দশ দিনের মধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র জমা দিতে হবে – বঙ্গবন্ধু | ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ | দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২
Unicoded by নাঈম হাসান আসিফ
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার এক বিবৃতিতে গণবাহিনীর প্রতি বাংলাদেশের জনগন ও সরকারের পক্ষ হতে গভীর কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং এই সঙ্গে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আগামি ১০ দিনের মধ্যে গোলাবারুদসহ অস্ত্রশস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী তার বিবৃতিতে নির্দেশ লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিদের পরিণাম সম্পর্কেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের জনসাধারণ ও আমার সরকারের পক্ষ হতে গণবাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি । সম্মিলিতভাবে এবং এককভাবে সকল সংগ্রামী শক্তির সদস্যরা যে দেশপ্রেম ও শৌর্য-বীর্যের যে পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্নত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অপর সকলের রক্ত ও ঘাম বৃথা যেতে দিব না। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের অধিকার, স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে। আমি আমার সরকার ও নিজের পক্ষ হতে গণবাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি একটি নয়া সমাজ গঠনে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংরক্ষণের কাজে তাদের সকল শক্তি ও প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সরকার আন্তরিকভাবে আশা করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিকেরা বাংলাদেশের নয়া সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর জন্য নেতৃত্ব অর্জনে সক্ষম হবেন।
গণ-পুলিশবাহিনীঃ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একটি নয়া পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পূর্বে পুলিশবাহিনী নির্যাতন ও নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে যেভাবে ব্যবহৃত হতো, এখন তার অবসান ঘটিয়ে একটি গনপুলিশবাহিনী গড়ে তোলা হবে। আমাদের গণবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে ও নেতৃত্বেই কেবল এই ধরণের একটি গণপুলিশবাহিনী যথাযথভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এতদুদ্দেশ্যে আমার সরকার গণবাহিনীর মধ্য হতে পুলিশ অফিসার ও পুলিশ কর্মচারী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বাধিক দ্রুততম গতিতে প্রিয় স্বদেশভূমির পুনর্গঠন এবং আমাদের জাতীয় লক্ষসমূহ অর্জনের জন্য সম্ভাব্য সকল সম্পদ (বৈষয়িক ও জনসম্পদ) সুবিন্যস্ত করার জন্য আমাদিগকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অগ্রগতির স্বার্থে পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আমাদের বিপুলসংখ্যক ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক কারিগর ও সকল প্রকার দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন হবে। সমাজের মৌলশক্তি- বুদ্ধিজীবী ও দক্ষ জনশক্তিকে, যারা আমাদের অগ্রগতির পথে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাদের একটি বিরাট অংশকে বর্বর শত্রুপক্ষ হত্যা করেছে। আমরা অনেক মূল্যবান জীবন হারিয়েছি। এখন আমাদের এই ক্ষতিকে শুধু পূরণ করাই নয়, উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষ লোক সৃষ্টি করতে হবে। অবিলম্বে যাতে আমরা আমাদের নয়া সমাজ গঠনের কাজ শুরু করতে পারি, তজ্জন্য সম্ভাব্য পরিকল্পিত সময়ের মধ্যে আমাদিগকে যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ অপসারণ করতে হবে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, গণবাহিনী এমন একটি সর্বোত্তম প্রতিভার ভাণ্ডার – যা দেশের পুনর্গঠন, অর্থনীতির মৌল কাঠামোর পুনঃনির্মাণ এবং সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্রগতি অর্জনে একটি নতুন ধরণের কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। সরকার আরও চান যে, গণবাহিনীর সদস্যরা বিশেষ করে যারা পড়াশুনা ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছেন, জাতীয় উন্নয়নে সকল ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জন করুক। উপরোক্ত লক্ষকে সামনে রেখে সরকার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে পড়াশুনা ও ট্রেনিং-এ যোগদান করতে ইচ্ছুক এমন মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধাদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যারা ইতিমধ্যে পড়াশুনা সমাপন করেছেন তাদের অবিলম্বে উপর্যুক্ত চাকরিতে নিয়োগ করা হবে। উপরুল্লেখিত নীতিসমূহের বাস্তবায়নের জন্য গণবাহিনী সদস্যদের জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তভুর্ক্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
জাতীয় মিলিশিয়াঃ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের বিস্তারিত কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। ঘোষিত কর্মসূচী মোতাবেক ইতোমধ্যেই সকল মহকুমা সদর দফতরে শিবির স্থাপন করা হয়েছে এবং এই সমস্ত শিবিরে প্রয়োজনীয় থাকার ব্যবস্থা, খাওয়া-দাওয়া, ট্রেনিং ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা হয়েছে এবং গণবাহিনীর যে সমস্ত সদস্যকে জাতীয় মিলিশিয়ার আওতায় আনা হচ্ছে, সরকার তাদের সমস্যাবলীর প্রতিকার করছে।
জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের লক্ষ্য হলাে গণবাহিনী সদস্যদের একটি সুশৃঙ্খল সংগঠনের অধীনে আনয়ন করা এবং অতঃপর তাদের ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুযায়ী জাতীয় পুনর্গঠন উন্নয়ন, দেশ রক্ষা ও আইন বিভাগে বিভিন্ন কলেজের জন্য মনােনীত করা। আমরা যে সমস্ত ছেলের জন্য গর্বিত তাদের সেবাকে যাতে কাজে লাগাতে পারি তজ্জন্য সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনে এই কর্মসূচিকে অবশ্যই বাস্তবায়িত করতে হবে। গণবাহিনীর সদস্যদেরও সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সমর্থন ছাড়া তা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় আমার নির্দেশ হলাে এই যে, গণবাহিনীর যে সমস্ত সদস্য এখনাে তাদের অস্ত্রসহ মহকুমা ক্যাম্পে রিপাের্ট করেন নাই এই নির্দেশ প্রকাশের তারিখ হতে দশদিনের মধ্যে তাদের অবশ্যই রিপোর্ট করতে হবে। এ সময়ের মধ্যেই গণবাহিনীর সদস্যদের গােলাবারুদসহ তাদের অস্ত্রশস্ত্র মহকুমা অফিসারের নিকট অবশ্যই জমা দিতে হবে। আমি সুনিশ্চিত যে আমার বীর মুক্তিযােদ্ধা ভাইয়েরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমার ডাকে সাড়া দিবেন এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট করবেন।এ সময়ের পরেও যারা অস্ত্র রেখে দিবেন,স্বাভাবিক ভাবে দেশবাসী তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখবেন।নির্ধারিত সময়ের পরে কেউ অস্ত্র রেখে দিলে তা অননুমোদিত ও বেআইনী বলে গণ্য হবে। শত্রুদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার : এই প্রসঙ্গে আমি আপনাদের স্মরণ করে দিতে চাই যে,ঘৃণিত ও কুখ্যাত আলবদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনীর বহু সদস্য নিজেদের গণবাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে জনগণের চোখকে ফাঁকি দেবার প্রয়াস পাচ্ছে এবং এভাবে দেশবাসীর জান ও সম্পত্তির পক্ষে এটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।অতএব, একথা ধরে নেয়া যায় যে,তারা যেমন যাবতীয় মিলিশিয়া ক্যাম্পে রিপোর্ট না করে আমার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করব না,অতএব অবধারিত সময়ের পরেও যারা অনুমোদনরত অস্ত্র জমা দেবে না আমার দেশবাসী ন্যায়সঙ্গত কারণে তাদের ঐ সমস্ত দস্যু সংগঠনের সদস্য বলে সন্দেহ করে এবং এভাবে তাদের জন্য একটি অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক পরিণতি সৃষ্টি হবে।চলুন,আমরা সকলে মিলে একটি নতুন সোনার বাংলা গড়ে তুলি।জয় বাংলা।
References:
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, p 40-42