নয়। তবুও আমি চীন সীমান্ত থেকে আমাদের সৈন্য সরিয়ে নেইনি এবং আমার কখনও বিশ্বাস হয়নি যে, চীনারা হস্তক্ষেপ করবে। অন্যভাবে বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ আমি বিশ্বাস করিনি। স্বাভাবিকভাবে, যদি আমেরিকানরা একটা গুলি ছুঁড়তাে, বঙ্গোপসাগরে বসে থাকা ভিন্ন সপ্তম নৌবহর যদি বেশি কিছু করতাে…হ্যাঁ, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারতাে। কিন্তু আমার সে ভয় আসেনি।
ও ফা : আপনার সাথে যুদ্ধ সম্পর্কে আলাপ করতে খুব অবাক লাগছে, কারণ। আপনি অহিংস মন্ত্র পাঠ করেই বড় হয়েছেন। আমার আরাে অবাক লাগে, যুদ্ধের দিনগুলােতে আপনি কেমন অনুভব করেছেন।
ই গা : তােমার মনে রাখতে হবে যে, এটা আমার প্রথম যুদ্ধ ছিল না। অন্যদেরকেও মােকাবেলা করতে হয়েছে। অহিংসা’ সম্পর্কে ছােট্ট একটা গল্প বলবাে।

পৃষ্ঠাঃ ২৪
১৯৪৭ সালে ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে, তখনই পাকিস্তান কাশ্মীরে অভিযান চালালাে। কাশ্মীর তখন এক মহারাজা শাসন করতেন। মহারাজা পালিয়ে গেলেন এবং শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরীরা ভারতের সাহায্য চাইলেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন তখনাে ভারতের গভর্নর জেনারেল। তিনি উত্তর দিলেন যে, পাকিস্তান যুদ্ধ ঘােষণা না করা পর্যন্ত তার পক্ষে কাশ্মীরে কোন সাহায্য দেয়া সম্ভব নয় এবং পাকিস্তানীরা যে জনগণকে হত্যা করছে তাতে তিনি বিচলিত হয়েছেন এমনও বােধ হলাে না। আমাদের নেতৃবৃন্দ একটি দলিলে সই করার সিদ্ধান্ত নিলেন যার দ্বারা নিজেদেরকে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য করলেন। অহিংস মন্ত্রের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীও সই করেছিলেন। তিনি যুদ্ধ চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এছাড়া আর কিছু করার ছিল না। যখন কেউ কাউকে রক্ষা করবে তখন যুদ্ধ অনিবার্য।
ও ফা : এই যুদ্ধ দেখ আমার মনে হয়েছে এটা দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ। একথা আমি জেনারেল অরােরা এবং জেনারেল নিয়াজীকেও বলেছি। উভয়েই উত্তর দিয়েছেন, “মূলত আমরা ভাই।”
ই গা : মূলত নয়-বরং পুরােপুরি ভাই। ভারতীয় ও পাকিস্তানীরা ভাই। আমি জানি, ঢাকার পতনের পর পাকিস্তানী ও ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের করমর্দন করতে দেখে তােমরা অবাক হয়েছে। কিন্তু ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমাদের বাহিনী ও পাকিস্তানী বাহিনীতে সৈনিক থেকে জেনারেল পর্যন্ত পরস্পর ভাই ছিল। রক্ত সম্পর্কের ভাই। একই পিতা ও মায়ের সন্তান। অথবা তুমি একপক্ষে চাচাকে, অপর পক্ষে ভাতিজাকে দেখতে। এক ভাই ভারতীয় বাহিনীতে আরেক ভাই পাকিস্তানী বাহিনীতে। এখনাে এ অবস্থাটাই সত্য। আমি তােমাকে আরাে কিছু বলবাে। এমনও সময় ছিল সুইজারল্যাণ্ডে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত দুই সহােদর ভাই। বৃটিশের চাপিয়ে দেয়া দেশ বিভাগ সত্যিই অমানবিক ছিল। এর ফলে শুধু পরিবার বিভক্ত হয়েছে, ভেঙ্গে গেছে। আমি এখনাে সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলাে স্মরণ করি। অনেক লােক দেশত্যাগ করেছে। অনেকে দেশত্যাগ করতে চায়নি। বহু মুসলিম ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে যেতে চায়নি। কিন্তু সুযােগ সুবিধা লাভের প্রােপাগাণ্ডায় তারা দেশ ছেড়েছে। অপরদিকে বহু হিন্দু পাকিস্তান ছাড়তে চায়নি। তাদের সম্পর্ক সেখানে ছিল, সম্পত্তি ছিল। অতএব তারা রয়ে গেছে।
আমরা যে শত্রু হয়েছি এল অসম্ভব মনে হয়। যখন তুমি ভাববে যে, হিন্দু ও মুসলমানরা একত্রে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেছে তখন এই শত্রুতাকে অসম্ভব মনে হবে। একথা সত্যি যে, বৃটিশদের সময়েও বিবদমান কিছু গ্রুপ ছিল। সংঘর্ষ হয়েছে। পরে আমরা দেখেছি, যারা চায়নি যে আমরা একত্রে বাস করি তারাই সংঘর্ষের প্ররােচনা দিয়েছে। আমাদেরকে বিভক্ত করার নীতি বিদেশীদের, দেশ বিভাগের পরও সে ষড়যন্ত্র রয়েছে। ভারতীয় ও পাকিস্তানীরা যদি একত্রে থাকে…..আমি কনফেডারেশনভুক্ত দেশের কথা বলছি না, সৎ প্রতিবেশী ও বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে…. ইতালি ও ফ্রান্সের মতাে….বিশ্বাস করাে আমাদের উভয়ের আরাে। অগ্রগতি হতাে। কারাে স্বার্থে আমরা সবসময় যুদ্ধ করেছি। পাকিস্তানীদের দোষ আমি

