ছেড়ে দেবার সময় বঙ্গবন্ধুকে ৫০ হাজার ডলার হাতখরচ অফার করেছিলেন ভুট্টো। আর বলেছিলেন, “নাইদার ইউ আর আ প্রিজনার, নর আ ফ্রি ম্যান”।
ভুট্টোর কুটকৌশল:
১৯৭২ সনের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ড করাচিতে বৈঠক করেন। তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেন জনসভায় বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত বন্দীশালা থেকে মুক্তি দেবেন। ভুট্টো বলেন, তিনি একদা কারাগারে যে সেলে ছিলেন শেখ মুজিব সেখানেই আছেন এবং সে স্থান থেকে সরিয়ে একটি গেস্ট হাউসে নিয়ে আসা হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শীর্ষনেতা হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর পাকিস্তান আভিযােগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁকে ২৬ মার্চ গ্রেফতার করে।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে ৯৩ হাজার পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমপন করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের এই লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের পর পশ্চিম পাকিস্তানে চরম বিক্ষোভ শুরু হয় সর্বস্তরে ও বিভিন্ন পর্যায়ে। ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে এ অবস্থা সৃষ্টি করে যার ফলে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ভুট্টোকে ক্ষমতাসীন করে। কীভাবে ক্ষমতা দখল করে ভুট্টো সে সব ঘটনা রাষ্ট্রদূতকে লুকিয়ে যায়। তবে এক কথা বলেন যে, মুজিবের ইচ্ছাকেই তিনি প্রাধান্য দেবেন। কিন্তু শেখ মুজিবের মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি ‘কুটনৈতিক চালের’ আশ্রয় নেবেন।
নাইদার ইউ আর প্রিজনার...
রাওয়ালপিন্ডির ২৫ কিলােমিটার দূরবর্তী শিহালাতে বঙ্গবন্ধুকে একটি রেস্ট হাউজে (যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল) নেয়া হয়। সেখানেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো দু’বার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন।
ভুট্টো যখন রেস্ট হাউজে আসেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলেছিল, ‘পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট আসবেন। তারপরে সেখানে ভুট্টো আসলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন যে, নাউ আই অ্যাম দ্যা প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চিফ মার্শাল ‘ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। ঐ অবস্থায় মুজিব হেসে দিলেন। তখন ভুট্টো জিজ্ঞেস করলেন, আপনি হাসছেন কেন?’ তখন মুজিব বললেন, “আমি বুঝতে পারি একজন প্রেসিডেন্ট সিভিলিয়ান হতে পারে। কিন্তু আমি অবাক হই যখন শুনি যে, একজন সিভিলিয়ান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক!’ তখন ভুট্টো বলেছিলেন, ‘দ্যাট ইজ পসিবল ইন পাকিস্তান। তারপরই মুজিবের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল যে, ‘মি. ভুট্টো টেল মি ফার্স্ট, হােয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার।’ তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রি ম্যান। বঙ্গবন্ধু বললেন, বন্দি হিসেবে আমি কথা বলতে পারি না। তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন যে, “ইউ আর এ ফ্রি ম্যান।’ এরপর মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। ভুট্টো অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসাথে থাকা যায়, ইত্যাদি। কিন্তু মুজিব কোনাে কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় জনগণ ও সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে না পারবাে, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়।’ তিনি আরও বললেন, আমার জনগণই আমার প্রাণ । আমি মৃত্যুকে পরােয়া করি না। আমাকে হত্যা করলে আমার লাশটা বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেবেন। তারা আমায় বড় ভালােবাসে। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি। তার দিকে এগিয়ে দেওয়া লিখিত যৌথ ইশতেহারের স্বাক্ষর করলেন না। প্রত্যাখান করলেন। শেখ মুজিব বললেন, আমি কি এখন দেশে যেতে পারি? ভুট্টো বললেন, ‘হ্যা, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের উপর দিয়ে যায় না। তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাব।’ এরপর ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে ওঠার আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার দিকে ৫০ হাজার ডলার হাত খরচের জন্য দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা চার্টার বিমানের জন্য আপনি রেখে দেন। তিনি লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
লন্ডনে পৌছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি লিখিত বিবৃতি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনের প্রসঙ্গ থাকায় ঐতিহাসিকভাবে বিবৃতিটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘােষণা করেছে তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসাবে একটি নির্জন ও পরিত্যক সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হওয়ার পর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ‘বিশ্বাসঘাতক’-এর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনাে প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাসিকাষ্ঠে ঝুলানাের ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভট্টো এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করতে অস্বীকার করেন।
জনাব ভট্রো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্য নিপ্রদীপ জারী করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল, যেখানে আমাকে তারা কোনাে রেডিও, কোনাে চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে, তা জানতে দেওয়া হয় নাই। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যে কোনাে একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটি বিবেচনা করতে অনুরােধ জানিয়েছেন। আমি তাকে বলেছি, আমার দেশবাসীর সাথে আলাপ-আলােচনা না করে আমি কোনাে কিছু বলতে পারবাে না। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজী নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।”
অন্ধকার থেকে আলােয় অভিযাত্রা
বঙ্গবন্ধু ঢাকা যাবার পথে কিছুক্ষণ দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সকালে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের নতুন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন : এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলােয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সােনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২।
Ref: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, pp 13-15