“ক্যাম্পের মধ্যে তাজা কুকুরে ভর্তি ছিল। এই অসংখ্য কুকুর খালের পাড়ে মানুষের তাজা রক্ত খাইয়া দিনে বেশ মোটা – তাজা হইত।“
২১ শে মে তারিখ শ্রীমঙ্গলের পথে গাড়িতে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া, তারপর পায়ে হাঁটিয়া প্রায় ৩৫ মেইল অতিক্রম করিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন রশিদপুর ২২ তারিখ আশ্রয় নেই। সেখানে পৌঁছিয়াই আমরা বিপদে আসন্ন বলিয়া আভাস পাইতে থাকি। আমাকে নাকি শ্রীমঙ্গলে পাক হানাদার বাহিনী খোঁজাখুঁজি করে। আমার আর সামনে পা দেওয়া উচিৎ নহে বলিয়া রশিদপুরস্থ কর্মীবৃন্দ হুঁশিয়ার করে। এতদুর আসিয়া বাসা বা পুরাতন ভৃত্যের সন্ধান মিলিবে না বুঝিয়া অত্যান্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ি। একটা ট্রেন শ্রীমঙ্গল অভিমুখে যাইতেছে দেখিয়া (২৩/৫/৭১ তাং) উঠিয়া পড়ি এবং পরবর্তী স্টেশন সাতগাঁ নামিয়া পড়ি। সেখান হইতে সরাসরি আমার স্টেশন শ্রীমঙ্গলে কথা বলার সুযোগ পাইয়া সহকর্মী ও স্টেশন মাষ্টার সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলিয়াছিলাম। আমি ও দিনের ক্লান্ত দেহে খাইয়া অনেকটা কাহিল হইয়া পড়ি এবং স্টেশন বিল্ডিং কক্ষে বিশ্রাম করিতে ছিলাম।
বেলা তখন হয়ত আড়াইটা। অতর্কিতে আমার সামনে বিভিন্ন ভারী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও তিন জন সৈনিক উপস্থিত এবং আমার নাম ধরিয়া সন্ধান জানিতে চাহে। তখন আমার মুখে কথা সরিতে ছিল না, মনে হইতেছিল যেন আমার পায়ের নিচের মাটি সরিয়া যাইতেছে। ক্ষণেকের মধ্যে স্টেশন মাস্টার সাহেবও আসিয়া উপস্থিত এবং আমারই নাম সামসুদ্দীন আহমদ সনাক্ত করিলে ক্যাপ্টেন আমাকে তাহাদের অনুসরন করিতে বলে। কয়েক কদম যাইয়াই তাদের জীপে উঠাইয়া আমাকে একটা বড় রকমের আসামী হিসেবে ঘিরিয়া রাখে। আধ ঘন্টার মধ্যে তাহারা আমাকে শ্রীমঙ্গল ওয়াপদাস্থ তাদের সামরিক আইন হেড কোয়ার্টারে নিয়া আসে।
আমাকে প্রথম লেফটেন্যান্ট আতাহারের কাছে হাজির করিলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করেন। তাহার জিজ্ঞাসাবাদের সংক্ষিপ্ত বিষয় ছিল চাকুরীতে যোগদান করি নাই কেন, কয়জন অবাঙ্গালী হত্যা করিয়াছি, সদ্য ভারত হইতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিয়া আসলাম কিনা। মুক্তিবাহিনীর লোক কাহারা, তাহাদের কি পোষাক, তাছাড়া শ্রীমঙ্গল স্টেশনের তৎকালীন অবাঙ্গালী স্টেশন মাস্টার আখতার ও তাহার ছেলেপেলে কোথায়, তাদের আমি হত্যা করিয়াছি। আমার বিরুদ্ধে নাকি সরাসরি হত্যার অভিযোগ আছে। তাছাড়া তিনি আমাকে কয়েকজন সমাজকর্মীর না-ধাম, তাহাদের আচার-ব্যবহার জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া আমাকে ছাড়িয়া অন্য রুমে চলিয়া যান।
একজন সৈনিক আসিয়া আমাকে কর্কশ স্বরে তাহার সহিত যাইতে বলে। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত গেলাম। একটা রুমে নিয়া আমাকে বসিতে বলিল। চতুর্দিকে কেবল গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছু নাই। আমাকে বিষণ্ন দেখিয়া একজন বিকট চেহারাধারী সৈনিক বলিল যে “যব এক দফে শের কা চক্কর মে আগিয়া, আর যানা কাহা হ্যায়”। কয়েক মিনিট পর আমাকে সেই বিল্ডিং হইতে ২-৩ মিনিটের রাস্তা দূরে অন্য এক বিল্ডিঙের ত্রিতলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার সুপরিচিত একজন বাঙ্গালী পুলিশের লোকের সাক্ষাৎ পাইলাম। সেই বাঙ্গালি লোকটা ২-৩ জন হানাদার বাহিনির লোক আমাকে মাটিতে বসিবার আদেশ দিয়া প্রশ্নবানে জর্জরিত করিয়া তোলে। ধমক দিতে থাকে, আর বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টা ব্যয় করে। সন্ধ্যা ক্রমাগত প্রায়, তখন আমাকে পার্শ্বস্থ একটা কামরায় ঢুকাইয়া বাহির হইতে তালাবদ্ধ করিয়া দিল। তখন আমার মানসিক অবস্থা কি তাহা আজ আর আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছিনা। আটকাবস্থায় পড়িয়া প্রথমেই আমার স্মরণ পড়ে আমার সর্বকনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী পারভীনের কথা। তারপর একে একে প্রতিটি সন্তান ও স্ত্রীর কথা। ক্রমে জীবনের স্মরণীয় মূহুর্তের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ভাসিয়া আসিতে থাকে।
আরও দুই জন ভদ্রলোককে সেখানে বন্দী হিসেবে দেখিলাম। একজনকে ভাল করিয়াই জানি, আর একজন আমার অপরিচিত। সন্ধ্যার লগ্নে আমাদের জন্য আটার রুটি ও ডাল দিয়া গেল। সাথের ঐ দুই ভদ্রলোক কয়েকদিন হইতে অভ্যস্থ বলিয়া ডাল-রুটি খাইলো। আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভবপর হইল না। দুই দিন পায়ে হাঁটিয়া এবং তৃতীয় দিনে আটকা অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থা একেবেরে শক্তিহীন হইয়া পড়ে।
রাত্র অনুমান আটটার দিকে দুজন সৈনিক আমাকে অন্য কক্ষে নিয়া যায় এবং আবার কেন চাকরীতে যোগদান করি নাই, মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছি, কয়েকজন অবাঙ্গালী হত্যা করিয়াছি ইত্যাদি প্রশ্ন করিয়া শাসাইতে আরম্ভ করে। জিজ্ঞাসাবাদ যাহারা করিতেছিল তাহাদের জল্লাদ বলিলেও যথেষ্ঠ হইবার নহে। লাঠি দ্বারা ধাক্কা দেয়, সত্য কথা না বলিলে জীবন এখনই শেষ করিয়া দিবে বলিয়া হুঁশিয়ার করিতে থাকে। তাহাদের মন মত কোন কথাই আমার কাছ থেকে পাইতেছে না মনে করিয়া তাহারা আমার প্রতি ভীষণ চটিয়া যায়। হাত দুই লম্বা লাঠি দ্বারা আমাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। জীবনে কোন কারনে, কোন অবস্থায় এমন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় নাই। তাহাদের মারের চোটে আমি কখন কোন অবস্থায় সংঞ্জা হারাইয়া ফেলি বলিতে পারি না। ভোর বেলা দেখি আমি প্রথম যে রুমে ঢুকি সেখানেই শায়িত। মার খাওয়া জায়গা গুলো কালো ও ফুলিয়া রহিয়াছে, হাত দিয়া ছুঁইতে পারিনা। রাত্রে যে রুমে নিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল তাহার চতুর্দিকের দেয়ালে রক্তের দাগে ঐ রুমটা যে জল্লাদের নির্যাতন কক্ষ তা বুঝিতে আমার বাকী ছিল না।
প্রত্যুষে তালা খুলিয়া আমাদেরকে পায়খানা প্রস্রাব করার জন্য নিকটস্থ খালের পড়ে নিয়া গেল। সেখানে পৌঁছিয়া আমরা ৮-১০ জন কয়েদী হইলাম, তাহাদের মধ্যে অনেকেই আমার মত অচল প্রায়, কথাবার্তা বলিতে পারেনা। কথা বলাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এক সাথে সকলকে কোন পর্দার ব্যবস্থা ছাড়া লাইন করিয়া বসাইয়া দিল পায়খানা করিতে। কে পায়খানা করিল জানি না। আমারতো পায়খানা-প্রস্রাব কিছুই হইলো না। তাছাড়া আমি দুই দিনের উপবাসী। ২-৩ মিনিটের মধ্যে পায়খানা-প্রস্রাব ও খালে পানি খরচ করিয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিতে হয়। বন্দুকধারী সৈনিক ও হাওয়ালদার দণ্ডায়মান।
আবার আসিয়া যার যার রুমে স্থান লইতে হইল। একটা পুরি ও এক কাপ চা খাইতে দেয়া হইল। দুপুরে আটার রুটি আর ডাইল। শরীরে জ্বর, কিছুই খাইতে পারি না। মুহুর্তে মূহুর্তে পরিবার-পরিজনদের কথাই মনে পড়িত। বিপদে পড়িয়া সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামই আহার-বিহারে সম্বল করিয়া লইলাম। বিকালে আবার ডাল-রুটি। ভাতের নাকি ব্যবস্থা নাই, তাই ভাতের কথা উচ্চারণ করিবার সাহসও হইল না।
আমাদিগকে যে রুমে রাখিলো তাহার দুদিকে বন্দুকধারী সৈনিকরা পোষাক ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া শুইয়া থাকে। আমাদের দিকে প্রকারান্তরে খুব খেয়াল করিত। আমরা কি বলি না বলি তাহা শুনিতে চেষ্টা করিত। জানালায় এক প্রকার কালো তার জড়ানো ছিল, তাহাতে আমাদের মধ্যে হইতে যেন তাহারা টেপ করিয়া রাখিয়াছে। জনমানব শুন্য এলাকায় আমরা ছিলাম, রোজই বিভিন্ন চেহারার সৈনিক আসিয়া তালা খুলিয়া দিলে কয়েদী হিসাবে আমাদের সহিত ঠাট্টা-চাতুরী করিত। কোথায় তোমাদের শেখ সাহেব, কোথায় বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বলিয়া ব্যঙ্গ করিত। আর লম্বা লাঠি দ্বারা গুঁতা দিয়া জানোয়ার ইত্যাদি বলিত। কেউ কেউ ধীরস্থীর হইয়া আমাদিগকে হিন্দুর গোলাম, হিন্দুর পয়দা বলিয়া গালি দিত।
এক দিন আমাদের সাথের একজন লোক বেলা প্রায় ১১ টার সময় পায়খানা করার জন্য অস্থিরভাবে প্রহরারত সৈনিককে মিনতি করিতে লাগিল। এমন সময় একজন সুবেদার মেজর আসিল। কর্মরত সৈনিক লোকটার পায়খানার কথা জানায়। তাদের ভাষায় – তারা কি বলিল জানিনা। তাহাকে দুই তিন জনে পায়খানা করাইবার মানসে নিয়া বাহির হইল। উপর হইতে আমরা নজর করিয়া দেখিলাম যে, তাহার হাত রশি দিয়া বাঁধিয়া আগে-পিছে সৈনিক তাহাকে খাল পাড়ে নিল এবং গুলি করিয়া তাহাকে খতম করিয়া তাহারা ফেরৎ চলিয়া আসিল। এমনিভাবে প্রতিদিন ২-১ জনের মৃত্যু দেখিয়াছিলাম। ক্যাম্পের মধ্যে তাজা কুকুরে ভর্তি ছিল। এই অসংখ্য কুকুর খালের পাড়ে মানুষের তাজা রক্ত খাইয়া দিনে বেশ মোটা – তাজা হইত। আর সৈনিকরা মানুষের সাথে কুকুরও গুলি করিয়া হত্যা করিত।
দু-একদিন ফাঁক দিয়াই তাহারা ঐ জল্লাদখানায় নিয়া আবার নির্যাতন করিত। এমনিভাবে বিভিন্ন উপায়ে আমাকে শারিরীক অত্যাচার আজ চির রোগা করিয়া দিয়াছে। মারের চোটে শরীর হইতে রক্ত ছিটিয়া পড়িত। ক্ষণে ক্ষণে বেহুঁশ হইলেও তাহারা রেহাই দিত না। তিন/চার দিন তাহারা আমাকে দিয়া লিখিত জবানবন্দি নিয়াছে। ২-৩ দিন কথিত লেফটেন্যান্ট আতাহারের সাক্ষাৎ পাইয়াছি। তাহাকে সাহস করিয়া আমার মুক্তির কথা জিজ্ঞাসা করিলে ব্যঙ্গ হাসি হাসিয়া বলিত “সবুর কর, কোহি তকলিফ তো নেহি দ্যা রাহা”।
একদিন রাত্র অনুমান ৯ টার সময় দুজন বন্দুকধারী সৈনিক আসিয়া বিশেষ করিয়া আমাকে খুব শাসাইতে লাগিল। আমি নাকি মুক্তিবাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ও কয়েকজন অবাঙ্গালী লোককে হত্যার ব্যাপারে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত ইত্যাদি। তাহারা আমাকে ত্রিতল হইতে ছাদের উপর নিয়া গেল এবং সেখানে আমাকে ভীষণভাবে নির্যাতন চালাইয়া একেবারে অচল করিয়া ফেলে। কর্তব্যরত সৈনিক আমার প্রতি খানিক সদয় থাকাতে আমাকে আবার আমার রুমে আনিয়া রাখিয়া যায়। আমাকে মারিয়া ফেলিবে এই ভাবিয়া আমার সঙ্গী ৮-১০ জন কয়েদী আমি ফিরিয়া দেখি তাহারা কাঁদিতেছে আর কালেমা পড়িতেছে ও দরূদ পাঠ করিতেছে। আমাকে ফেরৎ পাইয়া তাহারা অনেকটা শান্তি লাভ করে। তাহারা হানাদারদের কথা বলিত না, আমার মাধ্যমেই তাহাদের হানাদারদের সাথে কথোপকথন হইত।
যেহেতু আমি নির্দোষ ছিলাম, কর্ণেল ফকরুল আলম আমাকে ডাকিয়া অনেক শাসাইলো। কয়েকদফা গালি দিয়া আমাকে মুক্তির আদেশ দিল এবং কাজে যোগ দিবার জন্য একজন সুবেদার মেজরকে হাওলা করিয়া আমাকে স্টেশন পাঠাইয়া দিলে কোন মতে নয়দিন থাকিয়া স্বাস্থ্যগত কারনে ছুটি লইয়া শ্রীমঙ্গল হইতে কাটিয়া পড়ি। পাক বাহিনীর হাতে আমি মোট ২১ দিন বন্দি ছিলাম।
স্বাক্ষর/-
সামসুদ্দীন আহমদ
বুকিং ক্লার্ক
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে ষ্টেশন
সিলেট।
১৭.১০.৭৩
Ref: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র