পৃষ্ঠাঃ ২৫
দেই না। আমাদেরকে আক্রমণ করতে কেউ তাদেরকে উৎসাহিত করেছে। অস্ত্র। দিয়েছে এবং তারা আমাদেরকে আক্রমণ করেছে।
ও ফা : ভুট্টো বলেছেন যে, তিনি ভারতের সাথে কনফেডারেশন গঠনে প্রস্তুত। সে সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি মিসেস গান্ধী।
ই গা : তুমি জানাে- ভুট্টো ভারসাম্যপূর্ণ লােক নয়। যখন তিনি কথা বলেন, তুমি বুঝবে না তিনি কি বুঝাতে চান। এখন তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? আমাদের বন্ধু হতে চান? আমরা তাে কিছুদিন তার সাথে বন্ধু হতে চেয়েছিলাম। আমি সবসময়ই তা চেয়েছি। পাশ্চাত্যে লােকেরা কিছু বিষয় জানে না। পাশ্চাত্যের সংবাদ মাধ্যমগুলাে সবসময় প্রচার করছে যে, ভারত পাকিস্তানের শত্রু এবং পাকিস্তান ভারতের। তারা জানে না যে, আমরা দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার পার্টি এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তখন থেকে আমরা নীতি গ্রহণ করেছি যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ভ্রান্ত এবং অবাস্তব। সংখ্যালঘুদের একটি দেশ থেকে নির্মূল করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধর্মের লােকজন অবশ্যই এক সাথে বাস করবে।
কিন্তু বর্তমান বিশ্বে কি করে সম্ভব যে, ধর্মীয় কারণে পরস্পরকে হত্যা করার ঘটনা চলতেই থাকবে? এখন আমরা যে সমস্যায় ভুগছি তা ভিন্ন। এসব সমস্যা হচ্ছে দারিদ্র্য, ব্যক্তি অধিকার এবং প্রযুক্তি পরিবর্তন। এগুলাে ধর্মের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিশ্বজনীন সমস্যা। পাকিস্তান এবং আমরা একই সমস্যায় জর্জরিত। যখন লােকজন। উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে যে, ধর্ম বিপদগ্রস্ত-আমি খুব গুরুত্ব দেই না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারতে বহুলােক একথা বলছে। তারাই বলে যে, “আমরা কোনদিন পাকিস্তানীদের অস্তিত্বকে মেনে নিইনি। যেহেতু পাকিস্তান আছে। অতএব তাকে ধ্বংস করতে হবে।” কিন্তু এ ধরনের গুটিকয়েক উন্মাদের জনগণের মধ্যে কোন ভিত্তি নেই।
ভারতে তুমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা দেখবে না। যুদ্ধের সময় সামান্য প্রচারণা ছিল স্বাভাবিক। তবু নিয়ন্ত্রিত ছিল। পাকিস্তানীরা এতে বিস্মিত হয়েছে। বন্দী শিবিরের হাসপাতালে বন্দীরা আশ্চর্য হয়ে বলেছে, “তুমি হিন্দু চিকিৎসক হয়ে আমাকে সারিয়ে তুলবে?” আমি ভুট্টোকে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, তিনি যদি জানেন যে, তিনি কি বলছেন? তিনি বলছেন, যা বলা উচিত। তিনি যদি তা বলে না থাকেন, তাহলে তার ভবিষ্যত কি হবে? আমাকে বলা হয়েছে ভুট্টো উচ্চাভিলাষী। আমি তার উচ্চাভিলাষ আশাও করি। উচ্চাশা তাকে বাস্তব অনুধাবনে সহায়তা করবে।
ও ফা : মিসেস গান্ধী, আপনি তাে ধার্মিক নন? আসলে কি?
ই গা : ভালাে কথা, এটা নির্ভর করে, তােমার কাছে ধর্ম শব্দটির অর্থ কি? আমি অবশ্যই মন্দিরে যাইনা, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিনা। কিন্তু ধর্ম দ্বারা যদি শুধু ভগবান ছাড়া মানবতার প্রতি বিশ্বাস বুঝি, যার দ্বারা মানুষের কল্যাণ হবে, তাহলে আমি ধার্মিক।
ও ফা : তাহলে আমার প্রশ্নটা বিরক্তিকর ছিল না?

পৃষ্ঠাঃ ২৬
ই গা : না, তা কেন হবে।
ও ফা : কিন্তু এবারের প্রশ্নটা বিরক্তিকর। আপনি সবসময় জোট নিরপেক্ষ নীতি ঘােষণা করেছেন। তাহলে গত আগস্টে আপনি ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন কেন? এ দুয়ের মধ্যে কি কোন দ্বন্দ্ব নেই।
ই গা : না, আমি তা বলবাে না। জোট নিরপেক্ষ অর্থ কি? এর অর্থ আমরা কোন সামরিক জোটভুক্ত নই এবং স্বাধীনভাবে যে কোন দেশের সাথে বন্ধুত্ব করার অধিকার আমাদের আছে। ভারত-সােভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পরও সকল নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যেরা যা বলুক বা ভাবুক, সােভিয়েত ইউনিয়নের কারণে আমাদের নীতির পরিবর্তন হবে না। আমরা ভালােভাবেই জানি, আমাদের লক্ষ্য বিশ্ব শান্তির সাথে জড়িত। আমাদের ভৌগােলিক অবস্থানটা লক্ষ্য করলে দেখবে সােভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক কোন বিষয়ই বদলে যায়নি। এর দ্বারা অন্য দেশের বন্ধু হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়নি। জোট নিরপেক্ষ থাকার শর্তেও কোন বাধা আসেনি এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং অন্য কেউ খুশি হবে কি হবে না তা তােয়াক্কা না করেই আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে থাকবাে। চুক্তি স্বাক্ষরের মাসখানেক পরে কেউ একজন চৌ এন লাইকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বললে তিনি বলেছিলেন, “এর দ্বারা কোন কিছু বদলে যায়নি বা পার্থক্য সৃষ্টি হয়নি।”
ও ফা : নিকট ভবিষ্যতে হ্যানয়ে ভারতীয় দূতাবাস খুললেই পার্থক্যটা লক্ষ্য করা যাবে। আপনি তাে ভিয়েতনামের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশনের প্রধান। এর। অর্থ কি? আপনি কি কমিশনারের সদস্যপদ ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ত্যাগ করবেন?
ই গা : আমি জানি না। স্পষ্টত কিছু সমস্যা হচ্ছে….। এখনাে ভাবিনি কিভাবে সমাধান করবাে। এ ব্যাপারে বলবােই বা কি। শােন তাহলে, আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশন কিছুই করছে না, কখনাে কিছু করেনি। হ্যানয়ে দূতাবাস খােলার পূর্বে আমাকে ভাবতে হবে, কিন্তু এটা খুব বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নয়। সায়গনে পরিস্থিতির স্বাভাবিক নয় এবং আমি যা করেছি তাতে আমি সন্তুষ্ট।
ও ফা : তাহলে জনগণের ধারণাই যথার্থ যে আপনার পিতার চেয়ে আপনি অনেক বাম ঘেঁষা?
ই গা : পৃথিবী যে ডান ও বামে বিভক্ত হয়ে গেছে আমি এমন কিছু দেখিনা। কে ডানে বা কে বামে মধ্যস্থলে তারও তােয়াক্কা করিনা। আমরাও যদি শব্দগুলাে ব্যবহার করি, হ্যা আমি নিজেও করি-কিন্তু এগুলাের তেমন তাৎপর্য নেই। কোন চিহ্নে আমার আগ্রহ নেই-আমি শুধু সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করতে চাই। আমি একটা লক্ষ্যে পৌছতে চাই। আমার পিতার যে লক্ষ্য ছিল তা থেকে আমার লক্ষ্য ভিন্ন নয়-জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দারিদ্রের ক্যান্সার বিদূরণ, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার পরিণতি নির্মুল। আমি সফল হতে চাই এবং সম্ভাব্য উত্তম পন্থায় সফল হতে চাই, তাতে জনগণ আমাকে বামপন্থী বা ডানপন্থী বললে এ আমি তােয়াক্কা করি না।

