You dont have javascript enabled! Please enable it!

টিক্কা খানের বিদায়

রতনে রতন চেনে। আয়ুব খান চিনেছিলেন মােনেম খাকে। তাকে করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। ইয়াহিয়া খান চিনেছেন দাঁতের ডাক্তার আবদুল মতালেব মালেককে। বাংলাদেশে থাকবে না সামরিক শাসন। তার স্থান নেবে অসামরিক শাসকগােষ্ঠী। ডাঃ মালেক হলেন গভর্নর। তিনি গড়বেন মন্ত্রিসভা। করবেন বাংলাদেশ শাসন। সৈন্যবাহিনীর কাজ হবে সীমিত। প্রয়ােজন হলে অসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্য এগিয়ে আসবে তারা। এই নাকি ইয়াহিয়া খানের বাসনা। টিক্কা খানকে তিনি দিয়েছেন বিদায়। এই জবরদস্ত জেনারেলের পদ ছিল দুটি। একাধারে তিনি ছিলেন গভর্নর এবং অন্যদিকে সামরিক আইন প্রশাসক। গভর্নরের পদটি নিলেন ডাঃ মালেক। আর সামরিক প্রশাসকের আসনে বসলেন লেঃ জেঃ আমীর আবদুল্লা খান। বাংলাদেশে আপাততঃ টিক্কা খান হলেন বেকার। জবর একটা চাল দিলেন ইয়াহিয়া খান। সবাইকে তিনি দেখবেন বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক। অসামরিক দ্রলােক ডাঃ মালেক যখন ডাঙ্গায় থাকে তখন দেহের ইচ্ছায় নাড়েচড়ে লাঙ্গুল। আর যখন পানিতে পড়ে তখন লাঙ্গুল হয় দেহের কাণ্ডারী। গভর্নর ডাঃ মালেক নেমেছেন বাংলাদেশের নদীতে সাঁতার কাটতে। পাকসৈন্যদল তার তার কাণ্ডারী। যে ঘাটে পাড়ি জমাবার হুকুম আসবে সে-ঘাটেই উঠতে হবে তাঁকে। নইলে খাবেন নাকানী চুরানী। সব দেশেই দালালদের ভাগ্যে জুটে এধরণের বিড়ম্বনা। ডাঃ মালেকও তার ব্যতিক্রম নন।
এই ধরণের একটা লােক ঠকান ব্যবস্থা ছাড়া উপায় ছিল না ইয়াহিয়া খানের। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশকে শায়েস্তা করার ভার নিয়েছিলেন জেনারেল টিক্কা খান। শেষ হয়েছে পাঁচ মাস। এর মধ্যে হত্যা লুটপাট, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি কিছুই বাদ যায় নি। পাক-সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন সাধারণ মানুষ। আশী লক্ষাধিক নরনারী এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠছে প্রচণ্ড ধিক্কার। চীন, আমেরিকা এবং গােটা কয় ধর্মান্ধ মুসলিম রাষ্ট্র ছাড়া কেউ দিচ্ছে না পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য। মুজিবনগরে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। মুক্তিবাহিনীর মারে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে টিক্কার ঘাতকদল। পাক-অর্থনীতিতে লেগেছে ভাঙ্গন। বিদেশে প্রতিদিন ঘটছে ইসলামাবাদের ইজ্জতহানি। পাক-দুতাবাসগুলাের বাঙালী কূটনৈতিক কর্মীরা ছাড়ছেন দস্যু শাসকদের চাকরি। নিচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের আনুগত্য। মহামুস্কিলে পড়েছেন ইয়াহিয়া খান। মুস্কিল আসানের জন্য দরকার কতগুলাে দালাল। কলমের খোচায় পাক জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় অনেক আওয়ামী সদস্যের নাম তিনি করেছিলেন খারিজ। কথা ছিল উপনির্বাচনের। তাও নাকি স্থগিত থাকবে এখন। নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যথেষ্ট সংখ্যার দালাল। পূর্ব পাকিস্তানই নেই। দালাল জুটবে কোথায় থেকে? বাংলাদেশে দালালের সংখ্যা এখন খুবই কম। যারা আছে মুক্তিবাহিনীর ভয়ে তারা পারছে না বেশীদূর এগুতে। খুবই বড় ডাঃ মালেকের বুকের পাটা। মনে তার বিরাট আশা—ঢাকায় বসে টিক্কার আগুনে তামাক খাবেন তিনি। মালেক সাহেব নাকি প্রাক্তন শ্রমিক নেতা। মােনেম খাঁর চেয়ে অবশ্যই বুদ্ধি তার বেশী। টিক্কা খান গর্দান নিয়ে হয়ত চলে যাবেন ইসলামাবাদে। ডাঃ মালেক বাঙালী থাকতে হবে তাকে বাংলাদেশে। এদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য। দেয়ালের লিখন খণ্ডাতে পারবে না কেউ। দেশদ্রোহিতার শাস্তি কি এড়াতে পারবেন তিনি?
ইয়াহিয়া খানের জানা উচিত, গােটা বাঙালী জাতি তার সঙ্গে করছে অসহযােগিতা। দখলদার পাক-সৈন্য উচ্ছেদের জন্য জনতা ধরেছে অস্ত্র। দু’চার জন দালাল সামনে রেখে রােথ করা সম্ভব নয় মুক্তি সংগ্রামের দুর্বার গতি। যারা চান বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্ত ন্তির তার দেখুন ইয়াহিয়ার ধৃষ্টতা। পরখ করুন পাকিস্তানি মার্কিন বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। এর পরেও কি ইসলামাবাদের উকিল সেজে সাফাই গাইবেন প্রেসিডেন্ট নিকসন? বিদেশী সাংবাদিক এবং মানব দরদী নেতারা দেখেছেন পাক-অধিকৃত বাংলাদেশের অবস্থা। সীমান্তের এপারে শরণার্থীদের মুখ থেকে শুনছেন। মর্মন্তুদ কাহিনী। সামরিক শাসকদের আজ্ঞাবাহী ভূতের শাসনে দুর্ভাগারা কি ফিরতে পারবেন স্বদেশে? জঙ্গীশাহীর উপর নেই যাদের আস্থা তাদের ক্রীতদাসদের কি করে বিশ্বাস করবেন তারা? বর্বর সামরিক উৎপীড়ন জাগায় সাময়িক সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস থেকেই জন্ম নেয় প্রতিরােধ। আর দালালরা জাগায় ঘৃণ্য ঘৃণা এবং প্রতিশােধ দুই মুক্তিযােদ্ধাদের মানসিক খােরাক। গভর্নর পদে মালেকের নিয়ােগ ঘৃণার আগুনে জুগিয়েছে নতুন ইন্ধন। তাতে মুক্তি সংগ্রাম হবে আরও জোরদার বাড়বে দালাল নিধনের ব্যাপকতা। তাদের শবের উপর ঘটবে স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। টিক্কা খানের বিদায় তারই সূচনা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!