You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা সেনানিবাস ও শহরে যা ঘটেছিল
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল আবু তাহের সালাউদ্দিন
(১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে ক্যাপ্টেন পদে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন)

অসহযোগ আন্দোলনের সময় যেসকল ছোটখাটো গণ্ডগোল আরম্ভ হয় তাতে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণরূপ আওয়ামী লীগের উপর দোষারোপ করে এবং এই দোষ দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরকারের সহযোগিতায় ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশে সীমাহীন গনহত্যা চালায়। কিন্তু এই হত্যার পরিকল্পনা অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ব থেকে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী ছিল। তার কারণ-

যে কোন দেশে সেনাবাহিনীর সৈন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মোতায়েন করতে হলে তার মূল জায়গা অর্থাৎ যেখানে থেকে সৈন্য পাঠান হয় সেই জায়গায় প্রতিরিক্ষার উপর প্রথম গুরুত্ব দিতে হয় এবং সেটা করতে পারলেই সেই জায়গা থেকে সরানোর আদেশ হয়। (এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পাকিস্তান সামরিক সরকার ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ থেকেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। তাতেই প্রমান হয় যে পাকিস্তান সামরিক সরকারের সুপরিকল্পনা ছিল)।

যেহেতু সীমান্ত এলাকায় শত্রুদেশের সৈন্যের সঙ্গে কোন ছোটখাটো গোলাগুলি বিনিময় হয়নি বা দেশের জনসাধারণ ও খবরের কাগজে যুদ্ধের কোন হুমকির আভাসও পাওয়া যায়নি তথাপি পাকিস্তান সরকারের এরূপ সৈন্য মোতায়েন (বিভিন্ন থানা পর্যায়ে) প্রমান হয় যে পাকিস্তানী সামরিক সরকার বাংলাদেশের জনসাধারনের উপর গনহত্যার পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করেছিল।

১লা মার্চ, ৭১ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ জেনারেলগন বিভিন্ন সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সম্মেলন করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেনঃ

(১) লেঃ জেঃ টিক্কা খান, কমান্ডার ইস্টার্ণ কমাণ্ড।
(২) মোঃ জেঃ খাদেম হোসেন রাজা, জি-ও-সি, ১৪ ডিভিশন।
(৩) জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চীফ অব আর্মি স্টাফ।
(৪) লেঃ জেঃ এ,এ,কে নিয়াজী, কোর কমান্ডার।
(৫) মেঃ জেঃ আকবর হোসেন, ডাইরেক্ট জেনারেল, ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স।
(৬) মোঃ জেঃ ওমর,চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশন।
(৭) মেঃ জেঃ কমর আলী মীর্জা,প্রাক্তন ডাইরেক্টর, মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স (তখন-ডাইরেক্টর সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট।
(৮) মেঃ জেঃ মিঠঠা খান, স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ কমান্ডার এণ্ড কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল।
(৯) মেঃ জেঃ খোদা দাদ, এডজুট্যান্ট জেনারেল।
(১০) মেঃ জেঃ গুল হাসান, চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ।
(১১) মেঃ জেঃ রাও ফরমান আলী খান, সিভিল এফেয়ার্স এডভাইজার, গভর্ণমেন্ট অব আনসারী পাকিস্তান।
(১২) ব্রিগেডিয়ার আনসারী (মেঃ জেঃ আনসারী) (স্টেশন ,ঢাকা), (পরে জি-ও-সি, ৯-ডিভিশন)।
(১৩) মেঃ জেঃ নজর হুসেন শাহ।
(১৪) মেঃ জেঃ কাজী আবদুল মজিদ।
(১৫) লেঃ জেঃ পীরজাদা, (পি-এস-ও-টু জেঃ ইয়াহিয়া খান)।
(১৬) মেজর জেনারেল জামশেদ।
(১৭)মেঃ জেঃ বাহাদুর শের।

সৈন্য বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করার পূর্বে কতকগুলো দিক চিন্তা করতে হয়, যেমন সৈন্যদের থাকা, খাওয়া, বেতন, যানবাহন, যোগাযোগ ইত্যাদি। তাছাড়া ডাটা, ম্যাপ ইত্যাদি করতে হয়। পঁচিশে মার্চের গনহত্যা যদি হঠাৎই হতো তাহলে পাকিস্তানি সৈন্যগন ২৫ শে মার্চে বাংলাদেশের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একই সাথে একই সময়ে বাঙালি সৈন্য, ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, তথা জনসাধারনের উপর উপর আক্রমন ও গনহত্যা চালায় কিভাবে! এতেই প্রমান হয় যে পাকিস্তান সামরিক সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিল।

১৫ই মার্চ, ৭১ এ প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামী লীগ নের্তৃবর্গের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা, ক্ষমতা হস্তান্তর, অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট হাউসে (বর্তমান গনভবন) এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভায় আলোচনা করেন। অপরদিকে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উপোরোল্লিখিত জেনারেলদের সঙ্গে গোপন বৈঠক চলত।

যেহেতু আর্মি ইন্টেলিজেন্স এ ছিলাম ও সাধারণ পোশাকে কর্তব্য পালন ও চলাফেরা করতাম, সেজন্যই আমি পাকিস্তান সামরিক সরকারের কার্যকলাপ অনুসরণ করতে পারি।

২৫শে মার্চের পূর্বেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী তে যে সমস্ত উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসার ছিলেন, তাঁদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন বাঙালি অফিসারসহ কিছু বাঙালি সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠায়। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সঙ্গে যে সমস্ত বাঙালি সৈন্য ছিলেন তাঁদেরকে নিরস্ত্র করা হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সৈন্যকে সীমান্ত এলাকায় প্রেরণ করে ভারতের হুমকির অজুহাতে।

যেসকল বাঙালি অফিসারকে স্ব স্ব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ও কয়েকজনকে অন্য পদে দেওয়া হয়, তাদের পরিচয় যথাক্রমেঃ

(১) মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ, চীফ অব জেনারেল স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি। তিনি ছিলেন ৫৭-ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের (ঢাকা) ব্রিগেড মেজর (ব্রিগেড মেজরের কাজ হচ্ছে ব্রিগেডের অপারেশন প্লান করা এবং পরিচালনা করা)। মেজর খালেদ মোশাররফকে পাঠায় কুমিল্লা ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং তদস্থলে একজন পাঞ্জাবী অফিসারকে নিয়োগ করে।

(২) ব্রিগেডিয়ার মজুমদার। তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডান্ট ছিলেন।তাঁকে ২২শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয় এবং গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়।তার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ক্যাপ্টেন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর) বর্তমানে বাংলাদেশ ১৬-বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমাণ্ড’র।

(৩) লেঃ কঃ মাসুদুল হাসান খান। তিনি ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে জয়দেবপুরে ছিলেন। তাঁকে ২২শে অথবা ২৩শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে এবং তাকেও গৃহবন্দী করে এবং তার স্থলে লেঃ কঃ রকিবকে জয়দেবপুর ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে পাঠায়। কারণ লেঃ কঃ রকিব ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেন্টেই ঢাকায় ২৫শে মার্চের রাতে গনহত্যা চালায়। এছাড়াও কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রাখা হয়। তাদেরকে বাইরের যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়।

বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা হয়। যেমন, প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে যশোর ক্যাণ্টনমেন্ট থেকে চৌগাছা (সীমান্ত এলাকা) পাঠায়। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে জয়দেবপুর থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য একব কোম্পানী পাঠায় টাঙ্গাইল। উক্ত কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর শফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার-চীফ অব বাংলাদেশ আর্মি)। অন্য একটি পাঠায় ময়মনসিংহে। উক্ত কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর নূরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্নেল)।

সৈয়দপুরে অবস্থিত ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে সীমান্ত এলাকায় পাঠায়। কুমিল্লায় অবস্থিত ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে পাঠায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। উক্ত রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমান কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল চট্টগ্রামে। তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর আপ্রান চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় মোতায়েন করে। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে (ন্যাশনাল সার্ভিস ব্যাটেলিয়ন, যার অধিকাংশই ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল) ২৫শে মার্চের পূর্বেই ঢাকায় নিরস্ত্র করে। এছাড়াও ৬০৪ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রায় ২৫ জন বাঙালিকে (যার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিলাম আমি নিজেই) নিরস্ত্র করা হয়। শুধুমাত্র আমার অস্ত্রটা নিতে তারা সাহস করে নাই। তাছাড়া ঢাকায় অবস্থানরত নিম্নপদের সৈন্যগন যেমন সিগনাল রেজিমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, ৬০৪ কম্বাইণ্ড ওয়ার্কশপ, ১৪৭ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপ, সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী, কম্বাইণ্ড অর্ডন্যান্স ডিপো, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, ট্রানজিট ক্যাম্প,ফিল্ড এম্বুলেন্স ও পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সমস্ত সৈন্যদেরকে অতি কায়দায় ও চালাকি করে নিরস্ত্র করে। বাঙালিকে কেন নিরস্ত্র করা হচ্ছে পাঞ্জাবীরা তার কারণস্বরূপ দেখায় যে, যারা বাঙালি তারা বাঙালি আইন-শৃংখলা ভঙ্গকারী জনগনের উপর গুলি চালাতে সক্ষম হবে না। জনগনের উপর গুলি চালাতে আমাদের মায়া-মমতা লাগা স্বাভাবিক। কাজেই পাঞ্জাবীদের হাতে অস্ত্র কম থাকায় আমাদের অস্ত্র নিয়ে আইন শৃংখলা স্বাভাবিক ও আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে- এই কারনে আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিচ্ছে।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন শাহেদ নসরুল্লাহ (ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) আমার অফিসে প্রায়ই দেখা করত ও আমার নিকট থেকে খবরাখবর নিত। শাহেদ নসরুল্লাহ এভাবে আসা যাওয়া করাতে আমাকে আমার অফিসার কমান্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেন জিজ্ঞাসা করেন যে ছেলেটি কে এবং কেন আসে। আমি আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দেই এবং জানাই যে, যেহেতু আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে দেয়া হয় না সেজন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। পরে একদিন শাহেদ নসরুল্লাহ যখন আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তায় মেজর মনোয়ার হোসেনের হাওলাদার মোঃ আশরাফ তার ফটো তুলে নেয়।

পরদিন নসরুল্লাহ আমার নিকট এসে হাওলাদার কর্তৃক তার ফটো তোলার কথা জানায়। আমি নসরুল্লাহকে সাহস দিয়ে বলি ওতে কিছু হবে না। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো যখন ঢাকায় আসে তখন শাহেদ ছাত্রনেতাদের নের্তৃত্বে একটি ছাত্র ও গনবিক্ষোভ মিছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছে এবং ভূট্টো কে নিন্দা করে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়। ঐ মিছিলে শাহেদ নসরুল্লাহর শ্লোগান দেওয়া ফটোটি ‘দি পিপল’ পত্রিকায় দেখা যায়। পিপল পত্রিকায় নসরুল্লাহর ফটো দেখা মাত্র মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে ডেকে বলেন, যে ছেলেটি তোমার নিকট আসে ও তোমার আত্মীয়, সে তো একজন ছাত্রনেতা সে ছেলেটি মিছিলে নের্তৃত্ব দিয়েছিল। তিনি পিপল পত্রিকাটির কপি এনে আমাকে দেখান। তখন আমি মেজর মনোয়ার হোসেন কে জানাই যে আমি সঠিক কিছু বুঝতে পারছি না, সে তো কোনদিন ছাত্ররাজনীতি করতো না। এর থেকে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে আরও বেশী সন্দেহের চোখে দেখেন।

এরপর ১৫ই মার্চ থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের ঢাকা আগমন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার অগ্রগতির কথা শুনে আমরা কিছুটা আশাবাদী ছিলাম যে তারা সম্ভবত আওয়ামী লীগকে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আমরা বাঙালি অফিসাররাও পাঞ্জাবীদের মতিগতিকে তেমনভাবে লক্ষ্য করতাম না আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাবে মনে করে (আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীনের প্রেসনোটের উপর ভিত্তি করে)।

২৩শে মার্চ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ও গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় প্রত্যেক বাঙালির ঘরে ঘরে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ২৪শে মার্চ সকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেন্ট ওয়ালী খানসহ আরও কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতার ঢাকা ত্যাগ করে যাওয়ায় আমাদের মনে সন্দেহ হয় এজন্য যে, হয়তবা আলোচনা মোটেই ফলপ্রসূ হয় নাই।

২৫শে মার্চ আমি আকস্মিকভাবে বিকেল চারটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে চলে যাই আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে। দুর্ভাগ্যবশত শহর থেকে আমার মেসে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বেজে যায়। আমি ক্যান্টমেন্টে এসে সোজা আমার কক্ষে না গিয়ে ডাইনিং হলে যাই। খাওয়ার টেবিলে পাঞ্জাবী অফিসাররা উপস্থিত ছিল। খাবার পরে সাড়ে ন’টায় আমার কক্ষে যাই। সেখানে সিপাই মোশাররফ হোসেন (বাঙালি) আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই সে আমার নিকট ছুটে আসে এবং জানায় যে, সে আমার জন্য বিকেল ৪টা থেকে অপেক্ষা করছে। একথা বলেই সে সঙ্গে সঙ্গে তার পকেট থেকে ছোট এক টুকরো কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়।

উক্ত চিঠিখানা লিখেছিলেন ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) খুরশীদ আলম চৌধুরী। তিনি লিখেছিলেন, ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জাহেদ হাসান ঐদিন (২৫ শে মার্চ) বেলা আড়াইটায় নির্দেশ দিয়েছেন অদ্য রাতে (২৫ শে মার্চ) তার রেজিমেন্ট কে শহরে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শহরে আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে বলে জানান এবং আরও বলেন যে যদিও শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করার শহরে যাওয়া হবে তবু একটা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সঙ্গে নিতে হবে। আরও বলেছিলেন যে, তার নির্দেশের পর কোন বাঙালি অফিসার বা জোয়ানরা রেজিমেন্ট এলাকা থেকে কোনক্রমেই বাইরে যেতে পারবে না (তখন থেকে যতক্ষন পর্যন্ত রেজিমেন্ট শহরের উদ্দেশ্যে বের না হয়)। উক্ত ক্যাপ্টেন খুরশীদ আলম চৌধুরীর পক্ষে আমার নিকট চিঠিখানা এজন্যই পাঠানো সম্ভব হয়েছিল যে, তার রেজিমেন্ট এলাকা ও আমার মেস পাশাপাশি জায়গায় ছিল,মাঝখানে শুধু কাঁটাতারের বেড়া।

চিঠিখানা আমার হস্তগত হওয়ার পর আমি কিছুক্ষন অস্বস্তি বোধ করি। এমতবস্থায় কি করা কর্তব্য সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি এবং আমার সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে। গভীর চিন্তার পর আমার পাশের কক্ষের বন্ধু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজুর রহমান (তিনি আর্মি ইঞ্জিনিয়ার্সের ক্যাপ্টেন এবং বিমান বাহিনীর সঙ্গে ডেপুটেশনে ছিলেন এবং সেখানে সহকারী গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন) এর নিকট যাই। মুস্তাফিজুর রহমান আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং আমরা দু’জনে মাঝে মাঝে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর আলোচনা করতাম। তাঁকে ক্যাপ্টেন খুরশীদ আলম চৌধুরীর চিঠিখানা সম্বন্ধে জানাই। দু’জনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে শহরে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নের্তৃবর্গকে এ খবর পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেই। শেখ কামালের বিশিষ্ট বন্ধু শাহেদ নসরুল্লাহকে (ধানমন্ডীর বাসায়) প্রথমে খবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা শাহেদ নসরুল্লাহকে খবর দিলে সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট এ খবর অতিশীঘ্র পৌঁছাবে। মুস্তাফিজুর রহমান বললেন, তার কয়েকজন ভাই, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও বিভিন্ন হলে রয়েছে, তাদেরকেও এ খবর জানালে ছাত্ররাও প্রস্তুতি নিতে পারবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা দু’জন তার নিজস্ব টয়োটা গাড়িতে শহরে রওনা হই (রাত প্রায় দশটা)। যখন আমাদের টয়োটা গাড়ী ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্টের গেটে পৌঁছে তখন আমরা দেখতে পাই যে, ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্টের গেট দিয়ে চীফ অব আর্মি স্টাফের পতাকাসহ ৪ তারকাবিশিষ্ট একখানা স্টাফ কার বের হচ্ছে। উক্ত গাড়ীতে জেঃ আব্দুল হামিদ খান, চীফ অব আর্মি স্টাফ, পাকিস্তান আর্মি এবং জেনারেল টিক্কা খান, কমান্ডার ইস্টার্ণ কমাণ্ড ছিলেন। উক্ত গাড়ীর পিছনে প্রায় ৫০/৬০ খানা খোলাগাড়ী ছিল। কয়েকটি গাড়ীতে ভারী মেশীনগান লাগানো, কয়েকটি গাড়ীতে রিকয়েললেস রাইফেল লাগানো, কয়েকটি বড় বড় ট্রাকে পুরো যুদ্ধের পোষাক ও অস্ত্রসহ সৈন্য ছিল। আমরা রাস্তা নির্দেশের উলটোপথ দিয়ে তাদেরকে পিছনে ফেলে আগে চলে যাই। তখন শহরে লোকজন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছিল। প্রথমে আমরা ধানমন্ডি ২৬ নং সড়কে শাহেদ নসরুল্লাহর বাসভবনে গিয়ে বিস্তারিত জানাই এবং শেখ কামালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নিকট আমাদের খবর পৌঁছানোর কথা বলি। এছাড়া তাকে (নসরুল্লাহ) তার বাসা থেকে অন্যত্র চলে যাবার পরামর্শ দেই। কেননা মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট তার তুলে দেওয়া ফটো ও দি পিপল পত্রিকায় প্রকাশিত ফটো ছিল। আমাদের কথা শুনে শাহেদ নসরুল্লাহর পিতা খুবই চিন্তায় পড়েন। কিছুক্ষন পর আমরা মুস্তাফিজুর রহমানের ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়ার জন্য মোহাম্মদপুরে যাই। তাদেরকেও আমরা বিস্তারিত খবর জানাই এবং সতর্ক হওয়ার জন্য অন্যান্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনকে খবর পৌঁছাতে বলি। সেখান থেকে আমরা ক্যান্টনমেন্ট ফিরে আসার পথে ফার্মগেট ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিলের মাঝে পড়ি। ছাত্ররা ফার্মগেটে প্রতিবন্ধকতা (ব্যারিকেড) সৃষ্টি করেছিল যেন শহরে সৈন্যবাহিনীর যে সমস্ত গাড়ী গিয়েছে তারা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে না পারে। আমরা যখন মিছিলের মাঝে পড়ি তখন কয়েকজন ছাত্র আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমি সেনাবাহিনীর পরিচয় না দিয়ে বাঙালি ও সাধারণ মানুষ, গুলশানে বাসা আছে বলে জানাই। তখন তারা আমাদের গাড়ী চলার জন্য একটু জায়গা পরিস্কার করে দেয় (তখন রাত প্রায় এগারটা)। ব্যারিকেড অতিক্রম করার পরই আমরা দেখলাম সেনাবাহিনীর ৪ খানা মেশিনগান লাগানো গাড়ী (বাতি নিভানো) কয়েকজন সৈন্য ফার্মগেটের দিকে ঠেলে নিচ্ছে। আমাদের গাড়ী একটু থামালাম। গাড়ী কয়েকখানা ফার্মগেটের কাছাকাছি গিয়েই ছাত্রদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু ছাত্র ও সাধারণ মানুষ সেখানেই মারা যায়। তারপর আমরা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের মেসে ফিরে আসি। কিছুক্ষন পর আমি আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় আমার পিতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি এবং জানতে পারি যে চট্টগ্রামেও পশ্চিমা সৈন্যরা শহরে নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্মমভাবে গুলি করছে এবং হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। আমার পিতার সঙ্গে কথা শেষ করেই আমি ঢাকায় ধানমন্ডিতে আমার মামা এডভোকেট জনাব আবু তাহের চৌধুরীকে টেলিফোন করি ও তাকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী কর্তৃক গনহত্যার খবর জানাই। রাত বারটা পর্যন্ত টেলিফোন যোগাযোগ ছিল, তার পরই আমাদের কানে অসংখ্য গুলির আওয়াজ আসে। মীরপুর, গুলশান ও এয়ারপোর্ট এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির আওয়াজ ও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এসময় পুরোদমে পাঞ্জাবীরা নিরীহ ঘুমন্ত জনসাধারণের উপর আক্রমণ করে মেশিনগান দিয়ে নির্মমভাবে গনহত্যা শুরু করেছে। এভাবে সারারাত গনহত্যা চালায়। শেষরাতে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে শহরে আক্রমন চালায় এবং অসংখ্য বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ পাই। এভাবে আমি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ, ক্যাপ্টেন এনামসহ আরো কয়েকজন চিন্তায় থাকি ও অনিদ্রায় রাত কাটাই।

আমাদের বিল্ডিং-এ পাঞ্জাবী মেজর পীর কমরউদ্দিন (জি-এইচ-কিউ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অফিসার কমান্ডিং ছিলেন) সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার বিছানাপত্রসহ সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বলেন, তিনি অফিসে যাচ্ছেন এবং অফিসেই থাকবেন। মেজর কমর পাঞ্জাবী হলেও আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু এবং একই সাথে ইনটেলিজেন্স কোর্স করি। আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই তাকে চিনতেন। তিনি চলে যাবার সময় অকথ্য ভাষায় আমাদেরকে কতগুলি কটুক্তি করেন ও আওয়ামী লীগকে গালিগালাজ করেন। আমাদেরকে সন্দেহ করে কিংবা ভয় করেই হয়তবা তিনি চলে যান। তার এরুপ কটুক্তি ও গালাগালিতে আমরা সবাই ধারনা করি যে অন্যান্য পাঞ্জাবী অফিসারও বোধ হয় বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের সঙ্গে অনুরূপ দুর্ব্যাবহার করেছে।

২৬শে মার্চ সকাল সাতটায় আমি আমার অফিসে যাই। মেজর মনোয়ার হোসেনসহ মেজর ফারুকী ও মেজর মীর্জা উপস্থিত ছিলেন। তারা খুব আনন্দ ও হাসাহাসি করছিলেন এবং অতি খুশীতে মিষ্টি খাচ্ছিলেন। মেজর মনোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগের পতন ও বাঙালিদের দমন করার কথায় মেতে ছিলেন।তারা আমাকেও মিষ্টি খেতে বলেন। তখন আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও একটা মিষ্টি খেলাম, তারপরই আমি শহরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট কয়েক ঘন্টার জন্য বাইরে যাবার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে বাইরে যাওয়া থেকে বঞ্চিত করেন এবং বলেন, শহরে অনেক বাঙালি দুস্কৃতিকারী মারা গেছে। যেহেতু তুমি বাঙালি, কাজেই তাদের মৃতদেহ দেখে তুমি স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে পারবে না, কাজেই তোমাকে এখন বাইরে বা শহরে যাবার অনুমতি দিতে পারি না। আমি অফিসে প্রায় দু’টা পর্যন্ত বসে রইলাম। এসময় ইউনিটের বেশ কয়েকজন বাঙালি সৈন্য আমার নিকট এসে শহরে ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর জানায় এবং এমতাবস্থায় তাদের কি কর্তব্য তা আমার নিকট হতে জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। আমি তাদেরকে কিছুটা সান্ত্বনা দেই ও আরও কিছু সময়ের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে বলি। তারপর আড়াইটার সময় আমি আমার মেসে খেতে যাই এবং খাবার পরে কক্ষে প্রবেশ করলে আমার সিপাই মোশাররফ (যার নিকট একটা স্টেনগান থাকত) আমাকে জানায় যে তার নিকট থেকে পাঞ্জাবীরা স্টেনগানটি নিয়ে নিয়েছে। সিপাই মোশাররফের কাছ থেকে স্টেনগান কেড়ে নেয়ায় আমার একটু ভয় হয় এবং অত্যন্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। তার পরই আমাদের পাশের বাড়িতে মেজর মওলার (বাংগালী-১৪৯ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপের কমান্ডিং অফিসার) নিকট গিয়ে স্টেনগান কেড়ে নেয়ার কথা জানাই এবং আমরা যারা বাঙালি ছিলাম সবাই নিরাপত্তার কথাও বলি। আমার কথা শুনে মেজর মওলা বলেন, বাঙালিদেরকে পাঞ্জাবীরা মারবে না – মারতে পারে না। কিন্তু তবু আমরা তিন – চারজন অফিসার রাতে তার বাসায় থাকা ও ঘুমানোর কথা বলি এবং আরও জানাই যে আমাদের ঘুমের সময় একজন অফিসার রাতে সবসময় পাহারা থাকবে। তিনি রাজি হলেন। আমি, ক্যাপ্টেন এনাম এবং মুস্তাফিজ ও মেজর ইকবাল তার বাসায়ই থাকি। কিন্তু সারারাত গুলির আওয়াজ এবং মীরপুর, গুলশান এলাকায় আগুন লাগানো দেখে আমাদের মোটেই ঘুম হয় নি।

২৭শে মার্চ, সকাল সাড়ে সাতটায় আমি অফিসে গেলে দেখতে পাই যে, তিনটা ই-পি-আর ট্রাক অসংখ্য রাইফেল ও অস্ত্রশস্ত্র (অস্ত্রগুলোতে অনেক লাল রক্ত লাগানো দেখতে পাই) নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢুকছে। আমার অফিসের অফিসের অনেক বাঙালি সিপাই আমাকে জানায় যে, ই-পি-আর ক্যাম্প এবং রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পে পাঞ্জাবীরা নিষ্ঠুরভাবে আক্রমন করে এবং বহু ই-পি-আর ও পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এসময় আমি আমার শহরের আত্মীয়স্বজনের কোন খবরাখবর না পেয়ে খুবই চিন্তায় পড়ি এবং আমি মেজর মনোয়ার হোসেনকে কঠোরভাবে জানাই যে, যে কোন প্রকারে হোক আমাকে অন্তত আধ ঘন্টার জন্য শহরে যেতে হবে। পরে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে শহরে যাবার অনুমতি দেন। অনুমতি পাওয়ার পর আমি সকাল দশটার সময় এম, এম দৌল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারকে (জি-২ ইন্টেলিজেন্স হেড কোয়ার্টার, ইস্টার্ণ কমাণ্ড) সঙ্গে নিয়ে জীপে শহরে চলে যাই।

সেদিন সকাল দশটা বিকাল ৬ টা পর্যন্ত কোন কারফিউ ছিল না। আমরা যাবার পথেই দেখলাম অসংখ্য নরনারী শহর ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট এলাকা পার হবার পর আমরা স্বচক্ষে যা দেখলাম তা হলোঃ

ফার্মগেটের পরে আওলাদ হোসেন মার্কেটের সমস্ত কাঁচা ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট (কমপক্ষে ৬০/৭০ টি) জ্বালিয়ে দিয়েছে।

ইস্কাটন রোডে আমার ভগ্নিপতি জনাব এস, আর, খান (সেকশন অফিসার, মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন) এর বাসায় যাই। সেখানে তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঐ এলাকায় পাঞ্জাবীরা ২৫শে ও ২৬শে মার্চ রাস্তায় বাঙালি যাদেরকেই পেয়েছে তাদের সবাইকে জঘন্যভাবে হত্যা করে রাস্তার আশেপাশে মাটিতে চাপা দিয়েছে। ইস্কাটন রোড থেকে বের হয়ে যখন আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে পৌঁছালাম তখন ডানদিকে দি পিপল পত্রিকার অফিস দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং অসংখ্য মৃত লাশ পড়ে রয়েছে এবং অনেক লাশ আগুনে জ্বলছে। ঐ রাস্তা দিয়ে রাতে ট্যাংক চালানো হয়েছে। ট্যাংকের চেইন এর ছক তখনো রাস্তায় ছিল।

সেখান থেকে আমরা হাতিরপুলে মেজর দৌল্লাহ সাহেবের বাসায় যাই। সেখানে মেজর দৌল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই জনাব জনাব আসফউদ্দৌল্লাহ (বর্তমান জয়েন্ট সেক্রেটারী, ওয়ার্কস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হল, জগন্নাথ হল ও স্টাফ কোয়ার্টারে ঢুকে পাঞ্জাবীরা কিভাবে জঘন্যভাবে ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে তার বিবরণ দেন (২৫শে ও ২৬শে মার্চ জনাব আসফউদ্দৌলাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে তার শ্বশুর ভূগোল বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ নফিজ আহমেদের বাসায় ছিলেন)। জনাব আসফউদ্দৌলাকেও পাঞ্জাবীরা হত্যা করার চেষ্টা করে কিন্তু ডঃ নফিস তাঁকে রক্ষা করেন। হাতিরপুল এলাকায়ও আমরা কিছুকিছু বাড়িঘর ভস্মীভূত দেখি এবং কয়েকটি লাশ রাস্তায় দেখতে পাই।

হাতিরপুল থেকে আমরা ধানমন্ডি ১৪ নং সড়কে আমার মামা এডভোকেট আবু তাহের চৌধুরীর বাসায় যাই। মামার মুখে শুনতে পাই যে সেখানেও পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বহু লোককে গুলি করে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষন করে, কতিপয় মেয়েকে গাড়ীতে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে।

মামার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা নিউ মার্কেট হয়ে ইকবাল হলে রওনা হই। নিউ মার্কেটে বাজার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত অবস্থায় দেখি। আজিমপুর হয়ে যখন আমরা রেল ক্রসিং এ পৌঁছি তখন সেখানে বেশ কিছু সংখ্যক লাশ দেখতে পাই। ইকবাল হলের গেটে ঢোকার পর মাঠের মধ্যে আমরা ১১ জনের মৃতদেহ একই লাইনে পড়ে রয়েছে দেখতে পাই। প্রত্যেকের চেহারাই ছাত্র বলে ধারনা হলো। হলের সমস্ত দরজা জানালার কাঁচ ভাঙ্গা অবস্থায় দেখি এবং দেয়ালে ট্যাংকের গোলা দাগ ও গর্ত দেখা যাচ্ছিল। হলের মধ্যে ঢুকে কয়েকটি কক্ষে তাজা লাশ পড়ে থাকতে দেখি।

এ সময় বহু লোক হলের ভেতরে ঢুকে মৃত লাশগুলি দেখছিল। হল থেকে বের হবার সময় মাঠের মধ্যে কয়েকটি বিরাট গর্ত দেখতে পাই। জনসাধারণের মুখে শুনতে পাই যে, বহু ছাত্রকে হত্যা করে ঐ সমস্ত গর্তে কবর দেয়া হয়েছে। ইকবাল হল থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় এস এম হলের দেয়ালেও ট্যাংকের অনেক গোলার দাগ দেখতে পাই। এরপর আমরা জগন্নাথ হলের ভিতরে প্রবেশ করি। সেখানেও ইকবাল হলের মত একইভাবে মৃত লাশ ও গর্ত করা কবর দেখতে পাই। সেখানে কয়েকজন ছাত্র ও লোকের মুখে ডাঃ জি সি দেবসহ শিক্ষক, ছাত্র ও রোকেয়া হলে নারী ধর্ষণের করুণ কাহিনী শুনতে পাই।

জগন্নাথ হল থেকে বের হয়ে রোকেয়া হলের পাশ দিয়ে রেসকোর্স অতিক্রম করার সময় রেসকোর্সের মাঝখানে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় দেখি। হিন্দু মন্দিরে যে সমস্ত হিন্দু নরনারী ছিল তাদেরকে হত্যা করা হয় এবং তাদের কয়েকটি মৃতদেহ আমরা রাস্তা থেকেই দেখতে পাই।

রেসকোর্স থেকে হাইকোর্ট হয়ে গুলিস্তান এলাকায় যাই। গুলিস্তান থেকে নওয়াবপুর রোডে অনেক বাড়িঘরে আগুন জ্বলতে দেখি। আমরা গভর্ণর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) দিয়ে দৌল্লাহ সাহেবের এক ভাইয়ের বাসায় (উয়ারী) যাই। সেখানেও তার নিকট পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার ও গনহত্যার কাহিনী শুনি। সেখান থেকে ইত্তেফাক অফিসে আগুন জ্বলতে দেখি। তারপর আমরা পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসের সম্মুখে অফিসের সমস্ত কাগজপত্র রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি এবং কিছু কিছু কাগজ বা অন্য কিছু পোড়া দেখতে পাই। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে মতিঝিল হয়ে আমরা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সম্মুখে যাই। তখন প্রায় বিকেল তিনটা বাজে। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার্স এর মেজর এনামের মুখে আমরা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের যে বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারি তা হলোঃ

২৫শে মার্চ রাত বারোটার সময় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা পুরা যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের চতুর্দিক থেকে অতর্কিত হামলা করে গুলি চালায়। পুলিশরাও বীরত্বের সাথে নিজেদের আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এভাবে সারারাত উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালায়। এবং যুদ্ধে যখন পাক বাহিনী কোনক্রমেই পুলিশ দলের সঙ্গে জয়লাভ করতে পারছিল না তখন ভোর চারটার সময় পাক হানাদার বাহিনী ট্যাংক নিয়ে আক্রমন চালায়। ট্যাংকের আক্রমনও বীর পুলিশ ভাইয়েরা প্রতিহত করে। ২৫শে মার্চ সারারাত ২৬শে মার্চ বিকাল ৪টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ ভাইয়েরা প্রচণ্ড যুদ্ধ করে।

বিকাল চারটার পর পুলিশ বাহিনীর গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে যায় এবং প্রায় সাতশ পুলিশ ভাই শহীদ হন। প্রায় সাড়ে তিনশ আত্মসমর্পন করেন। বাকি সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।যে সমস্ত পুলিশ ভাই শহীদ হন তাদের লাশ পাঞ্জাবীরা পুলিশ ক্যাম্পের মাঠে বিরাট গর্ত করে কবর দেয়। মেজর এনামের মুখে বিস্তারিত খবর নিয়ে আমরা পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে যাই। সেখানে পাক হানাদার বাহিনী পিলখানার চতুর্দিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখায় আমরা কিছুই দেখতে পারিনি। সেখান থেকে আমরা বিকাল চারটার সময় ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসি।

ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছে আমি গোছল করি। বিকাল ৫ টার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে, সেক্রেটারিয়েট অফিসের কয়েকজন পদস্থ কর্মচারী ৩ টা বাসে পরিবারসহ ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে ময়মনসিংহ যাবার সময় (তাদের অধিকাংশই ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের অধিবাসী) পাঞ্জাবী ১৩-এফ-এ রেজিমেন্টে সৈন্যরা কুর্মিটোলা রেল স্টেশনের সম্মুখে যেখানে আর্মি ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল সেখানে উক্ত বাস ৩ টা বাস থামিয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত যুবতী মেয়েদেরকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখে এবং যুবক ও বয়স্ক স্ত্রী পুরুষদের মারধর করে তাদের বাস ছেড়ে দেয়। পরে মেয়েদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ১৯-সিগনাল ব্যাটালিয়নে নিয়ে যায়। এবং পরস্পর শোনা যায় যে সেখানে মেয়েদেরকে ধর্ষন ও অত্যাচার করছিল। এ খবর পাবার পর আমি লেঃ কর্নেল তাজ মোহাম্মদকে জানাতে যাই। লেঃ কর্নেল তাজকে না পেয়ে লেঃ কর্নেল সিনওয়ারীর (জিএসও-১ ইনটেলিজেন্স, জেড কোয়ার্টার, ইস্টার্ণ কমাণ্ড) নিকট যাই। তাকে না পেয়ে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টার অফিসার মেসে যাই। সেখান থেকে টেলিফোনে মেজর হাজী মোঃ কেয়ানীকে (জি-২ ইনটেলিজেন্স ১৪ ডিভিশন) নারী ধর্ষন ও অত্যাচারের কথা জানাই। আমার কথা শুনে মেজর হাজী কেয়ানী সাহেব অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তার করার কিছু নেই। কেননা ইতিপূর্বেও তিনি অনুরূপ কয়েকটি ঘটনার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, এ সমস্ত জঘন্য কার্যকলাপের জন্য কয়েকজন অফিসারই দায়ী। এবং বর্তমানে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যা তার পক্ষে বা অন্য কোন অফিসারের পক্ষেও আয়ত্ত্বে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা কতিপয় অফিসারের দোষেই সৈন্যরা বেশী প্রশ্রয় পেয়েছে। তিনি আমার কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে আমার নিকট তার অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চান এবং আরও বলেন যে, আমি যেন লজ্জাজনক কথা বলে তাঁকে গুনাহগার না করি। মেজর হাজী মোঃ কেয়ানী সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা শেষ করে আমার মেসে ফেরার পথে শহীদ আনোয়ার বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গনের এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডোর উপস্থিতিতে লেঃ জেঃ টিক্কা খানের ভাষন শুনতে পাই। তখন বিকাল সাড়ে ছটা। সন্ধ্যা সাতটার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম দুজন পাঞ্জাবীসহ জীপে আমার মেসে আসে। ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।তাকে নির্দেশ দিয়েছে সার্ভে অব পাকিস্তান-এ (বর্তমান সার্ভে অব বাংলাদেশ) গিয়ে চট্টগ্রামের মানচিত্র আনতে। আমি তাকে চুপে চুপে বললাম আমার ইউনিটে যে সমস্ত বাঙালি রয়েছে তাদের সবাইকে পালিয়ে যেতে। এবং ফজলুল করিম আমাকে জানাল যে তার সাথে দুইজন পাঞ্জাবী রয়েছে কাজেই সে কি করে পালাবে। আমি তাকে মানচিত্র নিয়ে আসার পর সুযোগ মত দেখা করতে বললাম। ফজলুল করিম চলে যাবার পর আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে হঠাৎ এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডোর একত্রে উপস্থিত হওয়ার কারণ কি থাকতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারনা হলো যে, তাদেরকে হয়তো বা কোথাও পাঠানো হচ্ছে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর চট্টগ্রামের মানচিত্র সংগ্রহের কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে, চট্টগ্রামের যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা বোধ হয় আমাদের বাঙালিদের নিকট পরাজিত হয়েছে এবং সে জন্যই মানচিত্রের সাহায্যে রাতে প্যারাসুটে তাদেরকে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে। ইতিপূর্বে সন্ধ্যা সাতটার সময় ক্যাপ্টেন এনামের কক্ষে রেডিওতে আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার) এর ভাষন শুনতে পাই। বেতারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং সমস্ত বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, বিমান বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও জনসাধারণকে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে চিরতরে এদেশ থেকে নির্মূল ও খতম করার আহবান জানান। এবং তিনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সিইনসি ঘোষনা করেন। এ খবর শোনার পর আমরা কয়েকজন অত্যন্ত আনন্দিত হই এবং অনেক মনোবল ফিরে পাই। আমরা বুঝতে পারলাম যে চট্টগ্রামে পাক বাহিনী পরাজিত হয়েছে এবং আমাদের পুরোপুরি দখল রয়েছে। এর পর থেকে আমি কিভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব এবং কিভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে গিয়ে যুদ্ধ করব সে চিন্তাই করতে লাগলাম। রাত ৯টার সময় ক্যাপ্টেন এনামের মারফত একটি ভীতিজনক খবর শুনতে পাই। সেটা হচ্ছে ৭ই ডিসেম্বর ’৭০ আমি এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ আমাদের মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের উপস্থিতিতে টেলিভিশনে দেশের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল দেখছিলাম। আওয়ামী লীগের পক্ষে সন্তোষজনক ফলাফলে পাঞ্জাবী অফিসাররা সকলেই কক্ষ থেকে কেটে পড়তে থাকে। ক্রমে ক্রমে সবাই কক্ষ ত্যাগ করলেও আমি এবং মুস্তাফিজ শুধু কক্ষে থাকি। রাত বারোটার সময় নায়েক পয়া খান (পাঠান) আমাদেরকে জানায় যে, মেস কমিটির সভাপতি মেজর রানার (পাঞ্জাবী) নির্দেশমত রাত বারোটার পর টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ করতে হবে। আমরা তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, সারা দেশের লোক টেলিভিশন দেখছে এমন কি প্রেসিডেন্ট স্বয়ং টেলিভিশনে নির্বাচনের খবরা খবর নিচ্ছেন সেখানে আমরা রাত বারোটার পর খবর শুনলে তেমন অসুবিধা হবে না। তাকে আরও বললাম যে, তার যদি কোন অসুবিধা হয় তবে আমরা অন্য বেয়ারা রেখে তাকে তার কর্তব্যের অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে দেব। আমাদের কথায় কর্ণপাত না করে উক্ত নায়েক পয়া খান নিজেই টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পরক্ষণই লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ টেলিভিশন অন করে। নায়েক পয়া খান দ্বিতীয়বার টেলিভিশন বন্ধ করলে লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ পুনরায় অন করে। কিন্তু পয়া খান আমাদের তোয়াক্কা না করে তৃতীয়বারও টেলিভিশন বন্ধ করে। এবারেও মুস্তাফিজ টেলিভিশন অন করতে উদ্যত হলে পয়া খান মুস্তাফিজের হাত ধরে ফেলে। তখন আমি রাগান্বিত হয়ে পয়া খানের জামার কলার চেপে ধরে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দিলে সে দৌড়ে গিয়ে একটা ছোড়া নিয়ে এসে আমাদের গালাগালি করতে থাকে যে, ‘শালা বাঙ্গাল লোককো খতম করেঙ্গে।’ এ সময় সেন্ট্রি দৌড়ে এসে তাকে ধরে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন আমি আমার অফিসার কমান্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেনকে লিখিতভাবে এবং মেজর রানাকে মৌখিকভাবে জানাই।পরে ঘটনার তদন্ত চলে। লেঃ কঃ শরিফের সভাপতিত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বিস্তারিত বিবৃতিতে আমাকে এবং মুস্তাফিজকেই দোষী করা হয় এবং আমাদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা প্রকাশ করে।

দ্বিতীয়ত, দেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আমাদেরকে হত্যা করার হুমকি দেখায়। মেজর রানা ক্যাপ্টেন এনামকে আরও বলেছিলেন যে, যেহেতু আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকে এমএনএ ও এমপিএ এবং অনেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থক সেহেতু আমি এবং মুস্তাফিজ দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থক সুতরাং আমাদের দুজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাত ৯টার সময় (২৭ শে মার্চ ১৯৭১) ক্যাপ্টেন এনামের মুখে উপরোক্ত কথা শুনে আমি খুবই ঘাবড়ে যাই। কিছুক্ষন পর আমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন এনামকেও আমার সঙ্গে পালানোর ইঙ্গিত দেই। কিন্তু সে নেতিবাচক জবাব দেয় এবং আমার কক্ষ থেকে তার নিজ কক্ষে চলে যায়। আমি চুপ করে মুস্তাফিজের কক্ষে গিয়ে তাকে আমার সঙ্গে পালানোর কথা বলি। সে পালানোর কোনো সিদ্ধান্ত রাতে নিতে পারলো না।

Source: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!