৬ দফার বিরুদ্ধে দমন নিপীড়ন এবং পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা
১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেওয়ার পর দলীয় ওয়ার্কিং কমিটিতে সেটি গৃহীত হয়। ৬ দফাকে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য শেখ মুজিবসহ দলীয় নেতৃবৃন্দ জেলাসমূহে সাংগঠনিক প্রচার ও সভা সমাবেশ বৃদ্ধি করার প্রেক্ষিতে প্রদেশের সর্বত্র জনগণের কাছে ৬ দফার আলােচনা ক্রমেই স্থান পেতে থাকে। বিশেষত ১৮-২০শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ৬ দফার ইশতেহার ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ৬ দফাকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বায়ত্তশাসনের প্রধান দলিল হিসেবে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রচারণায় নিয়ে আসেন। এটিকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ম্যাগনা কার্টা বা স্বাধীনতা ও মুক্তির মহাসনদ হিসেবে অভিহিত করে বক্তৃতা প্রদান করেন। তার এসব বক্তৃতা জনগণের কাছে দ্রুতই সমাদৃত হতে থাকে। ৬ দফা অচিরেই পূর্ব বাংলার জনগণের। মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে যাচ্ছে-এটি ক্রমেই দৃশ্যমান হতে থাকে। শেখ মুজিবের জনসভাগুলােতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি এবং তাঁর বক্তৃতার প্রতি মানুষের মনােযােগ ও আকর্ষণ পাকিস্তান সরকারের নজরে আসতে থাকে। সরকার যেহেতু কোনাে অবস্থাতেই ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পক্ষে চিন্তা করতে রাজি ছিল না, বরং
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১০৫
তারা এই পদ্ধতিতে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয় হিসেবে মনে করেছিল তাই পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে একধরনের ‘পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বিবেচনা করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা পূর্ব পাকিস্তানে যত বেশি জনসমর্থন লাভ করছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তত বেশি আতঙ্কবােধ করতে থাকে। তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ উত্থাপন করতে থাকে। পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলাে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ক্রমেই সােচ্চার হতে থাকে। সেই অবস্থায় সরকার শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে কোনােক্রমেই অগ্রসর হতে না দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবকে একের পর এক মামলায় জড়িয়ে তার রাজনৈতিক অগ্রযাত্রাকে যখন বন্ধ করা যায়নি তখন তাঁকে দীর্ঘ মেয়াদে জেলে আটকে রাখার নতুন কৌশলে একের পর এক মামলা রুজু করতে থাকে। ৮ই মে (১৯৬৬) তারিখে নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভার পর শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তান সরকার গেফতার শুরু করে। অবিলম্বে সেটি দেশব্যাপী বিস্তৃত করা হয়। আওয়ামী লীগও এই ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সােচ্চার হতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। পাকিস্তান সরকার উক্ত হরতাল দমনে সকল শক্তি প্রয়ােগ করে। এতে ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ নিহত হন, অনেকেই আহত ও গ্রেপ্তার হন। ৭ই জুনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের। সভা থেকে বিরােধীদল ওয়াক আউট করে এবং ঐদিন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বিরােধী দল এবং স্বতন্ত্র সদস্যগণ বের হয়ে আসেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারও পূর্ব বাংলায় তাদের স্বৈরশাসন দৃঢ় করার উদ্যোগ একে একে নিতে থাকে। ১৬ই জুন পাকিস্তান সরকার দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা টাইমস এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান সরকার ৭ জুনের পর দমন নিপীড়ন না। কমিয়ে বরং তা বৃদ্ধি করতে থাকে। আওয়ামী লীগ যেন কোনাে অবস্থাতেই
১০৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হতে পারে সে ধরনের নিবর্তনমূলক পুলিশি হয়রানি, জেল ও গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি শুরু হয়। এটি মূলত ৬ দফার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকার আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার, শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দকে জেলে আটকে রেখে স্বায়ত্তশাসনের প্রতি ক্রমবর্ধমান জনসমর্থনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার একটি পরিকল্পনা থেকে নেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার এইসব গ্রেফতার, জেলজুলুম ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কণ্ঠ রােধ করার প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করার পর মল নেতা শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদোহী কোনাে ষড়যন্ত্র মামলায়। নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা থেকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি সংস্কৃতিবিরােধী সরকারি কর্মকাণ্ডও বৃদ্ধি করা হয়, একই সঙ্গে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘উন্নয়নের ১০ বছর’ উদ্যাপন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৯ই মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দের অনেকেই জেলে বন্দি ছিলেন। ১৯৬৮ সালে বন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবকে সেনানিবাসে অন্তরীণ করে রাখা হয় এবং তার বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা রুজু করা হয়। একদিকে ৬ দফা আন্দোলনকে স্তব্ধ করা অন্যদিকে ভারতবিরােধী জিগির ও হিন্দুস্তানের ষড়যন্ত্রসহ পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে প্রসারিত করার বৃহত্তর পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। এই পর্বের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা সেইসব লক্ষণ, প্রভাব ও অবস্থারই প্রতিফলন দেখতে পাব।
৮ই মের সেই গভীর রাতে অর্থাৎ ৯ই মে প্রথম প্রহরে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধি আইন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, সহসভাপতি জনাব মুজিবর রহমান (রাজশাহী), সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রমিক সম্পাদক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, আওয়ামীলীগ নেতা খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ আজিজসহ মােট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে ১০ই মে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল হয়। ঢাকায়
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১০৭
অনুষ্ঠিত মিছিল বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে এবং পথসভায় বক্তাগণ শেখ মুজিবসহ কারাবন্দি সাত নেতার মুক্তি দাবি করেন।১৬৪ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তিনি গ্রেফতার হন ২২শে জুন ১৯৬৬, তারপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মােল্লা জালাল উদ্দিন। তার গ্রেফতারের পর ২৭শে জুলাই থেকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম। মিজান চৌধুরী ১৯৬৭ সালে মুক্তিলাভ করলেও ১৯৬৮ সালের শেষদিকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৩ই মে শুক্রবার আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে কারাবন্দি নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কারাবন্দি নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করা হয় এবং ‘ভারতের সহিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে দেশ হইতে অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার দ্বারা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরাইয়া আনিয়া জনসাধারণের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রবর্তনের দাবি করিয়া সভায় একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হইয়াছে।১৬৫ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকের গ্রেফতারের পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বেতার ও তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন প্রদেশের কয়েকটি স্থানে সফর ও মৌলিক গণতন্ত্রী এবং মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে লাহাের প্রত্যাবর্তন পূর্বক ১৬ই মে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এতে তিনি, ৬ দফা প্রস্তাব দেশের সংহতির প্রতি বিরাট হুমকীস্বরূপ বলিয়া… মনে করেন এবং জনগণের নিকট উহার স্বরূপ উদঘাটন করার প্রয়ােজন রহিয়াছে বলিয়া উল্লেখ করেন।১৬৬ অন্যদিকে কারাবন্দি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে শুক্রবার ২০শে মে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায়, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, জনাব শেখ মুজিবুর রহমানসহ
——————————————
১৬৪ দৈনিক আজাদ, ১০ই মে ১৯৬৬ (৯২)।
১৬৫ দৈনিক আজাদ, ১৫ই মে ১৯৬৬ (৯২)
১৬৬ দৈনিক আজাদ, ১৭ই মে ১৯৬৬ (৯২)
——————————————
১০৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
সকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের ওপর জারীকৃত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং অন্যান্য দাবির পরিপ্রেক্ষিতে… ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।১৬৭ এটি ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বড়াে ধরনের চ্যালেঞ্জ প্রদর্শন। যা ৬ দফার পক্ষে জনগণের মতামত গঠনে পরবর্তী সময়ে বড়াে ধরনের রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছিল। ২৭শে মে রাওয়ালপিন্ডিতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটি ৭ই জুন আহূত হরতালকে সমর্থন জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করে। ৩১শে মে ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক কমিটির পক্ষ থেকে হরতাল সফল করার আহ্বান। জানিয়ে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি কমিটির হরতালের প্রতি সমর্থনের বিষয়টি পত্রপত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানাে হয়।১৬৮ এদিকে ২রা জুন তারিখে (১৯৬৬) জেলেবন্দিরত অবস্থায় শেখ মুজিব লেখেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহিরা আলােচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য।১৬৯
৩রা জুন তারিখেও তিনি লেখেন, “দেখি জমাদার সাহেব লুঙ্গি পরা দুইজন লােক নিয়ে পুরানা বিশ সেলের দিকে যাচ্ছেন।… বুঝলাম আরও কিছু আমদানি হয়েছে। জেলে নতুন কয়েদি এলে ‘আমদানি’ বলে, আর চলে গেলে ‘খরচ’ বলে।… খবর পেলাম দুইজন এসেছে ১০ সেলে। এই দুইজনও শেখ সাহেবের দলের’-কয়েদিরা বলাবলি করতে থাকে।… ঢাকা জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হক সাহেব, আরেকজন আওয়ামী লীগের সদস্য নন।… আজ আর লেখাপড়ায় মন দিতে পারছি। না। কী হবে বাইরে, কর্মীদের কী অবস্থা, অত্যাচার ও গ্রেপ্তার সমানে চলছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর।”১৭০
—————————————-
১৬৭ দৈনিক আজাদ, ২১শে মে ১৯৬৬ (৯২)
১৬৮ দৈনিক আজাদ, ১লা জুন ১৯৬৬ (৯৩)
১৬৯ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, বাংলা একাডেমি, ২০১৭, পৃ. ৫৫ (৯৩)
১৭০ পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৮ (৯৩)
—————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১০৯
৫ই জুন তারিখ শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভােগ করেছে। ৬ দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভােগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শােষণের হাত থেকে বাঁচানাের সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবও পােস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলান হতেছে।১৭১
৬ই জুন তারিখ জেলে বসে ৭ই জুনের হরতাল সম্পর্কে প্রাপ্ত খবরাখবরের ভিত্তিতে একটি দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া লেখেন। তিনি লেখেন, ‘আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ববাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ৬ দফা সমর্থন করবে। তবে মােনায়েম খান যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গােলমাল বাঁধাবার চেষ্টা যে তিনি করছেন। এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও, বােঝেন না।… ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। যশাের আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করছে, ভূতপূর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। জনাব নুরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র সমালােচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শত্রুবিনাশের জন্য রচিত আইনে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার দেশবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে। ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকেসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি করিয়াছে, আর ৬ দফার দাবিকে সমর্থন করিয়াছে এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাইয়াছে। ৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে এবং তাদের মুক্তির দাবি করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথসভা করে চলেছে। মশাল শােভাযাত্রাও একটি বের করেছে।১৭২
কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেও শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই জুনের আহূত হরতালকে কেন্দ্র করে সরকারের দমন নিপীড়ন সত্ত্বেও আওয়ামী
—————————————
১৭১ পূর্বোক্ত, প, ৬৫ (৯৩)
১৭২ পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭-৬৮ (৯৩)
—————————————
১১০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
লীগের নেতাকর্মীদের দৃঢ় মনােবল ও রাস্তায় আন্দোলন অব্যাহত রাখার অবস্থান গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। একই সঙ্গে ৬ দফার প্রতি গণতন্ত্রী সদস্যদের এবং মােনায়েম সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে নুরুল আমীনের অবস্থানকে তুলে ধরেন। জেলে বসে পত্রপত্রিকা থেকে তিনি এসব খবরাখবর সংগ্রহ করতেন।
৭ তারিখ তিনি লেখেন, সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মােনায়েম খান যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচির ভেদ করে খবর আসল দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম আওয়ামী লীগই একলাই চালাইতেছে।১৭৩
৭ই জুন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আহূত হরতাল সংঘর্ষে রূপ ধারণ করে। এতে ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং অনেকেই আহত হন। সংঘর্ষ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সবচাইতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন স্থাপনা, যানবাহন ইত্যাদি ঘেরাও করে। মানুষের তীব্র ক্ষোভ পুলিশের দিকেও বর্ষিত হয়। পুলিশ গুলি চালিয়ে সেটি দমন করার চেষ্টা করে। ৮ই জুনের পত্রপত্রিকায় ৭ই জুনের হরতালের ব্যাপক বিবরণ রয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালে শ্রমিক এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। এর মাধ্যমে ৬ দফার এবং শেখ মুজিবসহ বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনগণের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ৭ই জুনের হরতালকে পরবর্তী সময়ে ৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৭ জুন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী সভা সমাবেশ করে আসছে। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালে প্রতিবছরই এই দিনটিতে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। তিনি এই দিবসটিকে স্বাধীনতার আন্দোলনে মােড় পরিবর্তনের দিবস হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন।
পাকিস্তান সরকারও ৭ই জুন আহূত হরতালকে দমন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছিল। তাদের ধারণা ছিল এটি করার মাধ্যমে ৬ দফা
—————————————-
১৭৩ পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৯ (৯৩)।
—————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১১১
এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সূচিত আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ৭ই জুন-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে বেশকিছু রাজনৈতিক দল পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানবিরােধী আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজনৈতিক জোট গঠন করতে থাকে। ৮ই জুন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামধারী বেশকিছু সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের দমন নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তােলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। তারা ১০টি দাবি জনগণের নিকট তুলে ধরেন। বিবৃতি দানকারীরা হলেন, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, মহীউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, দেওয়ান মাহবুব আলী, পীর হাবিবুর রহমান, মােজাফফর আহমদ, হাতেম আলী খান, ওসমান গনি, গােলাম মর্তুজা, নুরু ইসলাম ও ড. এমএ ওয়াদুদ। যদিও তাদের দাবির সঙ্গে ৬ দফার বেশকিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। তারপরও ৭ই জুন অনুষ্ঠিত হরতালকে কেন্দ্র করে বামপন্থি বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সােচ্চার হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে, পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি বড়াে ধরনের ইতিবাচক অগ্রগতি বলে ধরে নেওয়া যায়। ৮ই জুন তারিখ জেলখানায় শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই জুনের হরতালের সংবাদ জানার জন্য গভীরভাবে প্রতীক্ষা করছিলেন। কিন্তু পত্রপত্রিকা পেতে বিলম্ব হওয়ায় এবং তাতে হরতালের খবরাখবর না ছাপায় তিনি সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তির খবর থেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে যে ধারণাটি পােষণ করেছিলেন তাতেই তাঁর অনুমান সত্য হয়। এইদিন তিনি দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যা লেখেন তা কারাগারের রােজনামচার পৃষ্ঠা ৭১-৭৩-তে বিবৃত হয়েছে। জেলখানায় বসে বঙ্গবন্ধু ৭ই জুন হরতালে পুলিশের নির্বিচারে গুলিতে আহত ও নিহতদের প্রতি তাঁর সমবেদনা জানিয়ে লেখেন, ৬ দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শােষকশ্রেণি যে আর তার পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শােষণ বেশিদিন করতে পারবে না, সেকথা এবার জেলে
১১২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনাে শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণির ৬ দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।১৭৪
৯ই জুন তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের অভ্যন্তরে দুইদিন যাবৎ পুলিশ কর্তৃক ধরে আনা দুই-তিনশত ছেলেরা নাওয়া-খাওয়া ছাড়া যেভাবে অবহেলিত ছিল তাদের করুণ বিবরণ উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া ওইদিন বিকেলে পাওয়া পত্রিকার খবর থেকে জানতে পারেন, তথাকথিত জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বিরােধী দল ওয়াকআউট করেছে প্রতিবাদে। কারণ মুলতবি প্রস্তাব স্পীকার সাহেব উঠাতে দেন। নাই।’১৭৫
ওইদিনের পত্রিকায় আহত আরেক জনের মৃত্যুর খবর দেখে শেখ মুজিব ভীষণভাবে কষ্ট পান। ৭ই জুনের হরতালের পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবসহ অন্য নেতৃবৃন্দকে একে অপরের সঙ্গে যাতে যােগাযােগ, দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বলতে না পারে সে রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এ বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১০ই জুন তারিখের লেখায় বিস্তৃত বর্ণনা দেন। তিনি অবশ্য এতে কোনাে ধরনের ভয়ভীতি পাননি। বরং তিনি লেখেন, ‘আজ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা, যারা বাইরে আছেন যদি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেন তবে দাবি আদায় করতে বেশি সময় লাগবে না।’১৭৬
১০ তারিখে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত ১২ই জুন। পত্রপত্রিকায় বিবৃতি আকারে প্রেরণ করে এতে ১৬ই আগস্টের মধ্যে জরুরি আইন প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দান ইত্যাদির দাবিতে প্রতিরােধ দিবস পালনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। ১২ তারিখ জেলে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্ত সমর্থন করে লেখেন, “দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা
——————————–
১৭৪ পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৩ (৯৬)
১৭৫ পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৬ (৯৬)
১৭৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৯ (৯৭)
——————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১১৩
অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সংকল্প করিয়াছে। রক্ত এরা বৃথা যাইতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের। তার সভাপতিত্বে ১১ ঘণ্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যােগদান করতে পিন্ডি চলে গেছেন। ১৭, ১৮, ১৯শে জুন ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস উদ্যাপন করার আহ্বান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ই আগস্টের পূর্বে সমস্ত গণবিরােধী ব্যবস্থার অবসান দাবি করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই আগস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণ আন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই। ৬ দফা বাস্তবায়নের সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘােষণা করেছে। এখন আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে।১৭৭
বস্তুত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার ধরে নিয়েছিল যে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে কারাগারে আটক রাখাসহ ব্যপক নির্যাতনের মুখে ফেলা হলে শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটতে থাকে ভিন্ন। পরিস্থিতি। ৭ই জুনের হরতালকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার প্রতি। জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়, শেখ মুজিবসহ বন্দি কারা নেতৃবৃন্দের প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন দ্রুত বেড়ে যায়। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর নির্যাতনের মুখে আরও বেশি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে, নতুন নতুন কর্মসূচিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার অবস্থান তৈরি করে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি যথার্থই ৭ই জুনের পরের পরিস্থিতিকে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে অভিহিত করে। শেখ মুজিবের লেখা ১২ তারিখের পর্যালােচনায় আন্দোলনের পক্ষে দল এবং জনসমর্থনের উর্ধ্বমুখিনতার ধারণাই স্পষ্ট হয়।
১৪ই জুন শেখ মুজিব কারাগারে বসে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৭ই জুন প্রকাশিত Rawlepindi and East Pakistans Case শিরোনামে
———————————
১৭৭ পূর্বোক্ত…পৃ-৮৫ (৯৭)।
———————————
১১৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
লেখাটি পড়ে তা থেকে একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেন, ‘If Rawalpindi continues to belive that the revoulutionary spirit of Bengal is something of a joke, the Pakistani capital could be making quite a mistake.১৭৮ ‘ওইদিন তিনি আরও লেখেন,
..বাঙালির একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালি বুঝতে পেরেছে যে তাদের শােষণ করা হতেছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়াও।” (পূর্বোক্ত)
১৫ই জুন শেখ মুজিব তার রােজনামচায় লেখেন যে ইংল্যান্ড থেকে ব্রিটেনস্থ পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান প্রগতি ফ্রন্টের জেনারেল সেক্রেটারি এস এম হােসেন এক তারবার্তা প্রেরণ করে তাকে জানান যে ৭ জুনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা ১৭ ও ১৮ই জুন শহিদ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। উক্ত তারবার্তায় এস এম হােসেন লেখেন, ‘বর্তমান সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শােষণ, দুর্নীতি, অবিচার ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের অবসানের জন্য আমাদের সংঘবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলিতে হইবে।১৭৯
১৬ই জন ভােররাতে পাকিস্তান সরকার দেশ রক্ষা আইনে (ডিপিআর) দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসে। শেখ মুজিব তার ডায়েরিতে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তব্য লেখেন। (পৃ. ৯৫-৯৮) ১৭ই জুন তিনি লেখেন, ‘একজন খবর দিল রফিক সাহেব নামে আমাদের দলের একজন নেতা এসেছেন। তাকেও দশ সেলে রাখা হয়েছে। চলেছে গ্রেপ্তার সমানে। মনে হয় মােনায়েম খান সাহেব ৭ তারিখের পরে আরও ক্ষেপে গেছেন।… মনে হয় আওয়ামী লীগের কাকেও আর বাইরে রাখবে না। বােধ হয় এখনও অনেককে ধরতে চেষ্টা করছে। কেউ কেউ বােধ হয়। আত্মগােপন করে কাজ চালাইয়া যেতেছে।১৮০
———————————-
১৭৮ পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৯ (৯৮)
১৭৯ পূর্বোক্ত, পৃ. ৯২ (৯৮)
১৮০ পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৮-৯৯ (৯৯)
———————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১১৫
পরিস্থিতি তখন কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিরােধীদলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। বিশেষত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে ৯ই মে গ্রেফতার করার পর ৬ দফার পক্ষে যে জনসমর্থন তীব্রতর হয়ে উঠছিল সেটি স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য একের পর এক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল, ৭ই জুনের হরতালে পুলিশি শক্তি প্রয়ােগে দমন করার মাধ্যমে সরকার দেশব্যাপী তাণ্ডব ও ভয়ভীতি প্রদর্শন শুরু করে। সরকারের এমন কঠোর অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বেশকিছু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ থেকে দূরবর্তী অবস্থানে চলে যায়। বিশেষত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মওলানা ভাসানী ৬ দফার আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে রেখে বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯শে জুলাই পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রদত্ত সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বলেন, বিরােধী দলগুলি একটি সর্বসম্মত নিকটতম কর্মসূচির অভাবে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতেছে। কেননা এককভাবে কোনাে রাজনৈতিক দলের পক্ষে আন্দোলন গড়িয়া তােলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্র কায়েম, সাৰ্বজনীন ভােটাধিকার, স্বায়ত্তশাসন, রাজবন্দিদের মুক্তি, পররাষ্ট্র নীতি প্রভৃতি কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করিয়া বিরােধীদলগুলি অনায়াসে নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে পারে।… স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমেই ন্যাপের জন্ম হইয়াছে। স্বায়ত্তশাসনের দরুন পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট হইতে পারে না, বরং যতদিন এই দাবিকে ঝুলাইয়া রাখা হইবে ততই তিক্ততা বৃদ্ধি পাইবে। কিন্তু আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়া পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করিব।”১৮১ শেখ মুজিব অবশ্য জেলে বসেই ন্যাপ ভাসানীর ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সেকারণে তিনি ১৮ই জুন তারিখেই লেখেন, ‘…মওলানা ভাসানী সাহেব কোথায়? কী বলেন? আইয়ুব সাহেবের হাতকে শক্তিশালী করে পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে বের করে এনে সােশালিস্ট ব্লকে যােগ দিতে তিনি নাকি সক্ষম হবেন! তাই তিনি আইয়ুব সাহেবের সমস্ত অগণতান্ত্রিক পন্থাকে সমর্থন করেছেন। আর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলকে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল বলে গালি দিয়েছেন। এখন তাে প্রমাণ হয়ে গেছে
———————————-
১৮১ দৈনিক আজাদ, ১৯শে জুলাই ১৯৬৬ (১০০)
———————————-
১১৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
মওলানা সাহেব ও তাঁহার দলের কিছুসংখ্যক লােক সাম্রাজ্যবাদীদের দালালি করেছেন।১৮২
১৭ তারিখ রােজনামচায় শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাপ নেতা মশিউর রহমানের ৬ দফা এবং ৭ই জুনের হরতাল সম্পর্কে পাকিস্তানের আইন পরিষদে দেওয়া বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করে লেখেন, পূর্ব পাকিস্তানে গােলমাল করার সৃষ্টি করার জন্য মার্কিন গােয়েন্দা বিভাগ (সিআইএ) অর্থ প্রদান করিয়াছে। গত সপ্তাহে প্রদেশে যে ধর্মঘট হইয়াছে তাহাতে মার্কিন গােয়েন্দা বিভাগের অর্থ সাহায্য দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তিনি জানান।১৮৩
এতে স্পষ্ট হয় যে ন্যাপ ভাসানী ৬ দফার বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের পক্ষে ওকালতি শুরু করেছেন। শেখ মুজিব জেলে বসেই এসব দলের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর দলের আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে কোনাে ধরনের সংশয় বা হতাশা ব্যক্ত করেননি। এরই মধ্যে ১৭, ১৮ ও ১৯শে জুন প্রদেশব্যাপী জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালিত হয়। এর সঙ্গে ইত্তেফাক, নিউ নেশন, দৈনিক পূর্বাণী, ঢাকা টাইমস পত্রিকা বন্ধের বিরুদ্ধে সাংবাদিকগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। আইয়ুব শাহের বিরুদ্ধে গণপরিষদে স্বতন্ত্র এবং বিরােধী দলীয় সদস্যের আনীত মুলতবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ায় তারা ওয়াকআউট করেন। তারা কালাে ব্যাজ ধারণ করে প্রতিরােধ দিবস পালন করেন। সরকার পূর্ব বাংলায় ১৪৪ ধারা জারি করার মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠরােধ করার চেষ্টা করলেও বেশিদিন তা ধরে রাখতে পারবে না বলে শেখ মুজিব ১৯ তারিখের লেখায় লেখেন।১৮৪ তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া গ্রেফতার ও বিভিন্ন পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আন্দোলন জোরদার হয় এবং পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ থাকে। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে দমন নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাংবাদিকদের আন্দোলনও প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এমন অবস্থাতেও মওলানা ভাসানীর বিবৃতি থেকে তার দোদুল্যমান রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার হতে থাকে। দেশে তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান বেশ কঠোরতর হওয়ায় বেশকিছু রাজনৈতিক দল এ ধরনের দূরত্ব
——————————————————–
১৮২ পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৪ (১০০)
১৮৩ পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৯ (১০০)
১৮৪ বিস্তারিত দেখুন, কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ১০৮ (১০০)
——————————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১১৭
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বজায় রেখে চলতে শুরু করে। সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগ কার্য নির্বাহক কমিটির এক সভায় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলােচনা করা হয়। ২৩ তারিখ আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হতে থাকে। এমনকি আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসের পাহারাদারদেরও গ্রেফতার করা হতে থাকে। এই অবস্থায় ২৪শে জুন তারিখে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়, “জেল থেকে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মালিক গােলাম জিলানী, খাজা মহম্মদ রফিক, জনাব সিদ্দিকুল হাসান তাকে জানাইয়াছেন যে, তারা শেখ মুজিবুরের ৬ দফা প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্য কোনাে মতানৈক্য নাই। আমি জানি সত্যের জয় একদিন হবেই। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরাও একদিন এই ৬ দফা সমর্থন করে পাকিস্তানকে মজবুত করবেন। সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম চলছে। সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নাই। আজ পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা কারাগারে বন্দি। আওয়ামী লীগ আজ জেলখানায়। মানুষকে জেলে নিতে পারে কিন্তু নীতিকে জেলে নিতে পারে না।১৮৫
এতে প্রমাণিত হয় যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ৬ দফার আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে থাকে। তবে মুসলিম লীগ নেতা জনাব আবদুস সবুর খান ২৫শে জুনের পত্রিকায়। প্রকাশিত খবরে ৬ দফার বিরুদ্ধে বিষােদগার করেন। কিন্তু তার এই হুংকারের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব জেলে বসে লেখেন, ‘এসব কথা বলে। বাঙালির দাবি আর দমাতে পারবেন না, একথা ভালাে করে জেনে রাখুন সবুর সাহেব। জেল, জুলুম, মামলা সমানে চালাইয়াছেন। কাগজ বন্ধ করেছেন, এতেই গণআন্দোলন বন্ধ হয় না, সেরকম ভেবে থাকলে ভুল করেছেন।১৮৬
————————————————–
১৮৫ পূর্বোক্ত, পৃ. ১২০-২১২ (১০১)
১৮৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪ (১০২)
————————————————–
১১৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
২৮শে জুন তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বসে পত্রিকায় দেখতে পান যে মওলানা ভাসানী ‘সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং নিজে ময়দানে নামবেন বলে জানিয়েছেন। শেখ মুজিব এই সংবাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লেখেন, ‘মওলানা সাহেবের সঙ্গে যদি যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হয় তবে আইয়ুব সাহেবই বা কি অন্যায় করেছেন? মওলানা সাহেব তাে দেশের সমস্যার চিন্তা করেন না। বৈদেশিক নীতি নিয়ে ব্যস্ত।১৮৭ ২৮শে জুন তারিখে জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র ও বিরােধীদলীয় সদস্যগণ স্পিকারের রুলিংয়ের প্রতিবাদে ২ বার ওয়াক আউট করেন। জাতীয় পরিষদে তাদের বক্তব্য শােনা হয় না এবং পরিষদ আইয়ুব খানের ইচ্ছামত চলছে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
এই সময়ে ৬ দফার বিপক্ষে যারা রাজনৈতিক মাঠে কিংবা সরকারের অভ্যন্তরে নানা ধরনের বিষােদগার ও অপপ্রচার জোরদার করছিল তাদের সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান ২রা জুলাই স্পষ্ট করে লেখেন, ‘আজ যারা ৬ দফার দাবি যথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার দাবি বলে উড়াইয়া দিতে চায় বা অত্যাচার করে বন্ধ করতে চায় এই আন্দোলনকে, তারা খুবই ভুল পথে চলেছে। ৬ দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা-মরার দাবি। এটাকে জোর করে দাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। কংগ্রেস যে ভুল করেছিল প্রদেশের স্বায়ত্বশাসনের দাবি ও ফেডারেল শাসনতন্ত্র না মেনে আমাদের শাসকগােষ্ঠীও সেই ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না। আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের ন্যায্য দাবিও চাই, অন্যকে দিতেও চাই। কলােনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।১৮৮
———————————————————–
১৮৭ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩২ (১০২)
১৮৮ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪২ (১০২)
* ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ সরকারের গঠিত কেবিনেট মিশন ভারতবর্ষে একটি ফেডারেল পদ্ধতির রাষ্ট্রব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে একতম হয়েছিলাে। কিন্তু ১০ই জুলাই তারিখে আকস্মিকভাবে নেহেরু তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে পড়ায় জিন্নাহ এবং কেবিনেট মিশন তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। শেখ মুজিবুর রহমান কংগ্রেসের সেই ঐতিহাসিক ভুলের কথাই স্মরণ করিয়ে দেন।
———————————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১১৯
শেখ মুজিবুর রহমান উপযুক্ত বক্তব্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক শাসন ক্ষমতার স্বরূপটি তুলে ধরেন। এর বিপরীতে তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ফেডারেল তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরেন। এককেন্দ্রিক শাসন ক্ষমতা রাষ্ট্রকে স্বৈরতান্ত্রিক করে তুলে এতে রাষ্ট্রের প্রদেশসমূহের ক্ষমতা, অধিকার, উন্নয়ন চরমভাবে ব্যাহত হয়, সৃষ্টি হয় কেন্দ্র তথা রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা। পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে সৃষ্টির পর থেকে বহু জাতির অধিকার ভূলুণ্ঠিত করার মাধ্যমে ১৯৫৮ সালে এসে সামরিক স্বৈরশাসন পাকাপােক্ত করেছিল। সেকারণেই শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার মধ্যে শুধু পূর্ব বাংলার জন্যই নয় পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশ বা অঞ্চলের জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিও তুলে ধরেন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার এবং সরকারের প্রতি অনুগত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৌলিক দুর্বলতাকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানকে একটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক নিবর্তনমুলক রাষ্ট্রে পরিণত হতে সহায়তা করেছিল। এই সময় পর্যন্ত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল শেখ মুজিবের ৬ দফার অন্তর্নিহিত শক্তি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের ৬ দফা জনগণের কাছে দ্রুতই সমাদৃত হতে থাকে সে কারণে আওয়ামী লিগের বিরুদ্ধে দমন নিপীড়ন, জেল জুলুম যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, তত ৬ দফা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে থাকে। একারণেই আন্দোলন দমনের সরকারি সকল অপচেষ্টা খুব একটা কাজে লাগছিল না। যদিও ২০ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, মােনায়েম খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও নবাব কালাবাগ সাহেবকে বলেছেন পূর্ব বাংলার ৬ দফা আন্দোলন শেষ করে দিয়েছেন। আর কিছুদিন থাকলে একদম নস্যাৎ করে দিতে পারবেন।১৮৯
তবে এটি মােনায়েম খানের প্রেসিডেন্টকে তােষণনীতি ছাড়া আর কিছু ছিল না। ২৫শে জুলাই তারিখে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিবৃতি থেকে আওয়ামী লীগ কার্য নির্বাহক কমিটির বক্তব্য বুঝা যায়। ২৪ তারিখ অনুষ্ঠিত (স্থানের নাম উল্লেখ নেই), ‘দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহক কমিটি এই মর্মে প্রকাশ করেন
———————————————————
১৮৯ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭১ (১০৩)
———————————————————
১২০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
যে, আজ পর্যন্ত প্রায় ৫ শত আওয়ামী লীগ কর্মীকে সাজা দেওয়া হইয়াছে। এবং আরও বিপুল সংখ্যক মামলা কোর্টে বিচারাধীন রহিয়াছে। অধিকাংশ জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করিয়া সভা-সমিতি নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হইয়াছে। অন্যদিকে মফস্বল এলাকায় এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করিয়া রাখা হইয়াছে। যাহাতে স্থানীয় নেতারা সাহসী হইতেছে না বলিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে অভিযােগ করা হইয়াছে।
‘৬ দফা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের দমনমূলক ব্যবস্থার। তীব্র নিন্দা করা হয়। সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে সকল রাজবন্দির মুক্তিগ্রেফতারি পরওয়ানা এবং বিভিন্ন স্থান হইতে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার দাবি করা হইয়াছে। এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদে ‘আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন’ বলে অভিহিত করা হয়।১৯০ এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে সরকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় ও ভয়ভীতি প্রদর্শন জোরদার করতে থাকে। জেলেও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে জি আর নম্বর ১৮৯৩/৬৬ ইউ আর ৪৭ ডিপি আর ১৯৬৫ ধারায় রমনা থানায় ৮০ (৪)/৬৬ নম্বরের মামলার বিচার শুরু হয়।১৯১ নেতাকর্মীদের একটি অংশ জেলে কারারুদ্ধ হয়ে পড়ে, অন্য অংশ আত্মগােপন করতে বাধ্য হয়। সেই অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী লীগের জন্য জটিল হয়ে পড়ে। তবে আওয়ামী লীগ জটিল এই পরিস্থিতিতে সভা-সমাবেশ সংগঠিত করে সরকারকে মােকাবেলা করার কৌশল গ্রহণ করে। পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী এবং মুসলিম লীগসহ কয়েকটি দলের নেতৃবৃন্দ দেশব্যাপী ৬ দফার বিরুদ্ধে সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত করতে থাকে। ১৫ই আগস্ট খুলনায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় যােগাযােগ মন্ত্রী খান আবদুস সবুর এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি, ৬ দফা কর্মসূচিকে পাকিস্তানের সহিত ধ্বংস করার একটি সূক্ষ্ম পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করেন ।… বক্তৃতা দানকালে খান সবুর বিরােধীদলীয় নেতা জনাব নূরুল আমীনের সাম্প্রতিক বিবৃতির উল্লেখ করেন। বিবৃতিতে তিনি বলিয়াছিলেন যে কেহই দেশের বিচ্ছিন্নতা চাহেন না। খান সবুর জনাব নুরুল আমিনের বিবৃতির বিরােধিতা করেন নাই তবে এই মর্মে
————————————————
১৯০ দৈনিক আজাদ, ২৫শে জুলাই ১৯৬৬ (১০৪)
১৯১ কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ১৮১ (১০৪)
————————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১২১
অভিমত প্রকাশ করেন যে, বিরােধী দলীয় নেতা জনাব নুরুল আমিন ৬ দফার প্রণেতা নহেন। তিনি বলেন, শুধু ভারতই নহে অন্যান্য বৃহৎ শক্তিসমূহও ভারত বিভাগ এবং ধর্মভিত্তিক একটি আজাদী রাষ্ট্র গঠনকে সরল মনে মানিয়া লইতে পারে নাই। পাকিস্তানের স্বার্থবিরােধী এই শক্তিসমূহ সীমান্তের অপরাপর হইতে সকল প্রকার নৈতিক ও বৈবাহিক সাহায্য দ্বারা পুরাে পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের উৎসাহ যােগাইতেছে।১৯২ সরকারের এমন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যথাসম্ভব জনসংযােগ অব্যাহত রাখেন। ২৬ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ময়মনসিংহে সরকারের দমন নিপীড়ন ও ৬ দফা বিরােধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত করে। এতে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম বক্তৃতা করেন। ময়মনসিংহ টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের আয়ােজিত এই জনসভায় বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে বক্তৃতাদানকালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম বলেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিবে না বরং পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিবে…।’
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি আদায়ের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের কার্যসূচি হিসাবে মােমেনশাহী জেলা আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়ােজিত উক্ত জনসভায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম, জনাব আবদুর রব, জনাব নুরুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মিগণ ভাষণ দান করেন। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। মিসেস আমেনা বেগম তাহার ভাষণে বলেন যে, সরকার আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে অভিহিত করিতেছেন। তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের আজাদী সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর অবদান সর্বাধিক। কাজেই আমাদের বিরুদ্ধে
————————————————————-
১৯২ দৈনিক আজাদ, ১৬ই আগস্ট ১৯৬৬ (১০৪)
————————————————————-
১২২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদীর অভিযােগ এবং এই সম্পর্কে প্রচারণা চরম বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নহে। দরদী মন লইয়া আগাইয়া আসুন। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের উক্তির নিন্দা করিয়া আমেনা বেগম বলেন যে, রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্টের অভিযােগ রাষ্ট্রপ্রধানের মুখে শােভা পায় না। তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নিকট সত্যিকার দরদী মন লইয়া যােগ্য রাষ্ট্রপ্রধানের প্রজ্ঞায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ নির্ণয় করিবার আবেদন করেন। মিসেস আমেনা বেগম বলেন যে, সরকার (অস্পষ্ট) রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দান করিতেছেন, এমনকি পাকিস্তানের প্রস্তাবক শেরে বাংলা মরহুম এ কে ফজলুল হক, পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম পুরােধা মরহুম এইচ এস সােহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানকেও রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে আখ্যায়িত করা হইয়াছে। শেখ মুজিবরকে কারাগারে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছে। মিসেস আমেনা বেগম বলেন, যদি সত্যই শেখ মুজিবুর রাষ্ট্রদ্রোহী হইয়া থাকেন তাহা হইলে উহা প্রমাণ করিয়া তাহাকে ফাঁসি দিন না হইলে তাহাকে মুক্তিদান করুন১৯৩ ৩০ সেপ্টেম্বর যশাের টাউন হল ময়দানে প্রাক্তন এমএনএ জনাব আতাউর রশিদের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেন বেগম এক বক্তৃতায় দেশের দশ কোটি জনগণের মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পূরণ করিয়া দেশের উভয় অংশকে শক্তিশালী করিয়া তুলিবার জন্য সরকারকে অনুরােধ জানান।১৯৪
২রা অক্টোবর ১৯৬৬, নােয়াখালী চৌমুহনী রেলওয়ে ময়দানে জনাব এমএ রশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের এক বিরাট জনসভায় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৬ দফার ব্যাখ্যাদানকালে বলেন যে, “ইহা একটি শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত আন্দোলন। তিনি ৬ দফাকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধানের একমাত্র লক্ষ্য বলিয়া ঘােষণা করেন। সভায় বক্তৃতাদানকালে সাবেক উজির মনসুর আলী বলেন, রাজনীতিবিদরাই পাকিস্তান হাছেল করিয়াছেন এবং তাহারাই পাকিস্তান রক্ষা করিতে পারেন। জনাব এমএ রব বিনা বিচারে আটককে
————————————————
১৯৩ দৈনিক আজাদ, ২৭শে আগস্ট ১৯৬৬ (১০৬)
১৯৪ দৈনিক আজাদ, ১লা অক্টোবর ১৯৬৬ (১০৬)
————————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১২৩
এছলামবিরােধী এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের পরপন্থি বলিয়া অভিহিত করেন।১৯৫
এরপর ২৩শে অক্টোবর ১৯৬৬ ঢাকা পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ৬ দফার সমর্থনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহীর উদ্দিন বক্তৃতা করেন। এতে তিনি বলেন, ‘শত জোর-জুলুম চলুক না কেন, আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু সত্য প্রতিষ্ঠিত হইবেই।… জনাব জহীর উদ্দিন ৬ দফাকে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের দাবি হিসাবে উল্লেখ করিয়া বলেন যে, এই দাবি ক্ষমতা দখলের জন্য পেশ করা হয় নাই। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকবার ক্ষমতার প্রলােভন দেখান হইয়াছে কিন্তু আওয়ামী লীগ তাহা গ্রহণ করেন নাই।… তিনি আরও বলেন, ৬ দফা দাবি স্বীকার করিলে দেশের জনগণের মঙ্গল হইবে।১৯৬
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় বক্তৃতা করেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম, প্রাদেশিক পরিষদের বিরােধী দলের নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব নূরুল হক ও জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী। মিসেস আমেনা বেগম তার ভাষণে, ৬ দফাকে শােষিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত মানুষের দাবি’ হিসাবে উল্লেখ করেন। সাধারণ সম্পাদিকা তাঁহার ভাষণে আরও বলেন যে, বিদেশি শােষণের পর নির্যাতিত জনগণ যে পাকিস্তান কামনা করিয়াছিল সে পাকিস্তান তাঁহারা পায় নাই। নারীর দায়িত্ব- মিসেস আমেনা বেগম বর্তমান। রাজনৈতিক অবস্থাকে দুর্যোগপূর্ণ বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন যে, এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি হইতে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নারী সমাজের সঞ্চিত সমর্থন একান্ত প্রয়ােজন।… পরিশেষে তিনি বলেন যে, ৬ দফা দাবি এখন আর আওয়ামী লীগের দাবি নয় এখন ইহা জনসাধারণের দাবি এবং এই দাবি আদায়কল্পে সংগ্রামের জন্য জনসাধারণের নিকট আহ্বান জানান।
অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের ভাষণে, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সরকারে প্রতি আবেদন জানান এবং শেখ মুজিবুরসহ সকল রাজবন্দির
——————————————–
১৯৫ দৈনিক আজাদ, ৪ঠা অক্টোবর ১৯৬৬ (১০৬)
১৯৬ দৈনিক আজাদ, ২৪শে অক্টোবর ১৯৬৬ (১০৭)
——————————————–
১২৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
মুক্তিদানের দাবি করেন। সভাপতির ভাষণে জনাব নজরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্গত ও দুর্ভিক্ষ এলাকা ঘােষণার দাবি করেন।১৯৭
১৯৬৬ সালের শেষ এবং ১৯৬৭ সালের শুরুর দিনগুলােতে সরকার আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন দমনে মুখােমুখি অবস্থান নেয়।
শেখ মুজিব ১৯৬৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি লেখেন, “আজ আমার ১১টি মামলার একটি মামলা জেলগেটে, যার বিচার চলছে জনাব আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে; তার আগ্রুমেন্ট হবার কথা ছিল কিন্তু হতে পারে নাই। কারণ আমার এডভােকেট জনাব সালাম খান সাহেব এবং জহিরউদ্দিন সাহেব উপস্থিত হতে পারেন নাই। জনাব মাহমুদুল্লাহ সাহেব হাজির হয়ে দরখাস্ত করেছিলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম। ডিএসপি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার আর একটা মামলা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হবার কথা, কখন শুরু হবে? তিনি বললেন সরকার নতুন এডিএম যুক্ত করেছেন, শীঘ্রই জেলগেটে শুরু হবে। আমার এডভােকেট মাহমুদুল্লা সাহেব নােটিশ পেয়েছেন আমাকে হাজির করাবার জন্য। তিনি বলেছেন, আসামি কারাগারে সরকারের তত্ত্বাবধানে আছেন। সরকার ইচ্ছা। করলেই হাজির করতে পারবেন।১৯৮
বােঝাই যাচ্ছিল পাকিস্তান সরকার কারাগারের অন্তরীণ ৬ দফার প্রধান। নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মামলার জালে আটকে রাখার মাধ্যমে তাঁর মনােবল ভেঙে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু শেখ মুজিব এইসব মামলায় কোনাে ধরনের ভয়ভীতি পাওয়ার মতাে দেখা যায়নি। একই সঙ্গে সরকার আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশ পণ্ড করা এবং নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করার নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়। ১৬ই মার্চ পাবনায়, আওয়ামী লীগ নেতা ভূতপূর্ব মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ভূতপূর্ব এমএনএ জনাব আমজাদ হােসেন, জনাব আমিনউদ্দিন, আওয়ামী লীগ শ্রমিক নেতা আমজাদ হােসেন উকিল আরও বহু নেতা ও ছাত্র কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।১৯৯
———————————————–
১৯৭ পূর্বোক্ত (১০৭)। ১৯৮ কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ২০৮ (১০৮)
১৯৯ পূর্বোক্ত, প, ২০৯ (১০৮)।
———————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১২৫
১৮ মার্চ জেলগেটে শেখ মুজিবের দ্বিতীয় মামলার সওয়াল-জবাব হওয়ার কথা ছিল। সেদিন জেলে বসে শেখ মুজিব শুনেছেন বিভিন্ন জেলায় তাঁর নামে ছয়টি মামলা সরকার দায়ের করেছে। সরকার এই সময়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরে মেতে ওঠে। ৮ থেকে ১০ই এপ্রিল ১৯৬৫ সালের পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবের একটি ভাষণের বিরুদ্ধে রুজু করা মামলার সওয়াল জবাব শেষ হয়। এই সময়ে পাবনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করা হয়। তাদের আইনি সুবিধা গ্রহণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। ১৩ই এপ্রিল তারিখে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালের দায়ের করা ১২৪-এ ধারার রাষ্ট্রদোহী মামলা জেলগেটে শুনানি শুরু করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট শুনানির দিন ২২/৮/৬৭ নির্ধারণ করে চলে যান। মামলা, নির্যাতন, গ্রেফতার ইত্যাদির ব্যাপক বিস্তারের এই সময়ে যুক্তফ্রন্ট নামক একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকজন নেতা ২২শে এপ্রিল শেখ মুজিবের সঙ্গে জেলগেটে সাক্ষাৎ এবং মতামত নিতে আসেন। নেতারা হলেন- নবাবজাদা নসরুল্লা খা, মালিক গােলাম জিলানী, গােলাম মহম্মদ খান লুখাের, মালিক সরফরাজ ও জনাব আকতার আহম্মেদ খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মশিউর রহমান, নজরুল ইসলাম, এমএ আজিজ, আবুল হােসেন এবং আরও অনেকে।
এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব লিখেছেন, যশাের থেকে আবদুর রশিদ, খুলনা থেকে আবদুল মােমেন এসেছিল। যুক্তফ্রন্ট করা যায় কি না? নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট করার আপত্তি অনেকেরই নাই তবে ৬ দফা দাবি ছাড়তে কেহই রাজি নয়। এটা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হলেও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, জেল খাটছে। এই দাবি পূরণ না হলে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচবার কোনাে পথ নাই। আমি আমার মতামত দেই নাই কারণ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা নিজেরাই আলােচনা করে তাদের পথ। ঠিক করুক। আমি আমার মত চাপাইয়া দিতে যাবাে কেন? আমি বন্দি। বাইরের অবস্থা তারাই ভালাে জানে। তবে ৬ দফা দাবি দরকার হলে আমি একলাই করে যাব।”২০০
————————————
২০০ পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৬ (১০৯)
————————————
১২৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
ঐক্যজোট গঠন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং বেশকিছু বিরােধী দলের নেতার আগ্রহ বেশি ছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সেকারণে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের একটি অংশ ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। জেলের অভ্যন্তরে শেখ মুজিবের কাছে দাবিনামার একটি কপি প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি এই সব দাবিনামাকে শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে অভিহিত করেছেন।২০১ তিনি লিখেছেন, “কোর্টে জহির সাহেব আমার কাছে মত জিজ্ঞাসা করেছেন আর বলেছেন অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেছে-পিছান কষ্টকর। আমি আমেনা, আজিজ, মােস্তফা আর জহির সাহেবকে বলে দিয়েছি ঐক্যে আমার আপত্তি নাই তবে সকল বিরােধী দলকে নিতে হবে, ন্যাপকে বাদ দেওয়া চলবে না; দ্বিতীয় পার্টির কাজ বন্ধ হবে না-৬ দফার আন্দোলন চালাইয়া যাবে পার্টি। আমি ও আমার সহকর্মী যারা জেলে আছি বিশেষ করে খন্দকার মােশতাক, তাজউদ্দীন ও আমাকে কোনাে সর্বদলীয় কমিটিতে রাখবা না। আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। অনেক লােক গুলি খেয়ে মারা গেছে, অনেক কর্মী জেল খাটছে তাদের ত্যাগের দাম আমাকে দিতেই হবে। তাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারবাে না।২০২
২৭শে এপ্রিল ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ তারিখের পল্টন ময়দানের ভাষণের বক্তব্যের বিরুদ্ধে আনীত মামলায় শেখ মুজিবকে ১৫ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব লেখেন, “আমি দেখলাম আমার অবর্তমানে দুই গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। একদল ৬ দফা ছাড়া আপােষ করবে না আর একদল নিম্নতম কর্মসূচিতেই রাজি।’২০৩
স্বভাবতই বােঝা যাচ্ছে যে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (বেশিরভাগ নেতাই পশ্চিম পাকিস্তানের) নেতৃবৃন্দের প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক নেতার ভূমিকায় হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং
———————————————
২০১ বিস্তারিত দেখুন পুর্বোক্ত, পৃ. ২২৬-২৩২ (১০৯)
২০২ পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৯ (১০৯)
২০৩ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩০ (১১০)
———————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১২৭
মর্মাহত ছিলেন। তাদের ভূমিকার ফলে ৬ দফার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তবে ৬ দফার প্রণেতা হিসেবে তিনি কোনাে অবস্থাতেই ৬ দফার ক্ষতি হয় এমন কোনাে ঐক্যের পক্ষপাতী নন সেটা তিনি স্পষ্ট করে দেন। এই সময় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অনেকগুলাে মামলার রায় দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। একদিকে দলের অভ্যন্তরে মতবিরােধ, ঐক্যজোট তােড়জোড়, অন্যদিকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার রায়ে তাঁকে দীর্ঘমেয়াদে কারারুদ্ধ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছিল দ্রুতগতিতে। এটি সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই কারাবন্দি শেখ মুজিব দেখতে পাচ্ছিলেন। সম্ভবত মে মাসের প্রথম তারিখে সরকারের কাক্ষিত ঐক্যজোট গঠিত হয়। ঐক্যজোটের চুক্তিতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নসরুল্লাহ খান, আবদুস সালাম খান এবং গােলাম মােহাম্মদ খান লুন্দখাের, কাউন্সিল মােছলেম লীগের মমতাজ দৌলতানা, খাজা খয়ের উদ্দিন এবং তােফাজ্জল আলি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের জনাব নুরুল আমীন, জনাব আতাউর রহমান খান এবং হামিদুল হক চৌধুরী, জামাতে ইসলাম পার্টির জনাব তােফায়েল মােহম্মদ, জনাব আবদুর রহিম ও জনাব গােলাম আজম, নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মহম্মদ আলি, জনাব ফরিদ আহমদ এবং এম আর খান স্বাক্ষর করেন।২০৪ এই দলগুলাে ৬ দফার আদলে ৮ দফা (পরিশিষ্ট-৫)২০৫ প্রণয়ন করে বস্তুত ৬ দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এই উদ্যোগ নিয়েছিল এতে কোনাে সন্দেহ নেই। কেননা ঐক্যজোটে যেসব দল এবং নেতার নাম দেখা গেছে তাদের প্রায় সবাই ৬ দফাকে এতদিন পাকিস্তান ভাঙার দলিল বলে অভিহিত করছিলেন। হঠাৎ সেই সব নেতা ও দলের আদর্শে এমন কি পরিবর্তন ঘটেছিল যার ফলে তারা ৬ দফার আদলে ৮ দফায় স্বাক্ষর প্রদান করেন-সেটি কোনােভাবে স্পষ্ট হচ্ছিল না। যারা ন্যূনতম কর্মসূচির কথা বলেছিল তারা শেষ পর্যন্ত ৬ দফা এড়িয়ে ৮ দফায়। একমত হলেন কীভাবে? এখানে অতিরিক্ত আরও দুটো দফা যুক্ত হয়েছে। স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল যে জনগণের দৃষ্টি ৬ দফার আন্দোলন থেকে সরিয়ে
————————————————–
২০৪ বিস্তারিত দেখুন পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৬ (১১০)
২০৫ সূত্র: শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ২৩৬-২৩৭ (১১০)
————————————————–
১২৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় নেতার দিকে নিবদ্ধ করা, শেখ মুজিবকে হয়। তাদের নেতৃত্ব মেনে আসতে বাধ্য করা, নতুবা জেলের অন্তরালে তার কারাভােগ দীর্ঘায়িত করা, তার রাজনৈতিক মিশন-ভিশনকে দূর্বল করে দেওয়া। শেখ মুজিব জেলে বসে সরকারের নীলনকশা বুঝতে পেরেছিলেন। বলেই তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হননি। তাঁর আস্থা ছিল জনগণ তাকে ও ৬ দফাকে গ্রহণ করেছে। সুতরাং তাঁর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সরকারি রাজনীতির এই ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে তিনি পা দেননি। ২রা মে তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিসেস আমেনা বেগম এক যুক্ত বিবৃতিতে ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গঠীত পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্টে আওয়ামী লীগের শামিল হওয়া এবং ঐক্যফ্রন্ট গঠনের চুক্তিতে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর দানের বৈধতা সম্পর্কে।২০৬
এতে বােঝা গেল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অংশ ৬ দফার আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তবে আওয়ামী লীগকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য সরকারের নানা মহল তৎপর হতে থাকে। বিশেষ করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মে এবং জুন মাসে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে বিভিন্ন ধরনের মামলা সচল করার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে দুর্বল ও নিঃশেষিত করার সরকারি চেষ্টা বৃদ্ধি পায়।
তবে শেখ মুজিব তাতে ভীত না হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে লেখেন, ‘জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।২০৭
ঐক্যফ্রন্ট গঠন নিয়ে জেলের অভ্যন্তরেও কারাবন্দি নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সম্পর্কে শেখ মুজিব বিস্তারিত বর্ণনা দেন (পৃ. ২৪১-৪৩)। তবে পিডিএমের বিপক্ষে তথা ৬ দফার পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মােমিন, ওবায়দুর রহমান, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখ ছিলেন। তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া ও মিজান চৌধুরী পিডিএমের পক্ষে ছিলেন। খােন্দকার মােশতাক অবশ্য দল না ভাঙার পক্ষে ছিলেন। তবে শেখ
———————————————-
২০৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৮ (১১১)
২০৭ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৯ (১১১)
———————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১২৯
মুজিবুর রহমান ৬ দফার সঙ্গে তাঁর অবস্থানকে স্পষ্ট করে দলের পরবর্তী সম্মেলনে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দলের ওয়ার্কিং কমিটিকে জেল থেকে নির্দেশ প্রদান করেন। ২৩শে মে তারিখে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৬ দফা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করা। হয়। তবে পিডিএমের ৮ দফার বিষয়টি দলের পরবর্তী সম্মেলন পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওয়ার্কিং কমিটি পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে পিডিএমের সঙ্গে আন্দোলন করতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনাে আপত্তি নেই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়। বস্তুত এই সময় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা পিডিএমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এক ধরনের বিভাজন পরিলক্ষিত হলেও শেখ মুজিবের নির্দেশে ওয়ার্কিং কমিটি ৬ দফার আন্দোলনকে অক্ষুন্ন রাখার কৌশল অবলম্বন করেন। পিডিএমের ঘাের ছিল খুব সাময়িক। ওয়ার্কিং কমিটির সভার পর জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মজিবর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রশিদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরী লাহােরে অনুষ্ঠিত পিডিএম সম্মেলনে চলে যান। রাওয়ালপিন্ডি থেকে কামরুজ্জামান এমএনএ, ইউসুফ আলী এমএনএ এবং নুরুল ইসলাম এমএনএ সম্মেলনে যােগদান করেন। সভাপতির দায়িত্ব পান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও সম্পাদকের দায়িত্ব পান মাহমুদ আলী। নেতৃত্বের এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করার কৌশল নেপথ্যের শক্তি নিয়েছিল। পিডিএম গঠনের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনাে মৌলিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়ার কোনাে লক্ষণ দেখা যায়নি। এটি বড়ােজোর বড়াে বড়াে নেতাদের একত্রিত হওয়ার একটি প্লাটফর্মের বেশি কিছু হয়নি। এ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতিকে প্রেসিডেন্ট করার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এটা পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধোঁকা দেওয়ার ষড়যন্ত্র। কিছুতেই পারবে না এ বিশ্বাস আমার আছে।২০৮
পিডিএমের এই সম্মেলন ২৫শে মে তারিখ শেষ হয়। ২৭শে মে তারিখে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত ১২৪ক ধারার মামলার শুনানি জেলগেট কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে আদালতে উপস্থিত আইনজীবী
————————————————-
২০৮ পূর্বোক্ত, প. ২৪৩ (১১২)
————————————————-
১৩০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ (আবদুস সালাম খান, এডভােকেট জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মাহমুদুল্লা, এডভােকেট আবুল হােসেন, আমেনা বেগম, জনাব মােস্তফা এবং জনাব আলী (খুলনা) এবং অন্যান্য লাহােরে অনুষ্ঠিত পিডিএমের সভা এবং এতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যােগদান না করা নিয়ে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছিলেন। অধিকাংশ নেতা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পিডিএমের সঙ্গে থাকার মনােভাব প্রদর্শন করে শেখ মুজিবের সম্মতি আদায় করতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে শেখ মুজিব তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘…৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব।২০৯
শেখ মুজিবের এভাবে উত্তেজিত হবার প্রধান কারণ ছিল এই যে পিডিএমের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ৮ দফার বিরুদ্ধে কোনাে দাবি করা যাবে না। এর অর্থ দাঁড়ায় ৬ দফা ছেড়েই ৮ দফায় যুক্ত হতে হবে। এই প্রসঙ্গে শেখ মুজিব লিখেছেন, আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শােষক ও শাসকগােষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের নেতারা। বুঝেও বুঝতে চায় না।২১০
উপস্থিত নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের যুক্তির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ফিরে যান। তবে নেতৃবৃন্দ স্থান ত্যাগ করার আগে শেখ মুজিব ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা আমেনা বেগমকে বলেছিলেন, ৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শােভাযাত্রা পথসভা করবা।২১১
এই সময়ে তিনি একটি মামলায় আদালত থেকে জামিন পেলেও জামিনের আদেশ জেলগেটে আসেনি। কর্তৃপক্ষ মামলা এবং আদালতের রায় নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে টালবাহানা, লুকোচুরি এবং ইঁদুর দৌড় একের পর এক খেলে চলছিল। ২২শে জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ও কর্মী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। এরা হলেন-বজলুর রহমান, হারুনুর রশিদ, মাজেদুল হক, মুজিবুর রহমান, জালালউদ্দিন সাহেব, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সিরাজউদ্দিন, মােহাম্মদ আলি,
————————————–
২০৯ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৬ (১১৩)
২১০ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৬ (১১৩)
২১১ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৬ (১১৩)
————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৩১
শেখ মােহাম্মদ আলি, মানিক চৌধুরী। ২৫ তারিখ মুক্তি পান শামসুল হক। এসব মুক্তি দানের পেছনে সরকারের মধ্যে ইতিবাচক কোনাে মনােভাব থাকার কারণ নেই। বরং আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরােধ বাড়িয়ে তােলার অভিসন্ধি কাজ করে থাকতে পারে। পিডিএম গঠনকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মূল নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পীরজাদা নসরুল্লাহ খানের আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার প্রেক্ষাপটে যে সংকট তৈরি হয়। সেটি নিরসনে জেলের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দ দূর করার উদ্যোগ নেয়।
পাকিস্তানভিত্তিক আওয়ামী লীগের পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের প্রধান অংশ ৬ দফা গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। ফলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ১৯৬৭ সালের ২৭শে আগস্ট ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আহ্বান করা হয়। কাউন্সিলে একটি নতুন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যরা হলেন : সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামান।২১২ এ ছাড়া আরও সদস্য পদে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। সেই প্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামান এমএনএ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন। ১৯৬৭ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী আন্দোলন (পিডিএম) এ যােগ দেওয়ার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে মতবিরােধ দেখা দিয়াছিল। তাহারই চূড়ান্ত রূপ হিসাবে অচিরেই ৬ দফা কর্মসূচির অনুপ্রেরণাবিশিষ্ট আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হইবে বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন।… জনাব কামারুজ্জমান সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেন যে, করাচি ও সিন্ধু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ আলােচনাকালে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মতৈক্যে উপনীত হইয়াছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, করাচি ও সিন্ধু আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ পূনর্গঠনের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে।”২১৩
———————————-
২১২ নূহ আলম লেনিন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, সময় প্রকাশনা, ঢাকা, পৃ. ৫৮ (১১৪) ২১৩ দৈনিক আজাদ, ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ (১১৪)
———————————-
১৩২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
তবে পাকিস্তান সরকার ৬ দফার আন্দোলনকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসাবে এতদিন অভিহিত করলেও গােপণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশকিছু বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক আমলাকে অভিযুক্ত করে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে অপর ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযােগ এনে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা গােপনে দায়ের করে। ৬ই জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে ২৮ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ঘােষণা করে। তাদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তে জড়িত থাকার অভিযােগ পাওয়া গিয়েছে। … ‘গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে দুইজন সিএসপি অফিসার, কিছু সংখ্যক প্রাক্তন সামরিক কর্মচারী, কতিপয় চাকুরীরত সামরিক কর্মচারী ও দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা রহিয়াছেন। উল্লেখযােগ্য যে, ইতিপূর্বে এই ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত প্রেসনােট প্রকাশ করা হইয়াছিল। অদ্য স্বরাষ্ট্র দফতর কর্তৃক উপরােক্ত ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ দান করিয়া একটি প্রেসনােট প্রকাশ করা হইয়াছে। প্রকাশ, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিগণ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চালাইয়াছিলেন। ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারির? সহিত তাহাদের কয়েকজনের যােগাযােগ ছিল বলিয়া প্রেসনােটে উল্লেখ করা হয়। প্রেসনােটে আরও প্রকাশ, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় (ভারত) গমন করিয়া তাহাদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে লেঃ কর্ণেল মিশ্র, মেজর মেনন ও অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেন। তাহাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহই তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল বলিয়া প্রকাশ। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ গ্রেফতারকৃত বিভূতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরীসহ আরও কতিপয় ব্যক্তির মাধ্যমে এই সকল ব্যক্তি যে পর্যাপ্ত অর্থ লাভ করিয়াছেন তাহার প্রমাণাদিও রহিয়াছে বলিয়া অভিযােগ করা হয়। গ্রেফতারকৃত সিএসপি অফিসারদ্বয়ের মধ্যে একজন হইতেছেন।
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৩৩
আহমেদ ফজলুর রহমান। স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি বিগত এক বৎসরেরও অধিককাল ছুটি ভােগ করিয়া আসিতে ছিলেন। অন্যজন হইতেছেন জনাব রুহুল কুদ্স। ট্রেনিং গ্রহণকালে যুক্তরাষ্ট্র গমনের পূর্বে তিনিও ছুটি ভােগ করিতেছিলেন। এই চক্রান্তের সহিত ভারতীয় সামরিক অফিসার ও কূটনীতি বিভাগের জড়িত থাকার ব্যাপারেও ভারতীয় হাইকমিশনের গােচরীভূত করা হইয়াছে।…’২১৪
১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আকস্মিকভাবে নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি জেলার তােজাম্মেল সাহেব শেখ মুজিবের কক্ষে প্রবেশের অনুমতি চান। তিনি শেখ মুজিবকে জানান যে সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়েছে। বিষয়টি শুনে শেখ মুজিব বিস্মিত হন। তিনি জেলারকে তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনেকগুলাে মামলা থাকা অবস্থায় কীভাবে মুক্তি দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি জেলারের কাছে হুকুমনামা দেখতে চান। জেলার হুকুমনামা সংগ্রহের জন্য বের হয়ে গেলে শেখ মুজিব তার কক্ষসাথী আবদুল মােমিনকে সরকারের কোনাে না কোনাে গভীর ষড়যন্ত্রের নীলনকশা হিসেবে তাকে ঢাকা জেল। থেকে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব লেখেন, “ডেপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে মুক্তি’ দেওয়া হয়েছে।… বিছানা কাপড়গুলি বেঁধে দিলাে কয়েদিরা। মােমিন সাহেবকে বললাম বাড়িতে রেণুকে খবর দিতে, আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়াছে।…কারাে মুখে হাসি নাই। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, অন্য কোনাে বিপদে আমাকে ফেলছে সেটা আর কিছু না, ‘ষড়যন্ত্র মামলা’।২১৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানা থেকে শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর একটি বহর ঢাকা কুর্মিটোলা সেনানিবাসে গভীর রাতে নিয়ে আসে। সেখানে তাঁকে ‘আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলাে’২১৬ জানানাে হলাে। শেখ মুজিবকে ১৮ই জানুয়ারির প্রথম প্রহরে
————————————————
২১৪ দৈনিক আজাদ, ৭ই জানুয়ারি ১৯৬৮ (১১৫)
২১৫ কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ২৫৪ (১১৬)
২১৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৫ (১১৬)।
————————————————
১৩৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কারােই জানা ছিল না, সরকারি কোনাে আদেশ-নির্দেশের উল্লেখও ছিল না। পরে জানা গেছে ঢাকা সেনানিবাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করা হয়। শেখ মুজিবের বর্ণনা থেকে জানা গেছে তাঁকে সেনাবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের কঠোর পাহারায় একটি বিশেষ কক্ষে রাখা হয়। ১৮ই জানুয়ারি প্রত্যুষে সেনানিবাসে অফিসার মেস এলাকায় তাকে বন্দি অবস্থায় রাখার পর থেকে বেশ কিছুদিনের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ কারাগারের রােজনামচার ২৫২ থেকে ২৬৭ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমান বর্ণনা করেছেন। এতে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা তাকে নানাভাবে জেরা করার বিবরণ রয়েছে। সেনাবাহিনীর এইসব কর্মকর্তাগণ তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন জনকে অর্থ প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের তথ্য জানার চেষ্টা করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান একজন রাজনীতিবিদের মতােই তাদের সঙ্গে ৬ দফা প্রদানের পর পরবর্তী ঘটনাবলির বণর্না দেন এবং ১৯৬৬ সালের ৮ই মে পরবর্তী সময় থেকে জেলে বন্দি থাকার কারণে বাইরের কোনাে সামরিক বেসামরিক নেতা বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার দেখা সাক্ষাৎ বা যােগাযােগের সুযােগই ছিল না। তা ছাড়া তিনি কোনাে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে করেননি—সেটি দঢ়তার সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন। এই অংশের বর্ণনাতে তাঁকে সেনা সদস্যরা কীভাবে নজরদারিতে রাখত সেটির যেমন বর্ণনা রয়েছে একইভাবে তাকে অফিসার্স মেস এলাকার বাইরে হাঁটাতে নেওয়ার পেছনে হত্যার ষড়যন্ত্রের আঁচ করার বিষয়টিও উল্লেখ আছে। এর পর তিনি আর বাইরে হাঁটতে যাওয়ার সম্মতি দেননি। সেই সময়ের ঘটনাবলির লােমহর্ষক বর্ণনা উপযুক্ত পৃষ্ঠাগুলােতে রয়েছে।
২২শে জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক জরুরি সভা সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব আবদুর রশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায়, (১) ‘গৃহীত একটি প্রস্তাবে ষড়যন্ত্রের সহিত জড়িত বলিয়া অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপক্ষ সমর্থনের উপযুক্ত ব্যবস্থাসহ প্রকাশ্য বিচার দাবি করা হইয়াছে। অপর প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাস্থ্য
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৩৫
ও তিনি কোথায় রহিয়াছেন সে সম্পর্কে একটি প্রেসনােট প্রদানের জন্য সরকারের নিকট আবেদন জ্ঞাপন করা হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহক কমিটি পুনরায় ৬ দফা কর্মসূচির ওপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করিয়া পাকিস্তানের অধিকতর সংহতি ও একতার জন্য ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবি জানাইয়াছে।২১৭ ২৮শে জানুয়ারি উক্ত কার্যনির্বাহী পরিষদের মুলতবি সভায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ব্যবস্থা গােপনে না করে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত করার দাবি জানানাে হয়।২১৮ পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ আটককৃত নেতৃবৃন্দকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখলেও তাদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে কোনাে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। ফলে কী কারণে এইসব নেতাকে আটক করা হয়েছে, কিংবা তাদের আটকের পরিণতি কী হবে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনাে ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কোনাে কোনাে মন্ত্রী আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা উচ্চারণ করতে থাকেন। যেমন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী আলতাফ হােসেন ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানিদের যেকোনাে বিদেশি শক্তিই যেকোনাে ধরনের প্রতিশ্রুতি ও গ্যারান্টি প্রদান করুক না কেন সেটি প্রতিহত করা হবে। তিনি এটিকে আগরতলা ষড়যন্ত্রের অশুভ উদ্দেশ্য বলে দাবি করেন।২১৯ এপ্রিল মাসে জানা যায় যে শেখ মুজিবসহ আরও ৩৪ জন। ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় জড়িয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ করে রাখা হয়। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে মে মাসে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলাটি শুনানির জন্য আদালত গঠন এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করা হতে থাকে। উক্ত মামলার শুনানি ১৯শে জুন ১৯৬৮ শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ জনকে সামরিক আদালতে বিচার করার চেষ্টা করা হচ্ছে মর্মে সংবাদ জনসাধারণের কাছে। পৌঁছাতে থাকে। শেখ মুজিব এবং অন্য ৩৪ জনের মামলা পরিচালনায় হাইকোর্টের কয়েকজন প্রবীণ এবং নবীন আইনজীবী নিযুক্ত হন। তাদের
——————————————–
২১৭ দৈনিক আজাদ, ২৩শে জানুয়ারি ১৯৬৮ (১১৭)
২১৮ দৈনিক আজাদ, ২৯শে জানুয়ারি ১৯৬৮ (১১৭)
২১৯ দৈনিক আজাদ, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ (১১৮)
——————————————–
১৩৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
পাশাপাশি ব্রিটেন থেকে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীকে ঢাকায় আনার জন্য লন্ডনস্থ বাঙালি কমিউনিটির একটি অংশ চেষ্টা করতে থাকেন। একই সঙ্গে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল ভারতের আইনজীবী স্নেহাংশু আচার্য্যকে এ ব্যাপারে সহযােগিতা করার অনুরােধ করেন। তাঁর অনুরােধে স্নেহাংশ আচাৰ্য লন্ডনে বসবাসকারী প্রভাবশালী বাঙালি নীরােদ সি চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। নীরােদ চৌধুরীর অনুরােধে বিটেনে লেবার পার্টির সদস্য ও প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়মাস, কিউসি-কে শেখ মুজিবের মামলায় আইনজীবীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য ঢাকায় প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তিনি ৭ই জুলাই তারিখে সেনানিবাসে বন্দিরত শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন।
এ ছাড়া তার আইনজীবীদেরও আইনি লড়াইয়ে করণীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে যান। তবে এই মামলায় পাকিস্তান সরকারের শেখ মুজিব এবং তার সঙ্গে জড়িত অপর ৩৪ জন আসামিকে চূড়ান্ত দণ্ড দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে-এটি তিনি শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ জনদের একান্তে বলে যান। সে। কারণে বিচারিক লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে জনগণের লড়াইয়ের বিকল্প নেই বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়ে যান। পত্রপত্রিকায় মামলার নানা বিবরন প্রতিদিন প্রকাশিত হতে থাকে। এর ফলে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। সাধারণ মানুষ এই বিচারটিকে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে ৬ দফার লড়াইকে স্তব্ধ করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করতে থাকে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হামুদুর রহমানের শিক্ষা কমিশন, সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতি ও তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি ক্রমান্বয়ে বন্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১০ই আগস্ট প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ এবং ছাত্রদের ধরপাক করায় পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।২২০ আগস্ট মাসে ছাত্রদের কতিপয় দাবি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালনকালে পুলিশি হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিষয়টি রাজনৈতিক থমথমে পরিবেশে একটি বিস্ফোরণ হিসেবে দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তানে আগরতলা
————————————————–
২২০ দৈনিক আজাদ, ১১ই আগস্ট ১৯৬৮ (১১৯)।
————————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৩৭
মামলার বিরুদ্ধে সৃষ্ট জনমত ক্রমেই ফুসে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালীসহ) কয়েকটি রাজনৈতিক দল ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আলােচনা শুরু করেন। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্য নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি বেশি ছিল কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বৃহত্তর ঐক্যের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৩রা নভেম্বর পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত দলের এক জনসভায় সরকারের কঠোর সমালােচনা করে বক্তৃতা প্রদান করেন। এটি ছিল মওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে এই সময়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সরব উপস্থিতি। রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি দলের অবস্থান জোটবদ্ধ হওয়ার একটি লক্ষণও দেখা যেতে থাকে। তাতে দুই ন্যাপ এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। অচিরেই সেই উদ্যোগও অনেকটা। নেওয়া হতে থাকে।২২১ পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কোপন্থি) একটি সর্বদলীয় সভার প্রস্তাব করলে আওয়ামী লীগ ১লা ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে এ নিয়ে আলােচনা করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজান চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান যে কমিটি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সমর্থন রয়েছে। উল্লেখ মস্কোপন্থি ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন পিডিএম আওয়ামী লীগ এবং পিকিংপন্থি ন্যাপের নিকট একটি সর্বদলীয় ঐক্য গঠনের সম্মেলন করার প্রস্তাব করে। নভেম্বর মাসে পত্র প্রদান করেন। উক্ত পত্রের প্রতি সম্মতি জানিয়ে আওয়ামী লীগ সর্বদলীয় ঐক্য গঠনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে।২২২ ১২ ডিসেম্বর ধানমন্ডিস্থ শেখ মুজিবের বাসভবনে বেগম ফজিলাতুনেছা মুজিবের দেওয়া এক ইফতার পার্টিতে যােগদান করেন পাকিস্তান তেহরিকই-ইনসাফ পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল আজগর খান। তিনি সেখানে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সমান অধিকার দানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। এ ছাড়া, পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন সাধনে প্রচুর টাকা খরচ হইয়াছে।
————————————————–
২২১ দৈনিক আজাদ, ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৬৮ (১১৯)
২২২ দৈনিক আজাদ, ২রা ডিসেম্বর, ১৯৬৮ (১২০)
————————————————–
১৩৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
বলিয়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সম্প্রতি যে ঘােষণা দান করিয়াছেন ইহার ওপর মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইহা উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী। বেগম মুজিবের আয়ােজিত উক্ত ইফতারে অংশ নেন জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব আসাদুজ্জামান খান, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, জনাব মাে. ফরিদ আহমদ, জনাব জেড এ রহিম এবং শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পুত্রকন্যাও।২২৩ ১৪ই ডিসেম্বর আজগর খান সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম মুর্শেদসহ সিলেট বারের আমন্ত্রণে সিলেটে জেলা বার সমিতির সদস্যদের এক সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় আজগর খান, দুর্নীতিপরায়ণ এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান ঘটাইয়া দেশে সুশাসন কয়েমের আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের নাগরিক অধিকার এবং বাকস্বাধীনতা ছিনাইয়া নিয়াছেন।
অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস এম মুর্শেদ বলেন, দেশে যেকোনাে ধরনের শাসন ব্যবস্থা চালু থাকুক না কেন তাহাতে অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকিতে হইবে।২২৪ পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ালী ন্যাপের নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট করতে থাকেন। ওয়ালী ন্যাপের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিসহ অন্যান্য বিষয় সহযােগিতা প্রদানে এগিয়ে আসেন। ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৬৯ দৈনিক আজাদী এ ধরনের একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। তাতে লেখা হয়, মস্কোপন্থি পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত সাক্ষাতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আহ্বান জানাইয়াছেন। আজ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ষড়যন্ত্র মামলায় জনাব কাসুরী উপস্থিত ছিলেন। পূর্বাহে তিনি শেখ সাহেবের
——————————————————
২২৩ দৈনিক আজাদ, ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৬৮ (১২০)
২২৪ দৈনিক আজাদ, ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৬৮ (১২০)
*মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ চীন এবং আইয়ুব খানের সামরিক পক্ষাবলম্বন করায় উল্লেখ্যযােগ্য সংখ্যক নেতা কর্মী ১৯৬৭ সালে পৃথক একটি ন্যাপ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর অন্যতম নেতা ছিলেন অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। তারা ১৯৬৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল নেতাদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এর সভাপতি হন ওয়ালী খান।
——————————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৩৯
কৌসুলি হিসেবে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করিয়া আনীত রিট আবেদন জনাব কাসুরী হাইকোর্টে শেখ সাহেবের পক্ষ সমর্থন করিবেন। এই মামলার ব্যাপারে তিনি শেখ সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।২২৫
১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও সেখানে আইয়ুব ও মােনায়েম শাহীর সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিক্ষকদের নানাভাবে নাজেহাল করছিল। এ ছাড়া করাচিতে ছাত্র আন্দোলন ও সংগ্রামে পুলিশের নির্যাতন ঢাকায় বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ৬ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তােলার পক্ষে আলাপ আলােচনা শুরু করে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি ছাত্রলীগ, দুই ছাত্র ইউনিয়ন, ডাকসু শেখ। মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নতুন কর্মসূচি ও দাবিনামা প্রদানের ব্যাপারে আলােচনা অব্যাহত রাখে। এক্ষেত্রে পিকিংপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের ৬ দফার প্রতি তেমন সমর্থন ছিল না। পিকিংপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন ৬ দফার প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌছাতে বেশ গড়িমসি করছিল। তবে ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কোপন্থি) এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিল। ডিসেম্বরের শেষদিকে আলােচনা ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং ৬ দফার সঙ্গে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি দাবিনামা যুক্ত করে একটি আন্দোলন গড়ে তােলার ব্যাপারে সম্মত হয়। ১৯৬৯-এর ১লা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খােলার দিন কালাে পতাকা উত্তোলন ও মিছিল করার একটি যৌথ কর্মসূচি ছাত্রলীগ, দুই ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু পালন করে। এর বিরুদ্ধে পরদিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ডাকসু এবং নবগঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৫ই জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। ছাত্রলীগ ও তৎকালীন মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি উভয় ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের ৬ দফার বাস্তবায়ন ও তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শিক্ষা ও ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, কৃষক-শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও আদায়, জনকল্যাণমূলক আর্থ-সামজিক নীতি প্রবর্তন, জাতীয় স্বার্থের অনুকূল ও
————————————————–
২২৫ দৈনিক আজাদ, ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৬৯ (১২১)
————————————————–
১৪০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
যুক্তিযুক্ত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ ইত্যাদি বিষয়ের দাবি উল্লেখপূর্বক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ১১ দফার দাবিনামা এক ইশতেহারের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশ করে ৫ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে।২২৬ এ সময় থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন নতুন রূপ লাভ করে। একদিকে ডাকসু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দুই ন্যাপসহ আরও কিছু রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন দ্রুত জোরদার হতে থাকে। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলাের সভা সমাবেশ দাবিনামা ও কর্মসূচি জোরদার হতে থাকে।
১৯৬৯ সালের ৮ই জানুয়ারি ৮টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’ সংক্ষেপে (ডাক) গঠন করা হয়। এই রাজনৈতিক দলগুলাে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের অবসানের লক্ষ্যে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে সম্মত হয়। এতে আওয়ামী লীগ। মস্কোপন্থি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়াও নেজামে ইসলাম, এনডিএফ, জামাতে ইসলাম, পিডিপি, মুসলিম লীগ ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মতাে রাজনৈতিক দলও ছিল। তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘ডাক’ নেতৃবৃন্দকে ১১ দফার প্রতি সমর্থন জানানাের আহ্বান জানালে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অস্বীকতি জানায়। ১১ দফার প্রতি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থন রয়েছে কি না সেটি জানার জন্য উভয় ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে সেনানিবাসে তার সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যমে জানানাের দাবি জানায়। এই উপলক্ষে ছাত্রলীগের জনাব আবদুর রউফ এবং তােফায়েল আহমেদ একটি চিঠি লিখলে সেটি নিয়ে এমএ ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা সেনানিবাসে বন্দি পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। চিঠিটি তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে হস্তান্তর করেন এবং মৌখিকভাবে বিষয়টি জানান। তিনি পরদিন ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী এবং ডাকসুর ভিপি
