You dont have javascript enabled! Please enable it! মৌল গণতন্ত্র – তত্ত্বে এবং প্রয়ােগে - সংগ্রামের নোটবুক

মৌল গণতন্ত্র – তত্ত্বে এবং প্রয়ােগে

১৯৬২ র ৮ই জুন সামরিক শাসনের অবসান ঘটল। যুগপৎ উদ্বোধন হ’ল দ্বিতীয় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংসদ বা ব্যবস্থাপক সভার। উদ্বোধন লগ্নেই আয়ুব অবহিত ছিলেন এ সংসদ ঝানু সব রাজনীতিকে ঠাসা। সামরিক আইনের নিগড়ে গণতন্ত্রকে বাঁধার ফাঁকে, আবার একই সঙ্গে মৌল গণতন্ত্রের সােনার পাথরবাটি সাজাতে-সাজাতে আয়ুব খান যেন জানতেই পারেন নি কী কৌশলে রাজনীতিকরা নিজেরা অথবা তাদের-ই বাছাই করা প্রার্থীরা সংসদ ভবনে তাদের আসন পাকা করে নিয়েছে নির্বাচনে জয়লাভ করে। অথাৎ এত করেও, নিজের তাঁবেদার দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরেও, ঠিক স্তবকে-ভরা একটি সংসদ ভােগ করার বাসনা তাঁর পূর্ণ হ’ল না। ঐ রাজনীতির পাণ্ডারাই কি কম ধূর্ত ? ওদের ভােটে দাঁড়ানাে নিষিদ্ধ করা মাত্র ওরা ওদেরই চ্যালাদের ভােটে নামালাে এবং সংসদ-সদস্য করে ছাড়লাে! পূর্ব পাকিস্তানী পাঁচ জন মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হলাে। এরা প্রত্যেকেই এম, এন, এ। দশজন মন্ত্রিপরিষৎ সদস্যের অধিকাংশই ছিলেন এম, এন, এ। অবশ্য সংবিধানে সুযােগ ছিল সংসদ বহির্ভূত ব্যক্তিকে মন্ত্রী করার। আয়ুবের মলব, মন্ত্রিত্বের বিতরণে সংসদ-সদস্যদের মধ্যে খেয়ােখেয়ি বাধানাে। বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করা হ’ল। ইনি প্রাক্তন পাক প্রধান মন্ত্রীও বটে। সংসদীয় সচিব হিসাবে আয়ুব, বহুল সংখ্যক ব্যক্তিকে মনােনীত করলেন এম, এন, এ-দের মধ্য থেকে। এতে আয়ুবের স্তবক-সংখ্যা বাড়লাে। পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের মধ্যে বিরােধ তীব্রতর করতে প্রাক্তন মুসলিম লীগ নেতাদের-ই মন্ত্রিত্বে বরণ করা হ’ল। যে সংসদের কাছে মন্ত্রী দায়বদ্ধ নয়, তার বেলায় এত সচিব পদ সৃষ্টির প্রকৃতই কোনাে কারণ ছিল না। অবশ্য মলব সিদ্ধি-ও তাে একটা ব্যাপার। সমরনায়ক রাষ্ট্রনায়ক হলে সেটাই যে হয় একমাত্র ব্যাপার! ডন পত্রিকাও অনাবশ্যক সচিবপদ সৃষ্টির অভিসন্ধির মূল উদ্ঘাটিত করে সমালােচনা করে। রাজনীতিকদের কল্পনাশক্তিও নাগাল পাবে না এমন এক কীর্তি আয়ুবকে এ সব সত্ত্বেও সংবাদস্রষ্টার গৌরব দিল। তিনি সেই কে, এ, সাবুরকে কেন্দ্রীয় যােগাযােগ মন্ত্রীর আসনে বসালেন যাঁকে তাঁর নিজের-ই সৃষ্ট সামরিক আইন কিছু কাল পূর্বেই সাজা দিয়েছিল। (১) পূর্বপাকিস্তানের কুশলী সাংসদদের মােকাবিলা করার তাগিদেই আয়ুব খানকে নানা রাজনৈতিক ছলাকলার আশ্রয় নিতে হত। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে অসাংসদ মন্ত্রী দুজন ছিলেন। কিন্তু দক্ষ বিতার্কিক বলতে যা বােঝায় তারা সবাই যে ঐ বিরােধী ভাবাপন্ন। পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদ। পাঞ্জাবী সাংসদরা সীমান্ত প্রদেশের সদস্যদের চেয়ে, এবং পূর্ব পাকিস্তানীর চেয়ে তাে বটেই, কেমন যেন অপরিণত ছিলেন – এই মন্তব্য ১৯৬২-র ৩রা মে তারিখে ‘দি টাইমস’ পত্রিকাতে করা হয়েছিল। সভাধ্যক্ষ বা স্পীকার পদে সকল পূর্বপাকিস্তানী সদস্য একবাক্যে তমিজউদ্দিন খানকে সমর্থন করে তাঁদের সংহতি এবং শক্তি প্রতিপন্ন করেন। অথচ উপাধ্যক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের মতানৈক্য ছিল রীতিমতাে তীব্র। পূর্বপাকিস্তানীদের সংহতির মুখে আয়ুবপন্থীদের গােপন বাসনা পুরণ সম্ভব নয় বুঝে, তাদের প্রার্থী হবিবুর রহমান, অধ্যক্ষপদের জন্য তমিজুদ্দিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে শেষ পর্যন্ত সাহস-ই পান নি। পূর্বপাকিস্তানীরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে তমিজুদ্দিনকে সমর্থন করছেন একথা জেনেই আয়ুবপন্থী হবিবুর পিছিয়ে যান। প্রথম গণপরিষদ বা কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির চেয়ারম্যান এবং মুসলিম লীগের তখনকার দিনের অন্যতম প্রধান তমিজুদ্দিনকে সুসংহত সমর্থন জ্ঞাপন করে পূর্ব পাকিস্থানীরা ‘পাকিস্তান টাইমস’ – এর পর্যন্ত প্রশস্তি লাভ করেছিলেন। পশ্চিমখণ্ডের অনৈক্য ঠিক একই সঙ্গে সমালােচিত হয়েছিল ঐ পত্রিকায়। পূর্বখণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঐক্যবদ্ধ হবার উপদেশও বিতরণ করে ঐ পত্রিকা। নইলে, ঐ পত্রিকার মতে নাকি উভয় খণ্ডের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা হতে পারে। অর্থাৎ পত্রিকার লেখক বড়ই ভাবনায় ছিলেন, পূর্বের সঙ্গে লড়াই করবেন কী ভাবে এঁরা যাঁদের নিজেদেরই এত বিবাদ? (২)
ডন পত্রিকাও যে-বিষয়টি চেপে রাখতে চায় নি তা হ’ল পূর্বপাকিস্তানীদের বিত্ত, শিল্প, আর্থিক ব্যাপার ইত্যাদি উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলির মন্ত্রী করা হয় নি। এদিকে আবার মুহম্মদ আলির চাপে, আয়ুব সংবিধান শুধরে মন্ত্রীদের সংসদ সদস্য থেকে যাবার সুযােগ দিলেন। পাঁচ জন পূর্বপাকিস্তানী সাংসদকে মন্ত্রী করে নিলেন আয়ুব এই সঙ্গে। কিন্তু নিজ প্রদেশের দাবিদাওয়া মেটানাের প্রতিশ্রুতি না পেয়ে এবং নিজ প্রদেশের সাংসদদের সঙ্গে পরামর্শ না করে মন্ত্রিত্বে ব্রীত হবার জন্য এই পাঁচজনের প্রত্যেককে কার্যতঃ দলত্যাগী ঘােষণা করা হ’ল। ৭৮ জন পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যের মধ্যে ৬২ জনই এই নিন্দাপ্রস্তাবের এবং কার্যতঃ দল বা গােষ্ঠী থেকে বহিষ্কারের সমর্থন করেছিলেন। (৩)
পাকিস্তান টাইমস এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে, পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যরা যদি এর ফলে বিরােধী ভূমিকাই গ্রহণ করে চলে, তা হলে মন্ত্রিপরিষৎ সংসদের ভােটযুদ্ধে পরাভূত হতেও তাে পারে। অর্থাৎ মন্ত্রীদের যে সংবিধান শুধরে এম, এন, এ পদে ব্রীত থাকার অধিকার দিয়ে ঐ মন্ত্রিপরিষদের উপর একটুখানি গণতান্ত্রিক প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল তাই তাে মুছে যাবে ভােটে হেরে গেলে। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানীদের সুদৃঢ় ঐক্যে যে একটু ফাটল ধরানাে গেছে অর্থাৎ কয়েকজন দলছুটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে—এটাই আয়ুবের একমাত্র সাফল্য বা সান্ত্বনা। (৪)
পূর্বপাকিস্তানী সাংসদদের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা সরকারের ছিল। ১৬ই জুন, ১৯৬২-র পাকিস্তান টাইমস এই শক্তির উৎস নির্ণয় করে লেখে—পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজ অঞ্চলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ। ব্যক্তিগত স্বার্থচালিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে এই তাদের পার্থক্য।
আয়ুব চিরাচরিত স্বৈরাচারী ধাঁচে পুরস্কার এবং শাস্তির যুগপৎ যােগানের ব্যবস্থা রেখে চললেন। অনাবশ্যক সংসদ সচিব পদ গুলাে যেমন পুরস্কার, দুত মারফৎ হুমকি তেমন-ই শাস্তির হুঁশিয়ারি। সামরিক শাসন ফিরতে পারে – এই গুজবটি ছড়িয়ে আয়ুবতন্ত্র সন্ত্রস্ত করতে চেষ্টা করে গেছে সাংসদদের। প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করলে সাংসদরা যেটুকু স্বাধীনতা ভােগ করছে তাও খােয়াবে। কারণ ফের সামরিক শাসন আসবে সেক্ষেত্রে – এই গুজব কিছু সাংসদকে নিশ্চয়ই নিস্তেজ করে থাকবে। (৫)। রাজবন্দীদের মুক্তির মূলতবী প্রস্তাবের বিতর্কে পূর্বপাকিস্তানী এম, এন, এ-দের সুসংহত শক্তির মুখে মন্ত্রিত্বের সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েও বগুড়ার মুহম্মদ আলি পর্যন্ত বন্দীমুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস করেন নি। মশিউর রহমান বলেন, বিনা বিচারে সাড়ে তিন বছর জেল তাে বন্দীরা খেটেইছেন – সরকার আইনসম্মত বিচার করে অভিযােগ প্রমাণের চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়েছে এতদিন। এর পরে বিচারের প্রহসন অর্থহীন। বিনাবিচারেই
যেখানে সাজা হয়ে গেছে তাঁদের। সােহরাবর্দিকে দেশদ্রোহী বা দেশের শত্রুদের সঙ্গে যােগসাজশকারী বলা ভুল, একথা জোরের সঙ্গে বলেন কামরুল আহসান। এত বড় অভিযােগের প্রমাণ হ’ল না কেন এতদিনে – এ প্রশ্ন করে তিনি বন্দীমুক্তির অন্যথা হলে পূর্বপাকিস্তান যে উদ্বেল হয়ে উবে — সেই হুঁশিয়ারি দেন। (৬)
এর পরেই মুলতবী প্রস্তাবের পক্ষে এম, এন, এ-দের এককাট্টা অবস্থানে এবং তাদের বিস্তৃত বক্তৃতা শুনে, সন্ত্রস্ত আয়ুব মন্ত্রিপরিষদের মুখরক্ষা উদ্দেশ্যেই এম, এন, এ-দের সঙ্গে এক ভদ্রলােকের চুক্তি করেন। ছাঁটাই প্রস্তাব তােলা যাবে না বাজেট প্রস্তাবের উপর – ঐ চুক্তির এই শর্ত, বিরােধী ভাবাপন্ন সাংসদরা অগ্রাহ্য করেন এবং মামুলি এক টাকা হেঁটে দেবার প্রস্তাবের ছলে আলােচ্য প্রশ্নের সমস্যার দিকটি তুলে ধরেন। কামারুল আহসান ঐ দিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অধিকারের প্রশ্নটি — বিশেষ করে তার প্রতিরক্ষাকে স্বনির্ভর করার দীর্ঘ দিনের দাবি – উত্থাপন করেন। এ সব সত্ত্বেও ঐ মন্ত্রিপরিষৎকে খারিজ করার কোন সাংবিধানিক সুযােগ ছিল না। বিভাজনের দাবিকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্টের সহকারী ভুট্টোর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদদের বেশ বচসা হয়ে গেল। অবশ্য মন্ত্রিপরিষৎ, আয়ুবের অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে জয়লাভ তাে করতে বাধ্য করলেও জয়লাভ। আয়ুবের দোসর পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার প্রাজ্ঞ সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তানীদের ভৎসনা করলেন কারণ তাংরা সংসদীয় পরিমিতি বােধের পরিচয় দেননি।(৭)
সামরিক আইনের প্রথম দিকে দলীয় ব্যানারে ভােটে নামা নিষিদ্ধ ছিল। পরে দলগুলাের পুনরুত্থান নিষেধ করে অর্ডিন্যান্স বা আদেশনামা জারী-ও করা হয়। সামরিক আইন তােলার লগ্নে ৮ই জুন, ১৯৬২ তারিখেও রাজনৈতিক দলগুলাে যে সংসদীয় কার্যক্ষমতা নষ্ট করে তার উল্লেখ করেন আয়ুব খান। অথচ মাত্র একমাস পরেই বিশেষ শর্তসাপেক্ষ আইনের বলে ঐ রাজনৈতিক দলগুলির পুনরভ্যুত্থানের ব্যবস্থা করা হল। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তীব্র আন্দোলনের চাপেই এটা করতে হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষৎ তথা সরকারের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় করার আশায় আয়ুব, রাজনৈতিক দলগুলাের বৈধতা স্বীকার করার মতলব আটেন – এটা সত্য হলেও, কার্যক্ষেত্রে ঐ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযােগ সরকারের ভাগ্যে জোটে নি। বগুড়ার মুহম্মদ আলির গণতান্ত্রিক গােষ্ঠীর ৩৫ জন এবং সরকার-সমর্থক মুসলিম প্রগতিশীল গ্রুপের বারির নেতৃত্বাধীন ৩০ জন সদস্য, সংসদে থাকলেও সদার বাহাদুর খানের নেতৃত্বাধীন নিরপেক্ষ গােষ্ঠীর ৩০ জন এবং মশিউর রহমান ও ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে আস্থাবান্ প্রায় ৩০ জন পূর্ব পাকিস্তানীর কথা ১৯৬২র ১৭ই জুলাই তারিখের পাকিস্তান টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়েছিল। গােষ্ঠী বহির্ভূত সদস্যদেরও আনুগত্যে বিভাজন ছিল। (৮)
এই অবস্থায় এম, এন, এ পদে কায়েম থেকেও মন্ত্রীর আসনে ‘অভিষিক্ত থাকার ব্যাপারটি জটিলতার সৃষ্টি করলাে। সংসদে ভােটে ‘হার মন্ত্রীদের পক্ষে অতীব অবমাননাকর হতাে। প্রেসিডেন্ট নিয়ন্ত্রিত এই মন্ত্রিবর্গ অবশ্য সরকারী প্রস্তাবাদির পক্ষে সাংসদদের সমর্থন অর্জনে সচেষ্ট হতেন। সরকার পক্ষকে পরাজিত করলে আয়ুবের কোপে পড়তে হবে – এই ভীতি প্রদর্শন তাে করাই হ’ত। তদুপরি, ভােটাভুটিতে হেরে গেলেও মন্ত্রিপরিষৎ বহাল থাকবে – এমন আদেশনামা জারী তাে করাই হয়েছিল। সংসদীয় ব্যবস্থায় তথাপি ভােটাভুটিতে জিতে যাবার প্রয়ােজনে একটি তাঁবেদার রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজনের কথা আয়ুব যে অনুভব করতেন, তা তাঁর স্তবক পাকিস্তান টাইমস ১৯শে জুলাই, ১৯৬২র সংখ্যায় স্বীকার করা হয়েছিল। পরােক্ষ ভাবে হলেও একটি তাঁবেদার দলের নেতা হিসাবে আয়ুবের আবিভাব হােক – এই কামনাও ঐ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। (৯)
খােলাখুলি রাজনীতি করলে এক দলকে অপর দলের বিরুদ্ধে প্ররােচিত করে প্রেসিডেন্ট প্রথার বিরােধী সংসদপন্থীদের কোণঠাসা করতে সুযােগ পাবেন আয়ুব – এই হিতকথা পাকিস্তান টাইমস বর্ষণ করে চললাে। (১০) আয়ুবের মন্ত্রীরা না পেয়েছিলেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেরেছিলেন সংসদ ভবনের বাহিরে রাজনীতির খােলা ময়দানে জনসমর্থন। এবডাে – সাজা প্রাপ্ত রাজনীতিকরা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট প্রথার বিরুদ্ধে বিরাট বিরাট জনসভা করে চলেন পূর্ব পাকিস্তানে। তাদের সােহরাবর্দিকে গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে ও ছিল। খান আবদুল কাইয়ুম খানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিক্ষোভ। এদিকে আয়ুব স্তাবকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পাকিস্তান টাইমস ১০ই জুলাই ১৯৬২ যে মন্তব্য করলাে তা ছিল প্রেসিডেন্ট প্রথাকে জনপ্রিয় প্রমাণ করা এবং তার পক্ষে রাজনৈতিক দল গড়ার কথা কর্তৃপক্ষকে নিবেদন করার ছল মাত্র। প্রকৃত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল টাইমস অব ইণ্ডিয়ার সম্পাদকীয় কটাক্ষে – ‘আয়ুব জমানা এই সত্য আবিষ্কার করে হতাশ হচ্ছে যে, স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মাঝামাঝি কিছু হয় না।’ (১১) আয়ুবের গণতান্ত্রিক ঠাটবাটের মধ্যে তাঁর স্বৈরাচারী প্রবণতা কিছুমাত্র হ্রাস পায় নি। কোনাে সময়ে যাঁর ছয় মাসের কারাবাস হয়েছে ঐ স্বেচ্ছাচারী নিরাপত্তা আইনের সুবাদে, তিনি কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগ দিতে পারবেন না- এই অনুজ্ঞা জারী করা হ’ল। অথাৎ নিরাপত্তা আইনকেই আবার-ও সক্রিয় করে তােলা তাে হ’লই এই কৌশলের সাহায্যে, তার প্রযােগক্ষেত্রও আরাে সম্প্রসারিত হ’ল। এই সব একতন্ত্রবাদী বিধি নিষেধ রাজনৈতিক দলেগুলাের কার্যকলাপের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করে দিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তানের নাসরুল্লা খান, রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত নূতন বিল সম্পর্কে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছিলেন এই কথায় যে, এ বিল এক হাত দিয়ে যাকিছু দিয়েছিল অন্য হাতে তার সবটাই ফের কেড়ে নেবে। ঢাকায় ৮ই জুলাই, ১৯৬২ তারিখে এক মহতী জনসভায় এই গণতন্ত্রবিনাশী প্রতারণাপূর্ণ বিলের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। করাচী এবং লাহাের প্রভৃতি স্থানেও অনুরূপ প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ামকের ভূমিকা জনগণের। কিন্তু এ বিলে সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের উপরেই সেই ভূমিকা বর্তায়। রাজনীতির অবাধ কার্যকলাপ এবং প্রতিবেশী ভারতের মতাে দু’ তিনটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সরকারী স্তরে দুর্নীতি হ্রাস পেত—এই মত ফরিদ আমেদ প্রকাশ করে আয়ুবপন্থীদের মত খন্ডন করেন। অর্থাৎ রাজনীতিকে দুর্নীতির ক্ষেত্র এবং রাজনীতিককে তার নায়ক প্রতিপন্ন করার অপপ্রচারের জবাব দিয়ে যে সত্য পরােক্ষ ইঙ্গিতে ফাঁস করা হ’ল তা হ’ল স্বৈরাচারী প্রশাসকরা দুর্নীতির আধার। একাধিপত্য রক্ষার প্রয়ােজনেই আমলাদের অবাধ লুণ্ঠনের সুযােগ করে দেয় স্বৈরাচারী শাসক স্বয়ং।(১২)
মাত্র কয়েক সপ্তাহ হ’ল সামরিক শাসনের অবসান হয়েছে। এই অবস্থায় আয়ুব জমানার সমালােচনার যে-সুযােগ দীর্ঘ ৪৪ মাস পরে এসেছে তার সদ্ব্যবহার সংসদের বাহিরে যেমন ভিতরেও তেমন করলেন মধ্য জুলাই-এর সংসদ অধিবেশনের বক্তারা। বিতর্কের গুণ বিচারে সরকার পক্ষের যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হার মানতে হয়েছে—একথা পাকিস্তান টাইমসও স্বীকার করলাে। ডন-তাে এবারের সংসদ অধিবেশনে বক্তাদের দৃপ্ত এবং অকপট কার্যকলাপের সাধুবাদ করে প্রাক সামরিক শাসন কালের সাংসদদের চেয়েও এই সীমিত গণতন্ত্রাধীন সাংসদদের উদ্দীপ্ত বাচন ভঙ্গি এবং তাকে জোরের সঙ্গে অকপটভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতাকে বড় করে দেখালাে। পশ্চিম পাকিস্তানী সাংসদরা উত্তেজনা প্রবণ এলাকার ঐতিহ্য বহন করেও আনেন নি, আবার বিশেষ কোনাে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশজনিত একরােখা ভাব-ও তাদের ছিল না। উপরন্তু স্বভাবতঃই স্বল্পভাষী এবং সঙ্গতিপন্ন হবার কারণে জ্বালাময়ী বক্তৃতা নির্ভর রাজনীতি তাঁদের ধাতে নেই। এমন অনেক কথাই পাকিস্তান টাইমস লিখলাে যা থেকে বেশ বােঝা যায়, পূর্বপাকিস্তানী সাংসদদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পশ্চিম পাকিস্তানী সাংসদরা ঐ আয়ুব-স্তুতিকার সাংবাদিকের মনঃক্লেশের কারণ হয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়া বিরূপ হতে পারে এই আশঙ্কায় সকল সমালােচনা বন্ধের ঝুঁকি নিতে না পেরে সরকারকে এই পর্বে পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের উপস্থাপিত অনেক অসন্তোষজনক কথাবার্তা সহ্য করতে হয়েছে। যদিও ঐ মহল থেকেই বিপদ আসতে পারে এটা জানা ছিল, তবু সামরিক শাসন বাতিল করামাত্র পুনবার সেই প্রত্যক্ষ পীড়নের পথে যেতে অসুবিধা ছিল। কাইয়ুমকে গ্রেপ্তার করা কিংবা সােহরাবর্দির কারাবাস দীর্ঘতর করার বেশ বিরােধিতাই করেছিল ডন পত্রিকা। অবশ্য একই সঙ্গে ঐ পত্রিকা খােসামােদ করতেও ছাড়ে নি এই কথা বলে যে ওদুটো কাজ নাকি সরকারের কার্যাবলীর অমৃতভান্ডে পতিত মক্ষিকা সুলভ। অথাৎ, ঐ সাংবাদিকের মতে, সরকারের সাম্প্রতিক কার্যাবলী ছিল অমৃত ! (১৩)।
নেতাদের আটক রাখায় সরকার-বিরােধী আন্দোলন উঠেছিল তুঙ্গে তাঁদের মুক্তির দাবিতে এতাে সরকার পক্ষ দেখেইছে। আবার ছাড়া পেয়ে সােহরাবর্দি পশ্চিম-পূর্ব উভয় অংশ জুড়ে এক জাতীয় ফ্রন্টের সংগঠন করে সংবিধানকে গণতন্ত্রসম্মত করতে সচেষ্ট হন। পুনরায় আটক হবার ভয় অগ্রাহ্য করে মুজিবর রহমান ঝাঁপিয়ে পড়লেন ক্রিয়াকলাপে, অগণতান্তিক সরকারী নীতির কঠোর সমালােচনায় হলেন মুখর। একটি তাঁবেদার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করার মানসে মুসলিম লীগ দলকে চাঙ্গা করলেন আয়ুবপন্থীরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিমন্ডল বেছে বেছে প্রতিনিধি। মনােনীত করেও প্রথম অধিবেশনে পূর্বপাকিস্তানী প্রতিনিধিদের তােলা কাইয়ুম-এর। মুক্তিপ্রস্তাব নাকোচ করতে ব্যর্থ হলেন। একটি সংশােধনী প্রস্তাবের ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সংসদ সচিবদের আর অধিকার রইলাে না মুসলিম লীগদলের মধ্যে কোন দলীয় পদ লাভ করার। কর্তাব্যক্তিদের তৈরি দলীয় সংবিধান আরাে এক বড় ধাক্কা খেল। দেশের দুই খন্ডের সুষম প্রতিনিধিত্ব-র সংশােধনী পাশ হলে। এর ফলে লীগের কাউনসিল, কার্যকরী সমিতি এবং সংসদীয় বাের্ডে তাে বটেই, পার্টির সর্বোচ্চ পদসমূহ বিতরণের ক্ষেত্রেও এই নীতি অনুসরণের দাবি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানীরা। এই প্রশ্নে অবশ্য পাকিস্তানের দুই খন্ডের প্রতিনিধিদের বিরােধ সাধারণ্যে প্রচার পায়। (১৪)
১৯৬২র সেপ্টেম্বরে প্রাক্তন আওয়ামী লীগ এবং তখন লুপ্ত জাতীয় আওয়ামী দলের নেতাদের সঙ্গে তাে বটেই, প্রাক্তন মুসলিম লীগের যে দুই নেতা আয়ুবের মুসলিম লীগ থেকে সরে ছিলেন সেই সদার বাহাদুর খান এবং মিঞা মমতাজ দৌলাতানার সঙ্গেও আলাপ-আলােচনা চালাতে সােহরাবর্দি ব্যস্ত ছিলেন, যদিও তাঁর কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগ দেবার বা ভােটভিত্তিক কোনাে পদে ব্রীত হবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম করে পশ্চিম-পূর্ব উভয় খন্ডের জনগণের সমর্থন-ধন্য একটি জাতীয় ফ্রন্ট তিনি গড়ে তুললেন এবং আয়ুবকে এই ফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে গােলটেবিল বৈঠকে মিলিত হয়ে নূতন একটি সংবিধান রচনার উদ্যেগ নিতে পরামর্শ দিলেন। আয়ুবকে পূবর্তন সংবিধান রচনার উদ্যোক্তারা বিপথে চালিত করেছেন এই মত প্রকাশের সঙ্গে তিনি এই দাবি-ও করেন যে, জাতীয় ফ্রন্টকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৯৫ শতাংশ অধিবাসী সমর্থন করে। সােহরাবর্দি একথা কিন্তু মেনে নেন নি যে, এই জাতীয় ফ্রন্টের আড়ালে পূর্বপাকিস্তানীদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে। তার মতে, রাজনৈতিক চেতনা সমধিক ব’লেই পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ এই ফ্রন্ট গঠনে অধিকতর উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন। (১৫)
সােহরাবর্দির উপর উপরে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে, মৌলানা ভাসানি হলেন এই ফ্রন্টের অথাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বা এন, ডি, এফ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক পৃথক প্রাদেশিক কমিটি ইতঃপূর্বেই গঠিত হয়েছিল। ভাসানির জাতীয় আওয়ামী দল পাকিস্তানের উভয় অঙ্গেই জনপ্রিয় ছিল। ভাসানির উপরেই দলীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কোনাে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের রূপরেখা রচনার দায়িত্ব বর্তায়। পূর্ব পাকিস্তানী নেতারা কিন্তু তখনকার নানা বিধিনিষেধের নিগড়ে বাঁধা রাজনৈতিক দল গঠনে আপত্তি করেন। ভাসানি-ও তাদের যুক্তি মেনে নেন। আন্দোলন অবশ্য চলতেই থাকে। ঢাকার পল্টন ময়দানে ১৯৬৩র ১৭ই মার্চ নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভার উদ্যোক্তা ছিল এন, ডি, এফ। প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত সংসদের প্রতিনিধিরা যাতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন এমন গণতন্ত্র-সম্মত সংবিধানের দাবিতে প্রস্তাব, এই জনসভায় গৃহীত হয়। মুজিবর তাে নয়া সংবিধানের দাবিতে আন্দোলন সদলবলে পরিহার করবেন এই কথা জানান এই শর্তে যে আয়ুবের চালু করা সংবিধানের পক্ষে দেশের দশ শতাংশের সমর্থন আয়ুবকে গণভােটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ মুজিবর বুঝিয়ে দেন, দেশ শুদ্ধ মানুষ এই স্বৈরাচারী তথা নাগরিক অধিকার খর্বকারী সংবিধানের উপরে বীতশ্রদ্ধ। (১৬)।
পূর্বপাকিস্তানীছাত্রমহল থেকে এল আয়ুবতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্রতর সংগঠিত আঘাত। পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা হয়েও, আয়ুবের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হবার কারণে খান এ সাবুরের ডাকা জনসভার অনুষ্ঠান, রংপুরের ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং জনসাধারণের সহযােগিতায় আদৌ সম্ভবই হয় নি। সভা করতে ব্যর্থ হয়ে সাবুবের অনুগামীরা ছুরিকাঘাত করে ছাত্রদের । পাকিস্তান দিবসে, ১৯৬৩-র ২৩শে মার্চ, পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র নিহত হন। কিন্তু এই সব ঘটনা সম্পর্কে কোনাে মুলতবী প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করতে দেওয়া হয় নি। অবস্থা ক্রমশঃ আয়ুবের নাগালের বাইরে চলে যায়। স্বয়ং আয়ুব ঢাকায় উপস্থিত থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়-সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জন করতে বাধ্য হন। রাজশাহীতে গিয়েও আয়ুব সেখানকার ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। কার্জন হলে ডাকা ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ আক্রমণ করে। এ সব সম্পর্কে সংসদে মুলতবী প্রস্তাব তােলার দাবি অগ্রাহ্য করা হলেও, ছাত্রদের আন্দোলন এবং বিক্ষোভ সমাবেশ ইত্যাদির চাপে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলাে কার্যতঃ অচল অবস্থায় পৌছায়।(১৭)

গণ-আন্দোলনে সন্ত্রস্ত আয়ুব সরকার, জাতীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন শেষ হতেই ১৯৬২-র জুন মাসে পাকিস্তান দন্ডবিধি বা পীন্যাল কোড জারী করে। ছাত্রবিক্ষোভ এবারে কিন্তু করাচী, লাহাের পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বহু ছাত্র লাহােরে কারারুদ্ধও হয়। সমস্ত বিষয় উল্লেখ করে ঐ দন্ডবিধি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সংসদে বক্তৃতা করেছিলেন মাহাবুবউল হক। স্বাধীন পাকিস্তানে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে-আদর্শের কথা জিন্নার মুখে জেনে ছাত্ররা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার এই বীভৎস পরিণামে ছাত্রসমাজ গর্জে উঠলাে স্বাভাবিকভাবেই। মাহাবুব উল হক বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ কীভাবে এই কালাকানুনের পর থেকে হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের বিভীষিকা সেই কথা। (১৮)
অতঃপর এল আয়ুব-সংবিধানের প্রথম সংশােধনী বিল। সরকারপক্ষ এই বিলে পাকিস্তানকে ঐশ্লামিক রাষ্ট্র ঘােষণা করে তার নূতন নামকরণের প্রস্তাব করলে, বিরােধী সাংসদরা বাধা দেন, এবং নামে ইসলাম-প্রীতি জাহির করার প্রতিবাদ করে বলেন–যেসরকার বিদেশী সুরা আমদানীর পরিমাণ ক্রমশঃ বাড়তে দেয়, যদিও ইসলামে সুরাপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তার এই অহেতুক নামকরণে ইসলাম-প্রীতি জাহির করা হাস্যকর। ফরিদ আহমদ তাে তীক্ষ বিদ্রুপ করে বলেন—ঐশলামিক ভাবাবেগকে আজ সুরাপানের আবেগ পিছু হটতে বাধ্য করেছে। (১৯)
ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করে, মধ্যযুগীয় ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করার অভিসন্ধি কথঞ্চিৎ আড়াল করার প্রয়ােজনে সংবিধান-সংশােধনী বিলটিতে এক চমকপ্রদ প্রস্তাব ছিল। মৌলিক অধিকারকে আইন প্রণয়নের নীতিগত নিয়ামকের ভূমিকা থেকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেবার এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মাহাবুবউল হক বলেন, সরকার এই সব আপাত গণতান্ত্রিক নীতিগত সূক্ষ্ম কারুকার্যের আড়ালে বড়ােই স্থূলভাবে সামরিক শাসনকালের দমন-পীড়ন মূলক নির্দেশনামাগুলাে জীবন্ত করে তুলতে চাইছে। এই প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করেন বেগম রােকেইয়া আনােয়ার-“যদি ১৯৫৮-৬২ আমলের সামরিক শাসনকালে চাপানাে আইনগুলাে পূর্ববৎ বলবৎ থাকে, তা হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রদান করার দাবি আইনমন্ত্রী কোন্ যুক্তিতে করতে পারেন? জনগণের সচেতনতা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ছােট করে দেখার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারী দিয়ে কামরুল আহসান-ও বক্তৃতা করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন জনসাধারণের প্রতিবাদ অভ্যস্ত সংযমের সীমা লঙ্ঘন করলে তার জন্য দায়ী থাকবে সরকারী দমননীতি। (20)
রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত এক নম্বর আদেশনামার জোরে রাজনীতিকদের স্বাধীনতা আরাে খর্ব করার ব্যবস্থা হ’ল। এবডাের পীড়নে লাঞ্ছিত নেতারা পাকিস্তানের সৃষ্টির জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, এবডাের ছলে তাদের বিপজ্জনক বলে প্রচার করেও সরকার পক্ষ দেখলাে তাদের জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র হ্রাস পায় নি। আজিজুল নামের জনৈক ব্যক্তি কোনাে এক সরকারী কর্মচারী সভার পরিচালনা করেছিলেন—এই অজুহাতে নেতা আজিজুল হককে এবডাের কবলে ফেলা হয়েছিল। পল্টন ময়দানে সরকার সমর্থকরা একবার চ্যালেঞ্জ দিয়েও সভা করতে ব্যর্থ হয়। ঢাকার জনগণের সরকারের প্রতি অনাস্থা এতদূর তীব্র ছিল যে, সরকারের স্তাবকদের বক্তৃতা শােনার শ্রোতাই পাওয়া গেল না পল্টন ময়দানে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এবং মাৎসর্য বশতঃ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থিত নেতাদের জনসভায় ভাষণ দান কিংবা সংবাদপত্রে বিবৃতি দান নিষিদ্ধ হ’ল নূতন আদেশনামার জোরে কারণ এই সব নেতাদের উপর এবাের প্রয়ােগ করা হয়েছিল ঐ সামরিক শাসনকালে। (২১)
একই সঙ্গে এবডােসাজা প্রাপ্ত নেতাদের পছন্দমতাে ঐ অর্ডিন্যান্সের কোপ থেকে অব্যাহতি দেবার ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে আয়ুব চাইলেন বিরােধী শিবিরে ফাটল ধরাতে।(২২)।
এরপরেই আক্রমণ নেমে এল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর। ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ দেশ জুড়ে সরকারী আদেশনামাজারী হ’ল এই মর্মে যে সরকার পক্ষের বক্তব্য, প্রচারপত্র পুরাে বা সংক্ষিপ্তভাবে ছাপতে প্রতিটি পত্রিকা বাধ্য থাকবে। অথচ সংসদভবনে বিরােধীদের ভাষণের যে-ভাষ্য অধ্যক্ষ বা স্পীকার মারফৎ সংবাদপত্র দপ্তর প্রাপ্ত হবে, অবিকল তাই ছাপতে হবে। অন্যথা সংবাদপত্রের লাইসেন্স কেটে যাবে। ইচ্ছা করলেই সরকার একটি কমিশন নিয়ােগ করে সংবাদপত্রাদির আর্থিক শৃঙ্খলা পরীক্ষা করতে এবং সেই ছলে পেটোয়া পত্রিকার স্বার্থে বিরােধীভাবাপন্ন পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও পারবে -কা র্যতঃ এই মর্মে হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছিল সংবাদ পত্র ঘটিত ঐ আদেশনামায়।(২৩)
সােহরাবর্দি যখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের প্রধান মন্ত্রীর উচ্চপদ গ্রহণ করেন। তখন যে-ভাসানি তার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাতেন, সেই ভাসানিই এবারে চীনের মুক্তিদিবসে প্রতিনিধি হবার সামান্য সুযােগে আয়ুবের তাঁবে চলে গেলেন। অবশ্য ভাসানির নিজেকে ঠকানাের মতাে ছুতাে একটা ছিল। ১৯৬৩-র অক্টোবরের আগে থেকেই আয়ুব চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে লেগে পড়েছিলেন। স্ববিরােধের চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে ঐ। ভাসানিই নিজের পুরানাে দল ন্যাপের পুনরুভ্যুত্থানে ব্যস্ত হলেন এবং ১৯৬৩-র ১৫ ই ডিসেম্বরের মধ্যে তার প্রস্তাবিত পূর্বপাকিস্তানস্বার্থবাহী ছয় দফা দাবি পূরণ না হলে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন সে কথাও জানালেন। (২৪)।
অন্যদিকে পূর্বপাকিস্তানের মতাে পশ্চিম পাকিস্তানেও বিরােধীদের জনসভায় সরকার পক্ষের ভাড়াটে গুন্ডারা হামলা শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী সাংসদ চৌধুরী মুহম্মদ হুসেইন চাটঠা সংসদে বলেন—এই সংসদের ক্ষমতা কিছু না থাকলেও, এটিই আমাদের নিরাপদ বিলাপ-কক্ষ। জনসভাও তাে আজ বিপজ্জনক। মৌল গণতন্ত্র যে প্রকৃত গণতন্ত্র নয় তা এই সংসদের ক্ষমতাশূণ্যতাই প্রমাণ করে। আয়ুবপন্থী মুসলিম লীগ রাওয়ালপিন্ডির একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং শিয়ালকোটে জিন্নার স্মারক একটি হাসপাতাল ভবন জবরদখল করে এই সময় (জুন, ১৯৬৩)। আয়ুব এই দলের সদস্যপদ গ্রহণ করার পর থেকে নির্লজ্জ ভাবে সরকারী অর্থে এবং আনুকূল্যে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে ব্রতী হয় এই দল। মাহাবুব উল হক বলেন— একেই বলে পাকিস্তানী গণতন্ত্র। আয়ুব এই দলের নিম্নতম পর্যায়ের সদস্য বলে দলীয় ইশতেহারকে সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তি হিসাবে চালানাে হচ্ছে এবং দৈনিক পত্রিকাকে বাধ্য করা হচ্ছে সে সব ছাপতে। পৃথিবীর আর কোন্ দেশে এটা সম্ভব ? (২৫)
যে সংসদের ক্ষমতাই নেই আদপে তার সদস্যদের দায়িত্বপালনের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ আয়ুব তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে তুলনা করলেন। সৈয়দ হুসেইন মানসুর বলেন, ক্ষমতাই নেই কিছু কার যেখানে আমরা করবােই বা কী ? এক অর্থে। আয়ুবের কথা ঠিক। কিন্তু একথাও সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এ সংবিধানে আমাদের সাংসদ হয়েও কোন কিছু করার অধিকার নেই। সৈয়দ হুসেইন মানসুর বলেন, ব্যবস্থাপক সভা বা সংসদের হাতে ক্ষমতা কিছু নেই। তথাপি নির্বাচন জিতে এম, এন, এ হয়ে আর কিছু না হােক এই সংবিধানের বিচ্যুতিগুলাে আমরা প্রকাশ করতে পারবাে এই ধারণাটুকু ছিল। বিরােধী রাজনীতিকদের উপর পাকিস্তান দন্ডবিধি আদেশের যথেচ্ছ। অপপ্রয়ােগ রুখতে যে-সংশােধনী মুহম্মদ আবদুল হক চেয়েছিলনে তা-ও প্রত্যাখ্যাত হয়। তিনি আদপেই তা উত্থাপন করার সুযােগই পান নি। (২৬)।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে-দাবি পূর্বপাকিস্তানীরা করছিলেন তা মােটেও স্তিমিত হয় নি। সে সব সত্ত্বেও পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তান বেতারবার্তা জোর করে উর্দুভাষায় প্রচারমাত্রা বাড়িয়ে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙলা ভাষায় প্রচারের সময়সীমা নগণ্য করে এনে সমালােচনার সম্মুখীন হল। বেতার-উপদেষ্টামন্ডলের সদস্যা এবং এম, এন, এ বেগম শামসুন নাহার এই বিসদৃশ ভেদবুদ্ধির নিন্দা করলেন সংসদকক্ষের ভিতরে। অবশ্য সাংস্কৃতিক নিপীড়নের প্রতিরােধে আন্দোলন সংসদকক্ষেই আবদ্ধ ছিলএমন নয়। (২৭)।
পূর্বপাকিস্তানের স্থানীয় বাসিন্দা মােনেম খানের মতাে মক্কেলবিহীন আইনজীবীকে প্রাদেশিক গভর্নর বানিয়ে কিংবা বাঙলাভাষার সমৃদ্ধিকল্পে বাের্ড গঠনের কথা প্রচার করে পূর্বপাকিস্তানীদের স্বাধিকারের আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেন নি আয়ুব খান এবং তাঁর অনুগামীরা। এমন কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েও ঐ ন্যায্য দাবি স্থায়ীভাবে চাপা দিতে ব্যর্থ হয়েছে শাসককুল। নূতন সংসদে ১৮ই জুন, ১৯৬২ কামারুল আহসান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জ্ঞাপন করেন তাদের সঙ্কল্পের কথা : প্রতি বাজেটকে আমরা বিচার করবাে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক প্রয়ােজনগুলির নিরিখে। দেশের পূর্বখন্ড কতােদিনে পশ্চিমখন্ডের সঙ্গে আর্থিক বিকাশের দিক থেকে সম পর্যায়ে পৌছাবে তার কোনাে ইঙ্গিত নেই এ বাজেটে। অথচ ন্যূনতম কালক্ষেপ করে এইটি সম্পন্ন করা ছিল জরুরী। আজিজুর রহমান পরের দিনই বলেন, একটি দিন কেন একটি ঘন্টার কথাও আমার মনে পড়ে না যখন সংসদভবনে দেশের দুই খন্ডের আর্থিক বৈষম্য অপনােদনের দাবি আমরা করি নি। কিন্তু আমাদের বলা সব কথাই গিয়ে পড়েছে যে-কৰ্ণ কুহরে সে কর্ণ যে বধিরের। পূর্ব পাকিস্তানের যতাে অশান্তি, বিশেষতঃ ছাত্রমহলের যতাে অস্থিরতা তা ঐ বৈষম্যের কারণেই। (২৮) অমুসলিম সকল সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘায়ে তছনছ করে পুর্বপাকিস্তানবাসীকে তার রাজনৈতিক স্বাধিকার দাবি ছেড়ে সঙ্কীর্ণ ভ্রাতৃঘাতী জেহাদে মত্ত করা ছাড়াও একটি বিশেষ লক্ষ্য সম্ভবতঃ ছিল। ঐ দাঙ্গার প্রতিক্রিয়াজাত দাঙ্গা ভারতে এবং বিশেষতঃ কাশ্মীরে ছড়িয়ে গেলে কাশ্মীরে ছােবল সহজ হবে—এটাও সম্ভবতঃ আয়ুব ভাবতেন। তাই অপহৃত পবিত্র কেশ কাশ্মীরের মসজিদে এক সপ্তাহের মধ্যে উদ্ধার করার পরেও আয়ুবপন্থী পত্রপত্রিকা হজরৎ মুহম্মদের পবিত্র কেশ উদ্ধারকে ধাপ্পা বলে প্রচার করে চলে। দাঙ্গা চালু থাকলে অমুসলিমরা প্রাণের ভয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করবে। তখন পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতা দূর হবে। এই ছিল তাদের গুঢ় উদ্দেশ্য। (২৯)
উক্ত অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৩-র ২৭ শে ডিসেম্বর এবং পুনরুদ্ধারের তারিখ ছিল ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৬৪। কেন্দ্রীয় যােগাযােগ মন্ত্রী খান এ সাবুর ৩রা জানুয়ারী, ১৯৬৪ খুলনার দৌলতপুরের শ্রমিক-এলাকায় ঐ পবিত্রকেশ অপহরণের প্রতিবাদ সভায় তীব্র প্ররােচনাপূর্ণ ভাষণ দেবার পরেই সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষরা সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি এবং তাদের নারীর সতীত্ব লুণ্ঠন করে। একই দিনে গভর্ণর মােনেম খান বাগেরহাটে এমন বক্তৃতা করেন যে তিনি বক্তৃতা শেষ করে হেলিকপ্টারে উঠতে-না। উঠতে অমুসলিমদের উপরে জনতার আক্রমণ শুরু হ’ল। দাঙ্গাকারীরা পরের দিন সম্ভবতঃ একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের বদলে অমুসলিম নিধনে নেমে পড়লাে সামরিক বাহিনী। নির্দিষ্ট আদেশ ছাড়াই তারা গুলি চালালাে সংখ্যালঘুদের উপর। দাঙ্গাবিধ্বস্ত বা দাঙ্গাসন্ত্রস্ত হিন্দুদের ভারতে পালিয়ে যেতে পাকিস্তান সরকার যেন সাহায্যই করলাে এর পরে। প্রতিক্রিয়াজাত দাঙ্গা পশ্চিমবঙ্গে বাধলে পূর্ব পাকিস্তানে তার জবাবে আরাে বড় দাঙ্গা বাধানাের আকাঙক্ষায় ভারতে যাবার পথে কোনাে বাধা দেওয়া হয় নি অমুসলিম পলাতকদের। (৩০)
খুলনার হিন্দুনিধনপর্বের প্রতিক্রিয়ায় বাধা কলকাতার দাঙ্গা দ্রুত সামরিক বাহিনীর সাহায্যে কঠোর হস্তে দমন করা সত্ত্বেও এবং পবিত্রকেশ উদ্ধারের পরেও, আয়ুবসরকারের বড়কর্তারা অবাঙালী মিল মালিকদের সঙ্গে গােপন সভায় ১৪ এবং ১৫ই জানুয়ারী মিলগুলিতে ছুটি ঘােষণা করে। ঐ দু’দিন অবাঙালী শ্রমিকদের হাতে সর্ববিধ মারণাস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের আদমজি কারখানা এবং টাঙ্গির নিষাত কারখানা এলাকায় ঐ সব অবাঙালী শ্রমিকরা অমুসলিমদের হত্যা করে উৎসবের মেজাজে। সঙ্গে সম্পত্তি লুণ্ঠন, নারীধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযােগও ব্যাপকভাবে চলে। হিন্দুরা বিতাড়িত হলে বা ভয়ে পালিয়ে গেলে রুজিরােজগারে মুসলিম বেকারেরা সুবিধা পাবে—এই প্রচারের ফলে সাধারণ বেকাররাও ঐ হিন্দুনিধন পর্বে উৎসাহভরে যােগ দেয়। (৩১)
১৪ই জানুয়ারী, নেলী সেনগুপ্ত তার প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিদের বাধ্য করেন চট্টগ্রাম শহরে অমুসলিম নিধন তাণ্ডবের পরিকল্পনা ভন্ডুল করতে। ঐ দিন হিন্দু বৌদ্ধ ইত্যাদি অমুসলিমদের বাড়িতে প্রত্যুষে লক্ষ্য করা গেল বাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে ক্রশ চিহ্ন আঁকা। অর্থাৎ এই বাড়িগুলােতে ঐদিন হামলা হ’ত। সংসদ স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, এই পূর্বপাকিস্তানী নেতার বিশেষ অবদান ছিল ঐ দাঙ্গা প্রতিহত করায়। (৩২) ইউনিয়ন কাউনসিল সদস্যরা অনেকেই অথাৎ আয়ুবের বিচিত্র সংবিধান সম্মত ঐ সব মৌল গণতন্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ ধান্দাবাজরা সব সময়ই আয়ুব জমানায় সুযােগ পেত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিছু পরিমাণে জিইয়ে রেখে হিন্দুদের ধন সম্পত্তি টাকাকড়িতে ছােবল দেবার। ভারত থেকে বিতাড়িত বা নিষ্ক্রান্ত এই মিথ্যা পরিচয় দিয়ে খাড়া করতাে তারা নিজেদের পেটোয়া মুসলিমদের। হিন্দুদের ভয় দেখাতাে ঐ মৌল গণতান্ত্রীরা এই মর্মে যে, বিস্তর পয়সাকড়ি ভেট না পেলে তারা হিন্দুগৃহে ঐ সব ‘উদ্বাস্তু মুসলিমদের আবাসনের ব্যবস্থা করবে। যে দু একটি ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুরা সাজানাে নয়, প্রকৃতই ভারতত্যাগী মুসলিম, সেক্ষেত্রে তাে এ ব্যবস্থা প্রযুক্ত হ’তই। মিথ্যা অজুহাতেই হ’ত অধিকাংশক্ষেত্রে। এই সব নৃশংস এবং ক্রুর ইউনিয়ন কাউনসিল সদস্যরা কীভাবে হিন্দুনির্যাতন চালাতে সে সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছে সে সময়। মানবতাবাদী এবং প্রগতিশীল পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ সেই হাঙ্গামার সময়ে আয়ুবশাহীর সমাজবিরােধীদের হাতে প্রাণ হারাবার ঝুঁকি নিয়েও হিন্দু নির্যাতন বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। মুজিবর রহমন, হামিদুল হক চৌধুরী, সবে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টি এবারে বিশেষ গুরুত্ব পেল। সেই প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের সাম্প্রদায়িকতা জীইয়ে রাখার কুৎসিৎ চক্রান্তের স্বরূপ উদঘাটন করে ভাষণ দিলেন ছাত্রনেতৃবৃন্দ। ও পক্ষ থেমে ছিল না। ১৭ই ফেব্রুয়ারী এক নির্দেশনামা জারী হ’ল, যার ফলে অমুসলিমরা সংশ্লিষ্ট অফিসারের অনুমতি ব্যতিরেকে সম্পত্তি বিক্রয় করার অধিকার হারালাে। অথাৎ সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি হয়ে পড়লাে আয়ুবপন্থী লুটেরাদের অবাধ মৃগয়াভূমি। (৩৫)
‘ওয়াশিংটন সানডে স্টার’ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতেও অমুসলিম নিধনে। পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপােষকতার কথা লেখা হ’ল, যা পূর্বে কখনাে হয় নি। কারণ, এক লক্ষ খৃষ্ঠান এই দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হয়ে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। খৃষ্টানরাও যে ১৯৬৪-র জানুয়ারীর ভয়ংকর দাঙ্গায় লাঞ্ছিত হয়েছিলেন সে কথা মার্কিন এবং ইতালিয়ান খৃষ্টধর্ম যাজকদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিবৃতিতেও উল্লেখ ছিল। (৩৬)
কায়েদ-ঈ-আজম জিন্নার ভগিনী, ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪ তঁার ঈদ-বাতায় পাকিস্তান সরকারের সমালােচনা করে বলেন, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারই যেখানে জনসাধারণকে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার শিক্ষা দেয়, সেই অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে, বিচক্ষণতার অভাবে তারা ভােটাধিকার প্রয়ােগে অযােগ্য—একথা প্রতারণাময়। বিশেষতঃ ঐ সার্বজনীন ভােটাধিকারের সার্থক প্রয়ােগেই যেখানে পাকিস্তানের জন্ম হয়। জিন্নার ভগিনী ফতেমা জিন্নার ঐ বক্তব্যের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী কাশ্মীর সমস্যা, সাধারণ লােকের অজ্ঞতা, ইত্যাদিকে সার্বজনীন ভােটাধিকারের বিরুদ্ধ যুক্তি হিসাবে খাড়া করেন। অবশ্য সে-সময় কাউনসিলর মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন, এন, ডি, এফ এবং মুজিবর রহমান ফতেমার ঈদ-বার্তাকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসকরা যেমন স্বাধীনভাবে দেশ শাসনে অযােগ্য এই ছুতােয় ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিতে চাইতাে না, পাকিস্তানের শাসকচক্র-ও তেমন জনগণের অজ্ঞতার ছুতােয় প্রাপ্ত বয়স্কের ভােটাধিকারে রাজী হচ্ছেন না—এই মত প্রকাশ করা হল এন, ডি, এফ-এর পক্ষে। (৩৭)
পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিস্থিতিও ছিল শােচনীয়। বিরােধী পক্ষের সদস্যদের প্রাপ্য সুযােগ-সুবিধা, প্রশাসকরা মানতেন না। আইন-সভাতে আইন নয়, আদেশনামা বা অর্ডিনেন্স ঢালাও ভাবে সৃষ্টি করা হত। আয়ুবের স্তাবক কিন্তু অযােগ্য ত্রিশ জন পালামেন্টারি সচিব পদ সৃষ্টি করে আইনসভার সদস্যদের কিনে নিয়ে সরকারের শক্তিবৃদ্ধি করা হত। ঐ সব অযােগ্য সচিবরা প্রশ্নোত্তর পর্বে স্ববিরােধী উক্তি-প্রতুক্তি করে, ভুল তথ্য দিয়ে এবং পরে তা চাপে পড়ে শুধরে নিয়ে আইনস ভার মর্যাদাই শুধু ক্ষুন্ন করার যােগ্যতা দেখাতেন। (৩৮)
১৯৬৪র ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ দিবস পালন করা হল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সন্নিহিত শহীদ মিনারে। ছাত্রনেতৃত্ব, আগে থেকেই এবারের আওয়ামী লীগে যােগদানকারী প্রাক্তন লীগের নেতা শাহ আজিজুর রহমান এবং আতাউর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ঐকান্তিক প্রয়াসের সঙ্গে ছিল প্রগতিশীল পত্রিকা সংবাদের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রবন্ধদি যা বুঝিয়ে বলতাে, দাঙ্গা বাধিয়ে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিলে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলিমরা সংখ্যালঘু অঞ্চলের বাসিন্দায় পরিণত হয়ে আয়ুতন্ত্রের পীড়ন আরাে তীব্রভাবে ভােগ করতে বাধ্য হবে। সংবাদ পত্রিকা পরিচালকরা পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রাদিকেও আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে যৌথভাবে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার অভিযানে যােগ দিতে। ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হুসেইনের মতে, দু’ একটি ব্যতিক্রমের কথা ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রগােষ্ঠী ঐ আহ্বানে যথাযথ সাড়াই দিয়েছিল। (৩৩)
যে-আয়ুবপন্থী প্রশাসন দাঙ্গা বাধিয়েছিল তা থামাবার প্রশাসনিক দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে ঐ দাঙ্গা চালু রাখার সহজপন্থাই তারা বেছে নিয়েছিল। তারা বলতাে দাঙ্গা নেই। ১৯৬৪-র জানুয়ারী দাঙ্গার চরম অবস্থায় গভর্ণর মােনেম খান ঢাকায় ছিলেন না। ১৬-ই জানুয়ারী তিনি ফেরামাত্র প্রগতিশীল সাংবাদিকরা ছুটে গেলেন তার কাছে। ইত্যবসরে ইত্তেফাক এবং পাকিস্তান অবজার্ভার দৈনিক দুটো, দাঙ্গার সংবাদ চেপে না রেখে সরকারপক্ষের মিথ্যাভাষণ ফাঁস করে দিয়েছে, এই ‘অপরাধে’ পত্রিকা দুটোর কার্যালয়ে আয়ুবপন্থী দাঙ্গাবাজরা হামলা করে। সরকারী আদেশ জারী করাও হ’ল ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হুসেইনের উপর। তাকে পঁচিশ হাজার টাকা জমা রাখার আদেশ করলাে সরকার। তার উপর আক্রোশের মূল কারণ নারায়ণগঞ্জের ভয়ংকর দাঙ্গার সংবাদ চেপে না রেখে তিনি তার কাগজে সব খুলে লিখেছিলেন। শুধু সাংবাদিক বা রাজনীতিক নন—অনেক বুদ্ধিজীবী এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গদমনে প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে এমন ভাবে লড়ে গেছেন যা সর্বদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। অনেকক্ষেত্রেই হিন্দুদের বাঁচাতে গেছেন যে-সব মুসলিম, আয়ুবশাহীর সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদেরও সমানভাবে আক্রমণ করেছে। (৩৪)
এসব উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকল্পে কাজ করে চললেন প্রগতিশীল বাঙালী মুসলিমরা। ঈদের প্রাক্কালে সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ইত্তেফাক ১৪ই ফেব্রুয়ারী বিগত জানুয়ারীর দাঙ্গাকে ধিক্কার জানালাে। ২২শে ফেব্রুয়ারী, ‘আজাদ, ইত্তেফাক’, ‘ঢাকা টাইমস’ পাকিস্তান অবসাভার’ এবং সংবাদ সহ সাতটি সংবাদপত্রের সম্পাদকদের যৌথ বিবৃতিতে সমাজবিরােধীরা যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে না পারে এই মর্মে সক্রিয় হবার জন্য পাকিস্তান এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের কাছে আবেদন করা হল। ইত্তেফাকের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় মােসাফির এমন কথাও লিখলেন যে, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে কী হ’ল বা হ’ল না সে সব অগ্রাহ্য করে অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরােধকল্পে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান গুলিতে এবং তার প্রস্তুতিপর্বে ছাত্রসমাবেশগুলিতেও শহীদ দিবসের প্রতিজ্ঞার কথা প্রচার করেছিল। আয়ুব যে ভােটাধিকার সংক্রান্ত একটি বিল আনতে চলেছেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে সার্বজনীন ভােটাধিকার এবং স্বায়ত্ত্বশাসন আদায় করে সমস্ত দমন-পীড়নের অবসান ঘটানাের সঙ্কল্প ছাত্রনেতারা গ্রহণ করেছিলেন। শহীদ মিনার সমাবেশে ভাসানি এবং মুজিবর ভাষণ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের সকল দাবি-দাওয়ার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় আদেশনামা রদ করার দাবির প্রস্তাব-ও পাশ হল ঐ সম্মেলনে। অবশ্যই দেশের দুই খন্ডের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল’। (৩৯)
১১ই মার্চ ঢাকা শহরে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ বা অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়, তার পক্ষে ঘােষণা করা হ’ল পরাধীনতার নাগপাশ কাটিয়ে উঠেছে যে-জাতি তাকে পুনবার পরাধীন করা যাবে না। দাবি করা হ’ল সার্বজনীন ভােটাধিকার এবং প্রত্যক্ষ নিবাচন। নির্বাচনী বিধি সংক্রান্ত দাবি পুরণ-ই ছিল এই সমিতি গঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য এবং এর গঠনপর্বে ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল বেশ উজ্জ্বল। সদ্য পুনর্গঠিত ন্যাপ এবং আওয়ামি লীগের বিরােধ প্রশমনে ছাত্রদের উদ্যোগে গঠিত এই সংগ্রাম সমিতির একটা ভূমিকা ছিল। এন, ডি, এফ একই প্রকার দাবি তাদের ১৫ই মার্চের দাবিদিবসে জানালেও, ঐ সংগ্রাম পরিষদে যােগ দেয় নি। পাটিদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সকল পাটির কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পেয়ে প্রকারান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি আদায়ের আন্দোলনের কিছু লাভ-ই হয়েছিল। আয়ুবের মুসলিম লীগই ছিল সার্বজনীন প্রত্যক্ষ নির্বাচন বিরােধী একমাত্র দল। আয়ুব অন্য সব দল সম্বন্ধে কটুকাটব্য করে চলেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, (আয়ুবকথিত) খচ্চর অপবাদ পেতেও যদি হয় আয়ুবের কনভেনশনিষ্ট মুসলিম লীগ ছাড়ার জন্য, তবু বলবাে, ঐ খচ্চর-ও লীগ দলের চেয়ে শ্রেয়। এই সময় আয়ুব প্রচার করছিলেন বিরােধীদের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা। বিদেশী শক্তির কাছে দেশ বেচে দেওয়া, পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্য নষ্ট করা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা—এই সবই নাকি বিরােধীরা ক্ষমতায় এলে একে একে করে চলবে। বিরােধী শিবির এই সব কুৎসায় না দমে তার সংগ্রামী ঐতিহ্য স্মরণ করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’ল জোর লড়াই-এর উদ্দেশ্যে। একদিন তারা লিয়াকতের বি পি সি রিপাের্ট এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সঙ্কল্প ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ধাক্কায় চৌচির করে দিয়েছিলেন সে কথা স্মরণ করে তারা মনােবল রক্ষা করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চললেন। (৪০)
সংগ্রাম পরিষদ ১৮ই মার্চ পথসভা, ছােট মিছিল ইত্যাদির অনুষ্ঠান করে। প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভােটের দাবিতে এই যে আন্দোলন একে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার সমাজবিরােধীদের কাণ্ড’ আখ্যাত করলেও এ-আন্দোলনে ছাত্রীরাও সামিল হয়েছিলেন। ১৯শে বড় মিছিল এবং সাধারণ ধর্মঘটের ডাক। ১৮ তারিখের সন্ধ্যায় সরকার পক্ষের দালালবাহিনী জিপে জিপে মাইকযােগে প্রচার করে বেড়াল–সংগ্রাম-কমিটি ধর্মঘট হরতাল বাতিল করেছে, কাল ধর্মঘট নয় একথা জানিয়েছে। এত বড় রাজনৈতিক অসাধুতা সত্ত্বেও ১৯শে ধর্মঘট এবং বড় মিছিল পূর্ণ সাফল্য লাভ করেছিল। (৪১) গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এই পর্যায়ে ছাত্ররাই ছিল এর অগ্রণী বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার হরণ করে এবং অগণতান্ত্রিক তথা বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে সরকার পক্ষ ছিল ছাত্রমহলে ধিকৃত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসব প্রায় সকল ছাত্র বয়কট করেন। আয়ুব-স্তাবক কিছু সরকারী চাকুরীপ্রাপ্ত স্নাতক ঐ উৎসবে যােগ দেন। উৎসবমঞ্চে আয়ুবপন্থীদের ভাড়াটে লােক দিয়ে পূর্বাহ্নে অগ্নিসংযােগ করিয়ে, ঐ কুকীর্তির দায় ছাত্রদের ঘাড়ে চাপায় কুচক্রী প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের ঐ অগ্নিসংযােগের সাজানাে দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। সমাবর্তনের উৎসব কক্ষে বিরাট ছাত্র স্কোয়াড গভর্ণর বিরােধী শ্লোগান দেন। গ্রেপ্তার ছাত্রনেতাদের লক্ষাধিক টাকার জামিন ছাড়া ছেড়ে দেওয়া হবে না সরকারের এই ক্রুরতা, ছাত্রদের আরাে বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। পােকায়কাটা বইপত্র এবং জীর্ণছিন্ন সার্টিফিকেট পেয়ে দালাল ছাত্ররা সমাবর্তনে যােগ দেওয়া সত্ত্বেও বিক্ষোভ প্রকাশ করে ঐ সব অবহেলিত প্রাইজ ইত্যাদি ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে। নূতন করে প্রাইজ দেবার কথা সরকার পক্ষে বলা হয়। সমাবর্তনের তারিখটা ছিল ১৬ই মার্চ। (৪২) ১৮ই মার্চ ঢাকা এবং রাজশাহীতে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। (৪৩)
মােনেম বিরােধী, আয়ুব-বিরােধী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে মােনেমের ভাষণ শুনবেন না এবং সমাবর্তন উৎসব প্রকাশ্যে বয়কট করবেন এটুকু মােনেম-গােষ্ঠী ভালােই জানতাে। আগে থেকে জমায়েত গুন্ডা দিয়ে সম্ভাব্য ছাত্র বিক্ষোভের নেতাদের সমাবর্তন উৎসব প্রাঙ্গণে দারুণভাবে প্রহৃত এবং লঞ্ছিত করালাে ঐ ক্রুর প্রশাসন। এটি ঘটে ২১শে মার্চ।(৪৪)
২২শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব-প্রাঙ্গণ ঠাসা ছিল সশস্ত্র পুলিশে। পুলিশের অবাঞ্ছিত উপস্থিতির প্রতিবাদ করলেন ছাত্ররা। পরিণামে হ’ল খন্ডযুদ্ধ। অধিকাংশ চেয়ার ভেঙে গেছে—এই অবস্থাতেও মােনেম তার তথাকথিত সমাবর্তন ভাষণ পাঠ করে ছাড়লেন। তিন শতাধিক ছাত্র গ্রেপ্তার হলেন। তিনজন সাংবাদিকের অভিজ্ঞানপত্র থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার হতে হয় ঐ দিন। (৪৫)
দাবি পুরণ করা দূরের কথা বিবেচনা করাও আয়ুবতন্ত্রের দর্শনশাস্ত্রে ছিল না। ছিল দাবির জবাবে উৎপীড়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রকে লােভ এবং ভয়ের যথার্থ ব্যবহারে আয়ুবপন্থী করা হ’ল। সঙ্গে যােগ দিল কিছু গুণ্ডা। এরা সরকারের নির্দেশমতাে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কিছু গােলযােগ বাধালাে। শুধু এটুকুর অজুহাতে অনির্দিষ্ট কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ—এই মর্মে আদেশ জারী হ’ল। ইকবাল হলে এ সব অনাচারের প্রতিবাদে সভা করছিলেন ছাত্ররা। পুলিশ সেখানে হামাল চালালাে। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হলেন।(৪৬)
ভােটাধিকার বিবেচনার যে-কমিশন ১৯৬২ তে প্রায় সর্বস্তরে প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভােটভিত্তিক নিবার্চনপ্রথার সুপারিশ করেছিলেন, তার প্রতি ক্ৰক্ষেপ না করে ঐ উদ্দেশ্যে গঠিত নূতন কমিটি প্রাপ্ত বয়স্কের ভােটাধিকার অগ্রাহ্য করলেন। বিরােধী সদস্যদের প্রতিবাদ তারা সংখ্যাধিক্যের এবং সরকারী চাপের কারণে গ্রাহ্য করলেন না। ১৪ই এপ্রিল এই অগণতান্ত্রিক বিল সংসদে পাশ করিয়ে নিয়ে গণতন্ত্রের ভাঁড়ামি করা হ’ল। ২৬শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য গুলাম জিলানি মালিক আয়ুব সরকারকে মৌলগণতন্ত্রী ধান্দাবাজদের সরকার বলেছিলেন। সরকারের কিছু স্তবক নিজেদের স্বার্থে গণদাবি উপেক্ষা করায় তােফাজ্জল এই নির্বাচনী বিলের কঠোর সমালােচনা করলেন ১৫ই এপ্রিল। (৪৭) ১৯৬০-এর সংবাদপত্র প্রকাশনা আদেশনামা, ১৯৬৩র অক্টোবরে সংশােধিত হয়ে। সাংবাদিক স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন করেছিল। ফলে, ১৯৬৪র মার্চের শেষ সপ্তাহে ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশ এবং সেই সম্পর্কে সম্পাদকীয় রচনার কারণে আজাদ, ইত্তেফাক এবং সংবাদ-এর উপর আদেশ জারী হ’ল। পঁচিশ হাজার টাকা করে প্রত্যেক পত্রিকার কাছে কেন জামিন দাবি করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বলা হ’ল। একই সপ্তাহে দু’বারে মােট পঞ্চান্ন হাজার টাকা জামিন বাবদ দাবি করল সরকার ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকাটির কাছে। সরকারী বিবাচন বিধি বা সেন্সরের খেয়ালে অনেক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে সংবাদ বিশেষের প্রকাশ নিষিদ্ধ হবার ফলে ঐ সংস্করণ প্রকাশ করাই যেত না। এইভাবে প্রায়ই সংবাদপত্রহীন দিন কাটাতে হ’ত নির্ভীক দৈনিকগুলির পাঠকদের। এত করেও সংবাদিকদের অংশবিশেষকে সন্ত্রস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে আয়ুব সরকার একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং একটি প্রেস ট্রাস্টের সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিল। পেটোয়া কাগজে ভিন্ন সরকারী বিজ্ঞাপন যেন না প্রকাশিত হয় এবং বিরােধী সংবাদপত্রাদি যেন লােপ পায়—এই ছিল যথাক্রমে লক্ষ্য এই দুই হবু-প্রতিষ্ঠানের। (৪৮)
আয়ুব শাসনে প্রাক্তন বালুচি, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল দমন-পীড়নে জর্জর ছিল–মুজিবর এবং খাজা নাজিমুদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে এ সত্য প্রত্যক্ষ করেন। নিপীড়ন এবং বঞ্চনার প্রতিকার মানসে সংসদ-ভবনে ঐ সব অঞ্চলের সাংসদরা প্রস্তাবাদি তুলেছেন মাঝে মাঝে। সব মিলিয়ে দেশের উভয় খন্ডের আয়ুব বিরােধীদের সংহতির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল ছিল ১৯৬৪-র মধ্যভাগে এসে। আয়ুবের সামরিক শাসনের বিরােধী বালুচিদের উপর ১৯৬৪ ঈদ উৎসবের দিন বিমান থেকে বােমা-নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ‘কপ’ বা কমবাইনড অপােজিশন পার্টি নামের যে সংগঠনটির উদ্ভব হ’ল তার সদস্য এবং কর্মকর্তারা দেশের উভয় খন্ড থেকেই এসেছিলেন। পরিস্থিতির তাগিদেই দেশের উভয় অঙ্গের বিরােধীরা জোট বেঁধেছিলেন। নয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এক পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ইশতেহার এই কপ’ জোটের পক্ষে প্রকাশ করা হয়েছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের উপরে ঐ ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। (৪৯)
আয়ুবের মুসলিম লীগ, মৌল গণতন্ত্রী বা বি, ডিদের দৌরাত্ম্যের জন্য দায়ী এমন ধারণা জনসাধারণের ছিল। বি, ডি রা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেছিল এ কথা তাে সকলে স্বচক্ষে দেখেছে। প্রকল্পে নির্মিত রাস্তা এক পশলা বৃষ্টিতেই ধুয়ে যেত। আয়ুবের মুসলিম লীগ, বি, ডি নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পেল না। তাদের না-বাচক প্রস্তাব থেকে এটা বােঝা গেল। প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষেত্রেও ঐ দল গতবারের বিজয়ী প্রার্থীদের-ই মনােনয়ন প্রদান করবে— ১৯৬৪র ২০শে অগাস্ট গৃহীত তাদের প্রস্তাবে একথাও বলা হ’ল। অথাৎ আয়ুব এবারেও দুনীর্তির শিরােমণিদের-ই কারচুপির মাধ্যমে ভােটে জয়ী করতে চাইলেন। জনপ্রিয়তা তার কাছে কোনাে ব্যাপারই ছিল না। কারচুপি এবং পর্দার অন্তরালের গােপন রাজনীতির জোরে বি, ডি-দের হাত করে প্রাদেশিক স্তরের নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার আশা করলেও, বি, ডি দের নিবাচিত করা যে এই পথে দুষ্কর—এটা ভালােই বুঝেছিল আয়ুবের দল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও যে দুর্নীতি এবং কারচুপির জোরে এবারেও আয়ুব জয়ী হবেন—এমন সম্ভাবনা কেউ-ই উড়িয়ে দেন নি। (৫০)
আয়ুব তার জয় নিশ্চিত করতে নির্বাচনের প্রচার-প্রস্তুতির জন্য অর্থব্যয়ের উর্ধসীমা পূর্বের চেয়ে আটগুণ বাড়িয়ে ভােট কেনাবেচার পথটা প্রথমেই সুগম করে নিলেন এবারে। ভােটপত্রের বিপরীত পৃষ্ঠা অফিসারকে দেখিয়ে তবে বাক্সে ফেলা যাবে। অর্থাৎ গােপনীয়তা বিধিও লঙিঘত হ’ল নূতন নিয়মে। (৫১) নিবাচনী আইনে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় আইন সভাগুলাের সদস্যদের নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীর ক্ষেত্রে এইরূপ ব্যয়ের হিসাব দাখিল করার কোনাে প্রশ্ন ছিল না। তদুপরি মাত্র তিনজন নূতন প্রার্থী গ্রহণযােগ্য হবেন—এই বিধানের অপপ্রয়ােগ করে সাজানাে প্রার্থী দু’জন এবং একজন প্রকৃত প্রার্থীর মধ্যে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ করে, শেষ মুহূর্তে ঐ ভূয়া দুজনের নাম কার্যতঃ তুলে নেবার ছুতােয় তাদের খাতের ব্যয়যােগ্য অর্থ-ও আয়ুব নিজের প্রচারভিয়ানে ব্যয় করবেন—এ আশঙ্কা ‘কপ’ নেতৃত্ব করছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে তার সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে—বিরােধী পক্ষের এ দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। আসলে তারা নির্বাচন বিধির সংশােধনে যা কিছু প্রস্তাব করেন সবই অগ্রাহ্য করা হয়। (৫২)
স্বৈরাচারকে মদত দিতে যে-সব বেআইনি আইন একের পর এক প্রণয়ন করে চলেছিল আয়ুব সরকার তাদের মুখােমুখি গণআন্দোলন সহজে অভীষ্ট অর্জন করবে না এ কথা বােঝা যাচ্ছিল। তথাপি ২৯ শে মার্চ ১৯৬৪-র বর্ষণসিক্ত পল্টন ময়দানের জমায়েতে মানুষের ঢল নামে। ২৯শে অগাস্ট ১৩-দফা দাবির ভিত্তিতে রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়। মিছিল নিষিদ্ধ হয় সেদিন। ছাত্র-পুলিশে ইষ্টক বিনিময় এবং বেশ কিছু গ্রেপ্তার—ছিল এই দিনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ৩১শে অগাস্ট পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রদেশ জুড়ে সভা সমাবেশের ঘােষণাও ছাত্র সংগ্রাম সমিতির পক্ষে করা হয়। ১৩ দফা দাবির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা, ছাত্রদের উপরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ এবং সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়গুলি ছিল। (৫৩)
ছাত্রদের উপর প্রদেশ জুড়ে পীড়ন নেমে এল। লাঠি, কাঁদানে গ্যাস—এ সবের যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হল। টাঙ্গাইল শহরের অভিভাবকরা ছাত্রদের অবাধ পড়াশুনার ব্যবস্থার দাবিতে শহরের বার লাইব্রেরীতে সমবেত হয়ে সমস্যাটির উপরে আলােচনা করেন। এস, ডি, ও এই সভা বন্ধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। (৫৪)
কণ্ঠরােধকরা বিধি নিষেধের প্রহরায় যন্ত্রণাকাতর সাংবাদিকদের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত সাংবাদিকদের তিনঘন্টার প্রতীকী ধর্মঘটের পরে মাত্র তিনদিন কাটতেই ২৯শে সেপ্টেম্বর ‘কপ’-এর ডাকে ‘নিপীড়ন বিরােধী দিবস’ পালন উপলক্ষে ডাকা সর্বাত্মক ধর্মঘট সর্বাঙ্গীণ সাফল্য লাভ করলাে। শিক্ষা নিকেতন থেকে খেতখামার কারখানা, নদীপথের নৌকাজাহাজ থেকে রেলপথেট্রেন আকাশপথে বিমানপােত—সর্বত্র কর্মবিরতির সঙ্গে শ্লোগানে, মিছিলে, সমাবেশে আয়ুবশাহীর অপশাসনের প্রতি ধিক্কারধ্বনিত প্রতিবাদ। চূড়ান্ত পর্যায়ে পল্টন ময়দানের মহতী জনসভায় গণতন্ত্রের অধিকার অর্জনে সর্বত্যাগস্বীকারের অঙ্গীকারের প্রস্তাব গৃহীত হ’ল মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। ঢাকার চেয়ে তীব্রতর আক্রমণ নেমে এসেছিল সেদিন চট্টগ্রামের ছাত্রদের উপর। সন্ত্রস্ত আয়ুব সরকার পূর্বাহ্নেই করাচিতে মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। (৫৫)
আগামী নির্বাচনে সর্বাধিক দুর্নীতির ব্যাপক আয়ােজনের ব্যবস্থা হ’ল খিদমতগারিতে অভ্যস্ত সার্কেল অফিসারদের সাহায্যে। নির্বাচনী এলাকার অযৌক্তিক পুনর্বিন্যাস বা জেরিমেন্ডার করা হ’ল যত্র তত্র। বিরােধী ভােটারদের নাম কেটে দেওয়া হল। এক নম্বর সিদ্দিকবাজার ইউনিয়ন কমিটির পঞ্চাশ শতাংশ ভােটারের নাম খারিজ করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে ২৬, সনাতন পাল লেনের ১৯৪ জন বাসিন্দার নাম কাটা হ’ল ভােটার তালিকা থেকে এবং এমন ৮ জনের নাম স্থান পেল যারা আদৌ ঐ ঠিকানায় বাস করেননা। (৫৬)
‘কপ’ বা সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী ছিলেন একজন মহিলা ফতেমা জিন্না। ২৬শে সেপ্টেম্বর আয়ুবের নির্দেশে ২৩ জন ধর্মীয় নেতা করাচিতে এক বিবৃতি দিয়ে জানান, ইসলামের বিধিমতাে কোনাে মহিলা রাষ্ট্রনেত্রীপদে বৃতা হতে পারেন না। (লক্ষণীয় ইসলামের তত্ত্ব যখন রচিত হয়, গণতান্ত্রিক ভােটাভুটি তখন দুনিয়াতে ছিল প্রায় অজ্ঞাত। সুতরাং মূল ইসলামি ধর্মগ্রন্থে এমন ফতােয়া জারি না হয়ে থাকারই কথা।) যাই হোক প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। ব্যয় করেও পূর্ব পাকিস্তানের জনসভায় কলার খােসা, পাদুকা নিক্ষেপ—ইত্যাদির বেশি সমাদর আয়ুবের কখনােই জোটে নি। অন্যদিকে ফতেমা সম্বর্ধিত হয়েছেন প্রতি সমাবেশে। (৫৭) অফিস এবং কারখানায় কপ-সমর্থক ভােটার সমধিক। এঁদের ভােট দেওয়া অসম্ভব করতে ভােটগ্রহণের সময় করা হয়েছিল ৯ টা থেকে দুটো। দিনগুলােও ছিল কাজের দিন। অফিস বা কারখানায় কামাই করে ভােট দিতে গেলে একদিনের বেতন শুধু নয়, চাকুরীটাই বিপন্ন হতে পারে—আয়ুবসরকারকে এতদিনে এটুকু ঐ কর্মচারী বা শ্রমিক জনসাধারণ ভালােই চিনেছিলেন। (৫৮)
পরাজয়ের সম্ভাবনাও আছে এই ভয়ে দিশেহারা আয়ুব ৮ই নভেম্বর, ১৯৬৪ ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করলেন, প্রেসিডিন্ট নির্বাচনে ভােটাররা নির্বােধের মতাে ভােট দিলে এবারে যে নূতন বিপ্লব করা হবে তা হবে আরাে কঠোর। অথাৎ আয়ুবকে ভােটাররা ভােট না দিলে উনি রাজনীতিকদের দেখে নেবেন এবং এই দেখে নেওয়া বা প্রাণ কেড়ে নেওয়াকে উনি বিপ্লব বলবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে ঐ কথাগুলাে বলে উনি বােঝালেন, ভােটে হেরে গেলেও ওঁর ক্ষমতা এবং অত্যাচার বাড়বে বই কমবে না। (৫৯)
সর্ববিধ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ১০ই নভেম্বর থেকে যে বি, ডি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’ল তার ফলাফল আয়ুব তথা সরকারী মুসলিম লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই গেল। আয়ুব এই নির্বাচনে সন্ত্রাস, প্ররােচনা, পক্ষপাতিত্বের চূড়ান্ত করেও যখন সামাল দিতে পারলেন না তখন ব্যক্তিগত পত্রযােগে নবনির্বাচিত বি, ডি-দের সমর্থন চাইলেন এই অজুহাতে যে মৌল গণতন্ত্রের স্রষ্টা তিনিই! নজিরবিহীন এই পত্রের ঘটনা থেকে ‘কপ’ আশঙ্কা করলাে, তার নেতাদের জন্য আরাে বড় দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। অথাৎ আরাে জঘন্য সব আয়ুবীয় কারসাজি। (৬০)
নিপীড়ন এবং কারচুপির মাত্রা না বাড়ালে আশা নেই আয়ুবচক্ৰ এটা বেশ বুঝে গেল। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের তারিখ ২রা জানুয়ারী, ১৯৬৫ যতােই এগিয়ে এল, আয়ুবের সমর্থক যেন সাধারণের মধ্যে ততােই দুর্লভ হয়ে পড়লাে। এর ফল সীমিত নিবাচকমন্ডলীতেই পড়তে পারে এই আশঙ্কায় সন্ত্রাসের আয়ােজন অনেক আগে থেকেই করা হ’ল। ফতেমা ফাস করে দিয়েছিলেন, জিন্নার অনুকম্পা প্রদর্শনে আয়ুব সেই ১৯৪৭-এই প্রাণদন্ড থেকে অব্যাহতি পান। গুরুতর অপরাধে তার সামরিক বিচার হয়েছিল সে সময়। বিরােধী নেতারা ‘কপে’র পক্ষে প্রচার করেন, আয়ুব এই সামরিক শাসনের চার বছরের একাধিপত্যের সুযােগে তার সম্পত্তির পরিমাণ করেছেন ৫০ কোটি টাকা। গান্ধার শিল্পসংস্থার অধিকারী হয়ে রয়েছেন তারই পুত্র গাওহর আয়ুব। তিনি অবসরপ্রাপ্ত কাপ্তেন মাত্র। জবাব মুখে দিতে না পেরে, পুলিশের লাঠির মাধ্যমে দিতে হয়। আর তাই হ’ল সাবুরের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভের ক্ষেত্রে। ফতেমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসে রাজশাহী রেলস্টেশনে পুলিশ এবং গুণ্ডাদের সমবেত আক্রমণে দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ১৪ই ডিসেম্বর ‘জনতা’ ছেপেছিল আয়ুবের হয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাবার সেই নির্দেশ যা জেলা প্রশাসক পাঠিয়েছিলেন তার অধস্তনদের কাছে। অথাৎ নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছিল পুরােপুরি। (৬১) তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-ভুট্টো সােইব এবং সাবুর—প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হলে ফতেমাকে প্রার্থী হিসাবে খারিজ করা হবে এ আশঙ্কা ‘কপ’ করেছিল। কিন্তু অমনটি করা হলে প্রতিবাদের ঝড়ে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সারা দেশে প্রচন্ড অশান্তি দেখা দেবে—এই ভয়ে ফতেমার প্রার্থীপদ নাকোচ করতে সাহস করে নি সরকার পক্ষ। কাজেই ঐ সব মন্ত্রী-প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। এমনিতেই হাওয়ায় ছিল বারুদের গন্ধ। ডিসেম্বরের দশ তারিখ থেকে সমস্ত পাকিস্তান জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি একটানা ২৫ দিন বন্ধ ছিল। পাকিস্তানের উভয়খন্ডের ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে সেই সময়। এমনি আশঙ্কাবশতঃই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তাদের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্কল্প ত্যাগ করেন—এমনটি মনে করা চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ৫ই জানুয়ারী, ১৯৬৫ খােলার কথা হ’ল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তার আগেই হয়ে যাবে। অবশ্য এসবের পরেও ‘কপ’-এর শক্তির প্রধান উৎস যে সেই ছাত্রসমাজ সে কারণে ছাত্রনির্যাতনে কোন ছেদ পড়ে নি। (৬২)
মােনম খান ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলাে সন্ত্রাসের দিনে পরিণত করলাে। সামরিক বাহিনী,ই, পি, আর, পুলিশ—স্পর্শকাতর এলাকা এবং অঞ্চল জুড়ে এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেল। ক্ষমতার উচ্চাকাশচারীর-ও পাখির মতাে দুটো ডানায় ভর দিয়ে ভাসতে হয়। ক্ষমতার আর লােভের ডানা দুটোর ঝাপটানি এ সময় আরাে তীব্র হ’ল। খিদমতগারকে পুরস্কারের লােভ আর দুষমনকে শাস্তির ভয়-আয়ুবতন্ত্র এই দ্বিবিধ ভ্রষ্টাচার দোষে দুষ্ট ছিল। সৈন্য মােতায়েন করে বিরােধী জনসাধারণকে হত্যার ভয় দেখানাের সঙ্গে বি, ডিদের লটারি ভিত্তিক শত টাকার পুরস্কারের লােভ-ও দেখানাে হ’ল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে। বি, ডি-রা কোন রাজনীতির সমর্থক তা দ্রুত জানালে লটারির মাধ্যমে পুরস্কার পেলেও পেতে পারবেন—এই বিজ্ঞপ্তি জারীহ’ল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে। টীকা নিষ্প্রয়ােজন। (৬৩)
আয়ুব, পরােক্ষ নির্বাচনে টাকার জোরে, পুলিশ-প্রশাসন-গুন্ডাবাহিনীর জোরে, ফতেমাকে পরাজিত করবেন এ তাে জানা কথা। কিন্তু এই জয়ের পিছনে বি, ডি-পিছু ভােট কেনার খরচ দু’হাজার থেকে সাত হাজার টাকার জোগান দিল কারা ? মূলতঃ সেই পুঁজিপতিরা যাদের স্বার্থে আয়ুবতন্ত্র এসেছে এবং যাদের সর্মথনে টিকে আছে। বি, ডি-রা শুধু নগদ-বিদায়টুকুই চিন্তা করেন নি। আয়ুব হেরে গেলে পরােক্ষ ভােটের মস্করা চালাবার এই বি, ডি প্রথাটাই থাকবে না—এ আতঙ্কও তাদের ছিল। বছর জুড়ে দুর্নীতির মাধ্যমে নানা প্রাপ্তিযােগ বন্ধ হয়ে গেলে তাদের কী হবে? তাই তারা উৎকোচ না পেলেও আয়ুবকেই সমর্থন করতেন। উৎকোচটা ছিল বকশিস! ফতেমার ভােটারদের পুলিশ বহুক্ষেত্রে আটক করে ভােটদানের সুযােগই কেড়ে নিয়েছে তাদের। নির্বাচন কক্ষের অভ্যন্তরে আমলা, অফিসার, আয়ুবপন্থী গুণ্ডাবাহিনী নির্লজ্জের মতাে কারচুপি, বলপ্রয়ােগ ইত্যাদি সবই করেছে। অথাৎ স্বৈরাচারের দেশে ভােট-ও একটা স্বৈরাচার—এটাই আয়ুবশাহী প্রমাণ করে দিয়েছে। আয়ুবের হয়ে বেআইনী কাজ কারবার চলাকালে নির্বাচন কক্ষের কপ’ পক্ষীয় পােলিং এজেন্ট প্রতিবাদ করামাত্র বহিষ্কৃত হয়েছেন। পুলিশ সর্বত্র এইরূপ বহিষ্কারের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল কী হ’ল? আয়ুব নির্বাচন জিতলেন। একটু ছােট্ট পুনশ্চ যােগ না করলে সত্যটা বােঝা যাবে না। সেই ছােট্ট কথাটুকু জুড়ে পুরাে বাক্যটা দাঁড়ায় এই প্রকার। নির্বাচনে আয়ুবের জয় হ’ল কিন্তু নির্বাচনটা হয় নি। (৬৪)

References:

1. The Times, 3 May 1962. The Guardian, 8 June 1962. The Statesman, 14 June 1962. Dawn, 18 July 1962. Speech by MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 117.
2. The Times, 3 May 1962. The Pakistan Times, 11 June 1962. G. S. BHARGAVA, “Pakistan Politics—I”, The Hindustan Times, 6 July 1962.
3. Dawn, 14 June 1962. The Pakistan Times, 15 June 1962. G. S. BHARGAVA, n. 2.
4. The Pakistan Times, 15 June 1962.
5. G. S. BHARGAVA, “Pakistan Politics-II”, The Hindustan Times, 7 July 1962. The Pakistan Times, 15, 16 June 1962.
6. Speech by MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 117-18. Speech by QAMARUL AHSAN, Ibid., p. 119. The Pakistan Times, 17 July 1962.
7. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 95. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, NAP Debates, 27 June 1962. Vol. I, No. 12, pp. 643-44. Speech by FARID AHMAD, Ibid., p. 633. The Pakistan fimes, 30 June 1962. G. S. BHARGAVA, n. 5.
8. G. S. BHARGAVA, n. 2. The Pakistan Times, 17 July 1962. 9. Dawn, 18 July 1962. The Pakistan Times, 12, 19 July 1962. 10. Ibid., 7, 10, 19 July 1962. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 10 July 1962, Vol. I, No. 23, p. 1248.
11. The Times of India, 3 July 1962. Speech by MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 14 July 1962, Vol. I, No. 27, p. 1563.
12. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 9 July 1962, Vol. I, No. 22, pp. 1212-15. Speech by NASRULLAH KHAN, Ibid., pp. 122223. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 10 July 1962, Vol. I, No. 23, pp. 1248-49. Pakistan Observer, 9 July 1962.
13. The Pakistan Times, 17 July 1962. Dawn, 18 July 1962. The Statesman, 13 July 1962.
14. The Statesman, Ibid. Despatch from SITANSHU DAS stationed in Karachi, The Times of India, 6 September 1962. The Hindustan Times, 7 September 1962. Pakistan Observer, 5, 6 September 1962.
15. Despatch from the Correspondent in Rawalpindi, The Statesman, 25 September 1962.
16. Pakistan Observer, 18 March 1963. Despatch from P. DASGUPTA stationed in Dacca, The Hindustan Times, 18 March 1963. Despatch from the Correspondent in Dacca, The Statesman, 19 March 1963.
17. NAP Debates, 4, 10, 11, 12, 16 April 1963, Vol. I, pp. 1296-1301, 1559-60, 1574-77, 1757-60, 1882-83. Ittefaq, 12 April 1963.
18. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 16 December 1963, Vol. III, No. 6, pp. 1073-75.
19. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 19 March 1963, Vol. I, No. 9, p. 538. Despatch from P. DASGUPTA stationed in Dacca, The Hindustan Times, 29 March 1963.

20. Speeches by ABUL QUASEM ABDUR RASHID and BEGUM ROQUYYA ANWAR, NAP Debates, 19 March 1963, Vol. I, No. 9, pp. 522-23, 550, 597. Speeches by QAMARUL AHSAN and MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 20 March 1963, Vol. I, No. 10, pp. 604, 609.
21. Speeches by DR. GOLAM MAWLA, MAHBUBUL HAQ and MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 16 April 1963, Vol. I, pp. 188081, 1889, 1901. Speeches by SYED ABDUS SULTAN and SYED HUSAIN MANSUR, NAP Debates, 17 April 1963, pp. 1911, 1923.
22. Speeches by FARID AHMAD and QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 16 April 1963, Vol I, pp. 1865-70, 1881-82. NAP Debates, 17 April 1963, Vol. I, p. 1958.
23. Despatch from the Rawalpindi Correspondent, The Statesman, 4 September 1963. NAP Debates, 28 March 1963, Vol. I, No. 4, p. 894.
24. The Hindustan Times, 3 September 1963. Despatch from SITANSHU DAS stationed in Karachi, The Times of India, 26 September 1963.
25. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 14 June 1963, Vol. II, No. 9, p. 484. Speech by A. K. MD. YUSUF, NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 604. Speech by CHAUDHRI MUHAMAD HUSAIN CHATTHA, NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II, No. 12, p. 631.
26. Speech by SYED HUSAIN MANSUR, NAP Debates, 19 June 1963, Vol. II, No. 13, pp. 730-31. Spech by MUHAMMAD ABDUL HAQUE, NAP Debates, 16 December 1963, pp. 1093-95.
27. Speech by BEGUM SHAMSOON NAHAR MAHMOOD, NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 422.
28. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 96. Speech by AZIZUR RAHMAN, NAP Debates, 19 June 1963, Vol. II, No. 13, p. 783.
29. Dawn, 29, 30 December 1963 ; 1, 6, 7, 8, 13 January 1964. Morning News (Dacca), 31 December 1963 ; 2, 4, 9, 11, January 1964. The Pakistan Times, 3, 4, 5, 6, 9, 10, 11, 12, 13 January 1964. Pakistan Observer, 4, 5, 14 January 1964. Ittefaq, 5, 14, 17 January, 23, 24 February 1964. Sangbad, 6, 14 January 1964.
30. Committee of Enquiry, The Indian Commission of Jurists, Recurent Exodus of Minorities from East Pakistan and disturbances in

India, pp. 21-40, 58-59. SAMAR GUHA, Whither Minorities of Eastern Pakistan (Calcutta, 1964, Published by the author), pp. 2-4. SAKUNTAL SEN, Inside Pakistan (Calcutta, Compass Publications, 1964), pp. 15-16. MR. SEN presents in this booklet an account of his adventurous trip to East Pakistan undertaken, in the disguise of a Muslim, shortly after the 1964 massacre. 31. GUHA, n. 30, pp. 5-16. SEN, n. 30, pp. 16-17. 32. GUHA, n. 30, p. 12. SEN, n. 30, pp. 18-19.
33. Janata (Weekly, Dacca), 23 October 1963. Committee of Enquiry, Indian Commission of Jurists, n. 30, pp. 19-20, 311. Ittefaq, 24 February, 8 March 1964. AJIT KUMAR DATTA, Interview, 6 January 1967. HAMIDUL met some prominent citizens of Calcutta, including MR. DATTA, who, at the time of writing (i.e., May 1967), is the AdvocateGeneral of the Government of West Bengal.
34. Ittefaq, 17 January, 24 February, 29 March 1964. GUHA, n. 30, pp. 17, 19-21.
35. Ittefaq, 14, 17, 18, 23, 24 February 1964.
36. Despatch from T. V. PARASURAM in Washington, The Indian Express (New Delhi), 21 January 1964. PARASURAM gave excerpts from the Washington Sunday Star and the New York Times. The Hindustan Times, 23, 28 February 1964. The Indian Express, 26 February 1964. 37. Ittefaq, 17, 18, 21, 22 February 1964.
38. Ibid., 14, 17, 18, 19, 20 February 1964. The Staff Reporter of the Ittefaq wrote detailed surveys of the working of the provincial legislature of East Pakistan on, among others, the aforesaid dates.
39. Ibid., 17, 21, 22 February 1964. The Patriot (New Delhi), 3 March 1964.
40. Ittefaq, 1, 6, 9, 12, 13, 14, 16 March 1964. The Statesman, 17 March 1964.
41. Ittefaq, 17, 18, 19, 20, 21 March 1964. 42. Ibid., 27 February, 17, 21 March 1964. 43. Ibid., 18, 19 March 1964. 44. Ibid., 22 March 1964. 45. Ibid., 23 March 1964.

46. Ibid., 25 March 1964. 47. Speech by AKHTARUDDIN AHMAD (of East Pakistan), NAP Debates, 16 March 1964, Vol. I, No. 2, pp. 90-95. NAP Debates, 15 June 1964, Vol. II, No. 12, p. 725. Ittefaq, 22, 27, 29 March, 15 April 1964.
48. Compass (Bengali weekly, Calcutta), 18 April 1964, pp. 50-52. Ittefaq, 29, 30, 31 March, 3 April 1964. Sangbad, 29 March, 3 April 1964.
49. Speech by GHULAM MUHAMMAD WASSAN, NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 425 ; Speech by MUFTI MAHMOOD, Ibid., 14 June 1963, Vol. II, No. 9, pp. 465, 467 ; Speech by AMIR HYDER SHAH, Ibid., 17 June 1963, Vol. II, No. 11, pp. 602-3. WASSAN, MAHMOOD and SHAH all belonged to West Pakistan. Ittefaq, 13 April, 1, 2, 8, 10 August 1964. 50. Ittefaq, 12, 31 March, 19, 21 August 1964. 51. NAP Debates, 8 August 1964, Vol. III, No. 8, pp. 519-22. 52. Ittefaq, 18, 30 August 1964. NAP Debates, 18 August 1964, Vol. III, No. 15, pp. 988-90, 992-93, 1006-7, 1014-15. Special Correspondent, Rawalpindi Commentary, The Patriot, 25 August 1964. 53. Ittefaq, 30 March, 19, 30 August 1964. 54. Ibid., 25 August 1964. 55. Janata, 30 September 1964. The Indian Express, 1 October 1964. 56. Ittefaq, 8, 19 August 1964. 57. Morning News (Dacca), 27 September 1964. Janata, 21 October, 4 November 1964. Special Correspondent, Dacca Commentary, The Patriot, 5 November 1964
58. The Hindustan Times, 15 October 1964. Janata, 14 October 1964. The Patriot, 5 November 1964.
59. Janata, 11 November 1964. 60. Ibid., 11, 18, 25 November 1964.
61. The Hindustan Times, 5 November 1964. Janata, 2, 9, 16, 23 December 1964.
62. The Statesman (New Delhi), 10, 11 December 1964. Janata, 2, 16 December 1964. The Nagpur Times, 26 December 1964.
63. Janata, 30 December 1964. The Hindustan Times, 31 December 1964-AP despatch from Karachi, dated 30 December 1964.
১৭৫
64. Pakistan Observer, 4 January 1965. Anandabazar Patrika (Bengali daily, Calcutta), 6 January 1965. Janata, 25 November 1964. Compass, 9 January, 1965. pp. 17-18-a commentary by its own correspondent who visited East Pakistan for making a study of the Presidential elections.

65. গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার রায়, pp 79-100