You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ববাংলার সংগ্রাম ও চীন বিরােধী বিষােদগার
অমূল্য রতন সেন

পূর্ববাংলার ব্যাপারে চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চীন আশ্চর্যজনকভাবে শীতল অথচ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা সম্পর্কে অসাধারণভাবে উদগীব। পাকিস্তান পশ্চিমী জঙ্গিজোটের সদস্য, প্যান ঐশ্লামিক উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তির ওপর পাকিস্তান রাষ্ট্রটির উদ্ভব ও অস্তিত্ব। পাকিস্তান এমনকি বুর্জোয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকেও অনেক দূরের, অনেক পেছনের যাত্রী। বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক দেশ কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে তার দহরম মহরম’ এবং এমন একটি অতীতাশ্রয়ী রাষ্ট্রের প্রতি চীনের বিগলিত করুণাধারা’ তাই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলেছে, চীন কি সত্যি সত্যিই বিশ্বমুক্তির দুর্জয় সহযােদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধরত মানবগােষ্ঠীর অবিসংবাদিত দুর্গ হতে পারে? তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে চীন এতটা শীতল কেন? পাকিস্তানের ইয়াহিয়া জল্লাদদের প্রতি চীনের এত দরদ’ কেন? যে সিহানুকের প্রতি চীনের অত সমর্থন সে কি মুজিবের অপেক্ষা বেশি প্রগতিশীল? প্রভৃতি প্রভৃতি।
যে মহলে চীন সম্পর্কে উপরােক্ত বিতর্কমূলক চিন্তাধারা এবং প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা তৃতীয় মহল। প্রথম মহল যারা সরাসরি চীন বিরােধী। দ্বিতীয় মহল যারা সরাসরি চীনের সমর্থক। তৃতীয় মহল এই উভয় প্রান্তীয় মহলের সমদূরত্বে অবস্থান করছেন।
আজকের যুগে সমদূরত্বের নীতি প্রকৃত পরিণতিতে প্রতিক্রিয়াশীলতারই নীতি। রাষ্ট্র, গােষ্ঠী বা দলীয় মতবাদের ক্ষেত্রে, যে কোনাে রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমদূরত্বের নীতি আজ আর বিকাশের পর্যায়ে নেই, তা বিপর্যয়ের পর্যায়ে চলে গেছে। অর্থাৎ তা অবক্ষয়ী।
বুর্জোয়া সভ্যতা বিকাশের স্বর্ণযুগে এবং বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী চিন্তাধারার উষাকালে সমদূরত্বের নীতি মানবিক বিচার-বিবেক আর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার দিক থেকে মুক্ত চিন্তার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল লেনিন ও স্তালিনের নেতৃত্বে মহান সােভিয়েত ভূমির অভ্যুদয়ের পর তার প্রয়ােজন স্থানান্তরিত হয়ে ব্যক্তি মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে। অর্থাৎ সমদূরত্বের নীতি আজ আর সংগঠনগতভাবে নয়, মতবাদগতভাবে অনুধাবনের জগতে উপনীত হয়েছে। আজ আর কারাের পক্ষেই সমদূরত্বের নীতি নিয়ে একই সঙ্গে কমিউনিস্ট বিরােধী হওয়া সম্ভব নয়; কী সাংগঠনিক পর্যায়ে, কী ব্যক্তি পর্যায়ে ওটা সম্পূর্ণতই কমিউনিস্ট বিরােধিতা, কমিউনিজম বিরােধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদের দালালী। যেমন তৃতীয় বিশ্বের ধ্বজাধারী নিরপেক্ষ ভারত নির্লজ্জভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সায়গনের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আশ্রয়পুষ্ট ফ্যাসিস্ট সরকারকে টাটার ট্রাক আর ভিলাইয়ের ইস্পাত দিয়ে সাহায্য করে।
ব্যক্তি পর্যায়ে মতবাদগতভাবে সমদূরত্বের নীতিটি কী? একেবারেই পুরনাে সংগঠনগতভাবে সমদূরত্বের নীতি থেকে আলাদা। আজকের সমদূরত্বের নীতি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সংগঠন বা ঘটনার বিচার, সংগঠন বা ঘটনা দিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির বিচার নয়, বরং ঠিক উল্টো। বুর্জোয়া নৈতিকতা কিংবা কমিউনিস্ট বৈজ্ঞানিকতা আজ আর কোনাে প্রশ্নাধীন ঘটনা নয়, বরং ঘটনা’ই আজ বুর্জোয়া নৈতিকতা কিংবা কমিউনিস্ট বৈজ্ঞানিকতার প্রশ্নাধীন। তৃতীয় মহলকে তাই ঠিক করতে হবে, কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তারা পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধ এবং চীনের ভূমিকার বিচার করবেন। একই সঙ্গে আমেরিকা খারাপ, রাশিয়া খারাপ, ভারত খারাপ, কিন্তু চীন সম্পর্কে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আত্মিক অসহায়তা কিংবা ভণ্ডামি থেকে আসে। প্রথমত, সবাই খারাপ হলে দুনিয়াতে আর ভালাে-মন্দের পার্থক্য থাকে না ভালাের উদয়ই হয় না। দ্বিতীয়ত, দুনিয়াতে সবাই খারাপ হয়ে শুধু নিজে ভালাে হলেই ভালাে মনে করে না এমন কোনাে খারাপ কেউ দুনিয়াতে হয় না।
কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধ এবং চীনের ভূমিকাকে বিচার করতে হলে একটি সুসংবদ্ধ প্রণালীতেই আলােচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। খাপছাড়াভাবে চীন-ইয়াহিয়া বা চীন-সিহানুক নজির টেনে পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধের যেমন কোনাে সদর্থক মঙ্গল ঘটানাে যাবে না, তেমনি পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধকে নতুন করে চীন বিরােধী হিস্টিরিয়া সৃষ্টির কাজে লাগাতে ঘটনাগুলােই দৃষ্টিভঙ্গিকে অধীনস্থ করে ফেলবে।

॥ পটভূমি।।
সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে দেশীয় দালালদের সহযােগিতায় এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিসংবাদের স্পিরিট নিয়ে আসা হয়। সংগ্রাম অহিংসবাদ হচ্ছে এমন এক স্থিতিশীলতার নীতি যা এক জাতি কর্তৃক অন্য এক জাতি, এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য এক শ্রেণী শােষণ ও শাসনের নীতি, যখন প্রভুত্বপরায়ণরা সমাজের ওপর তাদের রাষ্ট্রিক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছে। এই উপমহাদেশীয় জীবনে বৃটিশ-পূর্ব ভারতে দেশীয় রাজন্যবর্গের হাতেই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন কর্তৃত্ব। বৃটিশ এসে সেই কর্তৃত্ব কেড়ে নেয় এবং শ্রেণীগত শােষণের ওপরে আরও একধাপ জাতিগত শশাষণের জোয়াল ভারতবাসীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের কর্তৃত্ব ইংল্যান্ডেশ্বরীর হাতে ন্যস্ত হবার পর এবং ভারতীয় জীবনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অভিশাপ টেনে নামানাের পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদী এবং দেশীয় দালালদের সহযােগিতা শুরু। এই শেষােক্তদলের সন্তান-সন্ততিরাই বৃটিশ ভারতের সামরিক উচ্চপদে, সিভিল এডমিনিস্ট্রেশনের সিংহাসনে, সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়, জাতীয় নেতৃত্বের মঞ্চ থেকে বৃটিশ ও দেশীয় ধনিক শ্রেণীর দালাল প্রতিভূরূপে ভারতবাসীর ওপর শতাব্দীব্যাপী খবরদারি করে এসেছে। ১৯৪৭ সালে আমরা অর্থাৎ এই উপমহাদেশের অধিবাসীরা-ভারত বা পাকিস্তানের জনগণ যে স্বাধীনতা পেয়েছে তাকে যদি স্বাধীনতা বলতে হয় তবে ঐ স্বাধীনতা আমরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অভিশাপের মুহূর্ত থেকেই পেয়েছি; আমাদের বৃটিশ ভক্ত জাতীয় নেতাদের স্থিতিশীলতার দর্শনে সেই স্বাধীনতা পরিপুষ্ট হয়েছে, আর বৃটিশ পদলেহনের কর্তৃত্বে কাড়াকাড়ি হয়ে ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ ভাগাভাগি হয়েছে। | ইতিহাসের এই পরাম্পর্য মনে রাখলে আমাদের এ কথা মানতেই হবে যে, বিভক্ত এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনের ওপর থেকে একধাপ ওপরের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের কর্তৃত্ব তাে শেষ হয়ই নি, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমাদের আরও কুর নয়া ঔপনিবেশিক শােষণের জোয়ালে আবদ্ধ করেছে এবং দেশীয় দালাল প্রতিভূরা সেই শশাষণ ব্যবস্থার সঙ্গে সমতা রক্ষা করে সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির পরিণতিগত সহায়করূপে ১৯৪৬ সালে ধর্মীয় জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টি এবং কর্তৃত্বের ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
এই উপমহাদেশকে ভাগাভাগি করে সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় দালাল প্রতিভূদের কোন কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়? ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যদিও বিশ্ব ফ্যাসিবাদী অভিযানের ওপর বিজয়ী, কিন্তু বিশাল চীনের ভূখণ্ড জুড়ে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বাহিনী চরম সাফল্যের পথে দ্রুত আগুয়ান। বিশ্বাসঘাতক চিয়াংকাইশেক এবং কুয়ােমিন্টং বাহিনীর প্রতি সর্বতাে সাম্রাজ্যবাদী সাহায্য সত্ত্বেও চিয়াংকাইশেক অস্তিত্ব পরাজয়ের পথে। এই ঘটনার প্রভাব বিশাল এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের মনে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টি করবে; যেমন মাও সে তুঙের চীনে তেমনি এই উপমহাদেশ থেকেও ষড়যন্ত্রকারী সাম্রাজ্যবাদী গ্রুপ এবং দালাল প্রতিভূরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা ভেঙে চৌচির হবার আগেই কর্তৃত্বের ভাগাভাগি করে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা হােক এবং চীনে সর্বাত্মক কমিউনিস্ট বিজয়ের আগেই তা করা হােক।
১৯৪৯-এ চীনে সর্বাত্মক কমিউনিস্ট বিজয় সম্পূর্ণ হয়, তার আগেই ১৯৪৭-এ এই উপমহাদেশ কেটে ভারত আর পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়।

।।কর্তৃত্বের অন্তবিরোধ।।
এই উপমহাদেশের জনগণকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা দালাল প্রতিভূদের কর্তৃত্ব ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছিল। ধর্মীয় বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রবণতায় উস্কানি দিয়ে এই ভাগবাটোয়ারার কাজটি তারা ভালােভাবেই করতে পেরেছিল। কিন্তু কর্তৃত্বের অন্তর্বিরােধ এতেই সম্পূর্ণ অবসিত হলাে না। যে বিচিত্র ও জটিল শােষণ ব্যবস্থার জোয়ালে উপমহাদেশের জীবন অবরুদ্ধ হয়ে আছে বিশ্ব পটপরিবর্তনের দ্রুত তরঙ্গাভিঘাতে বার বার সেই জীবন দুলে উঠেছে। চীনে কমিউনিস্ট বিজয়, কোরীয় যুদ্ধে নবজাত চীনের স্বেচ্ছাসেবী সৈন্যদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরােধী বীরদর্প রক্তাক্ত অভিযান ও কোরিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা, কিউবার বিপ্লব, মিশরে নাসেরের জাতিয়তাবাদী নেতৃত্বে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী অভ্যুত্থান, আলজেরিয়ায় বেন বেল্লার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী মুক্তি এবং পরিশেষে মহাবলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের জীবনপণ লড়াই একদিকে যেমন এই উপমহাদেশের নিপীড়িত মানবগােষ্ঠীকে সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছে তেমনি কঙ্গো, বায়ফ্রা, রােডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং পরিশেষে আরবের তৈল সমুদ্রে সাম্রাজ্যবাদী হাঙ্গরদের শয়তানি আর ষড়যন্ত্র এই উপমহাদেশের নিপীড়িত মানবগােষ্ঠীকে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধীও করে তুলেছে। জনগণের এই ভূমিকা অভ্যন্তরীণ শােষণ ও শাসনে। সাম্রাজ্যবাদের দালাল প্রতিভূ কর্তৃত্বের সম্মুখে যে সঙ্কট সৃষ্টি করে সেই সঙ্কট থেকেই কর্তৃত্বের অন্তর্বিরােধ দেখা দেয়। কর্তৃত্ব বিভাজনের সমস্যার সমাধান হতে পারে (এক) ভারত যে নীতি অনুসরণ করে, অর্থাৎ সমদূরত্বের নীতিতে। পরিণতিগতভাবে এই নীতি সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষার নীতি ছাড়াও এটি হলাে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে বিভিন্ন কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মধ্যকার অন্তর্বিরােধের সমতাবিধানেরও নীতি। ভারতে এ জন্যই দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় দালাল প্রতিভূরা কংগ্রেস সােস্যালিস্ট এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিও গড়ে তুলতে সক্ষম। বিড়লাজিও প্রয়ােজনে নকশালপন্থী হতে সক্ষম। (দুই) সমস্যার সমাধান হতে পারে পাকিস্তান যে নীতি অনুসরণ করে অর্থাৎ সমনৈকট্যের নীতিতে। পরিণতিগতভাবে এই নীতি সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষার নীতি হলেও এটি হলাে কর্তৃত্বের স্বার্থে বিভিন্ন কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মধ্যেকার বিরােধ বিকাশের নীতি। অংশত এই নীতি স্বাধীন এবং সেইজন্যই এই নীতি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কিছুটা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সিয়াটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনাম যুদ্ধে সায়গন সরকারকে বিন্দুমাত্র সাহায্য পাঠায়নি।

॥ মুজিবর নেতৃত্ব।।
মুজিবর নেতৃত্বকে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বলা হয়। মুজিবর নেতৃত্বকে যদি শুধু আঞ্চলিক অর্থেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বলা হয় তবু এই নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদ থেকে অনেক দূরে। যুগের বিচারে আজকের অসার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বেরও অনেক পেছনে।
জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলাে বহিরাগত শােষণকারীর শাসন শােষণের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করা। আমরা এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অহিংসবাদের ব্যাখ্যায় দেখিয়েছি যে, এটি একটি অন্যতম এবং বিরাট প্রশ্ন। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব শুধু বুর্জোয়া পরিচালিত নেতৃত্বই নয়, এই নেতৃত্বও জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলন সংগঠিত করে এবং শশাষক শ্রেণীর শােষণের উৎস, পন্থা ও উপায়গুলাের ওপর ধ্বংসের উদ্দেশে কখনাে গুপ্ত কখনাে বা প্রকাশ্য আঘাত করে। আন্দোলন বা বিপ্লবী প্রস্তুতিকে রক্ষা করার জন্য, এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য হামলাকারী শক্তির সঙ্গে নেতৃত্ব কখনাে কখনাে মিনিমাম আপােসে আসতে পারে বটে, কিন্তু কখনােই শত্রুর টোপ গিলে ফেলে না বা সাময়িক আপােস পন্থার ওপর আন্দোলন বা বিপ্লবী প্রস্তুতিকে নির্ভরশীল করে তােলে না। জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতাও এ যুগে একটি লক্ষণীয় দিক। মুজিবর নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের করুণাভিক্ষা আছে বটে, কিন্তু বিরােধিতার কণামাত্রও নেই।
পাকিস্তানের স্বৈরতন্ত্রী শাসকেরা একটি নির্বাচনের অনুষ্ঠান করেছিলেন, এই নির্বাচনী আপােসে মুজিবর নেতৃত্ব নিজের জনপ্রিয়তাকে দাদন দিয়েছিল এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তিকে ঐ সাময়িক আপােসের অধীনস্থ করে ফেলেছিল। মুজিবর নেতৃত্বের একমাত্র উৎকেন্দ্রিক শ্রমিক-কৃষক সমর্থন ছাড়া কখনাে কোননা শ্রমিক কৃষক সংগঠন শক্তির ভরসা ছিল না।
তাহলে মুজিবর নেতৃত্ব কী? মুজিবর নেতৃত্ব হলাে সেই সাম্রাজ্যবাদী দালাল প্রতিভূ নেতৃত্বেরই এক অংশ, পাকিস্তানের সমনৈকট্যের নীতির ফলে যার বিকাশ হয়েছে, যা পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী দালাল প্রতিভূ নেতৃত্বের অন্তর্বিরােধের সঙ্গে সঙ্গতকারণেই সমতাবিধান করতে পারেনি এবং প্রতিভূ নেতৃত্বের শক্তিশালী অংশের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

। উপমহাদেশের মুক্তির প্রশ্ন।
এই উপমহাদেশের জনগণের জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন অচ্ছেদ্য। সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় দালালদের সহযােগিতায় এই উপমহাদেশের জনগণকে ভাগাভাগি করা হয়েছে এবং জনগণের শত্রুরা নেতৃত্বের বিভিন্ন ছদ্মবেশে সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে জনগণকে প্রতারিত করে আসছে। পাকিস্তানের শাসকবর্গই তার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছেন। সংগ্রামরত জনগণকে এই উপমহাদেশের অখণ্ড অচ্ছেদ্য মুক্তির প্রশ্নে সামিল করা, সঠিক রাজনীতি ও নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিশ্ববিপ্লবের দুর্গ হিসেবে চীনের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের করুণা নির্ভর মুজিবর নেতৃত্বকে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী সহযােগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করে নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জগতে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলেছিল, আরব জগতে তৈল হাঙ্গরদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এবং মিশরে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সােভিয়েত রাশিয়ার মসনদ কাঁপিয়ে তুলেছিল। চীনের উদ্দেশ্য শতকরা একশ ভাগ সফল হয়েছে। পূর্ববাংলার অভ্যুত্থান নিয়ে সােভিয়েট পায়চারি আর মার্কিন ঘুঘুদের ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে গেল। প্রকাশ্যে সসাভিয়েট আমেরিকা পূর্ববাংলা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলাে। সাম্রাজ্যবাদের তরফে অতঃপর মুজিবর দালাল প্রতিভূ নেতৃত্বকে মদদ দেবার জন্য ভারতের দালাল প্রতিভূ নেতৃত্বকে নিযুক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর রইল না।
চীনের এই সুস্পষ্ট ভূমিকা যারা ভােলা চোখে দেখতে চান না, এই উপমহাদেশের মুক্তির প্রশ্নে হাজারটা মুজিবর ড্যান্স দিলেও তারা পূর্ববাংলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে পারবেন না, জয়লাভ তাে দূরে থাক।
হ্যা, এই উপমহাদেশের জনগণের মুক্তির অচ্ছেদ্য প্রশ্ন থেকে মুজিবর নেতৃত্ব যাদের কাছে বড় তাদের আমরা জানি এবং চিনি। তারা অনেক স্বয়ম্ভু সামরিক তত্ত্ব কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধের এমনকি জনযুদ্ধেরও বাত্তেলা মারেন। ঐসব ভাড়াটে গদ্য লিখিয়েদের জিজ্ঞাসা করি স্ট্যাট্রেজিক হিন্টারর্যান্ড ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ গেরিলা যুদ্ধ জনযুদ্ধ হয় কী করে হে মুখের দল? তােমরা কি তােমাদের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে প্রাক্তন জেনারেল চৌধুরীর প্রবন্ধটাও পড়ে কিছু শেখােনি? শেখার এই অনিচ্ছা থেকেই তাে বেশ বােঝা যায় তােমরা নিছক পায়রা নও, ঘুঘু।

সূত্র: দর্পণ
০৯.০৭.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!