—————————————–
২২৬ পূর্বোক্ত, ওয়াজেদ মিয়া, পৃ. ৪১ (১২২)
—————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৪১
তােফায়েল আহমেদকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন। পরদিন যথারীতি ছাত্র নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাদের ১১ দফার প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়ে দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ই জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং ‘ডাক’ কর্মসূচি প্রদান করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বড়াে ধরনের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও ১৪৪ ধারা জারি করে। সবকিছু উপক্ষো করে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ করে। ১৭ই জানুয়ারি থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন নতুন নতুন পর্যায়ে উন্নীত হতে থাকে। তখন কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ২০শে জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র বিক্ষোভ রাস্তায় নামে। পুলিশের গুলিতে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। সারা দেশ এ খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে ২১শে জানুয়ারি ঢাকায় ছিল ব্যাপক প্রতিবাদ সভা। ওইদিন প্রদেশব্যাপী হরতালও পালিত হয়। ঢাকায় সেদিন লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার শােক মিছিল হয়। ২২শে জানুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ ২৪শে জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করে। ঐদিন জাতীয় পরিষদের শীতকালীন অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনায়েম খানের নির্দেশে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশে শ্রমিক ছাত্র জনতা উক্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সচিবালয়সহ আশপাশের স্থাপনাসমূহ অবরােধ করে। উত্তেজিত জনতা মর্নিং নিউজ এবং দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা অফিসে অগ্নিসংযােগ করে। সেদিন পুলিশ, ইপিআরের গুলিতে ঢাকায় ৪ জন নিহত হয়। এ ছাড়া উত্তেজিত জনতা ঢাকায় আইয়ুব কনভেনশন মুসলিম লীগের দুজন। এমএলএর বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। শুরু হয় জনতার অগ্নিসংযােগ এবং চরম উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ। এটি সারা দেশেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অনেকেই জনতার আক্রোশে পড়ে। বিশেষ করে বিডি মেম্বার-চেয়্যারম্যানদের বাড়িঘর আক্রান্ত হতে থাকে। ফলে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে আগরতলা মামলার আসামিদের চুড়ান্ত জবানবন্দি আদালতে প্রদান করা হচ্ছিল। ২৮শে জানুয়ারি পূর্ব
১৪২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল মেসের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর একটি দীর্ঘ লিখিত জবানবন্দি পড়ে শুনান (পরিশিষ্ট-৬)। ২৯ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিরােধী দলের নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে আলােচনার জন্যে নিকট ভবিষ্যতে একটি গােলটেবিল বৈঠকের আয়ােজন করার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশিত হয়।২২৭ এর মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন ১৯৬৬ সালে শুরু হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার আন্দোলনের মুল নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দলের নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য ৩৪ জন ব্যক্তিকে পাকিস্তান ভাঙার অভিযােগে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল সেটি ১৯৬৯ সালের শুরুতে ছাত্র আন্দোলন ও ১১ দফার সংযােজনের মাধ্যমে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করায় পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এই ঘােষণার মাধ্যমে পিছু হটতে বাধ্য হন। এরপরেই রাজনীতির দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। জানুয়ারি মাসে সূচিত রক্তাক্ত আন্দোলন ফেব্রুয়ারি মাসেও বিস্তৃত হতে থাকে। আনে মাসেও বিস্তত হতে থাকে। আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লােকজন যুক্ত হতে থাকে এবং প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট বিস্তৃত হতে থাকে। ৬ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় আগমন করলে তাকে ঢাকায় ব্যাপকভাবে কালাে পতাকা প্রদর্শন করা হয়। আইয়ুব খানের প্রতি জনরােষ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার ১৪৪ ধারা এবং সেনাবাহিনীর পাহারা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি থাকা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান দুই ঘণ্টাব্যাপী আলােচনা করেন। জনাব নসরুল্লাহ খান সাংবাদিকদের জানান যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে তার আলােচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং তিনি তাঁর সঙ্গে আরও বৈঠকে বসার কথা জানান।২২৮ এর ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি দ্রুতই শেষ
————————————————-
২২৭ বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আজাদ, ৩১শে জানুয়ারি ১৯৬৯ (১২৪)
২২৮ বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আজাদ, ৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ (১২৪)
————————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৪৩
হতে যাওয়া এবং শেখ মুজিবের মুক্তি আসন্ন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ৮ই ফেব্রুয়ারি সরকার ইত্তেফাক পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্যজন মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দি দান সমাপ্ত হয়েছে।২২৯ সরকারের দিক থেকে মামলার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আন্দোলনরত নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে শান্ত করার কৌশল হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে আন্দোলনরত নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবের মুক্তি ব্যতীত আন্দোলন শেষ না হওয়ার ঘােষণা দিতে থাকেন। নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে ছাড়া কোনাে ধরনের গােলটেবিল বৈঠকের অংশগ্রহণে রাজি নয় এটি বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেন। ৯ই ফেব্রুয়ারি ‘নসরুল্লা খানের আমন্ত্রণে প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানে ভাসানীর অসম্মতি : শেখ মুজিব ছাড়া আওয়ামী লীগ বৈঠকে যােগদান করিবে না।২৩০ তখনও পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে কোনাে ধরনের প্রতিশ্রুতি দেননি। বরং তিনি তার অক্ষমতার কথা বলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল কাসেম পত্রিকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন যে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শেখ মুজিব ছাড়া কোনাে আলােচনাই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যাগুলির কোনাে মীমাংসা করিতে পারিবে না।… প্রেসিডেন্ট বিরােধীদলীয় রাজনৈতিক দলসমূহের সহিত গােলটেবিল বৈঠকে বসিয়া রাজনৈতিক বিষয়াদির যে মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছেন এবং বৈঠকের সাফল্যের পর জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান করিয়া অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির যে অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন উহা প্রশংসাযােগ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের অক্ষমতা প্রকাশ করিয়া তিনি যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহা আমাকে মর্মাহত করিয়াছে।২৩১
এর মাধ্যমে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের ব্যাপারে তার অনীহা তখনও পর্যন্ত ধরে রাখার চেষ্টা
————————————————–
২২৯ বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আজাদ, ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ (১২৫)
২৩০ বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আজাদ, ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ (১২৫)
২৩১ বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আজাদ, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ (১২৫)
————————————————–
১৪৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
করেছিলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ঐদিন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন ১৬ই ফেব্রুয়ারি সারা দেশে এই হত্যার তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। পরিস্থিতি চারদিকে অবনতি ঘটলে কারফিউ জারি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা দ্রুত অবনতিশীল হওয়ায় ১৬ তারিখ রাতেই রেডিও পাকিস্তানের খবরে শেখ মুজিবুর রহমান যাতে রাওয়ালপিন্ডিতে আহূত গােল টেবিল বৈঠকে নিরাপদে অংশ নিতে পারেন সেই প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ছাড়া রাওয়ালপিন্ডিতে আহূত গােলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার প্যারােলে মুক্তি দিয়ে গােলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান আদালতে বলেছেন যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্তে প্রত্যাহার করে সকলকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত তিনি গােলটেবিল বৈঠকে যাবেন না।২৩২
ফলে ১৭ই ফেব্রুয়ারি আহূত গােলটেবিল বৈঠক আইয়ুব খান ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেন। এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র জনতার আন্দোলন আরও উত্তেজনাকর হয়ে পড়ে। ২০শে ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র দেশব্যাপী আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালনের সঙ্গে শামসুজ্জোহার হত্যা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সর্বত্র উচ্চারিত হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলিতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। ফলে মানুষের ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায়। অনেক জায়গায় সেনাবাহিনী তলব করা হলে জনরােষ আরও বৃদ্ধি পায়। সেই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ২২শে ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাতিল করেন এবং শেখ মুজিবসহ উক্ত মামলার অন্য অভিযুক্তদের নিঃশর্তে মুক্তি দেন।২৩৩
———————————————–
২৩২ দেখুন, ওয়াজেদ মিয়া……পৃঃ ৫১ (১২৬)
২৩৩ দেখুন, ওয়াজেদ মিয়া…পৃ. ৫৩ (১২৬)
———————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৪৫
শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির সংবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এতে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসর সহসভাপতি তােফায়েল আহমেদ শেখ মজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। রেসকোর্সের বিশাল গণসংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, প্রয়ােজন হইলে সংগ্রাম করিয়া আবার কারাগারে যাইব, কিন্তু দেশবাসীর সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিব না।”২৩৪
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করে প্রধান আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকলের মুক্তি দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধু উপাধিতে শেখ মুজিবুর রহমান ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার গণসংবর্ধনা এবং দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমন হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৬ দফার আন্দোলন বড়াে ধরনের সাফল্য অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফা তখন জনগণের ব্যাপক সমর্থনে রাজনৈতিক বাস্তবতার যে উত্তরণ ঘটিয়েছিল তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে অগ্রসর করার সকল রাজনৈতিক ও গণসমর্থন লাভ করতে সক্ষম হন। পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলনের কাছে অনেকটাই পরাজিত হয়। পরবর্তী পর্বে ৬ দফার আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তরিত করার নতুন নতুন ধাপ অতিক্রম করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের শক্তিকে আরও বেগবান। করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং নির্বাচনােত্তর পরিস্থিতি ৬ দফার আন্দোলনকে এক দফার আন্দোলনে পরিণত করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা এবং কর্মসূচি নিয়মতান্ত্রিক ধারায় প্রয়ােগ করেন।
—————————————–
২৩৪ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ (১২৭)
Reference: ৬ দফা স্বাধীনতার মহাসনদ – মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী