১ উপক্রমণিকা ও পাকিস্তানের জন্ম ও জন্মদাগ
এ গ্রন্থের মুখ্য বিষয়গুলি এই অধ্যায়ের প্রথম দুটি অনুচ্ছেদে বিধৃত। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা দ্বিবিধ। প্রথমতঃ, জন্মাবধি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে চলে এসেছে পশ্চিমপাকিস্তানীদের একাধিপত্যের অবিচ্ছিন্ন একটি ধারা, অবশ্য ১৯৫৮ র সামরিক শাসন প্রবর্তিত হবার পূর্বে এই অবস্থার মধ্যেও সাময়িক পরিবর্তনের নিদর্শন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই কর্তৃত্ববাদী অভিসন্ধির মধ্যে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রের তুলনামূলক গুরুত্ব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ হয়তাে আছে। তবে এই অভিসন্ধির অস্তিত্ব তর্কাতীত। দ্বিতীয়ত , বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং সংখ্যার দিক থেকে সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রবল গরিষ্ঠতা বিশিষ্ট হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিভেদমূলক আচরণের মধ্যেমে তাঁদের ভারতের সন্নিহিত এলাকাসমূহে বিতাড়িত করার যে পরিকল্পনা, তার তীব্রতার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলেও পূর্ণ বিরতি ঘটেনি কখনােই।
পূর্বপকিস্তানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য পশ্চিমপাকিস্তানী শাসকচক্রের কাছে অগ্রাধিকার পেত, তারই পরিপূরক ছিল ঐ সংখ্যালঘু বিতাড়নের পরিকল্পনাগুলি। একটু সরলীকৃত হলেও এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে পূর্বোক্ত দুটি বিষয়ের যােগসূত্র প্রতীয়মান হবে। অবশ্য পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যালঘু উৎখাত পর্বেরও দৈনন্দিন, অনতিতীব্র একটি ধারার মধ্যে ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারী এবং ১৯৬৪র জানুয়ারীর ভয়ঙ্কর তাণ্ডবগুলি ছিল সম্পূর্ণ পৃথক ধাঁচের। পরবর্তী বৎসর গুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এই আক্রমণের তীব্রতা এবং পৌনঃপুনিকতা হ্রাস পেয়েছিল। পূর্বপাকিস্তান সমস্যার যে-দুটি ধারার উল্লেখ করা হয়েছে তাদের আরাে একটি ঐক্যসূত্র ছিল। পাকিস্তানী শাসকচক্র যদিও সমস্ত পূর্বপাকিস্তানীকে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ত মনে করতেন, তবুও সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এরূপ সন্দেহ ছিল তীব্রতর। সংখ্যালঘুদের প্রশ্নটিকে যেন ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি বা ভারতের উপর চাপসৃষ্টির উপায় মনে করা হত। বিশেষতঃ দেশভাগের পরে নিছক সন্দেহই এই ধরণের সিদ্ধান্তের মূলে থাকলেও, পাকিস্তানের প্রতি উক্ত পাকিস্তানবাসীদের বিশ্বস্ততার অভাবের ধারণা জন্মেছিল যে ঐতিহাসিক এবং ভৌগােলিক পটভূমিতে তার আলােচনা করা যেতে পারে।
পাকিস্তানের দাবিতে আন্দোলনে অবাঙালী মুসলিমরা বর্তমান পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ এবং বাঙলাকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ভারত-বহির্ভূত দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করতেন। পাকিস্তান ভাবনার জনক হিসাবে চিহ্নিত স্যার
মুহম্মদ ইকবাল-ও ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ সম্মেলনে বালুচিস্তান, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠনের কল্পনা করেছিলেন। (১) ১৯৩৩ সালে পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি চৌধুরী রহমৎ আলির কল্পনায় কাশ্মীর এবং সিন্ধুর সংযােজন হলেও, ইকবালের সূত্রের মতােই। * এবারেও বাঙলা বাদ থেকে গেল। ভারতীয়বাদের বিপদ এড়াতে পাকিস্তানের মতােই বাঙলাকেও একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে’—একথাই তিনি বলেন। পরবর্তী বৎসর গুলিতে পাকিস্তানের দাবি জোরদার হলে বাঙলার মুসলিমদের তিনি আহ্বান করেন স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র বাঙলার দাবিতে সংগ্রাম করতে। এর পরে হায়দারাবাদদাক্ষিণাত্য অঞ্চলে উসমানিস্তানের দাবি পেশ করলেন রহমৎ আলি। পাকিস্তান, বাঙলা এবং উসমানিস্তানের তিনটি জাতির মৈত্রী ভারতীয়দের বিপদ থেকে মুসলিমদের মুক্ত করবে—এ আশাও তিনি প্রকাশ করেন। (২)
রহমৎ আলি তাঁর বাহীন কল্পনায় ভারতবর্ষের জন্য পূর্ণাঙ্গ বলকান-পরিকল্পনাও পেশ করেছিলেন ; হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলােও খন্ড খন্ড করে হিন্দুস্তান, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং দ্রাবিড়িয়া নামে পৃথক সব স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণা করেন। তাঁর কল্পনায় আসাম বাঙলার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যাবে—এ আশাও ছিল। ভারতের অভ্যন্তরে বাসরত মুসলিমদের স্বার্থে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উড়িস্যা প্রভৃতির অন্তবর্তী নানা নামের মুসলিম রাষ্ট্রের চিন্তাও তিনি করেন। এ সবে আস্থা মুসলিম জনসাধারণেরও ছিল না। তথাপি এই সকল উদ্ভট ভাবনার পৃষ্ঠপােষক হিসাবে উইনস্টন চার্চিল এবং লর্ড লয়েডের নাম বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। (৩)
এল হামজার পাকিস্তান-একটি জাতিসত্তা গ্রন্থটির ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ এর মধ্যে তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। (৪) গ্রস্থলেখক হামজা উত্তর পশ্চিমভারতের প্রস্তাবিত রাষ্ট্র এবং পূর্বভারতের বাঙলার জলবায়ু, জমির ফসল, অধিবাসীদের শারীরিক গড়ন, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পােশাক ইত্যাদির পার্থক্য বিশেষভাবে আলােচনা করে বলেন এই দুই অঞ্চলের স্ত্রীলােকরাও পরস্পরকে সহানুভূতি দেখাবে না। এ দুই স্বতন্ত্র অঙ্গ নিয়ে একটি জাতিসত্তা গড়ে উঠবে একথা ভাবা যায় না। (৫) | ১৯৪০ সালে ভারতের মুসলিম লীগের লাহাের প্রস্তাবে উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং পূর্বভারতের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলির জন্য যে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়, তাদের পার্থক্য স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন হামজা তাঁর গ্রন্থে। অবিকল রহমতের মতাে বহুধা বিভক্ত ভারতের চিন্তা না করলেও, পাকিস্তান, বাঙলা ছাড়া হিন্দুপ্রধান ভারতের যে অঞ্চল সেখানে হিন্দুস্তান, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং দ্রাবিড়িয়ার মতাে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির চিন্তা তিনিও করেছিলেন।(৬)
এম, আর, টি—এই সাঙ্কেতিক নামে বিভিন্ন প্রবন্ধের এক লেখকও(৭) উত্তর
পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিমদের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্রের কারণে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। (৮) রহমতের মতাে ভারতবর্ষকে টুকরাে টুকরো করার কোনাে চিন্তা তাঁর ছিল না। পাকিস্তান’ শব্দে পা ধ্বনি পাঞ্জাব এবং • পে অন্যান্য ধ্বনি আফগান, সিন্ধু, বালুচিস্তান সূচিত করছে। বাঙলা এই
কারা অনুপস্থিত। তাই উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙলা একটি ভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে এণত হয়েছে পাকিস্তান-আন্দোলনে। লাহাের প্রস্তাবেও পাকিস্তান এবং বাঙলার অত রাষ্ট্র হিসাবেই উল্লেখ ছিল। হামজার বা রহমত-এর তুলনায় এম. আর. টি-র শিণে অধিকতর পুঙ্খানুপুঙ্খ। বাঁকুড়া, বীরভুম, দার্জিলিং প্রভৃতি হিন্দুপ্রধান ( গুলি এম, আর, টি-র পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাহিরে ছিল। অবশ্য আসামের wহD এবং গােয়ালপাড়া এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পশ্চিম এবং উত্তর বাঙলার বিস্তীর্ণ অল বাদ দেওয়া সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাঙলা বা পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যা মিশর, *স্য বা তুর্কীর দ্বিগুণ এবং আফগানিস্তানের তিনগুণ ছিল। (৯) ভারতের দুই প্রান্তে
লথিত দুটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র এম, আর, টির মতে ‘হিন্দু ভারতের দুরভিসন্ধির লি। দুটি প্রহরীর কাজ করে ভারতের ক্ষুদ্রায়তন প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের আশা ভরসার লণ হবে। | জিয়াউদ্দিন আহমাদ সুলেরি (১০) এবং জামিলউদিন (১১) একই প্রকার চিন্তা
।। তাঁরাও উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলে দু’টি * রাষ্ট্রের কথাই বলেছিলেন। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাকিস্তান প্রস্তাবে
ও অন্তর্গত ছিল না। বাঙলা ছিল একটি পৃথক রাষ্ট্র। অন্ততঃ গােড়ার দিকের *ণিজানের প্রতি প্রবক্তাই এইরূপ কল্পনা করেছিলেন।
১৯৯৪৭ এ বাঙলার মুসলিম প্রধান অংশকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত করা হ’লেও, এতদিন ধরে আলােচিত সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক যে বৈশিষ্ট্যগুলি পৃথক লালা রাষ্ট্র চিন্তার মূলে ছিল, তাদের বিলােপসাধন নিশ্চয়ই ঘটে নি। উত্তর-পশ্চিম
নং উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম প্রধান যে দুই ভূখন্ড জুড়ে এক অখন্ড রাষ্ট্র *নি নাম নিয়ে আবির্ভূত হ’ল তাদের মধ্যে হাজার মাইলের যে-ব্যবধান তা জুড়ে ইল ভারত রাষ্ট্র। শুধু ভৌগােলিক অবস্থানগত দূরত্ব নয়, বাঙলা মুলুকের ভাষাও যে। | “গুণ স্বতন্ত্র। এই ভাষা তাে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের-ও ভাষা। সুতরাং wit,মবঙ্গের মারফৎ ভারতীয় প্রভাব, পাকিস্তানের পূর্বখন্ডের মানুষদের উপরে প্রভাব (লে। পাকিস্তানের পশ্চিমখন্ডের শাসককুল এই বৈদেশিক প্রভাবের সম্ভাবনার
শ্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হতে পারে—এমন বিপদও দেখলেন। পূর্ণভাতের মুসলিমদের স্বদেশ হিসাবে বাঙলা যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র হণে, এই মতের সমর্থনে প্রাক-দেশবিভাগ আমলের মুসলিম লেখকরাও বাঙালী হিন্দু
এবং বাঙালী মুসলমানের জীবনধারা, ভাষা এবং সংস্কৃতির অভিন্নতার উল্লেখ করতেন। ঐ একই কারণে গান্ধীজি আবার পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। তিনি বাঙালী হিন্দু আর বাঙলী মুসলমানের মধ্যে কোনাে প্রভেদ লক্ষ্য করেন নি। সুতরাং তাঁর মতে, ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তা তর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু সােহরাবর্দি যখন পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ সংযুক্ত করে অখন্ড বাঙলা রূপে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের চিন্তা করলেন, সেই ১৯৪৭ সালে এসে কিন্তু এই উদ্যমও পশ্চিম পাকিস্তানীদের সন্দেহের উদ্রেক করে। (এ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়ের অবতারণা পরে করা হবে।) দেশভাগের পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য দূরে অবস্থিত রাজধানী থেকে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বাঙলা অঞ্চলের মুসলিমদের নৈরাশ্য বা আশাভঙ্গের কারণ হবে—এই আশঙ্কা গড়ে ওঠে ঐ পশ্চিমাঞ্চলের শাসকচক্রের মধ্যে। বিশেষতঃ রাজনীতি বােধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়ে অধিক অগ্রসর হিন্দু বাঙালীদের সাহচর্যে বাঙালী মুসলিমরা, পশ্চিমখন্ডের শাসকদের ঠেলে দিতে পারে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে—এমন আশঙ্কাও ছিল শাসকদের মনে। (১২)
নিজেদের পশ্চিম এশিয়া উদ্ভূত মনে করে, হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বাঙালী মুসলিমদের প্রতি ধর্মীয় ঐক্যের পরিবর্তে অবজ্ঞাসূচক মনােভাবকেই প্রশ্রয় দিত পশ্চিমপাকিস্তানী মুসলিমরা। সমাজের খুবই নিচু স্তরের হিন্দুরাই জাতিভেদের বা জাতপাতের পীড়ন থেকে অব্যাহতি পেতে ইসলামের শরণ নেন। বাঙলার মুসলিমদের এইসব কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলিম জ্ঞানে অবজ্ঞা করাটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলিমদের রেওয়াজ। (১৩) পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা এই মত খন্ডন করে বলতেন, যে-সময় বাঙলায় ইসলাম জনপ্রিয় হয় তখন হিন্দুধর্মের তেমন কোনাে প্রাধান্য সেখানে ছিল না। তা ছাড়া ভাষাসংস্কৃতির দিক থেকে পূর্ববঙ্গীয়রা পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত—এ কথাও এই বুদ্ধিজীবীরা জানতেন। পশ্চিম পাকিস্তানী আমলাদের রূঢ় এবং দাম্ভিক আচরণে তাদের উচ্চ রুচি বা পরিশীলিত সংস্কৃতির কোনাে পরিচয় সত্যই পাওয়া যেত না। উচ্চপদে নিযুক্ত হ’তে না পারার জ্বালা পূর্ববঙ্গীয়দের স্বভাবতঃই ছিল। বহিরাগত ঐ আমলাদের দুর্ব্যবহারে তা আরাে বর্ধিত হয়। (১৪)।
১৯৪৬-এর ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব অনুযায়ী গঠিত অবিভক্ত ভারতের গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে ১৯৪৭ এ গঠিত পাকিস্তান অংশের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাকিস্তানের প্রথম যে গণপরিষদ কার্যকর হয় তাতে ছিল পূর্ববঙ্গীয়দের বিপুল সংখ্যাধিক্য। পাকিস্তানী শাসকদের মর্জি মতাে আইনে তা গঠিত হলে এ সংখ্যাধিক্য নিশ্চয়ই থাকতাে না। ৪৪ জন পূর্ববঙ্গীয় সদস্যের ১৪ জন ছিলেন হিন্দু ; তা ছাড়া জিন্নার মনােনীত তিনজন অবাঙালীও পূর্ববাঙলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। এই বাঙালী
প্রধান গণপরিষদের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বাঙলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে। জিন্না একাধারে সাংবিধানিক এবং আইনগত প্রধান হিসাবে একনায়কের ক্ষমতা ভােগ করতেন। যদিও কাগজে কলমে গভর্ণর। জেনারেল হিসাবে তিনি নিতান্তই সাংবিধানিক প্রধান ভিন্ন কিছু ছিলেন না। জিন্নার জীবদ্দশায় গণপরিষদে বাঙালীর সংখ্যাগত আধিপত্য পাকিস্তানী রাজনীতিতে কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। সে সুযােগই তখন ছিল না। কিন্তু জিন্নার অভাবে পাকিস্তানী শাসকচক্র ঐ সংখ্যাগত আধিপত্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলাে। (১৫)
| জিন্নার মৃত্যুর পরে খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্ণর জেনারেল পদে প্রতিষ্ঠিত হলেও জিন্নার উত্তরাধিকারী বলে পরিচিত প্রধান মন্ত্রী লিয়াকৎ আলির প্রবল প্রতাপের মুখােমুখি নিজস্ব প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। প্রশাসন এবং সামরিক বিভাগের গুরুত্ব পূর্ণ পদগুলিতে পাঞ্জাবীদের আধিপত্য ঐ প্রদেশের নেতাদের উচ্চাকাঙক্ষা বাড়িয়ে দিল। শুধু উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলে পাঞ্জাবীরা হত তার অবিসংবাদী কর্ণধার এবং সুবিধাভােগী। (১৬) কিন্তু বুদ্ধি, রাজনৈতিক চেতনা এবং হিন্দুদের সহয়তা গুণে এখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবার যােগ্যতা রাখে পূর্ববঙ্গীয়রা। তাই বাঙলার হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। বিনষ্ট করতে তারা উর্দুকে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হ’ল বাঙলা ভাষার উপরে। পাঞ্জাবীদের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার এই দুরভিসন্ধি সংযত করার ক্ষমতা জিন্না এবং লিয়াকৎ আলির অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাঁরা সে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন নি। বরং পাঞ্জাবীরা ওঁদের সমর্থনই পেয়ে গেছে। (১৭) | রাশব্রুক উইলিয়ামস জিন্নাকে যেভাবে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের প্রতি সমভাবাপন্ন হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তা অতিরঞ্জিত। ১৯৪৮ এর মার্চে ঢাকা পরিদর্শন কালে জিন্না যে বিক্ষোভের সম্মুখীন হন তার ফলেই চারজন পূর্ববঙ্গীয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থান পান। এরা হলেন তফাজ্জল আলি, ডঃ এ, এম, মালিক, মুহম্মদ আলি এবং খাজা নাসরুল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত জিন্নাকে ছাত্ররা তিনটি ধ্বনি শুনিয়ে তাঁদের মনােভাব ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের ঐক্য, জিন্নার নেতৃত্ব এবং বাঙলাভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দান সম্পর্কে এই শ্লোগানগুলির কথা সেদিন জিন্নার পার্শে উপবিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বাপ্রােভােস্ট অধ্যাপক পি, সি, চক্রবর্তী, বর্তমান লেখককে জানিয়ে ছিলেন। সমাবর্তন ভাষণে জিন্না কিন্তু ভারতীয় সংবাদপত্রাদি যেন এই পূর্ববঙ্গীয় ভাষা উত্তেজনার কারণ এমন কথা বললেন। জিন্না এই আন্দোলনের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ততাকে জড়িয়ে যেইঙ্গিত সেদিন তাঁর ভাষণে দিয়েছিলেন, অচিরাৎ তারই প্রতিফলন ঘটলাে পূর্ববঙ্গে নিযুক্ত পাঞ্জাবী আমলাদের বঙ্গভাষা সমর্থকদের উপরে পুলিশ এবং গুণ্ডা লেলিয়ে
৫
দেবার মধ্যে। ঐ সমর্থকরা সভাসমিতিতে প্রচার করছিলেন বাঙ্গলাভাষার ন্যায্য অধিকারের কথা। কারণ ঐ সময় পাঞ্জাবী আমলারা বাঙালীদের উপর উর্দু ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেবার প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করে। (১৮)। . ১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে সংখ্যালঘুরা বিপুল সংখ্যায় পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে যাবার পরেও ১৯৫১ র আদমসুমারি অনুসারে বঙ্গভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল পাকিস্তানের জন সংখ্যার ৫৪.৬ শতাংশ। উর্দুভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। মাত্র ৭.২ শতাংশ পাকিস্তানবাসীর ভাষা উর্দুকেই পূর্ববঙ্গীয়দের উপরে চাপানাের চেষ্টা হ’ল। বাঙলা ভাষাকে বিশুদ্ধ ইসলামিক বলা যায় না। হিন্দুরাও বাঙলা ভাষার জন্য আন্দোলনে নিরত—এই দুটি অজুহাত অবশ্যই তুলে ধরা যেত ঐ বাঙলাভাষা সর্মথকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে। হিন্দুরা এই আন্দোলনে থাকার জন্য তাদের উপরে পাকিস্তান-বিরােধিতার অভিযােগও করা হ’ল। কিন্তু কুৎসা সহ্য করেও পাকিস্তানের হিন্দু রাজনীতিকরা বাঙলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ এর ২৫ শে ফেব্রুয়ারী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য হিসাবে ঐ পরিষদেই দাবি করলেন, “উর্দুর সঙ্গে বাঙলাতেও আইনসভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রধান মন্ত্রী ক্রুদ্ধ জবাবে জানালেন, পাকিস্তানের মতাে। মুসলিম রাষ্ট্রে উর্দুই হবে একমাত্র জাতীয়ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতের চর ভেবে নিন্দা করা দূরের কথা, বাঙালী মুসলিমরা তাঁর উর্দুর আগ্রাসী ভূমিকার বিরােধিতায় মদত দিলেন। গণপরিষদের বাঙালী-মুসলিম সদস্যরা যে জিন্নালিয়াকতের প্রবল প্রভাব কাটিয়ে সর্বদা বাঙালীর হয়ে কিছু বলতে পারেন না একথা তখন তাঁদের বিশেষভাবে মনে এল। (১৯) যে-সময় জিন্না ছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, লিয়াকৎ এবং নাজিমুদ্দিন যথাক্রমে পাকিস্তানী প্রধান মন্ত্রী এবং পূর্ববঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রী তখনকার দিনের ছাত্রদের উদ্যোগে বাঙলা-ভাষার পক্ষে যেআন্দোলন চলতাে তাকে কী অবজ্ঞার চোখে শাসকচক্র দেখতাে তার একটি দৃষ্টান্ত। আয়ুব-সুহৃদ মােহাম্মদ আহমদের কথায় পরিষ্কার হয়ে যায়। (২০) আহমদ বলেন, ‘পাকিস্তানের শত্রুদের উস্কানিতে পূর্ববঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্ররা বাঙলা ভাষার জন্য রাজনীতির নামে ছেলেখেলা শুরু করেছে। শ্লোগান, মিছিল নয় ।
তাে মন্ত্রীকে জোর করে বাঙলা ভাষার পক্ষে ভাষণ দান করানাে—এই সব চিত্তবিনােদনের নূতন বিকৃত পন্থাতেই তাদের শিক্ষায়তনে সময়ের বেশির ভাগ কেটে যায়। তবে অবস্থা আয়ত্তের বাহিরে চলে গেলে স্থানীয় দুর্গের মজুত সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতেই হবে প্রশাসনকে। এ সময় পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করলাে। জিন্না-লিয়াকতের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনুগত্য দেখিয়ে মুসলিম লীগ, পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্রের চক্রান্ত এবং দৌরাত্ম সবই মুখ বুজে সহ্য করেছিল।
পূর্ববঙ্গের স্বার্থে সে সবের প্রতিবাদ পর্যন্ত করে নি। ১৯৫৪র প্রাদেশিক নির্বাচনে এর মূল্য দিতে গিয়ে নাকাল হ’ল এই মুসলিম লীগ দল। (এ গ্রন্থে সে আলােচনা পরবর্তী পর্যায়ে করা হবে। কোনাে কোনাে বিদেশী বিশেষজ্ঞ’-ও পাকিস্তানী শাসকচক্রের কথার প্রতিধ্বনি করে বাঙালা ভাষা ঘটিত প্রশ্নটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চান নি। ক্যালার্ড এই শ্রেণীর একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে ইসলামিক রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয় এবং প্রয়ােগের সমস্যাটাই ছিল গণপরিষদের মূল বিবেচ্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি ক্রুদ্ধ আবেগ ভিন্ন কিছু দেখেন নি, যদিও সে আবেগের তীব্রতা তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছিল। ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রশ্নটির চেয়ে পূর্ববঙ্গীয়দের চোখে বাঙলাভাষার সরকারী স্বীকৃতির প্রশ্ন কোনক্রমেই কম জরুরী ছিল না—এটুকু ক্যালার্ড বুঝতে পারলেই ভালাে করতেন। (২১)।
পাঞ্জাবী আমলারা ভাষা প্রশ্নে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে সন্ত্রস্ত বােধ করে। ঐ ঐক্যে ফাটল ধরাতে ১৯৫০-এর ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। ইসলামিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বাঙলা ভাষার সংস্কারের অজুহাতে হিন্দু আবেগে ঘা দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাষা আন্দোলনে ভাঙন ধরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রের বশংবদ পূর্ববঙ্গ সরকার। এই উদ্দেশ্যে সরকার নিয়ােজিত কমিটি এক প্রশ্নোত্তরিকায় পাকিস্তানকে সরাসরি ইসলামিক রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করে। মূল লক্ষ্য সনদে বা অবজেকটিভ রেজোলিউশনে কিন্তু এমনটি ছিল না। বেছে বেছে পাঞ্জাবী আমলা এবং কেন্দ্রের বশংবদ মুসলিম লীগের মতে মত দেবে এমন সব লােকের কাছে এই প্রশ্নোত্তরিকা উপস্থিত করা হ’ল। আরবি লিপি, যথেচ্ছ আরবি, ফারসি এবং উর্দু শব্দ, আমদানি ইত্যাদি মাধ্যমে বাঙলা ভাষার প্রকৃতি ধ্বংস করার সঙ্গে সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষার ছুতােয় দুই ধর্মের মানুষের জন্য দু’ জাতের বাঙলা