You dont have javascript enabled! Please enable it! আইয়ুব খানের দশক | কর্নেল শওকত আলী - সংগ্রামের নোটবুক

আইয়ুব খানের দশক

মােহাম্মদ আইয়ুব খান এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবেন, যিনি মূলত পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী। পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার নামে তিনি এর ভিত্তিমূলই দুর্বল করে ফেলেছিলেন। তাঁর কাছে ফেডারেশনের ধারণা বা ফেডারেল সরকারের কাঠামাে বা প্রদেশগুলাের স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি কোনাে কিছুই বিবেচনার যােগ্য ছিল না। তিনি নিজের পছন্দের ও আজ্ঞাবহ লােক দ্বারা শাসিত প্রদেশসহ এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা তার রাজসিক চিন্তা ও চালচলনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ ছিল। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি পাকিস্তানের বিভক্তি চাননি, বরং তিনি আন্তরিকভাবে একটি শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কৃতকর্ম বিপরীত ফল বয়ে এনেছিল এবং সে রকম হওয়াই অবধারিত ছিল। তিনি জাতীয় ঐক্যের কথা বলতেন কিন্তু তাঁর পদক্ষেপগুলাে ধারাবাহিকভাবে অনৈক্যকে ত্বরান্বিত করেছিল। এটা যেকোনাে উচ্চাভিলাষী জেনারেল বা কর্নেল কিংবা অন্য যেকোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের জন্য উৎকৃষ্ট শিক্ষা হতে পারে যে, সঠিক রাজনৈতিক দর্শন ও জনগণের মতামত ছাড়া শুধু সাধু চিন্তা আর প্রয়ােজনীয় বলপ্রয়ােগ দিয়ে আর যা-ই হােক, ভালাে কিছু করা সম্ভব নয়। জাতীয় প্রেক্ষাপটে, আজ যা করা হয় কয়েক বছর পর তার ফলাফল উপলব্ধি করা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে কৃত অনেক কর্মের ফল সম্মিলিতভাবে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কর্মের নায়কদের কাছে তাদের কর্মগুলাে যতই দেশপ্রেমমূলক মনে হােক না কেন। দুর্বল অর্থনীতির একটি অনুন্নত দেশের একজন সেনাপ্রধানের পক্ষে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা
পৃষ্ঠাঃ ৭০

কুক্ষিগত করা সহজ কিন্তু দেশ পরিচালনা করা এবং দেশের উন্নতি করা খুব সহজ কাজ নয়। সেনাবাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে সামরিক স্বৈরশাসকেরা মাঝে মাঝে বিপ্লব নামে অভিহিত করে থাকেন, যেমনটি আইয়ুব খান করেছিলেন । কিন্তু আসলে এ রকম ঘটনায় বিপ্লবের বিপরীত ফল হতে বাধ্য। অনেকে আবার এটাকে জনগণের সামরিক শাসন বলে থাকেন, যেমন বাংলাদেশে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছিলেন। অথচ এতে জনগণের কোন সম্পক্ততাই ছিল না। এরশাদ এ কথাও বলে থাকেন, ক্ষমতা দখলের তাঁর কোনাে ইচ্ছা ছিল না, তাকে ক্ষমতা দখলে বাধ্য করা হয়েছিল। এরচেয়ে মিথ্যাচার ও উদ্ভট কথা আর হতে পারে না।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ছিল দীর্ঘদিনের লালিত আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন, যদিও আইয়ুব খান দাবি করতেন, ক্ষমতা গ্রহণের জন্য গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের অনুরােধ তিনি বারবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জনগণের ইচ্ছা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার প্রতি স্রেফ অবজ্ঞা প্রদর্শন ছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির আরেকটি কারণ। অসাংবিধানিকভাবে সরকার পরিবর্তন এবং নতুন শাসক কর্তৃক কিছু সংস্কারমূলক কাজ করলেই বিপ্লব সংঘটিত হয় না। বিপ্লবের লক্ষ্য হতে হবে পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী চিন্তা থেকে উৎসারিত সামাজিক ব্যবস্থা, যা মানুষ কর্তৃক মানুষকে শােষণের জন্ম দেয় ও বিস্তার ঘটায় তাকে আঘাত করা। বেশির ভাগ অভ্যুত্থানের নায়ক একটা ভুল ধারণা পােষণ করে থাকেন। তারা মনে করেন, তাদের উপলব্ধি বা উদ্ভাবনী ক্ষমতা কিংবা উর্বর চিন্তাধারা দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে। জনগণ সক্রিয় না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় দেশ যে ক্রমান্বয়ে অধঃপতনের দিকে ধাবিত হতে থাকে, এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে তারা ব্যর্থ হন। অভ্যুত্থানের নেতারা ভুলে যান যে গণমুখী দর্শন ছাড়া কেবল শক্তির জোরে দেশ শাসন করা যায়, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না। তারা শাসক হতে পারেন, কিন্তু নেতা হতে পারেন না। আধুনিক যুগ যাদের চায় তারা নেতা, আর মানবজাতি যাদের পেছনে ফেলে এসেছে তারা শাসক।
মােহাম্মদ আইয়ুব খান যুক্তরাজ্যের স্যান্ডহার্স্ট রয়াল মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন-পূর্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, চমৎকার ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণীয় দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারী একজন ভালাে জেনারেল ছিলেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে চমৎকার দায়িত্ব পালন করছিলেন। একজন পেশাগত সৈনিকের গৌরব ও কৃতিত্ব নিয়ে তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৭১

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে পারতেন। রাজনীতিতে তার কোন আগ্রহ থাকলে তিনি তা অবসর নেওয়ার পরও করতে পারতেন। কিন্তু সে রকম সম্মানজনক পথ অনুসরণ না করে তিনি সৈনিকের শপথ ভঙ্গ করেছিলেন এবং এর জন্য তাঁকে অসম্মানিত হতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় তিনি পাকিস্তান ভাঙার কাজটি ত্বরান্বিত করেছিলেন এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি তাঁর ১০ বছরের (১৯৫৮-১৯৬৮) শাসনকে ‘উন্নয়নের দশক’ হিসেবে ঘােষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল অনৈক্য, অসন্তোষ, মূল্যবােধের অবক্ষয়, দুর্নীতির বিস্তার, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিলুপ্তি, ধনীর আরও ধনী হওয়া এবং দরিদ্রের আরও দরিদ্র হওয়ার দশক। তার মৌলিক গণতন্ত্রের ধারণাটি ছিল গণতন্ত্রের অস্বীকৃতি। পাকিস্তানে যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিকশিত হওয়ার সুযােগ থাকত এবং কার্যকর হতো, তাহলে পাকিস্তান অনেক বেশি শক্তিশালী হতাে। তার পরিবর্তে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নামে তিনি জন-অংশগ্রহণশূন্য এমন এক রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, যা ছিল মূলত তার সমর্থকদের জন্য খােলামেলাভাবে রাজনৈতিক সুবিধা ভােগ ও লুটপাটের এক স্বর্ণযুগ। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের মােট ৮০ হাজার চেয়ারম্যান ও মেম্বারের একটি গােষ্ঠীকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করেছিলেন, যারা ছিলেন তাঁর তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য বা বিডি (বেসিক ডেমােক্র্যাট) মেম্বার। একই প্রক্রিয়ায় বিডি মেম্বাররা তাঁদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতেন। ওয়ার্কস প্রােগ্রামের (বর্তমানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচি) মূল সুবিধাভােগী ছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রীরা। তারা বেশির ভাগ আইয়ুব খানের দলীয় লােক ছিলেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সুযােগ-সুবিধা ভােগ করতেন। তাঁরা কায়েমি স্বার্থবাদী একটি শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিলেন। তদুপরি তাঁরা ছিলেন পুরােপুরি আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া বা তাঁর দলীয় লােকজনের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হওয়া কঠিন হতাে না। জনগণের মঙ্গলার্থে এই ধারণার উৎপত্তি হয়নি। বরং এর উৎপত্তি হয়েছিল আইয়ুব খানের ক্ষমতাকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানাের জন্য, জনগণের কপালে যা-ই ঘটুক। সব স্বৈরাচারের
পৃষ্ঠাঃ ৭২

সমস্যা এ রকমই। নিজেদের প্রভুত্ব টিকিয়ে রাখা তাঁদের স্বভাবজাত। তারা কমবেশি সবাই একই ধারা অনুসরণ করেন।
আইয়ুব খান তার ক্ষমতারােহণের প্রাক্কালে রাজনীতিবিদদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছিলেন এবং তাদের গায়ে কালিমা লেপন করেছিলেন। অথচ খুব তাড়াতাড়ি তিনি রাজনীতিবিদদের সহযােগী বনে গিয়েছিলেন অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ভান করেছিলেন। ফলে জন্ম নিয়েছিল তার নিজের রাজনৈতিক দল ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’।১
রাজনীতি কারও কারও কাছে অপছন্দের হতে পারে, কিন্তু রাজনীতিবিহীন দেশ বা সমাজ অকল্পনীয়। ভালাে হােক আর খারাপ হােক, রাজনীতি সব সময়েই আছে এবং থাকবে। প্রশ্ন হলাে, একজন ব্যক্তি একাই বা কয়েকজন ব্যক্তি মিলে রাজনৈতিক চর্চা করবেন নাকি জনগণ সম্মিলিতভাবে এতে অংশগ্রহণ করবে। প্রথমটি একনায়কতন্ত্র; পরেরটি গণতন্ত্র। কোনাে দেশেই কোন অরাজনৈতিক শাসন চলতে পারে না। বড়জোর একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকতে পারে। কিন্তু সে সরকার যদি কোনাে সামরিক অভ্যুত্থানের নায়ক কর্তৃক গঠিত হয়, তাহলে বেশি দিন তার অরাজনৈতিক চরিত্র ধরে রাখা সম্ভব হয় না এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এবং তাঁর দলবল একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের জন্য একটি রাজনৈতিক দল ঘােষণা করুন অথবা কোনাে একটি রাজনৈতিক দলে নিজেদের সম্পৃক্ত করুন আর না-ই করুন, তাদের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তাদের এ পথেই এগােতে হয়। যদিও তারা জোরেশােরে এবং বারবার নিজেদের অরাজনৈতিক হিসেবে প্রচার করেন। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন ‘বিশৃঙ্খলা দমন করা এবং দেশকে স্থিতিশীল ও সঠিক পথে পরিচালনার’২ লােক দেখানাে কারণে। কিন্তু কাজটি তিনি সম্পন্ন করতে পারেননি। বরং, তিনি নিজেই একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে বিশৃঙ্খলার বীজ নিহিত ছিল। তিনি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিলেন, ফলে তাঁরই অনুগ্রহভাজন জেনারেল মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
আইয়ুব খান কর্তৃক পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তর বাঙালিদের মনে অসন্তোষের নতুন মাত্রা যােগ করেছিল। প্রথমত, করাচির মতাে একটি বিশাল নগর ফেডারেল সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তা পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পত্তিতে পরিণত
পৃষ্ঠাঃ ৭৩

করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, করাচি শহর গড়ে তুলতে যে খরচ হয়েছিল, তা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে এবং সেই খরচের বেশির ভাগ অংশ দিয়েছিল বাঙালিরা বা পূর্ব পাকিস্তান। তৃতীয়ত, পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে ইসলামাবাদ অবস্থিত বিধায় কেন্দ্রীয় সরকার থেকে উদ্ভূত এবং আহরিত সব সুযােগ-সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভােগ করেছে। চতুর্থত, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী ১৯৪৭ সাল থেকে করাচিতে থাকার কারণে কয়েক বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিনিময় বা মেলামেশার ফলে সামান্য হলেও বাঙালিরা কেন্দ্রীয় রাজধানীর সুযােগ ভােগ করত। কিন্তু ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সে সুযােগ থেকে বাঙালিরা পুরােপুরি বঞ্চিত হলাে। পঞ্চমত, করাচি একটি সমুদ্রবন্দর হওয়ার কারণে সমুদ্রপথে করাচির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সীমিত পর্যায়ের হলেও একরকম সংযােগ গড়ে উঠেছিল। কালক্রমে করাচি বন্দর তথা করাচি নগরের সঙ্গে বাঙালিদের একধরনের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। স্বল্প ব্যয়ে সাত দিনের সমুদ্র ভ্রমণ করে দরিদ্র বাঙালিরা কাজের সন্ধানে করাচিতে যেতে পারত। আকাশপথে অর্থাৎ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া ব্যয়বহুল বিধায় দরিদ্র বাঙালিদের জন্য তা ছিল স্বপ্নের অতীত। কেবল সচ্ছল বাঙালিরাই সে সুযােগ নিতে পারত। ষষ্ঠত, করাচির আবহাওয়ার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের আবহাওয়ার কিছুটা মিল ছিল।
পাকিস্তানের নতুন রাজধানীর জন্য যে স্থানটি বেছে নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল একটি জনমানবশূন্য শিলাময় অনুর্বর ভূমি। স্থানটি বেছে নেওয়ার পর তার নামকরণ করা হয় ‘ইসলামাবাদ’। পাকিস্তানিদের মানসিকতার সঙ্গে মিল রেখেই আইয়ুব খান পাকিস্তানের নতুন রাজধানীর নামের সঙ্গে পবিত্র ইসলাম ধর্মের নাম যােগ করে দিয়েছিলেন। অপ্রয়ােজনে বা বিনা কারণে ধর্মকে তারাই ব্যবহার করে, যাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ বা ধর্মের প্রতি আনুগত্য নিয়ে যুক্তিসংগতভাবেই প্রশ্ন তােলা যায়। আইয়ুব খান সে রকম একজন ব্যক্তি ছিলেন। ইসলামাবাদ রাওয়ালপিন্ডি শহর থেকে খুব দূরে নয়। আর এই রাওয়ালপিন্ডি শহরের আছে দীর্ঘদিনের সামরিক ঐতিহ্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর এখানেই অবস্থিত। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আইয়ুব খানের কার্যালয় ছিল সেটাই। সামরিক আইন জারির পরও তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরেই বসতেন। কয়েক দিন পর তিনি যখন নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা করলেন, তারপর পাকিস্তানের তখনকার রাজধানী করাচিতে তার থাকার কথা। কারণ রাষ্ট্রপতি ভবন
পৃষ্ঠাঃ ৭৪

করাচিতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে থাকতে এবং সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে সেনাপ্রধানের অফিসে বসতে বেশি স্বচ্ছন্দ বােধ করতেন। এসব কারণেই তিনি তড়িঘড়ি করে রাওয়ালপিন্ডির কাছে নতুন রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। এর পেছনে তার কয়েকটি ভাবনা কাজ করেছিল।
প্রথমত, নতুন রাজধানী হবে ক্ষমতার উৎস বা সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের কাছাকাছি।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রাণকেন্দ্রে পাকিস্তানের নতুন রাজধানী স্থাপিত হলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে আইয়ুব খান তথা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সুবিধা হবে।
তৃতীয়ত, নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে খরচ হবে, তা মেটানাে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট থেকে। অর্থাৎ কমপক্ষে অর্ধেক খরচ পূর্ব পাকিস্তানকএ দিতে হবে। অথচ, রাজধানীর কোনাে সুযােগ-সুবিধাই বাঙালিরা ভােগ করতে পারবে না। বাঙালিদের টাকায় এর আগে করাচি নগর তৈরি করে তা পশ্চিম পাকিস্তানিদের দিয়ে দেওয়া হয়। এবার নতুন রাজধানী তৈরি করতে বাঙালিরা কমপক্ষে অর্ধেক খরচ দিলেও দূরত্বগত ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে বাঙালিরা পাকিস্তানের রাজধানীর কোনাে সুযােগ-সুবিধাই ভােগ করতে পারবে না।
মজার ব্যাপার হলাে, ইসলামাবাদে নতুন রাজধানীর অবকাঠামাে গড়ে ওঠার অনেক আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলাে করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে স্থানান্তর করা শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় রাওয়ালপিন্ডিতে কেন্দ্রীয় সরকারের আরেকটি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ফলে কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে আরেক দফা রাজধানী নির্মাণের খরচ জোগান দেওয়া হয়, যার অংশ অবশ্যম্ভাবীভাবে বাঙালিদের বহন করতে হয়। অর্থাৎ বাঙালিদের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটি জাতীয় রাজধানী গড়ে তােলা হয়। প্রথমে করাচি, পরে রাওয়ালপিন্ডি ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ইসলামাবাদ।
ইসলামাবাদে রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আইয়ুব খান ঘােষণা দিয়েছিলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাকিস্তানের রাজধানী নির্মাণের মতাে উপযুক্ত স্থান পাওয়া যায়নি। তার এই কথা কোনাে বাঙালি বিশ্বাস করেনি। এত বড় একটা মিথ্যা কথা আইয়ুব খানের মতাে একজন সৈনিক না বললেও পারতেন। ঢাকা যদি স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হতে পারে, তাহলে ঢাকা পাকিস্তানের রাজধানী হতে
পৃষ্ঠাঃ ৭৫

পারত। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। পাকিস্তানিরা শাসক আর বাঙালিরা শাসিত। পাকিস্তানিরা ভাবতেও পারত না, পাকিস্তানের রাজধানী পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত হবে। অথচ, অবলীলাক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানের তিন তিনটি জাতীয় রাজধানী গড়ে তােলা হয়েছিল এবং বাঙালিরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
বাঙালিদের মনে পাকিস্তানবিরােধী মনােভাব এভাবে দানা বাধছিল। কিন্তু পাকিস্তানিরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি। তারা রাজা, বাঙালিরা প্রজা। প্রজাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে রাজার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু চিরদিন এভাবে এটা চিন্তা করে তারা ভুল করেছিল, যার পরিণাম তারা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ করেছে।
ইসলামাবাদে পাকিস্তানের নতুন রাজধানী গড়ে তুলতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়, যার কমপক্ষে অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানকে বহন করতে হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলাে, এর ফলে পর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পাঞ্জাবি শাসকশ্রেণীর স্বার্থ সুরক্ষার জন্য ইসলামাবাদে নতুন রাজধানী স্থাপন করা হয়েছিল। ভৌগােলিকভাবে ইসলামাবাদ পশ্চিম পাঞ্জাবে অবস্থিত ছিল বিধায় কেন্দ্রীয় রাজধানী পাঞ্জাবিদের হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছিল। করাচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী থাকতেও কেন্দ্রীয় রাজধানীতে পাঞ্জাবিদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। কিন্তু ইসলামাবাদে কেন্দ্রীয় রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর তা সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে। পাঞ্জাবি শাসকদের পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার অপ্রতিহত সুযােগ ইসলামাবাদ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ফেডারেল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থাকে এভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পাঞ্জাবিদের একটি কলােনিতে পরিণত করা হয়েছিল। করাচি থেকে জাতীয় রাজধানী ইসলামাবাদে স্থানান্তর করতে এত তাড়াহুড়া করা হয়েছিল যে, ইসলামাবাদে একটি ইট বিছানাের আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলাে রাওয়ালপিন্ডিতে স্থানান্তর করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মােহাম্মদ আইয়ুব খান তার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু শক্ত করার লক্ষ্যে সময়ক্ষেপণ করা সমীচীন মনে করেননি।
বাঙালিদের শান্ত করার জন্য আইয়ুব খান ঢাকায় দ্বিতীয় জাতীয় রাজধানী করার ঘােষণা দিয়েছিলেন। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করার কথা ছিল। যেহেতু বাঙালিরা পাকিস্তানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিল, তাই দ্বিতীয় রাজধানীই তাদের প্রাপ্য ছিল (!)।
পৃষ্ঠাঃ ৭৬

প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদ আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতেন উর্দু ভাষায়। রেডিও, টিভি, জনসভায় তিনি উর্দু ভাষাই ব্যবহার করতেন। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও তিনি জনসভায় উর্দু ভাষায় বক্তব্য দিতেন। বাঙালিদের কাছে বিষয়টি গ্রহনযোগ্য ছিল না। বাঙালিরা ভাবত, প্রেসিডেন্ট সাহেব শাসকের ভাষায় কথা বলছেন। এমন একটি ভাষায় তিনি কথা বলছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন; যা তাদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। ফলে তাঁর সঙ্গে বাঙালিদের দুরত্ব বৃদ্ধি পেতে বেশি সময় লাগেনি। একজন বাঙালি প্রেসিডেন্ট যদি রেডিও বা টিভিতে বা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে জনসভায় বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিতেন, তাহলে বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে নিশ্চয়ই গ্রহনযোগ্য হতাে না। ভারসাম্য রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রীর ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য রাখাই সমীচীন ছিল। আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসার পর্বে তা-ই করা হতাে। কিন্তু আইয়ুব খান তার মােটা বুদ্ধি দিয়ে সব সমস্যা সমাধান করতে চেয়ে পাকিস্তানের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন।
১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে আবদুল মােনায়েম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করা হয়। এই নিয়ােগের মাধ্যমে আইয়ুব খান বাঙালিদের সঙ্গে একটি নিষ্ঠুর তামাশা করেছিলেন। আইয়ুব খানের প্রতি অকৃত্রিম প্রভুভক্তি ব্যতীত আবদুল মােনায়েম খানের আর কোনাে গুণ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার আগে আবদুল মােনায়েম খান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। আইয়ুব খান কর্তৃক রচিত এবং ১ মার্চ ১৯৬২ তারিখে ঘােষিত পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র অনুসারে ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে জাতীয় পরিষদের ও প্রাদেশিক পরিষদগুলাের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রী বা বিডি সদস্যরা ছিলেন নির্বাচকমণ্ডলী। পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ হাজার মােট ৮০ হাজার ছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রী। নির্বাচনের পরপরই কেন্দ্রে ও প্রদেশগুলােতে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। আইয়ুব খান কর্তৃক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার আগে আবদুল মােনায়েম খান ছিলেন ময়মনসিংহের একজন জেলা পর্যায়ের নেতা। ময়মনসিংহের বাইরে তার পরিচিতি ছিল খুবই সামান্য। আর ময়মনসিংহ জেলায়ও তার কুখ্যাতিই ছিল বেশি। তিনি ময়মনসিংহ জেলায় কুখ্যাত নুরুল আমীনের একজন লাঠিয়াল হিসেবে পরিচিত ছিলেন । নুরুল আমিন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের হত্যার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৭৭

কুখ্যাতি অর্জন করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আর রাজনৈতিকভাবে তার ঘনিষ্ঠ আবদুল মােনায়েম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করে আইয়ুব খান নতুন করে বাঙালিদের ঘৃণা কুড়িয়েছিলেন। আবদুল মােনায়েম খান যখন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন বিষয়টি তেমন বড় কিছু ছিল না। কিন্তু তার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়া বাঙালিদের প্রতি প্রচণ্ড অপমানজনক একটি আঘাত ছিল। রাষ্ট্রাচার বা প্রটোকল অনুযায়ী প্রদেশের ১ নং ব্যক্তি ছিলেন গভর্নর। কিন্তু আবদুল মােনায়েম খান এ রকম একজন বীভৎস চরিত্রের লােক ছিলেন যে গভর্নর হিসেবে তার নিয়ােগের মাধ্যমে আইয়ুব বাঙালিদের নিখুঁতভাবে ছোট বানাতে চেষ্টা করেছিলেন। অন্ততপক্ষে বাঙালিরা বিষয়টিকে সেভাবেই নিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আইয়ুব খানই এর মাধ্যমে বাঙালিদের কাছে ক্ষুদ্র মানসিকতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেছিলেন। আবদুল মােনায়েম খান অবশ্য তার কার্যক্রমের মাধ্যমে তার নিয়োগকে যথাযথ প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। তার প্রভু আইয়ুব খানকে সন্তুষ্ট করতে তিনি যেকোনাে বেআইনি, অন্যায় বা নীতিবিবর্জিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হতেন না। কুখ্যাত ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) ছিল তাঁরই সৃষ্টি। এনএসএফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে গােটা শিক্ষাঙ্গনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। শিক্ষাঙ্গনের বাইরে সাধারণ মানুষের ওপরও এনএসএফের ক্যাডার বাহিনী তাদের সন্ত্রাসী হাত প্রসারিত করত। প্রশাসনিক বাধা তাে দূরের কথা, গভর্নর সাহেবের নির্দেশে প্রশাসন এনএসএফকে সর্বদা সাহায্য করত। গভর্নর সাহেব ছাড়া এনএসএফের নেতাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হতাে না। এনএসএফ ছিল প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে। | আইয়ুব খানের নির্দেশে আবদুল মোেনায়েম খান বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিলেন। বিশ্বখ্যাত নােবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গান, যা রবীন্দ্রসংগীত হিসেবে সবার কাছে পরিচিত এবং প্রিয়, তা বর্জন করার আহ্বান জানিয়ে আবুদল মােনায়েম খান বাঙালির চরম ঘৃণার পাত্র হয়েছিলেন। কারণ হিসেবে আবদুল মােনায়েম খান উল্লেখ করতে ভােলেননি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকরের ধর্ম ইসলাম নয়, অতএব তার রচিত গান মুসলমানের কাছে গ্রহণযােগ্য হওয়া উচিত নয়। একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কবিদের
পৃষ্ঠাঃ ৭৮

উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনারা নিজেই রবীন্দ্রসংগীত রচনা করুন। আমাদের তৎকালীন গভর্নর সাহেবের বিদ্যাবুদ্ধি বা জ্ঞানালােকপ্রাপ্তির মান এ রকমই ছিল। এ রকম একজন নিকৃষ্ট মানের ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন এবং আইয়ুব খানের জায়গিরদার হিসেবে ছয় বছর পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন করেছিলেন। বাঙালিদের জন্য এর চেয়ে বড় অপমান আর কিছু হতে পারে না।
মােহাম্মদ আইয়ুব খান শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের প্রধান ছিলেন বিচারপতি হামুদুর রহমান। এই কমিশন সাধারণভাবে ‘হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন’ নামে পরিচিত। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশমালা পাকিস্তানে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভের সষ্টি করে। ছাত্রসমাজ হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশমালার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে, যা শিক্ষা কমিশন বিরােধী আন্দোলন নামে খ্যাতি অর্জন করে। এর আগে ৩০ জানুয়ারি ১৯৬২ তারিখে পাকিস্তান সরকার হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করে। সে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভের সষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে শিক্ষা কমিশন বিরােধী আন্দোলন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে আন্দোলন বেগবান হয় এবং আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে ১৯ আগস্ট ১৯৬২ তারিখে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেন।
আইয়ুব খানের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির অধীনস্থ হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যবসায়বাণিজ্য ও শিল্প পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানায় অথবা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠান থেকে আহরিত লভ্যাংশ পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্বিনিয়ােগ না করে তা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হতাে এবং সেখানে বিনিয়ােগ করা হতাে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের পুজি অব্যাহতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যেত। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাও পরিকল্পিত ও নিয়মিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা হতাে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য। কেন্দ্রীয় সরকার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণ করত
পৃষ্ঠাঃ ৭৯

বলে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হতো। আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের সংবিধানে গভর্নরদের প্রদেশগুলোর নির্বাহী প্রধান করা হয়েছিল এবং গভর্নরদের তিনি নিজে নিয়োগ করতেন। এভাবে ফেডারেল পদ্ধতির সরকারের কাঠামাে সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়ে যায়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান মােতাবেক একটি প্রদেশে গভর্নর সে প্রদেশের নির্বাহী প্রধান ছিলেন না। তিনি ছিলেন সে প্রদেশের সাংবিধানিক প্রধান, যেমন রাষ্ট্রপতি ছিলেন পাকিস্তানের সাংবিধানিক প্রধান। প্রদেশগুলােতে নির্বাহী বিভাগ পরিচালনা করত মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা। মুখ্যমন্ত্রীকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন হতে হতো। এভাবে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রচলনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সীমিত আকারে হলেও প্রদেশগুলােকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু আইয়ুব খানের সংবিধানে প্রদেশগুলাের নিয়ম ক্ষমতার ওপর জনগণের কোনাে কর্তৃত্ব ছিল না। কারণ প্রদেশের নির্বাহী প্রধান ছিলেন আইয়ুব খান কর্তৃক নিয়ােগ করা গভর্নর। গভর্নরকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হতাে না। গভর্নরকে জবাবদিহি করতে হতাে রাষ্ট্রপতির কাছে অর্থাৎ আইয়ুব খানের কাছে। ফলে, আইয়ুব খান শুধু কেন্দ্রীয় সরকারেরই নির্বাহী প্রধান ছিলেন না, তিনি পরােক্ষভাবে প্রাদেশিক সরকারগুলােরও নির্বাহী প্রধান ছিলেন। কারণ, প্রদেশগুলাের গভর্নরদের তিনিই নিয়ােগ করতেন। ইচ্ছা করলে তিনি তাদের বরখাস্তও করতে পারতেন। গভর্নরদের জনগণ কর্তৃক নির্বাচন করার প্রস্তাব আইয়ুব খান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আইয়ুব খানের দশকেই পাকিস্তান ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বিরুদ্ধে একটি অপ্রয়ােজনীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য নিঃসন্দেহে ভারতের পক্ষে ছিল এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে পাকিস্তানের পরাজয়। অবশ্যম্ভাবী ছিল। যদিও আইয়ুব খানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উচ্চ স্বরে বক্তৃতা দিয়ে সহস্র বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দম্ভ প্রকাশ করেছিলেন। আইয়ুব খান বাস্তবতা মেনে নিয়ে ত্বরিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হন এবং পরবর্তীকালে তাসখন্দ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের পক্ষে রাষ্ট্রপতি মােহাম্মদ আইয়ুব খান এবং ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৮০

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কসিগিন স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ততদিনে উভয় পক্ষের, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল।
সবাই একবাক্যে স্বীকার করে থাকে যে এই যুদ্ধের জন্য মূলত পাকিস্তানই দায়ি ছিল। পাকিস্তান জম্মু-কাশ্মীরের ভারতীয় অংশে সেনা-কমান্ডাে ঢুকিয়ে মুসলমানদের মধ্যে গােপন ঘাঁটি স্থাপন করে যাচ্ছিল। গােপন ঘাঁটির সংখ্যা এবং শক্তি বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তান আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকা পরিকল্পিত ভাবে দখল করে নেবে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতীয় অংশ পুরােটাই দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করবে বলে রণনীতি নির্ধারণ করেছিল। পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, পরিকল্পনাটি সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। বরং তা ছিল ভ্রান্ত তথ্য, ভ্রান্ত চিন্তা এবং ভ্রান্ত উপলব্ধির ওপর প্রস্তুতকৃত একটি উচ্চাভিলাষী সামরিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনা প্রস্তুত করার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী জম্মু-কাশ্মীরের মুসলমানদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া এবং সমর্থন সম্পর্কে ভুল অনুমান করেছিল। তা ছাড়া তারা পাকিস্তানি কমান্ডােদের যােগ্যতা বা শক্তি সম্পর্কেও ভুল ধারণা পােষণ করেছিল। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অবশ্য সার্বিক বিবেচনায় পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালাে যুদ্ধ করেছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন বা ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই যুদ্ধে লাহাের সেক্টরে (ঐতিহাসিকভাবে খেমখারান সেক্টর নামে পরিচিত) বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা বাঙালিদের জন্য সম্মান কুড়িয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধে পাকিস্তানের জয়লাভ করার, এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের কিছু অংশ দখল করে সীমিত বিজয় অর্জন করারও কোনাে সম্ভাবনাই ছিল না। যুদ্ধ ১২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু এই ১২ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যরা রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কারণ পাকিস্তানের তুলনায় ভারতীয় বাহিনী আকারে বড় ছিল। পাকিস্তানের হাতে কোনাে রিজার্ভ সৈন্য অবশিষ্ট ছিল না। অপরপক্ষে ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রচুরসংখ্যক রিজার্ভ গােলাবারুদ, হাতিয়ার ও ইকুইপমেন্ট ছিল। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা প্রয়ােজন, সবকিছুই ভারতীয়দের হাতে ছিল। ভারতীয়দের সমরাস্ত্র কারখানাগুলাের তুলনায় পাকিস্তানি সমরাস্ত্র কারখানার উৎপাদনক্ষমতা ছিল খুবই সামান্য। পাকিস্তানের ট্যাংক বা গােলন্দাজ বাহিনীর ইকুইপমেন্ট বা গাড়ি বা অন্য কোনাে সামরিক সরঞ্জাম যুদ্ধে বিকল হয়ে গেলে তার পরিবর্তে সৈন্যদের হাতে দেওয়ার মতাে
পৃষ্ঠাঃ ৮১

পাকিস্তানি হাইকমান্ডের হাতে কিছুই ছিল না। এমনটি পাকিস্তানিদের রিজার্ভ গােলাবারুদও ফুরিয়ে গিয়েছিল।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ১২ দিন পরে শেষ হয়ে গেলেও যুদ্ধের রেশ বাঙালিদের মন থেকে কোনাে দিন মুছে যায়নি। যুদ্ধের সময় এবং পরে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বদা আতঙ্কিত ছিল। আতঙ্কিত ছিক পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের কথা ভেবে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ অবশ্য মূলত ভারতের পশ্চিম ফ্রন্টে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যেকোনাে সময় পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আক্রমণ হতে পারত।
ভারতীয় বিমানবাহিনী ও পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মধ্যে বস্তুত সীমিত আকারের আকাশযুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছিল। কোনাে নৌযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়নি। স্থলযুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে প্রসারিত হয়নি মূলত ভারতীয় নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে। পূর্ব পাকিস্তানে তখন পাকিস্তানের একটিমাত্র পদাতিক ডিভিশন (১৪তম ডিভিশন) মােতায়েন ছিল। কিন্তু এই ডিভিশনটি ছিল পাকিস্তানের অন্যান্য পদাতিক ডিভিশনের চেয়ে অনেক ছােট এবং অনেক কম শক্তিসম্পন্ন। এই ডিভিশনে সাঁজোয়া বাহিনী বা গােলন্দাজ বাহিনীর কোনাে উপস্থিতি ছিল না। পদাতিক বাহিনীর উপস্থিতিও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটিমাত্র এফ-৮৬ জেট ফাইটারবম্বার স্কোয়াড্রন ছিল । নৌবাহিনী বলতে ছিল কয়েকটি পেট্রোল বােট। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় বাহিনী সহজেই পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারত। সে রকম অভিযান পরিচালনার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ স্থল, নৌ ও বিমানশক্তি ভারতের হাতে ছিল। কিন্তু ভারতীয় নেতৃত্বের দূরদর্শিতা এবং সঠিক ভারতীয় রণনীতির কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ না করে ভারত নিশ্চয়ই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার মধ্যে নিহিত আছে, আইয়ুব খানের এ রকম উক্তি সমর্থন করতে চায়নি। ভারত জানত যে, পাকিস্তান ওই যুদ্ধ শুরু করেছে এবং যুদ্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী হবে না। তাই পূর্ব পাকিস্তান দখল করলেও পরবর্তীকালে তা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু দখলদারির কারণে বাঙালিদের সঙ্গে ভারতীয়দের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি ফাটল ধরত। ভারতীয় নেতৃত্ব তা চায়নি বলেই তারা পূর্ব পাকিস্তান দখল করেনি। পক্ষান্তরে, আইয়ুব খান চেয়েছিলেন, সে রকম কিছু ঘটুক। অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতীয়রা দখল করুক এবং বাঙালিদের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি অবনতি
পৃষ্ঠাঃ ৮২

ঘটুক। আর পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য বাঙালিরা নিঃশর্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবদান রেখে চলুক। তাই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশচিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার মধ্যে নিহিত আছেএ ধরনের তত্ত্ব বাঙালিদের কাছে বা কোনাে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়নি।১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নিয়ে বাঙালিদের আতঙ্কে এ রকম তত্ত্ব কোনাে সান্ত্বনার বাণী শােনাতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এ রকম অযৌক্তিক সামরিক তত্ত্ব বাঙালিরা শুনে এসেছে। আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভুরা ক্লান্তহীনভাবে অবিরাম আমাদের বলে এসেছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করার পূর্বেই পাকিস্তান বাহিনী দিল্লিতে পৌছে যাবে এবং ভারতীয় রাজধানী দখল করে নেবে। এ কথার অর্থ এই দাঁড়ায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত করা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটাই লক্ষ্য এবং তা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিল্লির দিকে অগ্রসর হবে, তখন ভারতীয় বাহিনী অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে পাকিস্তানিদের স্যালুট করবে। আর পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী তাদের স্থায়ী সেনানিবাস থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার দিকে এগােবে। এ ধরনের কল্পকথা বা মিথ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় যথেষ্টভাবে অসত্য প্রমাণিত হয়েছিল, যখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দিল্লির দিকে অগ্রসর হওয়া তাে দূরের কথা, পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানকেই রক্ষা করতে পারেনি। কিছুটা হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড ভারতীয়দের দখলে চলে গিয়েছিল, যা তাসখন্দ চুক্তির পর পাকিস্তানিরা ফেরত পায়। আর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার কথা তখন পাকিস্তানিদের ভাবারও সময় ছিল না। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ভারতীয় নেতৃত্বের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
‘পূর্ব পাকিস্তানে ভারত আক্রমণ চালালে চীন ভারত আক্রমণ করবে’ পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর এ রকম দাম্ভিকতাপূর্ণ উক্তি ছিল আরেকটা ধাপ্পাবাজি। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের এ রকম কোনাে সামরিক চুক্তি ছিল না। চীনের বৈদেশিক নীতিও এ রকম কোনাে সম্ভাবনার কথা সমর্থন করে না। এ কথা সত্য, চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য চীন ভারত আক্রমণ করার মতাে অবিবেচকসুলভ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এ রকম চিন্তার পক্ষে কোনাে যুক্তি ছিল
পৃষ্ঠাঃ ৮৩

না। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাঙালিরা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সামরিক বাজেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দিয়েও তারা নিজেদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারেনি, বরং এর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভুদের স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি বিধান করা হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন বাঙালিরা শুধু প্রার্থনা করেছে যে, ভারতীয়রা যেন পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ না করে।

তথ্যসূত্র
১. সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ধারণা পােষণ করেছিলেন। অল্পদিনেই তিনি আবিষ্কার করলেন মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাই তাকে তাদের নেতা হিসেবে দেখতে চান, যা তাঁরা মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীদের এক কনভেনশনের মধ্যমে ঘােষণা দিয়েছিলেন। যদিও কোনাে কোনাে নেতা এই নেতৃত্বের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিলেন এবং বলেছিলেন, দলের কাউন্সিলের মাধ্যমেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং তারা কনভেনশনের বিরােধিতা করে কাউন্সিল অধিবেশন ডেকেছিলেন। মুসলিম লীগ নামের দলটি এভাবেই দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন অংশের নাম হয়েছিল ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’ এবং অপর অংশের নাম ‘কাউন্সিল মুসলিম লীগ’।
২. ৮ অক্টোবর ১৯৫৮ তারিখে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুবখানের ভাষণ।
৩. ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন। পরবর্তীকালে তাঁকে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন।
৪. উজবেকিস্তানের রাজধানীর নাম তাশখন্দ। ১৯৬৫ সালে উজবেকিস্তান সােভিয়েত ইউনিয়নের একটি অঙ্গরাজ্য ছিল। বর্তমানে এটি একটি স্বাধীন দেশ।
পৃষ্ঠাঃ ৮৪

Ref: সত্য মামলা আগরতলা, কর্নেল শওকত আলী, pp 70-84