You dont have javascript enabled! Please enable it!

সামরিক একনায়কত্বের পথে

সাময়িক স্বার্থের তাগিদে অবাঙালী শাসকচক্রের হাতে চালিত হয়ে মুসলিম লীগের বাঙালী নেতারা পূর্ববঙ্গের অতি জরুরী প্রয়ােজন গুলাের প্রতিও অবহেলা দেখান। পরিণামে তাঁরা ক্রমাগত জনগণের অপ্রিয় হয়ে পড়লেন। বিষয়টির সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সেই কারণেই ১৯৫২ – তে ধার্য নির্বাচনও ক্রমাগত পিছিয়ে চললেন। উপনির্বাচনের সম্মুখীন হবার সাহসও ছিল না তাঁদের। একটা সময় তাে প্রাদেশিক বিধানসভার ৩৪ টি আসন-ই শূন্য হয়ে পড়ে ছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সংস্কৃতি – সর্বত্র চলেছিল তীব্র সঙ্কট সে সময়। সে-সবের কারণেই পথ উন্মুক্ত হ’ল বিকল্প রাজনৈতিক দলের সামনে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দাবিদার হয়ে এল দুটি রাজনৈতিক দল – ১৯৪৯ সালে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং ১৯৫৩ সালে পূর্ববঙ্গের প্রবীণতম তথা সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কে, এস, পি বা কৃষক-শ্রমিক পার্টি। এই ফজলুল হকই ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। হুসেইন শহীদ সােহরাবর্দি পরে ভাসানির দলে যােগদান করেন। এই দলের পরে নাম হয় আওয়ামি লীগ। আওয়ামি লীগের অন্তর্ভুক্ত শেখ মুজিবর রহমানই বর্তমান মুহূর্তে (অগাস্ট, ১৯৬৮) পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার সংগ্রামের সবাগ্রগণ্য নেতা। (১)

অবাঙালী আমলারাই পূর্ববঙ্গের শাসন কার্য চালাতেন। এদের শাসনে জনগণের বাকস্বাধীনতা, ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার ভীষণভাবে খর্ব করা হয়েছিল। অথচ মুসলিম লীগ এই অবিচারে হয় প্রশ্রয় দিত নয় নিবীর্যের মতাে নিষ্ক্রিয় থাকতাে। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলির প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নূতন পাটি দুটির কোনাে বেগ পেতে হয় নি। সরকারের আনুকুল্যে এবং প্রশ্রয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে যে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা শােষণ করতেন এবং কী পরিমাণে পূর্বপাকিস্তানের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হত দেশের পশ্চিম খণ্ডকেই শুধু শিল্পোন্নত করার উদ্দেশ্যে সে। সবই নূতন পার্টি গুলি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরলাে। সরকারী পক্ষপাতিত্বের ফলে শিল্পস্থাপনে অনুমতিপত্র বা পারমিট এবং আমদানিসংক্রান্ত অনুজ্ঞাপত্র বা লাইসেন্স যে একতরফাভাবে বিতরণ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের – এসবই জন সাধারণের। গােচরীভূত হ’ল নূতন দলগুলির প্রচার গুণে। সমস্যা শুধু শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ ক্রেতা পূর্ববঙ্গে যে সব আমদানীকৃত পণ্যসম্ভার ক্রয় করতেন তার সব ক্ষেত্রেই মূল্যমান ছিল অত্যধিক। অথচ করাচিতে ঐ পণ্য আমদানি করা হয়েছিল অনেক কম দামে। বিক্রয়মূল্যের এই পার্থক্য, যা করাচি এবং পূর্ববঙ্গের যে কোনাে বাজারের মধ্যে দেখা যেত, তার ব্যাখ্যা পরিবহণ ব্যয়ের মধ্যে মিলবে না। এ ছিল মুনাফা শিকার। যার ভুক্তভােগী ছিলেন পূর্ববঙ্গবাসী। এই সব শােষণের চিত্র সরকারী তথ্যপুস্তিকাতেও প্রকাশ পেত। পূর্ববঙ্গবাসী দেশের এই পূর্ব-পশ্চিম খণ্ডের মধ্যে যে-বৈষম্য, তার সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিতও ছিলেন। নূতন রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের চিন্তাভাবনাগুলাে আরাে সুসংহত করেছিল – এই মাত্র। (২)। | পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার জন্য সাধারণ নির্বাচন ধার্য হ’ল ১৯৫৪ র মার্চ মাসে। এই ভােটযুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল ২১-দফা কার্যক্রমের ভিত্তিতে গঠিত। যুক্তফ্রন্ট। আওয়ামি মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টি এরাই ছিল ফ্রন্টের বড় শরিক। লাহাের প্রস্তাবের সূত্র ধরে পূর্ববঙ্গের জন্যে সর্বাঙ্গীণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানানাে হ’ল এই কার্যক্রমে। প্রতিরক্ষা, মুদ্রাব্যবস্থা এবং পররাষ্ট্রনীতি ভিন্ন সর্ব বিষয়ে পূর্ব বঙ্গের স্বাধিকারের এই দাবির সঙ্গে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ববঙ্গে স্থাপনের দাবিও করা হল। অথাৎ মূলতঃ বাঙালী মুসলিমরা যে-সকল দিক থেকে অবাঙালী মুসলিমদের শােষণ-শাসনে নিপীড়িত হয়েছেন এতকাল এবং যার প্রতিকারের চিন্তাও কখনাে করে নি মুসলিম লীগ দল, সেই দিকগুলির সম্পর্কে ইতিকর্তব্যের রূপরেখা স্বরূপ। ছিল ঐ ২১-দফা নির্বাচনী ইশতেহার। যুক্তফ্রন্ট তার প্রচারাভিযানে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম জনজীবনের বাস্তব চিত্রটি মনে রেখেছিল। তাই প্রতি শুক্রবার হাটে-হাটে নামাজ পড়তে জড়াে হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ফ্রন্টকর্মীরা নির্বাচনী প্রচার চালাতেন। হামিদুল হক চৌধুরীর এক পয়সা দামের এক পৃষ্ঠার সংবাদ’ নামের সংবাদ পত্র-ও ফ্রন্টের প্রচারাভিযানে ব্যবহৃত হতাে। এই পত্রিকায় ফ্রন্টের বক্তব্যই স্থান পেত। অন্যদিকে মুসলিম লীগের ছিল সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহারে দলীয় প্রচার চালানাের সুযােগ। সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানিদানও এই দল প্রচার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতাে। অবশ্য জনগণ ধিকৃত মুসলিম লীগ, ৩১০ টি আসন বিশিষ্ট প্রাদেশিক আইনসভায় কোনক্রমে নটি আসন লাভ করেছিল।। অথাৎ মাত্র আড়াই শতাংশ ভােট পেয়ে এবং প্রায় সকল আসনে শােচনীয় পরাজয় বরণ করে, রাজনৈতিক মৃত্যুর সম্মুখীন হ’ল মুসলিম লীগ এই নির্বাচনের ফলে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন মুসলিম লীগের সব চেয়ে নামী প্রার্থী হয়েও অজ্ঞাতকুলশীল পঁচিশ বছরের যুবার কাছে নির্বাচনযুদ্ধে হার মেনে এই মৃত্যুঘন্টাই যেন শুনিয়ে গেলেন। (৩)

অবাঙালী রাজনৈতিক নেতা এবং আমলারা এই নির্বাচনের ফলাফলে এক অস্বস্তিকর এবং অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মুখে পড়লেন। যুক্তফ্রন্ট ৯৭.৫ শতাংশ ভােট পেয়ে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্ত্বশাসন দাবি তুলে ধরবে। সেই সঙ্গে তারা পাকমার্কিন সামরিক সহায়তা চুক্তি সম্পাদনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। জনসমর্থনহীন মুসলিম লীগের। নেতাদের মতাে কিংবা পুতুল-প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলির মতাে আনুগত্য স্বীকার করার পাত্র যে জনতার মাথার মণিরূপ ফ্রন্ট নেতৃত্ব নয়- এটা স্মরণ করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন চক্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাে। নবনির্বাচিত ফ্রন্ট নেতারা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র বিরােধিতা করলে পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তাদের শঙ্কা সত্য প্রমাণিত হল। এই চুক্তির কথা নির্বাচনের পূর্বেই আইজেনহাওয়ার উল্লেখ করেছিলেন। সিডনি হার্জবার্গের মতে, তিনি হয়তাে এই ভেবেছিলেন, লীগ দল আমেরিকার মতাে বৃহৎ শক্তির মৈত্রী অর্জন করার সুবাদে ভােটে কিছু সুবিধা পাবে। ফল হয়েছিল অবশ্যই বিপরীত। (৪) | যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসাবে ফজলুল হক, ১৯৫৪ র ২ রা এপ্রিল পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হবার অল্পকাল পরে ৪ঠা মে কলকাতায় শ্রীঅজিত দত্তর গৃহে ঘরােয়া বৈঠকে প্রসঙ্গক্রমে জানান, হিন্দুদের দুর্গতি নিরসনের ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই কারণ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব অবাঙালীদের হাতে। তথাপি ভাষাগত ঐক্যের তাৎপর্য অনুধাবন করে রাজনৈতিক বিভাজন সত্ত্বেও দুই বাংলার বাঙালীদের একাত্মবােধের কথা তিনি বলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তাব্যক্তিরা এই ভাবাবেগ পূর্ণ বক্তব্যের বিকৃত ‘ভায্য করে রটনা করলাে – হক নাকি পাকিস্তানের সৃষ্টিরই নিন্দা করেছেন। অথাৎ ফ্রন্ট সরকারকে খারিজ করার উদ্দেশ্যে হকসাহেবকে দেশদ্রোহী হিসাবে দেখানাে শুরু হল। ঐ ঘরােয়া বৈঠকে অবশ্য হক সাহেব, আশা প্রকাশ করেছিলেন – পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবার পরে সংখ্যলঘুদের অসহায় দশা দূর করা সম্ভব হবে। (৫)

১৯৫৪ র ১০ই মে হক, তাঁর ভাষণের বিকৃত ভাষ্যকারদের স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন। তিনি বলেছিলেন শুধু এই কথা যে রাজনৈতিক ভেদ বশতঃ বন্ধুত্ব বা যােগাযােগ নষ্ট হয় না। চক্রান্ত আরাে গভীরে চলে গেছে তখন। তা বােঝা গেল, ২৩ শে মে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমসের। সংবাদ দাতা যখন বিবৃতি দিলেন যে করাচিতে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে হক তাঁকে বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতাই তার লক্ষ্য কারণ ভৌগােলিক ব্যবধান ছাড়াও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মধ্যে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত কী হবে – এই প্রশ্নের উত্তরে হক নাকি ঐ সাংবাদিককে বলেন – যখন কেউ স্বাধীনতা চায়, সে তা-ই চায়। বাধা যতােই আসুক। ঐ বিদেশী সাংবাদিক আগাগােড়া বানানাে বিবৃতিকে একটু বিশ্বাসযােগ্য করে তুলতে একথারও উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক নিবাচনী প্রচারে ‘হকের’ ফ্রন্ট, পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দের ন্যূনতার কথা উল্লেখ করেছে। পাট রপ্তানি করে পূর্ববঙ্গ-ই বৈদেশিকমুদ্রার্জনের প্রধান শরিক হয়েও, কেন্দ্রীয় সরকারকে তার সিংহভাগ প্রদান করতে হয় – নির্বাচনী প্রচারে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সাংবাদিক প্রবর এ কথাও মনে করিয়ে দেন। পাকিস্তান সরকার, হকের কথামতাে ঐ সাংবাদিকের বিবৃতি বানানাে মনে না করে, উভয়ের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে উভয়ের। বক্তব্যই প্রচারপুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে। সাংবাদিক কালাহান তাঁর বিবৃতির কোনাে অংশ প্রত্যাহার করেন নি এবং তাঁর সব কথা এবং হকের অস্বীকার ঐ পুস্তিকায় স্থান পায়। (৬)

হক- কালাহান বিতণ্ডা যে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের কারসাজিমাত্র এ সন্দেহ। বদ্ধমূল হয় যখন ১৫ই মে হক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ পর্ব এসে যাওয়া । মাত্র নারায়ণগঞ্জের আদমজি জুট মিলসের বাঙালী এবং অবাঙালী শ্রমিকদের দাঙ্গা বাধলাে। দাঙ্গা দমনে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা দেখালেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত অফিসাররা যাঁরা কেন্দ্রের চর বই কিছু নয়। ২৬ শে মে ‘ডন’ পত্রিকা আইন-শৃঙ্খলার অবনতির দায় চাপালাে। হক মন্ত্রীসভার উপর। অর্থাৎ কালাহান, নারায়ণগঞ্জ, কেন্দ্রস্তাবক প্রশাসন এবং কেন্দ্রের অনুগত ‘ডন’ – এদের সঞ্চারপথ বেশ ফুটে উঠল। হক মন্ত্রিসভাকে অযােগ্যতার অপবাদ দিয়ে তাকে খারিজ করার ফন্দি আঁটা হ’ল। (৭)।

অন্যায়ভাবে হক মন্ত্রিসভাকে যে খারিজ করতে চলেছে কেন্দ্র এই সত্য চাপা দিতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানাের জন্য দায়ী কেন্দ্রের চরসুলভ প্রশাসনকে আড়াল করে অহেতুক দায়ভাগী করা হ’ল হক মন্ত্রিসভাকে। ল, টাইমস (লণ্ডন) এই চক্রান্তে হাত মিলালাে। আরাে এক আজব অভিযােগ করা হ’লহক মন্ত্রিসভার মুজিবর একজন কমিউনিস্ট। মুজিবর ছাড়াও দু’জন কমিউনিস্ট মন্ত্রী আছেন ঐ মন্ত্রিসভায় এই প্রচার করা হ’ল। কেন্দ্রীয় শক্তিচক্রের হাতের পুতুল মুহম্মদ আলি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে হককে বললেন দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক এবং মুসলিমে – মুসলিমে খুনােখুনির নায়ক। ১৯শে এই বেতার ভাষণের দিনই মার্কিন – পাক সামরিক সহায়তা চুক্তি সই করা হয় এবং হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা হয় গভর্নর জেনারেলের আদেশানুসারে। প্রশাসক বসানাে হয় তৎস্থলে। ৩১মে আতাউর, যিনি ঐ খারিজ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তিনি এই আদেশের তীব্র নিন্দা করেন। (৮)। | পূর্ববঙ্গের জনগণের গণতান্ত্রিক রায় নাকোচ করলাে যে-শক্তি তার পিছনে দুনিয়ার পহেলা নম্বরের সামরিক শক্তি-ও রয়েছে। পূর্ববঙ্গবাসী বুঝলাে সবই, কিন্তু করতে পারলাে ।

কিছু। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এর পরে যা করলাে তা থেকে পরিষ্কার হ’ল হককে দেশদ্রোহী বলাটা ছিল একটা কারসাজি। কারণ পরে ঐ হককেই পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পূর্ববঙ্গের গভর্ণর পদে আসীন করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। জেড, এ, সুলেরি হকমন্ত্রিসভা বরখাস্ত করার কুকীর্তিকে ক্ষমতার নিকৃষ্ট অপব্যবহার বলেছিলেন। (৯) | পূর্ববঙ্গে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় নারায়ণগঞ্জ দাঙ্গার পরে। পাকিস্তান টাইমসের এই মন্তব্য থেকেই পূর্ববঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরূপতা স্পষ্ট হবে যে, সুদূর আমেরিকা যদি অনুরূপ কিছু পৌঁছাতে, সেটাই শােভন হ’ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখেও পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষ কমে না পশ্চিম পাকিস্তানী হােমরা-চোমরাদের – এটা এবারে পরিষ্কার হল। (১০) | দেশের পূর্ব এবং পশ্চিম খণ্ডের মধ্যে সমতার যে নীতি বগুড়ার মুহম্মদ আলি তুলে ধরেন, চৌধুরী মুহম্মদ আলি গােষ্ঠী তা গ্রহণ না করায় সংবিধান রচনা সম্পূর্ণ হবার পরেও এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হ’ল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােকে একটি মাত্র প্রশাসনিক এককে পরিণত করার যে-দাবি ঐ পাঞ্জাবী গােষ্ঠী করতে থাকেন এবং যার হয়ে ওকালতি করে চলে ‘টাইমস অব করাচি’র ২০ শে অগাস্ট, ১৯৬৪ র সম্পাদকীয়, তাতে সম্মতি দিলেন না পূর্ববঙ্গের সাংসদরা। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম লীগ পর্যদস্ত হলেও কেন্দ্রীয় সংসদ-সদস্য হিসাবে যাঁরা পূর্বে ছিলেন, তাঁরাই রয়ে গেছেন। পশ্চিমী কুচক্রীদের। সামাল দিতে না পেরেই যে তাঁদের দল জনতা কর্তৃক আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে পূর্ব বঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে সেই কথা মনে করে পূর্ববঙ্গের সাংসদরা ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরােধিতাই করতে চান। এই সময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন গুলাম মহম্মদ এবং চৌধুরী মুহম্মদ আলি। তাঁরা আঞ্চলিক সাব ফেডারেশন নামে পুরানাে ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তান প্রকল্পের এক বিকল্প উপস্থিত করলে নাজিমুদ্দিন তার নিন্দা করে।

চৌধুরী মুহম্মদ আলি গােষ্ঠী চা-পানের মতাে ছুতােয় কালক্ষেপ করে সংবিধানগঠন পরিষদ বা কনসাট টুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির কাজে বাধা দিয়ে চলে। গভর্নর জেনারেল প্রােডা আইনের জোরে সদস্যপদ খারিজ করার ভয় দেখিয়ে চৌধুরীর তাঁবেদারি করে চলেন। গভর্নর জেনারেলের অনুপস্থিতির সুযােগে ১৯৫৪ র সেপ্টেম্বরে এম, সি, এরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রােডা বাতিল করলেন। ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের এর পরে আর আশা নেই বুঝে সি, এ বা কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিটাই বাতিল করা হ’ল গভর্নর জেনারেলের ২৪ শে অক্টোবর, ১৯৫৪ র আদেশবলে। শাসকচত্রের পছন্দ মাফিক সংবিধান না করার কারণেই সদস্যদের এই ভাবে জব্দ করা হল – এই মত প্রকাশ করেন কে, বি, সইদ। (১২)। | ২৫ শে ডিসেম্বর সংবিধানের উদ্বোধন করা হবে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘােষণা শুনেই তড়িঘড়ি ২৪ শে অক্টোবর সি, এ বাতিল করা হয়েছিল। সংবিধান চালু হয়ে গেলে গভর্নর জেনারেল কোনমতেই এভাবে সি, এ বাতিল করতে পারতেন না। কাজটা এমনিতেই বিধিসম্মত ছিল না। অবশ্য সি,এ আর জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করছে না এই আপাতসুন্দর যুক্তি গর্ভনর জেনারেল দেখালেও, সি, এ বাতিল করা উচিত ছিল বঙ্গীয় আইন সভা নির্বাচনে বঙ্গীয় সি, এ সদস্যদের অধিকাংশের দল অথাৎ মুসলিম লীগ পর্যুদস্ত হবার সময়। এ সময় ঐ অজুহাত অর্থহীন ছিল। বাঙালী সদস্যদের বাগে আনতে পারেন নি বলেই এই অদ্ভুত গণতন্ত্রবিরােধী কাজ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করেন ঐ গুলাম মুহম্মদ।

| গুলাম মুহম্মদ পার্লামেন্টে আস্থাবান আদৌ ছিলেন না। বাঙালী যেখানে সংখ্যায় অধিক এবং অবাধ্য তেমন সি, এস র চেয়ে সামরিক এবং প্রশাসনিক মহলের উপরই ভরসা বেশি ছিল এই গভর্নর জেনারেলের। কিন্তু ফজলুল হক, সােহরাবর্দির মতাে অভিজ্ঞ তথা দক্ষ নে তারা, পূর্ববঙ্গীয় যুক্তফ্রন্টের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে আগামী দিনে তাঁদের মৌরসিপাট্টায় চ্যালেঞ্জ জানালে কী ভাবে সামাল দেওয়া যাবে এ তাে ভাবতেই হবে। ভেবে যা তিনি পেলেন, তা হ’ল ফ্রন্টের ঐক্যে ফাটল ধরানাের পথেই তাঁর টিকে থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ইস্কান্দার মিজা বাঙলার গভর্নর হ’য়ে ফ্রন্টের নতুন নেতাদের ভয় এবং প্রলােভনের যৌথ প্রয়ােগে অনেক ক্ষেত্রেই কৰ্জা করে ফেললেন। (১৪)।

ফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে অনেকেই সরকারী সুযােগ-সুবিধা পেলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভুলে যাবেন এটা বুঝে গুলাম মুহম্মদ অগণতান্ত্রিক এবং আজগুবি এক পার্ষদমণ্ডলী তৈরী করলেন। এর মন্ত্রিসভা নামটা এমনিতেই হাস্যকর। প্রতিভাধরদের মন্ত্রিসভা নাম দিয়ে তিনি চাপা হাসির বদলে অট্টহাসির প্রথম জোগান দিয়ে স্মরণীয় হলেন। এই প্রতিভা মন্ত্রিসভা ইস্কান্দারের ফ্রন্ট-বিরােধী কার্যকলাপ এবং কারসাজির পুরস্কার ঘােষণা করলাে তাকে এর আভ্যন্তরীণ বিষয়ের মন্ত্রী করে। আয়ুব প্রতিরক্ষা এবং সােহরাবর্দি আইন দপ্তর। পেলেন। চৌধুরী মুহম্মদ আলির জন্য নির্দিষ্ট হ’ল অর্থদপ্তর। সুবিধাবাদীর ঐক্য টেকে না। ফজলুল হক সােহরাবর্দির বিরােধী বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে সমর্থন করলেন। সােহরাবর্দি। চাইলেন এ এম এল দলের আতাউর রহমানকে যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসাবে। কিন্তু ঢাকায় ১৯৫৫ র ফেব্রুয়ারিতে এ এম এল এবং কে এস পি-র বিরােধ প্রকাশ্য সভাস্থলে ঠিকরে। পড়ে ফ্রন্টের ঐক্য কী স্তরে এসে ঠেকেছে তা দেখিয়ে দিল। দুই দল, একই ফ্রন্টের দুটি পৃথক সভা ডেকে সেদিন দল দুটির মধ্যে স্থায়ী ব্যবধান রচনা করে দিল। (১৫)।

প্রতিভা – মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হতে পেরে সােহরাবর্দির ভােল-বদল হ’ল চূড়ান্ত রকম। মার্কিনী সামরিক সাহায্য চুক্তির তিনি পৃষ্ঠপােষক হয়ে উঠলেন, এমন সংবিধানের খসড়া করলেন যা ইসলামিক সংবিধানে পরিণত হয়েছিল সহজেই। তা ছাড়া পূর্ববঙ্গের দাবি সনদ, যা গত নির্বাচনে ফ্রন্টের জয় এনে দিয়েছিল সে কথা ভুলেও উচ্চারণ করলেন না।

৪০

এত তাঁবেদারি করেও বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে সরানাে বা এ এম এল – চালিত পূর্ববঙ্গীয়। মন্ত্রিসভার ব্যবস্থা — কোনােটিই তিনি ক’রে উঠতে পারলেন না। যে – হককে বিশ্বাসঘাতক বলে নিন্দা করতে এক বছর আগে বাধে নি মুহম্মদ আলির, সেই হকের-ই অনুগামী আবু হুসেইন সরকারকে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বানালেন তিনি। অবশ্য হিন্দু সদস্যরা কলকাতার ১৯৪৬ – এর দাঙ্গার কারণে সােহরাবর্দির চেয়ে হককে বিশ্বাস করতেন ঢের বেশি – এ কারণে হকের মনােনীত ব্যক্তি একটা বাড়তি জোর পেয়ে থাকবেন। এর পরে অবশ্য ফেডারেল কোটের নির্দেশে নূতন কনসটটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির শীঘ্র অধিবেশন আহূত হতে চলেছে দেখে ফজলুল হক সংখ্যালঘুদের আশ্বাস দেন তিনি ধর্মনিরপেক্ষ তথা গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য প্রয়াস চালাবেন। হক-মুহম্মদ আলি সমঝােতার ফলেই আলি সফল হলেন সােহরাবর্দিকে প্রতিভাধরদের মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত করতে। (১৬)

কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির পুনরাবির্ভাব সত্ত্বেও গুলাম রাজনীতিকদের ধার শেষ করে। আগে থেকেই নিরাপদ হয়ে ছিলেন। কিন্তু গুরুতর রােগভার গ্রস্ত গুলাম ১৯৫৫ র অগাস্টে কাজে ছুটি নিয়ে চলে গিয়ে আর কখনােই ফিরে আসেন নি। তখন থেকে গভর্নর জেনারেল হলেন ইস্কান্দার মির্জা। সামরিক বাহিনী থেকে আগত মিজা অনুরূপ একজনকে অর্থাৎ চৌধুরী মুহম্মদ আলিকে প্রধান মন্ত্রী করলেন। এ এম এল ব্যতীত ফ্রন্ট হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝােতার মন্ত্রিসভা গঠন করলে পর, হককে প্রথমেই সংযুক্ত বা ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তান প্রস্তাবে সায় দিতে হ’ল। যুক্তফ্রন্টের পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার সংক্রান্ত দাবির কথা প্রথমে মুখে আনলেও পরে যেন ভুলেই গেলেন হক সাহেব অতীত সংগ্রাম এবং অঙ্গীকারের সমস্ত কথা। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ঐশ্লামিক সংবিধান ও হক মেনে নিলেন। এ সংবিধানে সংখ্যালঘুদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিক বিবেচনা করা হয়েছিল। এবং ধর্ম সম্প্রদায় ভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থাই এতে ছিল। (১৭)।

গুলাম মুহম্মদের অন্তর্ধানে ইস্কান্দার মির্জা এবং চৌধুরী মুহম্মদ আলিই রাজনীতির মঞ্চে মুখ্য ভূমিকায় রইলেন। ফজলুল হকও মেনে নিলেন একই পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে গভর্নর জেনারেল এবং প্রধান মন্ত্রীর বন্দোবস্ত। দ্বিতীয় সি, এ-তে চুক্তি হয়েছিল দেশের দুই প্রান্তের দুই খণ্ড থেকে এই দুই মুখ্য পদাধিকারী মনােনীত হবেন। ফেডারেল কোর্টের নির্দেশ অনুসারে আইনগুলির পুনবৈধকরণ প্রথমে না করে, সি, এ প্রথমেই করলাে সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানবিলের তােড়জোড়। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ঐ অঞ্চলের সব কিছুর বিধাতা হয়ে যাবেন – এমন ব্যবস্থা ঐ বিলে ছিল। স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে ঐ বিল পাশ হবারও পূর্বাহ্নে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের। গভর্নর এবং মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগও করা হল। (১৮) | পশ্চিম পাকিস্তান বিলের উপর বিতর্কে ১৯৫৪-র নভেম্বরে চৌধুরী মুহম্মদ আলির তত্ত্বাবধানে উচ্চপর্যায়ের আমলাদের দিয়ে একটি রাজনৈতিক ইশতেহার প্রস্তুত হয়। তার শিরােনাম ছিল, সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি’ বা ‘ক্লীয়ারিং দি ডেকস। সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তান হলে সংসদে বাঙালীদের দাবিয়ে রাখা যাবে এবং পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও বন্ধ করা যাবে। এসব কথা স্পষ্ট ভাষায় এই বিতর্ককালে জানা গেল। কেন্দ্রীয় সরকার তার মর্জি। অনুসারে সিন্ধুর পিরজাদা মন্ত্রিসভা খারিজ করে, তাঁর এই বিলে আপত্তি ছিল বলে।

পাঞ্জাবের মালিক ফিরােজ খাঁ নূন-ও মুখ্যমন্ত্রিত্ব খােয়ালেন একই কারণে। তার বদলে মুখ্যমন্ত্রী করা হ’ল এমন একজনকে যিনি আইনসভার সদস্যও নন। সীমান্ত প্রদেশের আবদুর রসিদ খান একই কারণে মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারান। তার স্থলে এসে বাহাদুর খান জানালেন—ঐ সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তান বিলের বিরােধীকে পাকিস্তানে অন্তর্ঘাত চালানাের অভিযােগে সাজা পেতে হবে। (১৯)

গণ ভােটের জোরে বিল পাশ করানাের চেষ্টা বা সাহস না করে বিরােধী আইন সভা প্রভৃতির সদস্যদের শাস্তি এবং তাঁদের পক্ষে রায় দিলে বিচারপতির পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হ’ল। পূর্ববঙ্গ-প্রতিনিধিদের সংসদের অভ্যন্তরেও দাবিয়ে রাখার এই চক্রান্তে হক এবং পূর্ববঙ্গের অপর নেতারা কার্যতঃ শরিক হলেন। শীঘ্রই তারা ব্যক্তিগত ক্ষমতাও হারালেন। নিজ প্রদেশের ক্ষতি মেনে নিয়েও তারা শাসকচক্রের কৃপা বেশি পান নি। (২০) | দ্বিতীয় সিএর মারী অধিবেশনে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন এবং দেশের উভয় খন্ডের মধ্যে সমতানীতির শর্তে ঐশ্লামিক সংবিধানের উপরে বিতর্ককালে সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানে সম্মতি দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের সাংসদরা। চুক্তিতে উর্দু, বাঙলার সম মর্যাদা নীতিও গৃহীত হয়েছিল। সাময়িক ভাবে ইংরেজিকেই সরকারী ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার কথাও হয়েছিল। কিন্তু নূতন সংবিধানে রাষ্ট্রভাষার বিকাশ বা ডেভলেপমেন্ট প্রশ্নটি পূর্ববঙ্গের সদস্যদের সন্দিগ্ধ করে তুললাে। যে- সংবিধান এবারে উপস্থাপিত হ’ল তাতে পূর্ববঙ্গের স্বার্থরক্ষা পায় মারী চুক্তির সেই অংশগুলি বাতিল হয়ে গেছে দেখা গেল। ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা করে ফজলুল হক ঢাকার মানুষদের এতই বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ করে তুলেছিলেন যে ঐ সময় তিনি ঢাকা শহরে সভা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। যদিও সংবিধানে। পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্বশাসনের বিধান না থাকার প্রতিবাদে ষাট হাজার মানুষ ঢাকার পল্টন ময়দানে জমায়েত হয়েছিলেন। হামিদুল হক চৌধুরী তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনি স্তাবকতার চরম নিদর্শন রেখে বললেন, সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা তাে রয়েইছে। পূর্ববঙ্গের জন্য। ক্ষমতার লড়াই-এ এ সময় সব চেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন চৌধুরী মুহম্মদ আলি। আতাউর রহমান, হামিদুলের ক্ষমতা হাতানাের ক্রুর কাহিনীর উধ্বর কটাক্ষপাত করেন যুক্তফ্রন্ট পরিষদীয় দলের বৈঠকে। অবশ্য ফজলুর রহমান সংবিধানরচনার ইতিহাসকে এই বলে ব্যঙ্গ করেন যে, এ হ’ল চৌধুরী মুহম্মদ আলির ক্ষমতার সিঁড়ি ব’য়ে শীর্ষে ওঠার ইতিহাস। (২১) | যৌথ নির্বাচন যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় এবং মারী চুক্তিতে গুরুত্ব পেলেও, পাকিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে তার নামগন্ধও ছিল না। ঐশ্লামিকতা নিয়ে সরকার পক্ষ গর্ব করলেও আওয়ামী লীগ এই সংবিধানকে ন্যায়ধর্ম বিরােধী এবং সেই সূত্রে ইসলামবিরােধী বলে চিহ্নিত করে। পূর্ববঙ্গের মুসলিম-অমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দাবি ছিল যৌথ নিবাচন প্রথা। তা অগ্রাহ্য করে ন্যায়নীতিকে বির্সজন দেওয়া হয়েছে—এই অভিমত তারা ব্যক্ত করেন এবং সঙ্গে একথাও বলেন, পাকিস্তান বহির্ভূত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কথা কি এই সংবিধানে আছে ? তারাও তাে ঐশ্লামিক শব্দের আওতায় আসবেন। তা ছাড়া ইসলামের সংজ্ঞা কি নির্দিষ্ট ? ১৯৫৩-র পাঞ্জাবের দাঙ্গার কথা তারা। স্মরণ করিয়ে দেন ঐ সংজ্ঞা প্রসঙ্গে। সমালােচকরা আরাে বলেন, জুয়াখেলা এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ না করে এ সংবিধান ইসলামের মূল আদর্শকেই বহুলাংশে লঙঘন করেছে। এই বিতর্কে যােগ দিয়ে মুজিবর রহমান বলেন—‘পাকিস্তান, পাকিস্তানীদের জন্য। কিন্তু শুধুই মুসলিমদের জন্য তাে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি। মুল্লাদের সমর্থন আদায় করে সেই সূত্রে জনগণকে শােষণ করার জন্য ইসলাম’-এই ল্যাবেল বা বিজ্ঞাপনটা সংবিধান রচয়িতারা গত সাত আট বছর ধরে ব্যবহার করে আসছেন। আতাউর রহমান এই সংবিধানকে তুলনা । করেন ইসলামে নিষিদ্ধ শরাবখানার সঙ্গে যাতে সাইনবাের্ড ঝুলছে-‘ইসলামিক শরাব । খানা। (২২)।

ফজলুল হকের ভােল পাল্টানােতে বিক্ষুব্ধ যতাে হিন্দু এখন আওয়ামি লীগ সমর্থক হয়েছেন তারা এই সংবিধান পাশ হবার পথে রীতিমতাে বাধার সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য মুসলিমলীগ এবং ফজলুল হকের ফ্রন্টের মধ্যে সরকারী আনুকুল্যলাভের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ঐক্যে কোনাে ফাটল ধরে নি এই সময় পর্যন্ত। বিরােধীপক্ষ ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ সভাকক্ষ ত্যাগ করলে সেই সুযােগে সংবিধানের পঞ্চাশটা ধারা পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বিতর্কমূলক ধারাগুলির নিষ্পত্তির জন্য সােহরাবর্দি, বিরােধী পক্ষের নেতা হিসাবে যে গােলটেবিল বৈঠকের পরামর্শ দেন, সরকার তাও প্রত্যাখ্যান করলে আওয়ামি লীগ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। প্রায় সকল হিন্দু সদস্যও তাঁদের অনুসরণে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। সংবিধানের চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার পথে ঐ কক্ষত্যাগ কোনাে গুরুত্ব পায় নি। কারণ একই দিনে অথাৎ ১৯৫৬র ২৯শে ফেব্রুয়ারী এই সংবিধান গৃহীত হয়। এরই ঠিক পূর্বে পূর্ববঙ্গে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। বন্যা নিয়ে বাঙালীরা আরাে বেশি ব্যস্ত থাকুক। সংবিধান নিয়ে মাথা ঘামানাের সময় যেন তারা তেমন না পায়—হয়তাে এই কারণেই বন্যাত্রাণে অত্যন্ত গাফিলতি করে কেন্দ্রীয় ত্রাণদপ্তর। অবশ্য ১৫ই জানুয়ারী তারিখে ভাসানি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন- পূর্ববঙ্গবাসীর উপর অবিচারের অবসান কেন্দ্রীয় সরকার না ঘটালে পূর্ববঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করবে।’ (২৩) | ১৯৫৬-র ২৩শে মার্চ সংবিধান চালু হতেই ফজলুল হক হয়ে এলেন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর। পূর্ববঙ্গ নামটা এতদিন পাল্টাতে পারে নি শাসকচক্র। এবারে এই নামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর সাংস্কৃতিক গৌরবটাও মুছে দিতে প্রথম ধাপ নিল। হকের এতদিনের তাবেদারির কারণটা এবার বােঝা গেল। সােহরাবদি আইনমন্ত্রী থাকা কালে যুক্তফ্রন্টের ২১দফা সম্পর্কে নিশ্ৰুপ ছিলেন—এ অভিযােগ করে হক পূর্ববঙ্গবাসীর সহানুভূতি মােটেও পান নি। কেন্দ্রের অনুগত হয়ে নানা সুযােগ পেলেও তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তিনি নিজ কর্মদোষেই শেষ করে এনেছেন। হকের যেহেতু ঐশ্লামিক সংবিধানে সম্মতি ছিল, হকের দল এবং আবু হুসেইনকে ছেড়ে প্রায় সব হিন্দু রাজনীতিক এসে জুটলেন আওয়ামি লীগে। যার নূতন নামে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নও আর ছিল না। এবং যৌথ নিবাচন যারা চাইতাে। আবু হুসেইন সরকার, হক-পন্থীদের ভরসায় সংখ্যাধিক্য রাখতে আর পারছিলেন না। হিন্দুদের। টোপ ফেলে, এমন কি রাষ্ট্রদূত করে, হিন্দু সদস্যদের সমর্থনের ব্যর্থ চেষ্টাও তিনি করে চললেন। এ সময় টোপ গিলতে লােকও জুটলাে অনেক প্রকার। মােট ৪০ জন মন্ত্রী এবং পার্লামেন্টারি সচিব পদ সৃষ্টি করে তিনি লােকসানাে এক বনাম অর্জন করলেন। তার ৪০ অনুগৃহীতের ললাকে নাম দিল—“আলিবাবা এবং তার ৪০ তস্কর’। লাইসেন্স, পারমিট ইত্যাদির দুর্নীতি এই বামের কারণ ছিল। (২৪)

সংখ্যালঘু সরকার মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার স্বার্থে স্পীকার নির্বাচনের উপলক্ষেই শুধু একবার প্রাদেশিক আইনসভার বৈঠক করতে দিয়েছিল। বড় দেরিতে শুধু বাজেট পাশ করার জন্য ১৯৫৬র ২২শে মের অধিবেশনে সরকারের মুরুব্বি এবং গভর্ণর হকের নির্দেশে অন্য আলােচনা নিষিদ্ধ হবার জন্য ক্রুদ্ধ স্পীকার আবদুল হাকিম, অতিবিলম্বের কারণে ঐ বাজেট পেশ হ’তেও না দিয়ে অধিবেশন স্থগিত করলে, সাংবিধানিক কারণে রাষ্ট্রপতি শাসন ৯দিন চলে। ফের ক্ষমতায় এসে হিন্দু সদস্যদের হাত করতে চেষ্টা করেও সফল না হয়ে হিন্দুদের ভারতের চর বলে নিন্দা করেন আবু হুসেইন সরকার। মুজবর রহমান-ই বাজেট পেশে বিলম্বের প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন। অতএব বিরােধী-স্পীকার যােগসাজশে অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে এমন রটনাও আবু হুসেইনপন্থীরা সে সময় করেছিলেন। এখন পুনর্বার ক্ষমতায় ফিরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার কোনাে সুযােগ করে নিতে পারলেন না হকের অভিভাবকত্বের সুবিধাভােগী এই আবু হুসেইন সরকার। (২৫)।

কেন্দ্রীয় সরকারী কর্তাব্যক্তিরা সব সময়ই চাইতেন সামরিক বাহিনীর প্রতি সাধারণের অবিশ্বাস কমাতে এবং রাজনীতিকদের সাধারণের শ্রদ্ধার আসন থেকে টেনে নামাতে। ১৯৫৬-র জুলাই মাসে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যসমস্যার মােকাবিলায় সামরিক বিভাগের উপর আবু হুসেইন সরকার খাদ্যদ্রব্যের পরিবহন এবং বিতরণের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। অসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ম্যাজিসট্রেট পর্যন্ত ঐ সামরিক কর্তাব্যক্তিদের রূঢ়তা সহ্য করতে বাধ্য হলেন। সরকার মন্ত্রিসভা তার অযােগ্যতা প্রমাণ করে সাধারণের মনে রাজনীতিকদের সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলছে—এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এই জনগণধিকৃত এবং আবু হুসেইন-চালিত সরকারকে না ফেলে বরং জিইয়ে রাখতে চাইলেন কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। ১৯৫৬-র ৪ঠা অগাষ্ট ভুখা মিছিলের পুরােভাগে ছিলেন মুজিবর রহমান। পুলিশের ব্যারিকেড সে মিছিলের গতিরােধ করতে না পেরে গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করলে, মুজিবর স্বয়ং একটি মৃতদেহ তুলে ধরে মিছিলের পথে নেতৃত্ব দিয়ে চলেন। জনতার মন জয় করে নিল মুজিবের এই মহান্ দৃষ্টান্ত। হাইকোর্ট এ সময় যেরায় দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের অধিকার অথাৎ খাদ্যসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের ক্ষমতা সামরিক বিভাগে ন্যস্ত হওয়াকে অসাংবিধানিক এবং বেআইনী বলেছিলেন, শীঘ্রই এক প্রশাসনিক ফরমান জারী হ’ল সেই রায়কেই বাতিল করে। বিচার বিভাগের উপরে ছড়ি ঘােরালাে প্রশাসন, জনগণের উপর সামরিক বিভাগ ! আবুর পুতুল-সরকার এই সব স্পষ্টতঃ অগণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের অংশীদার হয়ে রইলাে। অবশ্য এ সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল। (২৬) ।

১৩ই অগাস্ট বাজেট-অধিবেশন ডাকা হল। অধিবেশন শুরু হবার মাত্র চার ঘন্টা পূর্বে। আবু হুসেইনের অনুরােধে গভর্ণর সেই অধিবেশনের উপর স্থগিতাদেশ জারী করলে, স্পীকার বিরােধীপক্ষের তােলা প্রশাসনে সামরিক অনুপ্রবেশ নিয়ে আলােচনার অনুমতি দিলেন। ২০০ ভােট পড়লাে আবু-সরকারে অনাস্থা জানিয়ে। মােট ২৯৭ জন সদস্য সেদিন উপস্থিত। অধিকাংশ মন্ত্রীই হেনস্তা হবার ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অনাস্থা প্রস্তাব তুলেছিলেন মুজিবর। স্পীকার কিছু সময় পরে অবশ্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেছিলেন।

আইনসভার সদস্যরা তার পরেও দীর্ঘ সময় সভার অনুষ্ঠান করে চলেন। এই সময় প্রস্তাব নেওয়া হয় গভর্ণরকে বরখাস্ত করার দাবিতে। কারণ তিনি সংবিধান লঙঘন করে দলবিশেষের পৃষ্ঠপােষকতা করছেন। সােহরাবর্দি সংবাদ দেন, গভর্নরকে প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙে দিতে বলেছিলেন আবু। এ অতি বড় গহিত কাজ। কেননা, ১৯৫৩র মার্চ থেকে বাজেট পাশ করানাে হয় নি। সােহরাবর্দি শাসকচক্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন—সামরিক বাহিনী শুধু হুকুম তালিম করবে যেমন করেছিল প্রথম সংবিধান রচনা পরিষদ ভেঙে দেবার সময়, তা কিন্তু নয়। একটু পশ্চাদৃষ্টি নিয়ে এই কথা বিচার করে এর মধ্যে সম্ভবতঃ আয়ুবশাহীর অভুত্থানের ইঙ্গিতই পাওয়া যাবে। (২৭)

| কে-এস-পিকে ক্ষমতার স্বাদ দিয়ে তার ঐক্য এবং ভাবমূর্তি নষ্ট করে কেন্দ্রীয় শাসকচক্র এবারে ঐ কর্তব্যগুলাে আওয়ামি লীগের দিকে টানলাে। আস্থা প্রস্তাব এড়াতে পারবে না, তার চাপ কেন্দ্র দিচ্ছে, অতএব ৩১শে অগাস্ট আস্থা প্রমাণ না করে পদত্যাগ-ই করলাে আবু সরকার। আতাউর রহমান আওয়ামি লীগের মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। নামের মধ্যে থেকে মুসলিম শব্দ মুছে এবং যৌথ নির্বাচন চেয়ে হিন্দু সমর্থন ভালােই লাভ করেছিল আওয়ামি লীগ এ সময়। ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর-মন্ত্রিসভা গঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার প্রতিষ্ঠত হয়ে দীর্ঘদিন পরে পালামেন্টারি গণতন্ত্রের পথে ফিরলাে পূর্ব পাকিস্তান। অবশ্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা মিজার অভিসন্ধি হতে পারে না। সামরিক বাহিনীর এই পূবর্তন অফিসার প্রশাসনের অভিজ্ঞতাসম্পন্নও। তাই তার পেটোয়া ডঃ খান সাহেবকে দিয়ে রিপাবলিকান পার্টি গড়ে বেশ কিছু মুসলিম লীগপন্থীকে নিজের দলে টেনে আনলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানে ঐ সােহরাবর্দিদের লােভ-লালসাই আওয়ামি লীগের ঐক্য বিনষ্ট করে তার ইচ্ছা পুরণ করবে-রাজনৈতিক ছকটা তিনি কেটেছিলেন এই নিরিখেই। (২৮)

এবারে মুসলিম লীগ-যুক্তফ্রন্ট সমঝােতায় ফাটল ধরলাে। নূতন রিপাবলিকান দল, মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে, আওয়ামি দলের সঙ্গে মিলে কেন্দ্রে সরকার গঠন করলাে। পূর্বতন প্রধান মন্ত্রী চৌধুরী মুহম্মদ আলি পদত্যাগ করলেন। নূতন প্রধানমন্ত্রী সােহরাবর্দি অবশ্য ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বেশি কিছু না ভাবলেও, প্রকাশ্য সভায় ভাসানি-গােষ্ঠী তার মতের উপর নির্ভর না করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে এবং পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকারের পক্ষে প্রস্তাব নিলেন। ঢাকার সেই জনসভায় সােহরাবর্দি মুখ বুজে সহ্য করলেন। সবই, যদিও তার সােচ্চার নীরবতা বুঝিয়ে দিল তিনি শাসকচক্রের প্রতিই আনুগত্য স্বীকার করে চলবেন এখন থেকে। যতাে তােক প্রধান মন্ত্রীর সম্মান তাে আর হেলার বস্তু নয়। সােহরাবর্দি এবং আতাউর পারমিট, লাইসেন্স ইত্যাদির সঙ্গে সরকারী পদে নিয়ােগের মাধ্যমে তাদের অনুগামীসংখ্যা বাড়িয়ে চললেন; এই সুযােগ ভাসানির ছিল না। ভাসানিকে কোণঠাসা করতে অবাধ স্বজনপােষণ অনুগৃহীত তােষণ ইত্যাদির ব্যবহার করলেন। জাতীয় ব্যবস্থাপক সভা বা সংসদেও প্রথমােক্ত উপদলের সদস্যরাই অধিক সংখ্যায় ছিলেন। এম, এন, এ বলতে আওয়ামী লীগ দলে ঐ সােহরাবর্দি-আতাউর অনুগামীরাই ছিলেন। যাও বা একজন ভাসানি-পন্থী ছিলেন, ডেপুটি মন্ত্রীপদ প্রদত্ত হ’তেই তিনিও পক্ষ বদল করলেন। অবশ্য কাগমারির সভাস্থলে ভাসানি পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন তুলে জনপ্রিয়তার বিচারে উপরে রইলেন। পাক পররাষ্ট্রনীতিরও তিনি সমালােচনা করেন কাউনসিল সভায়। সােহরাবর্দি তারই নেতৃত্বে চালিত নীতির পক্ষে বললেন। অতঃপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভারত এবং পাকিস্তান—উভয়দেশের হিন্দু মুসলমান প্রতিনিধি এবং ভারত সহ নানা দেশের স্মরণীয় ব্যক্তিদের নামে তােরণ ঐ অনুষ্ঠানকে জাতিধমতীত মর্যাদা দান করলাে। অথচ কুৎসাকারীরা ঐ কারণেই ভাসানিকে ভারতের চর বলে নিন্দা করলাে। (২৯)।

১৯৫৭-র ৩রা এপ্রিল অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ পূর্বপাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করে এবংকেন্দ্রের অধিকারসীমা মুদ্রাব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষায় বেঁধে রাখতে চেয়ে প্রস্তাব তুললেন প্রাদেশিক আইন সভায়। মুজিবর তার আবেগময়। বক্তৃতায় প্রস্তাবকারীর ভাষণও যেন ম্লান করে দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর ঐদিন উপস্থিত-ই হন নি। যে-সােহরাবর্দি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার প্রাক্কালে ভাসানিকে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন যুক্তফ্রন্টের সেই ২১-দফার জন্য লড়াই করে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করবেন, তিনি তখনাে কিছু করেন নি এবং এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরাসরি পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য স্বাধিকারের দাবিকে প্রতিহত করতে চাইছেন—এই তথ্য পেশ করতে ভাসানি ৫ই এপ্রিল একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন। মুজাফ্ফর আহমেদের প্রস্তাব সম্পর্কে কেন্দ্রীয় আভ্যন্তরীণ মন্ত্রী বলেন, কেন্দ্র এই প্রকার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের কঠোর হস্তে মােকাবিলা করবে। আওয়ামি লীগ কাউনসিলের পরবর্তী সভা ১৩ এবং ১৪ জুন যখন অনুষ্ঠিত হ’লতার পূর্বেই বেশ কিছু ভাসানিপন্থী উপঢৌকন এবং অন্যায় সুযােগ-সুবিধার টানে সােহরাবর্দির উপদলে ভিড়ে গেছে। সভাস্থলে সােহরাবর্দির সরকারি কর্মচারী, পিয়ন ইত্যাদিও আওয়ামি লীগ কর্মী সেজে ঢুকে পড়ে। ভাসানি সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ভাষণ শেষ না করে সভাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন অন্য উপদলের ভাড়াটে লােকদের উপদ্রবে। ইত্যবসরে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত প্রস্তাব তড়িঘড়ি পাশ করানাে হয়। জনসাধারণকে স্তোক দিতে সােহরাবর্দি গােষ্ঠী আগামী নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সংবিধান পাল্টে পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার বিবেচনা করবে—একথা সেদিন বলেছিল ।(৩০)।

সােহরাবর্দির সুবিধাবাদের চূড়ান্ত রূপটি ফুটে ওঠে জাতীয় ব্যবস্থাপক সভায় হামিদুল হক চৌধুরীর শ্লেষাত্মক ভাষণে। তিনি বলেন, “যে সােহরাবর্দি এই সংবিধানকে কার্যকর হ’তে দেবেন না বলতেন এর পূর্বপাকিস্তান বিরূপতার কারণে এখন তিনিই বলছেন এই সং বিধান পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ দাবি পূরণ করেছে। অনুরূপ প্রাক্তন সংবিধানবিরােধীদের উচ্চপদে নিয়ােগ করা হলে নিশ্চয়ই শতকরা একশাে ভাগ দাবিই আদায় হয়ে গেছে বলা হবে। এর পরেই জুলাই-এর ২৫ এবং ২৬ তারিখে ঢাকা শহরে ভাসানি যেনূতন পাটি গঠনের কথা ঘােষণা করেন, সেই পার্টি বা জাতীয় আওয়ামি পার্টি পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় পাকিস্তানে প্রবলভাবে নানা দলের নেতা এবং সমর্থকের সাধুবাদ লাভ করে। অচিরাৎ এর জনপ্রিয়তা এবং ক্ষমতা এতদূর বৃদ্ধি পায় যে পশ্চিম পাকিস্তান আইন সভার ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এই জাতীয় পার্টির করতলগত হয়। পূর্বপাকিস্তানের আওয়ামি দলের-ও ভাসানি-অনুগামীরা এবং গণতন্ত্রীদল পর্যন্ত ভাসানির নূতন পার্টিতে যােগদানের অনুকূল অবস্থান গ্রহণ করলেন। ইতােমধ্যে এই পার্টির শক্তি বৃদ্ধি পাওয়াতে, রিপাবলিকান পার্টি এবং মুসলিম লীগ-ও এর সমর্থন আশা করতাে। অবশ্য সােহরাবদিও, তার ভাসানি-মুক্ত আওয়ামি লীগের সঙ্গে কে এস পি ইত্যাদির সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাকে কেউ-ই বাধিত করেন নি। নূতন পাটির গঠনের কারণে ২৪শে জুলাই তারিখেই ভাসানি, আওয়ামি লীগ দল থেকে পদত্যাগ করার জন্য ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন ঐ দলের সম্পাদক মুজিবর রহমানের কাছে । (৩১)

পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পার্টি এবং পূর্বপাকিস্তানের ভাসানিপন্থী আওয়ামি লীগের অংশটুকু এবং সেই সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের গণতন্ত্রী দল একত্র হয়ে জাতীয় আওয়ামি পার্টি গঠিত হলেও প্রাক্তন আওয়ামি লীগের প্রধান দাবি এবং প্রাক্তন জাতীয় পার্টির প্রধান দাবি অথাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং একীভূত পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের পূনবিভাজন বিশেষভাবে অন্তর্ভূক্ত ছিল এই নূতন পার্টির ইশতেহারে। অবশ্য পশ্চিম খণ্ডের ভিন্ন প্রদেশদের যােগসূত্র তথা সংহতির উদ্দেশ্যে একটি আঞ্চলিক ফেডারেশন গঠনের কথা এই ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল। অবশ্য ২৫ এবং ২৬ শে জুলাই নূতন দলের অধিবেশনে সােহরাবর্দি স্বয়ং প্রশাসন এবং গুণ্ডাবাহিনীর জঘন্য ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ দলের অনুষ্ঠান। সূচি বানচাল করতে গিয়ে রাজনীতিকদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন। একবার কে, এস, পি একবার সংখ্যালঘু – কোন মহলেই সমর্থন পাকা করতে না পারলেও, প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের। বাদশাহী রাজনীতির পথে পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালী-বিদ্বেষী গভর্ণর গুরমানির সাহায্য নিয়ে সােহারাবর্দি এর আগেই যে ব্যর্থ হন মিজাকে হটাতে, সেই পরাজয়ের গ্লানি যেন ঐ ভাসানি, সীমান্ত গান্ধী, বালুচি গান্ধীদের কনভেনশনে গুন্ডামি দিয়ে কথঞ্চিৎ মােচন করলেন। নিক্ষিপ্ত ইষ্টকখণ্ডে আহত বহিরাগত বর্ষীয়ান নেতারা সেদিন সভাস্থল ত্যাগ করে গেলেও, সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে এই নূতন দল যে সাড়া জাগায়, তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা সােহরাবর্দির হয় নি কোনক্রমেই। রিপাবলিকান পার্টি এখন পশ্চিম পাকিস্তানের একীভ বনের বিরুদ্ধে গেলে, সােহরাবর্দি তাঁর পূর্বতন মত বদলে ঐ সংযুক্ত পশ্চিমপাকিস্তানকেই সমর্থন করতে শুরু করলেন। এত করেও মিজা-খান সাহেব অক্ষের কোন ক্ষতিই সােহরাবন্দি করতে পারেন নি। তাঁর মুরুবি গুরমানিকেই বরং মিজা বরখাস্ত করেন। কে, এস, পি-র আজিজুল গােষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাতও সােহরাবর্দির হ’ল না। আজিজুলের দাবি—মােচায় অমুসলিমদের রাখা চলবে না। এটা মানা সােহারাবর্দি বিচক্ষণতার কাজ মনে করেন নি। (৩২)। | সােহারাবর্দিকে প্রধান মন্ত্রী পদে সহ্যই করতে পারছিলেন না খান সাহেব। এক বছর প্রধানমন্ত্রী পদে এসে তার মধ্যে ২০০ দিন দেশের বাইরে কাটিয়েছেন সােহরাবদি। তাঁর নিজস্ব আওয়ামি লীগ দলভুক্ত মন্ত্রীরা যাতে পালা করে বিদেশ ভ্রমণ করার সুযােগ পান। এবং তাঁর অনুগামীদের যাতে বরাত খুলে যায় সে সব ঠিক ঠিক দেখতেন সােহরাবর্দি। বড় মাপের দুর্নীতির অভিযােগ তাঁর বিরুদ্ধে এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে ছিল। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে মিজাকে সরানাে যাবে এই আশায় এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থনে প্রধান মন্ত্রিত্ব লাভ করা সত্ত্বেও, ভবিষ্যতের চিন্তা থেকে সােহরাবর্দি এই সময় নির্বাচনের দাবি করতে থাকেন। রিপাবলিক্যানদের অনেকের সঙ্গে তিক্ততা সৃষ্টি হবার কারণে প্রকাশ্য জনসভায় পর্যন্ত তিনি রিপাবলিকান দলের নিন্দা করে চলেন। এমন সময় বিনা মেঘেই ।

হ’ল বজ্রপাত। মিজা, ১১ই অক্টোবর সােহরাবর্দিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেন। সংসদে শক্তিপরীক্ষার সুযােগও তাঁকে দেওয়া হল না। সােহরাবর্দিকে অপমান করে তাড়াবার প্রতিবাদে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামি লীগ হরতাল ডেকেছিল। সে হরতালের ডাকে জনসাধারণ সাড়া দেন নি। হরতাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। যৌথ নির্বাচন চালু করা ছাড়া সােহরাবর্দির আমলে ভালাে কিছু হয় নি। ১৯৫৬র অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এবং ১৯৫৭র এপ্রিলে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যৌথ নিবাচন নীতি গৃহীত হয়। অন্যান্য মুসলিম দেশে যৌথ নির্বাচন প্রথার নজির দেখিয়ে এবং আহমাদি দাঙ্গার মতাে সম্ভাবনা এড়াতে সােহরাবর্দি স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথাকে দূরে রাখা প্রয়ােজন মনে করেন। দেশের দুইখণ্ডে একই প্রকার যৌথ নির্বাচন দেশের অখণ্ডতার প্রয়ােজনেই বিবেচ্য একথাও তিনি বলেন। অবশ্য সােহরাবর্দিকে প্রধান মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করার সময় রিপাবলিকানরা, স্বতন্ত্র নির্বাচন সমর্থনের কথা বলে মুসলিম লীগকে জোটের মধ্যে টেনে আনে। অন্যদিকে কে, এস, পি-র হামিদুল হক চৌধুরী পরিচালিত উপদলকে জোটে নিয়ে সরকারের হাত শক্ত করতে গিয়ে উল্টো কথাই তারা বলে চলে ; তারা হামিদুলের জন্য যৌথ নির্বাচনের সমর্থক সাজে। অর্থাৎ সােহরাবর্দিকে দূর করে দিল যে- রাজনীতি, সততার বড়াই তারও সাজে না।(৩৩)।

| রিপাবলিক্যান-মুসলিম লীগ জোটের সরকারে প্রধান মন্ত্রী করা হ’ল আই, আই, চুন্দ্রিগড়কে। চুন্দ্রিগড় কেন যৌথ নির্বাচন হলে সরকারী সংস্রব ত্যাগ করতে চাইতেন জামাত-ই-ইসলামি পাকিস্তানের একটি শ্বেতপত্রে তা-ই বিবৃত ছিল – বলা চলে। পূর্ব পাকিস্তানে ৮৯ টি আইনসভা আসনে হিন্দু ভােটার অন্ততঃ ১২ শতাংশ এবং তাদের মেয়েরাও বেশ ভােট দিয়ে থাকে। এর মধ্যে ১৪ টি আসনে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ৩৫ টিতে হিন্দুরাই মােট ভােটারের ৩৬ থেকে ৪৯.১৯ শতাংশ। অতএব পূর্ব পাকিস্তানে যৌথ নির্বাচন চালু হলে হিন্দুরা ঐ অংশে রাজনৈতিক প্রভাব তাে ফেলবেই, তাদের ছায়া এসে কেন্দ্রে-ও পড়বে। রিপাবলিক্যানরা অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে যৌথ বনাম স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রশ্নে সরেজমিন তদন্তের ব্যবস্থা করে অধিকাংশ পূর্বপাকিস্তানীর অভিমত পরখ করতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠালেন। জাতীয় আওয়ামি পাটি সঙ্গে সঙ্গে সর্বদলীয় কমিটি স্থাপন করে। যৌথ নিবাচনের পক্ষে প্রচারে নামলাে। আওয়ামি লীগও একই বক্তব্য পৃথক মঞ্চ থেকে। প্রচার করে হৃত রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারে লেগে পড়লাে। সােহরাবর্দি বললেন স্বতন্ত্র নির্বাচন হলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে যে সব এলাকায় তাদের নিয়ে হিন্দুরা দাবি করবে। নিজস্ব বাসভূমি বা প্রদেশ। এ ভূমি অতঃপর ভারতেই যােগ দেবে। অর্থাৎ যৌথ নিবাচনই সঙ্গত। স্বতন্ত্র নির্বাচনের বিরুদ্ধেই ঐ কেন্দ্রীয় তদন্ত টীম মতপ্রকাশ করে। চুন্দ্রিগড় এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। (৩৪)।

মালিক ফিরােজ খাঁ নুন নূতন প্রধান মন্ত্রী হলেন। মির্জা এবারে চাল বদল করে বরং মুসলিম লীগ দলকেই মদত দিয়ে চললেন। রিপাবলিকানদের প্রভাব বেড়ে যাওয়াতে এটা করতে হ’ল। অবশ্য রাজনীতিকদের ঐক্য নষ্ট করাই মিজর প্রথম লক্ষ্য। দলাদলি, রেষারেষির টানাপােড়েনে সােহরাবর্দিকেও আমল দিতে হ’ল প্রধান মন্ত্রী নূনকে। সােহরাবর্দির আওয়ামি লীগের সংসদীয় সমর্থন এখন তাঁর প্রয়ােজন। পূর্বপাকিস্তানে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর, মুজিবর-অনুগামীদের প্রিয় ছিলেন না। মুজিবরও মুখ্যমন্ত্রী পদে যােগ্যতর ভাবতেন নিজেকে। প্রাদেশিক স্তরে আওয়ামি লীগের এই অনৈক্য সত্ত্বেও, কেন্দ্রে সােহরাবদিহ নেতা বিবেচিত হতেন। সােহরাবর্দি নির্বাচন দাবি করতে শুরু করলেন। ঐ পথেই স্বেচ্ছাচারী কুচক্রী মিজাকে দূর করতে চান তিনি। মিজাও নির্বাচনের বিরুদ্ধে, রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে প্রচার চালালেন। সংবিধান চালু হবার পরেই সাধারণ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল – এই ছিল আওয়ামি লীগের প্রচার কৌশল। নিবচিনবিধি যৌথ হবে না স্বতন্ত্র হবে – এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা ছিল না সংবিধানে। এর সুযােগেই শাসকচক্র যে নির্বাচন শিকেয় তুলে রেখেছে – একথাও বলা হ’ল ঐ সব প্রচারাভিযানে। নির্বাচনের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে, মিজা-এ সময় নতুন করে মুসলিম লীগের মাধ্যমে যৌথ নির্বাচন বিধি খারিজ করার কাজে নেমে পড়লেন। নির্বাচন যতাে পিছিয়ে যাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দৌড়ে মির্জা ততােই এগিয়ে যেতে পারবেন। অতএব নির্বাচনে বাগড়া দাও। নিবার্চন-বিধি নিয়ে বিতণ্ডা ফের চালু করাে। অবশ্য চৌধুরী মুহম্মদ আলি বা সােহরাবর্দি-ও প্রধান মন্ত্রী পদে আসীন থেকে প্রতিশ্রুতিমতাে নির্বাচন-অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি – একথাও সত্য। কারণ ঐ পিচ্ছিল পদে থেকে পদচারণা করলে পদসস্থলনেরই সম্ভাবনা। স্রেফ বসে থেকে বা ক্ষমতার দালালদের পদচিহ্ন ধরে চললে, প্রধান মন্ত্রিত্বের মেয়াদ। তবু দু দণ্ড বাড়তে পারে। সুতরাং ওঁরাই বা মেয়াদ কমাতে সক্রিয় হবেন কেন? ১৯৫৮ র ২৯ শে জানুয়ারি মুজিবর সংসদ-ভাষণে জানতে চান – সংবিধান পাশ করার তিনবছর পরেও কোন অদৃশ্য হাতের খেলায় ভােটগ্রহণ হ’ল না? ভােটার তালিকার পর্যন্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় নি। করিম বলেন – বিগত সংসদের সদস্যদের মতােই আমরা কিছু করি না, আবার সংসদ ছাড়িও না। ইচ্ছে করি সংসদটা এভাবেই থেকে যাক। কিন্তু তবুও বিগত সংসদটিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।(৩৫) | সামরিক শাসন প্রবর্তনের অশুভ ইঙ্গিত এল ১৯৫৭ র ডিসেম্বর নাগাদ। ও, সি, ডি বা অপারেশন ক্লোজড ডাের অর্থবহ শব্দসমষ্টি নয়। রুদ্ধকক্ষ কার্যক্রম বললে কাৰ্যটাই যে কী তা অস্পষ্ট থেকে যায়। স্পষ্ট অবশ্য দ্রুত হ’ল। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান চোরাচালান রদে সামরিক বাহিনীর সাহায্য চেয়ে বসলেন। এই বাহিনী শুধু চোরাচালান বন্ধ করতে এল তা নয়। জনসাধারণের উপর এবং বিশেষত সংখ্যালঘুদের উপর প্রতিহিংসা। চরিতার্থ করলাে তারা। একাধারে সেনা, ম্যাজিসট্রেট, বিচারক সব দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে অবিভক্ত ভারতের আমলের কিছু কলমদানি রাখার দায়ে হেনস্থা করে তারা। একজনকে। উপযুক্ত সরকারি পারমিট নিয়ে কিছু পণ্য মজুত করে সাজা পেল এক দোকানী। এই সব তথ্য সংসদে পেশ করেছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। একজন উচ্চশ্রেণীর আইনজ্ঞ হিসাবে তিনি নিজে এই ঘটনাগুলাে পরখ করে দেখেছিলেন। অবশ্য চোরাচালান বলে অপরাধমূলক কার্যকলাপের মধ্যে যতােই ফেলা হােক, হরিয়ানা থেকে আসা গবাদি পশু কিংবা ভারতে চালান দেওয়া সুপারি বা পাট – পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবনের বাস্তব অর্থনীতির অপরিহার্য অঙ্গ। এসব বন্ধ করলে প্রাণে মারা পড়বেন অনেক স্বল্পবত্ত কৃষক তথা ব্যবসায়ী। এ সবের আমদানি এবং রপ্তানির বিকল্প বাজার সৃষ্টি না করে, চোরাচালানবিরােধী ভাবাবেগ খাইয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলােকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না – এই।শ্লেষােক্তি করেন সংসদভবনে হামিদুল স্বয়ং। (৩৬)

অন্যদলভুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করতে ও, সি, ডি-র ব্যবহার করতে আতাউর বড় উৎসাহ পেতেন। কিন্তু এই ও, সি, ডি-ই তাঁর নিজের কাল হ’ল। হিন্দুদের সম্পত্তিলুঠ, নারী-শিশু অপহরণ, অন্যান্য উৎপীড়ন ও,সি,ডি চালালাে। আতাউর, এ সব বন্ধ না করে গুজব বলে উড়িয়ে দিলে ও, সি, ডি যা চাইছিল তা-ই হ’ল। আতাউর-সরকার, সংখ্যালঘু সমর্থন খােয়ালাে। জাতীয় আওয়ামি পার্টির মামুদ মুলতবি প্রস্তাবের উপর বিতর্ক কালে বলেন, আতাউর সমরনায়কদের অভিসন্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করে ও, সি, ডি কে আহ্বান করে এনেছেন। অবশ্য আওয়ামি লীগের এই আতাউর পরিচালিত মন্ত্রিসভা ফেলে দিতে চাইছিল যে কে, এস, পি এবং মুসলিম লীগ, তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বলে ভাসানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ আদেশ করা সত্ত্বেও পূর্বপাকিস্তান আইন সভার জাতীয় আওয়ামি পার্টির সদস্যরা আতাউর- সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা-ভােট দিয়ে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে, আতাউর সরকার এ যাত্রা বেঁচে যায়। সরকার ফেলে দিলে ঐ কট্টর সাম্প্রদায়িক শক্তি ফের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় সংখ্যালঘু নিধন করে ছাড়তাে। তা ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে কেন্দ্র হয়তাে পালামেন্টারি শাসন ব্যবস্থাই বানচাল করে দিত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঐ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সেক্ষেত্রে চলতাে। অবশ্য জাতীয় আওয়ামি পার্টি বা ন্যাপের বিধায়কদের কাজের ফলে আতাউর – মন্ত্রিসভার পতন কিঞ্চিৎ বিলম্বিত হলেও প্রতিহত হয়নি। (৩৭)।

পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকরাও কতাে অপরিণামদর্শী তার প্রমাণ অচিরেই মিললাে। ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত যে-প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন চলার কথা, ৩১শে মে, বাজেট পর্যন্ত পেশ না করে তাকে স্থগিত করতে গভর্নর ফজলুল হককে অনুরােধ করে বসলেন আতাউর। হক, রাজী হলেন না এবং জানালেন আতাউর মন্ত্রিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নেই। ক্রুদ্ধ আতাউর ৩১শে মে তারিখেই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ করলেন ‘হককে হটান। সঙ্গে সঙ্গে হকই ঐ একই দিনে আতাউরকে বরখাস্ত করে নিজ পেটোয়া আবু হুসেইন সরকারকে মুখ্যমন্ত্রী বানালেন। আবুর কথায় ঐ হক-ই এবারে আইনসভা স্থগিত করে দিলেন। শেষে সমর্থন তুলে নেবার ভয় দেখিয়ে সােহরাবদি বাধ্য করলেন নূনকে ঐ হককে বরখাস্ত করতে। প্রধান সচিব হামিদ আলি ১লা এপ্রিল থেকে অস্থায়ী গভর্নর হলেন। অবাঙালী হামিদ, ১২ ঘন্টা আগে সৃষ্ট মুখ্যমন্ত্রী আবুকে দিলেন বরখাস্ত করে। গভর্ণর হবার এক ঘন্টার মধ্যেই হামিদ ফিরিয়ে আনলেন আতাউর-চালিত সরকারটি। এই নিয়ােগ- বরখাস্তের চালাচালি শেষ হ’ল মুজিবর আনীত আস্থাজ্ঞাপক প্রস্তাবের পক্ষে আতাউর সরকার আইন সভার সম্মতির প্রমাণ পেলে। (৩৮)। | এর পরে ১৮ই জুন আইনসভায় পরাজয় বরণ করে আতাউর পদত্যাগ করলে ফের আবু মুখ্যমন্ত্রী হন। ২২শে জুন হট্টগােলের মধ্যে মুজিবর আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের পরিণামে আবু-ও পদত্যাগ করলে, ২৫শ জুন প্রেসিডেন্টের আদেশে পালামেন্টারি শাসনব্যবস্থার উপর স্থগিতাদেশ জারী হয়। আওয়ামি লীগ, নূনকে বলে কয়ে ২৫শে অগাস্ট আতাউরকে ফের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ফিরিয়ে আনেন। পূর্বপাকিস্তানে স্বায়ত্বশাসনের বিরােধিতা করেছিলেন সােহরাবর্দি সে কথা ভুলে তাঁর অনুগামী আওয়ামি লীগ পুনরায় ঐ মর্মে প্রচার চালিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনে সচেষ্ট হ’ল। মিজাকে না সরালে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে – এমন কথা পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন মুজি। ভারতে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে একথা বলে সােহরাবর্দি অনুযােগ করেন, পাকিস্তানে আজও একটা সাধারণ নির্বাচন হ’ল না। (৩৯)।

১৯৫৮-র সেপ্টেম্বরে মিজা স্বাক্ষর করলেন ১৯৫৯ এর ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন বিলে। এদিকে আজিজুল, হামিদুলের শত্রু, পুরানাে কে, এস, পির আমল থেকেই। সেই হামিদুল এখন কেন্দ্রেরমন্ত্রী তাে হয়েইছেন, সােহরাবর্দির সঙ্গেও মাখামাখি। করছেন। হামিদুলকে জব্দ করা যাবে সােহরাবর্দির দল আওয়ামি লীগের আতাউর-চালিত মন্ত্রিসভা খারিজ করতে পারলে। স্পীকার আবদুল হাকিম আবার এই আজিজুলের বন্ধু। আওয়ামি লীগের এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিল, স্পীকার বিরােধীদের মদত দিয়ে আতাউরসরকার ফেলে দেবেন। এই স্পীকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলাে আওয়ামি লীগ।

স্পীকার তাঁর পদাধিকার বলে ঐ অনাস্থা প্রস্তাব তুলতেই দিলেন না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ লঙঘন করে সরকারি উকীল ইত্যাদি পদে নিযুক্ত ছয়জন আওয়ামী লীগ বিধায়ককে সভাকক্ষ থেকে তাড়াবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিধায়ক ও বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যে ২০ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ র আইনসভা কক্ষ হয়ে ওঠে রীতিমতাে নারকীয় তাণ্ডবক্ষেত্র। স্পীকার সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। পরে ঐদিন তাঁর বিরুদ্ধে দুটি প্রস্তাব পাশ করা হয় ঃ একটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা ব্যক্ত হয়, অন্যটিতে তাঁকে বিকৃতমস্তিষ্ক প্রতিপন্ন করা হয়। (৪০)।

২৩ শে সেপ্টেম্বর যখন প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন শুরু হতে চলেছে তখন আতাউর-সরকার নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে আছে। কে, এস, পির অথাৎ বিরােধীদলভুক্ত কিছু সদস্যকে টাকা দিয়ে হাত করেছিল আওয়ামি লীগ। সরকার পক্ষ সেনা, পুলিশ ইত্যাদির জোরে হাকিমকে সভাকক্ষে ঢুকতে দেয় নি, যদিও ডেপুটি স্পীকার সাহিদ আলি ঢুকে পড়েন এবং হাকিমের বদলে তিনিই স্পীকারের আসন দখল করেন। বিরােধী সদস্যরা হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছিলেন – তা সে চেয়ার, মাইক্রোফোন রড যাই হােক – তাই ছুড়ে অচৈতন্য এবং আহত করেন সাহিদকে। সাহিদকে হাসপাতালে দেওয়া হয়। পুলিশ। ইত্যাদি দাঙ্গারত বিরােধীদের অনেককেই সভাকক্ষ থেকে বহিষ্কৃত করে দেয়। এতে ধস্তাধস্তিও হয়। সরকার এত সব সত্ত্বেও অপর একজনকে স্পীকারের চেয়ারে বসিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যায় ঐ যুদ্ধক্ষেত্র শান্ত হয়ে এলে। ২৪ শে সেপ্টেম্বর আইনসভা স্থগিত করা হয়। ২৬ শে ঐ হাসপাতালেই সাহিদ আলির মৃত্যু হয়। (৪১)।

পাকিস্তানে পালামেন্টারি গণতন্ত্রের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল। নানা দলকে খুসি রেখে মন্ত্রিসভা বাঁচাতে গিয়ে নূন মন্ত্রিসভায় এক সময় দু’জন অর্থমন্ত্রী ছিলেন – আমজাদ আলি এবং হামিদুল হক চৌধুরী। অবশ্য শীঘ্রই আওয়ামি লীগ প্রতিনিধিরা ঐ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। তখন অর্থমন্ত্রী পদের দ্ব্যর্থকতা দূর হয়। কিন্তু এ সবই অর্থহীন হয়ে পড়লাে ৭/৮ অক্টোবরের রাতভর রাজনৈতিক নেতাদের যখন গ্রেপ্তার করলাে সামরিক কর্তৃপক্ষ। ৮ ই অক্টোবর সমরবিভাগের করা খসড়া হু ছেপে প্রভাতী পত্রিকাগুলি তার শিরােনাম-সংবাদে জানালাে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মিজা, সংবিধান, সংসদ, প্রাদেশিক আইনসভা এবং কেন্দ্রীয় তথা প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা সব বাতিল বা বরখাস্ত করে দিয়েছেন। সেনাবিভাগের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহম্মদ আয়ুব খানকে মুখ্য সামরিক প্রশাসক এবং ১৯৫০- এর সাম্প্রদায়িক ধ্বংস লীলার প্রধান স্থপতি আজিজ খানকে সহকারী মুখ্য সামরিক প্রশাসক পদে নিযুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট মিজা— এ সংবাদও প্রকাশ পেল। এর পরে মিজা, আয়ুবকে প্রধান মন্ত্রীর শিরােপা দান করলেন। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই মিজাও পদ ত্যাগ করলে আয়ুব প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রধান মন্ত্রী পদের বিলােপ সাধন করেন। আয়ুব একথাও বলেন, মিজা পদত্যাগ করেছেন ঘটনা এমন নয়। মিজাকে তিনিই নাকি বরখাস্ত করেছেন। নিয়ােগকারীকে বরখাস্ত করার বৈধতার প্রশ্ন অবশ্য সামরিক বাহিনীতে অবান্তর। (৪২)

আয়ুবের অন্যতম জীবনীকার, মহম্মদ আহমদ লিখেছেন, গুলাম মহম্মদ একাধিকবার আয়ুবকে বলেছিলেন সরকারের দখলদার হতে। কিন্তু গুলাম মহম্মদের চেয়েও ক্রুর সব। চাল চেলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মিজা, রাজনীতিকদের ঐক্য, আদর্শবাদ এবং শক্তি শেষ। করে আনার পরেই আয়ুব ক্ষমতা গ্রাস করলেন। আয়ুব-ই পশ্চিম পাকিস্তানকে এক প্রদেশে। পরিণত করার প্রধান হােতা, এবং সলেরির সেই অভিমত যে, সামরিক শাসন না চাপালে ঐ কৃত্রিম পশ্চিমপাকিস্তানী ঐক্য ধ্বংস হ’ত – এ সবই তকাতীত। কিন্তু আসল কথাটা বলে গেছেন কে, জে, নিউম্যান – যে-সংবিধান মাত্র আড়াই বছর আগে পাশ হয়েছে তার। কার্যকারিতা পরখ করার মতাে যথেষ্ট সময় না কাটতেই, মিজা তার উৎসাদন করে কী বুঝিয়ে দিচ্ছেন না যে, গণতান্ত্রিক ঐ প্রথা চালু থাকলে তিনি আর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন না বলেই সে সবের সমূলে উৎপাটন করতে হল। নিউম্যানের এই বক্রোক্তি আসলে সরল এবং সত্য তাৎপর্য বহন করে। গুলামের হিংস্র আঘাত সংবিধান গৃহীত হওয়া শেষ মুহূর্তে বানচাল করেছিল। আয়ুবের আঘাত-ও সাধারণ নির্বাচন আসন্ন এমন দিনে এল। আক্রান্ত অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রকামী রাজনীতিকরা। আয়ুব অবশ্য গণতন্ত্রের পয়লা নম্বর শত্রু মিজাকেও হটিয়ে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেন। তার কারণ নিশ্চয়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাভীতি। অবশ্য সামরিক প্রশাসনের খবরদারির মধ্যে রাজনীতিকদের স্বাধীন ভাবে কাজের সুযােগ কোনােদিনই ছিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোর করে উৎখাত করে তার আযােগ্যতাকে এই বিলােপের কারণ বলাটা যে ভণ্ডামি এই মত এ প্রসঙ্গে প্রকাশ করে উইলক আসলে সত্যটাই উদ্ঘাটিত করেছেন। (৪৩)।

১৯৫৪-৫৮ র বছরগুলােতে পূর্বপাকিস্তানের উপর পশ্চিমপাকিস্তানী শােষণ-পীড়নের কোনাে হেরফের হয় নি। অথচ পূর্ব পাকিস্তানী সরকার কেন্দ্রের বরাদ্দ অর্থ খরচ করতে ব্যর্থ হয় – এ অপবাদ পশ্চিমী তথা কেন্দ্রীয় মহল রটাতাে। সংসদ কক্ষে একবার মুজিবর তিক্তকণ্ঠে এই অপবাদের পেছনে যে তা আছে তা ফাস করে দিতে গিয়ে বলেন – পরিকল্পনামতাে কাজ শুরু করতে গিয়ে দফায় দফায় প্রশাসনিক বিভাগগুলাের দরজায় ধরনা দিতে দিতে, ঐ কাজের মেয়াদ ফুরিয়ে যায় বলে টাকা ফিরে যায়। কেন্দ্রীয় আমলাদের বাধাতেই পূর্ব পাকিস্তান সরকার সময়মতাে কাজ তুলতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী সােহরাবর্দির উদ্যোগে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্ত ৫৮ টি শিল্পোদ্যোগ অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। সােহরাবর্দির পতনের পর সবটাই চাপা পড়ে যায়। অথচ ঐ ৫৮ টি উদ্যোগ কার্যকর হলে পূর্ব পাকিস্তান বিশেষভাবে উপকৃত তাে হতই, পশ্চিম পাকিস্তানও হ’ত। কেন না, দুখণ্ডেই কিছু কিছু শিল্প স্থাপনের ভাবনাচিন্তা ঐ প্রকল্পে ছিল। ফিরােজ খাঁ নূন তখনকার পূর্ববঙ্গ সরকারের উপর কেন্দ্রের পেষণের একটি দৃষ্টান্ত গণপরিষদে তুলে ধরেছিলেন। কেন্দ্রীয় ভাণ্ডার ভিন্ন অন্য উৎস থেকে কোনাে শিল্পজাত দ্রব্য স্বাধীনভাবে ক্রয় করার অধিকার পূর্ববঙ্গ সরকারের ছিল । এমন কি, তিন-চার টাকা দামের যে পাম্প তারও কয়েকটা কিনতে পারে নি একবার ঐ পূর্ববঙ্গ সরকার। কারণ ঐ জলের পাম্প ঘটিত পরিকল্পনাটি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমােদন লাভ করে নি। পূর্বপাকিস্তানের ছােট ব্যবসায়ীদের নিজদেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য পৌছে দেবার রাস্তাই ছিল না বহু ক্ষেত্রে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতাে। এদিকে ও, সি, ডির ছুতােয় চোরাচালানের উপরে খড়হস্ত কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি ঐ রাস্তার সমস্যার সরেজমিন তদন্তে আসেন। স্থানীয় মানুষের ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ এই কেন্দ্রের চরবাহিনী কারুর সমস্যাই তেমন কানে নেয় নি। নিলেই কী বুঝতাে কিছু, ভাষাই যেখানে বাধা! তাঁরা আরামে বিলাসে থেকে টি, এ ইত্যাদি ভাতা হাতিয়ে প্রভুকে খুসি করার মতাে রিপাের্টই পাঠালেন। পূর্ববঙ্গে নতুন রাস্তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। গণপরিষদে এবং সংসদে পূর্ব পাকিস্তানীরা এই দুরভিসন্ধি প্রসূত প্রতিবেদনের তীব্র সমালােচনা করেও কোনাে সুফল লাভ করেন নি। (৪৪)। | কেন্দ্রীয় সরকার, ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৫-৫৬ র বছর গুলােতে প্রতিরক্ষা-ব্যয় করেছিল মােট ৭০৫.৭০ কোটি টাকা, যার সবটাই পশ্চিম পাকিস্তান অংশের কাজে এসেছিল। ১৯৫৬-র ১৬ ই জানুয়ারী আবুল মানসুর আহমদ, কেন্দ্রীয় তথ্য বিজ্ঞাপন এবং ফিল্ম দপ্তর প্রকাশিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গণপরিষদের সদস্যদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানীরা কেন্দ্রীয় রাজস্ব থেকে মাথাপিছু বৎসরে পান ১ টাকার বেশি (১ ১/৮ টাকা), পূর্ব পাকিস্তানীর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৩২ টাকা। কেন্দ্রীয় দপ্তরের উচ্চপদে বাঙালীদের নিয়ােগ কী অনুপাতে করা হ’ত, ১৯৫৬ -র শুরুতে লব্ধ পরিসংখ্যান থেকে তা স্পষ্ট হবে। ১৯ জন সচিবের একজনও বাঙালী ছিলেন না। ৫০ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন বাঙালী। ১৩৫ জন উপসচিবের মধ্যে ১০ জন এবং ৫৩০ জন অধস্তন সচিবের মধ্যে ৩০ জন – এই ছিল বাঙালীর জন্য বরাদ্দ। ১৯৫৮ র মার্চেও দেখা গেল, সহকারী সচিব পদে বাঙালী ১৬ জনের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানী ছিলেন ১৫১ জন। তথ্য এবং বেতার বিভাগের মন্ত্রী ১৯৫৮ র ৩রা মার্চ জানান, তাঁর বিভাগে সচিব, দু’জন উপসচিব এবং চারজন অধস্তন সচিব আছেন – তাঁরা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী। অবশ্য পূর্ববঙ্গ থেকে একজন অধস্তন সচিবও তাঁর বিভাগে ছিলেন। প্রেস কমিশনের নয় জন সদস্যের মধ্যে কিং বা গবেষণা-পদে বা পরিদর্শক পদে কোনাে বাঙালী ছিলেন না। ১৯৫৮ র ৪ ঠা মার্চ মুহম্মদ আবদুল খালেক বলেন, পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ জেগে উঠছে যে সব কারণে তার থেকে উপযুক্ত পাঠ নিয়ে দেওয়ালের লিখন পড়তে হবে। নইলে সে ভাঙন শত আওয়ামি লীগও রুখতে পারবে না। (৪৫)।

১৯৫৫ র ৩১ শে অগাস্ট আবুল মনসুর আহমদ, পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যান পত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, পাট পূর্ববঙ্গজাত। তথাপি পাট থেকে লব্ধ বৈদেশিক মুদ্রার বৃহৎ অংশই পূর্ববঙ্গের আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহৃত হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ দেখান, ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৪-৫৫ পর্যন্ত হিসাবে গড়ে বাৎসরিক ৩৪ কোটি ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক রক্ত শুষে নিয়ে তার প্রাণপ্রবাহ শুকিয়ে দেবার ব্যবস্থাই চালু আছে। কোনাে সভ্যসমাজে এ সবই অচিন্ত্য। ভােগৌলিক কারণেই দুরস্থিত কেন্দ্র পূর্ববঙ্গের প্রতি নজর রাখতে পারে না – এ-ও যদি ক্ষেত্রবিশেষে সত্য হয়, তবে এ-ও তাে হবে পূর্ব খণ্ডের স্বাধিকার দাবির পক্ষে আর একটি যুক্তি। (৪৬)

ব্রিটেনের অনুসরণে ১৯৪৯ সালে ভারত অবমূল্যায়ন মানলেও পাকিস্তান মানলাে না। এর কুফল ফললাে পূর্ববঙ্গে পাট উৎপাদনে জড়িত মানুষদের উপর। অবমূল্যায়নে আপত্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের। তাদের যন্ত্রাংশাদি আমদানির পক্ষে অবমূল্যায়নে অসুবিধাই হ’ত। তা ছাড়া, ১৯৪৮-৪৯ সালে ২৫ বছর মেয়াদী পাটক্রয় চুক্তির যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছিল, হামিদুলের মতে, তা ব্যর্থ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। হামিদুল ঐ চুক্তিকল্পে বৈঠকাদি সব কিছু সদস্য হিসাবে দেখেছিলেন। ১৯৪৯- এ পাট সংক্রান্ত যে আদেশনামা যা ১৯৫৭- তে বিলে রূপায়িত হয়, তার ফলে পূর্ববঙ্গের পাটচাষী পারমিট ধারীর শিকারে পরিণত হয়। সরকার নির্দিষ্ট ন্যূনতম মূল্য তারা দিত না। মিথ্যা রসিদ করে নিত এটা বােঝাতে যে ন্যায্য মূল্যেই পাট কেনা হয়েছে। গণপরিষদে ১৯৫৬-র ১৭ ই মার্চ, আবদুর। রহমান খান বলেছিলেন – গত পঞ্চাশ বছরে ব্রিটিশ এবং হিন্দু বেনিয়ারা একযােগে পাটচাষীর যে ক্ষতি করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি করছে সরকারের মুদ্রা নীতি (অথাৎ অবমূল্যায়নে বিরত থাকা)। (৪৭)

বন্যার মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দমনেও পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষে কোনাে হেরফের হয় নি কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিদের। বন্যায় নদীগর্ভে বাড়তি পলি জমে নদীর তলদেশ ৫ – ৬ ফুট উচু করে পুনঃ পুনঃ বন্যাই ডেকে আনতাে। অথচ পলি উদ্ধারের ব্যবস্থা হত না। বন্যা যে শুধু মানুষ এবং গৃহপালিত পশুসম্পদের বিনাশ ঘটাতাে তা নয়। কৃষিকর্মের সর্বনাশ হ’ত এর ফলে। ১৯৫৬ – র ১৮ ই মার্চ মুজিবর রহমান বলেন তিনি তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখাতে পারেন কী বিপুল সংখ্যায় অর্থসঙ্কটে ক্লিষ্ট পূর্বপাকিস্তানীরা ভারতে চলে যাচ্ছেন নিছক প্রাণের তাগিদে। আতাউর রহমান বলেছিলেন – ‘কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়ে আপনারা নতুন রাজধানী গড়ার বিলাসিতায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেন। অথচ ডুবে। মরছে বা রােগে মরছে যে পূর্ব পাকিস্তানীরা, জলে ভাসছে যে পূর্বপাকিস্তানীরা তাদের বাঁচাতে কয়েক কোটি টাকাও আপনারা বরাদ্দ করেন না। আপনাদের খয়রাতির বহরটা তাে ঐ ২৫ বা ৩০ লাখ টাকা। (৪৮)। | একে তাে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প স্থাপন করতেই দেবে না, তদুপরি পশ্চিমী আমলাদের খবরদারি চলবে যে মুষ্টিমেয় শিল্প কেন্দ্রের আনুকূল্যে পূর্বপাকিস্তানে স্থাপিত তাদের উপর – এই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অভিসন্ধি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পাদির জন্য প্রাপ্ত ১১২৫ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ অর্থ ছিল মাত্র ১২৬ কোটি টাকা। ১৯৫৬ র সংবিধানে পূর্ব পশ্চিম সৌষম্যের কথাটা ছিল কথার কথা। সােহরাবর্দির মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী আমজাদ আলি ১৯৫৭ ৫৮ র কেন্দ্রীয় বাজেটে এই ব্যবস্থা করে ছিলেন যে, ইতােমধ্যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের জন্যই বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কার্যতঃ সীমিত থাকবে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পবিকাশ বন্ধ করার এই চক্রান্তে চৌধুরী মুহম্মদ আলির হাত আছে এমন সন্দেহ হামিদুল হক চৌধুরী প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনের কথাটাই বলেছিলেন। চৌধুরী মুহম্মদ আলি নিশ্চয়ই আমজাদ আলির মাধ্যমে তাঁর পরবর্তী প্রধান মন্ত্রীর জনপ্রিয়তা ধ্বংস করতে এ কাজ করিয়েছেন। সর্বমােট হিসাব নিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বরাদ্দ ঢের বেশি হলেও, উন্নয়ন নামের খাতে এই তফাৎ কমিয়ে একটা সমতার বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৫৮-৫৯ এ। পূর্বখণ্ডে ৪৫ কোটি টাকার স্থলে ঐ খাতে পশ্চিমখণ্ডে দেখানাে হয়েছিল ৫৪ কোটি টাকা। (৪৯) | ১৯৫৬র ২১ শে মার্চ মুহম্মদ আবদুল খালেক গণপরিষদে অভিযােগ করেন, সরবরাহ এবং উন্নয়ন আধিকারিকের দপ্তরে বিভিন্ন উচ্চপদে পূর্বপাকিস্তানীদের প্রতি উপেক্ষা করে সংবিধানের ৩১ ধারা লঙঘন করা হয়েছে। কারণ সমতার নীতি মানা হয় নি। ২৭ জন আধিকারিকের মধ্যে ২৬ জনই ছিলেন ঐ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী। ডিরেক্টর জেনারেল বা তাঁর চার ডেপুটির কেউ-ই পূর্বপাকিস্তানী ছিলেন না। পি, আই, ডি, সি বা পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন সংস্থাতেও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের দৃষ্টিকটু সংখ্যাধিক্য। মুজিবর রহমান। ২১ শে মার্চ তারিখে বলেন, ‘পি, আই, ডি, সির প্রতিশ্রুতির কোনাে মূল্য নেই। স্থানীয় লােকেরা বড় অফিসারদের কারসাজিতে চাকুরী পায় না। যদিও পূর্বপাকিস্তানের। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এ প্রতিশ্রুতি মতাে ৭৫ শতাংশ চাকুরী স্থানীয়দের-ই পাবার কথা। মহাশয়, বাংলার মানুষরা কি পাকিস্তানের-ও মানুষও নন? পি, আই, ডি সি তার ৬১ টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ১৭ টি পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে রেখেছে। ১৯৫৬- ৫৭ র কেন্দ্রীয় বাজেটের স্মারকলিপি উদ্ধৃত করে একই দিনে জহিরুদ্দিন জানান, পি, আই, ডি, সি-র যে ১৬ টি প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৩ টির অবস্থান পূর্ব পাকিস্তানে। এ অবস্থায় কী কারণে। পূর্বপাকিস্তান, পাকিস্তানের অঙ্গীভূত থাকবে?’ (৫০)। | পি, আই, ডি, সি-র যে নগণ্য সংখ্যক প্রকল্প পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল তার প্রায় সকল শেয়ার মালিক এবং অধিকাংশ কর্মচারী হ’তেন পশ্চিম পাকিস্তানী। ১৯৫৬- র ২১ শে মার্চ মুজিবর জানান, একজন বাঙালী-ও অন্য দেশ থেকে কয়লা ক্রয় করার সরকারী অনুমতি পান নি। নিউজপ্রিন্ট বিতরণেও চুড়ান্ত পক্ষপাতিত্ব ছিল। পশ্চিম। পাকিস্তানের সংবাদ দৈনিকের ৩২, ৩৬ এমন কি ৫৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেখা যেত। পূর্ব পাকিস্তানের দৈনিক সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল চার বা ছয়। বাণিজ্যিক লাইসেন্স, পারমিট থেকে জাহাজে পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পণ্য আমদানি করতে গিয়েও পূর্ব পাকিস্তানীরা বৈষম্যের ক্রুর নীতির শিকার হতেন। প্রচুর ঘুষ দিয়ে মশলা প্রেরণার্থে জাহাজে জায়গা পেতে হত। জাহাজে পণ্য বােঝাই সংক্রান্ত স্থানবরাদ্দ নিয়েও একটি সরকারী বাের্ড ছিল ১৯৫৭ সাল থেকে। তার ফলে ঐ দুর্নীতির কোনাে হেরফের হয় নি। ফরিদ আহমদ এই বাের্ড সম্পর্কে ১৯৫৮ র ১১ই মার্চ মন্তব্য করেন – ‘এবাের্ড পূর্বপাকিস্তানীর মর্যাদাহানিতে ইন্ধন জোগায়। (৫১)

১৯৫৬-র ১৭ ই মার্চ গণপরিষদে জহিরুদ্দিন এক সরকারী শ্বেতপত্রের তথ্য উদ্ধৃত করে জানান, ঘনবসতির পূর্ববঙ্গে কৃষির প্রসারের আর সুযােগ না থাকায় তার প্রয়ােজন। শিল্পায়ন। অথচ শিল্প প্রতিষ্ঠিত একতরফা হয়ে চলেছে পশ্চিম পাকিস্তানেই। এন, এ, কুরেশির গবেষণা থেকে জানা যায়, শ্রমজীবীদের বেকারি পূর্বখণ্ড ১৭ শতাংশ এবং পশ্চিমে মাত্র ৪.৭ শতাংশ। তথাপি ৫৫ শতাংশ পাকিস্তানীর বাসভূমি পূর্বখণ্ডে মাত্র ৫ টি কর্ম বিনিয়ােগ কেন্দ্র রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা ১৩।(52)

৫৫

ভােগ্যপণ্যের ব্যবহারের সংকেতেও দেখা যায়, ১৯৫১-৫২ তে যে-সব ক্ষেত্রে পূর্বপাকিস্তান, পশ্চিমের চেয়ে এগিয়ে ছিল বা তুল্যমূল্য ছিল, ৭-৮ বছরেই সেই সব ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান ঢের পিছিয়ে পড়েছে। মাথা পিছু বস্ত্রের ব্যবহার ১৯৫১ র আমলে বাৎসরিক গড় হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১.৭ গজ, পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা ছিল ১.৪। ১৯৫৯-৬০-এ পশ্চিমের সংখ্যা উঠে পড়লাে ৯ এর স্তরে, আর পূর্ব পাকিস্তানের সং খ্য হ’ল ৩। ১৯৫৯-৬০ এ বিদাতের ব্যবহারের তুলনামূলক বিচারে পশ্চিমের ২৮.৮ কিলােওয়াটের স্থলে পূর্বের পরিমাণ ছিল ১.৬ কিলােওয়াট। পেট্রোলের সূচকগুলাে ঐ বৎসর ছিল ১.৩ গ্যালন এবং .১ গ্যালন। এ সবই মাথা পিছু বার্ষিক হিসাব। সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের নীতির কুফল স্পষ্ট। এস, ইউ খানের গবেষণা লব্ধ এই সকল তথ্যে বােঝা যায়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৫৫ তে চালু হলেও পূর্ব-পশ্চিমের সমতার কোনাে চিহ্ন ধরা যায় নি। আতাউর ১৯৫৬ র ১৯ শে মার্চ, এই ভেদনীতি সম্পর্কে তিক্ত মন্তব্য করে বলেন, পাকিস্তান যেন এক চাকার গাড়ি। একটি চাকা ধ্বংস করেই যেন গাড়িটা চালানাের চেষ্টা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় শাসকচক্রে কোনাে আস্থা পূর্বপাকিস্তানীর নেই – এর জন্য দায়ী ঐ চক্রই। (৫৩)।

১৯৫৭-র আদমসুমারিতে প্রকাশ পায়, শিল্প ইউনিটের মােট সংখ্যার মাত্র ১৮ শতাংশ পূর্বপাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। উৎপন্ন পণ্যের ২৬ শতাংশ এবং গড় দৈনিক কর্মনিয়ােগের ৩০ শতাংশ মাত্র পূর্বপাকিস্তানের অংশে পড়েছিল। শিল্পে অনুন্নত রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে বাধ্য করা হ’ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহুল পরিমাণে ভােগ্যদ্রব্যাদি আমদানি করতে। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫১-৫২র গড় হিসাবে, নুরুল ইসলাম প্রদত্ত তথ্যানুসারে পূর্ব পাকিস্তান যেখানে সাড়ে বাইশ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করতাে, পশ্চিম পাকিস্তান সেখানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে-পণ্য আমদানি করতাে তার মূল্য ছিল ৫ কোটি টাকার চেয়েও কম। ১৯৫৬ র ৩১শে জানুয়ারি সােহরাবর্দি বলেন – “ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযােগ ছিল আমাদের দেশের অর্থ তারা চালান করছে নিজের দেশে। একই প্রকারে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থও চালান করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে উৎপন্ন হস্তচালিত তাঁতবস্ত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে করাচিতে ঢুকতেই পেতনা। কৃত্রিম ভাবে পূর্ব পাকিস্তানী শিল্পপতিদের বাজার কেড়ে নিতে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিরা সাময়িক ভাবে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রয়ের ক্রুর পথও ধরবে – এ আশঙ্কাও পূর্ব পাকিস্তানীদের ছিল। (৫৪)।

| ডঃ কলিন ক্লার্ককে উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়ােগ করেছিল পাকিস্তান সরকার। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প এবং পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষি বিকাশের সুপারিশ করেছিলেন। শাসকচক্র তাঁর সুপারিশ প্রকাশ পর্যন্ত করে নি। পূর্ব পাকিস্তানীরা বুঝে ফেলেছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানাতে চায় কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। ১৯৫৮র ১লা মার্চ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস ঠিক এই কথাই বলেন। পূর্ব পাকিস্তানকে অবর-অস্পৃশ্য মনে করা হচ্ছে এ কথাও তিনি উল্লেখ করেন। পরের দিন, ক্লার্কের রিপাের্ট চেপে যাওয়ার কথা তুলে মুহম্মদ আবদুল খালেক বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের চিরস্থায়ী বাজার বানাতে চায় পূর্ব পাকিস্তানকে আমাদের শাসকবর্গ।

হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভাসানি যে পাকিস্তানকে বিদায় জানাবে পূর্ববঙ্গ একথা বলেছিলেন তার মূলে আছে সঙ্গত ক্ষোভ এবং নৈরাশ্য।” (৫৫)।

পাকিস্তানে যেন দুটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি বিরাজ করতাে। পূর্ব পাকিস্তান বিদ্বেষী মিঞা দৌলাতানাও গণপরিষদে এ সময় বলেন – একটা জনসমষ্টির বিবেচনা শুধুই ভুল না ভেবে পূর্ব পাকিস্তানীদের আশঙ্কা এবং অবিশ্বাসের সঙ্গত কারণ আছে এ সম্পর্কে আমরা সচেতন হয়েছি।” ২৬শে অগাষ্ট ১৯৫৫ দৌলাতানার এই উক্তির কয়েকদিন পরেই আতাউর রহমান ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে বিবৃত করেন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। পশ্চিম পাকিস্তানী শক্তিচক্রের কয়েকজন নেতা আতাউরকে তাঁর লাহােরে বাসস্থানে নামাজ পড়তে দেখে বলেন – ‘আপনি তাে খাটি মুসলমান। আপনার তাে বাঙলা ভাষার হয়ে দাবি তােলা। চলে না।’ ইসলামের বিধি মেনে যিনি চলবেন তাঁর জন্য বাঙলা ভাষা হবে নিষিদ্ধ বস্তু – এই ফরমান বঙ্গভাষাভাষী ভালাে মনে নেবে কেমন করে ? গেজেট, পাশপাের্ট, বিমানবন্দরে ঘােষণা – সর্বত্র বাঙলা ভাষাকে মুছে ফেলে বাঙালীর ভাবাবেগ এবং সাংস্কৃতিক অধিকার পদদলিত করতে চায় বলেই এই সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের প্রবেশ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কোন তদন্ত করে নি। (৫৬)।

| পরবর্তী বৎসর (১৯৫৬) মুজিবর গণপরিষদে অনুযােগ করেন, ‘পরিষদের দৈনন্দিন নির্দেশবার্তাও উর্দু এবং ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়; বাঙলাভাষা এখানেও পরিত্যক্ত। ঢাকা বিমান বন্দরেও বাঙলা ভাষা নিষিদ্ধ এবং জুরিখ, লণ্ডন, জেনেভা ভ্রমণে গিয়েও বিদেশের অনুভুতি এত তীব্র হয় নি, করাচিতে এলে যতাে হয়- ১৯শে মার্চ আতাউরের এই উক্তি এবং ২২শে মার্চ জহিরউদ্দিন নিবেদিত এই সংবাদ যে পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে চাল সরবরাহ না করার সাফাই হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তান বিদেশে চাল রপ্তানি কৃত্রিমভাবে বন্ধ রেখেছে যাতে চালের মজুত ধরা না পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তাব্যক্তিদের অপশাসনে পূর্বপাকিস্তানীর দুর্দশার দিকটি আবার তুলে ধরলাে। পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ পশ্চিম পাকিস্তানীদের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে’ – এ সত্যও আতাউর স্বরচিত “ওজারতির দুই বছর’ গ্রন্থে বিশদভাবে আলােচনা করে দেখিয়েছেন। (৫৭)।

প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্তারা পূর্ববঙ্গবাসীকে কী চোখে দেখে থাকেন তার একটি নিদর্শন এই যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পরের নয় বছরে বেঙ্গল রেজিমেন্টে মাত্র দুটি ব্যাটেলিয়ন যুক্ত হয়েছে। সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, গােলাগুলি বন্দুকের কারখানা প্রতিষ্ঠা অথবা সামরিক কলেজ স্থাপন সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবি উপেক্ষা করার পরেও সামরিক বিভাগের প্রধান মুহম্মদ আয়ুব খান বলে দিলেন – “পশ্চিম পাকিস্তানের উপরই পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নির্ভর করবে – পূর্ব পাকিস্তান আত্মরক্ষার সুযােগ পাবে না। এই স্বৈরাচারীর বিদ্বেষপ্রসূত বন্দোবস্তে আস্থা রাখলে কি চীন, ভারত প্রভৃতি বৃহদায়তন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। — এ প্রশ্নও তুললেন আতাউর রহমান খান। ১৯৫৫ – তে পাকিস্তানী প্রধান মন্ত্রী যে প্রিক্যাডেট কলেজ পূর্ববঙ্গে হতে চলেছে বলে স্তোক দিয়েছিলেন ১৯৫৭৫৮ র বাজেটেও তদ্রপ কোন কলেজের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয় নি এ তথ্য পেশ করেন ফরিদ। ১৯৫৬-৫৭ র বাজেটে চট্রগ্রামে নৌঘাঁটি নির্মাণের ভাসাভাসা ইঙ্গিতটুকুই ছিল না। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব তথ্য প্রয়ােজনীয় ঐ স্কোবাক্যে তার চিহ্নও ছিল না। পিটার পল গােমেজ বলেন – “পূর্ববঙ্গের জনগণের সঙ্গে সংস্রবহীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিয়ে গড়া পাকিস্তানী যে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন আছে, এ বাঙলার সাধারণ মানুষ তাকে দখলদার সেনা বই অন্য কিছু ভাবে না। (৫৮)

১৯৫৪-৫৮ -এই সময় জুড়ে সংখ্যালঘু দলনে এবং কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের উৎপীড়নে ঘন ঘন সামরিক বাহিনীর ছল বল কৌশল ব্যবহার করেছে ঐ শাসকচক্র। নিরাপত্তা আইনের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনা বিচারে আটক রাখার এক জঘন্য রেওয়াজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৯৫৮ র ৭ ই জানুয়ারি সংসদের। অধিবেশনে সদার ফজলুল করিম এই উক্তি করেন – এই নিরাপত্তা আইনকে জনসাধারণ এখন আর দেশের নিরাপত্তার আইন ভাবেন না। তাঁরা জেনে গেছেন, এ হল ‘গদির’ নিরাপত্তা রক্ষা করার আইন। ক্ষমতাসীন চক্র যাতে ক্ষমতায় নিরাপদে টিকে থাকেন, এ তারই আইন। এই আইন নিয়ে লােকে হাসি তামাসা করেন। গভীর আলােচনা কালে অবশ্য তাঁরা বােঝেন – এই আইনে আটক হলে বুঝতে হবে আটক ব্যক্তি প্রকৃত দেশপ্রেমিক। একই দিনে হামিদুল বলেন, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের ন্যায্য দাবির সমর্থন করার কারণে। তাঁকে বিনা পরােয়াণায় বিনা কৈফিয়তে গ্রেপ্তার করা তাে হয়-ই – সঙ্গে তাঁর সংবাদপত্র ‘পাকিস্তান অবসাভার’ প্রকাশ করাও ঐ একই কারণে বন্ধ করা হল। মামুদ আলি ঐ দিন জানান, নিরাপত্তা আইনে তাঁদেরও নির্বিচারে আটক করা হয়েছে যাঁদের বীরােচিত সংগ্রাম পাকিস্তানের জন্মকথার অন্যতম অধ্যায়। (৫৯) | এই অধ্যায় শেষে এই কথাই মনে হবে যে, পাকিস্তান সরকারের আমলাতন্ত্র এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ জোট বেঁধে পূর্ব পাকিস্তানীদের পীড়ন করে চলে বলেই নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের যে – দাবি জাগরূক হয়, তাকে দমন করতে ফের ঐ সামরিক বাহিনীর তৎপরতা দেখা যেত। আবুল মনসুর আহমদের কথায় – ‘পাকিস্তানী রাজনীতিকদের উপরে এক দুরূহ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম এবং ধর্মবিশ্বাস – এই দুটি বিষয়ে মিল থাকলেও ভাষা খাদ্য পােশাক জীবনধারা, আচার-আচরণ সমস্ত বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ভৌগােলিক অবস্থানেও বিচ্ছিন্ন তথা দূরবর্তী এক অঙ্গের সঙ্গে অপর অঙ্গের মিশ্রণে গড়া এক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে যে অনন্য যােগ্যতার প্রয়ােজন হয়, যে বিচক্ষণতার প্রয়ােজন হয়, পাকিস্তান সরকারের। পরিচালনায় তার হদিশ মেলে নি কোনােদিন।(৬০)

References:

  1. J. SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan, pp. 43-47, 85-89. ATAUR RAHMAN KHAN, Ojarotir Dui Bachchar [i.e., Two Years in Power), Dacca, Abhijan Printing House, 1964, pp. 21-29; (in Bengali).
  2. CAP Debates, 1 September 1955, Vol. I, No. 14, pp. 388-90. CAP Debates, 16 January 1956, Vol. I, No. 51, pp. 1816-25. CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, pp. 1846-48. CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, p. 67.
  3. K. CALLARD, Pakistan : A Political Study, pp. 57-58. H. TINKER, India and Pakistan, p. 77. CAP Debates, 31 August 1955, Vol. I. No. 13, pp. 371-72. KHONDKAR ABDUL KHALEQUE, Ek Shotabdi [i.e., One Century-a political biography of Fazlul Haq), Dacca, Prokash Bhaban, 1963, pp. 205-8. (In Bengali).
  4. SIDNEY HERTZBERG, “The Crisis in U.S. Foreign Policy”, Commentary, June 1954, p. 524. The New York Times, 21 April 1954. The Round Table, June 1954, p. 289.
  5. Dawn, 9, 11 May 1954. AJIT KUMAR DATTA, Interview, 6 January 1967. One of the topranking lawyers at the Calcutta High Court, Ajit Kumar Datta is the son of Kamini Kumar Datta, a member of Pakistan’s Constituent Assembly.
  6. The New York Times, 23 May 1954. Dawn, 25, 26 May 1954.
  7. J. SENGUPTA, n. 1, pp. 186-87. Ittefaq (Dacca), 16 May 1954. ALEXANDER CAMPBELL, The Heart of India (New York, A. A. Knopf, 1958), p. 264. Dawn, 26 May 1954.
  8. J. SENGUPTA, n. 1, pp. 188-89. The Times (London), 25 May 1954. Dawn, 26 May, 31 May, 1 June 1954. The Economist (London), 22 – May 1954, p. 612. HERBERT FELDMAN, A Constitution For Pakistan, pp. 59.60. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 8 February 1956, Vol, 1, No. 67, p. 2717 ; speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Ibid., p. 2718.
  9. Z. A. SULERI, Politicians & Ayub (Rawalpindi, Capital Law & General Book Depot, 1964), p. 133.
  10. The Pakistan Times, 16 August 1954. United States, Congress, House of Representatives, Committee on Foreign Affairs, 84th Congress, 1st Session, Mutual Security Act of 1955, p. 144.
  11. CAP Debates, 15 September 1954, p. 361. SULERI, n. 9, pp. 7374. K. B. SAYEED, Pakistan : The Formative Phase, p. 420. The Times of Karachi, 20 August 1954.
  12. SAYEED, n. 11, p. 422 ; also see Ibid., pp. 420-21. Speech by M. M. IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 9 September 1955, Vol. I, No. 20, p. 630. Speech by FAZLUR RAHMAN, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, p. 2047. Dawn, 21, 23, 25, October 1954. L. Binder, Religion and Politics in Pakistan, pp. 352-61. The Times of Karachi, 17 September 1954. For an entirely biased account of circumstances leading to the dissolution of the Constituent Assembly, see AYUB KHAN, Friends Not Masters (London, Oxford University Press, 1967), pp. 50-53.
  13. SAYEED, n. 11. p. 422. TINKER, n. 3, p. 77. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan, pp. 74-75. AYUB KHAN, Message to the Nation (Karachi, Ferozsons, 1958), pp. 4-5. KARL VON VORYS, Political Development in Pakistan (Princeton University Press, 1965), pp. 93-94.
  14. KEITH CALLARD, “The Political Stability of Pakistan”, Pacific Affairs, March 1956, p. 11. FELDMAN, n. 8, p. 60. S. GUHA, Swadhin Purba Bangla, pp. 42, 45-46. CAMPBELL, n. 7, pp. 264-65.
  15. SENGUPTA, n. 1, pp. 224-30. G. W. CHOUDHURY, “The East Pakistan Political Scene 1955-1957”, Pacific Affairs, December 1957, p. 312. SULERI, n. 9, p. 134. Pakistan Observer, 18 February 1955. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, CAP Debates, 14 September 1955, Vol. I, No. 24, p. 766.
  16. SENGUPTA, n. 1, pp. 234-37. GUHA, n. 14, p. 45. Pakistan Observer, 3, 4, 5, 6, 7 June 1955. Dawn, 8 July 1955. G. W. CHOUDHURY, n. 15, pp. 312-13. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, CAP Debates, 23 January 1956, Vol. I, No. 54, p. 1931.
  17. SENGUPTA, n. 1, pp. 238-41. GUHA, n. 14, pp. 57-58. KHALID B. SAYEED, “The Political Role of Pakistan’s Civil Service”, Pacific Affairs, June 1958, p. 134. G. W. CHOUDHURY, n. 13, pp. 75-76. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 7 September 1955, Vol. I, No. 18, p. 531.

AHMAD, CAP Debates, 8 February 1956, Vol. I, No. 67, p. 2661. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, CAP Debates, 21 January 1956, Vol. I, No. 53, pp. 1911-12.

  1. Speech by MAULANA A. R. TARKABAGISH, CAP Debates, 21 January 1956, Vol. I, No. 53, pp. 1890-91. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Ibid., pp. 1903-04, 1911. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 27 January 1956, pp. 2116-17. [Sharab Khana=Liquor shop.]
  2. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP Debates, 23 January 1956, Vol. 1, No. 54, p. 1940. CAP Debates, 7, 29 February 1956. CALLARD, n. 3, pp. 121-22. Speech by NURUR RAHMAN, CAP (Legislature) Debates, 20 March 1956, Vol. I, No. 5, p. 254. Pakistan Observer, 16 January

1956.

  1. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, CAP Debates, 25 August 1955, Vol. I, No. 11, p. 296. GUHA, n. 14, pp. 54-56. Speech by A. K. FAZLUL HAQ, CAP Debates, 23 January 1956, pp. 1932-33. SENGUPTA, n. 1, pp. 245-48 ; Sengupta, an Indian journalist stationed in Dacca, was requested by Abu Husain Sarkar to act as a mediator, and help Sarkar in patching up differences with some Hindu legislators and bringing them back to the United Front. 25.G. W. CHOUDHURY, n. 15, p. 316. Pakistan Observer, 22, 23 May, 1, 2, 3, June 1956. SENGUPTA, n. 1, pp. 251, 253-54. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY (ex-Foreign Minister), NAP (i.e., National Assembly of Pakistan) Debates, 13 April 1957, Vol. II. No. 6, p. 313.
  2. Pakistan Observer, 1, 2, 11, 12 July, 4, 5, 15, 16, 20, 21 August 1956. SENGUPTA, n. 1, pp. 249-50, 253, 259. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, National Assembly of Pakistan Debates (NAP Debates for short), 8 January 1958, vol. I, No. 2, p. 196.
  3. Ittefaq, 13, 14, 17, 18 August 1956.
  4. SAYEED, n. 17, p. 135. CHOUDHURY, n. 15, pp. 316-17. Ittefaq, 6, 7, September 1956. Morning News (Dacca), 24 August 1956. Speech by M. A. KHUHRO, NAP Debates, 12 April 1957, Vol. II, No. 5. p. 233.
  5. Azad (Dacca), 7, 8, 9 February 1957. Ittefaq, 7, 8, 9 February 1957.. Pakistan Observer, 12, 13, 14 September 1956 ; 7, 8, 9 February
  6. Morning News, 7, 8, 14 February 1957. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 143-44. Speech by MIAN MUMTAZ MUHAMMAD KHAN DAULATANA, NAP Debates, 13 February 1957, Vol. I, No. 4, pp. 261, 270-71. RICHARD D. LAMBERT, “Factors in Bengali Regionalism in Pakistan”, Far Eastern Survey, April 1959, pp. 56-57.
  7. Dawn, 3, 4, 5 April 1957. Pakistan Observer, 12, 13, 14, 17 June 1957. SENGUPTA, n. 1, pp. 326-34. CHOUDHURY, n. 15, pp. 318-19.
  8. Pakistan Observer, 18 June, 24, 25 July 1957. SENGUPTA, n. 1, pp. 335-36.
  9. Pakistan Observer, 18 April, 24, 25, 26, 27 July, 10 August, 23 September 1957. Dawn, 26, 27 July 1957. Pakistan Times, 12 May, 18 September, 4 November 1957.
  10. SAYEED, n. 11, pp. 429-30. SENGUPTA, n. 1, pp. 357-60. Dawn, 10, 12, 13 October 1956. The Times, 31 October 1957. Speech by SUHRAWARDY, NAP Debates, 22 April 1957, Vol. II, No. 13, pp. 84147. Speech by M. A. KHUHRO, Ibid., pp. 1011-14. Speech by M. A. KHUHRO, NAP Debates, 20 April 1957, Vol. II, No. 12, p. 804. SAYEED, n. 17. p. 136.
  11. SAYED ABUL ALA MAUDOOHI, in JOSHUA FAZL-UD-DIN, Separate Electorates-The Life blood of Pakistan (Lahore, Panjabi Darbar Publishing House, 1956), Part III, Chapter I, esp., pp. 129, 14245. Jamaat-e-Islami Pakistan, White Paper on The Electorate Issue (Karachi, n.d., 1958?), pp. 7-20, 23. Dawn, 23 October 1957. Ittefaq, 3, 6. December 1957. Pakistan Observer, 3, 6 December 1957.
  12. Speech by SARDAR FAZLUL KARIM (now belonging to the National Awami Party), NAP Debates, 7 January 1958, Vol. I, No. 1, p. 82. Speech by SARDAR FAZLUL KARIM, NAP Debates, 21 February 1958, Vol. II, p. 360. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Ibid., pp. 355-56. NAP Debates, 13 March 1958, Vol. II, pp. 1445, 1448-49. WAYNE A. WILCOX, n. 20, p. 200.
  13. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, NAP Debates, 8 January 1958, Vol. I, No. 2, pp. 195-97. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 3 March 1958, Vol. II, pp. 668-70. KHALID B. SAYEED, “Martial Law Administration in Pakistan”, Far Easern Survey, May 1959, p. 73. Pakistan Observer, 18 December 1957.
  14. Pakistan Observer, 18, 22, 23, 25 March 1958. HENRY FRANK GOODNOW was not probably correct in observing that the O.C.D. raised the popularity of the army in East Pakistan-GOODNOW, The Civil Service of Pakistan (New Haven, Yale University Press, 1964), p. 107. BHUPENDRA KUMAR DATTA, Interview, 12 September 1966.
  15. Ittefaq, 1, 2 April 1958. Pakistan Observer, 1, 2 April 1958. GOODNOW, n. 37, p. 95.
  16. ATAUR RAHMAN KHAN, Press Conference, Karachi, 4 June 1958. Morning News, 6 June 1958. Pakistan Observer, 19, 20, 21, 23, 24, 26 June 1958. SUHRAWARDY, speech at Narayanganj, 6 July 1958. Ittefaq, 25, 26 August 1958.
  17. Ittefaq, 21 September 1958. Pakistan Observer, 21 September 1958.
  18. Ittefag, 24, 25, 27 September 1958. Pakistan Observer, 24, 25, 27 September 1958. The Times, 25, 26 September 1958.
  19. Dawn, 3, 8 October 1958. The New York Times, 8, 25, 28, 29, 31 October 1958.
  20. SAYEED, n. 17, p. 135. SULERI, n. 9, p. 141. K. J. NEWMAN, “Pakistan’s Preventive Autocracy and its Causes”, Pacific Affairs, March 1959, p. 31. WILCOX, n. 20, p. 203. MOHAMMAD AHMAD, My Chief (Lahore, Longmans, 1960), pp. 3-5, 85-93, 97. TENDULKAR, n. 19, p. 513. For a confirmation of Mohammad Ahmad’s observation by AYUB himself, see Friends Not Masters, pp. 52, 58, 186-88.
  21. Speech by FIROZ KHAN NOON, CAP Debates, 25 August 1955, Vol. I, No. 11, p. 316. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, NAP Debates, 2 March 1958, Vol. II, pp. 565-66, 568-69. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, NAP Debates, 3 March 1958, Vol. II, p. 676. Speech by SARDAR FAZLUL KARIM, NAP Debates, 4 March 1958, Vol. II, p. 771. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 145-46, 149-50, 157-58. HAMIDUL Remarked : “You have created hell for the people within 10 miles of the border and they cannot move in the evening after dusk…….. This is too much. These poor people do not get even justice before a court of law.”-Ibid., p. 158.
  22. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 16 January 1956, Vol. I, No. 51, pp. 1819-21. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP

Debates, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, pp. 2049-50. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 3 March 1958, Vol. II, p. 637. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, NAP Debates, 4 March 1958, Vol. II, p. 773.

  1. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 31 August 1955, Vol. I, No. 13, pp. 381-82 ; Speech by ABUL MANSUR AHMAD, 16 Janary 1956, Vol. I, No. 51, pp. 1822-23. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP Debates, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, pp. 2049-50 : Fazlur quoted extensively from a series of articles written by PROF. MUZAFFAR AHMAD.
  2. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, pp. 1847-48. Speech by A. H. DELDAR AHMAD, CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, p. 60. Speech by ABDUR RAHMAN KHAN, Ibid., pp. 63-64. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 26 February 1957, Vol. I, NO. 16, pp. 1214-15, 1217-18.
  3. Speech by ABDUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 25 August 1955, Vol. I, No. 11, pp. 308-09. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 7 September 1955, Vol. I, No. 18, p. 538. Speech by SUHRAWARDY, CAP Debates, 31 January 1956, Vol. I, No. 60. p. 2234. Speech by DELDAR AHMAD, CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, p. 59. Speech by MUJIBUR, CAP (Legislature) Debates, 18 March 1956, Vol. I, No. 3, p. 102. Speech by SUHRAWARDY, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1956, Vol. I, No. 4, p. 225.
  4. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, pp. 1846-47, 1867. Speech by HAMIDUL, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 142, 144, 147. Speech by KHALEQUE, NAP Debates, 3 March 1958, Vol.II, p. 636. Speech by ZAHIRUDDIN, Ibid., pp. 710-11. Speech by MUJIBUR, CAP (Legislature) Debates, 21 March 1956, Vol. I, No. 6, p. 311. Speech by DELDAR, Ibid., 320.
  5. Speech by KHALEQUE, Ibid., p. 305. Speech by ZAHIRUDDIN, Ibid., p. 307. Speech by MUJIBUR, IBID., pp. 310-11. Speech by DELDAR, Ibid., p. 320. 51. Speech by MUJIBUR, Ibid., p. 312. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 187-88. Speech by

FARID AHMAD NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1262-63. Speech by ZAHIRUDDIN, NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1262-63. Speech by ZAHIRUDDIN, NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1266-67.

  1. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, Vol. I. No. 2, pp. 52-54. N. A. QURESHI, “Research about Employment Levels and Structure of the Labour Force in East Pakistan”, in P. BESSAIGNET (ed.), Social Research in East Pakistan (Dacca, 1960), pp. 68, 81, 83.
  2. S. U. KHAN, “A Measure of Economic Growth in East and West Pakistan”, Pakistan Development Review (Karachi), Autuman 1961, pp. 50, 52-54. Speech by ATAUR, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1956, Vol. I, No. 4, p. 215.
  3. NURUL ISLAM, “Some Aspects of Interwing Trade and Terms of Trade in Pakistan”, Pakistan Development Review, Spring 1963, pp. 23, 5. NAFIS AHMAD, An Economic Geography of East Pakistan (London, Oxford University Press, 1958), p. 312. Speech by SUHRAWARDY, CAP Debates, 31 January 1956, Vol. I, No. 60, p. 2233. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP Debates, 8 February 1956, Vol. I, No. 67, p. 2706. Speech by DELDAR, CAP (Legislature) Debates, 21 March 1956, Vol. I, No. 6, p. 320. Speech by FARID, NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1262-63.
  4. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 21 March 1956, Vol. I, No. 6, p. 307. Speech by HAMIDDUL, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 148-49. Speech by KHALEQUE, NAP Debates, 8 January 1958, Vol. I, pp. 191-92. Speech by LATIF, NAP Debates, 1 March 1958, Vol. II, pp. 491-93. Speech by KHALEQUE, NAP Debates, 2 March 1958, Vol. II, pp. 563-64.
  5. For a reference to “two economies” in Pakistan, see speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3. Speech by DAULATANA, CAP Debates, 26 August 1955, Vol. I, No. 12, p. 348. Speech by ATAUR, CAP Debates, 6 September 1955, Vol. I, No. 17, pp. 517-19.
  6. Speech by MUJIBUR, CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, p. 1841. Speech by ATAUR, CAP Debates, 27 January 1956, Vol. I, No. 58, p. 2124. Speech by ATAUR, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1956, Vol. I, No. 4, pp. 215-18. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 22 March 1956, Vol. I, No. 7, p. 341. ATAUR

RAHMAN KHAN, Ojarotir Dui Bachchar, pp. 39-50.

  1. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, pp. 55-56. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 20 March 1956, Vol. I, No. 5, pp. 273-74. Speech by MUJIBUR, Ibid., p. 275. Speech by PETER PAUL GOMEZ, CAP (Legislature) Debates, 22 March 1956, Vol. I, no. 7, pp. 332-33. Speech by ATAUR, CAP Debates, 27 January 1956, Vol. I, No. 58, p. 2131. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, p. 193.
  2. NAP Debates, 7 January 1958, Vol. I, No. 1-Speech by KARIM pp. 82-83 ; Speech by HAMIDUL, pp. 86-87 ; Speech by MR. MAHMUD ALI, p. 100.
  3. Speech by ABUL MANSUR, CAP Debates, 16 January 1956, Vol. I, No. 51, p. 1816.
  4. গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার রায়, pp 36-58
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!