সংশােধনবাদ ও মুক্তিযুদ্ধ
মৈত্রেয় ভাস্কর
যখন এই চিঠি লিখছি তখন মিলিটারি ও পুলিশ তারকাঁটা দিয়ে সমস্ত অঞ্চল ঘিরে ফেলেছে। একদিকে দরজায় দরজায় তাদের কর্কশ আওয়াজ ও বুটের শব্দ আর অন্যদিকে সাধারণের আর্তচিৎকার পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। এদিকে রেডিওর নিউজে জানা গেল অশােকনগরে আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে দুই তরুণ নিহত হয়েছেন। উগ্রপন্থী হিসেবে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। সংঘর্ষ আর নৃশংস হত্যার খবর প্রতিদিনই আসছে। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। শাসকশ্রেণীর অত্যাচার আরও ভয়াবহ হচ্ছে এবং সংশােধনবাদীদের মুখােশও খুলে পড়ছে, তবে এদের কার্যকলাপ সাম্যবাদী আন্দোলনে বিরাট বাধার সৃষ্টি করছে। এদের ভূমিকা যে কী মারাত্মক হতে পারে বেলেঘাটা ও বহরমপুরের ঘটনায় তা প্রমাণ হয়ে যায়। বেলেঘাটায় সম্পূর্ণ অঞ্চলটি কর্ডন করে মিলিটারি, সি আর পি ও স্থানীয় পুলিশ বিপ্লবীদের পাকড়াও করে এবং তাদের পাঁচজনকে বলির পাঠার মতাে হত্যা করে। তারা সবাই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অথচ কোনাে ছাত্র বিক্ষোভ দেখা দিল না, কোনাে প্রতিবাদ হলাে না। ছাত্র সংগঠনগুলাে যার মধ্যে অসংখ্য বিপ্লব-প্রাণ ছাত্রছাত্রী রয়েছেন সেগুলােকে সংশােধনবাদের পাকে দ্রুত ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভেবে দেখুন, এই পাশবিক ঘটনাটার দ্বারাই প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠীর হাড় কাঁপিয়ে দেয়া যেত। সংগ্রামী ছাত্রদের ক্রোধবহ্নির মােকাবেলার জন্য ওরা আরও দমনপীড়ন চালাত, কিন্তু প্রশাসন কি এতে অচল হয়ে যেত না, জনসাধারণের বৃহৎ অংশ কি এতে অংশ নিতেন না? বাম ছাত্র সংগঠন টু শব্দটি করল না।
আশার কথা এই সংশােধনবাদ ও নয়া সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে। মাগুরজানের কৃষকরা রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে গণমুক্তি বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের ইউনিটগুলাে বিভিন্ন স্থানে রাইফেল ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে চমকপ্রদ কর্মতৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। সাময়িকভাবে হটে এলেও ভারতবর্ষে লালঘাটি গড়ে তােলা সম্ভব তা বর্তমান প্রচেষ্টাগুলাের দ্বারা বােঝা যায়। শ্রীকাকুলাম, ডেবরা, গােপীবল্লভপুর, নকশালবাড়ি বেহালা অশােকনগর প্রভৃতি স্থানগুলাে হাজার হাজার পুলিশ মিলিটারি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। কিন্তু দু-এক বছরের মধ্যেই কয়েক হাজার নকশালবাড়ির সৃষ্টি হলে, ভারত সরকারের সাধ্য কি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সংশােধনবাদীদের চোখের সামনে এমনিভাবেই লাল ঘাঁটি গড়ে উঠবে।
সংশােধনবাদ আজকের দিনে বড় বিপদ। সংশােধনবাদ কেরলে এভাবেই সর্বনাশ ঘটিয়েছে। কেরলের মানুষ দক্ষিণপন্থীদের শিকার হলাে, কারণ সঠিক মার্কসবাদের আলাে তাঁদের কাছে পৌছে দেয়া হয়নি। যা নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা হলাে ভােটসর্বস্ব সস্তা রাজনীতি। অথচ ৫৬ সালে নামুদ্রিপাদ কেরলে ভারতবর্ষের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সি পি এম এর ঝানু প্রবক্তরা এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন কী করে? সমস্ত রাজনীতি বর্জন করেও ওরা ওখানে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। যার জন্য লীগের সাম্প্রদায়িক দাবি মেনে মুসলমান প্রধান জেলা গঠন করতে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলাে না এবং পরে ভােট যুদ্ধে তারা হেরে গেলেন। এটা অনেকটা আমেরিকা ডেমক্রেট রিপাবলিক দলের মতােই কিংবা ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির মতাে একবার জেতা, একবার হারা।
মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা এটাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং প্রয়ােগ করেছেন। প্রয়ােগ করে তারা ভােটের বিরােধিতা করে জনযুদ্ধের আহ্বান দিয়েছেন। যার প্রমাণ দিয়েছে শ্রীকাকুলাম এবং অন্ধ্রের অন্যান্য জেলাগুলাে নকশালবাড়ি, মেদিনপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, কোরাপুট।
আর একটা কথা, সি আর পি পরিবৃত সি পি এম নেতাদের পুলিশ ও নকশাল সমাজ বিরােধীদের যােগসাজস যে মিথ্যা রটনা এ কথা প্রাণ দিয়ে প্রমাণ দিয়ে গেলেন বহরমপুর জেলে মালদার পনেরাে বছরের ছেলে গােরা, জলঙ্গীর ছেলে নজরুল ইসলাম, মালদার কৃতী ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ, মণীন্দ্র বিদ্যাপীঠের মােল বছরের ছাত্র বরুণ চৌধুরী আর বেলেঘাটার পাঁচ জন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কারান্তরালে রয়েছে আরাে কত হাজার হাজার তার হিসাব কে রাখে! কত উল্লেখ করব সম্পাদক মহাশয়। আমি নিজে ছাত্র। লিখছি যখন চোখ ফেটে আমার জল এসে গেল। এখন মনে হচ্ছে একটা বিপ্লবীর মৃত্যু হাজার বীরের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ যেমন কতগুলাে বেইমান মীরজাফরের জন্ম দিয়েছে, তেমনি সে জন্ম দিয়েছে, অসংখ্য লেনিন, মাও, ক্ষুদিরামের। সে যে রত্নগর্ভা।
ভারতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ধনিক শ্রেণী ও তার দালালরা যত চেষ্টাই করুক না কেন, একদিন আগে বা পরে এখানে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। সুকান্তর কথা দিয়ে এই লেখা শেষ করলাম বিপ্লব স্পন্দিতবুকে মনে হয় আমিই লেনিন।
সূত্র: দর্পণ ৩০.০৪.১৯৭১