পিং পং দিয়ে সূচনা
পিংপং খেলতে ভারতীয় দল যাচ্ছেন চীনে। সংবাদটি ছােট। এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা হচ্ছে বিরাট। সামনে রয়েছে চীনা-মার্কিন পিংপং খেলার নজীর। এ খেলার ফিনিশিং টাচ দিয়েছিলেন কিসিঙ্গার। তার নীরব ডিপ্লোমেসী সম্ভব করেছে প্রেসিডেন্ট নিকসনের সম্ভাব্য পিকিং সফর। ভাঙ্গতে চলেছে চীন-মার্কিন রাজনৈতিক আড়ি। হয়ত শীঘ্রই উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে উঠবে কূটনৈতিক সম্পর্ক। চীন-ভারত বিরােধের প্রকৃতি আলাদা। সীমান্ত সমস্যা তাতে পেয়েছে প্রাধান্য। ১৯৬২ সালের লড়াই পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে এনেছিলেন নয়াদিল্লী। চীনা রাষ্ট্রদূতকেও স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের হুকুম দিয়েছিলেন পিকিং। এখন নয়াদিল্লী এবং পিকিংএ রয়েছেন যথাক্রমে ভারতীয় এবং চীনা চার্জ দি এ্যাফেয়ারর্স। উভয় রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না হলেও ওটা ছিল খুবই নড়বড়ে। পিকিংএর উগ্র প্লৈবিক প্রচার শুধু ভারতকেই নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলােকেও করেছিল ব্রিত। একমাত্র পাকিস্তান ছিল চীনের কাছাকাছি। ভারত-বিরােধিতা এ দুটির রাষ্ট্রের মধ্যে গড়েছিল দোস্তীর বনিয়াদ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সমাপ্তি ঘটেছে চীনা উগ্রতার যুগ। নমনীয়তার পথে পা বাড়াচ্ছেন পিকিং নায়কেরা। যাদের তারা ঠেলে দিয়েছিলেন দূরে এখন চেষ্টা করছেন তাদের কাছে টেনে নেবার। আত্মকেন্দ্রিক মনোেভাবের স্থান নিচ্ছে বহিঃ কেন্দ্রিক রাজনৈতিক চেতনা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে বাড়ছে চীনের বৈষয়িক লেনদেন। আন্তর্জাতিক মর্যাদাবােধ জেগেছে তার মনে। পিকিংএর হাতে আছে পারমাণকি বােমা। শীঘ্রই নাকি ভােলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক চীনা বিমান সংস্থা। বৃটেন থেকে কিনছে সে কোটি কোটি টাকার পরিবহন বিমান। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসাবে চীন স্বীকৃত। আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে রয়েছে চীনের সীমান্ত বিরােধ। আদর্শ সংঘাত এবং জমির মালিকানার দাবী সমস্যাটি করে ফেলেছে ঘােরাল। এদিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে জাপানী সামরিক উন্মত্ততা। তার প্রথম আঘাত আসবে চীনের উপর। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলােতে প্রভাব বিস্তারের বড় হাতিয়ার আর্থিক এবং কারিগরী সাহায্য। জাপানী সঙ্গতি বর্তমান চীনের চেয়ে বেশী। টোকিও সম্প্রতি ঝেড়ে ফেলেছেন যুদ্ধ পরবর্তী যুগের বিছিন্নতা। তাঁরাও এখন বেরিয়েছেন গােটা বিশ্বে, বিশেষ করে প্রতিবেশী অঞ্চলে বন্ধুর খোঁজে। সম্ভাব্য বন্ধুর তালিকায় অবশ্যই লেখা আছে ভারতের নাম। জাপানীরা অবশ্যই আনাগােনা করছেন নয়াদিল্লীতে। এ অবস্থায় ভারত সম্পর্কে চীনা নরমনীতি খুবই স্বাভাবিক।
পরিবর্তিত অবস্থার রাজনৈতিক মূল্যায়নে দেরী করেন নি নয়াদিল্লী। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি নিস্তরঙ্গ জলে তরঙ্গ সঞ্চারের চেষ্টা চালাচ্ছেন ভারতে নীতি নির্ধারকরা। এর মধ্যেই এসে পড়েছে আর একটি জটিল সমস্যা। ওটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ইসলামাবাদ চালিয়েছেন গণহত্যা। ইয়াহিয়া খান দিচ্ছিলেন যুদ্ধের হুমকি। সঙ্গী হিসাবে পাবেন তিনি চীনকে। এ ইঙ্গিত দিতেও ভুল করেন নি তিনি। প্রবল পাক যুদ্ধ উন্মাদনার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি। পিকিং নেতারা হয়ত বুঝতে পেরেছেন-ভারত সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক নীতি চীনা স্বার্থের পরিপন্থী। স্বৈরচারী ইসলামাবাদের ধিক্কারে গেল দুনিয়া সােচ্চার। গণহত্যাকারীদের সমর্থন প্রগতিগুলাে প্রতিবন্ধক। ওটা বন্ধু জোগারের বিরাট বাধা। নমনীয় আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গেও তা খাপ খায় না। ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করলেই পাকিস্তান ছাড়তে হবে—এমন কথা নেই। মার্কিন-সােভিয়েট সম্পর্ক এক সময় ছিল তিক্ত। বিশ্ব জোড়া ঠাণ্ডা লড়াইএর যুগ এ দুটি রাষ্ট্র নিয়েছিল পরস্পরবিরােধী শিবিরে দুটি নেতৃত্বের ভূমিকা। এ সময় আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে সমভাবেই গড়ে উঠেছিল ভারতের হৃদ্যতা আমেরিকা যখন চীনের এক নম্বর শত্রু তখন ভারতে উঠে “হিন্দী-চীনী ভাই ভাই” আওয়াজ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতির প্রতি আন্তরিক আস্থাই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দের মূলসূত্র। এই নীতিতে যদি আবার আস্থা জানায় চীন তবে তার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে বাধা নেই ভারতের। নয়াদিল্লীর উদ্যম আন্তরিকতায় ভরা। চীনা প্রধানমন্ত্রী চো এন লাইএর কাছে লিখিত শ্রীমতী গান্ধীর চিঠির জবাব আসে নি বলে নৈরাশ্যে কোন কারণ নেই। জাতি হিসাবে চীনারা খুবই হুশিয়ারী ওদের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ্য রুপ নিতে লাগে বেশী সময় এখন চলছে পিংপং খেলা। এটা পরিবেশ সৃষ্টির প্রথম ধাপ। তারপর হয়ত হবে আসল রাজনৈতিক খেলা। সূচনাতে সীমান্ত বিরােধের প্রশ্ন না তােলাই ভাল পারস্পরিক বিশ্বাস ফিরে এলেই তৈরী হবে দেওয়া নেওয়ার মনােভাব। এর থেকেই জন্ম নেবে হুদ্যতা। এর দরকার উভয় পক্ষের ধৈর্য এবং সহিষ্ণযতার প্রতীক্ষা ভাবালুতার স্থান নেই সেখানে। বাস্তববােধই সার্থকতার চাবিকাঠি। পিংপং দিয়ে যার সূচনা রাজনৈতিক বন্ধুর তার সমাপ্তি সবারই কাম্য।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১