You dont have javascript enabled! Please enable it!
কোদালিয়া সেতু আক্রমণ
টাঙ্গাইল জেলার সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মির্জাপুর থানাধীন ঢাকাটাঙ্গাইল সড়কে কোদালিয়া নামক স্থানে অবস্থিত কোদালিয়া সেতু। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর ৪টার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর অন্য কোম্পানিগুলাে ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার দিকে এগােতে থাকে। ৫টার মধ্যে তারা পাকা সড়কের পশ্চিমে যার যার সুবিধামতাে স্থানে অবস্থান নিয়ে নেয়। সেদিনও সড়ক পাহারায় নিয়ােজিত দুই কোম্পানি হানাদার ‘কনভয়’ ঢাকা-টাঙ্গাইল ও টাঙ্গাইল-ঢাকা যাতায়াত করে টহল দিচ্ছিল। দুইবার টহলদার বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, মুক্তিযােদ্ধারা তা বেশ ভালােভাবেই লক্ষ্য করলেন। টহলদার বাহিনীর মধ্যে কোনাে সংশয় নেই, উত্তেজনা নেই। গাড়ির মধ্যে তারা নিশ্চিন্তে, ঢিলেঢালাভাবেই ছিল। ইফতারের কিছু আগে টহলদার বাহিনী পাকুল্লা থেকে ঢাকার দিকে এগােতে থাকে। এ সময় অধিনায়ক আবদুস সবুর খান কোদালিয়া পুলের খুব কাছাকাছি থেকে হানাদারদের ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করছিলেন। ইফতারের মিনিট কুড়ি পর হানাদার দলটি কোদালিয়া সেতু পার হয়ে গেলে অধিনায়ক সবুর খান তার নেতৃত্বাধীন দলকে আরেকবার সতর্ক করে দিলেন। হানাদাররা সূত্রাপুর, গজারিয়াপাড়া ও কালিয়াকৈর পার হয়। কোদালিয়া সেতু পার হয়ে যাওয়ায় প্রায় ২ ঘণ্টা পরও মহিষবাথান সেতু পেরিয়ে যাওয়ার সংকেত না আসায় অধিনায়ক সবুর খান কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন।
ঢাকার দিক থেকে কোনাে সংকেত ছাড়া তারা পুলে আঘাত হানবেন কি না বুঝতে পারছিলেন না। ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট পরও কোনাে সংকেত না আসায় অধিনায়ক সাইদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করে সবুর মুক্তিযােদ্ধাদের কোদালিয়া সেতু আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। মুক্তিযােদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে গিয়ে পুলের উপর উঠলেন। বিস্মিত ও হতচকিত শত্রুপক্ষ প্রথম অবস্থায় কিছুটা বাধা দিলেও মুক্তিযােদ্ধারা তা সামলে নেন। কিন্তু পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে আসা মুক্তিবাহিনীর প্রতি সেতু থেকে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা ব্যাপকভাবে গুলি ছুঁড়তে থাকে। একদিক থেকে সবুর খান এবং অন্যদিক থেকে সাইদুর রহমান ৫৫জন করে ২টি দল নিয়ে পিছন দিক থেকে মিলিশিয়া ও রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে। হানাদারদের সব প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে। ফলে ৫-৭ মিনিটের মধ্যে ৪জন। মিলিশিয়াসহ প্রায় ৫৫জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কোদালিয়া সেতু দখলে মুক্তিযােদ্ধা ও শত্রু বাহিনীর কেউই হতাহত হয় নি। 
মির্জাপুর থানা দখল
ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল জেলার প্রবেশপথেই মির্জাপুর থানা এখানেই অবস্থিত। বিখ্যাত দানবীর রণদা প্রসাদের বাড়ি এবং তার প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুর হাসপাতাল। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর মির্জাপুর সেতু দখল করার পর প্রায় ৩ ঘণ্টা মির্জাপুর থানার উপর মুক্তিযােদ্ধা আজাদ কামাল ও তার সহযােদ্ধারা ক্রমাগত আক্রমণ চালালেও তা দখল করতে পারেন নি। এমন সময় অধিনায়ক সবুর প্রায় ৩০০ মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সেখানে হাজির হন। নানা দিক থেকে আক্রমণ করার পরও যখন পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারগুলাে দখল করা যায়নি, তখন অধিনায়ক সবুর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের পাওয়ার পাম্প ও পাইপ জোগাড় করে এনে রাতের অন্ধকারে পাম্প এনে খালের পাড়ে বসালেন। ভাের হওয়ার সাথে সাথে পাম্পগুলাে চালু করে প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে পাম্প চালানাে হলাে। ধীরে ধীরে পানি পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারের দিকে এগােতে লাগলাে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মির্জাপুর হাই স্কুল ও কলেজের মাঠ বর্ষার মতাে পানিতে ভরে গেল। থানার বাংকারগুলাে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তানি সেনারা পাম্পের দিকে ফায়ার করতে লাগলাে। বাংকারের ভিতর অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের জন্য। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে গুলিবিনিময় করতে করতে তারা ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১২জন পাকিস্তানি সেনা, ৪জন মিলিশিয়া ও ৭০জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং মির্জাপুর থানা মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!