পৃষ্ঠাঃ ২৭
আমরা যখন ব্যাংক জাতীয়করণ করি তখনাে এই প্রশ্নটা ছিল। জাতীয়করণের মুখরােচক কথার জন্যে জাতীয়করণ নয় বা জাতীয়করণ সকল অবিচার দূর করবে সে কারণেও নয়; যেখানে প্রয়ােজন আমি সেক্ষেত্রে জাতীয়করণের পক্ষে। যখন প্রথম আমরা জাতীয়করণের কথা বিবেচনা করছিলাম, তখন আমার পার্টিতে কেউ পক্ষে, আবার কেউ বিপক্ষে ছিল। পার্টিকে ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে আমি আপােসের প্রস্তাব দিয়েছিলাম-ব্যাংকগুলােকে এক বছর সময় দেয়া হােক। এর মধ্যে যদি তারা দেখাতে পারে যে, জাতীয়করণের জরুরী নয় তাহলে সে প্রশ্নই আসবে না। বছর কাটলাে এবং আমরা উপলব্ধি করলাম, ফলাফল ভালাে নয়। অর্থ ধনী শিল্পপতি বা ব্যাংকারদের বন্ধুদের হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে জাতীয়করণ করলাম। এটা সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ বা সমাজতন্ত্রবিরােধী তা বিবেচনার বদলে প্রয়ােজনটাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। এজন্যে কেউ আমাকে বামপন্থী ভাবলে সে বােকা।
ও ফা : যা হােক, আপনি বহুক্ষেত্রেই সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করেন।
ই গা : হ্যা, কারণ আমি যা করতে চাই, এটা তার কাছাকাছি এবং সকল সমাজে এক ধরনের সমাজতন্ত্র কার্যকর, একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য অর্জিত হয় এর মাধ্যমে। কিন্তু আজকাল সমাজতন্ত্রের অর্থ অসংখ্য এবং ব্যাখ্যাও বিভিন্ন। রুশরা নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রী বলে, সুইডিশরাও সমাজতন্ত্রী। এবং ভুললে চলবে না যে, জার্মানিতেও জাতীয় সমাজতন্ত্র আছে।
ও ফা : মিসেস গান্ধী, আপনার কাছে সমাজতন্ত্রের অর্থ কি?
ই গা : ন্যায়বিচার। হ্যা, এর অর্থ ন্যায়বিচার। এর অর্থ সমতাপূর্ণ সমাজে কাজ করার চেষ্টা করা।
ও ফা : কিন্তু বাস্তবে কোন প্রকার আদর্শ হতে বিমুক্ত হওয়া। ই গা : হা। আমার নিজের একটা আদর্শ আছে-কেউ শূন্যে কাজ করতে পারে। তােমাকে অবশ্যই কোন কিছুতে বিশ্বাসী হতে হবে। আমার বাবা বলতেন, তােমার মনটাকে অবশ্যই খােলা রাখতে হবে, কিন্তু মনের মধ্যে কিছু রাখতে হবে। তা না হলে ধ্যানধারণাগুলাে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বালির মতাে গড়িয়ে পড়বে। কথা হলাে, আমার একটা আদর্শ আছে, কিন্তু আমি গোঁড়া নই। এখন গোঁড়া থাকা যায় না। বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। এমনকি কুড়ি বছর আগে তুমি যা চাইতে, এখন তা সঙ্গতিহীন, পরিত্যক্ত।
ভারত এখনাে দারিদ্র্যে পীড়িত। স্বাধীনতার কোন সুফল জনগণের বিরাট অংশ আজো পায়নি-তাহলে মুক্ত হয়ে কি লাভ? আমরা কেনই বা মুক্ত হতে চেয়েছিলাম? শুধু কি বৃটিশকে তাড়াতে? এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। আমরা সবসময় বলেছি যে, উপনিবেশবাদের প্রতিনিধি বৃটিশের বিরুদ্ধেই শুধু আমাদের সংগ্রাম নয়, আমাদের সংগ্রাম ভারতে বিরাজমান সকল অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে। সমস্ত ব্যবস্থার ত্রুটি, বর্ণ

পৃষ্ঠাঃ ২৮
প্রথা বা অর্থনৈতিক অবিচারের ফলে সৃষ্ট সমস্যা ভারতে মারাত্মক দুষ্টগ্রহ। এসব কিছুই নির্মূল হয়নি। কুড়ি বছর পর আমরা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু আমরা যে লক্ষ্য স্থির করেছিলাম তা অর্জিত হয়নি।
ও ফা : তাহলে আপনি কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছেন?
ই গা : এটা বলা শক্ত। তুমি কি কখনাে পর্বতারােহণ করেছাে? কোন পর্বতের শিখরে উঠলে মনে হবে তুমি সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছে। কিন্তু সে ধারণা বেশিক্ষণ টিকে না। শীঘ্রই দেখবে, তুমি যে শিখরে উঠেছে তা খুব নিচু। উঁচু শিখরে উঠতে হলে বহু পর্বতে আরােহণ করতে হবে। উঁচুতে উঠতে থাকলে উঠতে ইচ্ছা হবে।
আমি বলতে চাই, ভারতে দারিদ্রের বহু দিক রয়েছে। শুধু শহুরে দারিদ্র নয়, উপজাতিগুলাের মধ্যে দারিদ্র্য রয়েছে, বনে-জঙ্গলে, পার্বত্য এলাকায় বহু দরিদ্র লােকের বাস। শহরের দরিদ্র লােকেরা ভালাে আছে বলে কি আমরা তাদের অবহেলা করতে পারি? যখন কেউ একটা দেশ শাসন করে, বিশেষ করে ভারতের মতাে বিশাল ও সমস্যাপূর্ণ দেশে কিছুই হাসিল করা যায় না। যখনই তুমি ভাববে কিছু অর্জিত হয়েছে, তখনই উপলব্ধি করবে কিছুই অর্জিত হয়নি। এরই মধ্যে একটা স্বপ্নের দিকে এগুতে হবে এত দূর যে কোনদিন সে পথের শুরু বা শেষ হয় নি।
ও ফা : মিসেস গান্ধী, আপনি সে পথের কোথায় উপনীত হয়েছেন?
ই গা : খুব গুরুত্বপূর্ণ এক পর্যায়ে। এক পর্যায়ে ভারতীয়রা যে কিছু করতে পারে সে ব্যাপারে আমি আশ্বস্ত। প্রথমে লােকজন আমাদের বলতাে,“আপনারা কি এটা করতে পারবেন?” আমরা চুপচাপ থাকতাম, কারণ আমরা নিজেদের বিশ্বাস করতাম না, আমরা যে কিছু করতে পারবাে সে বিশ্বাস আমাদের ছিল না। এখন আর কেউ বলে না, “পারবেন কি?” বরং বলে, “কখন কাজটা করবেন?” ভারতীয়রা শেষ পর্যন্ত নিজেদের বিশ্বাস করছে যে, তারা কিছু করতে পারে। “কখন” শব্দটি একজন মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন ব্যক্তি যদি কখনাে ভাবে যে সে কিছু করতে পারবে না, তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। সে যদি খুব বুদ্ধিমান বা মেধাসম্পন্ন হয়, তবুও না। সামর্থ্য হবার শর্ত হলাে নিজের উপর আস্থা। জাতি হিসাবে আজ আমরা নিজেদের উপর আস্থাশীল হতে পেরেছি। ভাবতে আমার ভালাে লাগে যে, আমিই আস্থাশীল করতে পেরেছি। তারা এখন গর্বিত। কেউ এই গর্ব আরােপ করতে পারে না এবং সহসা ভেঙ্গেও যায় না। এটা এক ধরনের অনুভব যা ধীরে ধীরে জন্মায়। আমাদের যা গর্ব-অহংকার তা জন্মেছে গত পঁচিশ বছরে। অন্যেরা এটা বুঝতে না পেরে ভুল ধারণা পােষণ করে। পাশ্চাত্যের লােকেরা ভারতীয়দের প্রতি কখনাে উদার ছিল না। ধীরে ধীরে সবকিছু বদলাচ্ছে তা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে। কিছু একটা ঘটেছে-খুব বেশি নয়, কিন্তু কিছু।
ও ফা : মিসেস গান্ধী আপনি নিজেই তাে যথেষ্ট অহঙ্কারী।

পৃষ্ঠাঃ ২৯
ই গা : না, আমি অহঙ্কারী নই।
ও ফা : অবশ্যই আপনি অহঙ্কারী। ১৯৬৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বিশ্ব যে সাহায্যের প্রস্তাব করেছিল তা নিতে অস্বীকৃতি জানানাে অহঙ্কার নয়? আমার মনে আছে একটি জাহাজ শস্য, খাদ্য বােঝাই করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি নেপলস বন্দর ত্যাগ করেনি এবং সব সামগ্রী পচে গেছে। অন্যদিকে ভারতের লােকজন মারা যাচ্ছিল।
ই গা : এ ঘটনা আমি কখনাে শুনিনি। আমি জানিনা যে, জাহাজটা বােঝাই করে ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল-তাহলে হয়তাে নিতে অস্বীকার করতাম না। তবে এটা সত্য যে আমি বিদেশী সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিলাম। এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না। গােটা দেশই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিশ্বাস করাে, এটা ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জনগণ, সকল রাজনৈতিক দল পার্লামেন্টের ডেপুটিরা পর্যন্ত বিদেশী সাহায্যের বিরােধী ছিল। ভিক্ষুকের জাতি হিসাবে পরিচিত হওয়ার চেয়ে ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ উত্তম-এই ছিল চেতনা। যারা আমাদের সাহায্য দিতে চেয়েছে তাদের কাছে এই চেতনা ব্যাখ্যা করেছি। আমি জানি এতে তােমরা আহত হয়েছ। অনেক সময় কিছু না বুঝে আমরা একে অন্যকে আহত করি।
ও ফা : আমরা আপনাকে আহত করতে চাইনি।
ই গা : আমি জানি এবং বুঝি তােমাকেও অবশ্যই আমাদেরকে বুঝতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে। তােমরা বলেছ, “সংঘাত ছাড়া কি করে যুদ্ধ সম্ভব? আমরা তাে কোন সংঘাত ছাড়াই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তােমরা বলেছ, “অশিক্ষিত জনগণ, যারা ক্ষুধায় মরছে, সেখানে কি করে গণতন্ত্র চর্চা হবে?” কিন্তু আমরা সেই জনগণ দিয়েই কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। তােমরা বলেছ, “পরিকল্পনা হয় কমিউনিস্ট দেশের জন্য। গণতন্ত্র ও পরিকল্পনার পাশাপাশি চলতে পারে না।” কিন্তু সকল ভুলভ্রান্তির মধ্যে আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। এরপর আমরা ঘােষণা করেছি, ভারতে মানুষ আর অনাহারে থাকবে না। তােমাদের সাড়া ছিল, “অসম্ভব। তােমরা কখনাে সফল হবে না।” কিন্তু আমরা সফল হয়েছি। এখন ভারতে না খেয়ে কেউ মরে না। খাদ্য চাহিদা অপেক্ষা অধিক। সবশেষে আমরা জন্মহার সীমিত রাখতে প্রতিজ্ঞা করেছি। তােমাদের তাও বিশ্বাস হয় না, অবজ্ঞার হাসি হাসাে। গত দশ বছরে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে সাত কোটির উপরে। কিন্তু এই হার অনেক দেশের চেয়ে কম।
ও ফা : সাধারণতঃ কি ভয়াবহ পদ্ধতিতে, পুরুষের নিবীর্যকরণের মতাে। আপনি কি তা অনুমােদন করেন?
ই গা : সুদূর অতীতে ভারতে যখন জনসংখ্যা কম ছিল, তখন নারীকে আশীর্বাদ করা হতাে, “তােমার অসংখ্য সন্তান হােক”। আমাদের অধিকাংশ মহাকাব্য ও সাহিত্যে এর উপর জোর দেয়া হয়েছে এবং আজো নারীর যে অসংখ্য সন্তান হওয়া উচিত, এ ধারণা দূর হয়নি। আমার অন্তরও বলে, মানুষ যত সংখ্যক সন্তান কামনা

পৃষ্ঠাঃ ৩০
করে তাই হওয়া উচিত। কিন্তু এটা ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের সহস্র বর্ষ ধরে লালিত অনেক ধারণার মতাে এ ধারণারও মূলােচ্ছেদ করতে হবে। পরিবার, সন্তানদের রক্ষা করতে হবে। শিশুদের দৈহিক ও মানসিক পরিচর্যা করতে হবে। তুমি কি জানাে, এখনাে দরিদ্র লােকেরা সন্তানের জন্ম দেয় তাদের দায়িত্ব নেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কি করে এই প্রাচীন ব্যবস্থাকে সহসা বলপূর্বক পরিবর্তন করা সম্ভব? একমাত্র উপায় পরিকল্পিত জন্ম। পুরুষকে নিবীর্যকরণ জন্ম নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি। অত্যন্ত নিরাপদ ও উন্নত পদ্ধতি। তােমার কাছে ভয়ঙ্কর। যথাযথভাবে এটা করলে মােটেই ভয়ঙ্কর নয়। যে লােকটি আট বা দশটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে তাকে নিবীর্যকরণের মধ্যে দোষের কিছু দেখিনা। বিশেষ করে এর ফলে সেই আট বা দশটি সন্তানের জীবন যদি উন্নত হয়।
ও ফা : আপনি কি কখনাে নারীমুক্তির পক্ষে ছিলেন, মিসেস গান্ধী?
ই গা : না, কোনদিন না। আমার প্রয়ােজন হয়নি। আমি যা করতে চেয়েছি, সবসময় তা করতে সক্ষম হয়েছি। আমার মা নারীমুক্তির পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন নারী হওয়াটা সবচেয়ে ঝামেলার। তার নিশ্চয়ই যুক্তি ছিল। তার সময়ে নারীকে পর্দার অন্তরালে থাকতে হতাে, ভারতের প্রায় সকল রাজ্যেই তারা রাস্তায়ও বেরুতে পারতাে না। মুসলিম নারীদের পর্দা প্রথা পালন করতে হতাে। হিন্দু নারীদের ডােলীতে চড়ে বাইরে বেরুতে হতাে। আমার মা অত্যন্ত তিক্ততার সাথে এসব বলতেন। দুইবােন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড় এবং ভাইদের সাথে তিনি বড় হয়েছেন প্রায় দশ বছর পর্যন্ত। এর পর তাকে বাধ্য করা হলাে নারীর লক্ষ্য অনুসরণ করতে-‘এটা করা ঠিক নয়’ ‘ওটা ভালাে নয়। “নারীর জন্যে কাজটা অনুচিত”-ইত্যাদি।
একটা বিশেষ সময়ে তার পরিবারকে জয়পুর চলে যেতে হলাে। সেখানে নারীর পক্ষে পর্দা এড়িয়ে চলা সম্ভব ছিল না। তাকে সকাল হতে রাত অবধি ঘরের মধ্যেই থাকতে হতাে-রান্নাবান্না করে অথবা কিছুই না করে। তিনি কিছু না করাকে ঘৃণা করতেন, রান্নার কাজও ঘৃণা করতেন। অতএব ফ্যাকাশে ও অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং ঠাকুর্দা বলতেন, “এখন কে ওকে বিয়ে করবে?” আমার ঠাকুরমা অপেক্ষা করতেন কখন ঠাকুর্দা বাইরে যায়। বাইরে চলে গেলেই তিনি মাকে ছেলের পােশাক পরিয়ে তার ভাইয়ের সাথে সাইকেল চালাতে দিতেন। ঠাকুর্দা কখনাে এটা জানতে পারেননি এবং ঠাকুরমা একটুও না হেসে আমাকে গল্পটা বলতেন। এই অবিচারের স্মৃতি তার মন থেকে কখনাে মুছে যায়নি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মা নারীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। নারী আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন তিনি। তিনি এত মহান নারী, বিরাট ব্যক্তিত্ব।
ও ফা : আপনি তাদের সম্পর্কে কি ভাবেন, মিসেস গান্ধী? আমি বলতে চাই, তাদের মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে?

