You dont have javascript enabled! Please enable it!
আব্দুস সোবহান, সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)
শ্রীমঙ্গল, সিলেট।
#Sinecide_Sylhet
ডাক বাংলায় থাকা অবস্থায় আমাকে নানা রকম প্রশ্ন করা হয়। আমি প্রানভয়ে সব প্রশ্নের উত্তরে কিছুই জানি না উত্তর দিতে থাকি। এতে আমার উপর অত্যাচার শুরু হয়। চড়, লাথি এবং ডাণ্ডা পিটা হয়; কিন্তু আমার কাছ থেকে না পাওয়ায় আমাকে ওয়েলফেয়ার বিল্ডিং এ স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে দেখতে পাই পাক জান্তারা বাঙ্গালীদের চক্রীর সাথে বেঁধে চক্র ঘুরিয়ে বেত দিতে থাকে। রাইফেলের অগ্রভাগ দিয়ে গুঁতো মারতে থাকে। রাত্রে কোথায় নিয়ে যায় এবং গুলি করে মারা শব্দ শুনা যায়। পরে জেনেছি শ্রীমঙ্গলস্থ সাধু বাবার থলি নামক স্থানে গণহত্যা করা হত। বুট দিয়ে মানুষকে লাথি দেয়া হত। জলন্ত সিগারেট দিয়ে শরীরে ফোস্কা তোলা হত। এই রকম অত্যাচারের প্রক্রিয়া দেখে আমি প্রাণভয়ে আল্লাহর কাছে প্রান ভিক্ষা করতে থাকি। কারন এ ছাড়া কোন উপায় ছিলনা।
 
এমনাবস্থায় ১২ মে ১৯৭১ সন পর্যন্ত থাকি এবং আমাকে নানাবিধ প্রশ্ন করা হয়। তন্মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল “তুম লোগ কা মেজর, কর্ণেল, ক্যাপ্টেন কিদার হ্যায়?” আমি বলতাম আমি জানিনা (অবশ্য উর্দুতে উত্তর দিতাম)। তারপর যখন আমি অসহ্য হয়ে যাই তখন আমি বললাম, হাম সরকারী দপ্তর তথ্য ইউনিয়ন কাউন্সিল কা মেকানিক হ্যায়, হাম কভি মুক্তি মে নেহি থা, ইছলিয়ে হাম কোছ নেহি জান্তা হ্যায়। এটা শোনার পর ক্যাপ্টেন তারেক আমাকে আমার উপরস্থ কর্মচারীর সার্টিফিকেট দাখিল করতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম পারবো। তখন আমাকে ২ জন সিপাহী দিয়ে সি,ও (রেভ) যিনি তখন সি,ও (ডেভ)- এর দায়িত্ব পালন করতেন তার কাছে পাঠায় এবং তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট আনলে ১৪ ই মে ১৯৭১ ইং তারিখে আমাকে পুনরায় কাজে যোগদান করব বলে স্বীকারনামা লিখিয়ে নিয়ে ছাড়ে এবং হেঁটে হেঁটে ১০ মেইল দূরে রাজঘাট ইউনিয়নে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। আমি প্রানভয়ে পায়ে হেঁটে রাজঘাট পৌছি। কিন্তু রাজঘাট গিয়ে আমার নিস্তার হয়নি। কারন আমাকে শ্রীমঙ্গল থেকে কোন রিলিজ সার্টিফিকেট দেয়া হয় নি। তাই আবার সিন্দুরখান ক্যাম্পে আটক করা সেখানে শ্রীমঙ্গলের সাথে যোগাযোগ করার পর আমাকে ছাড়ে।
 
সেখানে যাওয়ার পর দেখলাম কোথা হতে বাঙ্গালী লোক এনে বাসবাড়ী নামক স্থানে গুলি করে হত্যা করে এবং মানুষকে বেঁধে ডাণ্ডা দিয়ে পিটাতে থাকে।
 
এই সমস্ত অত্যাচারের মধ্যে যেটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তা হচ্ছে নিন্ম্রুপঃ
আমি রিলিজ হওয়ার ২ মাস পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সনের জুন মাসের শেষ দিকে রাজঘাট থেকে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিলাম। আমি ক্যাপ্টেন মুতালিব সাহেবের জীপে ছিলাম এবং তার ড্রাইভার আমার সাথে ছিল। আমরা কুনদড়া বাগানে যাওয়ার পথে দেখলাম কুনদড়া বাগানের পতিবরের উত্তরের পুলের উপরে কয়েকজন মিলিটারারী এবং এই মিলিটারীরা একজন শ্রমিককে একটি গাড়ির পেছনে বেঁধে প্রায় ৩০ মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে আমি ভীত হয়ে পড়ি এবন শ্রীমঙ্গল যাওয়ার চিন্তা ত্যাগ করি। লোকটিকে গাড়ির পিছনে বেঁধে টানায় তার শরীরের সমস্ত চামড়া উঠে যায়। এই অবস্থা দেখে আমরা আবার রাজঘাট ফিরে চলে আসি। অবশ্য শেষে শুনেছি লোকটা বেঁচেছে। লোকটাকে এভাবে অত্যাচার করার কারন পরে জেনেছি। পুর্ব রাত্রে মুক্তিবাহিনী কুলাউড়া পুল ভাঙ্গায় এ অত্যাচার তাকে করা হয়েছে। কারন সে কুলাউড়া বাগানের প্রধান নেতৃস্থানীয় শ্রমিক।
 
নানা স্থানে পাক সেনারা মেয়ে-ছেলেকে ধরে ধর্ষণ করেছে শুনেছি, তবে স্বচক্ষে দেখিনি। ঐ সময় পাক সেনারা শ্রীমঙ্গল শহরে নেতৃস্থানীয় লোকদের বাড়ী জ্বালাতে থাকে এবং বাড়ীস্থ সকল মালামাল লুট করতে থাকে। অবশ্য তাদের লুটের পর বাঙ্গালী লোভীরা তাদের উচ্ছিষ্ট কিছু কিছু জিনিস লুটে নেয়।.
 
পাক বাহিনীর অত্যাচারে লোক গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, শহর থেকে গ্রামে গ্রামে হেঁটে স্ত্রী-পুত্রসহ পলায়ন করে। কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই। পাক সেনারা গ্রামে ঢুকে সকল ব্যক্তিদেরকে ধরে মারধোর করত ও তাদের কাজ করাত। রাত্রে মুক্তিবাহিনী যাতে না আসে এজন্য কড়া পাহাড়া দেওয়াতো। যারা পাহারায় ছিল তারাই রক্ষা পেয়েছে, বাকী যারা পাক সেনাদের কবলে পড়েছে তারা ফিরতে পারেনি।
 
স্বাক্ষর/-
আব্দুস সোবহান
সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)
শ্রীমঙ্গল, সিলেট।
Ref: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!