You dont have javascript enabled! Please enable it! আইয়ুব খানের সামরিক আইনের আওতায় সেই দিনগুলাে - সংগ্রামের নোটবুক

আইয়ুব খানের আমলে পূর্ব বাঙলায় মাত্র ১০% কৃষকের লাঙ্গল ছিলো। তারপরেও আইয়ুব খানের তুলনামূলক অবস্থান পাকিস্তান আমলের অন্যান্য শাসকদের চেয়ে ভালো ধরা হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নাকি তার রাজনৈতিক কৌশল অন্যদের চেয়ে উন্নত ছিলো। সেও বিতর্কিত ও জটিল। এই রহস্য উদ্ঘাটনে তথ্য ও রেফারেন্সবহুল লেখাটা অবশ্যপাঠ্য।

সামরিক আইনের আওতায় সেই দিনগুলাে

১৯৫৮ র অক্টোবর মাস শুরু হয়েছে। কী ভাবছেন সচেতন পাকিস্তানী নাগরিকরা? খন্দকার আব্দুল খালেকের কথায়—“উপর মহলের কারসাজি মুক্ত, অবাধ সাধারণ নির্বাচনের আশা জেগেছে জনমানসে এই ক্ষণে – এতােদিনে। আশঙ্কাও কি নেই কিছু? হয়তাে আছে। গণতন্ত্রের বিলােপসাধনের সেই ভয়ংকর আশঙ্কা আজ অমূলক মনে হচ্ছে। এই তাে সেদিন বামুলুকে সামরিক আইন জারী হওয়াতে নিন্দা করেছে পাকিস্তান সরকার। সুতরাং আশঙ্কা থেকে আশ্বস্ত স্বস্তি। আশা মরীচিকাই। আশাবাদীদের মর্মাহত করে অলক্ষিত চরণের নিঃশব্দ গােপনীয়তায় এল ৭ই অক্টোবরের সেই বিনা মেঘে বজ্রপাত সম বজ্রনির্ঘোষ ঃ ‘পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী হয়েছে। ৭ই অক্টোবর সামরিক আইন প্রবর্তিত হবার দু’দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট মিজা ঘােষণা করলেন তিনি। নাকি পুরাে এক বছর জুড়ে এই প্রতীতি নিয়ে অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবাস্তব তথা অবান্তর। সামরিক শাসনে প্রকৃত ক্ষমতার দখলদার সেই আয়ুব একই ৯ই অক্টোবর তারিখে এক পদা চড়িয়ে বাগাড়ম্বর করলেন এই দম্ভোক্তি মাধ্যমে – ‘রাজনীতিকদের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দেবার দায়িত্ব তাে সমরবাহিনীর-ই। প্রেসিডেন্ট মিজার ১৫ তারিখের বিবৃতি যেন আরাে নরমপন্থী তাত্ত্বিকের ভাষণ মনে হ’ল যখন তিনি জানালেন এই সামরিক শাসন নিতান্তই এক সাময়িক পদক্ষেপ মাত্র। আয়ুবের স্পর্ধিত ভাষণের পাশে মিজার মধুর কথনে যে গরমিল তার উৎস সন্ধান অতঃপর জরুরী ঠেকবে। (১)

প্রথমেই মির্জা কেন সামরিক আইনের সাফাই গেয়েছেন সে কথায় আসা যাক। এই ব্যক্তি, এক দলের সঙ্গে অপর দলের কিংবা এক নেতার সঙ্গে অপর নেতার তিক্ততা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে আছেন। তিনি নিজে ভালােই জানেন, এর পরিণামে সব দলেই তাঁর শবৃদ্ধিই মাত্র ঘটেছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক নিবাচনী পদ্ধতি গ্রহণ করলে মিজা সাহেব ক্ষমতায় ফিরতে ব্যর্থ হবেন – এ তাে তাঁর নিজের ভালােই জানা ছিল। একটি ঘােষণা মারফত অর্থাৎ সামরিক আইন জারী করে আরাে কিছু কাল উচ্চ রাজশক্তি ভােগ করতেই তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে গেছেন। আতাউর রহমানকে যদিও উনি ভােটপর্বের দাঙ্গাহাঙ্গামার ভয়ের কথা শুনিয়ে সুবিধা করতে পারেন নি অথবা পূর্ববঙ্গের ১৯৫৪ র শান্তিপূর্ণ ভােটের বাস্তবের মুখে তাঁর বক্তব্যকে দাঁড় করাতেও পারেন নি, তথাপি চক্ষুলজ্জাটুকু ত্যাগ করে আতাউর সাহেবকে উনি স্পষ্টই জবাব দেন – হ্যা, ভােটাভুটি এড়াতে গিয়েই এই সামরিক শাসনের বিধি প্রবর্তিত হয়েছে। এ তাে গেল, মিজার প্রসঙ্গ। আয়ুবের কথায় এলে প্রথম থেকেই তার একটা সর্বেসর্বা ভাব ছিল চলনেবলনে। সেই ৯ তারিখের বিবৃতিতেই তাঁর দম্ভোক্তি স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন, “মিজা নিবোধের মতাে আচরণ করলে, যথােচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি তাঁর গুরু দায়িত্ব পালন করবেন। ঐ প্রতিবিপ্লব, আয়ুবেরই কারসাজি – এই মত কুরেশির। (২)।
আয়ুব এবং তার অনুগামীরা এই গণতন্ত্র হত্যাকে এক ‘রক্ত পাতহীন বিপ্লব আখ্যায় ভূষিত করলেও লণ্ডনের ডেলিমেল পত্রিকার সংবাদদাতা, সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে, পাকিস্তানী নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ঐ দেশের সীমানার বাইরে পৌছে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন তা থেকে আয়ুবের দাবি সম্পূর্ণ তথ্য বিকৃতি বই কিছু মনে হবে না। ঐ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সামরিক হােমরা-চোমরাদের মধ্যে যাঁরাই ঐ ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষমতা দখল বা ক-র বিরােধিতা করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয়। সামরিক আইনের অবসানের পরে জাতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদার আতাউল্লা খান, বালুচিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে এই তথ্য পেশ করেন যে, বালুচিস্তানের জনগণ সামরিক আইন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। আয়ুবের সেনাবাহিনী নৃশংস হত্যালীলার মাধ্যমে সে বিক্ষোভ দমন করে। সর্বময় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গিয়ে নিজস্ব সামরিক বিভাগের কর্মাধ্যক্ষদের আপন খেয়াল মতাে অন্যত্র, এমন কি অসামরিক বিভাগেও, স্থানান্তরিত করে আয়ুব স্বার্থান্ধ কুটিলতার এক নির্লজ্জ নিদর্শনও রেখে গেছেন। স্টিফেন বারবার জানিয়েছেন – ‘অন্ততঃ ১৩ জন জেনারেলকে, আয়ুব পদচ্যুত বা অপসারিত করেছেন সেই সময়। শুধু তাই নয়, সমরবিভাগের সদর দপ্তরে আয়ুবকে থাকতেই হবে। রাজধানী-শহর দূরে হলে তাঁর কর্তৃত্ব শিথিল হবে এই ভয়ে, করাচী থেকে রাওয়ালপিণ্ডিতে দেশের রাজধানীটাই সরিয়ে আনলেন এই ক্ষমতা লােলুপ সমরবিশারদ। একনায়কতন্ত্রের পথে আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল পদগৌরবে ভূষিত করলেন আয়ুব খান নিজেকে এর পরেই। (৩)’।
সামরিক শাসকেরা তাদের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানকে জনসমর্থনের মর্যাদায় ভূষিত করার জন্যে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাই বৃহৎ জমিদারদের জমির উর্ধ্ব সীমা বেঁধে দিয়ে, জনসাধারণের পরােক্ষ কিছু উপকারও সামরিক শাসন কালে হয়েছিল। অবশ্য সে-সবই পশ্চিম পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্ব পাকিস্তান কোনাে সুবিধাই সেই সুবাদে পায় নি। উপরন্তু নয়া রাজধানী স্থাপনে স্থাপত্য-কর্মকাণ্ডের আর্থিক লাভ সবটুকুই পেয়ে যায় ঐ পশ্চিম পাকিস্তানীরা। অন্যান্য সামরিক শাসকের মতাে আয়ুব-ও দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসনের বাগাড়ম্বর করতেন। কার্যতঃ তাঁর অনুগতদের দুর্নীতির কোনাে শাস্তির কোনাে প্রশ্নই ছিল না। নৈতিকতার অজুহাতে খড়গ গিয়ে পড়তাে বিরােধী প্রশাসকের গ্রীবাদেশে। নৈতিক যুদ্ধে অবশ্য আয়ুবের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন নানা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। আতাউর রহমান তিক্তকণ্ঠে বলেছিলেন — ‘মাইনে-করা দালাল বাহিনী পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, দোকানে-গঞ্জে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে কুৎসা অভিযান চালিয়ে গেছে। সর্বৈব ভিত্তিহীন সব অভিযােগ এরা করে যেত অবিরত। (৪)।
সামরিক শাসনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিশেষত পশ্চিম পাকিস্থানের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিদের-রাজনৈতিক প্রাধান্য ও অর্থনৈতিক শােষণের পথ অবশ্যই অধিকতর উন্মুক্ত হলাে। এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শােষণে পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবন পর্যদস্ত ছিল। উপরন্তু শামরিক স্বৈরাচার তন্ত্রের তথাকথিত লৌহ মানবদে র আবির্ভাবের ফলে শােষণ ও দমনপীড়নমূলক আইনের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিল। সামরিক শাসনের প্রবর্তনে কাদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী—পুঁজিপতি-বণিকদের না সামরিকঅসামরিক আমলাদের– এ ব্যাপারে বিতর্ক সহজেই উঠতে পারে। এই বিতর্ক বােধহয় সীমাহীন, তবে এর অন্যতম যুক্তিপূর্ণ সমাধান এই যে প্রভাবশালী পুঁজিপতিআমলা এবং দূরদৃষ্টিহীন রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের সােৎসাহ সমর্থন ছাড়া সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা হতাে না। ভবিষ্যতে সেনাপতিদের অনুচর ঐ রাজনীতিকরা অবশ্য কতােদিন নিজেদের অভিনন্দিত করেছিলেন সেটা বলা দুষ্কর।
১৯৬০-৬২ র বৎসর দুটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ইতিহাসে ব্যতিক্রম বিশেষ। খােদ গর্ভণর এবারে পূর্ববঙ্গ দরদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। সরকারী কমোদ্যোগ পূর্বখণ্ডে অতীব সীমিত। সেই সীমার মধ্যেও যথাসাধ্য জনদরদী ভূমিকা পালন করে নূতন গভর্ণর লেঃ জেনারেল আজম খান পূর্ববঙ্গে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেন। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রধান অন্তরায় আমলাতান্ত্রিক ঔদাসীন্য এবং দীর্ঘসূত্রতা, গভর্ণরের নিজস্ব প্রচেষ্টায় দূরীভূত হয়েছিল। ত্ৰাণকার্যে তিনি নিজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চট্টগ্রাম এলাকার ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী ত্রাণকার্যে আজম যেন দিনে আঠারাে ঘন্টা খেটে গেছেন – এই মত প্রকাশ করেছিলেন ইশওয়ার সাগর নামের জনৈক ভারতীয় সাংবাদিক। (৫)।
ফিরে-ফিরেই ঝড়-জল বন্যার প্রকোপে উপকূলবর্তী পূর্ববঙ্গবাসী নিরাপত্তাহীন শঙ্কার মধ্যে থাকতেন। আজম খান এই ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ এলাকার জন্য পাকা বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক বন্যানিরােধ প্রকল্পের খসড়াও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা তখন পূর্ববঙ্গে তুঙ্গে। এই হ’ল তাঁর কাল। ঈর্ষাপরায়ণ আয়ুব তাঁকে পূর্ববঙ্গের গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দিলে ১৯৬২ র ১৮ই জুন কামারুল আহসান এই খেদোক্তি করেন – “যাঁরাই পূর্ববঙ্গবাসীর কল্যাণ করতে আসেন, তাঁদেরই প্রস্থান ঘটে ত্বরিতে। পাকিস্তানের দুই খণ্ডের মধ্যে আর্থিক সাম্যের দাবি জানাতে গিয়ে আজম খান, আয়ুবের বিরাগভাজন হন। অবশ্য পূর্ববঙ্গের কোনাে অধিবাসীকে পূর্ববঙ্গের সরকারের প্রধান সচিব পদে নিযুক্ত করার কৃতিত্ব আজম খানের-ই। আজম খানের বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যাঁরা অশ্রুপাত করেন, আয়ুবপন্থী সংবাদপত্র তাঁদের ভারতের চর এবং পাকিস্তানে অন্তঘাত মুলক কার্যকলাপের তাত্ত্বিক বলে অভিহিত করে। অবশ্য স্টিফেন বারবার বলেছেন, আজমের জনপ্রিয়তায় ভীত আয়ুব-ই তাঁকে ঈর্ষাবশতঃ সরিয়েছেন। (৬)
(গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মতবাদের বিরুদ্ধে শুধু প্রত্যক্ষ দমননীতিই যথেষ্ট নয় যুদ্ধোত্তর দুনিয়ার কোনাে প্রান্তে। আয়ুবরাজেও তাই মেকী গণতন্ত্রের বুলি কপচানাের প্রয়ােজন ছিল। জনগণের গণতান্ত্রিক অভীপ্সা খােলাখুলি অস্বীকার না করে, এক জটিল পরােক্ষ গণতন্ত্রের মস্করার ব্যবস্থা করা হ’ল। এ হ’ল জনতােষণ। যা’ সামরিক একনায়কতন্ত্রের কলঙ্ক আংশিক মােচন করবে এমন আশা আয়ুবচক্রের ছিল।)।

১৯৫৯ এ প্রণীত হ’ল মৌল গণতন্ত্রের নির্দেশনামা। কী এই গণতন্ত্র। শুধু সর্বনিম্ন স্তরে নির্বাচন; অপর চারটি স্তরে পরােক্ষ নির্বাচন। প্রতি স্তরের প্রতিনিধি পরবর্তী উচ্চতর পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিবাচিত করবেন। লােভ জাগিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে মৌল বা সবনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিদের সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত করা অবশ্যই হ’ত। প্রতি স্তরের তথাকথিত নির্বাচনে আনুগত্যের পুরষ্কার এবং বিরােধিতার শাস্তির ঢালাও বন্দোবস্ত করা থাকতাে। এই কি গণতন্ত্র ? আসলে ব্রিটিশ আমলে বাংলা, বােম্বাই, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে চালু সতেরােটি আইনের জগাখিচুড়ি বিশেষ এই মৌল গণতন্ত্রের আদেশনামা, পূর্বতন আইনের চেয়েও অনেকাংশে অগণতান্ত্রিক ছিল। জেলাপরিষদের অধ্যক্ষপদে সরকারী আমলার নিয়ােগ আবশ্যিক করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারিত করার অধিকার ঐ আমলাদের উপর আরােপ করা – এই সব স্বৈরাচারী বিধি ১৯২০-র ব্রিটিশ ভারতের সংশ্লিষ্ট আইনে ছিল না। (অর্থাৎ, মৌল গণতন্ত্র ছিল এক মৌলিক প্রতারণামাত্র।) (৭)।
১৯৫৯ গােড়ার দিকে আয়ুব প্রবর্তিত সামরিক শাসনের পিছনে জনসমর্থন আবিষ্কার করেছিলেন কে, জে, নিউম্যান। তথাকথিত জনসমর্থন জাহির করার জন্য আয়ুব, ১৯৬০এর ফেব্রুয়ারী, আশি হাজার মৌল গণতন্ত্রী অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউনসিলর নির্বাচিত করালেন। তাঁরা আয়ুবে আস্থা জ্ঞাপনও করলেন। পিওডিও আইন তাে ছিলই। যা দিয়ে বেয়াড়া অফিসারকে দূর করা যেত। আরাে যে ছিল সেই ই বি ডি ও, যার জোরে বিরূপ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারিত করা যেত। এই আইনের ভয়ে একবাক্যে আয়ুব সমর্থক বনে গেলেন ঐ তথাকথিত মৌল গণতন্ত্রীরা। নির্বাচনটাও ছিল প্রহসন। আমলাদের তদারকিতে আয়ুবপন্থীদের জয় সুনিশ্চিত করাই ছিল। (৮)
গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ আরাে একটু জাহির করার ছক কষলেন আয়ুব খান ১৯৬০-এর
ফেব্রুয়ারী নাগাদ। এবারে তিনি এগিয়ে এলেন জাতিকে এক সংবিধান উপহার দিতে। ১৯৬০-এর ফেব্রুয়ারীতে গঠিত সংবিধান আয়ােগ বা কনস্টিটিউশন কমিশন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে জনমতের নমুনা সংগ্রহের ভান করে। প্রশ্নোত্তরিকা মাফিক জবাব লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রশ্নের গন্ডীতে উত্তর বাঁধা থাকতে বাধ্য। স্বভাবতঃই আয়ুবচক্র বিব্রত হতে পারে এসব প্রসঙ্গ ঐ লিখিত প্রশ্নমালায় স্থান পায় নি। উপরন্তু, এর উপক্রমণিকায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা দূর করতে সামরিক শাসন এসেছে—এই ফরমান জারী করা ছিল। আতাউর এই উপক্রমণিকাকেই অস্বীকার করে উক্ত আয়ােগের সম্মুখে বলেন—“সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ফল নয়, গণতন্ত্রের সম্ভাবনার সমাধি। নিকট ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিষেধক মাত্র। … ১৯৫৯ এর জন্য নির্দিষ্ট সাধারণ নির্বাচন বাতিল করে গণতন্ত্রের মূলে আঘাত হানা হয়েছে। সামরিক শাসনের প্রণেতা এবং পৃষ্ঠপােষক কেউ-ই আর আত্মসন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না এই পর্যায়ে। কেননা, সংবাদপত্রে জনগণের স্পষ্ট উক্তি-প্রত্যুক্তি প্রকাশ করা হচ্ছিল এই সময়। আয়ােগের সফর পর্বে এ এক উপসর্গ হয়ে এল শাসকগােষ্ঠীর সামনে। উপসর্গের অপনােদন অচিরাৎ করা হ’ল। সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হ’ল আয়ােগের সমীপে। বুদ্ধিজীবীরা এককাট্টা হয়ে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের দাবি জানাতে থাকেন এই সময়। পশ্চিম, পূর্ব উভয় ভূখন্ডেই একই দাবি উঠছে দেখে, তড়িঘড়ি সংবাদপত্রে বিরােধীদের বক্তব্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দিলেন আয়ুব খান। আশ্চর্য কান্ড ঘটলাে এসবের পরেও। সংবিধান আয়ােগের কর্তাব্যক্তিদের আয়ুবপন্থীই মনে করতে হবে। কারণ আয়ুব-ই তাঁদের নিয়ােগকর্তা। তথাপি তাঁদের প্রতিবেদনে সংসদীয় প্রথার পক্ষে সুপারিশ করা হল। ১৯৬১-তে এই অপ্রত্যাশিত সুপারিশ পেশ করা হলে আয়ুব তাে জ্বলে উঠলেন। রিচার্ড ভি উইকসের কথায়, “পর্দার অন্তরালে নানা কারসাজি করে, ঐ সুপারিশের বিপরীতধর্মী এক সংবিধান পেশ করলেন আয়ুব খান। তারিখটা ছিল ১লা মার্চ, ১৯৬২। কুরেশির ‘দি ডেভলপমেন্ট অব পাকিস্তান প্রবন্ধে এই গুরুত্বপূর্ণ অনিয়মের প্রসঙ্গটির উল্লেখ পর্যন্ত করা হয় নি। কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটেছে এটির প্রকাশকালে—এই তাঁর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে। (৯)
সংবিধান প্রকাশ করতে বিলম্ব হবার কারণ, আদ্যন্ত একে এমন ভাবে রচনা করা। হয়েছিল যাতে আয়ুবের হাতেই প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব বর্তায়। আমলা-নিয়ন্ত্রিত মৌল গণতন্ত্রী, সর্বশক্তিমান প্রেসিডেন্ট (অথাৎ আয়ুবের) বশংবদ নিবীর্য ব্যবস্থাপক সভার। সভাসদ তথা স্ব-নির্বাচিত মন্ত্রিপরিষৎ—এ সবই সেই গণতন্ত্রের মােড়কে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার কৌশল। বেগম রােকেয়া আনােয়ার তাে বলেই ফেলেন—“মন্ত্রিপরিষৎ ব্যবস্থাপক সভার কাছে দায়বদ্ধ নয়, দায়বদ্ধ প্রেসিডেন্টের কাছে। কারণ এর সদস্যরা তাঁরই বেতনভুক কর্মচারী। পি ও ডি ও এবং ই বি ডি ও-র খড়া মাথার উপর ঝুলতে দেখেও পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিরা সামরিক শাসনের প্রকৃত চরিত্র উদঘাটিত করতে ইতস্ততঃ করেন নি কোনক্রমেই। এ তাঁদের সঙ্কল্পের দৃঢ়তাই প্রমাণ করে। ব্যবস্থাপক সভার বাজেট নির্ধারণে কোনাে ভূমিকা স্বীকৃত ছিল না। নতুন কোনাে ব্যয়ের দাবিতে প্রস্তাব দেওয়ার অধিকারটুকুই ছিল শুধু। মাহাবুবুল হক এই ব্যবস্থাকে আত্মমর্যাদাহীন মনে করেছেন। সমস্ত ব্যবস্থাকে কামারুল আহসান বলেছেন—“নিয়ন্ত্রণাধীন গণতন্ত্র। ইঙ্গিত স্পষ্ট। আত্মমর্যাদায় আঘাত করে যে-নিয়ন্ত্রণ, তার মধ্যে গণতন্ত্রের মুক্ত বাতাস বইতে পারে না। (১০)। |
(স্বৈরাচারী শাসনের অনিবার্য একটি উপসর্গ হ’ল আঞ্চলিক বৈষম্যসৃষ্টি। কেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদের প্রয়ােজনেই একটি অঞ্চলকে কাঁচামাল যােগানের কাজে বেঁধে রেখে অন্য শিল্পোন্নত অঞ্চলে প্রস্তুত পণ্যের লাভের বাজার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বিকাশও এই অনুন্নত অঞ্চলে বিশেষ ভাবে ব্যাহত হয় ঐ স্বৈরাচারী শাসনের কল্যাণে।)।
পূর্ববঙ্গের স্কুলে উর্দু আবশ্যিক করা হ’ল আয়ুবের আমলে। পশ্চিম পাকিস্তানে কিন্তু বাঙলা স্বীকৃতি পেল না। ঢাকা বিমান বন্দরের ঘােষক বাঙলা নয় উর্দু এবং ইংরেজি ব্যবহার করতেন। যানবাহনে, পথে-ঘাটে সর্বত্র বাঙলা ভাষা বর্জন করে ঐ দুই ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকলাে। পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের বিভাগীয় পদোন্নতিকল্পে উর্দুতে পাশ করতে হত। বাঙলা এক্ষেত্রেও ছিল অপাঙক্তেয়। জাতীয় ব্যবস্থাপক সভার শৌচাগারেও উর্দুলিপি। পুরুষ সদস্যদের কেউ ভুল করে মহিলাদের শৌচাগারে ঢুকে পড়তে পারেন—এমন তিক্ত রসিকতাও করেছিলেন মেজর মহম্মদ আসরাফউদ্দিন সাহেব। সর্বতােভাবে প্রয়াস চালানাে হয়েছে এই ধারণা ছড়াতে যে, বাঙলা মুলুকের সংস্কৃতি, পশ্চিমখন্ডের তুলনায় নিম্নস্তরের। (১১)
আয়ুবের আমলের মেকী গণতন্ত্রের সমালােচনা করলে সাংবাদিককে নিগৃহীত হ’তে হতাে। মুনির সাহেবের মতাে বিচারক এই নিগ্রহের সমর্থনে সাফাই গাইতেও লজ্জা পেতেন না। (১২) তদানীনন্তন পুনবাসন মন্ত্রী লেঃ জেঃ আজম খানকে প্রশ্ন করতে গিয়ে আয়ুবশাসনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত করার কারণে একজন সাংবাদিকের কারাদন্ড হয় সাত বছরের জন্য। এই বিচারের বিরুদ্ধে ঐ সাংবাদিক পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টে আপীল করলে তা না-মঞ্জুর করে বলা হয়—“সামরিক শাসনের আইনকে প্রশ্ন করাই চলে না। (১৩)
স্বাধীনচেতা অর্থাৎ আয়ুবের বশংবদ নন এমন মেধাবী সাংবাদিক নিজ গুণে বিদেশ সফরের ডাক পেলেও বিমান বন্দরে তাঁকে প্রতিহত করা হত। চল্লিশ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন প্রতিমাসে পেত পূর্ববঙ্গের ইত্তেফাক, সংবাদ এবং পাকিস্তান অবসাভার পত্রিকাগােষ্ঠী। এই দৈনিকগুলাে সরকারী বিজ্ঞাপন লাভে বঞ্চিত হ’ল। কারণ তাদের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী স্বৈরাচারীচক্রের অপছন্দ। জনগণের স্বার্থে এবং দেশের দুইখন্ডের সাম্যপ্রতিষ্ঠার পক্ষে লেখার জন্যই তাদের এই শাস্তি। (১৪)
আঞ্চলিক অসাম্য দূর করার ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের কর্তাদের কোনাে সদিচ্ছা ছিল না। কেন্দ্রে অবশ্য কয়েকজন মন্ত্রী পূর্ববঙ্গ থেকে নেওয়া হয়। কিন্তু তার তাৎপর্য জনজীবনে ছিল শূন্য। উনিশজন সচিব পূর্ববঙ্গের সরকারে ছিলেন সে সময়। তাঁদের একজনও পূর্ববঙ্গের অধিবাসী নন। ৭৬৩ জন সেকশন অফিসারের মধ্যে মাত্র ৮৮ জন ছিলেন স্থানীয় অথাৎ পূর্ববঙ্গবাসী। অর্থমন্ত্রকের ৩৩৭ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৩৭ জন ছিলেন পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। একই চিত্র অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তাই তাে মাহাবুবুল হক বলেছিলেন—‘সরকারী নিয়ােগে একটু সমতার চিহ্ন থাকলেও পূর্ববঙ্গবাসীর অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের লাঘব হ’ত। (১৫)
মাত্র কুড়ি কোটি টাকা ব্যয়ে সেচের কিছু উন্নতি ঘটালে পূর্বপাকিস্তানের কৃষিব্যবস্থার যথেষ্ট উপকার হ’ত—এই কথা বলেছিলেন মাহাবুবুল হক। (১৬) ব্যবস্থা অবশ্য হয় নি। মার্কিন মুলুক থেকে প্রাপ্ত পণ্যসহায়তার ৩৪ শতাংশ জুটতাে পূর্বপাকিস্তানের বরাতে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এই হার ছিল আরাে নগণ্য—মাত্র ৪ শতাংশ। (১৭)
পূর্ববঙ্গের কৃষি এবং কৃষকের গভীর সমস্যার কথা প্রকাশ পায় ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারুকের গবেষণায়। অধ্যাপক হবিবুল্লার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে নােয়াখালি অঞ্চলে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যান ১৯৬১-র জুলাই থেকে ১৯৬২র জুন ঐ গবেষক এবং তাঁর সহযােগীরা। জানা যায়, পরিবার পিছু মাত্র ১.১ একর চাষের জমি আছে। তাও বহুধা বিভক্ত অবস্থায়। মাত্র দশ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব লাঙল ছিল। পরিবার পিছু গরু বা বলদের সংখ্যা একের চেয়েও বেশ কম। কাজের উপযুক্ত দিনগুলাের ৬৯ শতাংশ ব্যবহারযােগ্য ছিল তাঁদের কাছে। বৃষ্টি, উৎসব ইত্যাদি আরাে ৬ শতাংশ কর্মদিনের হিসাব দিত। তা হলে এক চতুর্থাংশ কর্মদিন ছিল অব্যবহৃত। ব্যবহৃত ৬৯ শতাংশ শ্রমদিবসের মধ্যে কৃষিকার্যে ব্যবহৃত ছিল ৪২ শতাংশ, ৭ শতাংশ ছিল বাগিচার কাজে আর ২০ শতাংশই ছিল খেতখামার বহির্ভূত ক্ষেত্রে। সাবিলপুরের এই তথ্য, গ্রামীণ কর্মহীনতার যে-চিত্র তুলে ধরেছিল, তার সংবাদ পাকিস্তান অবসাভারে প্রকাশিত হয়। ঐ দৈনিকে আশা প্রকাশ করা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সমীক্ষা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। (১৮)
পাকিস্তানের অর্থকরী ফসলের মধ্যে শীর্ষে অবস্থিত পাটের উৎপাদন বন্টন-বিক্রয় ইত্যাদির ভারপ্রাপ্ত পাটবাের্ড ১৯৪৯-এ স্থাপিত হলেও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন মহম্মদ সিরাজুল ইসলাম। (১৯) যখন সামরিক শাসন চলছিল, এই বাের্ডের ফলে কিছু সুবিধা পাটব্যবসায়ীরা পেয়েছিল—পাটচাষী পায় নি। অক্টোবর ১২, ১৯৬১ তারিখের মহম্মদ ওসমান হাসানের বিবৃতি থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে পাঁচমণী বস্তার পাটের দাম মাত্র ৬০ টাকা ছিল যখন স্টার্লিং এলাকায় তার দাম ছিল ২৭৫ টাকা।
৬৫
সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়া হয় নি বলে, মধ্যস্তরের ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পূর্বপাকিস্তানের চাষী ১২ বা ১৪ টাকায় এক মণ পাট বেচতে বাধ্য হতেন। ভারতীয় ক্রেতারাও ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মণে পাট কিনতে প্রস্তুত ছিলেন সে সময়। সীমান্তরক্ষীর গুলি অর্থাৎ প্রাণের ভয় তুচ্ছ করেও পূর্বপাকিস্তানী চাষী প্রাণের দায়ে ভারতে পাট বেচতেন। সামরিক শাসনের সামনে এই ‘অবৈধ’ চালান বন্ধ করা ছিল এক চ্যালেঞ্জ বিশেষ। প্রাণ হরণ না করে বা পীড়ন না করে এটা করা সম্ভব ছিল না। (২০)। | এসম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ, এফ, এ, হাসানের নেতৃত্বে সমীক্ষা চালিয়ে যে তথ্য পেশ করা হয় তা থেকে জানা যায় নানা ক্ষুদ্র মধ্যস্বত্বভােগীরাই চাষীর পাটের ক্রেতা। কিন্তু চড়া সুদ, ঋণ সংগ্রহের অসুবিধা, মন্থর যানবাহন এবং অন্যান্য কারণে তারাও ন্যায্য মূল্য চাষীকে দিতে পারে না। সরকারী গাফিলতি তাে আছেই। বাজারে পাট পৌঁছে দেবার প্রকৃত অর্থে সাধ্যই যেন নেই পাট চাষীর। তাকে যানবাহনের অভাবে ভুগতে হচ্ছে ক্রমশ আরাে বেশি। (২১)।
পূর্ব পাকিস্তানীর অর্থনৈতিক প্রয়ােজন এবং দাবিদাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন এই আয়ুব সরকারের আমলেই পশ্চিমপাকিস্তানী বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী ডঃ মাহাবুব উল হক, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে (২২) জানান, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে এমন এক বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে যে, ১৯৫১র পরের মাত্র আট বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে পূর্বপাকিস্তানীর চেয়ে ১৮র স্থলে ২৯ শতাংশ এগিয়ে গেছেন। ১৯৪৯-৫৩র মধ্যে গড়পড়তা মূল্যের হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান খাদ্য গমের দাম ছিল পূর্বখন্ডের প্রধানখাদ্য চালের দামের প্রায় অর্ধেক মাত্র। (২৩)
শুধু চাল-গমের দরে বৈষম্য নয়, সকল ভােগ্য পণ্যের ব্যবহারেই পূর্ব পাকিস্তানী অথভাবে অনেক পিছিয়ে ছিলেন তাঁর ভাগ্যবান পশ্চিমী সহনাগরিকের তুলনায়। মাথা পিছু ব্যবহারের হিসাবে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ২০ গুণ, মােটর গাড়ির ক্ষেত্রে ১০ গুণ, চার বেলায় ৮ গুণ, চিনি এবং বস্ত্রের ক্ষেত্রে ৩ গুণ করে বেশি ভােগ করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানী তাঁর পূর্বের সহনাগরিকের তুলনায়। শুধু মাথা পিছু আয়ের অঙ্কের মধ্যে পূর্বপশ্চিম খন্ডের বৈষম্যের ছবি ধরা পড়বে না—মাহাবুব উল হকের-ও এই অভিমত। তাঁরই পেশ করা উপরের তথ্যাদিও একই কথা বলবে। এই বৈষম্য দু’খন্ডের শহরবাসীদের ক্ষেত্রেই প্রকট। আর শহুরে মানুষ তাে মুখবুজে স’য়ে যাবার পাত্র নন। (২৪)।
পুরানাে দিনের কথা না তুলেও, ১৯৫৯-৬০এর হিসাবেই দেখা যাবে পূর্ব পাকিস্তান তার মােট আমদানির ৪৭.৬ শতাংশই করেছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অন্যোন্যক সংখ্যাটি মাত্র ১৭.৭। অর্থাৎ বাণিজ্যের মাধ্যমে পূর্বের সম্পদ পশ্চিমে গিয়ে শিল্পব্যবসায় ইত্যাদির পুঁজি সংগ্রহের সুরাহা করেছে ঐ খন্ডে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশের ভােক্তাও ঐ পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৮-৫৩ তে পশ্চিম পাকিস্তানের মােট রপ্তানির ২১.৮ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৫৫-৬০ এর আমলে এই মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭.৯ শতাংশে। পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মধ্যে আন্তর্বাণিজ্যের এই সব তথ্য সহযােগে ডঃ নুরুল ইসলাম এই মত প্রকাশ করেছিলেন, পূর্বপাকিস্তানই আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারে পরিণত হয়েছে। বিপরীতক্রমে বক্তব্য সত্য হবে না। জন. এইচ, পাওয়ারের সমীক্ষা অনুসারে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত গড়ে বৎসরে ১৮ কোটি টাকা করে অর্থাৎ মােট ২৫০ কোটি টাকা পূর্বপাকিস্তান থেকে পাচার হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। অসম বাণিজ্যই এই বিপুল অর্থপাচারের কারণ। পরিকল্পনা-কালের হিসাবটুকু ধরলেই দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান মাত্র ৫ শতাংশ সঞ্চয়ের জোরে ১২ শতাংশ বিনিয়ােগ করেছে। পূর্বের সঞ্চয় পরিকল্পনা-কালেও পূর্বের মতাে ৭ শতাংশই ছিল। তবু তার বিনিয়ােগে সূচক সংখ্যা পশ্চিমখন্ডের ১২ শতাংশের অর্ধেক মাত্র—অথাৎ ৬ শতাংশ। অসম শর্তের বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ যতােই জমুক পূর্ব থেকে পশ্চিমে, পূর্বাংশের শ্রমজীবীদের পশ্চিমে নিযুক্ত আদৌ করা হয় নি। এ সবেরই কুফল হিসাবে ক্রমবর্ধমান বেকারি পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে জুটেছে। (২৫)
আয়ুব-ও তাঁর ১৯৬১-র ১৮ অক্টোবর তারিখে ঢাকা শহরে প্রদত্ত ভাষণে পূর্বপাকিস্তানের অনগ্রসরতা দূরীকরণের সদিচ্ছা প্রকাশ করেন। মতের অমিল হওয়ায় দেশের দু’খন্ডের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য দু’ খন্ডের আয়ােগ-সদস্যরা দু’রকম প্রতিবেদন পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানী আয়ােগ সদস্যরা দ্বিতীয় পাঁচ সালা পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতে হবে—এই দাবি তােলেন যাতে পূর্ববঙ্গের সমস্যার কিছু সুরাহা হয়। যাই হােক, অর্থমন্ত্রী সােইব, ১৯৬২-র ২৮শে জানুয়ারী ঘােষণা করেন, নূতন রােয়েদাদ অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তান ২ কোটি টাকা এবং পূর্ব পাকিস্তান ১১ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব হিসাবে লাভ করবে। অধ্যাপক জি, ডব্লিউ, চৌধুরী এই প্রসঙ্গে যা বলেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, উন্নয়নখাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্ক এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তির প্রশ্নে এমন কিছু করা আরাে বেশি প্রয়ােজনীয় যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। অন্যথা পূর্ব-পশ্চিম খন্ড দুটোর আর্থ বৈষম্য দূর হবে না। (২৬)
পূর্বপাকিস্তানের সরকারের রাজস্ব, বৈদেশিক সাহায্য-কোনাে বিষয়েই কেন্দ্রনিরপেক্ষ উদ্যোগ গ্রহণের আইনগত অধিকার ছিল না। তা ছাড়া পশ্চিমাঞ্চলাগত আমলাদের চক্রান্ত, কেন্দ্রীয় আমলাদের নানা কারসাজি, পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্প গুলির কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতাে। কোন পরিকল্পনা পেশ করতে হলে কেন্দ্রীয় আমলাদের চাপে ৭৫ কপি একযােগে পেশ করতে হত। পূর্ব পাকিস্তান সরকার উন্নয়ন প্রকল্প পেশ করলে কেন্দ্র কী করতাে ? কালক্ষেপ করতাে এবং শেষটায় প্রত্যাখ্যান করতাে।(২৭)
সামরিক শাসনের প্রবক্তারা দেশের পূর্ব-পশ্চিম খন্ড দুটোর আর্থিক অসাম্যের জন্য রাজনীতিকদের দায়ী করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত গাণনিক এস, জামান কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সােইবকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান প্রকাশ পেলে দেখাই যাবে সামরিক শাসনের আওতায় উক্ত বৈষম্য আরাে বৃদ্ধি পেয়েছে। (২৮)

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কাগজেকলমে যে চিনি, ডি, ডি, টি, ইস্পাত এবং স্ট্রেপটোমাইসিন কারখানা পূর্বপাকিস্তানে স্থাপিত হবার কথা ছিল, আমলাতান্ত্রিকতা এবং অর্থের যােগানে কেন্দ্রের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী বশতঃ তার কোনটিই কার্যকর হয় নি। প্রথম পরিকল্পনার শেষভাগে সামরিক শাসন আসে। অথচ প্রথম কেন দ্বিতীয় পরিকল্পনাতেও সামরিক আইনের কর্তারা পূর্ববঙ্গে উপযুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠার কথা তুললেন না একটি বারও। পূর্ব পাকিস্তানে টেলিফোন পরিষেবাও পশ্চিম পাকিস্তানের সরবরাহ করা অব্যবহার্য টেলিফোন সেট এবং যন্ত্রাংশর কারণে রীতিমতাে বিঘ্নিত হ’ত —এই মর্মে জামান সাহেব সংসদে তথ্যাদি পেশ করেন। জামান সাহেব আরাে জানান-‘খাদ্য, ওষুধ সবই নিম্নমানের। এমন কি ভেজাল পর্যন্ত বেমালুম চাপানাে হয় পশ্চিম থেকে পূর্বখণ্ডে। পূর্বপাকিস্তান যেন ওদের অবাধ লুণ্ঠনের বাজার বিশেষ। সরষের তেল ? তাতেও ভেজাল। (২৯)।
সামরিক শাসন নাকি কঠোর শৃঙ্খলার শাসন। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যশস্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গঙ্গা-কপােতাক্ষ পরিকল্পনার রূপায়ণে চিরাচরিত টালবাহানা এবং অনিয়মের এতটুকু তারতম্য লক্ষ্য করা যায় নি। ১৯৫৪-তে যে-পরিকল্পনা শেষ হবার কথা, ১৯৬১-৬২র মাথায় এসে দেখা গেল, ১৯.৭৮ কোটি টাকার প্রাককলন মানের পরিকল্পনায় ঐ সময় পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক বৃহত্তর পরিকল্পনাও যে অনেক ক্ষিপ্রতা সহকারে রূপায়িত হয়ে থাকে—এই প্রসঙ্গে কামারুল আহসান তার উল্লেখ করেন। এন, এ, পি-তে বিতর্কচ্ছলে তিনি প্রশ্ন তােলেন—“পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এতাে ভুলভ্রান্তি ঔদাসীন্য-এ সবের অর্থ কী ?’ (৩০)
বাণিজ্যমন্ত্রকের পক্ষে সংসদীয় সচিব এক প্রশ্নের উত্তরে যা বলেন, তা থেকে পূর্ববঙ্গের ন্যায্য পাওনা অবহেলিত হবার কোনাে কারণ পাওয়া যায় না। অবশ্য সামরিক শাসনে পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপতা পূর্ববৎ প্রকট ছিল। শুধু ১৯৬১-৬২র হিসাব টুকুই ঐ সচিবের বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করলে দেখা যাবে রপ্তানির সিংহভাগ পূর্বখন্ডের গুণে হওয়া সত্ত্বেও বাড়তি সুযােগসুবিধা সবই পশ্চিমখন্ডকে দিয়ে যাওয়া নিতান্ত অসঙ্গত আচরণ হিসাবে চিহ্নিত হবে। ঐ বৎসরকালে পশ্চিম পাকিস্তান রপ্তানি করে ৫৪.২৮ কোটি টাকার পণ্য। আর পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ১৩০.০৬ কোটি টাকা—অথাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় আড়াই গুণ। তথাপি পূর্ববঙ্গের প্রতি অবহেলার কোনাে তারতম্য সামরিক আইনের আমলেও করা হয় নি। (৩১)।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ র বৎসর গুলিতে পাকিস্তানে গড়পড়তা ৯টি বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বৎসরে এসেছে। এদের মধ্যে গড়পড়তা ২.৭৫ টিকে বৎসর-প্রতি পূর্ববঙ্গে আসতে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশের চেয়েও কম সুযােগ দেওয়া হয়েছে। (৩২) রাওয়ালপিন্ডির কাছে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের নূতন রাজধানী স্থাপন এবং পুরানাে রাজধানী করাচী বন্দরকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকারে প্রত্যর্পণ করায় পূর্বপাকিস্তানীরা ক্ষুব্ধ হন। এই সব জাতীয় গুরুত্ববিশিষ্ট প্রশ্ন পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে আলােচনা পর্যন্ত করা হয় নি। যদিও করাচী বন্দরের রাজধানী-সুলভ রূপান্তরের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার যােগান ঐ পূর্ব পাকিস্তান-ই দিয়েছিল। (৩৩)
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের তথ্যাদি পেশ করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এন, এ, পি সদস্যরা। সামরিক আইন রদ হওয়ামাত্র ১৯৬২-র ২০শে জুন সয়িদ আবদুস সুলতান বিতর্ককালে সংসদে পেশ করেন এই চাঞ্চল্যকর তথ্য যে, বিগত ১৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পাদিতে মােট ব্যায় হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৯৯৮ কোটি টাকা। তদুপরি শিল্পঋণ, গৃহনির্মাণকল্পেঋণ ইত্যাদি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের থেকে মােট লব্ধ অর্থের মাত্র এক চতুথাংশ বা তারও কম জনবহুল পূর্বপকিস্তানের ভাগ্যে জুটেছে। বৈদেশিক ঋণ ইত্যাদির মাত্র ১৬ শতাংশ পেয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। যে-সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ১১২৫ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেও মাত্র ৫৪০ টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করার অধিকার পেয়েছিল, সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান মাত্র ৮১৫ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সত্ত্বেও ১৪০০ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে সুযােগ পেয়েছিল। অর্থাৎ যােগ্যতার বিপরীত অনুপাতে অধিকার—এই ছিল সরকারী বন্টননীতি। একটা অজুহাত দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা পূর্ববঙ্গের শিল্পবিকাশে বাধা দেন। তাঁরা বলে বেড়ান, পূর্ববঙ্গে নাকি শিল্প প্রসারের জন্য প্রয়ােজনীয় সম্পদ নেই। মাহাবুবউল হকের মতে, অবশ্য, চট এবং বয়ন শিল্প ছাড়া প্রায় অন্য সকল ক্ষেত্রে আমদানি করা কাঁচামাল ইত্যাদির উপর এ কালে শিল্পবিকাশ নির্ভর করে। কাজেই কাঁচামালের চেয়েও কারিগরি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রশ্নই প্রধান। আর এ সবের ভালাে-মন্দ তাে শিক্ষানবীশীর সুযােগই না দিয়ে নির্ধারণ করা চলে না। জাতিপুঞ্জের সহায়তায় যে-শিক্ষানবীশী, সেখানে পর্যন্ত পূর্বপকিস্তান থেকে মাত্র ১০০ জন এবং এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৭৩২ জনকে সুযােগ দেওয়া হয়েছিল। কলম্বাে প্রকল্পে ১৪৩১ জন পশ্চিম পাকিস্তানীর স্থলে মাত্র। ১৫০ জন পূর্ব পাকিস্তানীকে বেছে নেওয়া হয়েছিল শিক্ষানবীশ হিসাবে। উন্নয়ন বহিভূর্ত খাতে যে-কালে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছিল তিন হাজার কোটি টাকা, সেই। সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছিল মাত্র পাঁচ শত কোটিটাকা। (৩৪)
কেন্দ্রীয় বাজেটের সিংহভাগ প্রতিরক্ষা খাতেই ব্যয় করা হ’ত। তদুপরি মার্কিনসাহায্যও ছিল রীতিমতাে। কিন্তু প্রতিরক্ষার এই বিপুল ব্যয়ের কোনাে সুফল পুর্ব পাকিস্তান পেত না। সামরিক দপ্তর অথবা সামরিক উৎপাদনের কারখানার কোনটিই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল না। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী লেখক আসলাম সিদ্দিকি পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পূর্ব পাকিস্তানে বহিঃশত্রু যে কোনাে দিক থেকে আক্রমণ শানাতে পারে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্ব-নির্ভর আত্মরক্ষার প্রশ্নটিকে বরাবর উপেক্ষা করে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের সমরকুশলতা নেই—এই অজুহাত কেন্দ্রীয় কর্তাব্যক্তিরা দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা কর্মকান্ডের মানচিত্রে স্থানই দিতে চান না। এই কুৎসার জবাবে সয়িদ আবদুস সুলতান বলেছিলেন ঈশা খাঁর সামরিক প্রতিভার কথা। মােগল সম্রাট আকবরের সেনাধ্যক্ষও যে-ঈশা খাঁর কাছে পরাভূত হন, তিনি তাে পূর্ববঙ্গের-ই মানুষ ছিলেন। (৩৫)
পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে সামরিক বিভাগের মােট ব্যায়ের ৫ শতাংশ মাত্র বরাদ্দ। না আছে একটার বেশি ক্যাডেট কলেজ, না আছে যােগ্যতা অনুসারে পদোন্নতির সুযােগ। সামরিক বিভাগে পদোন্নতির যােগ্যতা দেখালে তাঁকে অসামরিক বিভাগে সরিয়ে দেওয়াও হত। আফসারউদ্দিন এ সমস্ত কারণেই খেদোক্তি করেন—“পূর্ব পাকিস্তানীরা যেন সমরবাহিনীতে কোনাে নিয়ামক ভূমিকা পালনের সুযােগ না পায়, কেন্দ্রীয় সরকার তাই যেন দেখছেন—এ সন্দেহ থেকেই যায়। (৩৬) ১৯৪৮ এবং ১৯৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত দুটি ব্যাটেলিয়নের পরে পূর্বপাকিস্তানী কোনাে ব্যাটেলিয়নের সৃষ্টি করা হয় নি। পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের যােগ্যতাকে একজন বৈদেশিক সমরনায়ক পাকিস্তানের পক্ষে দৃষ্টান্তমূলক-—এই প্রশক্তি করেন। তথাপি পূর্ব পাকিস্তানীদের বঞ্চনা চলতেই থাকে। ১৯৬১র ২৩ শে মার্চ আয়ুব অবশ্য মৌখিক আশ্বাস একটা দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের আরাে দুটি ব্যাটেলিয়ন চালু করা হবে। (৩৭)
সংখ্যালঘুদের উপরে পীড়নের মাত্রা, সামরিক শাসনে আদৌ কমে নি, বরং বেড়েছে। ইসলামিক সংবিধানের সুবাদে অসামাজিক শক্তিরা উস্কানি পেয়ে যায়। মিসেস জিনকিন, ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন তাতেই লিখেছিলেন, ‘হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য হন পাকিস্তান রাষ্ট্রে।’ ১৯৫৬-র সংবিধান চালু হবার পরে করা এই মন্তব্য, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাে বটেই বিচারকের নজরেও সত্য এবং সঙ্গত বিবেচিত হ’ত। অপহৃতা হিন্দু তরুণী মামলা করলে মামলা চলাকালে তাকে বাস করতে হ’ত হরণকারীর হেফাজতে। হিন্দুদের তাড়িয়ে সাংবিধানিক নিরিখেও পূর্বপাকিস্তানকে হীন প্রতিপন্ন করতে যে সাম্প্রদায়িকতার চক্রান্ত পশ্চিম পাকিস্তানীরা করতেন সে কথা মিসেস জিনকিন জানিয়ে গেছেন। আতলান্তিক পত্রিকায় ১৯৫৭-র সেপ্টেম্বরে যে মাসে দশ হাজার হিন্দু বিতাড়নের সংবাদ ছিল, তার-ও মূলে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যা হ্রাস পাইয়ে তার সংখ্যাগত প্রাধান্য দূর করা। (৩৮)
৭০
সামরিক শাসনে নানা প্রতারণাময় প্রতিশ্রুতির মধ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার উল্লেখ-ও ছিল। আয়ুব নিজে এবং তাঁর পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনজুর কাদির এই মর্মে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। (৩৯) কার্যক্ষেত্রে বিপরীত লক্ষণই প্রকট হল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হয়, অথবা ফরিদপুর এবং তারপরে রাজশাহীতে ১৯৬১ এবং ১৯৬২ সালে নিম্নবর্গের সংখ্যালঘুদের গৃহে অগ্নি সংযােগ করা হয়। হত্যাও করা হয় শুধু ফরিদপুরের গােপালগঞ্জ দাঙ্গায় তিন হাজার নিরপরাধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। ভারতের সহকারী হাই কমিশনারের চাপে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামানাে হয় এবং তার পরে ঐ জিঘাংসা বন্ধ হয়। হিন্দু সম্পত্তি এবং হিন্দু নারী এই দাঙ্গাকালে লুঠেরাদের সম্পত্তি বিশেষ হয়ে ওঠে।(৪০)
মনােরঞ্জন ধরের মতাে হিন্দু নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে তাঁর নিজস্ব বাসস্থান-শহর মৈমনসিংহের পথে-পথে পরিক্রমা করিয়ে সমারিক শাসনের কর্তারা হিন্দুদের আরাে সন্ত্রস্ত করে তােলেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানীদের বিদ্রোহী কণ্ঠও সংসদকক্ষে আর শােনা যেত না।(৪১)
মুসলিম নেতাদের মধ্যে যাঁরা আয়ুবের স্তবক ছিলেন না, তাঁদেরও প্রকৃত এবং নিরপেক্ষ বিচারের ব্যবস্থা না করে খেয়াল অনুসারে জেলে পুরে দেওয়া হত। পূর্ব পকিস্তানের মুসলমানদের বিপুল সমর্থন না পেলে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হ’ত না, এটুকু স্বীকৃতি দিতেও নারাজ ছিলেন সামরিক শাসকরা। এতােই তীব্র ছিল তাঁদের পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে বিদ্বেষ। সামরিক শাসনের অবসানের পর অবশ্য এ অনুচ্ছেদে বিবৃত সকল কথাই পূর্ব পাকিস্তানের এম, এন, এরা সংসদে তুলেছেন। (৪২)
বিরােধী রাজনীতিক সােহরাবর্দিকে আটক করে জেলে পুরে দেওয়া হ’ল ১৯৬২-র ৩০শে জানুয়ারী। তাঁর মার্কিন লবির ভয়ে, আয়ুব এই কাজটা এতাে দেরিতে করলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সম্প্রদায়, সােহরাবর্দি সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য গণতন্ত্র সম্মত দাবিতে সােচ্চার হয়ে ওঠে। এখন আয়ুব চীনের দিকে ঝুঁকছেন। তাই মার্কিন রাষ্ট্রদূত রুনটরী তাঁর পাকিস্তানের দৌত্যকর্মে ইস্তফা দিয়ে দেশে পাড়ি দিলেন। তাঁর বিদায় সভার পূর্বেই তাঁর সুহৃদ সােহরাবর্দিকে কারারুদ্ধ করা হ’ল। (৪৩)
১৯৬২-র ৩১ শে জানুয়ারী ঢাকায় আয়ুব তাঁর হােমরাচোমরা প্রশাসকদের সঙ্গে সম্মেলন ডাকেন। সােহরাবর্দি পাকিস্তানের শত্রু এবং সাধারণভাবে দেশদ্রোহী—এ কথা আয়ুব ঘােষণা করেন। অখন্ডবঙ্গ নিয়ে ইঙ্গিত এক সময় সােহরাবর্দির প্রতিযােগীরা করে জব্দ হন কারণ জিন্না স্বয়ং দুই বঙ্গ যােগে তৃতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়াস চালাতে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। আসলে সােহেরাবর্দির আইন এবং সংবিধান সংক্রান্ত জ্ঞানগম্যিকে আয়ুব ভয় পেতেন। সােহরাবর্দি নতুন সংবিধানের গলদ ধরে আয়ুব-বিরােধী শক্তিকে জোরদার করবেন এই ভয়ে তাঁকে আটক করতে বাধ্য হন আয়ুব। (৪৪)
১৯৬২র ১লা ফেব্রুয়ারী। আয়ুৰ এই দিনও ঢাকাতে রয়ে গেছেন। সবাত্মক এক ছাত্র বিক্ষোভ ঢাকা শহরের দীর্ঘ জাড্যদশার অবসান ঘটালাে। শুধু বন্দী মুক্তি নয়। গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ছাত্র ফৌজ সরকার পক্ষকে যেন আচমকা হতচকিত করে দিল। (৪৫)
বিহুল সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করলাে রমজান উপলক্ষ্যে দীর্ঘ এক মাস ছুটির এক নজির বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। ছাত্র মিছিল বের হ’ল ৬ ফেব্রুয়ারী এই বিচিত্র ছুটির আদেশের বিরুদ্ধে। সঙ্গে রইলাে পূর্বের সব দাবি। পুলিশ লাঠি চালালাে। সংবাদপত্রে এ সব বিরােধী রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রকাশ করা এই আমলে সম্ভব ছিল না। তবু ছাত্রনেতারা জানালাে, এই মিছিল এবং পুলিশী জুলুমের সত্য ঘটনা চেপে গেলে সংবাদপত্র অফিস আক্রমণ করা হবে। ৬ই ফেব্রুয়ারীর বিক্ষোভ কালে আয়ুবের শত শত আলােকচিত্র পদদলিত হ’ল। ছাত্ররা তাঁর আলােকচিত্র নিয়ে রীতিমতাে বহূৎসবও করে ছাড়লাে। আসলে তারা প্রমাণ করে ছাড়লাে আয়ুবের জনপ্রিয়তা কতাে সামান্য, অন্ততঃ এই পূর্ব পাকিস্তানে। পরের দিন, ৭ই ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা ধর্মঘট ডাকে। (৪৬)।
৭ই ফেব্রুয়ারীর ধর্মঘটে সাধারণ মানুষও সামিল হন। কিন্তু সরকারী তৎপরতা তথা পুলিশী পীড়ন এই আন্দোলনকে প্রথম থেকেই আয়ত্তে রেখে দেয়। মুজিবর রহমান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন প্রমুখ কাররুদ্ধ হন। কাঁদানে গ্যাস, সামরিক বাহিনীর টহল, একযােগে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেওয়া এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ—এ সবের লক্ষ্য ছিল এবারের শহীদ দিবস ২১ শে ফেব্রুয়ারীর উপলক্ষ্যে সম্ভাব্য বিক্ষোভ-আন্দোলনকে পূর্বাহ্নেই স্তব্ধ করে দেওয়া। সংবাদপত্রের জন্য বিবাচনবিধি বা সেনসরশিপ কঠোরতর করা হয়। সংবাদের অংশবিশেষ দুই কপি ঐ বিবাচকের জন্য পেশ করতে হ’ত। অতঃপর পরবর্তী দিবস তা ছাপা যেত। এইভাবে ইত্তেফাক এসে ঠেকল চার পৃষ্ঠায়। ছাত্র বিক্ষোভ ইত্যাদির নামগন্ধও সংবাদপত্রে ছাপা গেল না। দু’বার সেনসর সামলাতে গিয়েই ইত্তেফাকের দুটো পৃষ্ঠা কমে গেল। অথচ এ কারণে দুঃখপ্রকাশ করাও নিষিদ্ধ ছিল। ভারতীয় পত্রিকা স্টেটসম্যানও ১৯৬২-র ৪ঠা ফেব্রুয়ারীর পরে সাধারণের সমক্ষে পৌছাতে পারে নি। (৪৭)
ঢাকার ছাত্রদের দাবিয়ে রাখা গেলেও চট্টগ্রাম এবং বরিশালের ছাত্রসম্প্রদায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করলাে। এদিকে স্কুল শিক্ষকদের রাজনৈতিক লাইন সম্পর্কে রিপাের্ট করতে আদেশ পাঠানাে হ’ল স্কুল পরিদর্শকদের কাছে। আয়ুব-বিরােধীরা চাকুরী হারাবার আশঙ্কা করলাে এর ফলে। (৪৮) পূর্ব পাকিস্তানে দমন-পীড়ন চালিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ অসম্ভব করলে কী হবে? সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবিতে লন্ডনে ১৮ই ফেব্রুয়ারী প্রবাসী পাকিস্তানী ছাত্রদের ডাকা সভায় শ্রমিক দলের আন্তজাতিক দপ্তরের সচিব ডেভিস এনালস সভাপতিত্ব করলেন। অনেক ব্রিটিশ এম, পি এই সমাবেশের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান। অন্যদিকে পাকিস্তানী হাই কমিশন ভবনে পােষ্টার, শ্লোগান, বিক্ষোভে ছাত্ররা তাদের আয়ুবশাহীর প্রতি বিরূপ মনােভাব তিক্তভাবে প্রকাশ করে। রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খােলার দাবিতে শ্লোগান শােনা যায় বিক্ষোভ-জমায়েতে। (৪৯)।
ঢাকা থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারী প্রেরিত এক প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিউজ সার্ভিস উল্লেখ করে, পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুব পড়েছেন এক রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে। নিরক্ষরতার ভূয়া অজুহাতে গণতন্ত্র নিধন এবং সামরিক আইন। চালু রাখার পরিণামে বুদ্ধিজীবীদের মেজাজ বেশ তেতে আছে। (৫০) ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসে ছাত্র উদ্যোগে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এই সভায় ভাষণ দেন। সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব পাশ হয়। সভাস্থলের মুখেই পােস্টার। শােভা পায়। স্বৈরাচার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে সে সব পােস্টার এই সমাবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। (৫১)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী উপাচার্যকে সরিয়ে অবাঙালী প্রশাসক বসানাের ফলে ১৯৬০-এর ডিসেম্বর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ পূর্বপাকিস্তানের সকল শিক্ষায়তনের ছাত্ররাই স্বৈরাচার বিরােধী অবস্থানে কৃতসঙ্কল্প হয়। সংবিধান রচনার স্বার্থে যে প্রশ্নোত্তরিকা বিলি করা হয় জনসাধারণের মধ্যে, তা থেকে দেখা যায় শতকরা ৯০ জন চেয়েছেন সংসদীয় প্রথা এবং ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার। সােহরাবর্দির গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়া ছাত্রমহলে তীব্ররূপ নেয়। কে, জে, নিউম্যানের মতে, সােহরাবর্দির গ্রেপ্তার, ঢাকার দাঙ্গা এবং ১লা মার্চ প্রতিশ্রুত আয়ুবীয় সংবিধান—এদের মধ্যে যােগসূত্র আছে। ছাত্রদের একরােখা মেজাজের পরিচয় ৩রা ফেব্রুয়ারীতেই পেয়েছেন পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনজুর কাদির। ছাত্রদের সঙ্গে ঐ মন্ত্রীর আলােচনা সংবাদপত্রে ছাপা নিষিদ্ধ হলে ছাত্ররা মন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাক্ষাৎ করার কথা রক্ষা করবে না—এও জানানাে হল সেদিন। (৫২)।
অবশ্য ৭-ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬২ র ছাত্র বিক্ষোভকারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে আয়ুব। বিরােধী শ্লোগান দিয়েও এবং আয়ুবের স্তাবকদের গড় আয়ুব-তােরণটি চূর্ণ করেও, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসকের কারণে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পায়। একটা মুচলেকার বিনিময়ে এই অব্যাহতি। এই নরমপন্থী ভাব সরকার দেখাতে বাধ্য হয়। ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে ছাত্র বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। না জানি ২১ শে ফেব্রুয়ারী এ বিক্ষোভ কী চেহারা নেবে—এই শঙ্কাই ঐ উদারতার কারণ। (৫৩)
ছাত্রদের সম্বন্ধে উপযুক্ত নরম মনােভাবের মূলে আছে আজম-আয়ুবের দ্বন্দ্ব—একথা বলেছেন নিউম্যান। প্রায়ই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার উপরে আঘাত আসে ভিতর থেকেই। সােহরাবর্দির গ্রেপ্তারে আজমের সম্মতি ছিল না। প্রতিবাদী ছাত্রদের বিরুদ্ধেও তিনি কোনাে জোরালাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি—এই মত অনেকেই পােষণ করতেন। (৫৪)
১লা মার্চ, ১৯৬২ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে প্রকাশ করা হ’ল আয়ুবের সেই তথাকথিত সংবিধান। পুলিশ এবং গুপ্তচররা ছাত্রদের উপর লক্ষ্য রেখেও সংবিধানবিরােধী আলাপ আলােচনা বন্ধ করতে পারে নি। এ দিকে আয়ুবের মৌল গণতন্ত্রের মৌল গণতন্ত্রীরা—অথাৎ ৮০ হাজার ইউনিয়ন কাউনসিল সদস্য—পরােক্ষভাবে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভা নির্বাচিত করলেন। তাদের নয়, আয়ুবের হাতে ছিল ১ম চার্লসের মতাে ক্ষমতা—এই কথা বলেছেন স্টিফেন বাবার। ১৫ই মার্চ। মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ঘটা করে সংবিধানের সারাংশের নকল পুড়িয়ে ছাই করে বিদ্রোহী ছাত্ররা। প্রেসিডেন্ট প্রথা, রাজনৈতিক দলের বিলােপ, দমন-পীড়ন মূলক আইন—এ সবের বিরুদ্ধে জনমত ধূমায়িত হতে থাকে। সংবিধান প্রকাশে আয়ুব বিরােধিতা প্রবলতর হয়। পূর্বপাকিস্তানে তাে বটেই। গার্ডিয়ানের মতও অনুরূপ ছিল। অবশ্য অধ্যাপক রাশব্রুক উইলিয়ামস ভয়েই হয়তাে একটু রেখে ঢেকে বলেছেন এই সংবিধান-বিরােধিতার কথা। (৫৫)
বেকায়দায় পড়ে সরকার উঠে পড়ে লাগলাে এই কথাটা প্রতিপন্ন করতে যে, ছাত্র বা অন্যদের সংবিধান-বিরােধী বিক্ষোভ, সংবিধানের দোষে নয়, কমুনিস্ট এবং বৈদেশিক শত্রুদের প্ররােচনার ফলে ঘটে চলেছে। তথ্যসচিব এই তথ্য দিতে গিয়ে পশ্চিম। পাকিস্তানেও কমুনিষ্ট ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেন। সংখ্যালঘু অথাৎ হিন্দুরাও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একথাও বলতে দ্বিধা করেন নি সরকারী কর্তারা। তথাপি কুষ্টিয়ায় ছাত্রসমাবেশে সংবিধান পােড়ানাে হ’ল। আয়ুব পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে কলকাতা এবং কাবুলে পাক-বিরােধী কমুনিষ্ট কুচক্রীদের কথা বলেন। পরােক্ষভাবে একথাও মনে করিয়ে দেন হিন্দু যারা এখনাে পাকিস্তানে র’য়ে গেছে তাদের লক্ষ্য পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। এদিকে বিক্ষোভ আন্দোলন দমনে কোনাে। কোনাে পূর্ব পাকিস্তানী আমলা নরম মনােভাব দেখাবেন ভেবে তাদের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানী আমলার বসিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের আয়ুব-বিরােধী মনােভাবে নূতন প্রেরণা যােগানাে হ’ল। যদিও উদ্দেশ্য ছিল অন্যপ্রকার। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চক্রান্তেই সংবিধানের সমালােচনা করা হচ্ছে—এই আজব যুক্তি আয়ুবপন্থীরা অনর্গল বলে চললেন। অন্যদিকে দমন-পীড়নের ব্যবস্থাও জোরদার হ’ল। (৫৬)
আয়ুব তার নয়া ইশতেহার প্রকাশ করলেন। বলা হ’ল, পূর্বপকিস্তানকে প্রথমে বিচ্ছিন্ন করে, পরে সমগ্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চক্রান্ত বানচাল করতে হলে দেশের দুই খন্ডের ঐক্য প্রসারিত করতে হবে। তাই সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন—হিন্দু প্রভাব মুক্ত হতে এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে ঐক্য দৃঢ় করতে প্রয়ােজন বাঙলা ভাষার জন্য উর্দু লিপির প্রচলন। জনৈক পূর্ব পাকিস্তানী সংবাদপত্র সম্পাদক, আয়ুবের উক্তিকে তাঁদের দেশপ্রেমের উপরে গুঢ় ইঙ্গিত মনে করেন। তখন আয়ুব বলেন, তিনি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তােলেন নি। (৫৭)।
অতঃপর ১লা এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঘরােয়া বৈঠকে সংবিধান বিরােধিতার মূলে বৈদেশিক কুচক্রীর হাতে খেলার কথা বললেন আয়ুব। তিনি এই বিরােধিতার মূলে যে দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক দাবিদাওয়া জড়িত সে কথা না বােঝার ভাণ করলেন। ছাত্ররা সংবিধানের কিছু বােঝে না। তাদের এ বিষয়ে অনধিকার চর্চা বন্ধ করতেও তিনি পরামর্শ দেন এই বৈঠকে। (৫৮)।
ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে আহূত এক বৈঠকে ২রা এপ্রিল স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য বক্তব্য রাখতে গিয়ে আয়ুব পুনবার কলকাতা, আগরতলার কমুনিষ্টদের কথা এবং কলকাতা বন্দরের পশ্চাৎভূমি হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কথা আউড়ে গেলেন। অতীতের কোনাে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বর্তমানের ছাত্ররা বিদ্রোহ করছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে আয়ুব বলেন, অতীতের ঘটনার দায় তার নয়। ছাত্ররা অপরের ক্রীড়নক একথা বলে আয়ুব জানতে চান এত ভালাে কাজ হ’ল সামরিকশাসনে, সে কথা এরা বলে না কেন? (৫৯) ঢাকায় জাতীয় সংসদের প্রধান কার্যালয় করার তাৎপর্য কতােটুকু ? যে-সংসদের কোন ক্ষমতা নেই তার অবস্থান অমূলক। ঠিক তেমন, পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানী গভর্ণর বা মন্ত্রীর ব্যবস্থা অথবা বাঙলাকেও উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান—এ সবই আয়ুবের আমলে ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং আর্থিক সমানাধিকারের দাবি এই সব মামুলি সংস্কার দিয়ে চেপে দেওয়া সম্ভব ছিল না। আয়ুবের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় গভর্নর বঙ্গবাসী হলেও তাকে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক চক্রের বশংবদ হতে হবে। ভারত-বিরােধী জিগির তুলতে আজাদ-কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট খুরশিদকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ঝটিকা-সফর তথা ভাষণ দেওয়ানাে হয়। তবু কিন্তু ঢাকার ছাত্ররা ২৪শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে চকিত ধর্মঘটের ব্যবস্থা করে। বিক্ষোভকারী ২০৭ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে ১৩০ জনকে মুচলেকার বিনিময়ে খালাস করা হয়। (৬০)
যৎসামান্য আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের হাত করতে না পেরে আয়ুবপন্থীরা সেই ভারত-বিদ্বেষ ছড়িয়ে চললাে। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়াতে এই ভারত-বিরােধী জিগিরের বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ ছাপা হয় ১৯৬২-র ৩রা এপ্রিল। একই দিনে ডন পত্রিকা লিখলাে—পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা মুসলিম নিধনকে নৈমিত্তিক কর্ম মনে করে। এ-হেন হিন্দুরা নিজেরা পূর্বপাকিস্তান দখল করবার মতলবে পূর্বপাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার মন্ত্রণা দিচ্ছে। পাকিস্তানীদের উচিত নিজেদের দাবি নিজেরাই আদায় করে নেওয়া। (৬১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ দিনের ধর্মঘট ৪ঠা তুলে নিয়ে ছাত্ররা ফের ১৬ই এপ্রিল তিনদিনের ধর্মঘট ডাকে। বাঙলা হরফের সমর্থনে, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে এবং গ্রেপ্তারী পরােয়ানা বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা সােচ্চার হ’ল। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তুচ্ছ কিছু অজুহাতে ৩১শে মে, ১৯৬২ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলেন। তিনজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অথাৎ নুরুল আমিন, আবুহুসেন সরকার, আতাউর রহমান এবং হামিদুল হক চৌধুরী সহ সাতজন পূর্ব পাকিস্তানী নেতা ১৪ই এপ্রিল এক বিবৃতিতে জেলে আটক ছাত্রদের সঙ্গে অন্যান্য রাজবন্দীদেরও মুক্তির দাবি জানালে পশ্চিম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালার মৌল গণতন্ত্রীরা তাদের সমর্থন করে। সরকারকে ঐ সব দাবি মেনে নিতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাবিসমূহও মেনে নিতে আহ্বান জানালেন। এঁরা আরাে জানালেন, এর ফলে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। ডন পত্রিকা অবশ্য সােহরাবর্দিকে গ্রেপ্তার করায় মৃদু এবং দাসসুলভ সমালােচনা করার ছলে ঢাকার ছাত্র বিক্ষোভের নিন্দা এর আগেই প্রকাশ করেছিলা ১৮ই এপ্রিলের সম্পাদকীয়াতে। আর এই নিন্দাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। (৬২)
২৩শে এপ্রিল ছাত্রবিরােধী সকল কুৎসার জবাব দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ এনাইতুর রহমান। ছাত্ররা কোনাে রাজনীতিকের ক্রীড়নক নয়, দেশদ্রোহী নয় একথা তিনি জানালেন তার ঐ তারিখের বিবৃতি মারফত। লণ্ডনে ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকামী কমিটি ছাত্রসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করে এবং গণতন্ত্রকামী পূর্বপাকিস্তানীদের উপর সামরিক শাসনকালে যে নিপীড়ন চলছে তার নিন্দা করে। (৬৩)
ছাত্রদের একনিষ্ঠ সংগ্রামের চাপে শেষ পর্যন্ত আয়ুব ছাত্রদের প্রতি একটু নরম হলেন। কিছু কিছু দাবিও মেনে নিয়ে তাদের শান্ত করতে চাইলেন। অন্যদিকে প্রাক্তন মুসলিম লীগ দলের এবং অন্য দলেরও বেশ কিছু নেতা জাতীয় ব্যবস্থাপক সভায় নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করলেন, সংখ্যায় এঁরা ছিলেন শতাধিক। ১৫০ জনের সংসদে এ বেশ বড় সংখ্যা। দলীয় টিকিটে না জিতলেও তাদের জয় প্রমাণ করলাে গণতন্ত্রসম্মত নানা দলের অবাধ রাজনীতি এখনাে জনপ্রিয়। বিশেষতঃ আয়ুব পরিচালিত এই নির্বাচনে জয়লাভ কম কৃতিত্বের নয়। এ থেকে সামরিক শাসনে নির্বাচকদের অনাস্থাই সূচিত হ’ল। এই সব নয়। অঢেল অর্থব্যয় করেও আয়ুব কিন্তু ব্যবস্থাপক সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সর্মথন পেলেন না। প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনী ফলাফলেও আয়ুবের মুখরক্ষা হল না। জনগণতন্ত্রের দাবি একদিন ব্রিটিশ শাসকরাও মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক চেতনাকে আয়ুব ছােট করে দেখেছিলেন। (৬৪)
উপরে আলােচিত নিবাচনগুলি পদ্ধতিগত অর্থে প্রহসন মাত্র হয়েও, গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফলের কারণে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। ন্যাশনাল হেরাল্ড মন্তব্য করেছিল, আয়ুব কোন কিছুই পাল্টাতে পারেন নি। শুধুমাত্র ভয়বশতঃ দলীয় কোন্দল আর খেয়ােখেয়ি স্তব্ধ ছিল। অবশ্য এই প্রথম জাতীয় বা প্রাদেশিক স্তরে বর্ণহিন্দুর প্রতিনিধিত্ব ছিল না। প্রাদেশিক আইন সভাতেও মাত্র তিনজন অমুসলিম প্রতিনিধির দু’জন তফসীল সম্প্রদায়ের এবং একজন পার্বত্য উপজাতির লােক ছিলেন। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আয়ুবের আমলে যেন আপাঙক্তেয় হয়ে গেল রাজনীতির দরবারে। (৬৫)।
আয়ুব নিজস্ব রাজনীতির প্রতিপক্ষদের দূরে রাখতেই অবিরত রাজনীতিকদের বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু ব্যবস্থাপক সভায় পূর্ব পাকিস্তানীরা, রাজনৈতিক দলের ‘পুনরুদ্ধারের’ দাবি করতে থাকে। আয়ুব অবশ্য সামরিক আইনে আটক বিক্ষোভকারী সকল পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রকে জেল থেকে খালাস করে দিলেন। এর প্রশস্তি করল স্তবক ডন পত্রিকা। বাধ্য হয়ে এটা উনি করেন। এর মধ্যে কূটনীতিজ্ঞতার প্রমাণ বা উদারতার চিহ্ন খোজা অবান্তর। (৬৬)
পূর্বপাকিস্তানীদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে আয়ুব খান এবারে উর্দু, বাঙালা উভয় ভাষাকেই আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপযুক্ত মাধ্যমে উন্নীত করার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিলেন। নিজেই দুই ভাষাঘটিত বাের্ডের পৃষ্ঠপােষক হলেন। অবশ্য শুধু পুরস্কার, পারিতােষিকের উপর ভরসা করার মানুষ আয়ুব নন। ১৯৬২-র এপ্রিল-মে মাসে তার জমানার কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা, রাজশাহী এবং পাবনা এলাকায় সংখ্যালঘু নিধন তথা বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধালেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানবাহিত সেনাবাহিনী পূর্বপাকিস্তানে উপনীত হয়ে ভারত-বিরােধী জিগির জোরদার করলাে। ভারতীয় সহকারী মহাধ্যক্ষ বা ডেপুটি হাইকমিশনার-ভবন সেনাবষ্টিত রেখে, দূতাবাসের বাসিন্দাদের পক্ষে ঐ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের পথ বন্ধ করে রাখলাে একই সঙ্গে। রাজেশ্বর দয়াল তদানীন্তন ভারতীয় হাইকমিশনার। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁকেও রাজশহী-পাবনা অঞ্চলে যেতে দেওয়া হয় নি। তা ছাড়া আয়ুবের অনুগত গুলাম ফারুককে ১১ই মে, ১৯৬২ তারিখ থেকে দেওয়া হল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর পদ। আজমকে তার স্থানীয় জনপ্রিয়তার জন্য আয়ুব বরাবরই ঈর্ষা এবং সন্দেহ করতেন। অবশ্য আয়ুবের একান্ত ভক্ত পাকিস্তান টাইমস পত্রিকাতেও লেখা হ’ল বরিশাল এবং চাঁদপুরে বিশাল জনতা আজমকে যে আবেগাপ্লুত বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছিলেন ৬ই মে তারিখে, তার কথা এবারের দাঙ্গার মেজাজটাই ছিল আলাদা। সেই সঙ্গে যুদ্ধোন্মাদনার উস্কানি দিয়ে এবং পূর্বপাকিস্তানীরপ্রিয় গভর্নর আজমকে সরিয়ে দিয়ে, আয়ুব বুঝিয়ে দিলেন—তিনি প্রবােধ-সান্ত্বনা দানের পাশাপাশি কঠোরতর পদক্ষেপের প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে কুণ্ঠা করবেন না। (৬৭)
সামরিক আইনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। সামরিক শাসনকাল শেষ হবার একমাসকাল পরে, বিগত আমলে অনুষ্ঠিত তথাকথিত সাধারণ নির্বাচন অথাৎ সামরিক শাসনের নাগপাশ বজায় রেখে নির্বাচনের ঠাট বজায় রাখার যে-সুযােগ সামরিক শাসককুল পেয়েছিলেন, তার জন্য সংকোচ এবং লজ্জা অনুভব করে আবুল কাশেম খান ভাষণ দেন। তার মতে, গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল একথা সত্য নয়—গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে। পরীক্ষা করে দেখাই হয় নি। সংসদ চালু হবার মুখে সংবিধান বাতিল করা এবং নির্বাচনের মুখে সামরিক শাসনের জোয়াল চাপানাে অথবা ঐ শাসনের পীড়নের পরিবেশে সংবিধান চালু করা—এসবের কোনটিই প্রতিহত করতে না পারাই খান সাহেবের লজ্জা অনুভবের কারণ। (৬৮)
রাজনীতিকদের দুর্নীতির কথা বলে আয়ুবতন্ত্র যে কাচের ঘরে বাস করে ঢিল ছোড়ার ভুল করেছিল তার প্রমাণে তথ্য পেশ করেন পশ্চিম পাকিস্তানী এম, এন, এ চৌধুরী ফজল ইলাহী। আমলা তন্ত্রের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে তাদের অবাধ দুনীতির সুযােগ দিয়েছিল আয়ুব জমানা। ফলে প্রশাসনিক ব্যয় ২৯ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকায় ঠেকে এই আমলে। আসামরিক বিভাগে নিজেদের আত্মীয় অনুগতদের যথেচ্ছ চাকুরীদান ও স্বজন পােষণের চূড়ান্ত রূপটি মাহাবুবউল হকের কথায় পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি আয়ুবশাহীকে ফ্যাসিস্ত গণ্য করে বলেন—বিস্তর অর্থের অপচয় হ’ত কিছু লৌহমানব পুষতে। ফ্যাসিস্ত জমানার এরাই তাে স্তম্ভ। পূর্ব পাকিস্তানী এম, এন, এ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামিজউদ্দিন আহমেদের কথায় সামরিক শাসনের পূর্বের আমলে যদি দুর্নীতির অঙ্কগুলাে শত বা সহস্রের গন্ডীতে বাঁধা থেকে থাকে, সামরিক শাসনকালে তা লক্ষ এবং কোটির ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, প্রশাসনকে নিজেদের খেয়ালমতাে চালিত করতে হলে উৎকোচগ্রহণ, অর্থের অপব্যবহার এ সব সুযােগ ঐ প্রশাসকদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হয়—কার্ল ভােরিসের এই মতই সমর্থিত হয়েছে উপযুক্ত তথ্য এবং যুক্তির মাধ্যমে।(৬৯)

References: 

  1. KHONDKAR ABDUL KHALEQUE, Ek Shotabdi, pp. 217-18. K. J. NEWMAN, “Pakistan’s Preventive Autocracy and its Causes”, Pacific Affairs, March 1959, p. 31. Dawn, 10, 16 October 1958.
  2. ATAUR RAHMAN KHAN, Ojarotir Dui Bachchar, p. 355. Dawn, 10 October 1958. I. H. QURESHI, “The Development of Pakistan”, in GUY S. METRAUX and FRANCOIS CROUZET (ed.), The New Asia (New York, Mentor Books, 1965, for UNESCO), p. 253. AYUB KHAN, Friends Not Masters, pp. 56-57.
  3. J. SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan, pp. 445-46. Daily Mail Correspondent’s despatch, cited in The Hindu (Madras), 16 October 1958 ; despatch from London. Speech by SARDAR ATAULLAH KHAN, quoted in SENGUPTA, n. 3, pp. 431-32, and in The Times of India, 6 July 1962. STEPHEN BARBER, “Hopes and Hazards in Pakistan”, The Daily Telegraph, 15 May 1962. For some authoritative comments on Ayub’s coup, see TENDULKAR, Abdul Ghaffar Khan, pp. 515-16.
  4. QURESHI, n. 2, pp. 255-57. ATAUR, n. 2, p. 362. HERBERT

FELDMAN, Revolution in Pakistan (London, Oxford University Press, 1967), p. 206. For facts indicating that Ayub’s land reforms in West Pakistan were largely illusory, see “Spotlight on Ayub’s Dictatorship II”, written by “a wellknown Left-wing leader of Pakistan, who has been working underground in East Pakistan,” in Mainstream (New Delhi), 2 March 1968, pp. 24-25.

  1. EASWAR SAGAR, “East Pakistan under the New Regime”, The Hindu, 6 December 1960. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 16 April 1963, Vol. I, pp. 1882-83. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 430.
  2. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 94-95. Speech by S. M. HABIBUL HAQ, NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 577. Speech by JAMALUS SATTAR, NAP Debates, 19 June 1963, Vol. II, No. 13, p. 711. KARL VON VORYS, Political Development in Pakistan, p. 105. The Pakistan Times, 11 May 1962. BHUPENDRA KUMAR DATTA, Interview, I September 1966. STEPHEN BARBER, n. 3.
  3. Speech by NURUL AMIN, Leader of the Opposition, NAP Debates, 4 August 1965, Vol. II, No. 37, pp. 2531-33. Speech by BEGUM ROQUYYA ANWAR, NAP Debates, 19 March 1963, Vol. I, No. 9, p. 596. QURESHI, n. 2, pp. 257-58.
  4. NEWMAN, n. 1, p. 33. QURESHI, n. 2, p. 258. SENGUPTA, n. 3, p. 456.
  5. ATAUR RAHMAN KHAN, n. 2, p. 373. RICHARD V. WEEKES, Pakistan : Birth and Growth of a Muslim Nation (Princeton, Van Nostrand, 1964), p. 118. SENGUPTA, n. 3, p. 454. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan, pp. 227-28. QURESHI, n. 2, p. 258.
  6. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 105-6. Speech by BEGUM ROQUYYA ANWAR, n. 7. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 15 June 1963. Vol. II, No. 10, p. 518.
  7. Speech by EBRAHIM KHAN, NAP Debates, 3 July 1962, Vol. I, No. 17, p. 941. Speech by BEGUM ROQUYYA ANWAR, Ibid, p. 944. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, Ibid., p. 954. VORYS, n. 6, pp. 90-91.
  8. Dawn (Karachi), 28 October 1958.
  9. Pakistan Observer, 22 February 1959. One may indeed be shocked by Herbert Feldman’s observation, that at no time in the history of the Martial Law administration was sight ever lost of the democratic idea”, in Revolution in Pakistan,p. 206..
  10. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 11 July 1962, Vol. I, No. 24, pp. 1308, 1368-69. Speech by MAHBUBUL HAQ, Ibid., p. 1370.
  11. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 111-12. 16. Ibid., pp. 107-8.
  12. Speech by SYED ABDUS SULTAN, NAP Debates, 20 June 1962, Vol. I, No. 6, p. 194.
  13. The Pattern of Agricultural Unemployment: A Case Study of an East Pakistan Village (Bureau of Economic Research, Dacca University, 1962), esp., pp. 34-36.
  14. Speech by MD. SERAJUL ISLAM MIAH, NAP Debates, 26 June 1962, Vol. I, No. 11, p. 529.
  15. MOHAMMAD OSMAN HASAN, “Border Problems and Economic Security of East Pakistan”, Journal of the Pakistan Academy for Village Development, Comilla, July 1962, pp. 42-43.
  16. Marketing of Jute in East Pakistan (Dacca University SocioEconomic Research Board, 1961), esp., pp. 127-28, 153-54, 156-57.
  17. MAHBUB UL HAQ, The Strategy of Economic Planning (Karachi, Oxford University Press, 1963). 23. Ibid., pp. 92-93. 24. Ibid., pp. 93-95. 25. Ibid., pp. 100:4. NURUL ISLAM, “Some Aspects of Interwing Trade and Terms of Trade in Pakistan”, The Pakistan Development Review, Spring 1963, p. 6. JOHN H. POWER, “Industrialization in Pakistan : A Case of Frustrated Take-Off ?”, The Pakistan Development Review, Summer 1963, p. 205. It is surprising to note how Ayub simply denies the transfer of resources from East to West Pakistan in Friends Not Masters, p. 225.
  18. G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 235-40, esp., p. 240. Pakistan Observer, 19 October 1961. A. H. M. NURUDDIN CHOUDHURY,

“The Weight of Tax Revenue in the Pakistan Economy”, The Pakistan Development Review, Spring 1963, pp. 100-1.

  1. ATAUR RAHMAN KHAN, n. 2, pp. 159-62. VORYS, n. 6, pp. 94-96.
  2. Speech by S. ZAMAN, NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II, No.12, pp. 659-60.
  3. Ibid., pp. 661-63. 30. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 95.
  4. NAP Debates, 10 April 1963, Vol. I, p. 1544. 32. NAP Debates, 30 March 1963, Vol. I, No. 16, p. 1020. 33. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 109.
  5. Speech by SYED ABDUS SULTAN, NAP Debates, 20 June 1962, Vol. I, No. 6, p. 194. MAHBUB UL HAQ, n. 22, p. 114 ; this name must not be confused with the name of the East Pakistani MNA, MAHBUBUL HAQ, mentioned, for instance, in n. 33.
  6. ASLAM SIDDIQI, A Path for Pakistan (Karachi, Pakistan Publishing House, 1964), pp. 10, 11, 26. Speech by SYED ABDUS SULTAN, NAP Debates, 20 June 1962, Vol. I, No. 6, p. 193. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, NAP Debates, 27 June 1962, Vol. I, No. 12, p. 643.
  7. Ibid., pp. 643-44. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 15 June 1964, Vol. II, No. 12, p. 755. 37. SIDDIQI, n. 35, p. 78. AFSARUDDIN, n. 35.
  8. ZINKIN, quoted in SENGUPTA, n. 3, pp. 142-43. Also see Ibid., pp. 141-42. The Atlantic, September 1957, p. 8.
  9. Pakistan Observer, 31 January, 10 March 1959. The Pakistan Times, 25 February 1959.
  10. P. C. LAHIRY, India Partitioned and Minorities in Pakistan, pp. 50-56. The Statesman (New Delhi), 15 August 1961. 41. LAHIRY, n. 40, pp. 37-38.
  11. NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 117. NAP Debates, 9 July 1962, Vol. I, No. 22, p. 1215. NAP Debates, 16 April 1963, Vol. I, p. 1895.
  12. Dawn, 31 January 1962. The Hindu, 31 January 1962.
  13. The Pakistan Times, 31 January, 1 February 1962. The Amrita bazar Patrika (Calcutta), 1 February 1962. ATAUR RAHMAN KHAN, n. 2, pp. 17-18.
  14. The Pakistan Times, 2 February 1962. The Hindu, 2 February 1962.
  15. Despatch from Staff Correspondent in Dacca, The Statesman (New Delhi), 7 February 1962. 47. Ibid., 8, 9 February 1962.
  16. The Amrita Bazar Patrika, 11 February 1962. Also see GIRILAL JAIN, “Prospects in Pakistan”, The Times of India, 15 February 1962. 49. The Hindu, 20 February 1962. 50. The Times of India, 21 February 1962. 51. The Amrita Bazar Patrika, 22 February 1962.
  17. K. J. NEWMAN, “Pakistan’s rulers fear a political revival”, The Guardian (Manchester), 1 March 1962. VORYS, n. 6, pp. 100-01.
  18. The Pakistan Times, 13 March 1962. The Amrita Bazar Patrika, 23 February 1962.
  19. STEPHEN BARBER, n. 3. NEWMAN, n. 52.
  20. The Guardian, 2 March 1962. The Amrita Bazar Patrika, 3, 16 March 1962. The Pakistan Times, 15 March 1962. BARBER, n. 3. Also see The Times, 2 March 1962.
  21. The Times, 20 March 1962. The Indian Express (New Delhi), 29 March 1962. The Pakistan Times, 23, 29, 30 March 1962. Feldman, n. 4. pp. 160-63 57. The Statesman (New Delhi), 30 March 1962. 58. Dawn, 2 April 1962. 59. The Pakistan Times, 3 April 1962. 60. HUGH TINKER, India & Pakistan (London, Pall Mall Press, 1962), p. 92. The Times of India, 26 March 1962. The Pakistan Times, 26 March 1962. Despatch from INDER JIT, stationed in Karachi, The Times of India, 4 April 1962. RICHARD V. WEEKES, Pakistan : Birth and Growth of a Muslim Nation (Princeton University Press, 1964), pp. 12627 ; WEEKS appears to share Tinker’s views.

১৭০

  1. Dawn, 3 April 1962. INDER JIT, n. 60. 62. The Pakistan Times, 5 April 1962. Dawn, 15, 17, 18 April 1962. The Hindu, 19 April 1962.
  2. The Pakistan Times, 25 April 1962. The Hindustan Times (New Delhi), 30 April 1962. 64. BARBER, n. 3. The Times, 30 April, 3 May 1962. 65. The National Herald (Lucknow), 3 May 1962. LAHIRY, n. 40, p. 38.
  3. The Amrita Bazar Patrika, 22 April 1962. Dawn, 5 May 1962. BARBER, n. 3.
  4. Despatch from INDER JIT in Karachi, The Times of India, 30 April 1962. The Pakistan Times, 2, 3, 8 May 1962. The Amrita Bazar Patrika, 5 May 1962. The Pakistan Times, 3 June 1962. 68. NAP Debates, 9 July 1962, Vol. I, No. 22, p. 1219. 69. VORYS, n. 6, p. 296. Speech by CH. FAZL ELAHI, NAP Debates, 14 June 1963, Vol. II, No. 9, p. 474. Speech by RAMIZUDDIN AHMED, NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 567. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 27 June 1964, Vol. II, No. 24, p. 2046
  5. গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার-রায়, pp 58-78