পৃষ্ঠাঃ ৩১
ই গা : এটা খুব ভালাে। কারণ গুটিকয়েক লােক জনগণের নাম ভাঙ্গিয়ে জনগণের অধিকারের কথা বলেছে। কিন্তু এখন তারা প্রতিনিধির বদলে প্রত্যেকে নিজের কথা বলতে চায়, সরাসরি অংশগ্রহণ করে-একথা নিগ্রো-ইহুদী, নারী সবার জন্য প্রযােজ্য। নারী বিরাট এক বিদ্রোহের অংশ। নারীরা অনেক সময় বাড়াবাড়ি করে, এটা সত্য আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছুটা শিখেছি। ভারতে নারী পুরুষদের মধ্যে কখনাে দ্বন্দ্বপূর্ণ প্রতিযােগিতা ছিল না। যখনই কোন নারী নেতৃত্বে এসেছে, হয়তাে রাণী হিসাবে- জনগণ তাকে গ্রহণ করেছে। এতে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। ভুললে চলবে না। যে, ভারতের শক্তির চিহ্ন হচ্ছে নারী। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে নারী ও পুরুষ সমানভাবে স্বাধীনতার পর কেউ তা ভুলে যায়নি। পাশ্চাত্যে এ ধরনের কিছু ঘটেনি। নারীরা অংশগ্রহণ করেছে সত্য কিন্তু সেখানে বিপ্লব করেছে সবসময় পুরুষরা।
ও ফা : আমরা এখন ব্যক্তিগত প্রশ্নে আসতে পারি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার মতাে একজন নারী কি নিজেকে পুরুষ বা নারীদের মধ্যে সচ্ছন্দ বােধ করে?
ই গা : আমার জন্যে এতে কোন পার্থক্য নেই। আমি প্রত্যেককে একভাবে বিবেচনা করি। আমি দেখি ব্যক্তি হিসাবে-পুরুষ বা নারী হিসেবে নয়। এক্ষেত্রেও তােমাকে দেখতে হবে যে, আমি বিশেষ ধরনের শিক্ষালাভ করেছি। আমি আমার পিতার মতাে একজন পুরুষ ও মায়ের মতাে একজন নারীর কন্যা। ছেলের মতাে আমি বড় হয়েছি। কারণটা ছিল আমাদের বাড়িতে যে শিশুরা আসতাে, তাদের অধিকাংশই ছেলে। ছেলেদের সাথে আমি গাছে চড়েছি, দৌড়ের প্রতিযােগিতা করেছি, কুস্তি লড়েছি। ছেলেদের নিয়ে কোন জটিলতা বা হীনমন্যতা আসেনি আমার মধ্যে। একই সময়ে আমি পুতুল ভালােবাসতাম। অনেক পুতুল ছিল আমার। পুতুলগুলাের কোন সন্তান ছিল না বললেই চলে। তারা ছিল নারী ও পুরুষ। ব্যারাকে হানা দিতাে। কারাগারে আবদ্ধ থাকতাে ইত্যাদি। ব্যাপারটা হলাে, শুধু আমার বাবা মা নয়, পুরাে পরিবার প্রতিরােধ আন্দোলনে জড়িত ছিল। যখন তখন পুলিশ এসে নির্বিচারে তাদের ধরে নিয়ে যেতাে।
ও ফা : এছাড়া ছিল জোয়ান অব আর্কের গল্প তাই না?
ই গা : হ্যাঁ, সত্য। জোয়ান অব আর্ক ছিল আমার শৈশবের স্বপ্ন। দশ/বারাে বছর বয়সে যখন ফ্রান্সে গেছি, তখন তাকে আবিষ্কার করেছি। আমার মনে পড়ে না, কোথায় তার সম্পর্কে পড়েছি। কিন্তু আমার জন্যে সে মুহূর্তে একটি সুনির্দিষ্ট গুরুত্ব সৃষ্টি করেছিল। দেশের জন্যে আমি প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছি। এটা বােকামির মতাে মনে হলেও শৈশবে যা ঘটে আমাদের জীবনে তা চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
ও ফা : বাস্তবিকই তা হয়। আমি বুঝতে চাই, আপনি যে আজকের পর্যায়ে এসেছেন, তা কি করে মিসেস গান্ধী?
ই গা : আমার জীবন ছিল সমস্যাপূর্ণ, কঠোর। শৈশব থেকে আমি দুঃখ ভােগ করেছি। সমস্যার মধ্যে কাটানােটা আমার জন্যে মঙ্গলজনক ছিল এবং আমার সমসাময়িক বহু লােককে সমস্যায় কাটাতে হয়েছে। এখনকার নবীনেরা কি সে স্বপ্ন

পৃষ্ঠাঃ ৩২
দেখে, যে স্বপ্ন আমাদের জীবনকে গঠন করেছিল। আমার শৈশবের জীবনটা সুখকর ছিল না। আমি শুকনাে অসুস্থ এবং ভীতু বালিকা ছিলাম। পুলিশ যখন পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যেতাে, সপ্তাহর পর সপ্তাহ মাসের পর মাস আমাকে নিঃসঙ্গ থাকতে হতাে। শীঘ্রই একা থাকতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আট বছর বয়সে আমি ইউরােপে গিয়েছি। সে বয়সে আমি ভারত ও সুইজারল্যাণ্ডে, সুইজারল্যাণ্ড ও ফ্রান্সে, ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডে। একজন বয়ষ্কের মতাে নিজের অর্থের হিসাব নিকাশ করতাম। লােকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে। কে আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে? আপনার পিতা? মহাত্মা গান্ধী? হ্যা আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা মূলত তাদের দ্বারা প্রভাবিত। সাম্যের চেতনায় তারা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ন্যায়ের প্রতি আমার অনুরাগ এসেছে পিতার নিকট হতে এবং তিনি তা পেয়েছেন মহাত্মা গান্ধীর নিকট হতে। তবে একথা বলা ঠিক নয় যে, আমার উপর পিতার প্রভাব বেশি এবং আমার পক্ষে বলাও সম্ভব নয় যে, আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে কার প্রভাব বেশি-মা, বাবা অথবা মহাত্মা গান্ধীর, অথবা যেসব বন্ধুরা আমার সাথে ছিলেন, তাদের। কারাে একার প্রভাব নয়, সবার। কেউ কখনাে আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি। কেউ আমাকে দীক্ষা দেয়নি। আমি সবসময় স্বাধীনতার মধ্যে কিছু খুঁজতে চেষ্টা করেছি। আমার পিতা সাহসিকতার খুব গুরুত্ব দিতেন এবং ভীতুদের পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি আমাকে কখনাে বলেননি যে, “আমি তােমাকে সাহসী দেখতে চাই।” যখনই কঠিন কাজ করেছি অথবা ছেলেদের সাথে দৌড়ে জয়ী হয়েছি, তখন গর্বে মৃদু হাসতেন।
ও ফা : আপনি নিশ্চয়ই পিতাকে খুব ভালবাসতেন?
ই গা : অবশ্যই। আমার পিতা একজন সাধু ব্যক্তি ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে যে গুণ থাকে তা থেকে তিনি একজন সাধুর কাছাকাছি ছিলেন। তিনি এত ভালাে, এত মহৎ ছিলেন। আমি সবসময় তার পক্ষে ছিলাম-শৈশবে এবং এখনাে। তিনি কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন না-কোন ব্যাখ্যায়ই না। তার কর্মের মধ্যেই তিনি টিকে থাকবেন-ভারতের ভবিষ্যত চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতাে। আমরা। পরস্পরকে বুঝতাম।
ও ফা : আর মহাত্মা গান্ধী?
ই গা : তার মৃত্যুর পর অনেক কথা বলা হচ্ছে। তিনি একজন ব্যতিক্রমধর্মী লােক ছিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিমান, জনগণের জন্যে অসম্ভব রকমের দরদ এবং ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণের একাগ্রতা ছিল তার। তিনি বলতেন ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত একজন হরিজন অস্পৃশ্য মেয়ের। শ্রেণী প্রথার বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ছিলেন। নারীর উপর নির্যাতন তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন তখন তার সাথে মিশতাম। স্বাধীনতার পর তার সাথে বহু কাজ করেছি-হিন্দু-মুসলিম সমস্যা যখন চরমে তখন। মুসলমানদের প্রতি দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমার উপর তাদের রক্ষার দায়িত্বে তিনি মহান ছিলেন। আমার

পৃষ্ঠাঃ ৩৩
পিতা ও আমার মধ্যে যে সমঝােতা ছিল, মহাত্মা ও আমার মধ্যে সে সমঝােতা ছিল না। তিনি সবসময় ধর্মের কথা বলতেন এবং সেটাই সঠিক বলে মনে করতেন। অনেক ব্যাপারেই আমরা তরুণরা তার সাথে একমত হতাম না।
ও ফা : আবার আপনার প্রসঙ্গে ফিরে আসি মিসেস গান্ধী। এটা কি সত্য যে আপনি বিয়ে করতে চাননি?
ই গা : হ্যা, আঠার বছর পর্যন্ত চাইনি। কারণ আমি আমার পুরাে শক্তি নিয়ােজিত করতে চেয়েছিলাম ভারত স্বাধীন করার সংগ্রামে। আমার ধারণা ছিল, বিয়ে করলে আমি সে দায়িত্ব পালন করতে পারবাে না। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মন পরিবর্তন করলাম এবং আমার বয়স যখন আঠার তখন বিয়ের সম্ভাবনা বিবেচনা করতে শুরু করলাম। স্বামী পাবার জন্য নয়, সন্তান লাভের জন্য। আমি সব সময় সন্তান কামনা করতাম-যদি আমার উপর নির্ভর করতাে, তাহলে আমার ১১টা সন্তান হতাে। আমার স্বামী চাইতেন মাত্র দুটো।
তােমাকে আরাে একটা কথা বলি। আমার ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছিল যাতে আমি একটা সন্তানও ধারণ না করি। আমার স্বাস্থ্য ভালাে ছিল না এবং তারা বলতাে, গর্ভধারণ করলে খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। তারা যদি একথা না বলতাে, তাহলে হয়তাে আমি বিয়েই করতাম না। কিন্তু তাদের ব্যবস্থাপত্র আমাকে প্ররােচিত করলাে। আমি বললাম, “তাহলে একথা কেন ভাবছেন যে বিয়ে করবাে, অথচ সন্তান নিতে পারবাে না। আমি শুনতে চাই না যে, আমার সন্তান হতে পারবে না। আমাকে বলুন। সন্তান পাওয়ার জন্য আমাকে কি করতে হবে।” তারা কাঁধ ঝাকাল এবং মত ব্যক্ত করলাে যে, এজন্য আমাকে কিছু ওজন বাড়াতে হবে। এত শুকনাে অবস্থায় আমার পক্ষে কখনাে গর্ভ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আমি ওজন বাড়াতে থাকলাম। কডলিভার অয়েল খাওয়া শুরু করলাম। খাবার পরিমাণ দ্বিগুণ হলাে। এক আউন্স ওজনও বাড়লাে না। এরপর আমি স্বাস্থ্য নিবাস মুসুরীতে গেলাম এবং ডাক্তারদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করলাম। নিজস্ব পদ্ধতি পালন করে আমার ওজন বাড়লাে। অথচ এখন উল্টো করতে হচ্ছে। এখন শুকনাে থাকাটাই সমস্যা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার পক্ষে ম্যানেজ করা অসম্ভব হয় না। আমি খুব দৃঢ়চিত্তের লােক।
ও ফা : হ্যা আমি তা উপলব্ধি করেছি এবং আপনি বিয়ে করে আপনার দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন।
ই গা : বাস্তবিক তাই। কেউ সে বিয়ে চায়নি। কেউ না। মহাত্মা গান্ধীও এতে সুখী হননি। আমার পিতা এই বিয়ের বিরােধিতা করেছিলেন, একথা সত্য নয়, তিনি খুব আগ্রহ দেখাননি। আমার মনে হয় যে সব পিতার মেয়ে একটাই তারা চান বিয়ে একটু দেরিতে হােক। যাহােক, আমার প্রেমিক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি একজন পার্সী। এটা কেউ সহ্য করতে পারেনি-গােটা ভারত আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। তারা মহাত্মার কাছে, আমার পিতার কাছে লিখেছে। অপমান করেছে। হত্যার হুমকি

পৃষ্ঠাঃ ৩৪
দিয়েছে। প্রতিদিন ডাকপিয়ন আসততা বিরাট একটা বস্তা নিয়ে এবং মেঝের উপর চিঠির স্থূপটা রাখতাে। আমরা চিঠি পড়াও বাদ দিয়েছিলাম। আমরা কিছু বন্ধুকে সেগুলাে পড়ে আমাদের জানাতে বলতাম-“একজন তােমাকে টুকরাে টুকরাে করে কাটতে চেয়েছে। একজন তার স্ত্রী থাকার পরও তােমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে কারণ সে হিন্দু।” এক পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধী এই বিতর্কে অংশ নিলেন-তার পত্রিকায় এ ব্যাপারে একটা নিবন্ধ দেখেছিলাম। তাতে তিনি লােকজনের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়ার জন্য এবং সংকীর্ণ মানসিকতা পরিহার করার জন্য। এসবের মধ্যে আমি ফিরােজ গান্ধীকে বিয়ে করলাম। আমার মাথায় একবার কিছু ঢুকলে দুনিয়ার কেউই তা আর বদলাতে পারবে না।
ও ফা : আশা করি আপনার পুত্র রাজীব গান্ধী একজন ইতালীয় মেয়েকে বিয়ে করার কারণে সে ধরনের কিছু ঘটেনি?
ই গা : সময় বদলেছে। আমাকে যে ক্রোধ অতিক্রম করতে হয়েছে ওদের তা হয়নি। ১৯৬৫ সালে রাজীব লণ্ডন থেকে আমাকে লিখলাে, “তুমি সবসময় আমাকে মেয়ের ব্যাপারে বলতে যে, আমার কোন বিশেষ মেয়ে আছে কি না, ইত্যাদি। আমি একটি বিশেষ মেয়ের দেখা পেয়েছি। আমি তাকে প্রস্তাব দেইনি। কিন্তু এই সে মেয়ে, আমি যাকে বিয়ে করতে চাই।” এক বছর পর আমি যখন লণ্ডন গেলাম, মেয়েটির সাথে আমার দেখা হলাে। রাজীব ভারতে ফিরে এলে তাকে বললাম, “তুমি কি এখনাে আগের মতােই মেয়েটিকে নিয়ে চিন্তা করাে?” রাজীব হ্যা বললাে। কিন্তু একুশ বছর না হওয়া পর্যন্ত সে মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না এবং যে পর্যন্ত না সে নিশ্চিত হয় যে সে ভারতে বাস করতে পারবে। আমরা তার একুশ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সে ভারতে এলাে এবং বললাে ভারতকে তার ভালাে লেগেছে। আমরা বিয়ের পাকা কথা ঘােষণা করলাম। দু’মাস পর তারা স্বামী-স্ত্রী হলাে। সােনিয়া এখন পুরােপুরি ভারতীয় হয়ে গেছে, যদিও সে সবসময় শাড়ি পরে না। আমিও সবসময় শাড়ি পরি না। আমি যখন লণ্ডনে ছাত্রী ছিলাম, কখনাে কখনাে পাশ্চাত্যের পােশাক পরতাম। ঠাকুর মা হওয়ার খুব সখ ছিল আমার এবং দু’জনের ঠাকুরমা আমি। রাজীব ও সােনিয়ার এক ছেলে ও এক মেয়ে।
ও ফা : আপনার স্বামী বেশ ক’বছর পূর্বে গত হয়েছেন। আপনি কি কখনাে পুনরায় বিয়ের কথা ভেবেছেন?
ই গা : না, কারাে সাথে বসবাস করতে ভালাে লাগবে এমন কারাে সাথে যদি দেখা হতাে, তাহলে হয়তাে সমস্যাটার কথা ভাবা যেতাে। কিন্তু তেমন কারাে দেখা পাইনি আমি। আমি সুনিশ্চিত যে, আমি আর বিয়ে করবাে না। আমি কেন আবার বিয়ে করবাে, আমার জীবনতাে পরিপূর্ণ। এ প্রশ্নই উঠে না।
ও ফা : তাছাড়া, আমি আপনাকে একজন গৃহবধূ হিসেবে কল্পনা করতেই পারি না।

পৃষ্ঠাঃ ৩৫
ই গা : তােমার ধারণা ভুল। আমি একজন খাটি গৃহবধূ। মা হওয়ার কারণে যে সব কাজ তা আমি সবসময় পছন্দ করতাম। মা হতে, গৃহবধূ হতে আমাকে কোন ত্যাগ করতে হয়নি। আমার ছেলেদের প্রতি ভালােবাসা বাড়াবাড়ি গােছের এবং আমার মনে হয় ওদের লালন পালন করে এক বিরাট দায়িত্ব পালন করেছি। এখন দুজনই ভালাে এবং দক্ষ মানুষ। আমি অনেক মেয়ে মানুষকে বুঝতে পারি না, যারা তাদের সন্তানদের কারণে নিজেদের অসহায় মনে করে না। তােমার সময়কে যদি গুছিয়ে নিতে পারাে বুদ্ধিমত্তার সাথে তাহলে দু’টো দিকের সমন্বয় সাধন খুব কঠিন নয়। আমার ছেলেরা যখন ছােট ছিল, তখনাে আমি কাজ করেছি। ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের একজন কর্মী ছিলাম আমি। একটা ঘটনা বলি তােমাকে। রাজীবের বয়স যখন মােটে চার বছর এবং কিণ্ডারগার্টেনে যাচ্ছিল তখন ওর এক ছােট্ট বন্ধুর মা আমাদের সাথে দেখা করতে এসে বললাে, “এটা খুব দুঃখের ব্যাপার যে, ছােট্ট ছেলেটির সাথে কাটাবার মতাে সময় আপনার নেই।” রাজীব সিংহের মতাে গর্জে উঠলাে, “আপনি আপনার ছেলের সাথে যতটা সময় কাটান, আমার মা তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটান আমার সাথে। আপনার ছেলে তাে বলে যে আপনি ওকে সবসময় একা রেখে ব্রিজ খেলতে যান।” যে নারী কিছু না করে ব্রিজ খেলে তাকে আমার পছন্দ নয়।
ও ফা : তাহলে আপনার জীবনে দীর্ঘ একটা সময় যখন আপনি রাজনীতির বাইরে ছিলেন। আপনি কি তা বিশ্বাস করেন না?
ই গা : রাজনীতি……….দেখাে, এটা নির্ভর করে কোন ধরনের রাজনীতি। আমার পিতার সময়ে আমরা যা করেছি সে ছিল কর্তব্য। এর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। আমরা এখন যা করছি, তুমি মনে করাে না যে, আমি এ ধরনের রাজনীতিতে উৎসাহী। আমার ছেলেদের এই রাজনীতির বাইরে রাখতে আমি সবকিছু করেছি এবং সফলও হয়েছি। স্বাধীনতার পর আমি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলাম। আমার ছেলেদের প্রয়ােজন ছিল আমাকে। সমাজসেবী হিসেবে কাজ করতে আমি পছন্দ করতাম। যখন এটা আমার কাছে সুস্পষ্ট হলাে যে আমার পার্টি ঠিকভাবে চলছে না, তখনই আমি রাজনীতিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যুক্তি খুঁজতাম। আমার পিতার সাথে এবং সবার সাথে, যাদেরকে আমি শৈশব থেকে জানতাম। ১৯৫৫ সালের একদিন নেতাদের একজন অবাক হয়ে আমাকে বললেন, “তুমি তাে সমালােচনা” ছাড়া আর কিছুই করছােনা। তুমি যদি ভুল শােধরাতে পারাে, তাহলে শােধরাও।” আমি কখনাে চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করতে পারি না। অতএব আমি প্রচেষ্টা চালালাম। কিন্তু আমার মনে। হলাে এটা সাময়িক এবং আমার পিতা, যিনি আমাকে তার কাজে জড়িত করার চেষ্টা করেননি, তিনিও আমার মতাে অভিন্ন চিন্তা করতেন। লােকজন বলাবলি করতাে, আমার পিতা আমাকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যে প্রস্তুত করেছেন। তিনি যখন আমাকে সাহায্য করতে বললেন, আমি তার পরিণতি সম্পর্কে ভাবিনি।

পৃষ্ঠাঃ ৩৬
ও ফা : সবকিছু তাহলে তার কারণেই শুরু হয়েছিল?
ই গা : তা তাে বটেই তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার বাড়ির দায়িত্ব পালন। করা, তার সেবা করার মানেই রাজনীতিতে আমার হাত পড়া। সরাসরি অভিজ্ঞতার ফাঁদে আটকে যাওয়াও বুঝায়। ১৯৫৭ সালের এক সপ্তাহান্তে আমার পিতাকে উত্তরে যেতে হয়েছিল এক সমাবেশে। তার সাথে গিয়েছিলাম আমি বরাবরের মতাে। আমরা চাম্বায় পৌছে দেখলাম আমাদের সময়সূচীর দায়িত্বে যে ভদ্রমহিলা তিনি ভিন্ন একস্থানে পৃথক একটা বৈঠকের ব্যবস্থা রেখেছেন। আমার পিতা যদি চাম্বার সমাবেশ বাদ দেন। তাহলে আমরা চাষায় নির্বাচনে হেরে যাবাে। পাঠানকোটের কাছে অন্য এক শহরের সমাবেশ বাদ দিলে সেখানে আমরা হারবাে। পরামর্শ দিলাম, “যদি আমি গিয়ে বলি যে, একই সময়ে দুটো জায়গায় বক্তৃতা দেয়া সম্ভব নয়।” তিনি উত্তর দিলেন যে, এটা অসম্ভব। আমাকে খারাপ রাস্তা দিয়ে তিনশ’ মাইল যেতে হবে এবং এখন রাত ২টা। শুভরাত্রি বলে বিছানায় এলাম। ধারণাটা আমার কাছে ভালাে লাগছিল। ভাের সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে জেগে দরজার নিচে একটা নােট দেখলাম। এতে বলা হয়েছে, “একটা বিমান তােমাকে পাঠানকোট নিয়ে যাবে। সেখান থেকে গাড়িতে তিন ঘন্টা। যথাসময়েই তুমি পৌছবে।” যথাসময়ে পৌঁছে আমি সমাবেশে যােগ দিলাম। এটা সফল হল এবং আমাকে আরাে সমাবেশের জন্যে ঢাকা হলাে। সেই ছিল সূচনা………।
ও ফা : আপনি কি তখন বিবাহিতা ছিলেন, নাকি ইতিমধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল?
ই গা : আমি সব সময় বিবাহিতা অবস্থায়ই ছিলাম। সব সময়……তার মৃত্যু পর্যন্ত। আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছিল-এটা ঠিক নয়। আমার স্বামী থাকতেন লক্ষ্মৌতে এবং পিতা থাকতেন দিল্লীতে। আমাকে দিল্লী-লক্ষ্মৌ দৌড়াতে হতাে…..দিল্লীতে থাকতে আমার স্বামীর যখন প্রয়ােজন হতাে আমি তখন লক্ষ্মৌ ছুটতাম। আমি লক্ষ্মৌ থাকলে আমার পিতার যখন আমাকে প্রয়ােজন হতাে, ছুটে আসতাম দিল্লীতে। না, এটা খুব স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল না। দিল্লী ও লক্ষ্মেীর মধ্যে বেশ দূরত্ব। হ্যা, আমার স্বামী রাগ করতেন এবং ঝগড়া করতেন। আমরা উভয়ে ঝগড়া করতাম। বহু ঝগড়া করেছি। আমরা-একথা সত্য। আমরা উভয়ে সমানভাবে কঠোর লােক ছিলাম- কেউ হারতে চাইতাম না। আমার মনে হয় ঝগড়া করে ভালােই হয়েছে, আমার জীবন প্রাণবন্ত হয়েছে। ঝগড়া ছাড়া আমাদের জীবনটা হতাে স্বাভাবিক, একঘেঁয়ে ও বিরক্তিকর। আমাদের বিয়েটা তাে চাপিয়ে দেয়া ছিল না, আমাকে সে পছন্দ করেছিল-আমি বলতে চাই, সেই আমাকে পছন্দ করেছিল, আমি করিনি। আমি জানি না বিয়ের কথা হওয়ার পর আমি ওর চেয়ে বেশি ভালােবেসেছিলাম কিনা? পরে আমার মধ্যে ভালােবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমার পিতার জামাতা হওয়া তার পক্ষে সহজ ছিল না। কারাে পক্ষেই তা সহজ ছিল না। এটা ভুললে চলবে না যে সেও পার্লামেন্টে ডেপুটি ছিল। এক সময় সে

