You dont have javascript enabled! Please enable it!

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ঢাকা- ময়মনসিংহ – টাঙ্গাইল

জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়াব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরোধে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য বাহিনী

সাক্ষাতকারঃ মেজর জেনারেল (অব) কে এম সফিউল্লাহ 

(১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জয়দেবপুরে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসেবে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৫ সালে গৃহীত। উল্লেখ্য- মেজর জেনারেল (অবঃ) কেএম সফিউল্লাহর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বর্ণিত জয়দেবপুর সেনানিবাসের ঘটনাবলীর ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন অধিনায়ক লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আবদুর রকীব ১৩ মে ১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র ‘ভিন্নমত’ শীর্ষক কলামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তদুত্তরে পরবর্তী সময়ে ‘বিচিত্রা’র একই কলামে মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহর একটি প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়। এগুলি এখানে একই সঙ্গে সংযোজিত হলো)

১৪/১৫ই মার্চ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে আমাদের ব্যাটালিয়নের নিরস্ত্র করা হবে। এ গুজবের মধ্যে কিছু সত্যতাও ছিল। আমাদের কাছে কিছু প্রয়োজনের অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল। সেগুলো জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আমরাও সেই নির্দেশ মানার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। এই গুজবের পরিপ্রক্ষিতে ১৭ই মার্চ জনসাধারণ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৫০ জায়গায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এতে আমাদের খাদ্য সরবরাহে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় আমি প্রথম ব্যরিকেডে গিয়ে জনসাধারণকে বলি যে, আপনারা আমাদের উপর আস্থা রাখুন। আমি ১৭ বৎসর সামরিক বাহিনীতে চাকুরী করেছি অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য, ফিরিয়ে দেবার জন্য নয়। এই জন্য আমাদের উপর আপনাদের আস্থা রাখতেই হবে। আপনারা যদি না রাখেন তবে আমাদের উপর আস্থা রাখার মত লোক কেউ নেই। এই কথা শুনে তারা বলল যে আমরা আপনার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের সাথে দেখা করতে চাই। জনতার মধ্য থেকে চার- পাঁচজন গণ্য মান্য নেতা আমার সঙ্গে আসলেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার –এর সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এই আশ্বাস দিলেন যে আমাদের উপর আস্থা রাখুন এবং এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলুন। এতে আপনাদের সুবিধে হবে এবং আমরা কোনো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ব না। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলবো বলে আশ্বাস দিয়ে তারা চলে গেলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই গিয়ে প্রতিবন্ধকতা উঠাচ্ছিলাম। কিন্তু একদিকে যেই আমরা ব্যরিকেড সরাচ্ছিলাম অপরদিকে জনসাধারণ আবার ব্যরিকেড সৃষ্টি করছিলো। এর বিরুদ্ধে কোনো কড়া ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাক সেনাবাহিনীর চোখে আমরা সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছিলাম।

১৯শে মার্চ সকাল দশটার দিকে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের কাছে অয়ারলেসে এই মর্মে এক মেসেজ পাঠানো হয় যে “The commander with his escort is coming to have lunch with you. He would visit Gazipur Ordinance Factory.” (অনুবাদঃ কম্যান্ডার তাঁর প্রতিরক্ষাকারী বাহিনী সহ তোমার সাথে দুপুরে আহার করতে আসছে। তিনি গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করবেন) এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতেও এরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এবং সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়ন –এর লোকজন নিয়ে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির রেসিডেন্ট ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার করিমউল্লাহ্‌ (পশ্চিম পাকিস্থানী)- কে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করা হয় (তাঁকে ফ্যাক্টরীর লেবাররা ঘেরাও করে রেখেছিল)। এ ঘেরাও থেকে উদ্ধার করতে আমাদের কোনো বেগ পেতে হয়নি। ১২টার দিকে একটা মেসেজ আসে যে “I had cleared some barricade. Now I am at ‘Chowrasta’. I am using the civilians to open the barricade. You also clear the barricade from your side and meet me enroute. If there is any opposition use maximum force.”
(অনুবাদঃ আমি কিছু ব্যারিকেড পরিষ্কার করেছি। এখন আমি ‘চৌরাস্তায়’। আমি বেসামরিক লোকদের দ্বারা ব্যারিকেড পরিষ্কার করাচ্ছি। তুমিও তোমার দিক থেকে ব্যারিকেড পরিষ্কার কর এবং আমার সাথে পথে এই পথেই দেখা কর। কোন প্রকার বাঁধা পেলে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করবে) এ খবর পাবার পর আমরা আমাদের লোকজনকে নিয়ে জয়দেবপুর থেকে প্রতিবন্ধকতা সরাতে সরাতে অগ্রসর হই এবং ব্রিগেড কমান্ডার –এর সাথে রাস্তায় মিলিত হই।

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, আমরা প্রতিবন্ধকতা নিজেরাই পরিষ্কার করি। কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব এবং তার সঙ্গীরা জনগণকে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা পরিষ্কার করে। প্রতিবন্ধকতা সরাবার সময় বেশ কিছুসংখ্যক লোককে মারধর করা হয়। বেলা প্রায় দেড়টায় ব্রিগেড কমান্ডার তার লোকজনকে নিয়ে জয়দেবপুর পৌছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে যে সমস্ত লোক ছিল তাদের মধ্যে একজন লেঃ কর্নেল (আর্টিলারী), একজন ক্যাপ্টেন (আর্টিলারী), একজন মেজর (আর্মার), একজন ক্যাপ্টেন (ইনফ্যান্ট্রি), একজন ক্যাপ্টেন (কমান্ডো) এবং ৭০ জন জোয়ান চাইনিজ এলএমজিতে সজ্জিত ছিল। তিনি জয়দেবপুরে প্রবেশ করে গর্বিতভাবে বললেন, Nobody can stop us. We can move to any direction wherever we want to move.(অনুবাদঃ কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। আমরা যখন ইচ্ছা এবং যেদিকে ইচ্ছা যাওয়ার সক্ষমতা রাখি) তার উক্তি এবং ভাবভঙ্গিতে আমার মনে হলো যেন আলেকজান্ডার ভারত জয় করল। জয়দেবপুরে এসে শুধুমাত্র অফিসাররা জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে ঢুকল। কিন্তু ৭০ জন জোয়ান প্রাসাদের বাইরে রয়ে গেলো।

ব্রিগেড কমান্ডার যখন ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে আসছিলেন, তখন যাতে আমাদের উপর কোনো অঘটন না ঘটে, সেজন্য আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলাম। কেননা, আমাদের নিরস্ত্র করা হবে বলে একটা আশংকা আমাদের মনের মধ্যেও ছিল। ব্রিগেড কমান্ডার প্রাসাদে ঢুকে সমস্ত জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলেন এবং মন্তব্য করছিলেন যে এ রকমের প্রস্তুতি কেন? তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম যে, এখানকার পরিস্থিতি এমন যে, যেকোন মুহুর্তে উত্তেজিত জনতা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। এবং সীমান্তের পরিস্থিতি যা, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদেরকে সীমান্ত অভিমুখে রওনা দিতে হতে পারে। উত্তর যদিও মনপূত ছিলো তবুও আমরা একে অপরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছিলাম।

ব্রিগেড কমান্ডার প্রাসাদে ঢোকার সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসেছে। ফলে উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ জনতা আবার অল্প সময়ের মধ্যে জয়দেবপুর রেলক্রসিং- এ এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একটা ভর্তি মালবাহী গাড়ী, যেটা তখন ময়মনসিংহ থেকে জয়দেবপুর এসেছিল, তা দিয়ে রেলওয়ে ক্রসিং –এর উপরে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একথা শোনার সাথে ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল মাসুদকে নির্দেশ দেন যে ২০ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হোক। যদি কোনো বাধার সৃষ্টি হয়, তবে যেন ম্যাক্সিমাম শক্তি প্রয়োগ করা হয়। কর্নেল মাসুদুল হাসান এই নির্দেশ পাবার সাথে সাথে মেজর মইনুল হোসেনকে (বর্তমান লেঃ কর্নেল) নির্দেশ দিলেন যে তার কোম্পানি নিয়ে যেন এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হয়। কোনো সময় নষ্ট না করে মেজর মইন এই প্রতিবন্ধকতার সামনে পৌছান।

তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাছে আবেদন করেন যে, আপনাদের ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের সাথে এখনো অস্ত্র আছে। আমাদের কাছ থেকে এখনও অস্ত্র নেয়া হয় নাই। জনতা যখন শুনছিল না তখন তিনি ভীড় ঠেলে জনতার মধ্যে যারা নেতা তাঁদের সাথে আলাপ করেন। নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন আওয়ামী কর্মী জনাব হাবিবুল্লাহ এবং আর একজন ছিলেন শ্রমিক নেতা আবদুল মোতালেব। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং জয়দেবপুরে হাটবার। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের সমাবেশ ছিল সেখানে। কিছু জনতা প্রতিবন্ধকতার এ পাশে ছিল আর কিছু জনতা প্রতিবন্ধকতার অপর পাশে ছিল। নেতারা ছিলেন বাজারের দিকে। মেজর মইন ইতিমধ্যে নেতাদের বুঝাতে সক্ষম হন যে আমাদের এখনো নিরস্ত্র করা হয়নি। তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করেন। নেতারা জনসাধারণকে বুঝাবার চেষ্টা করছিলেন তারা যেন আর কোনো গণ্ডগোল না করে। জনতার মাঝে তখনও হৈ চৈ এবং গণ্ডগোল চলছিল। ইতিমধ্যে লেঃ কর্ণেল মাসুদ, ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব ও তার ট্রুপস সেখানে গিয়ে পৌঁছান।

ব্যারিকেড-এর বাজারের পাশের দিকে অধিকাংশ জনতার সমাবেশ ছিল এবং অপর পাশের দিকও বেশ জনসমাবেশ ছিল। কিন্তু এ পাশের লোক বেশ উত্তেজিত ছিল। কারণ তারা জানত না যে মেজর মইনের সাথে ব্যরিকেড- এর অপর পাশের জনতার কি কথাবার্তা হয়েছিল। জয়দেবপুর পর্যন্ত যে রাস্তা স্টেশনের দিকে চলে যায় সে রাস্তার শেষ প্রান্তে বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর ট্রুপস মোতায়েন ছিল। তার পিছনে হুকুম দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ব্রিগেড কমান্ডার জাহাজেব আরবাব তার বাহিনী নিয়ে এসে যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাকী সৈন্য প্যালেসে থেকে যায়। ব্রিগেড কমান্ডার আসার সাথে সাথে মেজর মইনকে আদেশ দেয় সে যেন তার সেনাবাহিনী পেছনে সরিয়ে নিয়ে এসে রেলস্টেশনে যাবার পথের উপর জনতাকে সামনে রেখে মোতায়েন করে। মেজর মইন তখন ব্রিগেড কমান্ডারকে বললেন যে নেতারা আপনার সাথে দেখা চান এবং এই উদেশ্যে তারা এদিকে আসছেন। ব্রিগেড কমান্ডার উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ I do not want to see them. Tell them to get away and deploy troops.” (অনুবাদঃ আমি ওদের সাথে দেখা করতে চাই না। তাঁদের চলে যেতে বলো এবং সৈন্যদল নামাও)

মেজর মইন নির্দেশ মোতাবেক সৈন্যদের মোতায়েন করার আদেশ দিচ্ছিলেন। এ আদেশ শুনে এবং সৈন্যদের গতিবিধি ও ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবাব -এর ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে নেতারা পেছনে সরে যান। নেতাদের পেছনে সরে যেতে দেখে এপাশের জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তখন ব্রিগেড কমান্ডার মেজন মইনকে নির্দেশ দেন জনতার উপর গুলি ছোড়ার জন্য। একদিকে তিনি নিজে মেজর মইনকে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন কিন্তু অপর দিকে তিনি মেজর মইনকে কর্নেল মাসুদের নির্দেশ নিতে বলছিলেন। কর্নেল মাসুদ ঐখানে ছিলেন।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, টাঙ্গাইলে আমাদের যে কন্টিনজেন্ট ছিল তাদের খাদ্য নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক (বেডফোর্ড) টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুর আসছিল। ঐ গাড়ী বাজারের নিকট এসে এক বিরাট জনতার ভিড় দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল যে আজ হাটবার তাই এত লোক। তারা এখানকার ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। হঠাৎ জনতার মধ্যে থেকে কিছু লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং বলে যে সামনে পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের গুলি ছোঁড়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তোমাদেরকে আমাদের সাথে যোগ দিয়ে পাঞ্জাবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ট্রাকের মধ্যে ড্রাইভারসহ ৭ জন বাঙালি সৈন্য ছিল। তারা হতবুদ্ধি হয়ে কি করতে হবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। জনতা পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে তাদেরকে বন্ধ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়। অস্ত্রের মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল এবং চাইনীজ এসএমজি ছিল। ড্রাইভার এবং কো-ড্রাইভার কোন রকমে পালিয়ে এসে বলে যে আমাদের পাঁচজন সৈন্যকে জনতা বোধ হয় মেরে ফেলেছে এবং আমরা মারধর খেয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। তখন ব্রিগেড কমান্ডার হুকুম দেয়, “Fire and clear the barricade” (অনুবাদঃ গুলি কর এবং ব্যারিকেড পরিষ্কার কর) মেজর মইন এই হুকুম পাবার পর প্রথম বিউগল বাজালেন এবং পতাকা উঠিয়ে গুলি ছোড়া হবে বলে মাইকে ঘোষণা করলেন। এ ঘোষণায় জনতার মাঝে কোন ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়নি। তারপর তিনি জনতার মাঝে একজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেন। এ আদেশ শোনার পর জনতার মাঝে একটু ভয় ও ভীতির সঞ্চার হয়। মেজর মইন যাকে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে বাংলায় বললেন যে নিচের দিকে গুলি ছুঁড়ে দাও। যেহেতু গুলিটা গিয়ে একটা গাছের মধ্যে লেগেছে সেহেতু ব্রিগেড কমান্ডার এটা দেখে খুব রাগান্বিত হলেন এবং নির্দেশ দিলেন, “Fire for effect” (অনুবাদঃ কার্যকরী ফলাফলের জন্য গুলি চালাও) এবারও জনতার মধ্যে একটু নড়চড় হচ্ছিল। এবারও তিনি বাংলায় বললেন উপর দিকে মেরে দাও। এবার যে গুলি করছিল, সে রাইফেলটাকে এমনভাবে উঠিয়ে ধরছিলো যে মনে হচ্ছিল সে আকাশের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তা দেখে ব্রিগেড কমান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “I want one dead body per bullet. If you cannot handle the situation I will employ my troops.” (অনুবাদঃ আমি প্রত্যেক গুলির বিনিময়ে একটি করে লাশ চাই। যদি তুমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, তবে আমি আমার সৈন্যদল নামাবো) এই সময় জনতার মধ্য থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছিলো। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে দেখে মেজর মইন এবার ঠিকভাবে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। গুলি একজনের গায়ে লাগে এবং সে মাটিতে পড়ে যায়। এর ফলে জনতা ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। এ সময় জনতার মধ্য থেকেও ভীষণভাবে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। জনতার গুলিতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর কিছু সংখ্যক সৈন্যও আহত হয়। এসময় জয়দেরপুর বাজারে অবস্থিত মসজিদের উপর থেকে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবাবকে লক্ষ্য করে এস- এম- সি ফায়ার শুরু হয়। আমাদের সৌভাগ্যশতঃ ব্রিগেডিয়ারের গায়ে তা লাগেনি। এখন জনতা এবং সৈন্যদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর বাকী সৈন্যসহ আমি তখন প্যালেসে ছিলাম এবং গুলির আওয়াজ শুনে কিছুসংখ্যক সৈনিককে জাহানজেব আরবাব –এর ট্রুপস -এর পিছনে মোতায়েন করি। এর দুটো উদ্দেশ্য ছিল- জনতার হাত থেকে সৈনিকদের বাঁচানো এবং যদি ব্রিগেড কমান্ডারের অশুভ উদ্দেশ্য থাকে তা প্রতিহত করা।

এ খণ্ডযুদ্ধ প্রায় পনের বিশ মিনিটের মত চলে এবং এরপর সম্পূর্ণ এলাকা জনতামুক্ত। জনতা চলে যাবার পর আমরা ব্যারিকেড খুলে ফেলি। এরপর ব্রিগেড কমান্ডার ঢাকার দিকে চলে গেলেন এবং যাবার আগে নির্দেশ দিয়ে গেলেন জয়দেবপুর ও গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকার মধ্যে সান্ধ্য আইন জারী করার জন্য এবং আরো বলে গেলেন অয়ারলেসে তাকে জানাবার জন্য কি রকম অ্যামুনিশন খরচ হয়েছে এবং কতজন হতাহত হয়েছে। আমরা তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, দুইজন লোক নিহত হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক আহত হয়েছে। ব্রিগেড কমান্ডার যাবার সময় চৌরাস্তায় কিছু লোক দেখতে পায়। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য দূর থেকে গুলি ছোড়ে এবং এতে দুজন লোক মারা যায়। আহতদের সংখ্যা জানা যায়নি।

আমরা নির্দেশ অনুযায়ী সান্ধ্য আইন জারী করি। সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে পাঁচজন নিখোঁজ লোককে আমরা মসজিদের পাশের এক কক্ষ থেকে উদ্ধার করি। স্থানীয় নেতাদের সাহায্যে এবং আমাদের লোকদের সাহায্যে তল্লাশী চালিয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ৪টি রাইফেল উদ্ধার করতে সক্ষম হই। তিন-চারদিন পর গফরগাঁও থেকে এসএমজিটি উদ্ধার করি। অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে বের করা পর্যন্ত ঐ বেলায় সান্ধ্য আইন বলবৎ ছিল। যদি ব্রিগেড কমান্ডার সেখানে না থাকত তাহলে আমরা ব্যারিকেড খুলে ফেলতে পারতাম। কোনো হতাহত হতো না। যেভাবে এ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা হয়েছে তাতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর সৈন্যরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ঐদিনই রাতে ৫ জন বাঙালি সৈন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ৪টি চাইনিজ রাইফেল এবং একটি এস-এম জি অ্যামুনিশনসহ ছিল। সন্ধ্যার সময় অয়ারলেসে আমরা ব্রিগেড কমান্ডারকে জানালাম যে, আমাদের ৬৩ রাউণ্ড গুলি খরচ হয়েছে এবং আমাদের কিছু সংখ্যক সৈন্য আহত হয়েছে। দুজন বেসামরিক লোক নিহত এবং বেশকিছু সংখ্যক আহত হয়েছে। যদিও তিনি বললেন যে ভাল করেছ, কিন্তু মনে মনে তিনি খুশী হতে পারেন নি। কেননা তিনি বলেছিলেন, why 63 round spent and only to dead? (অনুবাদঃ কেন ৬৩ রাউন্ড গুলি খরচ হলো কিন্তু নিহত মাত্র ২ জন?)

ব্যাটালিয়ন কমান্ডার–এর কর্তব্য এবং দায়িত্ব তার ব্যাটালিয়নের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি সুস্থ মস্তিষ্কে কিছুই করতে পারেননি। ব্রিগেড কমান্ডার–এর কাছ থেকে তাঁর উপর কারণ দর্শাও নোটিশ এলো; কিভাবে ট্রাকের পাঁচজন সৈন্য থেকে অস্ত্র নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো? এবং পাঁচজন কেন অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেল? ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এক্সপ্লানেশন –এর জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জবাবে ব্রিগেড কমান্ডার সন্তুষ্ট হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে নিজে গিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। যাবার পূর্বে আমার সাথে পরামর্শ করেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে যতক্ষন পর্যন্ত না আপনাকে ডাকছে ততক্ষণ আপনি ঢাকাতে যাবেন না। যেহেতু তিনি মানসিক অস্থিরতাতে ছিলেন সেহেতু তিনি সেই অস্থিরতা দূর করার জন্য ২৩শে মার্চ ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আসলেন। সেখানে যাবার সাথে তাঁকে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবাব বললেন, তোমাকে ব্যাটালিয়নে ফিরে যেতে হবে না। তুম স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এটাচড্‌; ব্যাটালিয়নের ঘটনাবলী নিয়ে তদন্ত হবে। তারপর থেকে ঢাকাতে থেকে যেতে বলা হয়। সেহেতু তিনি আর ব্যাটালিয়নে ফিরতে পারেন নি। আমাকে নিদেশ দেওয়া হয় যে কর্নেল মাসুদ স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এটাচড্‌; এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে আমি যেন ব্যাটালিয়ন–এর কার্যভার গ্রহণ করি।

২৫শে মার্চ বেলা ১১টার সময় আমাকে ব্রিগেড থেকে জানানো হয় যে, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, সেন্টার কমান্ড্যান্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, চট্টগ্রাম ব্যাটালিয়নে আসছেন এবং সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। আরো জানানো হয় নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী রকিব উদ্দিন নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে আসছেন এবং তিনিও আজ পৌঁছে যাবেন। কর্নেল মাসুদ আমাকে ১১টার দিকে টেলিফোনে বলেন যে, লেঃ কর্নেল রকিব নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসাবে আসছেন। তিনিও ভালো লোক। আমার যা হয়েছে তার জন্য কোন আফসোস নাই। খোদা যা করেন, ভালোর জন্য করেন।

বেলা প্রায় ১টায় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ব্যাটালিয়নে পৌঁছান এবং আমার সাথে এক ঘণ্টা পর্যন্ত আলাপ করেন। তাঁর কাছে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি তার পুরোপুরি জবাব দিতে পারেননি। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু ঘোলাটে পরিস্থিতিতে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে লেঃ কর্নেল কাজী রকিব ব্যাটালিয়নে পৌঁছে যান। বেলা প্রায় তিনটায় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। ভাষণের মর্ম এই ছিল যে, আমরা সৈনিক, আমরা সরকারের নির্দেশ মোতাবেক চলি। এবং সরকার যা হুকুম দেন তা আমরা পালন করতে বাধ্য হই। ব্যাটেলিয়নে ঘন্টাখানেক এ পরিপ্রক্ষিতে ভাষণ দেন। তারপর লেঃ কর্নেলরকিবকে ব্যাটালিয়নের ভার বুঝিয়ে দেন। এবং সৈনিকদের বলেন, আজ থেকে লেঃ কর্নেল রকিব তোমাদের নতুন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার। বেলা প্রায় পাঁচটার দকে তিনি ঢাকা রওনা হয়ে যান। কিন্তু যাবার আগে আমি তাঁকে বলেছিলাম, স্যার আপনি আমাদের ব্যাটালিয়নে নতুন এসেছেন। তাই আজ রাতটা এখানে থেকে যান। কিন্তু তিনি বলেন যে ঢাকাতেতিনি তার শ্বশুরবাড়িতে থাকবেন। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে যদি তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে থাকতেন, তাহলে হয়তো তিনি আজ আমাদের সাথেই থাকতেন।

ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চলে যাবার পর আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার রকিবকে দেশের তদানীন্তন গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মনোভাব জ্ঞাত করাই।২৫শে মার্চ পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন কিভাবে মোতায়েন ছিল তাও তাঁকে বলি। ডেপ্লয়মেন্টটা এই- এক কোম্পানী ময়মনসিংহ, এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে –এই দুই কোম্পানীর ভার ছিল আমার উপর। এক প্লাটুন ছিল রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপোতে। সেখানে আরো তিনটি পাঞ্জাবী প্লাটুন ছিল –এক প্লাটুন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, এক প্লাটুন বেলুচ রেজিমেন্ট এবং এক প্লাটুন ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। ব্যাটালিয়নের বাকি লোক সব জয়দেবপুর প্যালেসে ছিল।

২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টার দিকে কর্নেল রাকিবের ছেলে ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানায় যে তাদের বাসায় কয়েকটা বেনামী টেলিফোন কল এসেছে এবং ধমক দিয়ে বলা হয়েছে যে তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ঐদিন ব্রিগেড কন্ট্রোল রুমে আমাদের ব্যাটালিয়নের একজন পাঞ্জাবী অফিসার কর্তব্যরত ছিল। কর্নেল রকিব তাকে নির্দেশ দেন সে যেন ইপিআর হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন করে সেখান থেকে কিছু আর্মড গার্ড তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি ইপিআর থেকে মনে হয় এই ভরসায় সাহায্য চেয়েছিলেন যে তিনি মাত্র কিছুদিন আগে ইপিআর থেকে এসেছেন। আর্মড গার্ড তার বাসায় পাঠানো হয়েছিল কি না, তা পরে আর জানতে পারিনি।

২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১২টায় জেনারেল টিক্কা খান ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল রকিবের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং বলেন যে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে গোলযোগ চলছে। একজন দায়িত্বশীল অফিসারের নেতৃত্বে যেন সেখানে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হয়। গাজীপুর জয়দেবপুর থেকে নিকটবর্তী। সেখানে কোন গোলযোগ হলে নিশ্চয় আমরা খবর পেতাম। কিন্তু যেহেতু টিক্কা খান নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন সেহেতু ঐ রাতেই প্রায় তিনটায় এক কোম্পানী সৈন্য একজন অফিসারের নেতৃত্বে সেখানে পাঠানো হয়। সৈন্য পাঠাবার পর সেখানে দেখা গেল কোনো গণ্ডগোল ছিল না। আমার মনে হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাটালিয়নের সমস্ত সৈনিককে দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখা যাতে আমরা একত্রিত হয়ে পাকিস্থানী কর্তৃপক্ষের ২৫শে মার্চের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন বাধা সৃষ্টি না করতে পারি।

২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১টায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের অবস্থা কি? ঢাকাতে তো বেশ গুলিগোলার আওয়াজ শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পরপরই ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কি হচ্ছিল তার কোন খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না। ২৬শে মার্চ সকাল বেলায় ব্যাটিলিয়ন কমান্ডার রকিবকে বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং চারিদিকে যেসমস্ত গুজব রটছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ মুহুর্তে এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তা –ভাবনা করা উচিৎ। যেহেতু ঢাকার সাথে অন্য সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সেহেতু আমি অয়ারলেস সেটে গিয়ে ঢাকায় কি হচ্ছে তা শোনার চেষ্টা ক। ২৫শে মার্চ রাতে টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি ইউনিটে অয়ালেস সেটে যেভাবে কাজ চলছিল তার একটি বিস্তৃত বর্ণনা নিচে দেওয়া গেলঃ

ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে- ৫৭ ব্রিগেডে ছিল কন্ট্রোল স্টেশন আর সাব- স্টেশন ছিল নিম্নলিখিত ইউনিটগুলোঃ

১। ১৮ পাঞ্জাব,
২। ৩২ পাঞ্জাব,
৩। ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট,
৪। ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট,
৫। ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট,
৬। ৪৩ লাইট এন্টিএয়ারক্র্যফট রেজিমেন্ট,
৭। ট্যাংকস স্কোয়াড্রন –এগুলো সব ঢাকায় ছিল,
৮। ২ ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুর,
৯। ২ ইস্ট বেঙ্গল, টাঙ্গাইল (এ সেটগুলো ঢাকা থেকে এসেছিল)।
এর অপারেটর সব পাঞ্জাবী ছিল। অয়ারলেস সেট এবং অয়ারলেস নেট কিভাবে কাজ করে সে সম্বন্ধে যারা পুরোপুরি অবগত নন তাদের অবগতির জন্য বলছি যে, অয়ারলেস নেট- এ একই ফ্রিকোয়েন্সিতে যখন এক স্টেশনে কথা বলা হয়, তখন অন্য স্টেশনের লোকজন একই সময়ে ঐ সমস্ত কথাবার্তা শুনতে পায়।

২৬শে মার্চ সকাল ৭/৮ ঘটিকার সময় আমি এবং কর্নেল রকিব অয়ারলেস সেটে যাই। সেটটা জয়দেবপুর রাজবাড়ির অফিসার্স মেস –এর পূর্বদিকে বসানো ছিল। আমরা যখন সেটে যাই তখন সেটে কথা হচ্ছিল। আমরা সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে অপারেটর ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করাতে অন্যান্য স্টেশনের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি অপারেটরকে (পাঞ্জাবী ছিল) জিজ্ঞেস করি যে তুমি ফ্রিকোয়েন্সি কেন চেঞ্জ করছ? আর বাকী স্টেশন কোথায়? সে উত্তর দিল যে ঢাকা থেকে নির্দেশ দিয়েছে গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এবং এই নেটে অনেক স্টেশন হয়ে যাবার জন্য জয়দেবপুর –ঢাকা –টাঙ্গাইল এক নেটে থাকবে বলে নির্দেশ পাওয়া গেছে। আমি তাকে বললাম কিছুক্ষণ আগে অয়ারলেস সেট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল সে ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিরে যাও। সে উত্তর দিল যে, স্যার আমার সেট আর কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল না। আমি তখন তাকে বললাম যে অন্যান্য ইউনিট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে সে ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে সে ফ্রিকোয়েন্সিতে মিলাও বা সেট কর। এ উত্তর দিল “আমার সে ফ্রিকোয়েন্সি জানা নেই।“ আমি তাকে আর কিছু না বলে কর্নেল রকিবের সাথে অফিসে ফিরে আসি। আসার সময় রাস্তায় কর্নেল রকিবকে বলি, “There must have something serious happened in Dacca. That is why Dacca station does not want us to hear the conversation” (অনুবাদঃ ঢাকায় অবশ্যই গুরুতর কিছু হয়েছে। একারণেই ঢাকা স্টেশন চায় না যে আমরা আলোচনা শুনি) তারপর আম একজন বাঙালি অপারেটরকে গোপনে নির্দেশ দিই ঐ সেট এর উপর লক্ষ্য রাখার জন্য যে কি কথাবার্তা হয়। আমি অফিস যাবার সাথে সাথে আমাদেরব্যাটালিয়নের নিজস্ব অপারেটর আমাকে বলে যে ময়মনসিংহের কোম্পানী কমান্ডার মেজর নুরুল ইসলাম আপনার সাথে জরুরী কথা বলতে চান। টেলিফোন যোগাযোগ ছিল না বলে তিনি অয়ারলেসে কথা বলতে চান। ময়মনসিংহে আমাদের নিজস্ব অয়ারলেস সেট ছিল। আমি সেটে যাবার পর মেজর নুরুল ইসলাম বলে যে, সে কয়েক হাজার লোক দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। তারা বলছে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের সাথে যোগ দিক।

এখানে বলে রাখা দরকার ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টারে মেজর নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল। ইপিআর উইং কমান্ডার একজন পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসার ছিল। ইপিআর উইংয়ে তাদের যে রিজার্ভ কোম্পানী ছিল তার প্রায় অধিকাংশই বাঙালি ছিল। উইং কমান্ডার ঢাকার নির্দেশমত সমস্ত পশ্চিম পাকিস্থানী সৈনিকদের (ইপিআর) বর্ডার থেকে উইথড্র করে উইং হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। তাদের সংখ্যা উইং হেডকোয়ার্টারে ছিল প্রায় ৫০/৬০ জন। জনতা যখন উইং হেডকোয়ার্টারে ঘিরে ফেলল তখন হেডকোয়ার্টার –এর আউটার পেরিমিটারে বাঙালি সৈনিকরা পাহারারত অবস্থায় ছিল। মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মাইক্রোফোনে উচ্চস্বরে জনসাধারণকে এ এলাকা থেকে চলে যাবার নির্দেশ দিচ্ছিলেন এবং এও আশ্বাস দেন যে, সময় আসলে আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। সারাদিন তারা এ অবস্থায় ঘেরাও ছিল। মেজর নুরুল ইসলামের আশ্বাস পেয়ে জনতা আস্তে আস্তে সরে যায়। আমাকে যখন সে এ সমস্ত ঘটনা জানায় তখন আমি তাকে ধীরে সুস্থে কাজ কর। সময় আসলে সব কিছু বলব। সে আমাকে সেখানে আরো কিছু সৈনিক পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিল। আমি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে আমি পাঠানোর চেষ্টা করব।

আমি অয়ারলেস থেকে অফিসে ফিরে আসার সাথে সাথে আমি যে একজন অপারেটরকে ঐ অয়ারলেস সেটে লক্ষ্য রাখার জন্য সে এসে আমাকে খবর দিল যে, স্যার,আপনারা চলে আসার কিছুক্ষণ পর সে আবার ফ্রিকোয়েন্সি চেঞ্জ করে অন্যান্য স্টেশনের কথা শুনছিল। আমি দূর থেকে শুধু এতটুকুই শুনতে পেরেছি কে যেন কতগুলো লোক মেরেছে। পাঞ্জাবী অপারেটর তার সম্বন্ধে নির্দেশ চাইলে ঢাকার অপারেটর ভীষণভাবে রাগান্বিত হয়, এবং বলে সে যেন আর কখনো এই ফ্রিকোয়েন্সিতে না আসে। তাকে গতকাল যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন সেভাবে চলে।

এ খবর পেয়ে আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল রকিবের অফিসে যাই এবং তাকে এ সমস্ত ব্যাপার (ময়মনসিংহের ব্যাপার এবং অয়ারলেস –এর ব্যাপার) সব খুলে বলি। এবং তাকে আমি বলি যে, স্যার, আমাদের এখন কিছু একটা করা দরকার। তা না হলে পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। যদি চলে যায় আপনিও কিছু করতে পারবেন না, আমিও কিছু করতে পারবো না। তিনি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করা দরকার? আমি পরামর্শ দিলাম যে ময়মনসিংহের পরিস্থিতি খারাপ। ঢাকার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহের সাহায্যের জন্য আমাদের সমস্ত সৈনিকদের নিয়ে সেখানে চলে যাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের সৈনিকদের ময়মনসিংহ গিয়ে কনসেনট্রেট করা। আর পরিস্থিতি লক্ষ্য করে যদি কিছু করতে, তাহলে আমরা যেন একসাথে হয়ে করতে পারি। তিনি তখন বললেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ ছাড়া কি ভাবে এ পদক্ষেপ নিই। আমি তখন বললাম যে, আপনি ঢাকা থেকে নির্দেশ নেন যে ময়মনসিংহের অবস্থা খুবই খারাপ, আমাদের সেখানে ইনফোর্সমেন্ট পাঠানো দরকার। তিনি আমার কথামত ঢাকাতে অয়ারলেস সেটে কথা বললেন। কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না। আমি তাকে বললাম যে এখন আমরা যদি কিছু না করি তাহলে আমাদের সৈনিকদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা হয়ত আমরা পালন করতে পারব না। এতে তিনি একটু ঘাবড়িয়ে পড়লেন। ২৬শে মার্চ প্রায় দশটার দিকে জেনারেল টিক্কা খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে সামরিক আইন জারী করেন এবং ঐ আইনের নির্দেশাবলী রেডিওতে প্রচার করতে থাকেন। সামরিক আইন জারীর কথা শুনে সৈনিকদের মধ্যে এক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঢাকায় যে বেশ কিছু একটা ঘটেছে তার একটা আভাস পাওয়া যায়।

২৬শে মার্চ সকাল ১০/১১ টার দিকে দেখলাম একটা আর্মি হেলিকপ্টার রাজেন্দ্রপুরের দিকে একবার যাচ্ছে এবং আবার আসছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম তারা রাজেন্দ্রপুর থেক এমুনিশন নিচ্ছে। তাতে বুঝা যাচ্ছে ঢাকাতে যে এমুনিশন ছিল তা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে তারা খরচ করল। এ খবর পাবার পর ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে আবার বললাম যে, স্যার, “There must have something serious happened in Dacca and that is why they are running short of ammunition and ammunition is being lifted by helicopter.”(অনুবাদঃ ঢাকায় নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু হয়েছে এবং একারণেই তাঁরা গুলিস্বল্পতায় ভুগছে ও হেলিকপ্টার দ্বারা গুলি পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।)
২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকাতে কি ঘটেছিল তার কোনো খবর পাইনি। বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে খবর দিল যে ঢাকাতে বেশ গোলাগুলি হয়েছে এবং বেশকিছু লোক মারা গিয়েছে। সে আরো বলল যে, বাঙালি সৈনিকদের বেঁধে নিয়ে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সে ব্যাটালিয়নে পৌঁছার সাথে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে বলি যে, ঢাকা থেকে আপনি কোনো নির্দেশ পাচ্ছেন না। ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতিও খারাপ। আমরা যদি কোথাও কনসেনট্রেট না হই তাহলে পরিস্থিতি হয়ত তাহলে পরিস্থিতি হয়ত আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। আমি তাকে আবার বললাম যে, আমরা আমাদের সৈনিকদের নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ চলে যাই। তিনি উত্তরে বললেন যে আমার ছেলে পিলে আছে। বেলা প্রায় দু’টোর দিকে ঢাকা থেকে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ব্যাটালিয়ন কমান্ডার –এর সাথে অয়ারলেসে কথা বললেন এবং বললেন, “our troops are facing some difficulties at Tongi, Send a company to do some shooting.” (অনুবাদঃ টঙ্গীতে আমাদের সৈন্যদল কিছু সমস্যার সম্মুক্ষীণ হচ্ছে। কিছু গোলাগুলি করার জন্য একটি কোম্পানি পাঠাও) আমাকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, কি করা যায়? জয়দেবপুরে তখন শুধু একটা রাইফেল কোম্পানী ছিল, যার কমান্ডার মইনুল হোসেন চৌধুরী। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার রকীব বললেন এই কোম্পানীকে পাঠাবার জন্য। আমি তখন বললাম যে এখন এই কোম্পানীকে না পাঠিয়ে টংগীর খবর নিন। একজন পাঞ্জাবী অফিসার পাঠাতে বললাম। গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে আমাদের যে কোম্পানী ছিল তার কমান্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। আমি তাকে পাঠাতে বললাম। ড্রাইভার এবং বাকী লোক ছিল বাঙালী। ঐদিনই আমরা টঙ্গীতে বেশ কিছু বড় বড় গোলার আওয়াজ শুনি। অফিসারকে আর অন্যান্যদেরকে পৃথক পৃথক ব্রিফ করে টঙ্গী থেকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। বিকেলে টঙ্গী থেকে ফিরে আসার পর ঐ অফিসার কমান্ডিং অফিসারকে খবর দেয় যে সেখানে তেমন কিছু হয়নি। কিছু সংখ্যক জনতা টঙ্গী পুলের কাছে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে কিছু গোলাগুলি হয়েছে। সে এও বলল যে, “Since there was a barricade near Tongi bridge the troops from Dacca did some sporadic Firing. Incidentally I was also challenged by the Dacca troops.” (অনুবাদঃ যেহেতু টঙ্গী ব্রিজের কাছে একটি ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে, সেহেতু ঢাকা থেকে আগত সৈন্যদল কিছু বিচ্ছিন্ন গোলাগুলি করেছে। আমাকেও ঢাকার সৈন্যদল কর্তৃক প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছে) ড্রাইভার বলল যে আমরা টঙ্গীতে যাবার সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্থানী সৈন্যরা আমাদের সবাইকে (আমাদের অফিসারসহ) দুই হাত উপরে উঁচু করে বেয়নেটের ডগায় অফিসারের কাছে নিয়ে যায়। আমাদের সৈনিকদের সবাই ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। অফিসারকে যখন তারা উঁচু করায় (হ্যাণ্ডস-আপ) তখন অফিসার পাঞ্জাবী ভাষায় তাদের তিরস্কার করছিল। তার কথা শুনে পাঞ্জাবী সিপাইগুলো বলছিল, “দেখ, শালা পাঞ্জাবী ভি সিখ লিয়া।“ এখন মনে হয় তাকে বাঙালি অফিসার মনে করে হাত উঁচু করিয়েছিল। এইভাবে হাত উঁচু অবস্থায় তাদের অফিসারদের সামনে যাবার সাথে সাথে তারা (তাদের অফিসাররা) দুঃখ প্রকাশ করে। আমাদের অফিসার তাদের সাথে ঘন্টাখানেক আলাপ-আলোচনার পর ফিরে আসে।

আমি এই ঘটনা ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে বলি এবং এও বলি যে, “Sir, it is about time that we have take some actions, otherwise it will be too late,” (স্যার, এটাই একশন নেয়ার উপযুক্ত সময়। নতুবা খুব দেরি হয়ে যাবে) তিনি তখন বললেন আমি কি করতে পারি? আমি তাকে বললাম, “If you are so afraid of taking any action then I am going to take some actions. As far as your safety is concerned you can go to cantonment and tell them that they (2E Bengal pers) have all gone and no one listens to you. You will not be blamed for it as you have come only two days before. Neither you know the troops, nor they know you. If you want we will tie you and leave in one of the rooms and the Dacca authorities will not doubt you.” (অনুবাদঃ যদি আপনি একশন নিতে এত ভয় পান, তবে আমি একশন নিবো। যেহেতু আপনি আপনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, সেহেতু আপনি ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারেন এবং গিয়ে তাঁদের বলতে পারেন যে, ২য় ইস্ট বেঙ্গলের লোকেরা চলে গিয়েছে এবং কেউ আপনার কথা শুনে নাই। আপনাকে এর জন্য দোষারোপ করা হবে না। কারণ আপনি মাত্র ২ দিন আগে এসেছেন। আপনি যদি চান, তবে আমরা আপনাকে বেঁধে একটি রুমে রেখে যাবো। তাহলে আর ঢাকার কর্তৃপক্ষ আপনাকে সন্দেহ করবে না)। এ কথা বলার পর উনাকে একটু চিন্তা করে দেখতে বললাম এবং বললাম আমি সমস্ত অফিসার জেসিও’দের এ ব্যাপারে ব্রিফ করছি। যে পাঞ্জাবী অফিসার টঙ্গীতে খবর নিতে গিয়েছিল সে গাজীপুর ফিরে না গিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসে। জয়দেবপুরে আরো দুইজন পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসার এবং কিছুসংখ্যক পাকিস্থানী সৈন্য ছিল। তাদের মধ্যে গোপনে শলাপরামর্শ চলছিল। আমি এটা লক্ষ্য করেছিলাম। তাই এ অফিসারকে রীতিমত অর্ডার করে গাজীপুর পাঠিয়ে দিই।

২৭শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে কিছু লোক ঢাকা থেকে আসে। তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঢাকাতে বেশকিছু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর আগে ড্রাইভার ছাড়া আর কারো মুখে শুনতে পাইনি। ২৭শে মার্চ সকালে একজন লোক ধীরাশ্রম থেকে জয়দেবপুরে আসে। সে খবর নিয়ে আসে যে কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা ধীরাশ্রম রেলওয়ে স্টেশনে ঢাকা থেকে এসেছেন এবং সেখানে বসে আছেন। তিনি আমার সাথে বা লেঃ কর্নেল মাসুদের সাথে দেখা করতে চান। আমি ঐ লোকটার সঙ্গে গোপনে দেখা করি এবং লেঃ কর্নেল মাসুদ ব্যাটালিয়নে নেই, উনি ঢাকায়। বর্তমান ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল রকিব। আপনি চলে আসুন, কোনো অসুবিধা হবে না। বোধ হয় লেঃ কর্নেল রকিব ব্যাটালিয়ন কমান্ডার শুনে জয়দেবপুর আসতে সাহস পাননি। তাই তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয় নি।

২৮শে মার্চ সকালে ময়মনসিংহ থেকে মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে খবর পাঠায় যে ২৭/২৮ শে মার্চ রাতে তাঁর সেনাবাহিনীর উপর পাকিস্থানী ইপিআররা হামলা চালিয়েছে। লড়াই এখনো চলছে। এর পরিপ্রক্ষিতে আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে বললাম যে, আমাদের শিগগিরই ময়মনসিংহ রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো দরকার। আমরা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেই যে, যেহেতু ঢাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং ময়মনসিংহে আমাদের সৈন্যরা আক্রান্ত হয়েছে, সেহেতু আমাদের এখন তাদের সাহায্যে যাওয়া উচিৎ। ময়মনসিংহে যে আমাদের সৈন্যরা পশ্চিম পাকিস্থানীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে একথা আমরা কাউকে বলিনি। আমাদের একথা গোপন রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যে জয়দেবপুর থেকে সবাইকে এক সাথে নিয়ে যাওয়া এবং পথিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করা। এ ব্যাপারে আমরা এক পরিকল্পনা তৈরি করি। রাতে যাবার পরিকল্পনা এজন্য করা হয়েছিল যে গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে আমাদের যেসব সৈনিকরা আছে তাদেরকেও যদি সাথে নিয়ে না যাই তাহলে তারা হয়ত আটকা পড়বে। যেহেতু দিনের বেলায় তাদের সরাতে গেলে অসুবিধা হতে পারে সেহেতু রাতে তাদেরকে সরানোর সময় বেছে নেয়া হয়। কেননা, গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে যে সমস্ত বাঙালি সৈন্য আছে তাদেরকে গোপনে সংবাদ দিতে হবে। আমরা যে জয়দেবপুর থেকে যাচ্ছি এটা সবাই জানত। কিন্তু গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সৈন্য সরাতে গেলে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে এজন্য রাতে যেন বাঙালি সৈন্যরা গোপনে বের হয়ে আসতে পারে তার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছিল। আরো পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছিল যে, আমি সারপ্লাস অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কিছুসংখ্যক সৈনিক নিয়ে সকাল দশটার দিকে ময়মনসিংহে যাত্রা করব। এবং লেঃ কর্নেল রকিব বাকী লোকদের নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রওনা হবেন। এই সময়টা যেন গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা যেন ঠিক ঐসময় বেরিয়ে আসতে পারে। ওয়াপদার সাথে এটাও ঠিক হয়েছিল যে, ঐ সময় গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর ও জয়দেবপুর বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে- যাতে এ সমস্ত জায়গা থেকে আমাদের বের হতে কোনো অসুবিধা না হয়। গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে লোক পাঠিয়ে ওদেরকে ঐ সময়ের মধ্যে বের হবার খবর দেওয়া হয়েছিল।

২৮শে মার্চ সকাল দশটায় সমস্ত উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং যানবহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। যাবার সময় লেঃ কর্নেল রকিব এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের নিয়ে তিনি সন্ধ্যার সময় রওনা হবেন। আমি জয়দেবপুর থেকে বের হবার পর চৌরাস্তা থেকে সমস্ত গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানদের মাঝে এক অভূতপুর্ব আনন্দের হিল্লোল সৃষ্টি হয়। এবং সবাই উল্লাসে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে থাকে। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং আমাদেরকে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে অনুপ্রাণিত করে। তাদের মধ্যে কিছু লোক জানত আমরা কি করছি। যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় লোক আমাদের পরিকল্পনার কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জনাব আবদুল মোতালেব। তিনি একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের জন্য বেসামরিক ট্রাক, বাস, গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন।

টাঙ্গাইলের কাছাকাছি যাবার পর দেখতে পেলাম অপরদিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটা জীপ গাড়ী আসছে। ঐ গাড়িটা আমাদের কনভয়-এর কাছে এসে দাঁড়ায় এবং আমাদের গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে খুশি হয়। তারা বলে যে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমাদের লোকজন পজিশন নিয়ে আছে। আমরা তাদেরকে খবর দিয়ে আসি, যেন কোন অঘটন না ঘটে। কিছুক্ষণ পর আমরা টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করি। সেখানে ব্যাণ্ডপার্টিসহ এক উৎফুল্ল জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করে। জনতার এই উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু মনে মনে শুধু একটা চিন্তা করছিলাম যে, আমি যা করতে চলেছি এ কাজে আমি কি শুধু একা? না আরো কেউ আছে? যদিও একদিকে খুশী ছিলাম, অপরদিকে ভাবনাও কম ছিল না। কারণ আমি জানি আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই সাজা। কিন্তু তবু জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সঞ্চার হতো। টাঙ্গাইলে যাবার পর কে একজন আমাকে বললেন যে মেজর জিয়া নামে একজন চট্রগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ কথা শুনে আমার সাহস দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বেড়ে যায়। কারণ, তখন আমার মনে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এ কাজে আমি একা নই।

টাঙ্গাইলের জনগণ আমাদেরকে যেভাবে সাহায্য করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ্যমুনিশেন বোঝাই একটা গাড়ীর অ্যাক্সেল ভেঙ্গে যাবার সাথে সাথেই সে আক্সেল তারা বদলিয়ে দেয়। আমি আমার সমস্ত সৈন্য এবং যানবাহন নিয়ে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে পৌঁছে যাই।

টাঙ্গাইলে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল, তার কমান্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। টাঙ্গাইল কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে পৌছার সাথে সাথেই কোম্পানীর জেসিও আমাকে বলে যে , সে গত রাতে কোম্পানী কমাণ্ডারকে নিরস্ত্র করে রেখেছে। আমি তখন সমস্ত কোম্পানীকে একত্রিত করে লেঃ মোরশেদকে তাদের কোম্পানী কমণ্ডার নিয়োগ করি। আর সমস্ত কোম্পানীকে এই বলি যে তোমরা সবাই ময়মনসিংহে চলে আস এবং ময়মনসিংহ পৌছার পর তোমাদের বাকি নির্দেশ দেব। এখন থেকে লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) তোমাদের কোম্পানী কমণ্ডার আর তোমাদের কাছ থেকে এ ওয়াদা চাই যে তোমাদের কাছে আমি তোমাদের পুরাতন কোম্পানী কমণ্ডারকে আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি! তোমরা তাকে তোমাদের সাথে নিয়ে আসবে। এবং আমার কাছে ময়মনসিংহ পৌঁছাবে। যেহেতু আমি ময়মনসিংহ যাবার জন্য তাড়াহুড়াতে ছিলাম সেহেতু বেলা দুটোর দিকে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে রওনা হই। তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়ে আসি যে, জয়দেবপুর থেকে লোক না আসার আগে তারা যেন টাঙ্গাইল ত্যাগ না করে।

টাঙ্গাইল থেকে কয়েক মেইল যাবার পর প্রথম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই। এখানে বলে রাখা দরকার, ঢাকার খবর পাবার পরপরই জনসাধারণ টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তার মাঝে মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে। প্রথম যে প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাই সেটা ছিল একটি কাঠের পুল। জনসাধারণ সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এবং আগুন তখনও জ্বলছিল। পুলটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমার কনভয়কে অনেক দূর ঘুরে কোন কোন জায়গাতে নতুন রাস্তা করে যেতে হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা খুলে অগ্রসর হতে আমার বেশ সময় লেগে যায় এবং রাত প্রায় তিনটায় আমি মুক্তাগাছা পৌঁছি। মুক্তাগাছায়ও টাঙ্গাইলের মত কিছু লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। তারা আমাদের উপর গুলি করার আগেই আমরা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হই আমরা তাদের শত্রু নই। আমরা বাংলাদেশের সৈনিক। তখন বহু লোক বেরিয়ে আসে এবং রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ঐ রাত আমরা মুক্তাগাছা কলেজে কাটাই। আমাদের সাথে খাবার ছিল না। জনসাধারণ আমাদের খাবার ব্যবস্থা করে।

ভোর হবার আগেই জয়দেবপুর এবং টাঙ্গাইলের লোকজন মুক্তাগাছায় পৌঁছে। মেজর মইন (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল) আমাকে বলে যে সবাই এসে গেছে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কোথায়। উত্তরে বলল সে আসে নাই। আমি জয়দেবপুর থেকে আসার পূর্বোল্লিখিত পরিকল্পনার কিছুটা রদবদল হয়েছিল। তা নিম্নরূপ আমাদের লোকজন জয়দেবপুর থেকে সরিয়ে আনার কথা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার পরে মেজর মইনকে বলেছিলেন এ সময় বদলী করে ৮ টা করার জন্য। সময় ছিল বলে ঐ পরিবর্তিত সময় সবাইকে জানানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার ঠিক মত করতে পারছিলেন না। সন্ধ্যে সাতটায় মেজর মইনকে আবার বললেন যে সময়টা পরিবর্তন করে সাড়ে সাতটা করে দাও। মেজর মইন তাকে বলেছিলেন যে, এখন আর সবাইকে এই সময় সম্বন্ধে বলার সুযোগ হলো না, তাই এই সময়টা অপরিবর্তিত থেকে যায়। রাত ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। রাত ঠিক ৮টায় অয়ারলেস, যেটা অফিসার্স-মেস-এর পূর্বাংশে ছিল, সেখান থেকে একজন পাঞ্জাবী সৈনিক আমাদের সৈনিক আমাদের একজন সিপাইকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এই গুলির আওয়াজের সাথে সাথে চারদিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের লোক একজন অপরজনের উপর মোতায়এন করা হয়েছিল এবং তারা সজাগ ছিল সেহেতু আমাদের লোকের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই গোলাগোলিতে কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিক মারা যায়। কথামত পৌনে ৮টায় প্যালেসের বাইরে যে জীপ গাড়ী দাঁড়ানো ছিল সে জীপে করে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তিনি গাড়ীর কাছে না গিয়ে একজন পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে অফিসার্স মেস-এর দ্বিতলে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তাই হয়ত তিনি ঐ অফিসারের হাত থেকে সরে আস্তে পারেননি। অথবা নিজে ইচ্ছে করে আসেন নি। কারণ ঐ সময় তাঁর ঐ জায়গাতে থাকার কথা ছিল না।

গোলাগুলির পর ব্যাটালিয়ন-এর লোকজন সময়মত বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। গাজীপুর থেকে যখন লোক বেরিয়ে আসে তখন পাঞ্জাবী অফিসার বাধা দেওয়াতে তারা তাঁকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। জয়দেবপুরের লোক টাঙ্গাইল পৌছার সঙ্গে সঙ্গে এক গোলযোগের সৃষ্টি হয়। গোলযোগের সূত্রপাত এভাবেহএছিল যে, জয়দেবপুর থেকে যখন বাঙালি সৈন্যরা বেরিয়ে আসছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ কথা বলার সাথে সাথে আমি যে অফিসারকে আমানত রেখে গিয়েছিলাম তাঁর উপর আক্রোশে গুলি চালানো হয় এবং সে মারা যায়।

এ সমস্ত ঘটনার পর আমি দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করলাম যে আমাদেরকে এখন মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

২৯শে মার্চ সকালে মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহ যাত্রা করি। যদিও দূরত্ব ছিল মাত্র ১০ মেইল তবুও এই পথ অতিক্রম করতে আমদের প্রায় তিন ঘন্টা লেগেছিল। ময়মনসিংহ পৌছার সাথে সাথে মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্ণেল) বলল যে, গতকাল আড়াইটা পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে সবাই মারা গেছে, শুধু ছয়জন ছাড়া। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে ময়মনসিংহের ঘটনার যে বর্ণনা দেন তা উল্লেখ করছি। ২৬শে মার্চ ময়মনসিংহে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর কোম্পানী ও ইপিআর-এর লোক জনসাধারণ কর্তৃক ঘেরাও হয়েছিল। তখন ইপিআর হেডকোয়ার্টার পেরিমিটারের বাইরে বাঙালি সৈণ্যরা পাহারা দিচ্ছিল। তারা জনসাধারণকে সরে যেতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে উইং কমাণ্ডার (পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার) চালাকি করে বাঙালি ইপিআর লোকদের বলে যে গতকাল তোমরা অনেক কষ্ট করেছ। আজ তোমরা রেস্ট কর। আজকের ডীউটি দেবে অন্য কোম্পানী (সে কোম্পানীটা ছিল পাঞ্জাবীদের)। আজ রাতে তোমাদের আর কোন ডিউটি হবে না। তোমরা হাতিয়ার জমা দিয়ে রেস্ট কর। যেহেতু চারদিকে একটা থমথমে পরিবেশ ছিল সে কারণে কেউ হাতিয়ার জমা দেয়নি। সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যার যার বিছনায় শুয়ে পড়ে। রাত প্রায় ১২টার মধ্যেই পাকিস্তানী ইপিআর-এর সৈনিকরা ইপিআর-এর যত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল তা তারা ছাদের উপর নিয়ে যায় এবং সমস্ত যানবাহন সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় যাতে সমস্ত গাড়ী স্টার্ট করতে হেড লাইট অন করে তখন যেন সমস্ত আলো ইপিআর-এর বাঙালিরা যে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছে সে ব্যারাকের উপর পড়ে এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীর তাঁবুতে পড়ে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় তারা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মেজর নুরুল ইসলাম ও লেঃ মান্নান ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধ মেইল দূরে স-এণ্ড-বি রেস্ট হাউসে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে বারোটায় রেস্ট হাউস-এর উপর তাদের কামরা লক্ষ্য করে অটোমেটিক গুলি ছোড়া হয়। প্রথমে তিনি টেলিফোন কোম্পানীর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি এবং লেঃ মান্নান পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নদীর দিকে চলে যান। এবং সেখান থেকে ময়মনসিংহ শহরে যান। সকাল না হওয়া পর্যন্ত তিমি কোম্পানীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারেননি। ভোরে যখন যোগাযোগ হয় তখন ভীষণভাবে দুই দলের মধ্যে গোলাগুলি চলছিল। এই গোলাগুলি বেলা দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই গোলাগুলিতে ৬ জন পাকিস্তানী ছাড়া আর সবাই মারা যায়। অবশিষ্ট ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে ময়মনসিংহ জেলে রাখা হয়। আমি ময়মনসিংহ পৌছার সাথে সাথে এ সমস্ত ঘটনা শুনতে পাই।

২৯শে মার্চ বিকেল চারটা পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন-এর সমস্ত লোক কনসেনট্রেট হয়। রাজেন্দ্রপুর কন্টিনজেন্ট রাত্রে পৌঁছে। আমি ময়মনসিংহে পৌঁছে আমার পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য সীমান্ত থেকে সমস্ত ইপিআরকে ময়মনসিংহে এসে কনসেনট্রেট হতে অর্ডার দিলাম। তারপর আমি ময়মনসিংহ পুলিশ অয়ারলেসে গিয়ে বাংলাদেশের যত জায়গাতে পুলিশ অয়ারলেস কমিউনিকেশন আছে সবাইকে লক্ষ্য করে এই নির্দেশ দিলাম যে, আমি মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছি। বর্তমানে ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা আমার নিয়ন্ত্রণাধীন আছে। আপনারা যে যেখানে আছেন, যদি বাঙালি হন, যার কাছে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান এবং দেশকে পাকিস্তানীদের কবল থেকে স্বাধীন করতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করুন। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে আমি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেলাম। যে সমস্ত জায়গা থেকে আমি কনফারমেশন পেয়েছি যে তারা অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেসব জায়গা হল- দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, ফেনী এবং চট্রগ্রাম।

২৯শে মার্চ বিকেলে জেলা এডমিনিস্ট্রেশন-এর সমস্ত অফিসারবৃন্দ, জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এম-এন এ এবং এম-পি এদেরকে নিয়ে এক বৈঠক করি। সেই বৈঠকে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে তাঁর পরিকল্পনা নিই। জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সামরিক বাহিনীকে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করার ভার বেসামরিক প্রশাসন এবং এন-এম এ ও এম-পি দের উপর ন্যস্ত করা হল। তাঁরা বেশ আগ্রহের সাথে এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার হাতে রাখি। এই বৈঠকে এও সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন। এবং সেটা পাবার জন্য আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের প্রস্তাব করা দরকার। তাই, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, আমাদের একজন এম-এন-একে দিল্লী পাঠানো হবে আমাদের প্রস্তাব দিয়ে। আমরা এম-এন-এ জনাব সৈয়দ আবদুস সুলতাঙ্কে বাংলাদেশের দূত হিসেবে দিল্লীতে আমাদের এ প্রস্তাব কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করার জন্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিই। এ সিদ্ধান্তও নেয়া হল যে তাঁকে সীমান্তের বাইরে পাঠাবার পূর্বে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা দরকার যে তারা আমাদের গ্রহণ করবে কিনা। এই মর্মে আমি একজন অফিসারকে (ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, বর্তমানে মেজর) হালুয়াঘাটে বিএসএফ-এর সাথে যোগাযোগ করতে পাঠাই। সে ওখানে পৌছার পর বিএসএফ-এর একজন অফিসার ক্যাপ্টেন বালজিতের সাথে দেখা করে। সেখানে ক্যাপ্টেন ছাড়াও আরো দু’জন অফিসার ছিলেন। একজন লেঃ কর্ণেল সিনহা। তিনি ছিলেন ইন্টেলিজেন্স-এর লোক এবং আর একজন ছিলেন সেখানকার বিএসএফ কমান্ড্যান্ট। তাদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলে। তাঁরা আমাদের সব কিছু দিয়ে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমি সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করি।

