মৃত্যুকে আমি ভয় করি না, মেশিনগানের সামনে আমি বুক পেতে দাঁড়াতে পারি
২৬ জুন ১৯৭২, মাইজদিকোর্ট, নোয়াখালী
(ভাষণের অডিও নীচে যুক্ত হল)
আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আপনারা অনেক কষ্ট করে এই বৃষ্টি কাদার মধ্যে দূর থেকে এসেছেন। আপনাদের আমি কষ্ট দিতে চাই না। বেশি সময় আমি বক্তব্য দিতে চাই না। জেলে থেকে বের হয়ে আসার পরে বলেছিলাম আপনাদের কাছে তাড়াতাড়ি আসবো। কিন্তু আসতে পারি নাই। আমি জানি, আমি যখন জেলের মধ্যে বন্দী ছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানে, আমি জানি, যখন আমি দিন গুনছিলাম কবে আমার ফাসি হবে, আমি জানতাম আপনারা আমার মা-বোনেরা ও ভাইয়েরা বাংলার গ্রামে-গ্রামে রোজা রাখতেন, দোয়া করতেন এবং এই পিশাচের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আপনারা জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী আমার দেশের কী সর্বনাশ করেছে। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথের ভিখারি করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার কচি ছেলেদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমার জমির ক্ষেতের ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমার রেললাইন ভেঙে দিয়েছে। আমার ফ্যাক্টরি, কারখানা নষ্ট করেছে। আমার ছেলেদের কাপুরুষের মতো ঘরের থেকে ধরে নিয়ে টুকরা টুকরা করে কেটেছে। তারা বলে মুসলমান, তারা বলে মানুষ! তারা বলতেন, আমরা মুসলমান! এত বড় নরপশু দুনিয়ায় কোথাও পয়দা হয় নাই। আপনাদের মনে আছে, যেদিন আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, সেইদিন আমি বলে দিয়েছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ আমি জানি না তোমাদের কাছে আর কথা বলতে পারবো কি না, হতে পারে এই আমার শেষ, হতে পারে ওরা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ করো। আমার পুলিশ, আমার ইপিআর, আমার সৈন্যবাহিনী, আমার সরকারি কর্মচারী, আমার শ্রমিক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার ছাত্র কিছু সংখ্যক দালাল ছাড়া সশস্ত্র বর্বর বাহিনীর সামনে রুখে দাঁড়ায়। লক্ষ লক্ষ মায়ের বুক খালি হয়ে গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ ছেলে আজ হাত পাও কাটা, লক্ষ লক্ষ সংসার আজ ছারখার হয়ে গেছে। কী পেয়েছি? আমি যেদিন জেলে থেকে বের হয়ে আসলাম, আমি যখন রেসকোর্স ময়দানে খাড়া হলাম, আমি যখন আমার বাংলার মাটিতে পাড়া দিলাম, আমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই, অনেক রাত আমি ঘুমাই নাই। অনেকদিন আমি বসে বসে কাটিয়েছি। যেদিন থেকে আমি এসে বাংলায় নেমেছি, তারপর থেকে একদিনও আমি বিশ্রাম করি নাই। কী করবো? আমার পোর্ট নাই। পোর্ট ভেঙে দিয়ে গেছে। আমার গুদামের চাল লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার কাগজপত্র পর্যন্ত অফিসের জ্বালিয়ে দিয়েছে। এমনকি নোটগুলো পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। বাংলার সোনা লুট করে নিয়ে গেছে, বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে। ভাইয়েরা আমার, ইনশাল্লাহ্ ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ না খাওয়া, আমি জানি, আমি জানি, বাংলার মানুষ দুঃখি, আমি জানি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খায় না। আমি জানি বাংলার মানুষের ঘর নাই। এক কোটি লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে স্থান নিয়েছিল। দেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। এক কোটি লোকে ফিরে এসেছে, কোথায় আমি খাবার পাবো? কোথায় আমি টিন পাবো? কোথায় আমি পয়সা পাবো? কোথায় আমি বাংলার মানুষকে পেট ভরে খাবার দেবো? রাতের পর রাত, দিনের পর দিন চিন্তা করেছি, কী করবো? কিন্তু জানি, আমার বাংলার মানুষ দুঃখি। আমি দেখলাম, যে সব গেছে, কিন্তু বাংলার মানুষ, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার বাতাস, বাংলার নিঃস্বার্থ কর্মীকে হত্যা করতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ্ সোনার বাংলা একদিন সোনার বাংলা হবে। এদেশের মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে। (জনতার করতালি।) জালেম আমার সম্পদ নিতে পারে জালেম আমার টাকা নিতে পারে , জালেম আমার ইমান নিতে পারে নাই, জালেম আমার মাটি নিতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ যদি বাংলার মানুষ সৎ পথে থাকে, ভালোভাবে কাজ করে, ইমানদারের সঙ্গে কাজ করে, আমি বিশ্বাস করি সোনার বাংলার মানুষ আবার সোনার বাংলা গড়তে পারবে এ বিশ্বাস আমার আছে। ভাইয়েরা আমার, আমি দেখলাম কী, শতকরা ৬০ জন পুলিশকে হত্যা করেছে।
নোয়াখালীর ভাইয়েরা আমার,
এখনও আমার পাষণ্ডের দল ৩০ লক্ষ লোকেরে হত্যা করেও শান্তি পায় নাই। আমার ৪ লক্ষ বাঙালিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকায়ে রেখেছে। ভুট্টো সাহেব তাদের দেবেন না। ভুট্টো সাহেব তাদের নিয়া ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। ভুট্টো সাহেব তাদের ছাড়বেন না। ভুট্টো সাহেব মনে করেছেন, যে বাংলার মানুষকে আটকায়ে রেখে তিনি আমাদের মাথা নত করাবেন। যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে সে জাতি কারো কাছে মাথা নত করতে জানে না। (জনতার করতালি।) ভুট্টো সাহেব আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচায় রাখে ভুট্টো সাহেব, বাংলার মানুষকে আমি বাংলায় ফিরায় আনবো, আপনি রাখতে পারবেন না। আপনি মনে করেছেন, যে আটকায়ে রাখলে আমি আপনার যারা যুদ্ধ অপরাধী তাদের বিচার করবো না। যারা আমার দুই লক্ষ মা-বোনের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, যারা আমার ছেলেদের নিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছে, যারা আমার গরিবের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, যারা আমার মা-বোনকে পথের ভিখারি করেছে, তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে যদি আমি বেঁচে থাকি। (জনতার করতালি।)
ভুট্টো সাহেব, আপনি জানেন, মৃত্যুকে আমি ভয় করি না। মেশিনগানের সামনে আমি বুক পেতে দাঁড়াতে পারি। আপনি জানেন, যে ফাসির জন্য আমার কবর খুঁড়েছিলেন, কিন্তু আমি মাথা নত করি নাই। এই জন্য আমার বাংলার মানুষও মাথা নত করবে না। ভুট্টো সাহেব অবশ্য এখনও বাংলাদেশকে তিনি মানেন না। বাংলাদেশ বলে স্বাধীন না। দুনিয়ার ৭৫টা দেশ মেনেছে। দুনিয়ার জাতিসংঘের অনেক কমিটির আমি সদস্য হয়েছি। উনি বাংলাদেশকে মানেন না। আমি তোমারে মানি কিনা সেইটাই বড় কথা, তুমি আমারে মানো না মানো সেইটা বড় কথা না। আমার দেশ বাংলাদেশ। আমার স্বাধীনতা থাকবে। আমার পতাকা থাকবে। আমার বাংলার মানুষ খেয়ে খুশিভাবে বেড়াবে, তোমাদের গোলামি আর কোনদিন করতে আমরা পারবো না। সুখে থাকো বন্ধু। সুখে থাকো। সুখে থাকো। আরামে থাকো, আশীর্বাদ করি। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো। আল্লাহর কাছে মাফ চাও যা করেছ। আর যা নিয়েছ, ভদ্রলোকের মতো ফেরত দিলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। (জনতার করতালি।)
২৪ বচ্ছরে আমার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে গেছ। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আমার বাংলার থেকে লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছ। এখন বড় বড় কথা বলেন। উনরা বলে মুসলমান। উনরা বলে ইসলামের কথা বলেন। গটর গটর মদ খাইয়া পড়ে থাকেন, আর ইসলাম ইসলাম করেন। বাংলাদেশে মদ খাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি বন্ধ করতে পারো নাই। (জনতার করতালি।) তুমি পারবা না। আমার নাই কিছু। আপনাদের আমি কিচ্ছু দেবার পারবো না। দেবো কোত্থেকে? হ্যা, এ কথা সত্য। আপনাদের যত বকেয়া খাজনা ছিল সব আমি মাফ করে দিয়েছি। দেই নাই? আপনাদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা রোজকেয়ামত পর্যন্ত মাফ হয়ে গেছে, আমি করে দিয়েছি। আপনাদের গ্রামে-গ্রামে পেস্লিপে টাকা দেওয়া হয়েছে। আপনাদের লবণের খাজনা মাফ করে দেওয়া হয়েছে। আমি পাবো কোথায়? আমি দেবো কোত্থেকে? আমি তো মানুষের কাছে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে পয়সা আনতে পারি না। কোটি কোটি মণ খাবার আমার আনতে হচ্ছে। আর একটা অসুবিধা হয়ে গেছে। আমি ভিক্ষাটিক্ষা করে আনি, গ্রামে-গ্রামে পাঠাই, চাটার দল এখনও বলে মাঝে মাঝে চাইটে চাইটে তাই চুরি করে খায়। (জনতার করতালি।) আমি সাবধান করে দিচ্ছি। খবরদার গরিবের হক কেউই মেরে খাবা না। আমি গরিবের জন্য, গরিব আমার জন্য। বাংলাদেশে গরিব কৃষকের রাজ কায়েম হবে। বাংলাদেশে গরিবের রাজ কায়েম হবে। (জনতার করতালি।) শোষোকের রাজ কায়েম হবে না।
ভায়েরা আমার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করো। ঘুষ খাওয়া বন্ধ করো। গরিবের রক্ত চোষা বন্ধ করো। গরিবের রক্ত খাওয়া বন্ধ কর। গরিবের পয়সা মেরে খাওয়া বন্ধ করো। না হলে ভালো হবে না। তোমরা আমাকে চেন। আজকে ২২ তারিখ, বড় বড় বাড়ি দখল করেছে, বড় বড় গাড়ি দখল করেছে বড় বড় জাগায়। আজ ২২ তারিখ চারটা বাজে। এই চারটার পর থেকে বড় বড় শহরে অ্যাকশন নেওয়া হবে। যাদের বাড়িঘর লুট করেছে তাদের বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হবে। যারা গুদামে চাল রেখে চালের দাম বাড়ায়ে গরিবকে লুট করে খাবার চায়, তারা সাবধান হয়ে যাও। আইন আমি পাস করছি। আইন আমার আছে। দরকার হলে আরও করবো। দরকার হয় এমন আইন করবো যে, প্রকাশ্য জায়গায় গুলি করে মারা হবে এই চোরদের। (জনতার করতালি।) কিন্তু গরিবকে লুট করে খাওয়ার দেওয়া হবে না। ভাইয়েরা আমার বোনেরা আমার, একদল লোকে আছে, রাস্তায় বের হইছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখি নাই, এহিয়া খানের দালালি করেছে, আইয়ুব খানের দালালি করেছেন। এখন আমি গণতন্ত্র দিয়েছি, উনারা কথা বলতে শুরু করেছেন। ফুটফাট চুপচাপ ফুসফাস করেন। একটু আস্তে আস্তে কও চান রা। ছিলা কোথায় চান রা? করেছিলা কি চান রা? দালালি করেছ এহিয়া খানের, পয়সা খেয়েছ আইয়ুব খানের, পয়সা খেয়েছ এস্কেন্দার মির্জার। যখন জীবনের ১০-১১টি বৎসর আমি জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি, আমার সহকর্মীরা জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে, তখন তোমরা বসে বসে কোরমা পোলাও খেয়েছ। এখন সুযোগ পাইয়া এটা করল না, ওটা করল না। কোত্থেকে করবো? খাজনা মাফ, ট্যাক্স মাফ, লবণ কর মাফ, পয়সা কোত্থেকে আসবে? করবো কোত্থেকে? কাজ করতে হবে। ফসল উৎপাদন করতে হবে। কারখানার কাজ করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। তাহলেই তো পয়সা আসবে। তাহলেই তো মানুষকে কাজ দিতে পারবো। নায়পারবো কোত্থেকে? বাজে কথা বললে চলবে না। মিথ্যা কথা আমি বলি না। আমি রেসকোর্স ময়দানে জিজ্ঞাসা করলাম যে, তোমাদের কী দিয়েছি? প্রায় একশো কোটি টাকার মতো টেস্ট রিলিফ এই বাংলাদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৬ কোটি টাকার মতো টেস্ট রিলিফ দেওয়া হয়েছে, খাজনা-ট্যাক্স মাফ করা হয়েছে। আপনারা জানেন, কোটি কোটি মণ চাল আনতে হচ্ছে আমার গ্রামে পৌছুবার জন্য। কোটি কোটি মণ চাল। ট্রাক নাই, বাস নাই, রেলওয়ে নাই। পোর্ট ভাঙা ছিল। দুনিয়া থেকে চাল কিনবো। চিটাগাং পোর্টে এ আনবো। সেখানে থেকে গ্রামে পৌছায় দিবো। অন্তত পক্ষে প্রত্যেকটা গ্রামে গ্রামে কিছু কিছু খাবার আপনাদের জন্য আমি পৌছাইছি এই ভাঙ্গা হাতে। কিন্তু নাই কিছু। এবার পারবো না। আমি মিথ্যা ধোকা আপনাদের দেইনা, কোনদিন দেই নাই। কোনও দিন দেবো না। ৩ বচ্ছর আপনাদের আমি কিছুই দিবার পারবো না। আপনারা রাজি আছেন কিনা আমি জানতে চাই। (জনতা সমস্বরে – ‘রাজি’।) তার মনে আমি দেবো না এটা ঠিক না। আমি যেখান থেকে পারি ভিক্ষা কইরা আইনা বাংলার গরিবের সামনে আমি হাজার করার চেষ্টা করবো। কিন্তু গরিবকে খেয়ে বাঁচতে হবে।
ভাইয়েরা আমার, কিন্তু একটা কথা, একটা কথা, নাকে খৎ দিয়া, নাকে খৎ দিয়া দুনিয়ার কাছ থেকে আমি আনতে পারবো না। সত্য কথা ভারতবর্ষ আমারে দুই তিন কোটি মণ খাবার দিয়েছে। … ইউনাইটেড নেশন থেকে ৬ লক্ষ টন আমি খাবার পাচ্ছি। তার মধ্যে ইউএসএ ৪ লক্ষ টন দিয়েছে। রাশিয়া আমার বন্ধু। তারা আমাকে দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সেখান থেকে আমি আনছি। বার্মা থেকে চাল আমি কিনছি। জাপানের থেকে চাল আমি কিনতেছি। কিন্তু আনতে জাহাজ নাই। জাহাজ ভাড়া কইরা আনতে হবে। চট্টগ্রামে পৌছবে, ট্রাক লাগবে, রেল ইঞ্জিন নাই। পাঠাতে হবে নোয়াখালী, যেতে হবে গ্রামে সময় লাগবে ভই। সময় লাগবে। মিথ্যা ধোকা দিবার পারবো না। আমি কাউকে ধোকা দিইনা। তবে বাংলার যে সম্পদ এ সম্পদ আপনাদের। যেখান থেকে আয় করি না কেন, সেই সম্পদ যেখান থেকে আনি না কেন, বাংলার গরিবের জন্য আনা হবে। স্কুল-কলেজ ভেঙে গেছে। তা সারতে টাকা দিতে হবে। এছাড়াও গরিব কর্মচারী, যারা না খেয়ে কষ্ট পেত, তাদের আমি মাসে ২৫ টাকা, ২০ টাকা, ১৫ টাকা বেতন বাড়ায়া দিয়েছি তাতে আমাকে দিতে হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। কোথায় পাবো? কোন জায়গায় থেকে আসবে? কীভাবে দিবো? বিশ্বাস করেন, ভাইয়েরা আমার, আমি রাত্রে ঘুমাতে পারি না। আমি চিন্তা করতে পারি না। জেলের থেকে যেদিন আমি, পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে আসছি। তারপর থেকে একদিন আমি বিশ্রাম করি নাই। আমার পক্ষে দিনের আরাম রাতের বিশ্রাম হারাম হয়ে গেছে। আপনাদের দিকে আমি চাইতে পারি না। আমি দেখলে আমার বুক ফেটে যায়। আমি আসতেছিলাম- প্লেন আসে না – আমি রাস্তাউ ওপর প্লেন থামাইছি। প্লেন থামছে। আসতে পারে না। গ্রামের লোকে দৌড়ায়া আসছে। বাবা তোমারে একটু দেখাবো, তোমরা কাছে কিচ্ছু চাই না। তোমারে দেখবো। আপনারা আমারে দোয়া করেন। আপনারা যেভাবে আমাকে ভালোবাসেন, আমি যেন আপনাদের এ ভালোবাসা নিয়ে মরতে পারি, এর বেশি আমি আপনাদের কাছে কিছুই চাই না। (জনতার করতালি।)
আপনারা আমাকে ভালোবাসেন, আমিও আপনাদের ভালোবাসি। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। আমার দেবার মতো যা আছে, একটা জান, তা বাংলার মানুষের জন্য আমি মটর্গেজ করে দিয়েছি। ভাইয়েরা আমার, হ্যা, একটা কথা বলে যাবার চাই ও লাইঠেল পাইঠেল আর চলবে না। ১০০ বিঘার বেশি জমি কেউ রাখতে পারবে না এবং বাকি জমি যাদের জমি নাই তার মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। আমি ডিসি সাহেবকে অর্ডার দিয়ে যাচ্ছি। দেখেন কোন কোন লাঠিয়াল জমি দখল করে রাখছে, সোজা জেলখানায় দিয়ে দেন। আর গরিবের মধ্যে সে জমি ভাগ করে দেন। কোনও ভয় নাই আপনার। ছাড়ব না। ১০০ বিঘার বেশি কেউ রাখতে পারবে না। বাকি যা আছে তা গরিবের মধ্যে চরে ভাগ করে দিতে হবে। এটা গর্ভমেন্টের আইন; এ আইন কাজ হবে এবং আমি সরকারি কর্মচারীদেরকে হুকুম দিয়ে যাচ্ছি যে, যত তাড়াতাড়ি হয়, সে বন্দোবস্ত করা হোক। আর, আইন শৃঙ্খলা রাখেন। চোর-ডাকাত-গুণ্ডা মানুষের শান্তি যেন নষ্ট করতে না পারে। চোর-ডাকাত-গুণ্ডাদের আপনারা গ্রামের লোকে তাদের ধইরা পুলিশের কাছে দিয়ে দেবেন। তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। আর কিছু কিছু রাজাকার, আলবদর, যারা আমার লোকেরে মারছে, তারা পলায়া পলায়া বেড়াচ্ছে এবং জাগায় জাগায় সুযোগ পাইয়া আবার কাছিমের মতো মাথা বাইর করতেছে। তোমাদেরযে যে এখন পর্যন্ত কিছু করা হয় নাই তার অর্থ দুর্বলতা নয়, তোমরা সাবধান হয়ে যাও, তোমাদের লিস্ট আমাদের কাছে আছে। যদি বাড়াবাড়ি করো তাইলে মনে রেখ কোলাবরেটর আইনে তোমাদের জেলে যেতে হবে। কেউ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। তবে আইন মতো তোমাদের বিচার হবে। এসম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকতে পার। আমার ভাইয়েরা, বোনেরা, আপনারা বহু কষ্ট করেছেন লক্ষ লক্ষ লোক, বৃষ্টি কাদার মধ্যে আপনারা রয়েছেন। আমার দুঃখ হচ্ছে – ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার – আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। তবে একটা কথা বলে যাই। আওয়ামী লীগের নেতারা – আওয়ামী লীগ এই দেশের গরিবের প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ গরিবের প্রতিষ্ঠান থাকবে। আওয়ামী লীগ গরিবের জন্য সংগ্রাম করেছে। আওয়ামী লীগ গরিবের জন্য সংগ্রাম করবে। যদি কোনও আওয়ামী লীগের নেতা দুর্নীতি করে তাদের পার্টি থেকে বাইর করে দাও কিন্তু আওয়ামী লীগের যেন বদনাম হয় না। আপনারা ইউনিয়নে ইউনিয়নে নিঃস্বার্থ কর্মীরা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করেন এবং সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে এবং পুলিশের সঙ্গে কোঅপারেশন করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। না হলে আমার মুখ কালি করবেন না। আমার মুখে কালি দেবেন না। সাত কোটি, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুখে কালি দেবেন না। আমার কর্মীদের কাছে এই আমার আবেদন। (জনতার করতালি।) বাংলা বাংলাদেশ। প্রত্যেক বাঙালির এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেয়ে কাজ করে খাবার অধিকার রয়েছে। কেউ বন্ধ করতে পারবে না। একটা কথা বলে যাই বাংলাদেশ ৪টা নীতির উপরে চলবে। জাতীয়তাবাদ, সেটা হলো কী? আমরা বাঙালি আমাদের জয় বাংলা। আমার দেশ তোমরা দেশ বাংলাদেশ। এই বাঙালি আমরা এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। আপনারা বাঙালি না? ২ নম্বর- আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। কিন্তু যদি গণতন্ত্র মানে, যার যা ইচ্ছা তাই লেখবেন আর যা ইচ্ছা তাই বলবেন, সেটাকে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের একটা নীতি আছে। এবং গণতন্ত্রে আমি বিশ্বাস করি। আপনারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না? আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। যাকে বলা হয় শোষণহীন সমাজ। শোষণহীন সমাজ মানে কেউ কাউকে শাষোন করতে পারবে না। আপনারা চান না? আমরা ধর্ম নিরপেক্ষে বিশ্বাস করি। তার অর্থ ধর্ম বিরোধী নয়। মুসলমান মুসলমান ধর্ম পালন করবে, হিন্দু হিন্দু ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করবে। এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচার করবে না। ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার, লুটতরাজ, ব্যবসা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পয়সা খাইয়া রাজনীতি করা চলবে না। (জনতার করতালি।) ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। তবে আমি মুসলমান, আমি মুসলমান হিসেবে আমার ধর্ম-কর্ম পালন করবো। হিন্দু হিন্দু ধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্ম কর্মে বাধা দিবার পারবে না। ঠিক? মানেন? আমার ধর্ম আমার কাছে। তোমরা ধর্ম তোমরা কাছে। আছে না? ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফেরুন।
লা আ’বুদু মাতা’বুদুন।
ওয়ালা আনতুম
আবিদুনা মা’আবুদ।
ওয়ালা আনা আবিদুম
মা আবাদ তুম। ওয়ালা আনতুম
আবিদুনা মা’আবুদ। লাকুম
দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।
তোমরা ধর্ম তোমরা কাছে। আমার ধর্ম আমার কাছে। এইটাই হলো ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তাই থাকবে। তাই আমি আশা করি, আপনারা এতে বিশ্বাস আছেন। বৃষ্টি কাদা চলে যাক। আমি একটু কাজকর্ম গুছায়া লই। সব ঠিক ঠাক করি। আবার নোয়াখালী এসে আপনাদের কাছ থেকে বেড়ায় যাবো। ঠিক আছে? আমি যা বলবো তাই আপনারা তা করবেন? আপনারা দিন ভরে পরিশ্রম করে উৎপাদন করবেন? চোরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন? এবং যা আছে শোষণহীনসমাজ হওয়ার চেষ্টা করবেন? সকলে হাত তোলেন সব।
জয় বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা’)
জয় বাংলা।। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা’)
আমার দেশ তোমরা দেশ (জনতা সমস্বরে- ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
আমার দেশ তোমরা দেশ (জনতা সমস্বরে- ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
Unicoded by Dr Razibul Bari
Reference:
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক
পিপলস ভয়েস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান
অডিও