পৃষ্ঠাঃ ৩৭
সিদ্ধান্ত নিলাে যে লক্ষ্মৌ ছেড়ে দিল্লীতে থাকবে, আমার পিতার বাড়িতে। কিন্তু পার্লামেন্টের ডেপুটি হয়ে সে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে কি করে লােকজনের সাথে সাক্ষাৎ করবে? খুব সহজে বুঝলাে ব্যাপারটা এবং একটা ছােট্ট বাড়ি নিলাে। খুব ভালাে বাড়ি নয়। জীবন তার জন্যে খুব সহজ ছিল না।
ও ফা : আপনি কি কখনাে অনুতাপ করেছেন, দুঃখ করেছেন? কিংবা ভয়?
ই গা : না, কখনাে না। যে কোন ভয় আসলে সময়ের অপচয়, দুঃখবােধের মতােই। আমি যা কিছু করেছি, আমার ইচ্ছায় করেছি। যখন ছােট ছিলাম, বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়েছি মাংকি ব্রিগেডে অথবা যখন বালিকা ছিলাম, সন্তান চেয়েছি এবং নারী হিসেবে যখন পিতার সেবা করেছি কিংবা স্বামীকে যখন ক্রোধান্বিত করেছি-আমি সব সময় একটা বিশ্বাস থেকেই করেছি। যখন কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন পরিণতিও মেনে নিয়েছি। এমনকি দেশের সাথে জড়িত নয়, সেক্ষেত্রেও একই ভূমিকা আমার। আমার মনে পড়ে, জাপান যখন চীনে অভিযান চালায় তখন আমি কেমন ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। আমি শীঘ্র একটি কমিটিতে যােগ দিয়ে অর্থ ও ঔষধপত্র সংগ্রহ শুরু করি এবং একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের জন্য স্বাক্ষর করি। জাপানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাই। আমার মতাে একজন লােকের প্রথমে ভীতি ও পরে অনুতাপের কারণ থাকে না।
ও ফা : তাছাড়া আপনি ভুল করেননি। অনেকে বলে যুদ্ধ জয়ের পর কেউ আপনার বিরুদ্ধাচরণ করবে না এবং আপনি কমপক্ষে কুড়ি বছর ক্ষমতায় থাকবেন।
ই গা : আমি কতদিন থাকবাে এ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এটা জানারও কোন আগ্রহ নেই আমার। আমি প্রধানমন্ত্রী থাকবাে কিনা, তারও তােয়াক্কা করি না। আমি সব সময় ভালাে কাজ করতে আগ্রহী, যতদিন আমি ক্লান্ত না হই। আমি ক্লান্ত নই। কাজ মানুষকে ক্লান্ত করে না। কোন কিছুই চিরদিন টিকে না। কেউ বলতেও পারে না সদর বা নিকট ভবিষ্যতে আমার কি ঘটবে। আমি উচ্চাভিলাষী নই। একটুও না। আমি জানি, আমার এসব কথায় মানুষ অবাক হয়। কিন্তু এটাই সত্য। সম্মান কখনাে আমাকে উত্তেজিত করে না।
প্রধানমন্ত্রীর কাজ আমি অবশ্যই পছন্দ করি। কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে আমার যা করার তার চেয়ে বেশি পছন্দ করি না। কিছু দিন আগে আমি বলেছিলাম, আমার পিতা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বরং আমি নিজেকে মনে করি রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক জীবন শুরু করতে আমার আগ্রহ ছিল না। আমি আমার স্বপ্নের ভারত গড়তেই আজ রাজনীতিতে। আমি যে ভারত চাই তা অতাে দরিদ্র নয় এবং বিদেশী প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদি আমার মনে হয় দেশটা সেই লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছে, তাহলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেব।
ও ফা : কি করবেন?
ই গা : যে কোন কাজ। তােমাকে বলেছি যে কাজ আমি করি, সেটা আমি ভালােবাসি এবং চেষ্টা করি ভালাে করতে। প্রধানমন্ত্রী হওয়া জীবনের একমাত্র কাজ নয়। আমি একটা গ্রামে বাস করেও সন্তুষ্ট থাকতে পারি। যখন আমাকে দেশ পরিচালনা করতে হবে না, তখন আমি শিশুদের পরিচর্যা করবাে। অথবা আমি নৃতত্ত্বে পড়াশােনা করবাে অথবা অক্সফোর্ড গিয়ে ইতিহাস পড়বাে, যেখান থেকে আমি ইতিহাসে ডিগ্রী নিয়েছি। অথবা….আমি জানি না, উপজাতীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার যথেষ্ট আগ্রহ। হয়তাে তাদের সাথে ব্যস্ত থাকবাে।
শােন, আমার জীবনটা নিশ্চয়ই শূন্য থাকবে না। ভবিষ্যত আমাকে ভীত করে না, যদি তা অন্যান্য সমস্যায় সংকুলও থাকে। ব্যক্তির, দেশের সমস্যা থাকেই। ব্যাপার হলাে, তা মেনে নেয়া, সম্ভব হলে সমস্যা দূর করা অথবা সমস্যার মধ্যেই কাটাবাে। লড়াই করা সম্ভব হলে ভালাে, অসম্ভব হলে আপােস করাই উত্তম। যে সব লােক অভিযােগ করে তারা স্বার্থপর। তরুণ বয়সে আমি খুব স্বার্থপর ছিলাম। কিন্তু এখন আমি আর তা নই। অবাঞ্ছিত বিষয় এখন আর আমাকে বিরক্ত করে না। আমি জীবনের সাথে সব সময় সমঝােতায় আসতে চাই।
ও ফা : আপনি কি একজন সুখী নারী মিসেস গান্ধী?
ই গা : আমি জানি না। সুখ এমন এক ধরনের চলমান অনুভব। -নিস্তরঙ্গ বা বাধাহীন সুখ বলে কিছু নেই। সুখ হলাে মুহূর্তের অনুভব। তৃপ্তি থেকে সুখ। সুখ দ্বারা যদি তুমি সাধারণ পরিতৃপ্তি বুঝাতে চাও তাহলে খুব বেশি সুখী নই। সন্তুষ্ট নই-তবে তৃপ্ত। আমার দেশের জন্যে আমি কখনাে সন্তুষ্ট হতে পারবাে না। সেজন্যে আমি বিপদসংকুল পথই বেছে নেই। একটি পাকা রাস্তা ও পার্বত্য পথে চলার মধ্যে আমি পায়ে চলা পথই বেছে নেই। আমার দেহরক্ষীরা তা পছন্দ করে না।
ও ফা : ধন্যবাদ মিসেস গান্ধী।
ই গা : তােমাকেও ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা। সব সময় আমি যা বলি, তােমার জন্যে খুব সহজ সময় আশা করি না। কিন্তু তােমার যে অসুবিধাই থাকুক, আশা করি তুমি তা সমাধান করবে।
নয়াদিল্লী, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২

রেফারেন্স – ইনটারভিউ উইথ হিস্টরি – ওরিয়ানা ফালাচি – অনুবাদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!