ভাষার আশ্বাস দিয়ে আসলে হিন্দু এবং মুসলমানের সাংস্কৃতিক সংহতি বিনাশেই ব্রতী হ’ল কেন্দ্রের বশং বদ প্রাদেশিক সরকার। উর্বর কল্পনার বেগে জমি-জায়গার মতাে ভাষারও এলাকাভাগ করতে উদ্যত হ’ল বাঙলা ভাষা সংস্কার কমিটি। (২২) ‘আজাদ’সম্পাদক মৌলানা আক্রাম খান বাঙলা ভাষার প্রস্তাবিত সংস্কারের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সরােজেন্দ্র নাথ রায় ঐ ‘আজাদ পত্রিকা ‘ থেকেই নানা উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন, ‘আনন্দবাজার’-পত্রিকার ভাষা থেকে ঐ ভাষা ভিন্ন নয়। ডঃ রায় তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ মুয়াজিম হুসেইনের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান, প্রকৃতই আরবি ভাষার এই পন্ডিতের রচনায় বাঙলাভাষার মধ্যে আরবি শব্দ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নি। উভয় ভাষার মর্যাদাই হুসেইন এইভাবে রক্ষা করেছেন। ডঃ রায় আরাে বলেন, উর্দু অথাৎ আরবি লিপিতে বাঙলাভাষা চালু করার অর্থ হবে বাঙলাভাষার উপর পীড়ন তথা
লুণ্ঠনের শামিল। (২৩) ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ববঙ্গের অগ্রণী শিক্ষাব্রতী। ভাষাবিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যেও তাঁর স্থান শীর্ষে। তিনি এই সময় ৮০ পৃষ্ঠার এক পুস্তিকা রচনা করেন। আমাদের সমস্যা’ বা ‘আওয়ার প্রবলেম নামের এই পুস্তিকায় ভাষা সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের সমাধানে তিনি যা লিখেছেন তার মধ্যে রাজনীতির উত্তপ্ত পক্ষপাতিত্ব নেই। তিনি বুঝিয়েছেন, বাঙলা ভাষার বিকাশ হিন্দুযুগে বা হিন্দুধর্মপ্রভাবে ঘটে নি। কারণ বৌদ্ধযুগে উদ্ভূত এই বাঙলাভাষাকে পরবর্তী হিন্দুরাজগণ (বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ) আদৌ ভালাে চোখে দেখেন নি। এই ভাষার প্রাথমিক বিকাশ এবং উন্নতি ঘটেছে পাঠান রাজত্বে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই পাঠান রাজগণ এই ভাষার পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। অর্থাৎ হিন্দুরাজাদের বিরূপতা সত্ত্বেও পরবর্তী মুসলিম রাজশক্তির সহায়তায় যে-ভাষার বিকাশ ঘটেছে তাকে নিছক হিন্দুধর্মসংস্কৃতির প্রচার মাধ্যম বলা সম্পূর্ণ ভুল। তদুপরি বাঙলা ভাষা শুধু অধিকাংশ পাকিস্তানীর মাতৃভাষাই নয়, এ খুবই সমৃদ্ধ একটি ভাষা। বিপরীতক্রমে, উর্দু পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলের অধিবাসীর-ই মাতৃভাষা নয়। তথাপি ইংরেজির উচ্ছেদ হলে উর্দুকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করা যেতে পারে। বাঙলাকে অবশ্যই প্রথম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। ধর্ম এবং ভাষার প্রশ্ন মিশিয়ে ফেলার কাজটি নিন্দনীয়। লিপি প্রসঙ্গে যে উর্দু হরফে বাঙলাভাষা প্রবর্তনের কথা চলছে, এটি হলে পূর্ববঙ্গের শিক্ষাদীক্ষার মূল উৎসমুখই শুকিয়ে যাবে। পূর্ববঙ্গের বিনাশ হবে এর ফলে। আদালতে এবং শিক্ষায়তনে বাঙলাভাষার স্থলে উর্দুর প্রচলন শুধু বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার-ই পরিপন্থী হবে তা নয়। এই পরিবর্তনের ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের মূলনীতিকেই খন্ডন করা হবে। (২৪)
বাঙলালিপিকে ব্রাহ্মী লিপি বলা মারাত্মক ভুল। ভারত, শ্যাম, যবদ্বীপের যাবতীয় লিপি ঐ ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ব্রাহ্মী লিপি নাম দিয়ে বাঙলা লিপিকে হিন্দু ব্রাহ্মণদের ব্যাপার হিসাবে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এই ইচ্ছাকৃত প্রমাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল পূর্ববঙ্গবিদ্বেষী শাসকচক্র। উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষার মতাে কৃত্রিম প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্যালার্ড বা রাশব্রুক উইলিয়ামসের মতাে যশস্বী লেখকরাও কিছু লেখেন নি। নিরপেক্ষ শিক্ষাসংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতার নিদর্শন তাে অন্যায় স’য়ে যাওয়া নয়। বরং একালের মনীষার সম্পর্কে এই সহিষ্ণুতা দেখে বিরূপ মন্তব্যের ইচ্ছা জাগে। বাঙালী এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের লিপির মিল যদি মনের মিল ঘটাতে পারে তা হলে লিপির মিল থাকা সত্ত্বেও জার্মানদের সঙ্গে ইংরাজ বা ফরাসির যুদ্ধ বাধে কেন—এ প্রশ্ন তুললেন পূর্ববঙ্গের লেখককুল। পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে বিশিষ্ট অনেকে এমন কথাও বললেন, “আমরা উর্দু শিখতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু উর্দু লিপিতে বাঙলা পড়বাে না।’ পূর্ববঙ্গের লেখকসম্প্রদায় মনে করলেন, উর্দু লিপিতে বাঙলা
প্রচলিত হলে ছয় শত বৎসর ব্যাপী বাঙলা ভাষার যা-কিছু সমৃদ্ধি লাভ হয়েছে তার সবই মুছে যাবে। (২৫) ফের নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে। পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি’ বা ‘দি ফিউচার প্রগ্রেস অব ইস্ট বেঙ্গল’ নামের এক প্রবন্ধে ডঃ শহীদুল্লা অভিযােগ করেন, “উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষা সংক্রান্ত রিপাের্ট সরকারী কমিটি পেশ করার পূর্বেই সরকার ঐ কর্মে অগ্রসর হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষায় উর্দু লিপিতে বাঙলাভাষা ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল অর্থ মঞ্জুর করেছে। এর কী অর্থ ? ক’টাই বা বই সদ্যশিক্ষাপ্রাপ্ত পড়তে পাবে যার ভাষা বাঙলা অথচ লিপি উর্দু ?’ (২৬) প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষায় উর্দু লিপিতে বাঙলাভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৪৯ সালে সরকার ২০ টি স্কুল খুলেছিল। এ ব্যাপারে ১৯৫০ সালে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়। উর্দু লিপিতে বাঙলার সমর্থনে এই সময় যে প্রচারপত্র ছড়ানাে হয় তার মূলে যে সরকারী আনুকূল্য ছিল,সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিল ‘অগত্যা’ নামের এক বাঙলা পত্রিকা। (২৭)
এইরূপ একটি প্রচারপত্রে চট্টগ্রামবাসী কোনাে এক মৌলানা জুলফিকর আলির স্বপ্নাদেশ বর্ণিত হয়েছিল। ঐ প্রচারপত্র অনুসারে, পয়গম্বর স্বপ্নে ঐ মৌলানাকে আদেশ করেন উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষা চালু করতে। পাকিস্তানের জন্ম যেমন মুসলিমদের উপর হিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্য খতম করেছে, উর্দু লিপিও তেমন হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য শেষ করবে। কোরান যখন মুসলিমকে পড়তেই হবে, আর বাঙলা হরফের দ্বারা যখন কোরাণের আরবি ভাষা লেখা অসম্ভব অতএব আরবি লিপি অবশ্য জ্ঞাতব্য। সুতরাং ঐ আরবি অথাৎ উর্দু লিপি সর্বত্র চলা সঙ্গত। বাঙলাভাষার লিপি হিসাবেও যুক্তিসঙ্গত হবে উর্দুর ব্যবহার। ঐ সব প্রচারপত্রে বাঙলা লিপিকে হিন্দুসংস্কৃতির আধিপত্যবাদ তথা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের অনৈক্যের বীজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ উর্দু লিপির কারসাজিতে পাঞ্জাবী শাসকচক্র চেয়েছিল পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম সংহতি—দুয়েরই সর্বনাশ করতে। বাঙলার সাধারণ সংস্কৃতির নামের পৌত্তলিকতা উর্দুর হাতুড়ির ঘায়ে চূর্ণ করতে হবে। কারণ ঐ সাধারণ সংস্কৃতির ধুয়া তুলে তারা পাকিস্তানের মধ্যে শত্রশিবিরের আদর্শ ছড়াতে এবং পাকিস্তানের সংহতি ধ্বংস করতে চায়।'(২৮) একটি প্রচারপত্রে এই মন্তব্যটুকু ছিল। | এই সব প্ররােচনামূলক প্রচারপত্রের পরে বিদগ্ধ লেখক ডঃ শহীদুল্লার বক্তব্য নিশ্চয়ই ক্লান্তিহরণ করবে। তুর্কীতে কামাল আতাতুর্ক আরবি লিপির স্থলে রােম্যান। লিপি চালু করে যে সাফল্য পেয়েছিলেন এবং ইন্দোনেশিয়াতেও যে অনুরূপ পরিবর্তন সাধনে সুফল ফলেছে তার উল্লেখ করে বাঙলা লিপির স্থলে উর্দু অর্থাৎ আরবি লিপি আনার তিনি বিরােধিতা করেন। আহমদ শরিফ লেখেন যে, পারস্যের
অনুসরণে ইসলামের শিক্ষা সফলভাবে প্রচার করতে হলে চাই বাঙালীর মাতৃভাষা বাঙলায় সেটি করা। (২৯)
সরকার পক্ষের এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থপর এবং ক্রুর পরিকল্পনার ব্যাপারে একটাই আশার কথা যে, ঐ পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারে নি। পূর্ববঙ্গের মুসলিমদেরই এ এক কৃতিত্বের কথা। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এ ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়, এই কারণে পাৱাৰী প্রশাসকরা এটি ধ্বংস করার ফন্দি আঁটতে লাগলো। হিন্দুরা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও অংশ গ্রহণ করতাে। ১৯৪৯-এ ঢাকার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা করােনেশন পার্কে অধিকতর নাগরিক অধিকারের দাবিতে জনসভার আয়ােজন করলে সভাস্থলে প্রথমে গুণ্ডাবাহিনী পরে পুলিশও তাঁদের সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে সম্ভ্রমহানি করে। পুলিশ প্রথমে গুণ্ডাদের কাজেই সন্তুষ্ট ছিল। পরে তার নিজস্ব কর্তব্যজ্ঞান জেগে উঠলে তারাও ঐ মহৎ কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুণ্ডাদের সহযােগী হয়। (৩০) আরাে একটি আন্দোলনে মুসলমান কৃষকের পাশে হিন্দু মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ নারীসম্প্রদায়ের কৃতিত্বের পরিচয় বহন করছে। শ্রীহট্টের মুসলমান কৃষকদের এমন কি তাঁদের পত্নীদের-ও অত্যাচারী জমিদার তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতাে। ঐ অঞ্চলের মুসলমান কৃষকরা এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার দমনকল্পে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী প্রেরিত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দু’জন হিন্দুরমণীও ছিলেন। এই দুই মহিলাকে পুলিশ চুল ধরে দু মাইল দীর্ঘ ধানখেতের উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। (৩১) এই সংগ্রামী ঐক্যের বুনিয়াদ যে সাংস্কৃতিক ঐক্য, বহুদশকের সেই মৈত্রীবন্ধন ছিন্ন করবে এমন সহজ পন্থা সরকারের জানা ছিল না। নীরােদ চৌধুরী লিখেছেন, পােশাক এবং খাদ্যভ্যাস বা রন্ধনপ্রণালী ব্যাপারে (বাঙালী হিন্দু এবং মুসলমানের) একীভবন কিছুদূর পর্যন্ত ঘটেছে। সাহিত্যে ঘটেছে আরাে বেশি। কিন্তু লােকায়ত সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এই মিলন সর্বাধিক। হিন্দু এবং মুসলমানরা (এই স্তরে) একই লােকগীতি গায়। একই উৎসব উভয়ের। ধর্মের ক্ষেত্রে অবধি এই মিলনের সুর লক্ষণীয়। হিন্দু দেবমন্দিরে মুসলমান কৃষক ব্রত করেন। আবার হিন্দুও গিয়ে পীরের দরগায় বা মুসলিম ধর্মানুসারে অনুরূপ কোনাে পবিত্রস্থানে মানত করেন। সেই পীর ঐতিহাসিক বা কিংবদন্তীর যাই হােন একই অনুষ্ঠান চলে। (৩২)।
যে-সংস্কৃতিক মিলনে বাঙালী লেখক শ্লাঘান্বিত পাঞ্জাবী শাসকচক্রের মলব সিদ্ধ করতে হলে সেই ঐক্য ধ্বংস না করলেই যে নয়। ১৯৪৬-এর আগষ্টে সােহরাবর্দি মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালে কলকাতা শহরে যে হত্যালীলা চলে দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গার ফলে, তার অনুরূপ কিছু করতে উদ্যত হল ঐ শাসকচক্র। (৩৩)।
