You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাদশা খানের সাফ জবাব

মানুষ চেনেন নি ইয়াহিয়া খান। তার এজেন্টরা গিয়েছিলেন বাদশা খানের মন ভুলাতে। জালালাবাদের পাক-কাল দেখা করেছিলেন কাবুলে খান আবদুল গফফর খানের সঙ্গে। মুজিবর রহমানের মুন্ডুপাত ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি এবং তাঁর আওয়ামী লীগ নাকি ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতৃত্ব। তাঁদের ছ’দফা দাবী নাকি মারাত্মক। এত সব ধানাই পানাই এর পর ইয়াহিয়ার এজেন্ট চেয়েছিলেন বাদশা খানের কাছে একটি বিবৃতি। শান্তির দূত গফফর খান জানতেন কি ঘটেছে বাংলাদেশে। পাক-সামরিক দাপটের সঙ্গে তিনি নিজে পরিচিত। দেশ বিভাগের সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিধানসভায় বাদশা খানের দলের ছিল সংখ্যাধিক্য। জিন্না ভেঙ্গে দিয়েছিলেন মন্ত্রীসভা। কায়েম করেছিলেন সংখ্যালঘু লীগ সরকার। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বাদশা খান। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ, তিনি হিন্দুদের এজেন্ট। ইপির ফকিরকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে যাচ্ছিলেন সীমান্তের এই সত্যসন্ধ নেতা। মিথ্যা অভিযােগ এনেই পাক সরকার তাদের কর্তব্য শেষ করেন নি। নামাজ পড়ার সময় বারবায় জনতার উপর পাক সৈন্যরা চালিয়েছিলেন মেশিনগানের গুলী। আকশ থেকে ফেলেছিল বােমা। খুন করেছিল শত শত নারী পুরুষ এবং শিশু। দিনের পর দিন চলছিল অমানুষিক নির্যাতন। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বাদশা খান অনুমান করতে পেরেছিলেন বাংলাদেশে পাক-সৈন্যদের মারণযজ্ঞের ব্যাপকতা। যাদের অত্যাচারে নিজে তিনি নির্বাসিত তাদের কথার কোন মূল্য তার কাছে না থাকাটাই স্বাভাবিক।
শান্তি দৌত্য নিয়ে বেদনাহত বাদশা খান যেতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে। তাঁকে আমল দেন নি ইসলামাবাদের শাসকগােষ্ঠী। বাংলাদেশের সংগ্রামের মৌল তত্ত্ব জানেন গফফর খান। সমর নায়কদের সহায়তায় পাঞ্জাবী ধনিক শ্ৰেণী চান গােটা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে রাখতে। কায়েমী স্বার্থবাদীদের শাসন বিরুদ্ধে জানপ্রাণ কবুল করে লড়ছে বাংলাদেশ। তাদের সংগ্রাম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সংগ্রাম। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু বেলুচিস্থান কিছুই বাদ পড়তে পারে না এই সংগ্রামের আওতা থেকে। অকপটভাবে বলেছেন বাদশা খান বাঙ্গালীদের অপরাধ তারা নির্বাচনে জিতেছিলেন। আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবী রাতারাতি গজিয়ে ওঠে নি। মাসের পর মাস এ দাবীর অনুকূলে চলেছিল প্রচার কার্য। আর এই দাবীর ভিত্তিতেই তারা নেমেছিলেন নির্বাচনী ময়দানে। পাক-সামরিক শাসকদের দৃষ্টিতে ওটা তখন আপত্তিকর ছিল না। নির্বাচনের পরও ইয়াহিয়া খান আপােষ আলােচনা চালিয়েছিলেন শেষ মুজিবর রহমানের সঙ্গে। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মুজিবের পিঠও চাপড়িয়েছিলেন ইসলামাবাদের ডিকটেটর। তারপর রাতারাতি ইয়াহিয়ার বিচারে মুজিবর রহমান বললেন রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁর ঘাতকদল শুরু করল গণহত্যা। ইসলামাবাদের ভাড়াটিয়া দলগুলাে চালাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। স্বৈরাচারীর পক্ষপুট আশ্রিত সংবাদপত্রগুলােতে প্রকাশিত হচ্ছে আপত্তিকর বিবৃতি। পাক-বেতার সেগুলােকে পৌছিয়ে দিচ্ছে দেশ দেশান্তরে। এসব অপপ্রচারের উত্তর যারা দিতে পারতেন তারা হয় কারাগারে কিম্বা বন্দুক হাতে রণক্ষেত্রে। এই একতরফা ব্যবস্থার নাম প্রশাসন। বাদশা খানের কাছে ওটা দুঃশাসন।
হিসাবে ভুল করেছিলেন খান আবদুল গফফর খান। ইসলামাবাদের শয়তানি জানা থাকা সত্ত্বেও মানুষের উপর আস্থা হারাতে পারেন নি তিনি। দুনিয়ার শান্তিকামীদের এটা একটা ব্যাধি অথবা আজন্ম সংস্কার। তারা পদে পদে ঘা খান, কিন্তু আশা ছাড়েন না। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত। প্রায় চৌত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালী গৃহতাড়িত। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত। দস্যুদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সংগ্রামরত। সংখ্যাগুরু অত্যাচারিতের বাহুতে নৈতিক শক্তি। এ দুয়ের মধ্যে আপােষ রফা অসম্ভব। বাদশা খান নিজেই বলছেন পশ্চিম পাকিস্তানে আবার এক ইউনিট চালু করার ষড়যন্ত্র চলছে। সামরিক দস্যুদের বুটের গুতায় বছরের পর বছর পিষ্ট হয়েছে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। ক্রীতদাসত্ব সহ্য করবেন না এ অঞ্চলের জনসাধারণ। বাদশা খানের সঙ্কল্প কার্যকর করার অর্থ ইসলামাবাদের শয়তান গােষ্ঠীর উচ্ছেদ। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বাংলাদেশ ধরেছে অস্ত্র। বেছে নিয়েছে রক্তের পথ। বাদশা খানের লক্ষের সঙ্গে বাঙ্গালীর লক্ষের তফাৎ নেই। খান আবদুল গফফর খান অহিংস। আর অবস্থার বিপাকে বাংলাদেশ সরকার এবং তাদের সৈন্যদল সহিংস। বাদশা খান যদি বাংলাদেশে এসে জনতার নেতৃত্ব নেন তবে তাঁর পাশে অহিংস যযাদ্ধারাও এসে দাঁড়াবেন। দুষমনের সঙ্গে শান্তির প্রয়াস অবাস্তব। আজন্ম মিথ্যাবাদীকে সত্যাশ্রয়ী করার সাধনা পন্ডশ্রম। রক্ত পিপাসুকে রক্তের স্বাদ ভুলানাে অস্ত্রের জোরে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব বজায় রাখা যাবে না। পাক ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছেন ভুট্টো-কায়ুম-ইয়াহিয়া চক্র। মুজিবর নিরপরাধ। তাঁকে সংগ্রামের পথে। ঠেলে দিয়েছেন ইসলামাবাদের কায়েমী স্বার্থের জিম্বাদররা। এধরনের অপ্রিয় সত্য যিনি বলতে পারেন। তাঁকে কি করে শান্তির দূত হিসাবে মেনে নেবেন ইয়াহিয়া খান?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!