২৩ জুলাই জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের জন্মবার্ষিকী
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৫ সালের এই দিনে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলায় দরদরিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও আদর্শবাদের তিনি অনন্য এক প্রতীক।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর শুরু করে একতরফা গণহত্যাযজ্ঞ। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তখন নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজ উদ্দীন আহমদের ওপর।
তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ১৯৭১ সালে এক চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সফল ভূমিকা পালন। নয় মাসের মধ্যে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মন্ত্রিসভা থেকে সরে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকচক্র সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দী করে।
পরে তাকে জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় তাকে এবং আরও তিন জাতীয় নেতাকে জেলখানার অভ্যন্তরে একই বছরের ৩ নভেম্বর ঘাতকচক্র নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
১৯৪৩ সাল থেকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের(হাসিম—সোহরাওারদী) সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
১৯ বছর বয়সে ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কাউন্সিলর হিসেবে তিনি ১৯৪৫ ও ১৯৪৭ সালে দিল্লী কনভেনশনে(৪৭ কনভেনশনে দুই টির পরিবর্তে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়) যোগ দেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠিত হয় । তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
তাজউদ্দীন আহমদ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। তাজউদ্দীন ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তাদের অন্যতম। ১৯৫৪-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ছাত্র তাজউদ্দীন সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুল মান্নানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে এমএলএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯,০৩৯ এবং ফকির আবদুল মান্নান ৫,৯৭২ ভোট পান।
তাজ উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার কারণে তার এমএ পরীক্ষা দেওয়া সম্বব হয়নি। এমএলএ নির্বাচিত হয়েও তিনি আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে নিয়মিত ক্লাস করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে তিনি আইন শাস্ত্রেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পেশায় তিনি আইনজীবী ছিলেন। ১৯৫৯ সালে এপ্রিলের ২৬ তারিখে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সৈয়দা জোহরা খাতুনের বিয়ে হয়।
১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদলের সাথে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যও সফর করেন।
১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন।
১৯৬৪ সালে তিনি পুনরিজ্জিবিত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালে তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ছয় দফার অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আপন সাংগঠনিক দক্ষতা ও একনিষ্ঠতার গুণে ইতিমধ্যে তিনি বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। এ বছরই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক পদে নির্বাচিত হন।
ছয় দফার প্রচারাভিযানের সময় ১৯৬৬ সালের ৮মে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তি পাওয়ার পর তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের মুক্তির দূতিয়ালি করেন নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রি এ আর খানের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন এবং কারাগারে শেখ মুজিবের সাথে বৈঠক করে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।
এরপর ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে জাতীয ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ছিলেন। । তাজউদ্দীন আহমদ ওই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হওয়া অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলনে নিজেকে উজার করে দেন। এই অসহযোগ আন্দোলনে সাংগঠনিক দিকগুলো পরিচালনা ও জনগণের কর্তৃত্বের পরিপ্রকাশক নির্দেশাবলি প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ অতুলনীয সাংগঠনিক দক্ষতা প্রদর্শন করেন। অসহযোগ আন্দোল চলাকালেই পাকিস্তানের সামরিক শাককদের সঙ্গে ঢাকায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়।
১৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন সহযোগী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার পরিচয় দেন।
বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তিনি সর্বসম্মতভাবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং ওই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা স্থানীয় জনগণ এবং শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক এই সন্ধিক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয। চরম প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বিষয়াদিসহ সব দিক সংগঠিত করে তোলেন। তাঁর সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ মাত্র নয় মাসেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও স্বদেশপ্রেম সবাইকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে নির্দ্বিধায় অভিহিত করা চলে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, সেই মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রী হিসেবে আত্মনির্ভর বিকাশমান অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য তিনি বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মন্ত্রিত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই দিন সকালে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয় এবং পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দি অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ সভেম্বর কারাগারের সব নিয়ম ভঙ্গ করে বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে অপর তিন জাতীয় নিত নেতা-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান সহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় ।