রােডম্যাপের নকশা | পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারণা। বিশ্বাসযােগ্য বন্ধুর অন্বেষন
শশাঙ্ক ব্যানার্জী
১৯৬২ সালের অক্টোবরে চীন সামরিকভাবে অপ্রস্তুত ভারত দখল করতে শাঁখের করাতের মত দ্বিমুখি আক্রমন চালায়। পশ্চিমে আকসাই চীন ভেদ করে ভারতীয় প্রদেশ জম্মু ও কাশ্মিরের লাদাখ অঞ্চল এবং পূর্বে হিমালয় পর্বতমালা ও তিব্বতের মালভূমি পেরিয়ে অরুণাচল প্রদেশের ভেতরে তেজপুর পর্যন্ত ১৯৬২ সালের অক্টোবর নাগাদ চীন দখল করে নেয়। ভারতীয় ভূখন্ডের অনেক বড় একটি অংশে চীনের এই অবৈধ দখলদারিত্বে নয়াদিল্লী বিব্রত অবস্থায় পড়ে। পরাজয় ও ভূখন্ড হারাবার এই ধাক্কা ভারতকে এতটাই বিপর্যস্ত করে তুলেছিলাে যে আজও প্রায় অর্ধশতক পরেও জাতি এখনাে ভুলতে অথবা তাদের ক্ষমা করতেও প্রস্তুত নয় যে চীন কীভাবে ভারতের গৌরব এবং আত্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছিল। তার দুবছরের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু, আন্তর্জাতিক কুশলী কূটনীতিবিদ হিসেবে যিনি সুপ্রসিদ্ধ, তিনি মুত্যুবরণ করেন প্রধানত জাতির এই লজ্জার প্রেক্ষিতে তাঁর ব্যক্তিগত হতাশার কারণে। কৌশলগত ক্ষেত্রে যুদ্ধ থেকে ছিটকে যাবার পর পরপরই নয়া দিল্লীর সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ায় স্থিতাবস্থা আসে। ফলশ্রুতিতে ভারত চীন সম্পর্কিত কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা সেরে উঠতে অনেক বছর লেগে যায়। এখন পর্যন্ত তা আংশিক অর্জিত হয়েছে। ভারতের প্রতি চীনের ইতিবাচক মনােভাব বিগত বছরগুলােতে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু পুরােপুরি সহায়ক হয়নি।
স্বতঃস্ফুর্ত নয়, একটি প্রতিক্রিয়াপ্রবন রাষ্ট্র হিসেবে চীনা দখলদারিত্বের বিষয়টি ভারতের জন্য ছিল ঘুম ভাঙ্গার গান।।
চীন-ভারত যুদ্ধের পরবর্তী ৩ মাসে যখন ভারতের আত্মদর্শণ চলছিলাে তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতাপশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা
৪০
শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর মাথায় দেশের মানুষের মুক্তির বিপ্লবী চিন্তাধারণা লালন করতে শুরু করেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই শত্রুভাবাপন্ন ও জটিল পরিস্থিতিতে তার পরিকল্পনা কতখানি কার্যকরী হবে তাই নিয়ে তিনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন।
তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলাে বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে তিনি সাহায্য ও বিপদ থেকে মুক্তির জন্য কার কাছে যাবেন তা নির্ধারন করা। উল্লেখ্য, তিনি আসলেই জানতেন যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তির এই সংগ্রামের সফল সমাপ্তি সম্ভব নয়। তার ঘাড়ে তখন নিপীড়নকারী সামরিক একনায়কতন্ত্র ও দেশের মাটিতে তৈরি বিপ্লব এক সাথে ঝুলে ছিলাে। মুজিবের তাই প্রয়ােজন ছিলাে বৃহৎ শক্তির সমর্থন । মুজিবের কৌশলগত চিন্তা ছিলাে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার বলে বলীয়াণ। এই সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন। মুক্তির সংগ্রামে কে সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য মিত্র হতে পারে। তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন যে মিত্র যেই হােক না কেন বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কৌশলে যেন একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক অবস্থান থাকে। স্নায়ুযুদ্ধ ছিলাে তখন সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ ।
মুজিবের ভয় ছিলাে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্র চীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুক্তি নিয়ে তাঁর যে স্বপ্ন তা ধ্বংস করার কোন সুযােগ ছাড়বে না। তার মতানুসারে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে মুক্ত হতে হবে পাঞ্জাব পরিচালিত নিপীড়ক সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবল থেকে যা অনেকদূরে অবস্থিত রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিয়ন্ত্রন করা হয়। মুজিব ঝুঁকির মুখে দমে যাবার পাত্র ছিলেন না, তিনি ঝুঁকি নিতে জানতেন।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ ভারতের জন্য ছিলাে ঘুম ভাঙ্গার ডাক। নয়াদিল্লী সেই সময় তার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। এই পরিস্থিতি মুজিবকে সুযােগ করে দেয় ভারতের সামনে এক অভিনব ও পূর্বে অপরীক্ষিত এক নীতি উপস্থাপনের- যা ছিলাে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন। এই সাহসী চিন্তা যাকে বলা যেতে পারে ‘মুজিব স্পেশাল’ মুজিবকে হুট করেই নিয়তি নির্ধারক করে তােলে।
একথা চিন্তা করা ভুল হবে যে মুজিব একরকম তাড়াহুড়াে করেই ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার ডঙ্কা বাজাতে মনস্থির করেছিলেন। এমন নয় যে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের চাকে ঢিল ছুড়লে যে ঝামেলা হতে। পারে সে সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত
৪১
ইউনিয়ন-উভয়ের কাছেই বিপুল পরিমান আনবিক অস্ত্রের মজুদ ছিলাে যা দিয়ে দশবার এই পৃথিবী ধ্বংস করা সম্ভব । এই দুই পরাশক্তি আপন আপন দর্শনের সংঘাতে আটকে ছিলাে। এই পরাশক্তিগুলির মধ্যে মিত্র কারা মুজিব তা খুব ভালাে করে জানতেন। তাঁর চিন্তা ছিলাে এই কৌশলগত দাবার বাের্ডে বাঙলাদেশের অবস্থান নিয়ে।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্র তখন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত। এই কাজের জন্য তারা সবচেয়ে ঘৃনিত সামরিক একনায়কতন্ত্র তৈরি করছিলাে। এর সাথে সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় পাকিস্তানের, যার কবল থেকে মুজিব বাংলাদেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তাই অল্পকথায় বলতে গেলে বাংলাদেশের এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্র হিসেবে পাওয়া যেত না।
পাকিস্তানের সাথে চীনের কৌশলগত বারােমাসি মিত্রতা ততদিনে সবাই জানে। তাই বেইজিং-এর কাছে সমর্থন ও বিপদ থেকে মুক্তির জন্য যাওয়াও ছিল নিরর্থক। একটা ধারণা মুজিবের মাথায় ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন যদি পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় তবে তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।
মুজিব যখন পরিকল্পনা করছিলেন সমর্থনের জন্য কার কাছে যাবেন, তার মাথায় চীনের সাথে ভারতের শত্রুতার বিষয়টি খুব ভালােমতাে গাঁথা ছিলাে। ভারত দখলের জন্য চীনের ১৯৬২ সাল বেছে নেয়া তার সময় জ্ঞান ও হিসেবের পরিচয় দেয়। সেই বছর “The Bay of pigs Crisis” সংকট চলছিলাে যার ফলে দুই পরাশক্তি কিউবাকে কেন্দ্র করে আনবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে পরস্পরের মুখােমুখি অবস্থান করছিল। চীন নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলাে যে সেই সময়টা ভারতের অপ্রস্তুত অবস্থার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন পারস্পরিক সংঘাতে ব্যস্ত থাকবে। তাই একথা ধরেই। নেয়া যেত যে ওয়াশিংটন ও মস্কো তখন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত থাকবে যদি না পরিস্থিতি পুরােপুরি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই নেতিবাচক আবহাওয়ায় মুজিবের পক্ষে অত্যন্ত সাবধানী না হয়ে কোন উপায় ছিলাে না।
একথা নিশ্চিত ছিলাে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন ছিলাে ভারতের সবচেয়ে বিশ্বাসী মিত্র ও কৌশলগত অংশীদার। সােভিয়েত
৪২
এবং পাকিস্তান ইউনিয়ন এর সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র চিন্তাটা কোন বিষয় ছিল না। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিলাে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। কিন্তু অতি-সাবধানী, নমনীয় ভারতকে প্রভাবিত করা কোন সহজ কাজ ছিল না। যাই হােক, বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের সমর্থন পাওয়া মানে ছিল বিশ্বের তৎকালীন পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নকে বাঙলাদেশের পাশে পাওয়া। এটি ছিলাে মুজিবের কৌশলগত চিন্তার ফলাফল যার ফসল সময় এলে ঘরে তােলা যাবে। শুধুমাত্র একজন অংশগ্রহনকারী নন, শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দো-সােভিয়েত কৌশলগত মিত্রতা শক্তিশালী করতে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছেন।
রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী