You dont have javascript enabled! Please enable it! সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সাথে হেনরি কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎকার - সংগ্রামের নোটবুক

সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সাথে হেনরি কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎকার

তিনি খ্যাতিমান, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। তাকে বলা হয় সুপারম্যান, সুপারস্টার। বহু অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি, অসম্ভব চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন। যখন ইচ্ছা মাও সে তুং এর সাথে সাক্ষাত না ক্রেমলিনে প্রবেশ করেছেন। তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষে গেছেন প্রয়ােজনে এবং নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেছেন। তার কর্মকুশলতার কাছে জেমস বণ্ডকেও আকর্ষণহীন মনে হয়। জেমস বণ্ডের মতাে তিনি গুলি করেননি, চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েননি, কিন্তু যুদ্ধ। সম্পর্কে মন্ত্রণা দিয়েছেন, যুদ্ধ সমাপ্ত করেছেন। তিনি স্বনামখ্যাত হেনরি কিসিঞ্জার।
১৯২৩ সালে জার্মানীর ফুরথে এক ইহুদী পরিবারে হেনরি কিসিঞ্জারের জন্ম। তার পিতা লুইস কিসিঞ্জার ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মায়ের নাম পওলা কিসিঞ্জার। তাদের পরিবারের চৌদ্দজন সদস্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারা যাবার পর হেনরি কিসিঞ্জার তার পিতামাতা ও ভাই ওয়াল্টারের সাথে ১৯৩৮ সালে পালিয়ে আসেন লণ্ডনে এবং সেখান থেকে নিউইয়র্কে। তখন তার বয়স পনের এবং জার্মান নাম ছিল হেইনজ। আমেরিকায় আসার পর তার পিতা পােস্ট অফিসে কাজ করতেন এবং মা একটা বেকারি চালু করেছিলেন। হেনরি পড়াশােনায় এতটা ভালাে ছিলেন যে, তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযােগ পান এবং স্পেঙ্গলার, টয়েনবি ও কান্টের উপর থিসিস লিখে অনার্সসহ ডিগ্রী লাভ করেন। পরে তিনি হার্ভার্ডেই প্রফেসর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি জার্মানিতে গিয়েছিলেন এবং সামরিক বাহিনীতেও যােগ দেন। মেধা ও বিচক্ষণতার কারণে তাকে জার্মান শহর ক্ৰেফেলড এর সরকার গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এখানেই রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ও প্রেসিডেন্ট জনসনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। তাকে ছাড়া নিক্সনের ভূমিকা ছিল না। সেজন্যে কিসিঞ্জারের দ্বিতীয় নাম দাঁড়িয়েছিল নিক্সিঞ্জার। নিক্সনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রতিটি সিদ্ধান্তে কিসিঞ্জারের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। তিনি একাধারে অ্যামব্যাসেডর, সিক্রেট এজেন্ট, মুখ্য আলােচক, প্রকৃত প্রেসিডেন্ট; যিনি হােয়াইট হাউসকে ব্যবহার করতেন নিজের বাসভবন হিসেবে।
কিসিঞ্জার হােয়াইট হাউসে ঘুমাতেন না। কারণ সেখানে নারী নিয়ে আসার অনুমতি ছিল না। কিন্তু বাইরে তাকে দেখা যেতাে অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী, মডেল,

পৃষ্ঠাঃ ৬৬
মহিলা সাংবাদিক, নর্তকী এবং ধনী মহিলাদের সঙ্গে। বলা হয়, মেয়েদের তিনি তেমন তােয়াক্কা করতেন না। নারীসঙ্গের আবশ্যকতা তার কাছে প্রমােদের জন্যেই। এ ব্যাপারেও তিনি আমেরিকায় আলােচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। চশমার মােটা কাঁচ, কোঁকড়া চুল, ধূসর স্যুট এবং নীল নেকটাই ছিল তার ফ্যাশনের অংশ।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন লজ্জায় ও ধিক্কারে পদত্যাগ করেন, তখন অনেকে বলেছিলেন, কিসিঞ্জারেরও পতন হবে। তা হয়নি। তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই থাকলেন প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের ক্ষমতাশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। কোন কম্পন তাকে স্পর্শ করেনি। শিরার মতই তিনি অবিনাশী অথবা ক্যানসারের মতাে দুরারােগ্য। আসলে কিসিঞ্জার নিজেই এক রহস্য। তার সবকিছুই যেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উর্ধ্বে। সচরাচর ঘটে যে, কেউ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে, তার সম্পর্কে যত জানা যায়, তাকে উপলব্ধি করা যায় তত কম। ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার তিনি দেন না। শুধু প্রশাসন আয়ােজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন। আমি শপথ করে বলছি, আমি কোনদিন বুঝবাে না যে কেন তিনি আমার সাথে সাক্ষাতকারে সম্মত হলেন। আমার চিঠি পাওয়ার তিনদিন পর তিনি এ সম্মতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, ১৯৬৯ সালে হ্যানয়ে জেনারেল গিয়াপের সাথে সাক্ষাতকারের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। হতে পারে। কিন্তু রাজি হওয়ার পরও তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে একটি শর্তে আমাকে সাক্ষাতকার দিতে চাইলেন যে, তিনি আমাকে কিছুই বলবেন না। যাহােক, সাক্ষাতকারের সময় স্থির হলাে ১৯৭২ সালের ২রা নভেম্বর বৃহস্পতিবার। আমি তাকে আসতে দেখলাম নিরাসক্তভাবে, মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। “গুড মর্নিং, মিস ফ্যালাচি।” তাকে অনুসরণ করে প্রবেশ করলাম তার সুসজ্জিত অফিসে। বইপত্র টেলিফোন, কাগজপত্র, বিমূর্ত চিত্রকর্ম, নিক্সনের ছবি সে কক্ষে। আমার উপস্থিতি মুহূর্তে বিস্মৃত হয়ে উল্টো দিকে ফিরে একটা রিপাের্ট পড়তে শুরু করলেন। কক্ষের মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা বিরক্তিকর। তদুপরি তিনি পিছন ফিরে আছেন। রীতিমতাে অভদ্র আচরণ। ভালাে হলাে, আমাকে বুঝে উঠার আগে আমি তাকে বুঝতে পারলাম। আমি আবিষ্কার করলাম, কিসিঞ্জার আকর্ষণীয় নন। খাটো, স্থূলকায় এবং মেষের বড় মাথাবিশিষ্ট। কারাে মুখােমুখি হতে তিনি সময় নেন।
রিপাের্ট পাঠ শেষ করে তিনি আমার দিকে ফিরলেন এবং বসতে বললেন। তার বসার স্থান আমার থেকে উঁচুতে। মনে হলাে একজন প্রফেসর তার ছাত্রের সাথে কথা বলছেন, যার উপর তার আস্থা কম। তাকে দেখে আমার অঙ্ক ও ফিজিক্স শিক্ষক লিসেও গ্যালিলির কথা মনে পড়লাে, যাকে আমি ঘৃণা করি। চশমার আড়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি আমার ভয় উৎপাদন করতেন। কিসিঞ্জারের প্রতিটি প্রশ্নে আমার মনে হচ্ছিল, আমি কি উত্তরটা জানি? তার প্রথম প্রশ্ন ছিল জেনারেল গিয়াপ সম্পর্কে। “আমি তাে তােমাকে বলেছি, কখনাে আমি ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার দেইনা। তােমাকে সুযােগটা দেয়ার কারণ, আমি গিয়াপের সাথে তােমার সাক্ষাতকার পড়েছি। চমৎকার। আচ্ছা, গিয়াপ দেখতে কেমন?” আমি উত্তর দিলাম, “আমার কাছে মনে

পৃষ্ঠাঃ ৬৭
হয়েছে ফরাসী ইতর। ক্ষ্যাপা লােক। আসলে লোেকটা বৃষ্টিমুখর দিনের মতােই বিরক্তিকর। গিয়াপ সাক্ষাতকার দেয়নি, বক্তৃতা দিয়েছে। তবে যাই বলুক, তার কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।”
“কোনটা সত্য?” আমি বললাম যে, গিয়াপ ১৯৬৯ সালেই ঘােষণা করেছিলেন যে, ১৯৭২ সালে কি ঘটবে?
“যেমন?”
“এই ধরুন, তার কথা ছিল, আমেরিকানরা ধীরে ধীরে ভিয়েতনাম থেকে গুটিয়ে নেবে এবং যে যুদ্ধের বিপুল ব্যয় শীঘ্রই আমেরিকাকে মুদ্রাস্ফীতির মুখােমুখি করবে।”
পনের মিনিট কথাবার্তার পর আমি ক্ষুব্ধভাবে আমার নখ কামড়ে ভাবছিলাম, কেন কিসিঞ্জারের সাথে এই অসম্ভব সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছি। একটু পর তিনি একজন আগ্রহী রিপাের্টারের মতাে জানতে চাইলেন যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে আমার সাক্ষাতকার সবচেয়ে আনন্দদায়ক হয়েছে বা কোন রাষ্ট্রপ্রধান আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন। তিনি ভুট্টো সম্পর্কে মতৈক্যে পৌছলেন, “অত্যন্ত বিচক্ষণ, মেধাসম্পন্ন।” কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে তার অভিমত ভিন্ন, “সত্যিই কি তাকে তােমার ভালাে লেগেছে?” ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি নিক্সনকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে সাফাই দেয়ার চেষ্টা না করে তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষে বললেন, যারা যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের কারাে সম্পর্কে যখন বললাম যে, আমার কাছে তাকে বুদ্ধিমান মনে না হলেও তাকে আমার ভালাে লেগেছে, তখন কিসিঞ্জার বললেন, একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য বুদ্ধি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রপ্রধানের যােগ্যতা বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে শক্তি, সাহস, ধূর্ততা ও শক্তি।
এই বক্তব্য থেকে কিসিঞ্জারের বৈশিষ্ট্য, তার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। সবার উপরে তিনি ভালােবাসেন শক্তি। বিচক্ষণতা তাকে কমই আগ্রহী করে। যদিও তিনি নিজে বিচক্ষণ এবং তার সাথে যােগ হয়েছে ধূর্ততা। শেষদিকে তিনি যে প্রশ্নটা করলেন, আমি তা আশা করিনি, “যুদ্ধবিরতি হলে ভিয়েতনামে কি ঘটবে বলে তােমার ধারণা?” বিস্মিত হলেও আমি সত্য কথাটাই বললাম, “একটা বড় ধরনের রক্তপাত ঘটবে। দু’পক্ষেই এবং যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। আর এই রক্তপাত শুরু করবে আপনার বন্ধু থিউ।” তিনি প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, একটু আহত হলেন, “আমার বন্ধু। কিন্তু কেন?”
“ভিয়েতকংরা রক্তপাত শুরুর পূর্বে থিউ কারাগারগুলােতে গােপনে হত্যাকাণ্ড চালাবে। যুদ্ধবিরতির পর অস্থায়ী সরকার গঠনের মতাে নিরপেক্ষ বা ভিয়েতকং পাওয়া যাবেনা।”
“কিন্তু সেখানে তাে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা থাকবে।”
“ড. কিসিঞ্জার, ঢাকায়ও ভারতীয় ছিল। কিন্তু তারা বিহারীদেরকে হত্যা করা থেকে মুক্তিবাহিনীকে বিরত করতে পারেনি।”
কিসিঞ্জার আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাতকার দেয়ার দিন স্থির করলেন দু’দিন পর ৪ঠা। নবেম্বর, শনিবার। এক ঘণ্টা সময় দেবেন তিনি। শনিবার সকাল দশটায় আমি

পৃষ্ঠাঃ ৬৮
হােয়াইট হাউসে তার অফিসে প্রবেশ করলাম সম্ভবত সবচেয়ে অস্বস্তিকর ও বাজে সাক্ষাতকার আরম্ভ করার জন্য। প্রতি দশ মিনিট অন্তর টেলিফোন বেজে উঠছিল। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের টেলিফোন। নিক্সন কিছু চাচ্ছিলেন, জিজ্ঞাসা করছিলেন-মায়ের নিকট থেকে দূর যেতে পারেনা যেন এমন শিশু। কিসিঞ্জার প্রতিবার উত্তর দিচ্ছিলেন শান্তভাবে, মনােযােগ দিয়ে। আমাদের আলােচনা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল বারবার। তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে চমৎকার কথাটা বলার মুহূর্তেই ফোন বাজলাে। প্রেসিডেন্ট কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকে ডেকেছেন। তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে কক্ষের বাইরে গেলেন। দু’ঘণ্টা অপেক্ষার পর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে জানালেন, প্রেসিডেন্ট ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছেন এবং কিসিঞ্জারকেও যেতে হবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পূর্বে তিনি ওয়াশিংটনে ফিরবেন না। আমার সন্দেহ হলাে সাক্ষাতকার সমাপ্ত করতে পারবাে কিনা। আমি নবেম্বরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে হয়তাে অনেক কিছুই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেতাে।
ভিয়েতনাম সম্পর্কে তিনি আমাকে বেশি কিছু বলতে পারেননি। তার বক্তব্য পুরােটাই বলেছেন। যুদ্ধ সমাপ্ত হবে অথবা অব্যাহত থাকবে তা শুধু কিসিঞ্জারের উপর নির্ভর করতাে না। অপ্রয়ােজনীয় কথা বলে সবকিছু আপােস করে ফেলার বিলাসিতা তার ধাতে সয় না। যখনই তাকে স্পষ্ট কিছু জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি বাইন মাছের মতাে পিছলে গেছেন। বরফের চেয়েও শীতল সে বাইন মাছ। ঈশ্বর, এমন শীতল মানুষও হয়। সাক্ষাতকারের সময়েও তার প্রকাশ ছিল অপরিবর্তিত। কঠোর সৃষ্টি, বিষাদপূর্ণ কণ্ঠস্বর; একঘেয়ে। সাধারণত প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সাথে টেপ রেকর্ডারের কাঁটা নড়ে উঠে উচ্চ লয় থেকে নিচু লয়ে। কিন্তু কিসিঞ্জার যখন বলছিলেন কাঁটা নড়েনি। একাধিকবার আমাকে চেক করতে হয়েছে যে, রেকর্ডার চলছে কিনা। ছাদের উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ যেমন অবসাদ আনে, তার কণ্ঠস্বরও তেমন। এবং তার চিন্তার ক্ষেত্রে কোন ইচ্ছা, কৌতুক, ভ্রান্তির উত্তেজনা কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। তার সবকিছু যেন সুপরিকল্পিত, স্বয়ংক্রিয় পাইলট চালিত বিমানের মতই নিয়ন্ত্রিত। তার প্রতিটি বাক্য যেন পরিমাপ করা। তিনি যাই বলেন, সবই কাজের কথা। দাবা খেলােয়াড়ের মতাে স্নায়ু ও মস্তিষ্ক কিসিঞ্জারের।
হেনরি কিসিঞ্জার একজন ইহুদী ও জার্মান। তিনি এমন এক দেশে বাস করেন যে দেশ ইহুদী ও জার্মানদের এখনাে সন্দেহের চোখে দেখে। তিনি বয়ে বেড়ান। স্ববিরােধিতার বােঝা, ক্ষোভ এবং সম্ভবত লুক্কায়িত মানবতা। আমাদেরকে বিস্মৃত হলে চলবে না যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যর্থ ও নিন্দিত, প্রেসিডেন্টের আমলেই কিসিঞ্জারের সাফল্য এসেছে। নিক্সন একজন প্রবঞ্চক ও মিথ্যাবাদী। রুগ্ন স্নায়ু ও অসুস্থ মনের ব্যক্তি। ভুললে চলবে না যে কিসিঞ্জার আসলে নিক্সনেরই সৃষ্টি। নিক্সনের অস্তিত্ব যদি না থাকতাে, তাহলে আমরা হয়তাে জানতামই না যে, কিসিঞ্জারের জন্মই হয়েছিল। তিনি বহু বছর ধরে আরাে দু’জন প্রেসিডেন্টের সাথে কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের কেউই তাকে অতােটা গুরুত্ব দেননি। তিনি এমন একজন গবর্নরের পছন্দনীয়

পৃষ্ঠাঃ ৬৯
ছিলেন, যিনি বুদ্ধি বিবেচনায় খ্যাতিমান ছিলেন না, বিপুল অর্থবিত্তের কারণে রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছিলেন-নেলসন রকফেলার। পরে রকফেলারই তার সম্পর্কে নিক্সনের কাছে সুপারিশ করেন। কিন্তু নিক্সনের যখন দুর্দিন, তখন অবলীলায় কিসিঞ্জার পরিত্যাগ করেছিলেন নিক্সনকে। ক্যালিফোর্নিয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নিক্সনকে দেখতেও যাননি। বরং তল্পিতল্পাসহ তার উত্তরাধিকারী ফোর্ডের কাছে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কিসিঞ্জার তার কাজ অব্যাহত রাখেন।
কথাটা এভাবেও বলা যায়-কিসিঞ্জার একজন উচ্চাভিলাষী বুদ্ধিজীবী। কিন্তু তার। সাফল্য আকস্মিক। তার দেয়া সমাধান, আশাবাদ কোথাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার বড় ধরনের ভুলও ধরা পড়েছে। ভিয়েতনামে তার শান্তি প্রচেষ্টা সমস্যা নিষ্পত্তি বা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। কম্বােডিয়ায় তার শান্তি চুক্তি ভুয়া-নিক্সনের মুখরক্ষার জন্য করা হয়েছিল। আরব ও ইসরাইলের মধ্যে তার মধ্যস্থতা মধ্যপ্রাচ্যের দুঃখজনক পরিস্থিতিকে বিন্দুমাত্র লাঘব করতে পারেনি। যখন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন তখন উত্তেজনা রূপ নিলাে যুদ্ধে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ইয়াসির আরাফাতকে অভ্যর্থনা জানান হলাে জাতিসংঘে। বাদশাহ হােসেনকে পশ্চিম তীরের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলাে। কিসিঞ্জারের কারণে সাইপ্রাস পরিস্থিতি বিস্ফোরিত হয়েছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের হারিয়েছেন।
ওরিয়ানা ফ্যালাচি : আমি খুব বিস্মিত হবাে যদি আপনি আমাদের মতাে হতাশায় ভােগেন। মি. কিসিঞ্জার, সত্যিই কি আপনি হতাশ?