৩০শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ইপিআর, পুলিশ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং কিছু আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলি। যার লোকসংখ্যা ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার। ময়মনসিংহে যখন পৌছি তখন আমার সাথে অনেক জেসিও এবং নিম্নলিখিত অফিসার ছিলেন :
১।মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল)
২।মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল)
৩। মেজর নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল)
৪। ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর)
৫। ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরী
৬। লেঃ গোলাম হেলাল মুরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)
৭। লেঃ ইবরাহীম।
এছাড়া ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বর্তমানে মেজর) যিনি ময়মনসিংহে ছুটিতে ছিলেন তাঁকে আমি সাথে নিয়ে নিই। তাকে বলার সাথে সাথে সে আমার ব্যাটালিয়নে যোগ দেয়। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কাজী নুরুজ্জামান ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যোগ দেন। ময়মনসিংহ থেকে যাবার পথে দুইজন মেডিকেল কলেজের ডাক্তার নিয়ে নিই। তাঁরা হদ্ধে ডাঃ আবদুর রহমান এবং ডাঃ আহমদ আলী।

ময়মনসিংহ পৌঁছে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোথায় কি করছে সে খবর নেওয়ার জন্য আমার অয়ারলেস দিয়ে মনিটরিং করি। এবং যে সমস্ত খবর পাই তন্মধ্যে ২৯শে মার্চের বিকেলের খবর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঐ দিন ১৪ ডিভেশন-এর হেডকোয়ার্টারের কর্নেল সাদুল্লাহ এবং যশোর বিগ্রেডের বিগ্রেড মেজরের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তাঁর মধ্যে নিম্নলিখিত উক্তি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কর্নেল ষ্টাফ রীতিমত বিগ্রেড মেজরকে গালিগালাজ করে বলেছিলেন, “You have been routed by rag-tags. You people have no shame, How could you be routed by unarmed people? You need kick. However, tell your commander, if he needs any help, we will send air stories. We are in any way sending two air-stories to Kushtia circuit house. We have been able to tackle Dacca which did not bother us much. We are really concerned about Kushtia now. We have captured 8.E.B.Hq. We are now proceeding towards Radio Station. In the process we have suffered a lot of casualties. Send a c-130 (Transport aircraft) tomorrow in Chittagong, so that the dead and the wounded can be sent in Dacca. If it cannot come then send an “Allwate” (Helicopter) to naval base at 10-30. If c-130 can come then. “Allwate” is not required.” (অনুবাদঃ তোমরা অসংগঠিত লোকদের থেকে পিছিয়ে গেছো। তোমাদের কোন লজ্জা নেই। কিভাবে তোমরা অস্ত্রহীন লোকদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেলে? তোমরা লাথির যোগ্য। যাই হোক, তোমাদের কমান্ডারকে বলো, যদি তাঁর কোন সাহায্যের দরকার হয়, আমরা আকাশপথে সাহায্য পাঠাবো। আমরা কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে আকাশপথে সাহায্য পাঠাচ্ছি। আমরা সহজেই ঢাকা দখল করেছি। আমরা এখন কুষ্টিয়া নিয়ে চিন্তিত। আমরা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল হেডোকোয়ার্টার দখল করেছি। আমরা এখন রেডিও স্টেশনের দিকে যাচ্ছি। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রচুর হতাহত হয়েছে। আগামীকাল একটি সি-১৩০ যোগাযোগ হেলিকপ্টার চট্টগ্রামে পাঠাও যেন মৃত এবং আহতদের আমরা ঢাকায় নিয়ে যেতে পারি। যদি এটি আসতে না পারে, তবে নৌ-বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে একটি অলওয়েট হেলিকপ্টার পাঠাও ১০:৩০-এ। যদি সি-১৩০ আসতে পারে তবে অলওয়েটের দরকার নেই)“ এবং তারা হয়ত ঢাকা থেকে এসব জায়গায় রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠাবে। আমার আরো চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে যখন জিওসিএর মেসেজ শুনলাম যে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল হেডকোয়ার্টার দখল করা হয়েছে। তখন সাথে সাথে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি যে মেজর জিয়া (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) তার দলবল নিয়ে হয়ত ধরা পড়ে গেছে। এমতাবস্থায় সেখানে এমন কোন অফিসার জানামত ছিল না যে নেতৃত্ব দিতে পারবে। আমি তখন এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে অতিশীঘ্র ঢাকা আক্রমণ করা উচিত যেন কোন রি-ইনফোর্সমেন্ট বাইরে না যেতে পারে।

এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রুপায়িত করার জন্য নিম্নলিখিত পরিকল্পনা নিলাম- নর্থ বেঙ্গল থেকে যাতে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের দিকে না আসতে পারে সেই জন্য পুলিশ এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক সৈনিকদের নিয়ে গঠিত এক কোম্পানী সৈন্য বাহাদুরবাদ ঘাটে পাঠাই। আর কোম্পানী ই-পিআর সিরাজগঞ্জ ঘাটে পাঠাই। এক কোম্পানী ইপিআর এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক কোম্পানী গফরগাঁওয়ে পাঠাই। এক কোম্পানী পাঠাই টাঙ্গাইলে। ৩১ শে মার্চের মধ্যে এরা এ সমস্ত জায়গায় পৌঁছে যায়। এ ছাড়া আরো দুই কোম্পানী লোক (ইপিআর) ঢাকার পশ্চিমাংশ মীরপুর, মোহাম্মদপুর এবং ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ১লা এপ্রিলের মধ্যে আক্রমণ করার নির্দেশ ইদ্যে পাঠাই। আমি আমার ব্যাটালিয়ান এবং ইপিয়ার-এর একটি কোম্পানী নিয়ে ঢাকার পূর্বদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নিই। এ পরিকল্পনা আমি এই জন্য নিই যে, পাকবাহিনী প্রত্যাশা করছিল যে আমরা যদি তাদেরকে আক্রমণ করি তাহলে পশ্চিমাংশ দিয়া করব। তাই তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য পূর্বাংশ দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এদিক দিয়ে আসার জন্য আমি যে রাস্তা ব্যবহার করেছিলাম তা ছিলো ময়মনসিংহ থেকে কিহশোরগঞ্জ-ভৈরব-নরসিংদী ট্রেনে। তারপর নরসিংদী থেকে পায়ে হেঁটে ভাংগা দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ঢাকায় পূর্বাংশ দিয়ে আক্রমণ করব। এই পরিকল্পনাও যেন ১লা এপ্রিলে বাস্তবায়িত হয় তারও ব্যবস্থা করি।

৩০ শে মার্চ আমি যখন জায়গায় জায়গায় নির্দেশ দিয়ে লোকজন পাঠাচ্ছিলাম তখন গাজীপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার সকাল সাড়ে এগারোটায় টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন এবং বলেন যে দু’খানা জেট জঙ্গী বিমান জয়দেবপুরের প্যালেস ভীষণভাবে আক্রমণ করেছে এবং স্ট্রাফিং করছে। তার প্রায় ১৫ মিনিট পর আবার টেলিফোনে বললেন যে আর একখানা জঙ্গী বিমান জয়দেবপুর প্যালেসে বড় বড় বোমা ফেলছে। তাতে বিকট আওয়াজ হচ্ছে এবং প্রাসাদে আগুন লেগে গেছে। এ সংবাদ শুনে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম এই বভেবে যে আমরা ঠিক সময় বেরিয়ে পড়তে পেরেছি। আমাদের মনে কোন দ্বিধা রইল না যে আমরা কোন ভুল করিনি। বরং ঠিকই করেছি।

আমরা পূর্বপরিকল্পনা মত লোকজন জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিই। আমি আমার বাহিনীর নিয়ে ৩০শে মার্চ ট্রেনিংযোগে নরসিংদীর দিকে রওয়ানা হই। অল্পসংখ্যক কম্পার্টমেন্টে আমরা এক সাথে সবাই যেতে পারছিলাম না। তাই অল্প অল্প করে গন্তব্যস্থানে পাঠাচ্ছিলাম।

ময়মনসিংহ থেকে চলে আসার পূর্বে আমি জনগণকে আশ্বাস দিলাম যে আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছি। ৩০ শে মার্চ আমি আমার হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ স্থানন্তরিত করি। কিশোরগঞ্জে ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমান মেজর) নামে আর একজন অফিসারের সাথে দেখা হয়। সে তখন বাড়িতে ছিল। তাঁকে বলার সাথে সাথে সেও আমাদের সাথে যোগ দেয়।

৩১ শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের লোক গন্তব্য স্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যারা সর্বপ্রথম রওয়ানা হয়েছিলো ১লা এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত ঢাকার পূর্বাঞ্চলে বসাবো, ডেমরা এ স্থানে গিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। সেদিন আমি কিশোরগঞ্জে অবস্থান করছিলাম। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একটি খবর আসলো যে মেজর খালেদ মোশাররফ (বর্তমান কর্নেল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাবডিভিশন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন রেখেছেন এবং তিনি আমার সাথে কথা বলতে চান। আমি যখন তাঁকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম তখন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যে আমি যেন ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর না হয়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করি। ঐ দিনই আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে যাই। আমার সৈনিকেরা যারা ঢাকার অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল আমি তাঁদের আর বাঁধা দিইনি। মেজর খালেদ মোশাররফ কি বলতে চান তা জানার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর সাথে দেখা করতে চাই। আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছি তখন খালেদ সেখানে ছিলেন না। তিনি তাঁর সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর শাফায়াত জামিল (বর্তমান লেঃ কর্নেল)-কে মেসেজ দিয়ে পাঠান। এরপর আমি সেখানে ফিরে আসি। আমি যেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেরার পথে দু’খানা জঙ্গী বিমান আমাদের তাড়া করে। বেশ কিছুক্ষণ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে স্ট্রাফিং-এর পরে তিতাস গ্যাস অয়েল ট্যাঙ্কার-এর উপর বোমাবর্ষণ করে এবং এতে আগুন ধরে যায়। আমাদের সৈনিকেরা যারা ভৈরবে ছিল তাদেরকেও জঙ্গী বিমান দুটো খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু না পেয়ে তারা নরসিংদীতেও খোঁজাখুঁজি করে। আমাদের সন্দান কোথাও পায়নি। দিনটি ছিল ১লা এপ্রিল।

মেজর খালেদ মোশাররফ মেজর শাফায়াত জামিল মারফত আমার নিকট যে মেসেজ পাঠান তা ছিল নিম্নরূপঃ “Do not go towards Dacca. You will be banging your head against wall. We have liberated an area whole of Brahmanbaria Subdivision and a part of Sylhet. Before taking any further action on Dacca, we should jointly liberate this whole area and then go for Dacca. I had already contacted Indian BSF officers and they have agreed to help us. I could not come and meet you today because I am going to meet Brigadier B.C. Pabna of BSF who promised me to help us.”
(অনুবাদঃ ঢাকার দিকে যেও না। তবে তুমি দেয়ালে তোমার মাথা বাড়ি দিতে থাকবে। আমরা ব্রাক্ষণবাড়িয়া সাব-ডিভিশন এবং সিলেটের একটি পূর্ণ এলাকা মুক্ত করেছি। ঢাকায় যাওয়ার আগে আমাদের পূর্ণ এলাকা মুক্ত করা উচিৎ। আমি ইতোমধ্যে ভারতীয় বিএসএফ অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং তাঁরা আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন। আমি আজ এসে তোমার সাথে দেখা করতে পারলাম না কারণ আমি আজ বিএসএফ-এর বি,সি পান্ডার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। উনি আমাদের সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন)
তার পরিকল্পনা আমার মোটামুটি পছন্দ হলো। কারণ, আমি জানি যে তখন ঢাকাতে পাকিস্তানের যে সমস্ত সৈনিক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে আমাদের তার ১০ ভাগের এক ভাগও নেই। তাই যাতে আমরা যুক্তভাবে একটা পরিকল্পনা নিতে পারি সেই চিন্তা আমি করেছিলাম। এবং আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে, আমাদের এভাবে তাড়াহুড়া করে ঢাকা আক্রমণ করা ঠিক হবে না। আমি তখন আমার অফিসারদের নির্দেশ দেই যে যারা ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হয়েছে তারা যেন নিম্নরূপ মোতায়েন হয়ঃ এক কোম্পানী যেন ঢাকা- নরসিংদী রাস্তা পাহারা দেয়। এক কোম্পানী আশুগঞ্জ আর বাকী লোক যেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসে। ঢাকার পূর্বাংশে ও পশ্চিমাঞ্চলে যে সমস্ত সৈনিক গিয়েছিল ইয়াদের সাথে পাকবাহিনীর ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়। আমার সাথে পর্যাপ্ত অয়ারলেস সেট না থাকায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে যারা ছিল তাদের সাথে একমাত্র দূত (রানার) ছাড়া আর কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না।

খালেদ মোশাররফের সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন পরিকল্পনা নেয়া হয় যে আমরা যুক্তভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেট এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করব। এই পরিকল্পনাকে আমি বাস্তবায়িত করার জন্য আমার হেডকোয়ার্টার কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া টি গার্ডেনে ৩রা এপ্রিল স্থানান্তরিত করি। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ বা ভৈরববাজার যাবার সময় আমাদের যানবাহনগুলি নেবার জন্য মালগাড়ীর ওয়াগনকে ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে কেটে জায়গা করা হয় এবং গাড়ি পার করার ব্যবস্থা করা হয়। ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন থেকে সবাইকে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার পর ১৫০০ রাইফেল, প্রায় ২০টা এল-এমজি, কিছুসংখ্যক স্টেনগান আর ৩ লক্ষ এ্যামুনিশন আমি আমার সাথে নিয়ে আসি। আমাদের ব্যক্তিগর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এই আর্মস এ্যামুনিশন ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।

১লা এপ্রিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে যে এলাকা ছিল তা এরূপঃ মেঘনার পশ্চিম পাড়ে নরসিংদী-তারাবো-ঢাকা রাস্তা আমাদের সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রাণাধীনে ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাবডিভিশন মেঘনার পূর্বপাড়ে যেখানে আমি আমার সৈনিকদের মোতায়েন করেছিলাম সে জায়গাগুলো হল উত্তরে আজবপুর, তারপর আশুগঞ্জ এবং সবচেয়ে দক্ষিণে লালপুর, উত্তরে সিলেটের শেরপুর, শাদীপুর এবং শেওলা করিমগঞ্জও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্ব এবং দক্ষিণাংশে মেজর (বর্তমানে কর্ণেল) খালেদ মোশাররফের সৈন্যরা ছিল। যে সব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রাণাধীনে ছিল তা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর, গোকর্ণহাট, উজানিসার পুল এবং গঙ্গাসাগর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিওর ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকার রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বেসামরিক যানবাহন, ট্রাক, বাস একত্রিত হয়। এই ট্রাক বাস দ্বারা দুই কলাম ফোর্স তৈরী করা হয় যার এক কলাম ২রা এপ্রিল টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হয় এবং আর এক কলাম নরসিংদীর দিকে রওয়ানা হয়। যে কলামে টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা হয়েছিল আমার টাঙ্গাইলে প্রেরিত কোম্পানী তাদেরকে রাস্তায় এ্যামবুশ করে। এই কলামে প্রায় ১০০টির বেশী গাড়ী ছিল। এ এ্যামবুশ এত সুন্দর হয়েছিল যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেশকিছু লোক হতাহত হয়। হতাহতের সংখ্যা বলা যাবে না। তবে লোকেমুখে শোনা যায় যে আহতদের নিয়ে যাবার জন্য ছয়খানা গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অপারেশনে আমাদেরও কিছু লোক মারা যায়। এই খবর পাই মেসেজের মাধ্যমে। এই পশ্চিমাংশের লোকদের খবরাখবর ততদিন পর্যন্ত পাই, যতদিন তারা মধুপুর জঙ্গল থেকে যুদ্ধ চালাচ্ছিল।

যে কলাম ঢাকা থেকে নরসিংদী রওয়ানা দিয়েছিল তারা আমাদের কোম্পানীর দ্বারা নরসিংদী এবং পাঁচদোনার মাঝামাঝি জায়গায় আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণে পাকিস্তানের সৈন্যদের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তাদের পিছে হটে যেতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনা ঘটে ২রা এপ্রিল। তারা ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর শায্য চায়। যেহেতু বিমান বাহিনী অন্যান্য জায়গায় ব্যস্ত ছিল সেহেতু বিমান বাহিনী সেদিন তাদের সাহায্যে আসতে পারেনি। কিন্তু পরদিন তাদের আর্টিলারি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের সৈনিকরা যে জায়হাতে ছিল সেই জায়গাতে পাঁচদোনা- নরসিংদীতে ভীষনভাবে আর্টিলারী গোলাবর্ষ্ণ শুরু হয়। আমাদের নিকট দূরপাল্লার কোন অস্ত্রই ছিল না, রাইফেল এবং লাইট মেশিনগান ব্যতীত। তাই আমরা তাদের পাল্টা জবাব দিতে পারিনি। এভাবে তারা ৪৮ ঘন্টা যাবৎ আমাদের উপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। ৩রা এপ্রিল আর্টিলাআরী গোলাবর্ষণ ছাড়াও জঙ্গী বিমান ও আমাদের উপর ব্যাপকভাবে স্ট্রাফিং করে। শত্রুর মুখোমুখি যুদ্ধ এই ছিল আমাদের প্রথম। সৈনিকরা এ রকম গোলাবর্ষণের সম্মুখীন আর কখনো হয়নি। তাই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পেছনে সরে আসে। আমরা বেশকিছু সংখ্যক সৈনিককে ভৈরবে একত্রিত করতে সক্ষন হই এবং পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভৈরবের পূর্বাংশে রামপুরা ব্রীজের কাছে সেনা মোতায়েন করি –যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় ভৈরব পৌঁছাতে না পারে।

৩রা এপ্রিল এই পরিকল্পনা নিই যে, যেহেতু আমাদের সৈন্য কম সেহেতু পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য ডিনায়াল প্ল্যান গ্রহণ করি। এর উদ্দেশ্য, রাস্তাঘাট, রেলওয়ে ব্রীজ, রোড ব্রীজ ভেঙ্গে দেয়া যাতে শত্রুরা অতি সহজে সম্মুখে আসতে না পারে। ডিনায়াল প্লান-এর প্রথম আমরা ভৈরবের কাছে রামপুরের ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলি। আর কিশোরগঞ্জের কাছে রোড এবং রেলব্রীজ দুটোই ভেঙ্গে দিই। ভৈরবের ব্রীজ ভাঙ্গারও পরিকল্পনা নিই।

৪ঠা এপ্রিল দেখা গেল কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল)-এর সাথে আমারই হেডকোয়ার্টারে তেলিয়াপাড়াতে। তিনি আগরতলা থেকে তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনিই সেই ওয়সমানী যাকে আমি ভালোভাবে চিনতাম। আমি তাঁকে চিনতে পারিনি এই জন্যে যে আত্মগোপন করার জন্য গোঁফ কেটে রেখেছিলেন। ঐ দিনই আমি খবর পেলাম যে জিয়াউর রহমান (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) চট্রগ্রাম থেকে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আমার কাছে আসছেন।

একটা কথা বলা দরকার, ৪ঠা এপ্রিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মস্ত বড় দিন। সেদিন আমার হেডকোয়ার্টারে অনেক সিনিয়র অফিসার একত্রিত হয়েছিলেন। যারা ছিলেন তাঁরা হলেনঃ
১। কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল, বিমান ও নৌযান মন্ত্রী),
২। মেজর জিয়াউর রহমান (ব্রিগেডিয়ার),
৩। মেজর খালেদ মোশাররফ (কর্নেল),
৪। লেঃ কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা (রিটায়ার্ড কর্নেল),
৫। মেজর কাজী নুরুজ্জামান (রিটায়ার্ড লেঃ কর্নেল),
৬। মেজর নুরুল ইসলাম (লেঃ কর্নেল),
৭। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (লেঃ কর্নেল),
৮। লেঃ কর্নেল আবদুর রব (রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল, বর্তমানে এম-পি) এবং অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। তিনি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। It was decided that day, that the operation for liberation war to be conducted under one command and the commander being colonel M.A.G Osmany (now rtd. General Osmany. অনুবাদঃ ঐ দিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে স্বাধীনতার যুদ্ধ কেবল একটি কমান্ডের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে এবং তা হবে কর্নেল এম, এ, জি ওসমানীর কম্যান্ডে (বর্তমানে রিটায়ার্ড জেনারেল ওসমানী)

ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে এই অনুরোধ করি যে যত শীঘ্র হোক রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা যেন সরকার গঠন করা হয়। যতক্ষন পর্যন্ত সরকার গঠিত হচ্ছে না ততক্ষন পর্যন্ত আমরা কোন বৈদেশিক সাহায্য পাব না। ঐ দিন আন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে এটাও সাব্যস্ত হল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিলেট এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফের উপর ন্যস্ত করা হয়। চট্রগ্রাম এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের যুদ্ধ পরিচালনার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের উপর। এই সিদ্ধান্তের পর আমরা যার যার এলাকার সৈনি মোতায়েন করি।

৪ঠা এপ্রিল আমার বাহিনী নিম্নলিখিত এলাকায় নিযুক্ত থাকেঃ প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য নরসিংদীতে, এক কোম্পানী আজবপুরে, এক কোম্পানী আশুগঞ্জে, এক কোম্পানী লালপুরে, এক কোম্পানী সিলেটের শেরপুরে ও শাদিপুরে এক কোম্পানী সরাইলে (এই কোম্পানী আমার রিজার্ভ কোম্পানী ছিল)। তাদের উপর দুটো টাস্ক দেয়া হয়েছিল। প্রথম টাস্ক হল, যদি দরকার হয় ঢাকার দিক থেকে পাকসৈন্যরা আক্রমণ বৃদ্ধি পেলে লালপুর এবং আশুগঞ্জে যেসব সৈনিক আছে তাদের সাহায্যার্থে তালশহর এবং গোকনঘাট এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করবে। দ্বিতীয় টাস্ক হল, যদি সিলেটের দিক দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ বৃদ্ধি পায় তাহলে শেরপুরে সৈন্যদের সাহায্যার্থে যেন মৌলভীবাজারে সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়। এসব কোম্পানী ছাড়াও মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের অনুরোধে চট্রগ্রামের সৈনিকদের রি-ইনফোর্সমেন্ট-এর জন্য আমাকে এক কোম্পানী সৈন্য তাঁকে দিতে হয়। ৫ই এপ্রিল তাঁরা আমার কাছ থেকে চট্রগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। এবং সে কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যে রাস্তা কুমিল্লার দিকে চলে গেছে সে রাস্তার উপর নজর রাখার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফের উপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করার জন্য উজানিয়া পুলের নিকট এক কোম্পানী, গংগা সাগরে এক কোম্পানী এবং গোকনঘাটে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন করেন।

যেহেতু আমার সুদক্ষ সৈনিকের অভাব ছিল সেহেতু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, প্রাক্তন ইপিআর, পুলিশ এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোক নিয়ে এই সমস্ত কোম্পানী পুনর্গঠন করা হয়।

সৈন্যসংখ্যা আমাদের কম থাকায় ৪ঠা এপ্রিল থেকেই আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ যুবক ট্রেনিং নিচ্ছিল। অল্প সংখ্যক অফিসার এবং ইন্সট্রাক্টর নিয়ে আমি এই ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করি। আমার যে সমস্ত অফিসার ছিল তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কোম্পানী নিয়ে ৪ঠা এপ্রিল নিম্নলিখিত জায়গাতে মোতায়েন ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নরসিংদীতে , ক্যাপ্টেন নাসিম আশুগঞ্জে, লেঃ মোরশেদ লালপুরে, ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলে, ক্যাপ্টেন আজিজ শেরপুর কাদিপুরে, ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী চট্রগ্রাম অভিমুখে, মেজর মইন তেলিয়াপাড়াতে তার কোম্পানীর সাথে, মেজর নুরুল ইসলাম ট্রেনিং দেয়ার জন্য এবং লেঃ ইব্রাহীম আমার হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে। ৫ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান আমার সাথে যোগ দেয়। (নুরুজ্জামান যোগ দিয়ে তার পরিবারকে আনার জন্য রায়পুরাতে চলে যায় এবং ২৬শে জুন পুনরায় যোগদান করে)

আমাকে সিলেট থেকে ভৈরব এবং নরসিংদী পর্যন্ত সৈনিকদের তত্ত্বাবধান করতে হত। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, জয়দেবপুর থেকে যেদিন আমরা বেরিয়ে এসেছি ঐদিন থেকে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, আমরা যখন যেখানেই ছিলাম ঐ জায়গার জনসাধারণ আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত। তাই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। যাঁরা আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ
নরসিংদীতে মিজানুর রহমান (একজন স’মিল ম্যানেজার),
আশুগঞ্জে মোঃ শফিউদ্দীন,
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রাক্তন এমপিএ সাচ্চু মিঞা এবং সিলেটের সাবু চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলকাস মিঞা।

৪ঠা এপ্রিল আমি সিলেট অভিমুখে যাত্রা করি আমার যে কোম্পানী সৈন্য শেরপুর, শাদিপুরে পাঠিয়েছি তাঁদের যুদ্ধের পরিকল্পনা দেবার জন্য। মৌলভীবাজার গিয়ে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) চিত্তরঞ্জন দত্তের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেখানে মেজর দত্ত, এমএনএ মানিক চৌধুরী, কিছুসংখ্যক প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকজনকে নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেন। আমি মৌলভীবাজারে গিয়ে তাঁদের কাছে আমার মনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করি। আমার সৈনিক এবং তাঁদের গঠিত বাহিনী নিয়ে সিলেট জেলাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সিলেটে তখন এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী সৈন্য ছিল। আমার কাছে তখন আমার নিজস্ব এক কোম্পানী সৈনিক এবং কর্নেল দত্তের দ্বারা গঠিত আরো প্রায় দুই কোম্পানী সৈনিক ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের নিকট যে সৈন্য রয়েছে তাঁদের দ্বারা সিলেট শত্রুমুক্ত করতে হলে আমাদের দুই পর্যায়ে এই আক্রমণ চালাতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে মুক্ত করা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সুরমা নদীর উত্তরাঞ্চল মুক্ত করা।

এই প্রথম পর্যায় সম্পন্ন করার জন্য পাকিস্তানী যত সৈনিক সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে ছিল তাদের পরাজিত করতে তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করি। এক কোম্পানী শেরপুর থেকে সিলেটের দিকে প্রধান সড়ক দিয়ে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হয়। এক কোম্পানী ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে রেললাইন ধরে অগ্রসর হয়, আআর এক কোম্পানী শেওলা করিমগঞ্জের দিক থেকে সুরমা নদীর দক্ষিণ পার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়।

এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে এক খণ্ডযুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং তাঁরা পলায়ন করে শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত হয়। ৫ই এপ্রিল সুরমা নদীর সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং সুরমা নদীর উত্তরে দিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়ে আমাদের হস্তগত হয়। প্রাক্তন ইপিআর এর কিছু সংখ্যক লোক যারা সুনামগঞ্জে ছিলেন তারাও উত্তর পশ্চিম দিক থেকে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। ঐ দিন পর্যন্ত আমাদের আয়ত্তাধীনে যে সমস্ত এলাকা ছিল তা হলঃ সমস্ত সুরমা নদীর দক্ষিনে এবং পশ্চিমে সমস্ত অঞ্চল, সিলেট শহর এবং খাদিমনগর। আমাদের কাছে সৈন্য ছিল মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি এবং প্রাক্তন ইপিআর এর তিন কোম্পানি, যারা সমস্ত এলাকাকে ঘিরে রাখে। পাকিস্তানের যে সৈনিক ছিল তা এক ব্যাটেলিয়নেরও বেশি। তারা শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্র হয়েছিল। পাকিস্তানিদের কাছে আধুনিক, মারাত্মক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। যে ব্যাটেলিয়ন সেখানে ছিল তা হল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

প্রথম পর্যায় শেষ করার পর আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দিই, যে এলাকা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানে যেন শত্রুরা বুহ্য ভেদ করতে না পারে। সে জন্য সজাগ দৃষ্টি রেখে সে এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে বলি। দ্বিতীয় পর্যায় অপারেশন আমি শুরু করতে পারছিলাম না, এই জন্য যে, শত্রু সৈন্যের সংখ্যা আমাদের ছেয়ে অনেক বেশি ছিল। তাই সবাইকে পরিখা খনন করে বুহ্য প্রস্তুত করতে বলি।

পাক সৈনিকরাও তখন বেশ অসস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিল। তাদের মনোবলও লোপ পেয়েছিল। আত্মসমর্পণের ইচ্ছা থাকলেও তাদের মনে আশংকা ছিল যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। তাই আত্তরক্ষার জন্য তারাও চারিপাশে পরিখা খনন করে বূহ্য তৈরি করলো। আমি তখন চিন্তা করছিলাম যে অন্য কোথাও থেকে এখানে সৈন্য আনা যায় কিনা। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে কোন সৈন্য সরাতে পারছিলাম না এইজন্য যে তখন নরসিংদীতে লড়াই চলছিল। পাকিস্তানিরাও তখন নীরব থাকেনি। তারা পিআই ফোকার ফ্রেণ্ডশিপ এবং সি-১৩০ বিমানের সাহায্যে সিলেটে রি-ইনপোর্সমেন্ট শুরু করে। আমাদের শুধু সৈন্যই কম ছিল না, অস্ত্রশস্ত্রেরও অভাব ছিল যথেষ্ট। আরো অধিক সৈন্য কিভাবে যোগাড় করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য মৌলভীবাজারে মেজর দত্ত (বর্তমানে কর্নেল দত্ত) এবং এমএনএ মানিক চৌধুরীর সাথে মিলিত হই। এই সাক্ষাৎকার ঘটে ৮ই এপ্রিল। অই দিন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে শত্রুকে ধোকা দেয়ার জন্য বেশ কিছু বেসামরিক লোককে পাকিস্তানীদের বুহ্যের পশ্চিমাংশ দিয়ে মহড়া দেখানো বা শো করানো যেন এই সুযোগে খাদিমনগরের দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শালুকাটিকার বিমান ঘাটির উপর আক্রমণ চালাতে পারি। এ সমস্ত লোককে একত্রিত করার দায়িত্ব নেন এমএনএ মানিক চৌধুরী। ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত লোক যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তানী রি-ইনফোর্স্মেন্ট বেশ হয়ে যায় এবং ৯ই এপ্রিল দিবাগত রাত্রে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমনে সারারাত লড়াই চলে এবং অবশেষে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। এ লড়াইয়ে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হন এবং পাঁচজন আহত হন। যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন হাওলাদার কাজী মোস্লেহউদ্দিন এবং ল্যান্সনায়েক আবদুর রহমান। শত্রুপক্ষেরও বেশ হতাহত হয়। তাদের দূরপাল্লার কামানের গোলার মুখে আমরা টিকতে পারছিলাম না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানী জঙ্গি বিমানও আমাদের উপর আক্রমণ চালায়।

সেখান থেকে পিছু হটে আমরা আবার শেরপুরে বুহ্য নির্মাণ করি এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা করার জন্য আবার মৌলভীবাজারে মিলিত হই। ওইদিন কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল), মেজর কাজী নুরুজ্জামানও (অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) মৌলভীবাজারে উপস্থিত হন। যেহেতু আমাকে সিলেট ও নরসংদিতে যুদ্ধের পরিকল্পনা তত্তাবধান করতে হয়েছিল এবং নরসংদিতে যুদ্ধ চলছিল সেহেতু মেজর কাজী নুরুজ্জামান এবং মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তকে সিলেটের যুদ্ধের পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। মেজর নুরুজ্জামান সিনিয়র হওয়াতে তাকে অধিনায়ক করা হয়। যে সমস্ত সৈন্য যুদ্ধের জন্য আমি সিলেট নিয়েছিলাম তাদেরকে রেখে আসি। ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে এক কোম্পানি সৈন্য সিলেট এবং এক কোম্পানি সৈন্য চিটাগাং পাঠাবার পর আমার নিকট মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য থেকে যায়। তাদের দ্বারা আমাদের ঢাকা থেলে অগ্রসরমান এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্যের মোকাবিলা করতে হচ্ছিলো।

আমি এই দুই কোম্পানি সৈন্য প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক জনগন দ্বারা এক ব্যাটেলিয়নের মতো সৈন্য আবার তৈরি করি। তাদের দ্বারাই আমি পাকিস্তানী সৈনিকদের মোকাবিলা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। এবং আজবপুর, আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপূর এবং গোকনঘাটে এক বূহ্য তৈরি এবং শত্রুদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকি।

১১ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভৈরব এলাকায় পাকবাহিনী হেলিকপ্টার এবং জঙ্গি বিমানের সাহায্যে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাপকভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। আমাদের নিকট কোন বিমান বিধ্বংসী কামান ছিল না বলে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারিনি। পাকসেনাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে ১৩ই এপ্রিল আমি কিছু সংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভৈরব, আশুগঞ্জের নিকট পাঠাই যেন মেঘনা নদীর পূর্বপাড়ের এলাকাগুলোতে আমরা বেশ শক্তিশালী থাকতে পারি। ঐ সমস্ত ছেলেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে ষ্টেশনের কাছে পাকবাহিনীর জঙ্গি বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দুজন তরুন শহীদ হয়। এর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন। তার নাম সিপাই মোহাম্মদ মোহসীন। ট্রেনিং প্রাপ্ত যে ছেলেটি শহীদ হয় তার নাম জানা নেই। ঐ দিন আমাদের অপারেশনাল কো-অর্ডিনেশনের জন্য মৌলভীবাজার যেতে হয়। আক্রমণের কথা শুনে আমি মৌলভীবাজার থেকে ১৩/১৪ই এপ্রিল রাত দুটার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে ভোরে প্রায় ৫টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সেদিন কর্নেল রেজা ছিলেন। পাকবাহিনীর আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়াতে আমি সরাইলে যে রিজার্ভ কোম্পানিকে রেখেছিলাম তিনি সেই রিজার্ভ কোম্পানিকে লালপুরে আমাদের লোকদের সাহায্যার্থে পাঠান। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌছে এই খবর পাই যে সরাইলে আমার যে রিজার্ভ কোম্পানি ছিল, তা লালপুর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে। ওয়্যারলেস সেট না থাকাতে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হচ্ছিল। কারণ, কারো কাছে কিছু কিছু বলতে হলে আমাকে রানার দ্বারা অথবা নিজে ফিয়ে যোগাযোগ করতে হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই রিজার্ভ কোম্পানিকে ইচ্ছা থাকলেও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। সরাইলে তাদের রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, যুদ্ধ যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে তাহলে তারা যেন তালশহর ও গোকনঘাট এলাকায় বূহ্য রচনা করতে পারে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শত্রু যদি মেঘনা নদীর পূর্বপারে আমরা যে বূহ্য রচনা করেছি তা ভেদ করে তা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছার পূর্বে তাদের যেন বাঁধা দিতে পারি। তাছাড়া মেঘনা নদীর পূর্বপারে আমার যেসব সৈন্য মোতায়েন আছে তাদের সাহায্যে যেন তারা আসতে পারে। এই রিজার্ভ কোম্পানি লালপুর চলে যাওয়াতে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

১৪ই এপ্রিল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে গিয়ে কিভাবে তাদের ফিরিয়ে আনা যায় তা পরিকল্পনা করছিলাম। এ সময় প্রায় সকাল ৫টায় পাক সেনাবাহিনী আমার বাহিনীর উপর ভীষণভাবে আক্রমণ করে। এই আক্রমনে পাক সেনাবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈনিক রেল লাইন ঘেঁষে ভৈরবের দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটেলিয়ন সৈনিক আইডব্লিটিএ”এলসিটি এবং মোটর লঞ্চের সাহায্যে মেঘনা নদী দিয়ে লালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক এই সময় নরসিংদীর নিকটবর্তী কোন জায়গা থেকে দূরপাল্লার কামান দ্বারা লালপুর, আশুগঞ্জ এবং ভৈরবে ভীষণভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, ছয়খানা এফ-৮৬ বিমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব এবং লালপুর প্রভৃতি জায়গাগুলোতে ভীষণভাবে আক্রমণ করে এবনফ সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ক্রমাগত ছয় ঘণ্টা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। যখন জঙ্গি বিমানের আক্রমণ চলছিল তখন ছয়খানা হেলিকপ্টার দ্বারা কয়েকবার তারা নরসিংদী থেকে প্রায় দুই কোম্পানি কমান্ডার আমাদের পেছনে মেঘনার পূর্বপারে অবতরণ করায়। যুদ্ধ তখন তুমুলভাবে বেধে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের নিকট কোন দূরপাল্লার কামান বা ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বিমান বিধ্বংসী কামান না থাকায় আমাদের সৈনিকদের মনোবল বেশ ভেঙে যায়। কারণ আমরা চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত হই। এভাবে বেলা প্রায় ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবং আমার সৈনিকগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমাদের একত্রিত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যেহেতু আমার নিকট কোন রিজার্ভ ফোর্স ছিল না, তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকটবর্তী শাহবাজপুরে একত্রিত করি। শাহবাজপুর এলাকাটা প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় আমি সিলেটের মাধবপুরে আমার প্রতিরক্ষা বূহ্য নির্মাণ করতে শুরু করি। আশুগঞ্জের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহী কফিলউদ্দিন, সিপাহী আব্দুর রহমান সরকার।

১৪/১৫ই এপ্রিল রাত প্রায় দুটায় শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে যে পুল ছিল তা ভেঙে দিই এবং তিতাস নদীর পূর্বপারে শাহবাজপুরের কাছে একটা বূহ্য নির্মাণ করি। যদিও ১৪ই এপ্রিল আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু তবুও পাকিস্তানী সৈনিকরা দুই দিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ঢুকেনি। এ দুদিন তারা অনবরত ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গোলাবর্ষণ করেছে। তারপর তারা আস্তে আস্তে শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। শাহবাজপুর দখল করার জন্য তারা জল এবং স্থল উভয় পথে আসে। ২১শে এপ্রিল তারা শাহবাজপুর দখল করে। সেদিন তারা আমাদের অবস্থানের উপর বেপরোয়াভাবে দূরপাল্লার কামান দিয়ে এবং জঙ্গি বিমান দিয়ে গোলাগুলি করে। আমাদের কাছে বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার কোন অস্ত্র না থাকায় এবং পাকিস্তানী জঙ্গি বিমানের আক্রমনে আমাদের সৈনিকরা এতই আতংকিত হয়েছিল যে তারা বিমান দেখলেই ভয় পেয়ে যেত।

পাক সৈন্যের শাহবাজপুর দখল করার সাথে সাথে আমি শাহবাজপুর থেকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য বেশ বিপুল সংখ্যক পুল ভেঙ্গে ফেলি। আমরা মাধবপুর বেশ বড় রকমের বূহ্য তৈরি করি। মাধবপুর দখল করার জন্য পাকবাহিনী আমাদের উপর কয়েকবার আক্রমণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ২৮শে এপ্রিল বেলা পাঁচটায় মাধবপুর দখল করে নেয়। এই আক্রমনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রায় দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে। লড়াই সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়। পাকবাহিনী মাধবপুর আক্রমণের জন্য দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে এবং যে গোলাবারুদ তারা ব্যবহার করে তা ছিল হাই এক্সপ্লোসিভ এবং আগ্নেয় ধরনের। কাজেই যেখানেই তাদের গোলা পড়তো সেখানেই আগুন লেগে যেত। পরিখা এবং বাঙ্কার তৈরি করে আমরা যে বূহ্য তৈরি করেছিলাম সেটাও ছিল বেশ মজবুত। কিন্তু আমাদের সাথে রাইফেল, এলএমজি এবং মেশিনগান ছাড়া কোন ভারী অস্ত্র ছিল না। বেলা প্রায় ১২টার মধ্যে আমাদের অবস্থানের চারপাশে শুধু আগুন জ্বলছিল। তবুও আমাদের জোয়ানরা কেউই তাদের ট্রেঞ্চ এবং বাঙ্কার ছেড়ে যায়নি। বাঙ্কার এবং ট্রেঞ্চে বসে শত্রু নিপাত করছিল। বেলা প্রায় সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানী সৈনিকরা মাধবপুর দখল করার জন্য আমাদের অবস্থানের দিকে দলে দলে অগ্রসর হয় এবং ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। আমাদের মেশিনগান, এলএমজি এবং রাইফেল তাদের অগ্রসর হতে দিচ্ছিল না। তাদের যে দলই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল সে দলটিকেই গুলি করে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছিল। মাধবপুরে যখন এভাএ মুখোমুখি যুদ্ধ চলছিল তখন আমি মাধবপুরে পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে অপর একটি ছোট সৈনিক দলকে লেঃ মুরশেদের নের্তৃত্বে পাঠায় যাতে সে তাদের পিছন দিয়ে আক্রমণ করতে পারে। তার আক্রমণও বেশ ফলপ্রসূ হয়। সারাদিন যুদ্ধ করার পর আমাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে যায়। এবং দক্ষিন-পশ্চিমাংশের এক অংশের সৈনিকদের গোলাবারুদ একেবারেই ফুরিয়ে যায়। ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে গোলাবারুদ পাঠানো সম্ভব হয় নাই, এমনকি তারাও কোন খবর দিতে পারেনি। এখানে একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল। যখন আমাদের সৈনিকদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায় তখন তারা অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে আসে। অনুরূপ পাকবাহিনীও যারা আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তারাও গোলাগুলি না করে পিছনের দিকে চলে যায়।

এই অবস্থা সুরক্ষিত না থাকায় পর মুহুর্তে পাকবাহিনীর কিছু সৈনিক আমাদের বূহ্যের ভিতর ঢুকে পরে। এতে আমাদের অবস্থান রক্ষা করা আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এখানে রীতিমত হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। অবশেষে আমি তাদের হুকুম দিতে বাধ্য হই তারা যেন পেছনে চলে আসে। এই যুদ্ধে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ
১। ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল),
২। ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর),
৩। সুবেদার করিম (বর্তমানে সুবেদার মেজর),
৪। হাবিলদার এরশাদ,
৫। সিপাহী সোলেমান,
৬। সিপাহী মান্নান,
৭। সিপাহী খায়ের (শহীদ)।

এ যুদ্ধে আমার অনুমান পাকিস্তানী সৈনিক খুব হলেও ২৭০ থেকে ৩০০ জন হতাহত হয়েছিল। মাধবপুরের যুদ্ধে সিপাহী খারে এবং সিপাহী শাহজাহান শাদাত বরণ করেন। তাছাড়া বেশ কিছু সংখ্যক আহত হয়। মাধবপুর থেকে সরিয়ে আমি তাদের সিলেটের মনতলাতে নিয়ে আসি এবং নতুন করে আবার বূহ্য তৈরি করার নির্দেশ দেই।

মাধবপুরের যুদ্ধের পর যেসব এলাকা আমার নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল সেগুলো হল, উত্তরে শ্রীমঙ্গল, শায়েস্তাগঞ্জ এবং দক্ষিনে তেলিয়াপারা, মুকুন্দপূর, সিঙ্গারবিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার দিক থেকে শাহবাজপুর এবং মাধবপুরেরদিকে আসছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল যত শীঘ্র হোক সিলেটের সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করা। তাই তারা মরিয়া হয়ে সিলেট হাইওয়ে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট হাইওয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

আমাদেরও চেষ্টা ছিল যাতে করে তারা এ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। তাই সিঙ্গারবিল থেকে শাহজিবাজার পর্যন্ত এক প্রতিরক্ষা বূহ্য নির্মাণ করি। পাকিস্তানীরা কেবলমাত্র ঢাকা থেকে সৈন্য এনে সিলেটের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল না, তারা কুমিল্লার দিক থেকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কুমিল্লার দিক থেকে যে সমস্ত সৈন্য অগ্রসর হচ্ছিল তাদের বাঁধা দেয়ার জন্য মেজর খালেদ মোশারফ কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে লাইনের উপর নিম্নলিখিত জায়গায় পুল ভেঙ্গে দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে, যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় অগ্রসর হতে না পারে। যে সব পুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হলঃ
উজানিসার হাইওয়ে ব্রীজ,
গঙ্গাসাগর এবং আখাউড়া রেলওয়ে ব্রীজ।

আমরা নিম্নলিখিত কারনে পাকিস্তানী সৈনিকদের অগ্রগতি রোধ করতে পারছিলাম নাঃ আমাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল কম। তাছাড়া আমাদেরকে এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরক্ষা বূহ্য তৈরি করে পাকিস্তানী সৈনিকদের বাঁধা দিতে হচ্ছিল। অপরদিকে পাকিস্তানী সৈনিকরা এক যায়গায় কন্সেন্ট্রেট ছিল এবং তাদের সৈন্য সংখ্যাও বেশি ছিল। ফলে আমাদের পক্ষেও অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তাদের সৈন্য সংখ্যাই বেশি ছিল না, তাদের বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। যেহেতু আমরা সিলেট হাইওয়ের উপর তেলিয়াপাড়াতে প্রতিরক্ষাবূহ্য তৈরি করে রেখেছিলাম সেহেতু পাকিস্তানী সৈন্যরাও ঐ বূহ্য ভেদ করে অগ্রসর হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল। কারণ সিলেটে অগ্রসর হতে হলে ঐ প্রতিরক্ষা বুহ্য ভেদ করা একান্ত প্রয়োজন ছিল।

শেরপুর এবং শাদিপুর আমাদের যে সকল বূহ্য ছিল সেগুল্র পতন হয় ২৪শে এপ্রিল তারিখে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীরা প্রায় দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য সিলেটের দিক থেকে মোতায়েন করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের বেশসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। এই যুদ্ধে নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আজিজ (বর্তমানে মেজর)। যুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন আজিজ জেট জঙ্গি বিমানের গুলিতে আহত হন। আমাদের যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহী মোহসীন, সিপাহী শাহাদৎ হোসেন, নায়েক সুরত আলী, সিপাহী রহিউদ্দিন মোল্লা, মোজাহিদ সুরদন নমশুদ্র।

শেরপুর-শাদিপুর পতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতহত করার জন্য সিলেটে আমাদের সৈন্য সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না। তাই তারা অতি সহজে এবং শীঘ্রই সিলেটের দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তেলিয়াপাড়া তখনও আমাদের অধীন ছিল। পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়াকে বাইপাস করে শাহজীবাজারের শায়েস্তাগঞ্জের দিকে চলে যায় এবং সিলেট থেকে আরো অগ্রসরমান পাকসেনাদের শ্রীমঙ্গলে এসে যোগাযোগ হয়। তখন থেকে ঢাকা-সিলেট রাস্তা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়। কিন্তু তেলিয়াপাড়া আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকায় পাকবাহিনী সহজে চলাফেরা করতে পারতো না। কেননা তেলিয়াপাড়া থেকে চুনারুঘাট পর্যন্ত চা বাগানের ভেতর দিয়ে যে হাইওয়েটা চলে গিয়েছিল সেটা তাদের মরণ ফাঁদ ছিল। প্রত্যেক দিনই পাকিস্তানী সেনারা এমবুশের সম্মুখীন হতো এবং তারা বেশ হতাহত হত।

সিলেট হাইওয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা পর্যন্ত আমরা যেভাবে যুদ্ধ করছিলাম সেটা ছিল প্রথাগত যুদ্ধ। কিন্তু সিলেট হাইওয়ে পতনের পর আমাদের যুদ্ধের পদ্ধতি বদলিয়ে ফেলে গেরিলারা ওয়ারফেয়ার শুরু করি। কিন্তু কনভেশনাল ওয়ারফেয়ার একেবারে বাদ দেইনি। তবে এখন থেকে আমাদের যুদ্ধের প্রধান পদ্ধতি ছিল গেরিলা ওয়ারফেয়ার। আমরা যে সমস্ত ক্যাম্প খুলেছিলাম তা ছিল প্রধানত গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য। তাছাড়া কিছু সংখ্যক ট্রেনিং ক্যাম্প কনভেনশনাল পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার প্রশক্ষন দেয়া হত। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য যে সমস্ত ক্যাম্প খোলা হয়েছিল সেগুলোতে আমাদের ইন্সট্রাক্টর ছারাও বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আমরা বেশকিছুসংখ্যক ইন্সট্রাক্টর পেয়েছিলাম। কিন্তু যে সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্পে কনভেনশনাল যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেয়া হত সে ক্যাম্পগুলোর ইন্সট্রাক্টর সমস্ত আমাদেরই ছিল।

গেরিলা বাহিনী সম্বন্ধে দু-চারটা কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বা মুক্তির জন্য সমস্ত জনগন (নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনী) মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এই মুক্তিবাহিনীর দুটি অংশ ছিল। একটিকে নিয়মিত বাহিনী বলা হত। অপরটি গেরিলা-তাকে গণবাহিনী বলা হত। এ নামগুলো বাংলাদেশ সরকার দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের নিয়মিত বাহিনী “মুক্তিফৌজ” নামে পরিচিত ছিল। এবং গণবাহিনী ফ্রিডম ফাইটার (এফ,এফ) হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

এটা আমাদের জানা ছিল যে, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা সম্ভব নয়। দেশ জয় করতে হলে আমাদের নিয়মিত বাহিনী দরকার। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র কিন্তু এ ব্যপারে একমন ছিল না। যদিও এটা তাদের অজানা নয় যে দেশ জয় করতে হলে রেগুলার ফোর্সের দরকার, শুধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা যায় না। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত রেগুলার ফোর্স বা নিয়মিত বাহিনী গঠন করার বিরুদ্ধে এই জন্য ছিল যে, তারা হয়তো মনে করতো যদি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান দখল করার সুনাম সম্পূর্ণ যেন তারা নিতে পারে। কিন্তু আমরাও পেশাদার সৈনিক ছিলাম। তাই তাদের এসব পরামর্শে আমরা কখনো কর্ণপাত করিনি এবং আমরা গেরিলা বাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও গড়ে তুলি।

তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাটের মরণফাদ থেকে বাচার জন্য পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠে। আমি তখন তেলিয়াপাড়ার বূহ্যকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকি। কারণ এটা শুধু আমার ডিফেন্সই ছিল না, এটা ছিল আমার হেডকোয়ার্টার।

পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়া তাদের আয়ত্তে আনার জন্য ক্রমাগত ২১ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এ যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আরও একজন অফিসার আমার সাথে যোগ দেয়। তার নাম ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া (বর্তমানে মেজর)। যেসব অফিসারের উপর তেলিয়াপাড়া রক্ষা করার ভার দেই তারা ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর), লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন), এ ছাড়াও কিছু সংখ্যক কলেজের ছাত্রও ছিলেন। তাঁরা হলেন শহীদ সেলিম আহসান, আনিসুল হাসান, ফজলে হোসেন, আনিসুর রহমান (পরবর্তীকালে এরা সবাই সেনাবাহিনীর কমিশন পান এবং অফিসার হন)। এদের মধ্যে সেলিম মিরপুর অপারেশনে শহীদ হন এবং আনিস তার কলেজ জীবনে ফিরে যান।

তেলিয়াপাড়া ব্যূহ রক্ষা করার জন্য যে ২১ দিন হয়েছিল সেই যুদ্ধে এই সমস্ত অফিসার এবং সৈনিকরা মনোবল ও সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ২১ দিন লড়াইয়ের মধ্যে পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়ার উপর প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে পাঁচবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাঁরা তিনবার আমাদের কাছ থেকে তেলিয়াপাড়া দখল করে। আমরা দুবার তাদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই। কিন্তু তৃতীয় বারে তাদের সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র এত বেশী ছিল যে তালিয়াপাড়া ঐবার আর দখল করা যায়নি। ১৯ শে মে শেষ পর্যন্ত তেলিয়াপাড়ার পতন হয়। তালিয়াপাড়ার যুদ্ধে যারা শাহাদত বরণ করেন তাঁরা হলেনঃ সিপাই মোবারক আলী, সিপাই রংগু মিয়া, নায়েক নিজাম উদ্দিন, ল্যান্স নায়েক আসলাম মিয়া, সিপাই আব্দুল গফুর মিয়া, সিপাই আলী আজম ভুঁইয়া, সিপাই জামাল উদ্দীন, সিপাই আবু মিয়া, মোজাহিদ গিয়াস উদ্দীন, মোজাহিদ আলকাস মিয়া।

এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত গেরিলা অপারেশনগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ

মাধবপুর এ্যামবুশ, ১৪ মেঃ
মাধবপুরের পতনের পর পাক সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়ক ব্যাবহার করতে শুরু করে। যদিও ঐ সড়কের স্থানে স্থানে আমরা পুল ভেঙ্গে দিয়েছিলাম তবুও তাঁরা বিকল্প পথ তৈরী করে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তাদের যাতায়াতে বাঁধা দেবার জন্য মাধবপুরের কাছে ঐ এক বিকল্প সড়কের উপর পাকবাহিনীকে এ্যামবুশ করার জন্য ১৪ই মে তারিখে লেঃ মোরশেদের নেতৃত্বে ১২ জন সৈনিকসহ একটি দল পাঠাই। এ দল ঐ জায়গাতে রাত প্রায় দুটায় পৌঁছে এবং বিকল্প সড়কের উপর দু’খানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পেতে তারই পাশে ওত পেতে বসে থাকে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল এবং সকাল প্রায় ৮টা পর্যন্ত এ সড়কে পাক সেনাবাহিনীর কোন গাড়ী না চলাতে দেখে তাদের এমনিই বসে থাকতে হয়। বৃষ্টিতে তারা সবাই ভিজে যাওয়াতে নিকটবর্তী এক গ্রামে আশ্রয় নেয়। গ্রামে এক নির্জন বাড়ীতে যখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন সিলেটের দিক থেকে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন পাকবাহিনী ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এই কনভয়ের সবচেয়ে প্রথম গাড়ীটি ছিল একটি জীপ গাড়ী। ঐ জীপ গাড়ীটি বিকল্প পথ দিয়ে যাবার সময় ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং সাথে সাথে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এই গাড়ীটি ধ্বংস হবার পর আমাদের সৈনিকরা সেখানে (ঐ বাড়ীতে) নীরবে বসে থাকে এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। প্রথম গাড়ীটি বিধ্বস্ত হবার পর তার পেছনের গাড়ীটি দ্রুত এগুবার চেষ্টা করে। ফলে সেটিও মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হবার সাথে সাথে পাক সৈনিকরা বিপদ দেখে গাড়ী থেকে দ্রুত নেমে পড়ে এবং ঐ পুরো গ্রামখানি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের এ্যামবুশ দলটিতে মোট ১২ জন লোক ছিল। আর শত্রুপক্ষের খুব কম হলেও প্রায় ৪০০ লোক ছিল। আমাদের লোকজন যখন দেখল যে তারা প্রায় ঘেরাও হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা শত্রুদের উপর গুলি ছুড়ে ট্যাকটিক্যাল উইথড্র করে আসতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পেছনে প্রায় তিন মাইল পর্যন্ত ধাওয়া করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এখানেই সর্বপ্রথম ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে দু’খানা যানবাহন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং ঐসব গাড়ীতে যারা ছিল তাদের অধিকাংশ হতাহত হয়। এই এ্যামবুশে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ
১। লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)
২। সেলিম (ছাত্র) পরবর্তীকালে লেঃ (শহীদ)
৩। আনিস (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট)।

নালুয়া চা বাগানের এ্যামবুশঃ
১৫/১৬ই মে, ১৯৭১ সন-১৫/১৬ই ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ১২/১৩ জন সৈনিক নিয়ে নালুয়া চে বাগানে সিলেট সড়কের উপর এক এ্যামবুশ তৈরী করে। ঐ দিন প্রায় এক কোম্পানী পাকসেনা সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাচ্ছিল। বিকেল প্রায় দুটার দিকে তারা ঐ এ্যামবুশের ভেতরে চলে আসে এবং চারিদিক থেকে আমাদের সৈনিকরা তাঁদের উপর গোলাবর্ষণ করতে শুরু করে। ঐ এ্যামবুশে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। এ এ্যামবুশ এত কার্যকরী ছিল যে পাকসেনা বাহিনীর এক কোপানী সৈনিকের মধ্যে অধিকাংশই নিহত হয়। তিনখানা গাড়ী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় এবং দু’খানা গাড়ী বিকল হয়ে যায়। আমাদের সৈন্য সংখ্যা বেশী না থাকাতে সে স্থান ত্যাগ করে পিছে চলে আসতে বাধ্য হয়। পরে চা বাগানের শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পারা যায় প্রায় ৬৫ জনের মত পাকসেনা নিহত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে যারা বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
১। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বর্তমানে মেজর)
২। হাওয়ালদার আবুল কালাম (বর্তমানে সুবেদার)।

তেলিয়াপাড়া এ্যামবুশ ১৬ই মে, ১৯৭১ সন-মতিন তখন তেলিয়াপাড়ায় নিযুক্ত ছিলেন। নালুয়া চা বাগানে এক কোম্পানী পাকসেনা এ্যামবুশ হবার পর তাদের বেশকিছুসংখ্যক হতাহত হয়। তাদের সাহয্যার্থে চুনারুঘাট থেকে আরো কিছুসংখ্যক সৈন্য একত্রিত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তেলিয়াপাড়ার নিকট তারা পুনরায় এ্যামবুশ হয়। এই এ্যামবুশ-এর নেতৃত্ব দিচ্ছিল ক্যাপ্টেন মতিন। এ এ্যামবুশেও ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। পাকসেনাদের একখানা গাড়ী ধ্বংস হয় এবং বেশ কিছু সংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়।

যেহেতু আমাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ছিল “হিট এণ্ড রান”- শত্রুনিপাত এবং নিজের কম ক্ষতি। তাই আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে শত্রুর উপর আঘাত হেনে পিছনে চলে আসত। কিছুদিন পর জানা গিয়েছে যে ঐ এ্যামবুশে প্রায় ৪০/৫০ জন পাকসেনা হতাহত হয়েছিল। তেলিয়াপাড়া এ্যামবুশঃ ১৯শে মে ১৯৭১ সন-তেলিয়াপাড়ার এই দিন পতন ঘটে। মুর্শেদ ছিলেন এর প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত। পাকসেনারা যখন সিলেট সড়কের উপর বার বার এ্যামবুশ হচ্ছিল এবং ১৬ তারিখের এ্যামবুশে যখন তাদের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন বোধহয় তাদের সাহায্যার্থে পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট অভিমুখে আসে। সেদিন রাতেই তেলিয়াপাড়ার চা বাগানের নিকটবর্তী এলাকার চারখানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে আমাদের সৈনিকেরা সিলেট সড়কের উপর ওত পেতে বসে থাকে। এই এ্যামবুশের নেতৃত্ব দিচ্ছিল লেঃ মোর্শেদ। দলে তার লোক ছিল ১৫ জন। কনভয়-এর প্রথম গড়িটি মাইনের উপর দিয়ে চলে যায় কিন্তু মাইন ফাটেনি। যখন দ্বিতীয়, তৃতীয় গাড়ী মাইন অতিক্রম করছিল সাথে সাথে দুখানি গাড়ীই একত্রে বিধ্বস্ত হয়। পেছনের গাড়ীতে যে সমস্ত পাকসেনা ছিল তারা গাড়ী থেকে পিছনে বেশ কিছু দূরে এক খোলা ময়দানে একত্রিত হয়। পাকসেনাদের দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ খোলা মাঠের নিকটবর্তী এলাকায় আমাদের একদল লোক মেশিনগান নিয়ে ওত পেতে বসেছিল। এবং পাকসেনাদের যারা এখানে একত্রিত হয়েছিল তাদের প্রায় সবাই মেশিগানের গুলিতে হতাহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সৈন্য এসে সে সব মৃতদেহ ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মোজাহেদ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। পরে সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ এ্যামবুশে পাকসেনাদের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র এবং একখানা গাড়ী আমাদের হস্তাগত হয়। এছাড়া তাদের তিনখানা গাড়ী বিধ্বস্ত হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা ১৩০ থেকে ১৫০ জনের মত ছিল।

Source: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!