You dont have javascript enabled! Please enable it!

অস্তমিত মুসলিম লীগ

১৯৫০ এর পূর্ববঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পাকিস্তানের ইতিহাসে পথনির্দেশ চিহ্ন বিশেষ। এই নরঘাতী যজ্ঞের হােতা অথাৎ এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্থপতি ছিলেন যাঁরা তাঁরা নিজেরাও অবহিত ছিলেন না তাঁদের কৃতকর্মের ফলে একদিন তাঁদের এ রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যকে অস্বীকার করার আন্দোলনের মুখে পড়তে হবে। অস্বীকার করার বীজ সুপ্ত আছে তাদের ঐ হিন্দুনিধন যজ্ঞের গভীরে এ তাঁরা কল্পনাও করেন নি। বর্তমান লেখক শ্রীভূপেন্দ্র নাথ দত্তের মারফৎ এ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর যে-তথ্য লাভ করেন তার উৎস পাকিস্তানের জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। দুটি পাকিস্তানী গণপরিষদের সদস্য ভূপেন বাবু ঐ মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেন নি। তথ্য হ’ল এই: চৌধুরী মুহম্মদ আলি ছিলেন পাকিস্তানে সরকারের প্রথম তথা একমাত্র মহাসচিব পদে ব্রীত ব্যক্তি। এই ব্যক্তির তত্ত্ব ছিল খুবই সরল। পূর্ববঙ্গ আজ হােক আর কাল হােক পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং পূর্ববঙ্গের আর্থিক উন্নতিকল্পে অপব্যয় না করে ঐ প্রদেশের হিন্দু অধিবাসীদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চাপে পূর্ববঙ্গ থেকে সরিয়ে দিলে সেটাই হবে কাজের কাজ। (১) আমলারা হিন্দু-বিতাড়নের জন্য কারসাজি করেছিলেন পাকা হাতে। বেশ কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ী উচ্চবিত্ত হিন্দুদের স্থলে জমিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন, এও সত্য। তথাপি ঐ আত্মসন্তুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পূর্ববঙ্গে নিয়ুক্ত আমলারা একটা হিসাব কষে দেখে নি যে, হিন্দুদের পরিত্যক্ত বহু আসনেই, বহু চাকুরীস্থলে এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পূর্ববঙ্গবাসী মুসলিমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে শীঘ্রই একটি আলােকপ্রাপ্ত তথা সচ্ছল মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি করবে। কলেজের অধ্যাপিকা পদে মুসলিমের সংখ্যা ১৯৪৭ এর অগাস্টে ছিল নগণ্য। এক দশক পরের হিসাবে ঐ সম্প্রদায়ের নারীরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়। (২)

চৌধুরী মুহম্মদ আলির মন্ত্রণা মতাে দ্রুত কিছু ফয়দা লুটে পূর্ববঙ্গের উপরে আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে চললাে ঐ অবাঙালী আমলারা। উন্নয়নে ব্যয় না করে বরং শােষণের মাত্রা বাড়িয়েই পূর্ববঙ্গের বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপারটিকে আর কিছু না হােক কিছু বিলম্বিত করা যাবে – এই ছিল চৌধুরী সাহেবের তত্ত্ব। (৩) তত্ত্ব বলে একে উপাত্ত বলাই সঙ্গত। পশ্চিমাঞ্চলের পাকিস্তানীদের তুলনায় পূর্ববঙ্গের অধিবাসীর রাজনৈতিক চেতনা যে অনেক সমৃদ্ধ এবং নব্য মধ্য শ্রেণীর উদ্ভবে সেই চেতনা যে নুতন ভরবেগ লাভ করেছে এ সব ঐ আমলারা ভেবে দেখে নি। নিছক চাপের কাছে নতি স্বীকার পূর্ববঙ্গবাসীর ধাতে নেই। (৪)

পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম খণ্ডের ভৌগােলিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধান জনিত সমস্যার সমাধানের চিন্তা না করে, পেষণ এবং পীড়নের পথে অবাঙালী শাসকচক্র ঐ সমস্যাকে চেপে দিতে চেয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে জাতীয় সংহতি রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে যে সংযম এবং নমনীয়তার প্রয়ােজন হয় তার কোনাে অভাব পূর্ববঙ্গবাসীর আচরণে ছিল না। ভারতত্যাগী অবাঙালী মুসলিম উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আচরণে পূর্ববঙ্গবাসী তার রাষ্ট্রীয় সংহতি বােধের পরিচয় দিয়েছেন। এমন কি, রাষ্ট্রের নামকরণে অথাৎ ‘পাকিস্তান’ শব্দের বর্ণসঙ্কেতে পূর্ববঙ্গ সূচক কোন বর্ণ না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কোনাে প্রশ্ন তােলেন নি। আসলে ‘প’ পাঞ্জাব, আ’ আফগানিয়া অথাৎ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, ‘ক’ কাশ্মীর, ‘স’ সিন্ধু এবং তান’ বালুচিস্তানের দ্যোতক। অথাৎ পূর্ববঙ্গ সূচক কোনাে বর্ণ রাষ্ট্রের নাম ‘পাকিস্তান’ শব্দে অনুপস্থিত। তথাপি ‘পাকিস্তান নাম মেনে নিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গ বাসী। দেশের পশ্চিম খণ্ডের শহর করাচী রাজধানী নিবাচিত হবার ফলে যে বিপুল আর্থিক সুবিধা তার সবটুকুই তাে পশ্চিমখণ্ডের বাসিন্দারা পাবেন। এজন্য কোনাে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নি পূর্ববঙ্গবাসী। শুধু যে ভারত ছেড়ে আসা অবাঙালী মুসলিমদের পূর্ববঙ্গ সরকারের হাজার হাজার পদে নিয়ােগ করা হয়েছিল তা নয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের সচিব পদগুলি সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে অবঙালী মুসলিমদের নিয়ােগ করা হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক সরকারে পূর্ববঙ্গের স্থানীয় অধিবাসীকে কোনাে উচ্চপদ পেতে না দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসকচক্র যে-জঘন্য পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছিল তার সমর্থনে যে যুক্তি দেখাতাে তা ছিল সমান জঘন্য। বলা হত। পূর্ববঙ্গে ঐ সব গুরুত্ব পূর্ণ পদে নিযুক্ত হবার মতাে যােগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নেই। আই, সি, এস-এর অভাব পুরণ করতে অডিট, ফরেস্ট ইত্যাদি সার্ভিসের কর্মচারীদের সি, এস, পি পদে উন্নীত করা হয়েছিল। পুলিশ সার্ভিসের ক্ষেত্রে এই সুযােগ দেওয়া হয় নি। আসলে অনেক বাঙালী আই, পি, কে ঐ সুযােগ থেকে বঞ্চিত করার চক্রান্ত করা হয়েছিল। বাঙালীদের মধ্যে তখন বেশ কিছু পুলিশ সার্ভিসের সদস্য অথাৎ আই, পি, ছিলেন। এই বাঙালী বিদ্বেষের কারণেই কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে পাকিস্তানের জন্মের পরে কোনাে বাঙালী সচিব ছিলেন না। এ সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে প্রশ্নকতাকেই প্রাদেশিকতা ক্লিষ্ট বলা হ’ত। প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট শাসকচক্র পূর্ববঙ্গবাসীকে সমস্ত সরকারী উচ্চপদ থেকে অন্যায় ভবে সরিয়ে রেখে ঐ সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে ঐরূপ অদ্ভুত কথা বলতাে। পূর্ববঙ্গ রেলের পদস্থ অফিসার বলতে বাঙালী কেউ ছিলেন না। অন্যদিকে পশ্চিমখণ্ডের রেল বিভাগে পশ্চিমখণ্ডের অধিবাসীই সকল উচ্চ পদে নিযুক্ত হতেন। পাকিস্তান গণপরিষদে পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের প্রাপ্য সদস্যসংখ্যার মধ্যে ছয়টি ছেড়ে দিতে হয়েছিল পশ্চিমখণ্ডের প্রার্থীদের স্বার্থে। স্বয়ং লিয়াকৎ আলি খান-ও পূর্ববঙ্গের আসন থেকে গণপরিষদে সদস্যপদ লাভ করেন। পূর্ব বঙ্গ ভিন্ন অন্য কোনাে প্রদেশ এই ভাবে আসন বন্টনে ত্যাগ স্বীকার করে নি। পূর্ববঙ্গ বাসী দেখতেন, চাকুরী থেকে গণপরিষদের আসন—সমস্ত ব্যাপারেই পূর্ববঙ্গ সকলের। অথচ অন্যান্য প্রদেশগুলির প্রত্যেকটি নিজের জন্য। (৫)

১৯৫০-এর হিন্দুনিধনের পরিণামে বিপুল সংখ্যায় হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে গেলেও, পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশই পূর্ববঙ্গবাসী ছিলেন। সংবিধান চালু করতে ইচ্ছাকৃত বিলম্বের কারণ ছিল এই সংখ্যাধিক্য, যার ফলে গণতান্ত্রিক বিধানে আইনসভা ইত্যাদি স্তরে পূর্ববঙ্গেরই আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হত ।(৬) এমন কি এক পৃষ্ঠার দলিলটুকু অথাৎ মূল লক্ষ্যের প্রস্তাবনা বা অবজেকটিভস রেজোলিউশান রচনা শেষ হয় ১৯৪৯ সালে। গণপরিষদে পূর্ববঙ্গের একজন হিন্দু সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বলেন, পাকিস্তানে এই পরিষদ দিনে মাত্র দু’ঘন্টা কাজ করে যেখানে ব্রিটেনে এই কাজ দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এর জবাবে লিয়াকৎ দেন লােকসানাে জবাব – ‘কারণ ব্রিটেনের লােকেরা বড় বেশি বকে। অবশ্য অপর একজন পূর্ববঙ্গীয় সদস্য হামিদুল হক চৌধুরীও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যে সায় দিয়েছিলেন।(৭) গণপরিষদে মুসলিম লীগের বাঙালী সদস্যদের সংখ্যার সঙ্গে আনুপাতিক হারে দরকষাকষির ক্ষমতা ছিল না। ২৬ জন মূলনীতি কমিটির সদস্যের মধ্যে বাঙালী ছিলেন মাত্র ছয় জন – তার মধ্যে তিন জন ছিলেন হিন্দু। ডাঃ মামুদ হুসেইন, ডঃ আই, এইচ, কুরেশি এবং লিয়াকৎ স্বয়ং পূর্ববাঙলার প্রতিনিধি বিবেচিত হলেও এরা প্রত্যেকেই ছিলেন অবাঙালী। অবশ্য এই কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল একজন বাঙালীকেই। এই কমিটির অন্তর্বর্তী রিপাের্টে উর্দু একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে বাঙালী মুসলিম লীগ সদস্যদের যে লিয়াককে মেনে চলা ভিন্ন কিছু করার ছিল না তারই প্রমাণ দিল। কেন্দ্রীয় আইনসভা সম্বন্ধে ঐ রিপাের্টের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হ’ল, এর দুটি কক্ষ থাকবে। উচ্চকক্ষ বা আপার হাউসে পাকিস্তানের উভয় অঙ্গের সমপ্রতিনিধিত্ব থাকবে। নিম্ন কক্ষ বা লােকসভা হবে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। বিবাদ-বিসংবাদ মেটাতে উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহূত হবে। জনগণ-নিবাচিত প্রতিনিধিরা ঠিক কী পদ্ধতিতে নিবাচিত সেকথা উহ্য রইলাে। পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার গরিষ্ঠতার ফল বানচাল করার এই আভাস আসলে গণতন্ত্রের উপর শাসকচক্রের প্রাধান্য বিস্তারের ছক মাত্র। স্বভাবতঃই পূর্ববঙ্গবাসী এই আশঙ্কা বােধ করলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসনের গণতান্ত্রিক বিধি লঙঘন করা হচ্ছে সংখ্যালঘু ক্ষমতাসীনচক্রের আধিপত্য কায়েম করতে। অথাৎ অদ্ভুত এক সংবিধান খাড়া করে সংখ্যালঘু পশ্চিমখণ্ডকে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বখণ্ডের উপর ছড়ি ঘােরানাের অনাচারকে সাংবিধানিক অজুহাতে চালিয়ে নেওয়া হবে – এটা বােঝা গেল। (৮)

১৯৫০ এর নভেম্বরে এক জাতীয় সম্মেলনে আতাউর রহমান, ফজলুল হক প্রমুখ নেতারা ঐ অন্তর্বর্তী রিপাের্ট খারিজ করে তৎপরিবর্তে দেশের উভয় অঙ্গের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেন। প্রতিবাদী গণ আন্দোলন দমনে ব্যাপক ধরপাকড় চললাে। অবশ্য এই আন্দোলনের চাপে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম লীগ বাধ্য হ’ল ঐ অন্তর্বর্তী রিপাের্টের আমূল পরিবর্তনের দাবি জানাতে। (৯)

১৯৫০ এর ২১ শে নভেম্বর গণপরিষদে ঐ রিপোের্ট সংক্রান্ত আলােচনা স্থগিত রাখার প্রস্তাব করে লিয়াকৎ এই রিপাের্টকে আরাে ইসলামিক করার ব্যাপারে জনসাধারণের মতামত আহ্বান করলেন। মূল লক্ষ্যানুগ করার কথাও বললেন একে। কিন্তু উল্লেখ-ও করলেন না পূর্ববঙ্গের প্রতিবাদের কথার। যদিও ঐ প্রতিবাদ যে বেশ জোরালাে গণপ্রতিবাদ তা তিনি ভালােই জানতেন। লিয়াকতের প্রস্তাবিত ইসলামীকরণ সংখ্যালঘু হিন্দু এমন কি আহমাদি মুসলিমদেরও নিরাপত্তা ব্যাহত করেছিল – এ কথা পরে আলােচনা করা হবে। জনৈক পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ সদস্য নূর আহমেদ এই সময় ঐ স্থগিত রাখাটা ভালাে হচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন, পূর্ববঙ্গে এই সন্দেহ দানা বাঁধছে যে অন্তর্বর্তী রিপাের্ট কার্যকর হলে তা আসলে পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশ বানিয়ে ছাড়বে। অতি দ্রুত নুর আহমেদ যােগ করলেন তিনি নিজে ঐ সন্দেহ করেন না। শুধু নূর নন, পুরাে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম লীগই যেন শাসকচক্রের আজ্ঞাবহ সেবাদাসে পরিণত হয়েছিল। (১০)।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ১৯৪৮ সালে ২৭ টি এবং ১৯৪৯ সালে ২০ টি আদেশনামা বা অর্ডিনেন্স জারী করেন। ভারত সরকার বিলের দ্বিতীয় সংশােধনীতে ৩১ শে ডিসেম্বরের পরে জারী আদেশ আইন সভার অধিবেশন ফের শুরু হবার ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাতিল বলে গণ্য করা হবে যদি আইন সভা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ ভারতে অনুরূপ অগণতান্ত্রিকভাবে চাপানাে অর্ডিনেন্স-এর বিধির বিরােধিতা করে গণ আন্দোলনে নেমেছিল। এই প্রকার গণআন্দোলন তার পক্ষে ছিল এক অনন্যসাধারণ পদক্ষেপ। বর্তমান বিলের প্রশ্নে মুসলিম লীগ আইন সভায় আদেশনামা পেশ করারই প্রয়ােজন দেখলাে না। হিন্দু সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী প্রমুখ বিলটিকে ৩১ সে ডিসেম্বর ১৯৪৯ এর পূর্বে জারী নিরাপত্তা-ঘটিত আদেশনামাগুলির সম্বন্ধে প্রয়ােগ করার প্রস্তাব দিলে মুসলিম লীগ বিরুদ্ধে ভােট দেয়। যে-দুজন অবাঙালী মুসলিম এই বিলের বিরােধিতা করেছিলেন রাজকুমার বাবুর সংশােধনী প্রস্তাবের সময় তাঁরাও পাশ কাটান। পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ তার কর্তাভজা চরিত্র প্রকাশ করে পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয়তা অনেকটাই হারালাে।(১১)

এই বিল পাশ করে আমলাতন্ত্র প্রমাণ করলাে রাজনীতিকদের উপরে তার প্রভাব কতাে বেশি। আমলাতন্ত্র এখানেই থেমে থাকে নি। অন্তর্বর্তী রিপাের্ট স্থগিত রাখা এবং টিমে তালে হলেও একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার প্রয়াস – এই দুটি কারণে আমলাতান্ত্রিক চক্র লিয়াককে বাঙালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করলাে। লিয়াককে হত্যা করার পশ্চাতে এই চক্রের প্রশ্রয় ছিল এই সন্দেহ জাগে নানা কারণে। যে-পুলিশ অফিসার লিয়াকতের আততায়ীকে তৎক্ষণাৎ গুলি করে হত্যা করে তার সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতি হয়। পদোন্নতি হয় সেই সব পাঞ্জাবী আমলার যাদের সঙ্গে ঐ গুপ্তহত্যার সংস্রব সন্দেহ করা হয়েছিল। তা ছাড়া লিয়াকতের গুপ্ত হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত রিপাের্ট ইত্যাদিও এক বিমান দুর্ঘটনায় লােপাট হয়ে গেলে, বিমান দুর্ঘটনার কোনাে তদন্ত হয় নি। লিয়াকৎ পত্নীও তাঁর স্বামীকে হত্যা করার পশ্চাতে আমলাদের সংস্রব সন্দেহ করে নানা জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। অবশেষে এই মহিলাকে রাষ্ট্রদূতের পদে অধিষ্ঠিত করে তাঁর। মুখ বন্ধ করা হয়। (১২)

লিয়াকতের মৃত্যুর পরে বাঙালী নাজিমুদ্দিন হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ভীরু এই ব্যক্তিকে চালিয়ে নেওয়া সহজ হবে ভেবে ইনি বাঙালী হলেও এঁকে পাঞ্জাবীরা মেনে নিলেন। অসুস্থ গুলাম মহম্মদকে সামলানাে সহজ হবে ভেবে বাঙালীরাও ওঁকে গভর্নর জেনারেল পদে মেনে নিলেন। বাঙালীদের হিসাবে ভুল ছিল। তবে পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্র প্রকৃতই নাজিমুদ্দিনের দুর্বলতার সুযােগে নিজেদের অভিসন্ধি পূর্ণ করেছিল। (১৩) * ১৯৪৮ এ ছাত্ররা যখন বাঙলাভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গণ্য করানাের দাবিতে তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকার বাসভবন ঘেরাও করেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন সেদিন ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৫২-র ২৬ শে জানুয়ারী সেই নাজিমুদ্দিন ঐ ঢাকাতেই ঘােষণা করলেন, উর্দুই হবে একমাত্র সরকারী ভাষা। সেক্ষেত্রে বাঙালীদের উর্দু না জানার অজুহাতে সরকারী চাকুরী থেকে আরাে বেশি বঞ্চিত করা হবে। স্টেট ব্যাঙ্কের গভর্নরও ঐ একই দিনে বিজ্ঞপ্তি জারী করেন যে, এখন থেকে চেকেও উর্দু ব্যবহৃত হবে। নাজিমুদ্দিনের ডােল বদলে ছাত্র সমাজ অবিলম্বে প্রতিবাদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়ােজন অনুভব করলাে। (১৪)

নাজিমুদ্দিনের ১৯৫২ র ২৬ শে জানুয়ারীর বিবৃতি পূর্ববঙ্গের জনগণকে মুসলিম লীগ সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ এবং বাঙলাভাষার মর্যাদারক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করলাে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে বৃহত্তর প্রতিরােধ আন্দোলনের প্রস্তুতি চললাে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম খণ্ডের এই আগ্রাসন অথাৎ উর্দুকে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে বাঙলা ভাষার মর্যাদা হানির উদ্ধত অনাচার ছাত্রসম্প্রদায় তথা সাধারণ মানুষ যে-কোনাে মুল্যে প্রতিহত করতে সঙ্কল্প গ্রহণ করলাে। ১৯৫২র ২১ শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র বিক্ষোভকারীদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। মিছিলে চলে গুলি- দু’জন ছাত্র তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ২২ শে ফেব্রুয়ারী উদ্যোগ নিয়ে প্রাদেশিক আইনসভার পক্ষে এক প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানালেন বাঙলাকেও সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ছাত্র এবং জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। দুটো দিন আগে নুরুলের চৈতন্যোদ্য হলে দুটি তাজা প্রাণ এভাবে ঝরে যেত না। নুরুল এবং দলগত ভাবে মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনের মধ্যে কমিউনিস্ট এবং ভারতীয় প্রভাবের কথা রটনা করে সাধারণের বিশ্বাসে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হন। সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন এই ভাষা হিন্দু সংস্কৃতির বাহক’এমন কথা প্রচার করতে শুরু করলেন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। কথাটা অমূলক। বাঙলা ভাষার প্রায় অর্ধেক শব্দ আরবি, ফারসি এবং উর্দুভাষাজাত। বাঙালীর সংস্কৃতি ধর্মভেদে দ্বিধাবিভক্ত নয়। হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ ভাব-ভাবনা, জীবন-বেদ এই সংস্কৃতির প্রাণ। মাত্র ৭.২ শতাংশ লােকের ভাষা উর্দু অথচ ৫৪.৬ শতাংশ পাকিস্তান বাসীর ব্যবহার্য ভাষা বাঙলা। ১৯৫১-এর আদমসুমারির নিরিখে বাঙলা ভাষাকে অন্যতম সরকারী ভাষা করার দাবি নিতান্তই বিনীত। অবশ্য নুরুল আমিন প্রমুখ নেতারা এটা বুঝেও বুঝেছেন বলার সাহস পেলেন না। (১৫)

২১ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশী তাণ্ডবের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ২২ শে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক আইনসভায় ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য সমর্থন করে প্রস্তাব গ্রহণ করলেও মুসলিম লীগের বাঙালী নেতৃত্বাংশও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের প্রতি দাসমনােভাব দেখাতে বাধ্য ছিলেন। অবশ্য আন্দোলনের প্রতিঘাতে গোঁড়া মুসলিম লীগ পন্থী দৈনিক আজাদ’, ঐ আন্দোলনের যথাযথ প্রতিবেদন পেশ করেছিল। পত্রিকার সম্পাদকও মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন। পুলিশী নৃশংসতার যে-সব তথ্য তাঁর কাগজে ছাপা হয়েছিল তার পরিণামে তাঁকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়তাে বাধ্য করাই হ’ত। ১০ ই এপ্রিল, ১৯৫২ গণপরিষদে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গশাখার চরিত্র উদ্ঘাটিত হয়। যে-কারণেই হােক নুর আহমেদ ভাষা আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের দাবিকে প্রস্তাব আকারে রেখে বাঙলাকে অন্যতম সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার অনুরােধ করলে, সে প্রস্তাবের বিবেচনা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখার আদেশ হ’ল। পশ্চিমখণ্ডের ক্ষমতাচক্রের ভয়ে নুরুল, নূরকে। বক্তৃতা করে তাঁর রাখা প্রস্তাব সমর্থন করতে নিষেধ করলে প্রগতার জন্য বিখ্যাত নূর তৎক্ষণাৎ চুপ করে গিয়েছিলেন। নুরুল, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেও গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। ঐ সময় ঐ পরিষদই ছিল কার্যতঃ পাকিস্তানের সংসদ। পিরজাদা আবদুস সাত্তার আবদুল রহমানের তােলা যে- প্রস্তাবে নূর আহমেদের প্রস্তাব স্থগিত রাখতে বলা হয়েছিল, পশ্চিমাঞ্চলের শাসকচক্রের তাতে সায় ছিল। তথাপি ফজলুল হক এই স্থগিত প্রস্তাব সম্পর্কে বিদ্রুপ করেও তাঁর সমর্থন জ্ঞাপন করেন এই কারণে যে, নুরের প্রস্তাব স্থগিত রেখে পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের অপ্রস্তুত দশায় পড়াটা এ যাত্রা রক্ষা পেল। বিবেকের অনুশাসন ছাড়াও শাসকচক্রের প্রতি আনুগত্যের নিগড়ে বাঁধা এই সব সদস্য হয়তাে ভােট দিতেন নূরের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। সুতরাং স্থগিত – প্রস্তাব মন্দের ভালাে হয়ে এসেছে। নুরুলের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু সদস্যরা সেদিন বাঙলাভাষার দাবির পক্ষে ক্ষুরধার যুক্তির অবতারণা করলে, নুরুল প্রথমে বলেন, এই হিন্দু সদস্যরা এমন ভাবে কথা বলছেন যে তাঁরাই যেন বাঙলা ভাষার একমাত্র অছি এবং স্রষ্টাও।’ নুরুল এর পরে বলেন, হিন্দুর বাঙলা আর মুসলমানের বাঙলা ভাষা হিসাবে আলাদা। হিন্দুর জল মুসলমানের ‘পানি’ তার দৃষ্টান্ত। আসলে নুরুল গুলিয়ে দিতে চেয়েছেন সব কিছু। উত্তর ভারতের হিন্দুরাও ‘পানি’ বলে থাকে। মুসলিম লীগের কর্তাভজাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নূর যে কাণ্ডটি করলেন সংসদীয় ইতিহাসে তা এক বিশ্বরেকর্ড। তাঁর নিজের উত্থাপিত প্রস্তাবের বিবেচনা এখন করারই প্রয়ােজন নেই, ওটা স্থগিত থাক – এই মত তিনিও নির্লজ্জের মতাে প্রকাশ করে দোষস্থান করলেন।(১৬)।

এক অশ্রুতপূর্ব স্বৈরাচারী বিল এপ্রিল, ১৯৫২ তে খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রধান মন্ত্রিত্বকালে উপস্থিত করা হল। যে-কোনাে মন্ত্রী যে-কোনাে ব্যক্তিকে এক বছরের জন্য গ্রেপ্তার করার হুকুম দিতে পারবেন। গ্রেপ্তার যিনি হলেন তাঁকে কারণ জানানাে হবেনা। তিনি কোনাে আদালতে এর বিরুদ্ধে বিচার চাইতে পারবেন না। এক উপদেষ্টা কমিটি বৎসরান্তে ঐ আটক ব্যক্তির প্রশ্নটি বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু বৎসর শেষ হবার মুখে দু’চার দিনের জন্য ঐ ব্যক্তিকে ছেড়ে দিয়ে ফের ঐ নিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। এভাবে অনির্দিষ্টকাল বিনা বিচারে আটকের হয়রানির সুযােগকে দেশের নিরাপত্তার পক্ষে প্রয়ােজনীয় মনে করলেন পূর্ব বঙ্গের মুসলিম লীগপন্থী গণপরিষদ সদস্যরাও। অবশ্য পাঞ্জাবের শৌকত হায়াৎ খান এই বিলের বিরােধিতা করেছিলেন। অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী সংশােধনী প্রস্তাব এনে ঐ বিলের সর্বনাশা দিকটিকে একটু প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সকল সংশােধনীই প্রত্যাখ্যাত হয়। নাগরিক অধিকারের উপর এরূপ উন্মত্ত আক্রমণ যে বিলের লক্ষ্য তাকে পাশ করাও হয় তড়িঘড়ি। (১৭) | পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগকে তল্পিবাহকে পরিণত করে পাকিস্তানের অবাঙ্গালী শাসকচক্রের উদ্যোগ এবারে অন্যান্য দল এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐক্য ধ্বংস করার মধ্যে নিহিত হ’ল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভাকে ধর্মীয় মেলার মতাে রঙ বেরঙে বিভক্ত করতে চেয়ে সাধারণ হিন্দু, তফসীল হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ প্রতি সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা করা হ’ল। যদিও তফসীল ফেডারেশন ১৯৪৯ এর নভেম্বরে এবং পূর্ববঙ্গ । আইনসভার হিন্দু সদস্যগণ ১৯৫১ র মার্চ মাসে যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা দাবি করেছিলেন। সংখ্যালঘুরা নিজেরা তাঁদের স্বার্থ রক্ষার্থে যা চায় নি, সরকার তা চাপিয়ে দিতে এগিয়ে এল কেন? বিশেষতঃ পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে তফসীলী এবং সাধারণ হিন্দুদের নিবাচনী ব্যবস্থা এক এবং অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের জন্য এই বহুধা বিভক্ত বন্দোবস্তের একমাত্র কারণ ছিল সরকার বিরােধী রাজনীতির মধ্যে বিরােধের বীজ উপ্ত করা। তা ছাড়া শাসকচক্রের পরম অনুগত মুসলিম লীগের হয়তাে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে কিছু সুবিধা হলেও হতে পারে এমন ভাবনা শাসকচক্র করে থাকবে। জনপ্রিয়তা নাশের ফলে ‘ আগামী কোনাে নির্বাচন-ই যে মুসলিম লীগের পক্ষে সুখকর সংবাদ বয়ে আনবে না – এটুকু ঐ ধূর্ত চক্র ভালােই বুঝতাে। (১৮)

সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শাসকচক্রের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পৃথক নিবাচনী বিলের সমালােচনা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলেন, এ হল সংখ্যালঘুদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার ছল। এ কথাও তাঁরা বললেন, ‘গণতন্ত্র ধ্বংস পাবে। এর ফলে। সাম্প্রদায়িকতা এবং একদলের একনায়কত্ব দেখা দেবে। জাতীয় সংহতিরও ক্ষতি করবে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা। উপনিবেশবাদীদের সেই সাবেকী কৌশলে জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে শাসন কায়েম করার পুনরাবৃত্তি এই বিলে নিহিত।’ (১৯)

নুরুল আমিন পৃথক নিবাচনী বিলের সমর্থনে বলেন, অনুন্নত সম্প্রদায়ের কোনাে প্রতিনিধি যৌথ নির্বাচনী প্রথায় আইন সভায় আসতে পারেন নি কোনাে দিন। সঙ্গে সঙ্গে ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত প্রেমহরি বর্মা প্রতিবাদ করে জানান, তিনি অবিভক্ত বাঙলার আইনসভা সদস্য ছিলেন। এরপর নুরুলের অপ্রাসঙ্গিক এবং অশালীন বক্তব্যে না গিয়ে জাফরুল্লা খানের বক্তৃতার কথা বলা যাক। ইনি মান্ধাতার আমলের অপ্রাসঙ্গিকতা ভুলে গিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে শূদ্রদের অনুন্নত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত করতে বলেন। বেদ, স্মৃতি, নানা পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জাফরুল্লা খান ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রের পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। জনৈক হিন্দু সদস্য অবশ্য এঁদের উৎসাহে ভাটা পড়ে এমন কিছু বলেন। জিন্নার মত উদ্ধৃত করে ইনি বলেন, “তা হলে জিন্না সাহেব তফসীল জাতিকে পৃথক না বলে হিন্দুজাতিরই অংশ বলেছেন। জিন্নার মত গ্রহণ করলে তাে তফসীল এবং সাধারণ হিন্দুদের পৃথক নির্বাচন চিন্তা করা চলে না। (২০)

| ভারত সরকার তৃতীয় সংশােধনী বিলে পাঞ্জাবীদের জন্য প্রতি এক লক্ষ চার হাজার নাগরিক পিছু একটি প্রাদেশিক আইনসভা আসনের বরাদ্দ হলেও পূর্ববঙ্গের জন্য এক একটি আসনে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার নাগরিককে ঠাসা হ’ল। প্রাদেশিক আইনসংখ্যায় জনসংখ্যা বিচারে আসনহ্রাস হয়তাে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় আইনসভায় অনুরূপ হ্রাসের পূর্বসঙ্কেত, এমন আশঙ্কার কারণ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ এ ব্যবস্থা মেনে নিল। পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার ফলে অবস্থাপন্ন হিন্দুদের আর উৎসাহ রইলাে না পূর্ববঙ্গে বিনিয়ােগ করার ব্যাপারে। এর ফল পূর্ববঙ্গের দীন অর্থনীতির পক্ষে নিশ্চয়ই শুভ হয় নি। এদিকে সংখ্যালঘুর সঙ্গত আশঙ্কা দূর করার বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই দাবি করলাে তাদের কাছে এমন আচরণ যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মন থেকে সংখ্যালঘুদের সম্বন্ধে আশঙ্কা- অবিশ্বাস দূর হয়। (২১)।

করলেন। ৪০০ সদস্যের লােকসভা দেশের উভয় অঙ্গ থেকে সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবার কথা এবং হাউস অব ইউনিটস- এ ১২০ জন অনুরূপ সমবিভাজন নীতিতে সদস্যপদ লাভ করতে পারবেন – রিপাের্টে এই তথ্য ছিল। হাউস অব ইউনিটস-এর প্রয়ােজনীয়তা এবং দুই কক্ষে বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে নেবার ব্যবস্থা – এর কোনােটিরই ব্যাখ্যা ঐ রিপাের্ট ছিল না। (২২)

পাঞ্জাবী চক্র সমতা নীতিটুকুকেই তাদের একাধিপত্যের পক্ষে যথেষ্ট মনে করলাে । যতাে হােক নটি খণ্ডে বিভক্ত পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চলের ঐক্যবদ্ধ সাংসদদের পাশে অসুবিধা বােধ করবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আবার পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশে পাঞ্জাব-বিরােধী মনােভাব জাগাতে প্ররােচনা দিয়ে থাকেন। আশার কথা, নাজিমুদ্দিনের অন্তরঙ্গ ফজলুর, গুলাম মুহম্মদের চক্ষুশূল। এই বিদ্বেষটা কাজে লাগিয়ে হয়তাে গুলামকে দিয়ে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা খারিজ করা যাবে – এমন মৎলব করলাে পাঞ্জাবী চক্র। মুসলিমদের একটি ক্ষুদ্র শাখা বা সেক্ট আহমাদি সম্প্রদায়। তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাধিয়ে, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দৌলাতানা দাঙ্গার দায় চাপালেন নাজিমুদ্দিনের উপর। এটা হ’ল ১৯৫৩ র মার্চ-এপ্রিলের কথা। নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করলেন গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহম্মদ। পূর্ববঙ্গের এম, সি, এ-দের নিকট সুবিধা আদায়ের পরিস্থিতি এবারে হাতে এল পাঞ্জাবীদের। (২৩)

আহমাদি-নিধন পর্বের নেপথ্য কাহিনী পাঞ্জাবীচক্রের ক্রুর চক্রান্তের কাহিনী। ১৯৫২-র জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কাহিনীর মূলসূত্র খুঁজতে হবে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দৌলাতানার সমর্থন নিয়ে, ঐ সরকারের বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বরাদ্দ অর্থ সংবাদপত্রদের মত ক্রয় করার কাজে ব্যবহার করা হয়। সংবাদপত্র-উলামা সমস্বরে আহমাদিদের অমুসলিম ঘােষণা করার দাবি তুললাে। উলামাদের প্রতিনিধিদল প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের কাছে একই দাবি পেশ করলাে। এমন কি, আহমাদি মুসলিম জাফরুল্লা খানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করার দাবিও তােলা হ’ল। পাঞ্জাব প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পূর্বেই আহমাদি-বিরােধী প্রস্তাব পাশ করেছিল। ১৯৫৩-র ৬ ই মার্চ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দৌলাতানা ঘােষণা করলেন, পাঞ্জাব সরকার আহমাদি-বিরােধী আন্দোলনকে যুক্তিসঙ্গত মনে করে। একজন প্রাদেশিক মন্ত্রীকে এই সম্পর্কে আলােচনা করতে শীঘ্রই কেন্দ্রীয় সরকারের সমীপে পাঠানাে হবে। (২৪) | একই মুসলিম লীগ দলের কেন্দ্রীয় সরকার করাচিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তথাপি পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ লঙঘন করে ঐ দাঙ্গা প্রতিহত না করে তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চললাে। দৌলাতানা স্পষ্ট জানালেন, নাজিমুদ্দিনের ঐ মূলনীতি রিপোের্ট তিনি মনে-মনে মানেন না। দাঙ্গা থামাতে শেষে সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়। লাহােরে মে মাসের মধ্যভাগ অবধি সামরিক শাসন চালু ছিল। বাঙালীরা নাজিমুদ্দিন রিপাের্টে যথেষ্ট কূপকাৎ হয় নি বলেই নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে দেবার গূঢ় উদ্দেশ্যে এই আহমাদি বিরােধী দাঙ্গার আগুন জ্বালা হয়েছিল। (২৫) | রাজনৈতিক চক্রান্ত সম্বন্ধে অবহিত হ’য়েও নাজিমুদ্দিন কেন প্রথমেই আহমাদি বিরােধী দাঙ্গাকে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা গণ্য করে কঠোর হস্তে দমন করেন নি? আসলে নাজিমুদ্দিনের বি, পি, সি বা মূলনীতি রিপাের্টও ধর্মান্ধ উলামাদের এবং ইসলামের বিধি নিষেধকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল। ইসলামের নামে ধর্মান্ধরা এবং উলামারা এখন তাঁকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেললেও তাঁর কিছু করার ছিল না। উলামার বিচারে তিনি ইসলাম বিরােধী হয়ে গেলে তাঁর যে আরাে বড় বিপদে পড়তে হবে! এতএব ধীরে চলা বই পথ ছিল না তাঁর। (২৬)

পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র গণ্য করা এবং কোরান ও সুন্নার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই বাণিজ্যিক তথা প্রযুক্তিনির্ভর যুগের সংবিধান রচনা করা এবং একই সঙ্গে জনসাধারণকে প্রীত করতে গণতন্ত্রের কথা বলা – এত সবের মধ্যে সঙ্গতি রক্ষা করা যায় । তা ছাড়া খলিফা তাে পাকিস্তানের নন, সকল মুসলমানও পাকিস্তানের অধিবাসী নন। তা হলে তাে ইসলামিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞানুসারে পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র ভাবাই যায় না। ইসলামের জয়জয়াকারের ঐতিহাসিক কাহিনী কল্পনা করে সরলচিত্ত নাগরিকদের ধর্মীয় উন্মাদনায় প্ররােচিত করার গঢ় উদ্দেশ্য সহজেই অনুমেয়। আহমাদি নিধন ঠেকাতে উলামাকে খােসামােদ করেও নাজিমুদ্দিনের লাভ হয় নি। অথচ ঐ হত্যালীলা বন্ধ করতে না পারার অজুহাতে ১৯৫৩-র ১৭ ই এপ্রিল নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে দিলেন গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহম্মদ। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। মুহম্মদের পরবর্তী কালে ইসলামিক সনাতন বিধিনিষেধে কোনাে সংযােজনের দৃষ্টান্ত নেই। শারিয়া – বিধি আধুনিক ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের পরিপন্থী। সীমাহীন ক্ষমতার অধিকার বর্তায় রাষ্ট্রনেতার উপরে। এই ইসলামিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্র খাপ খায় না। (২৭)। | নাজিমুদ্দিন – কথিত ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এলে উলামা অন্তহীন ক্ষমতালাভ করবে। ব্যক্তিস্বাধীনতার উল্লেখ ছিল নাজিমুদ্দিনের আমলের মূলনীতি প্রস্তাবনায়। উলামা এর মধ্যে ইসলাম – বিরােধী ভাব ছাড়া আর কিছু দেখে নি। তা ছাড়া, শিয়া, সুন্নি, বারেলভি । এবং দেওবান্দি গােষ্ঠীগুলাের প্রত্যেকটি অপরগুলিকে কাফির বা ইসলাম -বহির্ভূত গােষ্ঠী। ভাবে। ইসলামিক রাষ্ট্রের দ্বারা বিজিত রাষ্ট্রের অমুসলিমেরা ‘জিমি’ স্তরের নাগরিক হবেন এবং ইসলামিক রাষ্ট্রের অন্তর্গত অমুসলিম মুয়াহিদ স্তরের নাগরিক হবেন যদি ঐ রূপ বন্দোবস্ত রাষ্ট্র করে থাকে। অবশ্যই তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার থাকবে না। উদ্ধৃত নির্দেশ উলামার। অথাৎ পাকিস্তানের অমুসলিমদের অধিকার উক্ত দুই শ্রেনীর নাগরিকদের তুলনাতেও নগণ্য হবে। (২৮) • পাকিস্তানের সংবিধান রচয়িতারা ইসলামিক রাষ্ট্রের কল্পনা করে উলামার গুরুত্ব বিস্তর বাড়িয়ে দেন। ফলে উলামার ধর্মান্ধ প্রচারগুণে সাধারণের মধ্যে বিধর্মীদের উপর নৃশংস আচরণ করার প্রবণতা দেখা দেবে। সম্রাট আকবরের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার নীতি এবং তাঁর জিজিয়া কর উচ্ছেদ করার নীতি শেখ সিরিন্দির মনঃপূত ছিল না। এই সিরিন্দির প্রতি শ্রদ্ধাশীল উলামাই আহমাদি হত্যার নির্দেশ দেন। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে তালিমাত-ই-ইসলামি বাের্ডের সদস্যরা নিজ সরকারের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন এবং আহমেদি-নিধনের সমর্থক ছিলেন। ধর্মান্ধদের প্রচারে বিভ্রান্ত দার্শনিক – কবি ইকবাল পর্যন্ত আহমেদিদের অমুসলমান হিসাবে চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছিলেন।(২৯)

১৯৪৭ এর ১১ই অগাস্ট জিন্না বলেছিলেন, ‘ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। গণতান্ত্রিক অধিকার সকলের জন্য সমান। ধর্ম, জাতি এ সব এখানে নিয়ামক নয়। কিন্তু ১৯৪৯ এর ১২ ই মার্চের মূললক্ষ্য ঘােষণায় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বিঘ্নিত করা হয়। জিন্নার বক্তব্যের বিপরীত মেরুতেই ঐ লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান চিহ্নিত হয়েছিল। আহমাদি নিধন দৌলাতানার কারসাজি। অথচ শান্তিরক্ষায় ব্যর্থতার অজুহাতে ঐ আহমাদি নিধন দাঙ্গাকে উপলক্ষ করে গুলাম মুহম্মদ নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভা খারিজ করলেন ১৯৫৩ র ১৭ই এপ্রিল।(৩০)

আয়ব্যয় বা বাজেট প্রস্তাব পাশ করিয়ে নাজিমুদ্দিন গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন অক্ষুন্ন রেখেছেন, এ প্রমাণ উপস্থিত করার পরেও তাঁর মন্ত্রিসভা খারিজ করে দিয়ে গভর্নর জেনারেল ক্ষমতার যে অপব্যবহার করেন, তেমন বেহদ্দ অগণতান্ত্রিকতার নজির দুর্লভ। অতঃপর পূর্ববঙ্গের বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত করে নিরাপদ একটি উপায় আবিষ্কার করা হ’ল যার ফলে বাঙালী ভাবাবেগ প্রীত হবে অথচ কাটিয়ে এবং মুসলিম লীগ দলের উপর প্রভাবশূন্য হয়ে পুতুল প্রধানমন্ত্রীপদের যােগ্যতা সর্বাধিক অর্জন করেছিলেন বগুড়ার এই ব্যক্তি। পালামেন্টারি রাজনীতি হয়ে এল, নিরুত্তাপ। কুচক্রী আমলাতন্ত্র কিংবা নাটের গুরু চৌধুরী মুহম্মদ আলি এমন কি ঐ চক্রের ক্রীড়াপুত্তলিকা স্বরূপ নূতন প্রধান মন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলি – কারুর সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য নেই রাজনীতিকদের মামুলি ভাষণে। সংসদীয় প্রথার যথেচ্ছ লঙ্ঘনে ঐ শাসকচক্রকে কোনাে বাধা দেবার মতাে ঐক্য ছিল না সাংসদদের। খালিদ বি, সয়িদ এই অবস্থাকে রাজনীতিকদের বিশৃঙ্খলতা বলে এর সাথে ফুটবল মাঠের হুটোপুটির তুলনা করেন। অবশ্য তাঁর মন্তব্যে ফাঁক ছিল। বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি রাজনীতিকরা নন, করেছিলেন ঐ আমলারা।(৩১) | প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ আলি গভর্নর জেনারেলের অন্তর্বর্তী সংবিধানের পরিকল্পনা মেনে নিয়ে বশংবদতা প্রমাণ করলেন। এই পরিকল্পনা অনুসারে, গভর্নর জেনারেল তাঁর মর্জিমাফিক ব্যবহার্য বিশেষ ক্ষমতার প্রয়ােগ করে আইনসভায় পাশ হওয়া সত্ত্বেও কোনাে আইনকে নাকোচ করতে পারবেন। কোরান এবং সুন্নার সঙ্গে সঙ্গতিহীন আইন প্রণয়নের অধিকার দূর করার ব্যবস্থাও এই পরিকল্পনায় নিহিত ছিল। চালু গণপরিষদের প্রতিনিধিত্ব মূলক চরিত্র না থাকায় নূতন গণপরিষদ গঠনের কথাও এতে ছিল। মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি অন্তর্বর্তী সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে এবং সে ব্যাপারে উলামার সমর্থনও অর্জন করে। উলামার ক্ষমতা যে বেড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল পূর্ববঙ্গীয়রা যখন বি, পি, সি-র সুপারিশে সায় দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান পদে মুসলিম আবশ্যিক এই ধারা মেনে তাে নিলেনই এবং কোরান অথবা সুন্নার পরিপন্থী কোনাে আইন প্রণয়ন চলবে না- এও মেনে নিলেন। পাঞ্জাবী শক্তিচক্র পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলি একাকার করার মলবে বি, পি, সি-র সুপারিশ সংশােধন করতে চাইলাে। তখন দুই অঞ্চলের মােট প্রতিনিধির সমতার অপব্যবহার করে গণপরিষদে বাঙালীর আধিপত্য খর্ব করার যে- ইচ্ছা তার প্রধান বাধা পূর্ববঙ্গীয়রা। এমনিতেই ছােট প্রদেশগুলাের পাঞ্জাবী আধিপত্য ভীতি ছিল। পূর্ববঙ্গীয়রা তার সুযােগ নিলেন। শুধু নাজিমুদ্দিনকে হটাতে পারার ক্ষমতা দেখিয়ে গণপরিষদ কঞ্জা করা গেল না দেখে শাসকচক্র আরাে চরম পন্থার কথা ভাবতে বাধ্য হল। (৩২)। | প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলির মস্তিষ্কপ্রসূত বলে খ্যাত নূতন এক প্রতিনিধিসমতা সূত্র গভর্নর জেনারেল মেনে নেবার ফলে গণ পরিষদে ফের বি, পি, সি নিয়ে আলােচনার সুযােগ এল। হাউস অব পিপলে পূর্ববঙ্গের ১৬৫ টি এবং পশ্চিমাঞ্চলের ১৩৫ টি আসন থাকবে। অন্যদিকে হাউস অব ইউনিটসে পূর্ববঙ্গের ১০ টি এবং পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলাের মােট ৪০ টি আসন থাকবে। উভয় হাউসের অন্ততঃ ৩০ শতাংশের সমর্থন না থাকলে বিবাদ নিরসনে দুই হাউসের যৌথ অধিবেশন কোন সিদ্ধান্তই কার্যকর করতে পারবে না। মুহম্মদ আলির নূতন সূত্র পূর্ববঙ্গীয়দের সংখ্যাগত আধিক্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। তবু জনগণকে কিছু করা হচ্ছে বােঝাতেই পাঞ্জাব এবং পূর্ববঙ্গ এই নূতন সমতা নীতি গ্রহণ করলেন। বি, পি, সি রিপাের্টে প্রাদেশিক সরকার গুলাে কোন্ নিরিখে তাদের প্রাপ্য লাভ করবে সে কথার কোনাে উল্লেখ ছিল না। একই প্রকার। বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, সংসদীয় পদ্ধতি উপেক্ষা করে গণপরিষদের বাহিরে ঐ সমতা। নীতি গৃহীত হয়েছিল। (৩৩)।

মুহম্মদ আলি সূত্রে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ঈষাপরায়ণতা মেনে নিয়েই যা কিছু করা হয়েছিল। নাজিমুদ্দিন সূত্রের চেয়েও বেশি প্রকট হয়ে পড়েছিল ঐ সংহতিহীনতা। তাকেই যেন একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চেয়েছিল। নূতন সূত্র। আপার হাউস বা উচ্চপরিষদ জননির্বাচিত না হয়েও নিম্নপরিষদের বা হাউস অব দি পিল-এর সমতুল ক্ষমতার অধিকারী ছিল এই নূতন সূত্রে। পরােক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ধনীদের এই হাউসে প্রতিনিধি হয়ে আসার সমধিক সম্ভাবনা ছিল। ধনিক সম্প্রদায় তার স্বার্থহানিকর সমাজকল্যাণ মূলক আইন প্রণয়নে বাধাসৃষ্টিই করবে এ তাে। সহজ কথা। আর এই উচ্চকক্ষ বা আপার হাউসের ৫০ টির মধ্যে ৪০ টি আসনই বরাদ্দ । করা হয়েছিল পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। এর ফলে পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিসংস্কারের কাজে প্রতিবন্ধকতা আসবে এমন অশুভ সম্ভাবনা থেকেই গেল। প্রাদেশিকতা ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হবে মুহম্মদ আলি সূত্র থেকে। এই সূত্রের প্রকাশ ঘটামাত্র পশ্চিম খণ্ডে বাঙালীবিদ্বেষ বেড়ে গেছে। পূর্ববঙ্গেও মুসলিম লীগ ভিন্ন দলগুলি এই সূত্রের বিরােধিতা করেছে। পাঞ্জাব মুসলিম লীগের কিছু নেতা এই সূত্রের বিরুদ্ধে প্রাদেশিক আইনসভার অভ্যন্তরেই মতামত ব্যক্ত করতে উদ্যত বুঝে ঐ আইনসভার অধিবেশনই আকস্মিকভাবে স্থগিত করে দেওয়া হয়। তিরিশ শতাংশ ধারার আড়ালে দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রিগণ আশ্রয় পাবেন – এ সম্ভবনাও থেকে গেল। এত বাগাড়ম্বরের পরও পূর্ববঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের অজুহাতে বলা হ’ল বি, পি, সি রিপাের্ট সম্পূর্ণ করা এই সময় সম্ভব হবে না। বেগম সইতা সােহরাবর্দি ইক্রামুল্লাহ এর প্রতিবাদে দীর্ঘদিনের মুসলিমলীগসদস্য পদ পরিহার করার কথা ঘােষণা করলেন গণপরিষদ কক্ষের অভ্যন্তরেই। তিনি বলেন, কয়েকটি ধারা অনুমােদন, তাদের উপরে ইসলামিক তকমা লেপন এবং তারপরেই সংবিধান বস্তুটিকে ঠাণ্ডাঘরে বন্ধ করে রেখে দেওয়া – জনগণকে এইভাবে প্রতারিত করে যেতে তিনি আর পারছেন না।(৩৪)

মুহম্মদ আলি সূত্র মেনে নিয়ে বি, পি, সি রিপাের্ট এর বিবেচনা পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেবার সময় মুসলিম লীগপন্থীরা পূর্ববঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের কথা মনে রেখেছিলেন একথা সত্য হলেও সংখ্যালঘুদের শক্ত করে তুলেছিলেন তাঁরা ইসলামিক রাষ্ট্রের সােৎসাহ সমর্থনের ফলে। কোরান বা সুন্নার সঙ্গে মিল না থাকলে দেশের আইন কেন ব্যক্তিগত প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট আইনও অগ্রাহ্য হবার সংবাদে এস্ত হিন্দুরা শেষােক্ত ক্ষেত্রে অব্যাহতি চেয়েও পান নি। ধর্মীয় আগ্রাসন যেন সাংবিধানিক অনুমােদন নিয়ে বিধর্মীদের উপর উদ্যত- এমন আশঙ্কা বােধ করলেন সংখ্যালঘুরা। তাঁদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে – এও তাঁরা বুঝে নিলেন। (৩৫)

উলামা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের সংবাদপত্র – সর্বত্র নিদর্শন ছিল যে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা অমূলক নয়। তালিমত-ই-ইসলামি বাের্ডসদস্যদের রচিত এক রিপাের্টে কোরাণের স্তোত্র উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়, অমুসলিমের সঙ্গে মুসলিমের সখ্য সম্ভব নয়। অপর এক স্তোত্র উদ্ধৃত করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন এই সদস্যগণ যে, সরকারী উচ্চপদে অমুসলিম অচল। হিন্দু এম, সি, এ গণ একবার তাঁদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গভর্নর জেনারেলকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলে ঐ অনুষ্ঠানকে শুভ বলে তিনি উল্লেখ করেন। করাচির দৈনিক ডন এই মন্তব্যের সমালােচনা করে লেখে, অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানকে শুভ বলাটা অসঙ্গত। বাঙলা ভাষার স্তুতি করে একটি গান গেয়েছিলেন কিছু মুসলিম এবং হিন্দু এম, সি, এ। ‘মর্নিং নিউজ’ এর মধ্যেও পৌত্তলিকতা আবিষ্কার করেছিল। শিক্ষিত মুসলিমরাও ইসলামিক রাষ্ট্রের ভাবনা থেকে উদ্ভূত সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদিয়কতার শিকার হয়ে ছিলেন এই পর্যায়ে। বহু দশক ধরে হিন্দু-মুসলমান একযােগে যে হিন্দু ধর্মোৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শােভাযাত্রায় উৎসাহ সহকারে যােগ দিতেন তারও চিরাচরিত গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন কিছু সংরক্ষণশীল মুসলিম। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন ইচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের নিরস্ত করতে পারেন নি। (৩৬)

১৯৫০- এর বীভৎস সংখ্যালঘুনিধনের পরেও কোনাে সহৃদয়তার পরিচয় পাওয়া যায় নি। নেহেরু – লিয়াকৎ চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সরকারী আদেশনামা পাঠানাে হয় যাতে জেলাশাসকের অনুমােদন ব্যতীত কোনাে অমুসলিমকে কর্মে নিযুক্ত করা না হয় সেই মর্মে। ৫০-এর দাঙ্গাসন্ত্রস্ত হিন্দুরা ফিরে এলে তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়াও নিষিদ্ধ হয় অপর এক আদেশবলে। চাকুরী নেই, ব্যবসাও অসম্ভব বুঝে হিন্দুদের পাকিস্তানে বাস করার পাট চুকিয়ে ভারতে চলে যেতে হল। কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ববঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠায় অনিচ্ছা যে- সময় ঐ অঞ্চলকে শিল্পের দিক থেকে বড় দীন অবস্থায় রেখেছিল, তখন পাকিস্তানকে নিজের দেশ জ্ঞান করে অনেক ধনী হিন্দু কোটি টাকা বিনিয়ােগও করেছিলেন পূর্ববঙ্গের শিল্পোন্নয়ন কল্পে। অথচ আমলাতন্ত্রের প্রতিকূলতায় তার পরেও তাঁদের পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে হয়েছিল। তখন আবার দেশত্যাগী বলে এঁদের দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশও করতে ছাড়ে নি ঐ একই শাসকচক্র। লিয়াকৎ হত্যার দায়-ও হিন্দুদের ঘাড়ে চাপানাের চেষ্টা প্রথম দিকে হয়েছিল। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের কোনাে অবনতি ঘটলে, তার খেসারত দিতে হত হিন্দুদের। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় ঘােষণা করেছিলেন, পাকিস্তান কোনাে জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্র নয়, এ হ’ল ইসলামিক রাষ্ট্র। গােলার ধান, পুকুরের মাছ যখন অমুসলমানদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হত, পরিস্থিতির গুণে তার বিরুদ্ধে নালিশও কেউ না জানিয়ে মুখ বুজে সহ্য করতেন। কারণ অভিযােগকারীকেই সেক্ষেত্রে পুলিশের হামলার মুখে পড়তে হ’ত। অমুসলিমদের সকল অধিকারের উপর আগ্রাসনে প্রশ্রয় দিয়ে সরকার কার্যতঃ সমগ্র সামাজিক কাঠামাে এবং তার শৃঙ্খলাই চূর্ণ করে দিয়েছিল। (৩৭) | অমুসলিমদের চোখের সামনে গণতান্ত্রিক শাসনের সম্ভাবনাও ভাসে নি সে সময়। চতুর্দিকে অমানিশার অশুভ ইঙ্গিতের মধ্যেও সান্ত্বনার কথা শুনিয়েছিলেন মিঞা মুহম্মদ ইফতিখার উদ্দিন। যেদিন বগুড়ার মুহম্মদ আলি বি, পি, সি রিপাের্ট পেশ করেন সেই ১৯৫৩ র ২২ শে অক্টোবর গণপরিষদের সমক্ষে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানে হিন্দুদের চেয়ে ঢের ভালাে ব্যবহার পেয়ে থাকেন ভারতে মুসলিমরা। অমুসলিমদের পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে অঙ্গীভূত হতে বাধা দেওয়া হচ্ছে ইসলামিক রাষ্ট্রের শ্লোগানের আড়ালে। যে-সব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানকার মুসলমানদের উপরেও তাে এ সবের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। (৩৮)।

মুসলিম লীগ নেতৃত্ব শুধু ইসলামিক রাষ্ট্র শ্লোগানের জোরেই পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে উতরে যাবার ভুল স্বপ্ন দেখেছিল। পূর্ববঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় শাসকচক্র যে অবিচার করে চলেছিল তার প্রতিকারের কোনাে ক্ষমতাই এই দলের ছিল না। তখনকার অর্থমন্ত্রী গুলাম মুহম্মদের এক সংশােধনী বিলের ফলে বিক্রয়কর ১৯৫০ থেকে আরাে দু’বছরের জন্য। কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত রইল। পাট রপ্তানি ঘটিত শুল্কের ক্ষেত্রেও পূর্ববঙ্গের বঞ্চনার মান আংশিক লাঘব হয়েছিল রেইসমান রােয়েদাদে। ঐ রােয়েদাদে অবশ্য তামাক, চা, সুপারির উৎপাদন শুল্কের কিছু অংশ কেন্দ্র ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল পূর্ববঙ্গ সরকারকে। কিন্তু যে বিক্রয়করই ছিল পূর্ববঙ্গ সরকারের ভরসাস্থল, তার অধিকার কেন্দ্রে বর্তানাের অর্থ ছিল সর্বনাশা। আদমসুমারির তথ্যে পূর্ববঙ্গের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ অপুষ্টিক্লিষ্ট একথা জানার পরেও, পূর্ববঙ্গে বিক্রীত দ্রব্য সামগ্রীর বিক্রয়কর পূর্ববঙ্গসরকার পেত না। যদিও আমদানি অনুজ্ঞাপত্ৰ সহজেই লাভ করে পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ঐ সব পণ্যের বিক্রয় মাধ্যমে মােটা হারে মুনাফা ঘরে তুলতাে। অবশ্যই এ সবের ক্রেতা হ’ত অভাবক্লিষ্ট পূর্ববঙ্গবাসীই। বিদেশ থেকে এই সব পণ্য সরাসরি সুলভে আমদানি করা সঙ্গত হলেও সম্ভব ছিল না কারণ পূর্ববঙ্গীয়রা ঐ আমদানি অনুজ্ঞাই পেতেন না। শাসকচক্রের পূর্ববঙ্গনীতির ছিল এমনই মহিমা। (৩৯) পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপ আচরণ করে চলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যেন খােলাখুলি বৈরিভাবের আশ্রয় নিতেও সঙ্কোচ করতাে না। পাকিস্তানের জন সংখ্যার ৫৬ শতাংশ পূর্ববঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় রাজস্বের ১৮.৭ শতাংশ মাত্র পূর্ববঙ্গের প্রাপ্য ছিল ১৯৫২-৫৩ র বাজেটে। পাট পূর্ববঙ্গের একচেটিয়া উৎপন্ন দ্রব্য। পাটের কারণে প্রাপ্যটুকু এই হিসাবে ধরা হয় নি। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পূর্ববঙ্গের প্রাপ্য কেন্দ্রীয় সাহায্য ২৫ কোটি টাকার চেয়েও বেশি হ’ত। অথচ পূর্ববঙ্গ পেয়েছে ১০ কোটি টাকারও কম। ঋণের অঙ্কও সেই হিসাবে হওয়া উচিত ছিল প্রায় ২৮ কোটি টাকা, হয়েছিল সাড়ে ১৫ কোটি টাকার চেয়েও কম। পশ্চিমাঞ্চলের তুলা উৎপাদক কেন্দ্রীয় সরকারের যে অর্থানুকূল্য লাভ করে থাকে পূর্ববঙ্গের পাট উৎপাদক তদ্রপ সহায়তা থেকে বঞ্চিত। পাঞ্জাবী তুলা উৎপাদক যে ভরতুকি পেয়ে থাকেন, পূর্ববঙ্গের পাট উৎপাক তা থেকে পুরােপুরি বঞ্চিত। তদুপরি পশ্চিমাঞ্চলের যেসব অধিবাসী পূর্ববঙ্গ সরকারের বড় মাপের আমলা এবং কর্মকর্তা, তারা পূর্ববঙ্গবাসীকে অত্যন্ত অবজ্ঞা করে থাকে। শাহুদুল হক তাই ১৯৫২ র ১৮ই মার্চ গণপরিষদে এই উক্তি করেছিলেন, এ সত্য গােপন করে লাভ নেই যে পূর্ববঙ্গ বাসী ক্ৰমশঃই আরাে স্পষ্ট অনুভব করছেন, পূর্বাঞ্চল হতে চলেছে পশ্চিমাঞ্চলের উপনিবেশ। (৪০)।

বাঙালীর রাজনৈতিক চেতনায় শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার বাঙালীদের সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখতাে। একই পদ্ধতি নিল পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ উপদেষ্টাদের মতে একমাত্র বাঙালী ব্যাটেলিয়ন সুদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও রটনা করা হত। বাঙালীর সামরিক দক্ষতা নেই। ১৯৪৮ এ পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এই ভেদ-নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেও যখন প্রধান মন্ত্রী হলেন এ ব্যাপারে মুখ খুলতেও ভয় পেলেন। ১৯৫২-৫৩ র কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনে পূর্ববঙ্গীয় এম, সি, এ গণ এই প্রসঙ্গে পুনঃ পুনঃ তথ্যাদি পেশ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বস্তুতঃ বিমানবাহিনীতে নিয়ােগ করার জন্য ৮ টির মধ্যে যে ১ টি মাত্র কেন্দ্র পূর্ববঙ্গে ছিল তারও ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল পশ্চিমঅঞ্চলের পাকিস্তানীদের জন্য। সামরিক শিক্ষা প্রদানের ৭ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও ১ টি মাত্র অবস্থিত ছিল পূর্ববঙ্গে। পূর্ববঙ্গীয় এম, সি, এ গণ তিক্তকণ্ঠে বলেন তাঁরা এই অবিচার অবসানের দাবি করে করে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। (৪১) | পূর্ববঙ্গীয় এম, সি, এ-দের বক্তৃতায় প্রকাশ পেল শাসকচক্রের বাঙালী-বিদ্বেষের নানা তথ্য। শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে পশ্চিমাঞ্চলের প্রাপ্য সাড়ে ১২ কোটি টাকা। পূর্বাঞ্চলের বরাদ্দ ঐ একই কারণে মাত্র সাড়ে ৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ৭ টি প্রযুক্তি শিক্ষায়তনের প্রত্যেকটিই পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। তাদের মােট ছাত্র সংখ্যা ১১ শত। আর পূর্বাঞ্চলের অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলি সব বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকায় যে একটি মাত্র প্রযুক্তিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু আছে তার শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ১ শত ৫০ জন। পদোন্নতি ব্যাপারেও পশ্চিমাঞ্চলের আমলারা পূর্ববঙ্গীয়দের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করতাে। সৈয়দ আবুল বাসার মামুদ হুসেইন এই সময় যথার্থই বলেছিলেন, ইসলামের নামে ধ্বনি সবাই দেয়। ইসলামের আদর্শ মানে খুব কম লােকই। আর কতােদিন আপনারা ঐ ইসলামের নাম করে পূর্ববঙ্গকে শােষণ করবেন? পূর্ববঙ্গের জন্য সরকারী প্রকল্পাদির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ‘ধীরে চলাে নীতির আসল উদ্দেশ্য পূর্ববঙ্গকে পঙ্গু করে রাখা। (৪২)

পূর্ববঙ্গের সমস্যাগুলাের সমাধানকল্পে প্রয়ােজন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। অথচ বি, পি, সি রিপাের্ট মুহম্মদ আলি যখন পেশ করলেন, স্বায়ত্তশাসনের নামগন্ধও তার মধ্যে পাওয়া গেল না। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সহ মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতারা মনে। করেছিলেন ঐ ঘাটতি পূরণ করা যাবে ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্বনিমাহাত্ম্যে। অথাৎ পূর্ববঙ্গে যে-নির্বাচন আসছে, সেখানে মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িকতাকেই মূলধন করবে প্রচার অভিযানে – এই ছিল তাঁদের অভিমত। অবশ্য বি, পি, সি রিপাের্টে সায় দিয়ে নুরুল আমিন একটা কাজ করতে পেরেছিলেন। শাসকচক্রকে খুসি করার বিনিময়ে কিছু বাঙালী মুসলিম লীগপন্থীদের জুটে যায় কেন্দ্রীয় আইন সভায় বেশ কিছু চাকুরী। অবশ্য ব্যাপক হারে বাঙালীর জন্য পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সভায় চাকুরী লাভ ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিরােধীরা গড়ে তুলছেন নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট। তার মুখােমুখি একটু কিছু না করলে ঐ দাবির জোরে বিরােধীরা মুসলিম লীগকে ছাপিয়ে যাবে এই ভাবনা থেকে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গীয়রা দাবি করলেন, কেন্দ্রীয় আইনসভার অন্ততঃ একটি অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত করতে হবে। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মর্যাদা বাড়বে। উপনিবেশে পরিণত হচ্ছে পূর্ববঙ্গ এই প্রচারও মার খাবে—এমন কিছু ওঁরা কল্পনা করেছিলেন। মিঞা মুহম্মদ ইফতিকারউদ্দিন অবশ্য এই একটি অধিবেশনকে মস্করা বলে উড়িয়ে দেন কারণ ‘প্রকৃত স্বয়ত্তশাসনের প্রসঙ্গের উল্লেখমাত্র ঐ বি, পি, সি রিপাের্টে নেই। লাহাের প্রস্তাবের হােতাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতা মাথায় ছিল না। তাঁরা অবিভক্ত ভারতেই দু’টি স্বশাসিত প্রদেশ মুসলিমদের সুবিধার খাতিরে চিন্তা করেন। বর্তমানে যাঁরা পাকিস্তানের শাসক ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে তাঁরা এতই লিপ্ত যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মতাে সঙ্গত ব্যবস্থাও তাঁরা করে উঠতে পারেন না। (৪৩)

১৯৫৩-৫৪ র মধ্যবর্তী কালে আমলাতন্ত্র এবং সামরিক প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সাহায্য চুক্তি সম্পাদনের মলব আঁটে। এর ফলে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। তা ছাড়া, যে- স্বৈরাচারী শাসনযন্ত্রে পূর্ববঙ্গের মানুষ আস্থা হারিয়েছেন তার জৌলুশ অনেকটাই বাড়ানাে যাবে এর ফলে। এমন চিন্তাও হয়তাে করা হয়েছিল যে একটা সময় আসতে পারে যখন পূর্ববঙ্গকে শাসনাধীন রাখতে হবে নিছক সামরিক শক্তির জোরে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐ চুক্তি ১৯৫৪-র মে মাসের পূর্বে সম্পাদন করা সম্ভব হয় নি। (৪৪) ইতােমধ্যে পূর্ববঙ্গের রাজনীতি এক নাটকীয় মােড় নিলে পশ্চিমখণ্ডের শাসককুল সেই সুবাদে এক চরম বাধার সম্মুখীন হয়।

References: 

  1. MR. DATTA elaborately dealt with these points in his typewritten statement dated 30 November 1965, submitted to the Commission of Enquiry on the exodus of minorities from East Pakistan (appointed) by the Government of India and presided over by Jusitce J. L. KAPUR ). This author consulted that statement.
  2. MD. AFSAR UDDIN, “Notes on Researches about Student Problems at the University of Dacca”, in Pierre Bessaignet (ed.), Social Research in East Pakistan (Dacca, 1960), p 57. BERNARD BARBER, “Change And The Stratification System in Russia, Great Britain and the United States”, in B. BARBER and E. G. BARBER (ed.), European Social Class : Stability and Change (New York, Macmillan, 1965), pp. 139-40. A. F. A. HUSAIN, Employment of Middle Class Muslim Women in Dacca (Dacca University Socio-Economic Research Board, 1958), p. 69.
  3. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN,Constituent Assembly of Pakistan Debates ( CAP Debates for short), 6 September 1955, Vol. I. no. 17, p. 525. Ataur was for some time the Chief Minister of East Pakistan.
  4. Testimony of DR, CHARLES B. MARSHALL, Adviser to the Prime Ministers of Pakistan, 1955-57,beofre a Sub-Committee of the Committee on Foreign Affairs, the United States House of Representatives-Review of the Mutual Security Program : Development and Implementation : Pakistan, January 21 and 22, 1959 (Washington D.C., 1959), p. 5.
  5. CAP (Legislature ) Debates, 19 March 1952, Vol. I. no. 5, pp. 257-58. Speech by H. S. SUHRAWARDY, CAP Debates, 12 September 1955, Vol. I, No. 22, p. 679. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, CAP Debates, 21 January 1956, Vol. I, No. 53, p. 1915. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, Constituent Assembly (Legislature) of Pakistan Debates (CAP (Legislature) Debates for short), 22 March 1956, Vol. I, No. 7, pp. 359-60. Also see National Assembly of Pakistan Debates (NAP Debates for short), 29 May 1963, Vol. II, No. 2, pp. 83-84 ; NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II, No. 12, p. 676.
  6. G. W. CHOUDHURY, “The Constitution of Pakistan”, Pacific Affairs, September 1956, p. 246. Speech by MIAN MUHAMMAD IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 22 October 1953, Vol. XV, No. 11, pp. 300-01.
  7. CAP Debates, 18 January 1950, Vol. VI, No. 4, pp. 66, 84-85.
  8. CAP Debates, 28 September 1950, Vol. VIII, 8. N. 1, pp. 15-42. KEITH CALLARD, Pakistan : A Political Study, pp. 91-92.
  9. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan (Dacca, Green Book House, 1963), pp. 70-71, 227. CAP Debates, 6 September 1955, Vol. I, No. 17. p. 522. Speech by DHIRENDRA NATH DATTA, CAP Debates, 6 January 1950, p. 54. KHALID B. SAYEED was wrong when he stated that this Interim Report of the B.P.C. did not mention any state language-See his Pakistan : The Formative Phase (Karachi, Pakistan Publishing House, 1960), p. 412.
  10. LEONARD BINDER, Religion and Politics in Pakistan, pp 115, 205-07. CAP Debates, 21 November 1950, Vol. VIII, No. 6, pp. 181-83. 11. Cap Debates, 6 january 1950, pp. 34-61.
  11. Ibid., p. 36. KHALID BIN SAYEED, n. 9, pp. 413-14. JYOTI SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan, pp. 23-24. 13. KHALID BIN SAYEED, n. 9, pp. 414-15. 14. CAP DEBATES, 10 APRIL 1952, VOL. XI, No. 3. pp. 25, 31-32
  12. CAP (Legislature ) Debates, 17 March 1952, Vol. I, No. 3. pp. 132-33, 146 ; Speech by A.M.A. HAMID, pp. 185-86. Speech by KAMINI KUMAR DUTTA, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, pp. 27-29. JYOTI SENGUPTA, n. 12, pp. 128-35. Census of Pakistan, 1951, Vol. I, p. 71. HASAN HAFIZUR RAHMAN (ed.), Ekushe February (i.e., Twentyfirst February); this collection of thirty essays, stories, dramas, sketches, poems and songs amply brings out the significance of 21 February 1952 in the history of East Bengal.
  13. JYOTI SENGUPTA, n. 12, p. 133. CAP Debates, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, pp. 22-47. Speech by A. K. FAZLUL HUQ, Ibid., pp. 3436; speech by NURUL AMIN, pp. 43-46.
  14. Speech by RAJ KUMAR CHAKRAVARTY, CAP Debates, 21 April 1952, Vol. I, No. 24, pp. 1550-53. Speech by SARDAR SHAUKAT HYAT KHAN, CAP Debates, 22 April 1952, Vol. I, No. 25, pp. 1602-04. CAP Debates, 25 April 1952, Vol. I, No. 27, pp. 1687-1706.
  15. CAP Debates, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, pp. 47-49. CAP Debates, 15 April 1952, Vol. XI, No. 4, pp. 76-77. CAP Debates, 16 April 1952, Vol. XI, No. 5, pp. 87, 90-91, 106.
  16. CAP Debates, 15 April 1952, Vol. XI, No. 4, pp. 68-69, 70-71, 74. CAP Debates, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, p. 51.
  17. CAP Debates, 16 April 1952, Vol. XI, No. 5, p. 106 ; speech by NURUL AMIN, Ibid., pp. 97-100. CAP Debates, 17 April 1952, pp. 133, 138 ; speech by SIR MUHAMMAD ZAFRULLAH KHAN, Ibid., pp. 128-33. CAP Debates, 19 April 1952, Vol. XI, No. 8, p. 220.
  18. CAP Debates, 15 April 1952, Vol. XI, No. 4, pp. 65-66, 69. CAP Debates, 18 January 1950, Vol. VI, No. 4, pp. 84-85. CAP Debates, 11 April 1951, Vol. IX, No. 2, p. 12.
  19. Appendix I, in CAP Debates, 22 December 1952, Vol. XII, No. 2, pp. 80-160, contains the Report of the Basic Principles Committee.
  20. BHUPENDRA KUMAR DATTA (Interview, 12 September 1966) laid a great emphasis on the personal enemity between Ghulam Muhammad and Fazlur Rahman as an explanation of the dismissal of the Nazimuddin Ministry on 17 April 1953. G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 71-72. K. B. SAYEED, n. 9, pp. 415-16. HERBERT FELDMAN, A Constitution for Pakistan (Karachi, Oxford University Press, 1955), pp. 46-47. Z. A. SULERI, Politicians & Ayub (Rawalpindi, Capital Law & General Book Depot, 1964), pp. 8-9. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP Debates, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, p. 2046. LEONARD BINDER, n. 10, pp. 246-47.
  21. Report of the Court of Inquiry constituted under Punjab Act ll of 1954 to enquire into the Punjab Disturbances of 1953 (Lahore, Government Printing, Punjab, 1954), pp. 1, 237, 240, 263-65, 274-75, 386.
  22. Ibid., pp. 1, 231, 237, 276, 285, 385, 387. 26. JYOTI SENGUPTA, ‘n. 12, p. 51. LEONARD BINDER, n. 10, pp. 142-43, 155-56. Report of the Court of Inquiry, n. 24, pp. 237, 239, 240-41, 264-65, 282.
  23. H. A. R. GIBB, “Constitutional Organization”, in MAJID KHADDURI AND HERBERT J. LIEBESNEY (eds.), Law in the Middle East (Washington, The Middle East Institute, 1955), p. 3. NOEL J. COULSON, “The State and the Individual in Islamic Law”, International and Comparative Law Quarterly, January 1957, pp. 50-52. NOEL J. COULSON, “The Concept of Progress and Islamic Law”, in ROBERT N. BELLAH (ed.), Religion and Progress in Modern Asia (New York, Free Press, 1965), pp. 74-75. Report of the Court of Inquiry, n. 24, p. 210. Professor AJIT KUMAR SEN of Dacca University wrote a brief article in Janamat, 13 September 1949, p. 3, exposing effectively the fallacies

inherent in the description of Pakistan as an Islamic State. For an ingenious, thogh unconvincing, interpretation of an Islamic State as the repository of justice, see W. C. SMITH, Pakistan As An Islamic State (Lahore, Shaikh Muhammad Ashraf, 1951).

  1. Report of the Court of Inquiry, n. 24, pp. 203, 212-15, 218-19.
  2. SAIYID A. A. RIZVI, Muslim Revivalist Movements in Northern India in the Sixteenth and Seventeenth Centuries (Agra University, 1955), pp. x, 212, 247-49. MAULANA MUHAMMAD ALI, “Sir Muhammad Iqbal’s statement re the Qadianis”, The Ahmadiyya Anjuman Isha’ at-i-Islam Tract Series (Lahore), October 1935, Vol. I, No. 2, pp. 24, 26, 28-29, 31. Report of the Court of Inquiry, n. 24. pp. 242-43.
  3. G. W. CHOUDHURY, Constitutional Development in Pakistan (Lahore, Longmans Green, 1959), pp. 65-66. Speech by Jinnah, CAP Debates, 11 July 1947, Vol. I, No. 2, pp. 19f. KEITH CALLARD, n. 8, pp. 135-36. Report of the Court of Inquiry, n. 24, p. 282. BINDER, n. 10, pp. 302-03.
  4. KHALID B. SAYEED, “Martial Law Administration in – Pakistan”, Far Eastern Survey, May 1959, p. 72. HUGH TINKER, India

and Pakistan (London, Pall Mall Press, 1962), p. 76. K. B. SAYEED, n. 9, pp. 417-19. MUSHTAQ AHMAD, Government and Politics in Pakistan (Karachi, Pakistan Publishing House, 1959), p. 13. BINDER, n. 10, pp. 296-98, 300-01. CALLARD, n. 8, pp. 136-37.

  1. Civil and Military Gazette, 1 July, 5 August, 17, 29 September 1953. SULERI, n. 23, pp. 74-75. Dawn, 19 October 1953. BINDER, n. 10, pp. 327-28, 345-46.
  2. G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 73-74. Speech by DHIRENDRA NATH DATTA, CAP Debates, 7 October 1953, Vol. XV, No. 2, pp. 5354. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP Debates, 21 October 1953, Vol. XV, No. 10, p. 258. SULERI is not correct when he observes that, under the Muhammad Ali formula, “the real power resided in the Lower House”-SULERI, n. 23, p. 76. BINDER is not clear when he suggests that thirty percent requirement is an additional safeguard” for East Bengal–BINDER, n. 10, p. 312.
  3. Speech by Prof. RAJKUMAR CHAKRAVARTY, CAP Debates, Vol. XV, No. 3, 8 October 1953, pp. 70-72. CAP Debates, Vol. XV, No. 11, pp. 321-22. CAP Debates, 7 October 1953, Vol. XV. No. 2, p. 37. Speech by DR. MAHMUD HUSAIN, CAP Debates, 13 October 1953, Vol. XV, no. 6, p. 157. Speech by BEGUM S. S. IKRAMULLAH. CAP Debates 14 November 1953, Vol. XV, No. 28, pp. 748-49.
  4. CAP Debates, 14 October 1953, Vol. XV, No. 7, p. 185. CAP Debates, 31 October 1953, Vol. XV, No. 19, pp. 630, 638-39, 656. Speech by SRIS CHANDRA CHATTOPADHYAY, CAP Debates, 2 November 1953, Vol. XV, No. 20, pp. 658-59. BINDER is not accurate in asserting that Hindus succeeded in securing a safeguard for their personal laws-BINDER, n. 10, p. 328.
  5. CAP Debates, 29 October 1953, Vol. XV, No. 17, pp. 590-91. CAP Debates, 30 October 1953, Vol. XV, No. 18, p. 606.
  6. CAP (Legislature) Debates, 17 March 1952, Vol. I, No. 3, pp. 132-33, 145-46. CAP (Legislature) Debates, 28 March 1952, Vol. I, No. 12, pp. 677-78. CAP Debates, 19 October 1953, Vol. XV, No. 8, p. 201.
  7. Speech by MIAN MUHAMMAD IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 22 October 1953, Vol. XV, No. 11, pp. 294-95.
  8. CAP Debates, 27 March 1950, Vol. VII, No. 1, pp. 4-9. CAP Debates, 20 March 1952, Vol. XI, No. 1, pp. 12-13. G. W. CHOUDHURY, n. 30, pp. 192-93. G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 23537. CAP (Legislature ) Debates, 18 March 1952, Vol. I, No. 4, p. 185.
  9. Speech by SHAHOODUL HAQUE, CAP (Legislature) Debates, 18 March 1952, Vol. I, No. 4, pp. 197-98. Speech by MOULAVI EBRAHIM KHAN, Ibid., pp. 195-96. Sppech by ABDUL MONEM KHAN, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1952, Vol. I, No. 5, p. 256.
  10. CAP (Legislature) Debates, 19 March 1952, Vol. I, No. 5, pp. 247, 254, 257.
  11. Speech by SYED ABUL BASHER MAHMUD HUSAIN, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1952, Vol. I, No. 5, pp. 253-55 ; Speech by ABDUL MONEM KHAN, Ibid., pp. 256-57.
  12. Speech by IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 22 October 1953, Vol. XV, No. 11, pp. 301-2, 304-5. CAP Debates, 6 November 1953, pp. 699-700. Speech by NUR AHMED, CAP Debates, 7 November 1953, pp. 705-6. Speech by IFTIKHARUDDIN, Ibid., pp. 706-8.
  13. Dawn, 20 May 1954.

Source: গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা, জয়ন্তকুমার রায়, pp 18-35

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!