হেনরি কিসিঞ্জার : হতাশ? কেন? এমন কি ঘটেছে যে আমাকে হতাশ হতে হবে?
ও ফা: কিছু বিষয়তাে নিশ্চয়ই সুখের নয়। যদিও আপনি বলেছিলেন, উত্তর ভিয়েতনামের সাথে একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু শান্তি আসেনি। যুদ্ধ আগের মতই চলছে বরং পরিস্থিতি আরাে খারাপ।
হে কি : শান্তি আসবেই। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বা তারও কম সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। গত কয়েক মাস ধরে আমরা আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তােমরা রিপাের্টাররা আমাদের বিশ্বাস করছােনা। তােমরা বলছে ওরা আলােচনায় আসবে না। এরপর হঠাৎ করেই চিৎকার শুরু করলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে। এখন বলছে, শান্তি আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। একথা বলার মাধ্যমে তােমরা প্রতিদিন আমাদের তাপমাত্রা পরিমাপ করছাে, দিনে চারবার এবং এটা করছাে হ্যানয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে। মনে রেখাে, হ্যানয়ের দৃষ্টিকোণ আমি জানি। উত্তর ভিয়েতনামীরা চেয়েছিল, আমরা ৩১শে অক্টোবরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করি যেটা একই সময়ে যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক। না, এ ব্যাপারে আমি কোন বিতর্কে যেতে চাইনা।
ও ফা: কিন্তু আপনি তাে ৩১শে অক্টোবরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
হে কি : ওরা তারিখটার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করছিল। আমরা সে সময়ের মধ্যে আলােচনাটা শেষ করতে চেয়েছিলাম। আসলে আমরা এমন একটা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চাইনি যা অস্পষ্ট। কিন্তু আমি হতাশ নই। হ্যানয় যদি চুক্তি ভঙ্গ করে বা চুক্তির কিছু পরিবর্তনে অস্বীকৃতি জানায় তাহলেই আমি হতাশ হবাে না।

পৃষ্ঠাঃ৭০
ও ফা: কিন্তু মনে হচ্ছে তারা সত্যি সত্যিই অনড় মনােভাব গ্রহণ করেছে। কঠোর পথ নিয়েছে এবং আপনার বিরুদ্ধে মারাত্মক, প্রায় অপমানজনক সব অভিযােগ তুলছে।
হে কি : ওগুলাে অর্থহীন। আগেও এমন ঘটেছে, কিন্তু আমরা গুরুত্ব দেইনি। কঠোর পন্থা, মারাত্মক অভিযােগ, এমনকি অপমান-সবই স্বাভাবিক পরিস্থিতির অংশ। ৩১শে অক্টোবর থেকে আমরা চুপচাপ বসে আছি। রিপাের্টাররা প্রশ্ন করছে রােগী দুর্বল। কিনা? কিন্তু আমি তাে কোন দুর্বলতা দেখিনা। কমবেশি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। আলােচনা পুনরায় শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শান্তি আসবে। কয়েক মাস নয়, কয়েক সপ্তাহ।
ও ফা: কিন্তু কখন শুরু হবে সে আলােচনা? সেটাই প্রশ্ন।
হে কি : যখনই লি ডাক থাে আমার সাথে সাক্ষাতে ইচ্ছা পােষণ করবেন তখন। আমি তার আহ্বানের প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে আমি বেশি বলতে চাই না। আমার মুখ থেকে একটা শব্দ বেরুলে সেটাই সংবাদ হয়ে যায়। শােন, নবেম্বরের শেষ দিকে আবার আমাদের সাক্ষাত হলে কেমন হয়?
ও ফা: ড. কিসিঞ্জার, বিষয়টা এখনই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিউ আপনার সাথে কথা বলতে সাহস করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের ক্লিপিংটা দেখুন। থিউ এর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে এতে, “ কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞাসা করুন যে, কোন্ প্রশ্নে আমরা বিভক্ত। আমি যে দিকগুলাে গ্রহণ করিনি সেগুলাে কি?”
হে কি : আমাকে দেখতে দাও…..। না, আমি তার প্রশ্নের উত্তর দেবনা। তার এই আমন্ত্রণের প্রতি মনোেযােগই দেব না।
ও ফা: থিউ নিজেই তার উত্তরটা দিয়েছেন ড. কিসিঞ্জার। তিনি বলেছেন, উত্তর ভিয়েতনামী সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনামে থাকবে। আপনি কি মনে করেন থিউকে বুঝাতে সক্ষম হতেন? আপনি কি মনে করেন, আমেরিকা হ্যানয়ের সাথে পৃথক একটি চুক্তিতে পৌছবে?
হে কি : আমাকে সে প্রশ্ন করাে না। দশ দিন আগে আমি প্রকাশ্যে যা বলেছি। এখনাে আমাকে সে কথাই বলতে হবে। যা ঘটতে পারে বলে আমি করি না সে ধরনের কোন অনুমান আমি বিবেচনায় আনতে চাইনা। এটুকু বলতে পারি, আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ এবং যে কোনভাবে আমরা শান্তিতে উপনীত হবাে। থিউ যা খুশি বলতে পারে। সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।
ও ফা: মি. কিসিঞ্জার, আমি যদি আপনার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জানতে চাই যে। থিউ ও ডাক থাের মধ্যে আপনি কার সঙ্গে নৈশভােজ পছন্দ করবেন-আপনার জবাব কি হবে?
হে কি : এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অপারগ।
ও ফা: উত্তরটা যদি আমিই দেই যে, আমার মনে হয় লি ডাক থাে’র সাথে নৈশভোেজই আগ্রহ আপনার বেশি হবে?
৭১ হে কি : এ প্রশ্নের জবাব দেবার কোন ইচ্ছাই আমার নেই।
ও ফা: তাহলে নিশ্চয়ই এ কথার জবাব দেবেন-আপনি কি লি ডাক থােকে পছন্দ করেন?
হে কি : হ্যাঁ, অবশ্যই। তাকে দেখেছি তার লক্ষ্যের প্রতি উৎসর্গীকৃত। তিনি দৃঢ়চেতা। সাহসী এবং বরাবরই ভদ্র ও বিনয়ী। কখনাে বা অত্যন্ত কঠোর, আলােচনা করাও শক্ত হয়ে উঠে। সেজন্যে তার প্রতি সবসময় আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা অত্যন্ত পেশাগত। তবু আমরা হাসিঠাট্টা করতেও সক্ষম হয়েছি। আমরা একথা বলেছি যে, একদিন হয়তাে আমি হ্যানয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াবাে এবং লি ডাক থাে হার্ভার্ডে আসবেন মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ শিক্ষা দিতে। আমাদের সম্পর্কটা ভালােই বলতে হবে।
ও ফা: থিউ এর ব্যাপারেও কি আপনি একথাই বলবেন?
হে কি : হ্যাঁ, থিউ এর সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালাে।
ও ফা: দক্ষিণ ভিয়েতনামীরা বলে যে, আপনারা, প্রথমে পরস্পর ভালাে বন্ধুর। মতাে আচরণ করেননি।
হে কি : আমাদের পরস্পরের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা অনিবার্যভাবেই অভিন্ন নয়।
ও ফা: থিউ এর সমস্যার ব্যাপারে আপনি কি আশাবাদী?
হে কি : তা তাে বটেই। এখনাে আমার অনেক করণীয় আছে। আমি নিজেকে ক্ষমতাহীন মনে করি না। নিরুৎসাহী ভাবিনা। আমি প্রস্তুত এবং আস্থাবান।
ও ফা: আজকের সংবাদপত্রে নিহত এক ভিয়েতকং তরুণের ছবি ছাপা হয়েছে। ঘটনাটা ৩১শে অক্টোবরের দু’দিন পরের। ভিয়েতকংদের মর্টারের গােলায় ভূপাতিত হেলিকপ্টারের ২২জন আমেরিকান সৈন্য নিহত। এ ঘটনা ৩১শে অক্টোবরের তিন দিন পরের। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর থিউকে অস্ত্রশস্ত্রের নতুন চালান পাঠাচ্ছে। হ্যানয়ও একই কাজ করছে।
হে কি : এটা অনিবার্য। যুদ্ধবিরতির পূর্বে সবসময় এ ধরনের ঘটনা ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যেও যুদ্ধবিরতির পূর্বক্ষণে এ ঘটনা ঘটেছিল এবং কমপক্ষে দু’বছর ধরে তা অব্যাহত ছিল। আমরা যখন সায়গনে আরাে অস্ত্র পাঠাচ্ছি, তখন উত্তর ভিয়েতনামও দক্ষিণ ভিয়েতনামে অবস্থানরত তাদের বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ দিচ্ছে। এর তেমন কোন তাৎপর্য নেই। আশা করি ভিয়েতনাম সম্পর্কে তুমি আমাকে কথা বলতে আর পীড়াপীড়ি করবে না।
ও ফা: আপনি কি এ ব্যাপারেও কথা বলতে চান না যে, আপনি এবং নিক্সন যে চুক্তিটা মেনে নিয়েছেন, অনেকের কাছে সেটা হলাে হ্যানয়ের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া?
হে কি : এ ধরনের অভিযােগকে আমি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। আর ভিয়েতনাম নয়। তার চেয়ে মেকিয়াভেলি, সিসেরাে সম্পর্কে আমরা কথা বলতে পারি। ভিয়েতনাম ছাড়া যে কোন বিষয়।
ও ফা: তাহলে চলুন, যুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলি। ড. কিসিঞ্জার, আপনি কি শান্তিবাদী?

পৃষ্ঠাঃ ৭২
হে কি : আমার মনে হয় না যে, আমি শান্তিবাদী। যদিও আমি প্রকৃত শাক্তিবাদীদের শ্রদ্ধা করি। যুদ্ধ নির্ভর করে কিছু শর্তের উপর। যেমন, হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। কোন জাতিকে যুদ্ধ করতে হয় তাদের বীরত্ব, স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য। এগুলাে বজায় রাখতে জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
ও ফা: তাহলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? আমার বিশ্বাস। আপনি কখনাে ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন না।
হে কি : কি করে বিরুদ্ধে থাকতে পারি। আমার বর্তমান অবস্থানের পূর্বেও এই যুদ্ধের বিরােধী ছিলাম না। কখনাে না।
ও ফা: তাহলে কি আপনি শ্লেসিঞ্জারের বক্তব্যকে সঠিক মনে করেন না যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুধু এটাই প্রমাণ করতে সফল হবে যে, পাঁচ লক্ষ আমেরিকান তাদের সকল প্রযুক্তিসহ কালাে পায়জামা পরা অনুন্নত অস্ত্রধারী লােকদের পরাভূত করতেও অক্ষম।
হে কি : সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। যদি প্রশ্নটা এমন হয় যে, ভিয়েতনামে যুদ্ধ জরুরী ছিল কিনা, অথবা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ কিনা-তাহলে ইতিহাসই সে রায় দেবে। যখন কোন রাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তার পক্ষে এটা বলাই যথার্থ নয় যে যুদ্ধ শেষ হওয়া উচিত। যুদ্ধ শেষ করতে হলেও কিছু নীতিমালা অনুসারেই করতে হবে। যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সঠিক ছিল এই বক্তব্য থেকে এটা ভিন্নতর।
ও ফা: চীনের সাথে যােগসূত্র স্থাপনে আপনার অভিযান সফল হয়েছে। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগেও আপনি সফল হয়েছেন। ভিয়েতনামেও শান্তি আসছে। এখন আমার একটা প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটা আমি চন্দ্র অভিযানকারী নভােচারীদেরও করেছিলাম, “এর পর কি? চাঁদের পর আপনারা কি করবেন? নভােচারী হিসেবে কাজের বাইরে আপনাদের আর কি করার আছে?”
হে কি : নভােচারীরা কি উত্তর দিয়েছিল?
ও ফা: তারা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, “আমরা দেখবাে…..আমরা জানি না।”
হে কি : আমিও জানি না। এরপর যে কি করবাে জানি না। কিন্তু নভােচারীদের মতাে আমি দ্বিধাগ্রস্ত নই। আমার জীবনে অনেক কিছু দেখেছি করার মতাে।
ও ফা: আপনি কি হার্ভার্ডে ফিরে যাবেন?
হে কি : যেতেও পারি। তবে খুব সম্ভব যাবাে না। আমি কোনভাবেই এ সিদ্ধান্ত নেইনি যে বর্তমান পদটা ছেড়ে দেব। এই কাজটা আমি খুব পছন্দ করি এবং তা তােমার জানা।
ও ফা: অবশ্যই। ক্ষমতা সবসময় লােভনীয়। ড. কিসিঞ্জার ক্ষমতা আপনাকে কতটুকু প্রভাবিত করে? দয়া করে সত্যি কথাটাই বলবেন।
হে কি : তােমার যখন ক্ষমতা থাকবে এবং দীর্ঘদিন ধরে তখন মনে হবে এটা তােমার প্রাপ্যই ছিল। আমি নিশ্চিত যে, আমার এই পদ ছেড়ে যাওয়ার পর আমি

পৃষ্ঠাঃ ৭৩ ক্ষমতাহীন বলে অনুভব করবাে। তবু ক্ষমতাকে অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করার কথা কখনাে ভাবিনি। এ ধরনের চিন্তা আমাকে আনন্দিত করে না যে, আমার জন্যে একটা বিমান, চালকসহ গাড়ি সব সময় অপেক্ষমাণ। ক্ষমতা থাকলে অনেক ভালাে কাজ করা যায়। অবশ্য ক্ষমতার জন্যে আকাক্ষা আমাকে এই পদে টেনে আনেনি। আমার রাজনৈতিক অতীত দেখলেই বুঝতে পারবে নিক্সন আমার পরিকল্পনা নির্দেশ করেন। তিনটি নির্বাচনে আমি তার বিরুদ্ধে ছিলাম।
ও ফা: আমি জানি। এমনকি একসময় একথাও বলেছিলেন যে, “নিক্সনের প্রেসিডেন্ট হবার যােগ্যতা নেই।” এটা কি নিক্সনের সাথে আপনাকে কখনাে অপ্রস্তুত করে?
হে কি : নিক্সনের বিরুদ্ধে ঠিক কি বলেছিলাম তা আমার মনে পড়ছে না। তবু ওরকম কিছুই বলেছি। তা যদি বলেই থাকি তাতেও প্রমাণিত হয় যে, সরকারের উঁচু পদ লাভের পরিকল্পনাতেও নিক্সনের সাথে আমার যােগসূত্র ছিল না। অপ্রস্তুত হবার তাে প্রশ্ন উঠে না। তখন আমি নিক্সনকে চিনতামই না। তিনি যখন আমাকে দায়িত্ব দিতে চাইলেন, আমি তখন তার সম্মুখে যাইনি। তার প্রস্তাবে আমি হতবাক হয়েছিলাম। কারণ তিনি জানতেন যে আমি কখনাে তার প্রতি বন্ধুত্ব বা সমবেদনার ভাব দেখাইনি। সত্যি তিনি আমাকে ডেকে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
ও ফা: আপনাকে ডেকে তাে তিনি কিছু হারাননি মি. কিসিঞ্জার। শুধু একটা অভিযােগ ছাড়া যে, আপনি নিক্সনের মানসিক পরিচর্যাকারী।
হে কি : এটা সম্পূর্ণভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন অভিযােগ। ভুললে চলবে না যে, আমাকে চেনার পূর্বে নিক্সন বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে খুব তৎপর ছিলেন। নির্বাচিত হবার পূর্বেও বৈদেশিক নীতি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এ সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা আছে। তিনি খুব সাহসী লােক। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দু’বার মনােনয়ন না পেলে কেউ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। দুর্বল লােক দীর্ঘদিন রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে না। কারাে হাতিয়ার হিসেবে কেউ দু’বার প্রেসিডেন্ট হতে পারে না।
ও ফা: আপনি কি নিক্সনকে পছন্দ করেন মি. কিসিঞ্জার?
হে কি : তার প্রতি আমার প্রচুর শ্রদ্ধা রয়েছে।
ও ফা: লােকে বলাবলি করে যে, নিক্সনকে আপনি পাত্তাই দেন না। চাকরিটাই আপনার কাছে বড় তারা বলে, যে কোন প্রেসিডেন্টের অধীনে আপনি একাজ করতে পারবেন।
হে কি : নিক্সনের সাথে যে দায়িত্ব পালন করেছি, অন্য কোন প্রেসিডেন্টের সাথে তা করতে পারবাে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। নিক্সনের অধীনে যেসব কাজ করেছি তা সম্ভব হয়েছে তিনি সম্ভব করে দিয়েছেন বলেই।
ও ফা: আপনি তাে আরাে ক’জন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ছিলেন এমনকি যারা নিক্সনের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আমি কেনেডি, জনসনের কথা বলছি….
হে কি : আমি সবার কাছে চাকরি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার মতামত ব্যক্ত করেছি। আমার চিন্তাভাবনা সবিস্তারে বলেছি। তারা কোন দলের লােক

পৃষ্ঠাঃ ৭৪
তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। একই স্বাধীনতা নিয়ে আমি কেনেডি, জনসন ও নিক্সনের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। সবাইকে একই পরামর্শ দিয়েছি। এটা সত্য যে, কেনেডির সাথে মতৈক্যে পৌছা একটু অসুবিধাজনক ছিল। আমি যে তার সাথে পুরােপুরি একাত্ম হতে পারিনি তা আমার দোষেই। তখন অবশ্য আমি এতটা পরিপক্ক ছিলাম না। আমি ছিলাম খণ্ডকালীন উপদেষ্টা যখন অন্যদের সাথে প্রেসিডেন্টের সপ্তাহের সাত দিনই দেখা হয় তখন সপ্তাহে মাত্র দু’দিনের সাক্ষাতে প্রতিদিনের নীতির উপর প্রভাব ফেলা যায় না। আসলে কেনেডি ও জনসনের সাথে আমার এখনকার দায়িত্ব তুলনীয় নয়।
ও ফা: মেকিয়াভেলির আশ্রয় নেবেন না ড. কিসিঞ্জার। হে কি : কিন্তু ওকথা কেন?
ও ফা: আপনার কথায় কেউ বিস্মিত হবে এটা ভেবে নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উপর আপনার কতখানি বরং বিস্ময়ের ব্যাপার হলাে, আপনার উপর মেকিয়াভেলির প্রভাব কতটুকু?
হে কি : কোনভাবেই তার প্রভাব নেই। আধুনিক বিশ্বে মেকিয়াভেলির তত্ত্বের খুব কমই গ্রহণ বা কাজে লাগানাে সম্ভব। মেকিয়াভেলির একটি বিষয় আমার কাছে ভালাে লাগে, তা হলাে রাজপুত্রের ইচ্ছাকে বিবেচনা করার পদ্ধতি। ভালাে লাগার অর্থ আমাকে প্রভাবিত করা নয়। তুমি যদি জানতে চাও যে, আমার উপর কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি, তাহলে আমি দু’জন দার্শনিকের নাম বলবাে : স্পিনােজা ও কান্ট। তুমি যে মেকিয়াভেলির সাথে আমাকে জড়িত করছে তাতে আমারই অবাক লাগছে। লােকে বরং আমার সাথে মেটারনিকের নামকে জড়িত করে, যা রীতিমতাে শিশুসুলভ। আমি মেটারনিকের উপর একটা গ্রন্থ রচনা করেছি। এই পর্যন্তই। মেটারনিক ও আমার মধ্যে কোথাও মিল নেই। তিনি চ্যান্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এমন এক সময়ে যখন ইউরােপের কেন্দ্রস্থল হতে অন্য কোন মহাদেশে যেতে তিন সপ্তাহ লাগতাে এবং যখন যুদ্ধ পরিচালিত হতাে পেশাদার সৈন্যদের দ্বারা এবং কূটনীতি ছিল অভিজাতদের হাতে। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে তখনকার কোন সামঞ্জস্য নেই।
ও ফা: ড. কিসিঞ্জার আপনি ছায়াছবির নায়কদের মতাে যে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তা কিভাবে উপভােগ করেন। আপনি যে একজন প্রেসিডেন্টের চেয়েও বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সেটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন। এ ব্যাপারে কি আপনার নিজস্ব কোন তত্ত্ব আছে?
হে কি : তা আছে। কিন্তু তােমাকে বলবাে না। কারণ এটা অধিকাংশ লােকের তত্ত্বের সাথে মিলবে না। যেমন, বুদ্ধির তত্ত্ব। ক্ষমতা প্রয়ােগের ক্ষেত্রে বুদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। একজন রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি নিজে আমার কাজগুলাে করবেন তাকে খুব বুদ্ধিমান না হলেও চলবে। আমার তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তােমাকে বলবাে না। তার চেয়ে তােমার তত্ত্বটা আমাকে বলাে। আমার জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে তুমিও যে একটা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
হেনরি কিসিঞ্জার

পৃষ্ঠাঃ ৭৫
ও ফা: আমি নিশ্চিত নই ড. কিসিঞ্জার। সাক্ষাতকারের মাধ্যমে তত্ত্বটি খুঁজে পেতে চাই। কিন্তু পাচ্ছি না।
হে কি : আমি সব সময় একা কাজ করেছি। আমেরিকানরা এটা খুব পছন্দ করে। আমেরিকানরা কাউবয়দের পছন্দ করে, যারা একাকী তার ঘােড়ায় চেপে শহরে, গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, ওয়াগন পরিচালনা করে। সঙ্গে শুধু তার ঘােড়া, আর কিছু নয়। হতে পারে পিস্তলও তার কাছে নেই। সে কর্মতৎপর-এটাই যথেষ্ট। যথাসময়ে তাকে যথাস্থানে পাওয়া যায়।
ও ফা: তাহলে তা আপনি নিজেকে হেনরি ফণ্ডার মতাে ভাবেন। নিরস্ত্র কিন্তু তার মুষ্টি ও সৎ আদর্শ নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। একা, সাহসী…..
হে কি : সাহসের প্রয়ােজনও নেই। প্রয়ােজন একা থাকার এবং সকলকে প্রদর্শন করা যে সবকিছু সে একা করতে পারে। একা থাকা সবসময় আমার বৈশিষ্ট্য। আমার কৌশল। এর সাথে রয়েছে আমার স্বাধীনতা। এগুলাে আমার মধ্যে এবং আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এসব কিছুর উপর হচ্ছে দৃঢ়তা। আমি সব সময় নিশ্চিত থাকি যে আমি যা কিছু করেছি তা আমাকে করতে হতাে। আমার প্রতি যে মানুষের বিশ্বাস রয়েছে তার প্রতি আমার খেয়াল রয়েছে। জনগণকে দ্বিধাগ্রস্ত করতে আমি পছন্দ করি না। অবশ্য জনমত আমাকে কখনাে বিচলিত করেনি। আমি জনপ্রিয়তা চাইনা, জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে কিছু করি না। জনসমর্থন হারাবার কোন ভয় আমার নেই। যা আমি ভাবি তা আমি বলতে পারি। জনগণের প্রতিক্রিয়া দ্বারা নিজেকে বিচলিত হতে দেই না। অভিনেতাদের লক্ষ্য করুন। ভালাে অভিনেতা শুধু কৌশলের উপর নির্ভর করে না। একটা কৌশল তারা অনুসরণ করে, একই সঙ্গে সক্রিয় থাকে তাদের দৃঢ়তা। আমার মতাে তারাও খাটি। কিন্তু চিরদিন একই কৌশল খাটে না। তবু যখন প্রয়ােজন। তখনকার জন্য যথার্থ।
ও ফা: আপনি কি বলতে চান যে, আপনি একজন স্বতঃস্ফুর্ত মানুষ। মেকিয়াভেলির সাথে তুলনাই সঙ্গত ছিল, এখন মনে হচ্ছে আপনি ঠাণ্ডা অঙ্কবিদের সাথে তুলনীয়, দুঃখজনকভাবে স্বনিয়ন্ত্রিত। আমার যদি ভুল না হয়, আপনি খুব শীতল মানুষ ড. কিসিঞ্জার।
হে কি : চাতুর্যে না হলেও কৌশলে শীতল। আসলে আমি কল্পনা বা চিন্তাভাবনার চেয়ে মানুষের সাথে সম্পর্কে বেশি বিশ্বাস করি। আমার চিন্তা ব্যবহার করি, কিন্তু আমার প্রয়ােজন মানবিক সম্পর্ক। আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তা কি সহসা ঘটেনি? আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন প্রফেসর ছিলাম। এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়েছি। আমি সব সময় স্বতঃস্ফুর্ত সিদ্ধান্ত দ্বারা পরিচালিত হয়েছি। কেউ বলতে পারে যে, যা ঘটার ছিল তাই ঘটেছে। কেউ একথা বলে না যে, যা ঘটেনি তার ইতিহাস লিখা হয় না। আমি আমার লক্ষ্যে বিশ্বাস করি।
ও ফা: অভিনয় আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও খ্যাতির অনেকখানি আপনার প্রাপ্য নয় বলে আমার বিশ্বাস।

পৃষ্ঠাঃ ৭৬
হে কি : একথা আংশিকভাবে অতিরঞ্জিত। কিছুটা সত্যি। নারীর প্রতি আমি কতটা নিবেদিত, এটা যদি বিবেচনা করি বলতে হবে, নারী আমার জীবনে কতখানি জুড়ে আছে। আমার কাছে নারী শুধু প্রমােদের জন্য, বলা যায় একটা হবি। কেউই তার হবি’র পিছনে প্রচুর সময় ব্যয় করতে পারে না। আমি খুব সীমিত সময় নারীর সাহচর্যে কাটাই। আমার কার্যসূচীর দিকে দেখলেই তুমি তা বুঝতে পারবে। আমি মাঝে মাঝে আমার দুই সন্তানকে দেখতে যাই। আমরা একত্রে ক্রিসমাস এবং গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনগুলাে অতিবাহিত করি এবং গ্রীষ্মের বেশ কয়েক সপ্তাহ আমরা একসাথে থাকি। মাসে একবার বােস্টনে যাই ওদেরকে দেখতে। তুমি নিশ্চয়ই জান যে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আমি বিপত্নীক। বিপত্নীক থাকায় আমি অস্বস্তিতে কাটাই না। সন্তানের সাথে বাস না করায় আমার মধ্যে অপরাধবােধের জটিলতা সৃষ্টি করে না। আমার বৈবাহিক জীবন শেষ হওয়াটাই যৌক্তিক হয়েছে। আমি যখন আমার সন্তানদের মায়ের স্বামী ছিলাম, তখনকার চেয়ে বরং এখনই সন্তানদের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। তাদের সাথে এখন আমি অনেক সুখী।
ও ফা: ড. কিসিঞ্জার, আপনি কি বিয়েবিরােধী?
হে কি : বিয়ে করবাে কি করবাে না, নীতির প্রশ্নে সেই সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব। হতে পারে যে, আমি পুনরায় বিয়ে করবাে……হ্যা তা হতেও পারে। কিন্তু আমার মতাে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে কারাে সাথে বাস করা এবং একত্রে ঘর করা খুবই মুশকিল। অনিবার্যভাবেই জটিল। একজনকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এই বিষয়গুলাে ব্যাখ্যা করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি একজন রিপাের্টারকে বিশ্বাস করার মতাে লােক নই।
ও ফা: তাই তাে মনে হয় ড. কিসিঞ্জার। আমি কখনাে এমন কারাে সাক্ষাতকার নেইনি, যিনি প্রশ্ন এড়িয়ে যান। আপনি কি লাজুক?
হে কি : হ্যাঁ, কিছুটা তাই। তাছাড়া আমার মনে হয়, আমি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি। অনেকে ভাবে আমি রহস্যময়, যন্ত্রণাদায়ক চরিত্র। অনেকে আমাকে সদা উৎফুল্ল বলে বর্ণনা করে, সদা হাস্যময়। এই দু’টি ভাবমূর্তির ধারণাই ভুল। দুটোর একটাও আমি নই। আমি তােমাকে বলবাে না, আমি কি। আমি কাউকে সে কথা বলিনি।
ওয়াশিংটন, নবেম্বর, ১৯৭২

রেফারেন্স – ইনটারভিউ উইথ হিস্টরি – ওরিয়ানা ফালাচি – অনুবাদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু