You dont have javascript enabled! Please enable it!

৩১ জুলাই, ১৯৭১ প্রবাসী সরকার
জাতিসংঘের মহাসচিব উ‘থান্টের কাছে প্রেরিত বার্তায় বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর জানায়, দেশের জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে পাশ কাটিয়ে শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

সৈয়দপুর জমজম বিমানবন্দর নির্মাণ ও আত্মসমর্পণ
(লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলি জহির এর অনলাইনে দুইটি লেখাকে একত্রিত করে, একটি লেখার ভুল সংশোধন ও দুইটি লেখার সম্পাদনা )
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল সৈয়দপুর। সৈয়দপুর শহরটি ছিল মূলত অবাঙালি অধ্যুষিত। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর থেকেই সৈয়দপুর ও এর আশপাশের এলাকার বাঙালিদের ওপর অত্যাচার শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর অবাঙালিরা। বিপুল সংখ্যক বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারকেরা সৈয়দপুরে একটি পূর্ণ বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সৈয়দপুরে সেনানিবাসের অবস্থান ও অবাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণেই তারা এই শহরকে নিরাপদ মনে করত। বিমানবন্দরের জন্য টার্মিনাল বিল্ডিং ও রানওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলো, যেন সেখানে সামরিক বাহিনীর বড়ো আকারের বিমান অবতরণ ও উড্ডয়ন করতে পারে। তাছাড়াও এই বিমানবন্দর নির্মিত হলে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোতে আরও দ্রুত বিপুল সংখ্যক যুদ্ধসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী প্রেরণ করা সম্ভব হবে। তখন ফেরির মাধ্যমে যমুনা নদী পার হতে হতো এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই ফেরি আক্রমণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তা ছাড়া ভবিষ্যতে বড়ো ধরনের যুদ্ধের সময় এই বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান ব্যবহার করা সহজতর হবে। এসব বিবেচনায় সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের নিয়ন্ত্রণে ২৬ এফ এফ এর তত্ত্বাবধানে এই কাজ শুরু হয়।
একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করতে অনেক শ্রমিক ও অর্থের প্রয়োজন হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা আলাপ-আলোচনা করে সৈয়দপুর ও এর আশপাশের গ্রামের নিরীহ বাঙালিদেরকে বাধ্যতামূলক শ্রমের জন্য ব্যবহার করা হবে বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এই লক্ষ্যে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় সৈয়দপুর ও এর আশপাশের গ্রাম থেকে প্রায় ৩ হাজার বাঙালি পরিবারের পুরুষদেরকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে আসে এবং তাদেরকে সৈয়দপুর হাই স্কুল, নিকটবর্তী দারুল উলুম মাদ্রাসা ও টেকনিক্যাল স্কুলে বন্দি করে রাখে। সৈয়দপুর শহর ও আশপাশের হাজারিহাট, মোতলাবাড়ি, কামারপুকুর, লক্ষণপুর, কাশীরামপুর, সোনারা গ্রাম থেকে তাদেরকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী প্রায় ৮০০জন বাঙালিকে রেখে বাকিদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ব্যক্তিমালিকানার প্রায় ৩৫টি ট্রাক শিবিরের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বন্দি বাঙালিদেরকে ট্রাকের পিছন দিয়ে ওঠার জন্য নির্দেশ দেয়া হতো। যদি কেউ ট্রাকে উঠতে দেরি করতেন তাহলে তাকে লাথি মেরে এবং চাবুকের আঘাতে ট্রাকে তোলা হতো। কড়া পাহারায় রানওয়ে এলাকায় নিয়ে সারাদিন তাদেরকে দিয়ে রানওয়ে স¤প্রসারণের জন্য মাটি কাটা, পাথর আনা, পাথর বিছানো ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করানো হতো। শ্রমিকদের মধ্যে সব বয়সি পুরুষই ছিলেন। সারা দিন তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো; কিন্তু বিনিময়ে তাদেরকে দিনে মাত্র একটি করে মোটা রুটি খেতে দেওয়া হতো। কয়েকজনকে আশপাশের গ্রাম থেকে পানি আনার জন্য পাঠানো হতো এবং তাদেরকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত কয়েকজন সৈন্য। রুটিগুলো এত শক্ত ছিল যে হতভাগ্য মানুষগুলো রুটি পানিতে ভিজিয়ে কোনোমতে গলাধঃকরণ করতেন।
প্রবীণ ব্যক্তিরা যারা দ্রুত কাজ করতে পারতেন না তাদেরকে চাবুকের আঘাত করা হতো। ক্ষুধার জ্বালা আর চাবুকের আঘাত সহ্য করতে না পেরে অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। অবাঙালিরা অসুস্থদের সম্বন্ধে নিজেদের মধ্যে আলাপ করত যে, তাদেরকে আর রেখে লাভ নাই। তাদের নাম ‘খরচাখাতা’য় লেখা হবে। এর অর্থ ছিল যে, তাদেরকে মেরে ফেলা হবে। তাছাড়াও তাদের ইচ্ছামতো যদি কোনো শ্রমিক কাজ করতে সক্ষম না হতেন তাহলে তাদেরকে সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে অত্যাচার করে পুনরায় কাজে পাঠানো হতো। অত্যাচারের ভয়ে নিরীহ বাঙালিরা যতটা সম্ভব কাজ করে যেতেন।
বিমানবন্দরের চারদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সর্বক্ষণ পাহারার ব্যবস্থা করেছিল যেন কোনো বাঙালি পালিয়ে যেতে না পারেন। যদি কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন তাকে গুলি করে হত্যা করা হতো। অবাঙালিরা চাবুক ও বেত নিয়ে বাঙালিদের কাজের তদারকি করত। তারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানান কট‚ক্তি করত এবং বাঙালি জাতিকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করত।
বিমানবন্দর নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা প্রায়ই লক্ষ্য করতেন যে, তাদের মধ্যে অনেকেই অনুপস্থিত। তারা ধারণা করতে পারেন যে, কাজে অক্ষম শ্রমিকদেরকে হয়ত মেরে ফেলা হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জাভেদ, ক্যাপটেন গুল, সুবেদার ফতেহ খানকে এই কাজের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ক্যাপটেন গুল প্রায়ই কোমর থেকে পিস্তল বের করে শ্রমিকদেরকে গুলি করার ভয় প্রদর্শন করত এবং সুবেদার ফতেহ খান চাবুক দিয়ে প্রায়ই শ্রমিকদেরকে আঘাত করত। তাছাড়াও আরও অনেক নিরীহ বাঙালিও বিমানবন্দর নির্মাণকাজে নিয়োজিত ছিলেন। মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন সৌভাগ্যবান বাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
১৯৭১ সালের মে-অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ অব্যাহত ছিল। কাজ শেষ হওয়ার পর শ্রমিকদের মধ্যে অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল।
নিরীহ বাঙালিদেরকে বলপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে অন্তরীণ করে রাখা, বলপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত করা, কাজের সময় অত্যাচার করা ও শ্রমিকদেরকে হত্যা করা – সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের সময় এসবই প্রয়োগ করা হয়েছিল। সৈয়দপুরে সংঘটিত এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে যে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি স্থানের মতো বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে বলপূর্বক শ্রম আদায়ের পর শ্রমিকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বিকালে এই বিমানবন্দরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেদিন সৈয়দপুরে অবস্থানরত ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ও তাদের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল মো. শফি পিছনে দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৩৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, ৮৩ মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বস্তুত ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এই বিমানবন্দর নির্মাণকাজে নিয়োজিত ছিল। এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরাইশী ।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণকাজে যে-সকল পাকিস্তানি সৈন্য নিরীহ বাঙালিদেরকে দিয়ে বলপূর্বক শ্রম করিয়েছিল ১৭ই ডিসেম্বর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে তারাই নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করেছিল।
এদিন ‘ওদের পরনে শুধু খাকি পোশাকটাই ছিল। কোনো রেঙ্ক ব্যাজ ছিল না, কোমরে ছিল না বেল্ট। এমনকি পায়ে ছিল না ভারী বুট। বিমর্ষ দেখাচ্ছিল হানাদারদের। অথচ দুদিন আগেও ওদের বদমেজাজি হিংস্র চেহারা ছিল, কথায় কথায় বাঙালিদের বুকে গুলি চালাত।’
আত্মসমর্পণের দৃশ্যের বিবরণ পাওয়া যায় মিত্রবাহিনীর লে. কর্নেল দলজিৎ সিংয়ের লেখায়। ঢাকা থেকে একটি হেলিকপ্টারে সেখানে উড়ে আসেন তিনি। নেমে স্যালুট করেন সৈয়দপুর সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম শফিকে। করমর্দনের পর দলজিৎ সিং বলেন, ‘ভালো হতো এর চেয়ে আনন্দদায়ক কোনো পরিস্থিতিতে যদি আমাদের মোলাকাত ঘটত।’ ব্রিগেডিয়ার শফি মৃদু কণ্ঠে জবাব দেন, ‘একেই বলে যুদ্ধের কপাল। আমি মাত্র পাঁচ দিন আগে এখানকার দায়িত্ব নিয়েছি।’

দলজিৎ সিংয়ের হিসাবে ১৭ তারিখ বিকেল সাড়ে চারটায় সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ভারতীয় ৭১ ব্রিগেড কমান্ডার কাথাপালিয়ান এর কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রায় পাঁচ হাজার পাকিস্তানি সেনা।(২০০৮ এ এদেশে এসেছিলেন) এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৮ জন অফিসার আর ১১৪ জন জেসিও। দিল্লির নির্দেশে এই দৃশ্যের কোনো ছবি ধারণ করা হয়নি বলে আফসোস করেছেন দলজিৎ সিং।
দলজিৎ সিংয়ের লেখাতে স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, দিনাজপুরের ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশি টানা কাঁদছিলেন। অশ্রুর ধারা তাঁর পাকানো গোঁফে এসে শুকিয়ে গেছে। তাঁর গলাও ধরে আসা। দলজিৎ সিং লিখেছেন, ‘এভাবে পূর্ণবয়স্ক লোকজনকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখা সত্যি হৃদয়বিদারক।
(নোটঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১০ম খণ্ডে এই কাহিনী নাই। সুলতান শাহরিয়ার রশিদের বর্ণনায় শুধু আত্মসমর্পণের কথা আছে আর তার বর্ণনায় দেখা যায় সৈয়দপুর দখল নিতে ৭১ এর যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈন্য এর ৭০ শতাংশ এখানেই মারা গেছে। চাপা?)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!