পাকিস্তানের জন্মের পরে ১৯৪৬-এর দাঙ্গা স্মরণ করে কিছু প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ভারতে চলে যান। শূন্যস্থান পূরণ করে আর্থিক এবং সামজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কিছু মুসলিম।
১০
হিন্দুদের আর্থিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তি হ্রাস পেলে অর্থাৎ হিন্দু ব্যবসায়ী এবং নানা ওরের এবং পেশার বুদ্ধিজীবী হিন্দুরা ব্যাপক ভাবে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করলে ঐ শূন্যস্থান পুরণের আরাে বড় সুযোেগ মুসলিমদের সামনে এসে পড়বে—এ তাে সত্যই। (৩৪) পাকিস্তান সরকারের নীতি নিয়মিতভাবে হিন্দুদের পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। অথচ দেশবিভাগের অব্যবহিত পূর্বে সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজিীবী মানুষ (যারা অধিকাংশই হিন্দু) ভারতে চলে যেতে শুরু করলে জিন্না এবং লিয়াকৎ আলি তার নিন্দা করে বলেন, পাকিস্তানের প্রশাসন এবং অর্থনীতিকে অচল করে দেবার এই অপচেষ্টা ভারতের প্ররােচনায় ঘটছে। (৩৫) আসলে হিন্দুদের পাকিস্তান ত্যাগ করে যাওয়া তাঁদের অভিপ্রেত হলেও, এত দ্রুত এত বেশী সংখ্যায় শূন্যপদের সৃষ্টি হলে উপযুক্ত মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যাগত অভাব দেখা দেওয়াতেই পাকিস্তানী শাসকরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
| ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরেও পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ববাঙলায় স্থায়ীভাবে বসবাসে আগ্রহী অনেক বুদ্ধিজীবী ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারীর সরকার চালিত বীভৎস হিন্দুনিধন স্বচক্ষে দর্শন করে, নিরাপত্তার কারণে ভারতে চলে আসেন। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বহু নির্যাতন এবং অপমান সহ্য করেও জন্মভূমি আঁকড়ে তাঁরা ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে থেকে যান। অথচ বিদেশী লেখক ক্যালার্ড লেখেন, পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা বড়জোর ব্যতিক্রমের মতাে কখনাে ঘটলেও, মােটের উপর পূর্ববঙ্গ দেশবিভাগের পরে দাঙ্গামুক্ত এলাকা হিসাবেই রয়ে গেছে। (৩৬) ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারীর বিধ্বংসী দাঙ্গার কথা এই লেখক উল্লেখই করেন নি। (৩৭) | আনসার বাহিনী (ন্যাশানাল গার্ড) সাদরে গ্রহণ করতে সমাজ-বিরােধী গুণ্ডাদের। কুট্টিরা ছিল বিহারী গুণ্ডা। ঢাকার নবাবরাও এদের দিয়েই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতেন। সবের উপরে পয়লা নম্বরের দাঙ্গাবাজ ছিলেন পাঞ্জাবী প্রধান সচিব আজিজ আহমেদ। তিনি নিজেকেই পূর্ববঙ্গসরকার ভাবতেন। দাঙ্গাবাজ অফিসারদের পদোন্নতির ব্যবস্থা ইনিই করে দিতেন। অবশ্য এই সব কুচক্রীদের উস্কানি না পেলে সাধারণ মানুষ নীতি বিগহিত কাজ অপছন্দই করতেন। (৩৮) একসময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী জানিয়েছিলেন একবার লুঠ করা জিনিসপত্র তাঁর অনুরােধে দাঙ্গাকারীরা আসল মালিককে ফেরৎ দিয়েছিল। (৩৯) ক্যালার্ডের ধারণা যে কতাে ভ্রান্ত আনসার বাহিনী এবং কুট্টিদের কথা জানার পরে তা বুঝিয়ে বলার দরকার করে না।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নীতিবােধ জাগ্রত হলে পূর্ববঙ্গের কেন্দ্র নির্ভর প্রাদেশিক সরকারও ব্যাপারটা লাভজনক মনে করতেন না। তাঁদের লাভ হ’ত আনসার এবং কুট্টিরা সাধারণ মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ সংক্রমিত করলে। আনসার এবং কুট্টিরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা লাভবান হ’ত। শুধু নির্যাতনে তারা পরিতৃপ্তি পেত না। তাদের এই গুণ্ডামিতে মদত না দিয়ে অনেক
উদারচেতা মুসলমান ভদ্রলােক এই গুণ্ডাদল অথাৎ আনসার বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়েছে। আনসাররা জানতাে সরকারের উপর মহলে তাদের এই সব বেআইনী কাজের জন্য প্রশংসা বই নিন্দা হবে না। তাই বেশ উচ্চ পর্যায়ের অফিসারকেও আনসার বাহিনী প্রয়ােজন বােধ করলে অবজ্ঞা করতাে। রাজশাহীর জেলাশাসক খন্দকার আলি তােয়েব ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। তিনি যথাসাধ্য সংখ্যালঘুদের আগলে রাখতেন। শুণ্ডারা তাঁকে বিদ্রুপ করে বলতাে কালী তােয়েব। কালী হিন্দুদেবী; তােয়েবকে তাঁরা হিন্দুঘেঁষা বলতে চাইতাে। এই উদার অফিসারকে সচিবালয়ে সরিয়ে দিয়ে মজিদ নামে দাঙ্গাবাজ এক অবাঙ্গালীকে রাজশাহীর জেলা শাসক করা হয়। রাজশাহী জেলা জুড়ে হিন্দুদের উপর। নৃশংস অত্যাচারের পাণ্ডা এই মজিদ অনাচারী এবং নিষ্ঠুর অফিসার হিসাবে তােয়েবের প্রাতিপদিক অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর পরে এই ব্যক্তি মৈমনসিংহে বদলি হয়ে একসঙ্গে ৭ শত হিন্দু বাড়ি ক্রোক করেন। মজিদের দ্রুত উন্নতি হয়েছিল। তায়েবের হয় নি। প্রভাস লাহিড়ী মজিদের নৃশংসতার রিপোের্ট প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ এবং গভর্নর জেনারেল নাজিমুদ্দিনকে পাঠান। অবশ্য ফল হয়েছিল শূন্য। (৪০) পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্নেই অথবা অব্যবহিত পরেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্ভাবনা ছিল। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন কিছু হিন্দু নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সেই সময় কয়েকটি নির্দিষ্ট জেলায় সফর করে সেই সম্ভাবনাকে তখনকার মতাে দূর করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যসচিব আজিজ আহমেদ যখন হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ থেকে বহিষ্কার করার মলবে একের পর এক হিন্দুর বাড়ি ক্রোক করে চলেন, নাজিমুদ্দিন সে কুকাজ মেনেই নিয়েছিলেন। ভারতভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রথম দিকে ব্যবসা, চাকুরী, বৃত্তি নির্ভর জীবিকা সর্ব ব্যাপারে হিন্দুরা গড় হিসাবে মুসলমানদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। হিন্দু বিতাড়ন জনিত শূন্যস্থানে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আজিজের ঐ বেআইনী, বে-আব্র দৌরাত্ম্যের পথে অত্যল্পকালের নােটিশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি জবরদখল বা ক্রোক করার সহজ বিকল্প ছিল না। স্কুল, কারখানা, বাসস্থানে একই ভাবে হিন্দুদের গুণ্ডা বা পুলিশ দিয়ে, প্রয়ােজনে বিনা নােটিশে, দূর করে তস্থলে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত করার কোনাে বিরাম ছিল না। কোনাে অফিসার কিছু পুলিশ বা গুণ্ডার সাহায্যেই এই কাজগুলাে করতে পারতেন। ভাড়া একটা দেবার কথা থাকতাে সরকারের পক্ষে। তার মূল্য কিন্তু তুচ্ছ। প্রায়ই তা দেওয়াও হ’ত না। হিন্দুবিতাড়নের পন্থা হিসাবে এটি বেশ ধীর, দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকর একটি ব্যবস্থা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। (৪১, ৪২)।
এই সময় ঢাকার মনিং নিউজ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, সরকারী অফিসার এবং কেরানিদের ঢাকায় বাসস্থানের অভাব দূর করতে আজিমপুরায় বহু অর্থ ব্যয়ে সরকার যে বাড়িগুলি তৈরি করেছে তাতে কোনাে অফিসার যেতে চাইছেন না। কারণ হিন্দুদের থেকে ক্রোক করা সুন্দর সব বাড়ি, সরকার-নির্দিষ্ট নামমাত্র ভাড়ায় তাদের
পক্ষে ঢের বেশি সুবিধাজনক (৪৩)।
| রিচার্ড সিমণ্ডস বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অমুসলিমরা সব চেয়ে গুরুতর যে অভিযােগ করেছেন তা তাঁদের ঘরবাড়ি নির্দয়ভাবে ক্রোক করারা সম্পর্কেই।’ (৪৪) একই প্রকার নিষ্ঠুরতার নিদর্শন সম্রান্ত ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক নেতাকে ভারতের গুপ্তচর অপবাদ দিয়ে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রেও পাওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ পি, সি, চক্রবর্তীকেও এই দুর্ভোগ সইতে হয়েছিল। গান্ধী বা নেহেরুর প্রতিকৃতি রাখার কারণেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অফিসাররা তাে বটেই আনসাররাও যে-কোনাে হিন্দু বাড়ি তল্লাস করার নামে উৎপীড়ন করার ক্ষমতা রাখতাে। স্ত্রীলােকদের সম্ভ্রমহানি করাও হত। কখনােই অপরাধমূলক কিছু পাওয়া যেত না। হয়রানি করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। পি, টি, আই প্রতিনিধিদের হয়রানি করা হ’ত নিয়মিতভাবে। সংখ্যালঘুদের উপর এই সব উৎপীড়ন মুলতবী প্রস্তাব আকারে আইনসভায় তুলতেও দেয় নি সরকারপক্ষ। ফলে অফিসারদের অবাধ সুযােগ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর লুণ্ঠন এবং পীড়ন যুগপৎ চালাবার। যশােরের কোন সময়ের জেলা শাসক এক হিন্দুব্যবসায়ীকে তাঁর চাল, আটা এবং সুড়কির সব কল বন্ধ করতে আদেশ দিয়ে বিনা রসিদে ঐ ব্যবসায়ীর কারখানাগুলাের জন্য মজুত ২০ ওয়াগান কয়লা জবরদখল করে নেন। জিন্না-লিয়াকৎ যদি হিন্দুদের পাকিস্তান ত্যাগ করাকে চক্রান্ত মনে করেন, তাকে বস্তুনিষ্ঠ বলা যাবে না। ধানখেতের ধান, পুকুরের মাছ—সবই গুণ্ডারা কেড়ে নিত। হিন্দুদের নিজস্ব ফসল ঘরে তােলা সম্ভব হ’ত
। অভিযােগ করলে অভিযােগকারীকে পুলিশের পীড়নের মুখে পড়তে হ’ত। ভারত ছেড়ে আসা মুসলিমরা এই সব ছিনিয়ে নেওয়ার দুষ্কর্মে বেশি তৎপর ছিল। তাদের তাে আর পরিচিত ব্যক্তির উপর চড়াও হবার যে চক্ষুলজ্জা সেটাও ছিল না। যে-হিন্দুরা অবস্থা কী দাঁড়াবে বুঝে আত্মরক্ষা করতে পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা ঐ যশােরের ব্যবসায়ীর দুর্গতি এড়িয়েছেন—এ অভিযােগ অবশ্য ঐ গুণ্ডারা করতে পারে। বিধর্মী পীড়নের ‘স্বর্গসুখ’ থেকে তাদের অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করার মন্ত্রণা তাদের ভারত ছাড়া কে-ই বা দেবে? (৪৫)।
| ১৯৪৯ সালে নুরুল আমিন ছিলেন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কাছে স্মারকলিপি পেশ করে কংগ্রেস পরিষদীয় দল। ১৯৪৮ এর ১৯শে এপ্রিল ভারত-পাকিস্তান চুক্তিমতাে সংখ্যালঘু বাের্ড গঠিত হয় নি অনেক এলাকায় অথবা হলেও কোনাে সভা হয় নি। যে-সব পুরসভায় হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সে-সব সরকার ভেঙে দিয়েছে। আইন শৃঙ্খলার অভিভাবকরা সংখ্যালঘুদের করা অভিযােগ কর্ণপাত করেন না। এই সমস্ত কথা ঐ স্মারক লিপিতে তাে ছিলই, এমন কি, গুণ্ডারা কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উৎপীড়ন করে চলেছে—সে কথাও ছিল। (৪৬) অবশ্য স্মারকলিপি কোনাে কাজেই আসে নি।
পাঞ্জাবী আমলারা এবং তাদের সহযােগী মুসলিম লীগের নেতারা এবারে নিলেন এক
চরম পরিকলম্পনা। এখনাে যে মধ্যত্তি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীভুক্ত হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে রয়ে গেছেন তাঁদের বহিষ্কার, সীমান্ত অঞ্চলে দলবদ্ধভাবে বসবাসকারী পেশীবলে বলীয়ান্ নমঃশূদ্রদের নিধন, অবশিষ্ট হিন্দুদের হীনম্মন্য ক্লীবত্বে পর্যবসিত করা এবং অবাঙালী মুসলিমদের সম্পর্কে বাঙালী মুসলিমের সন্দেহ দূর করা এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের অর্থনৈতিক কুফল থেকে জনসাধারণের নজর অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়া—এই পাঁচদফা কর্মসূচি যে একটি মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল তাই হ’ল ১৯৫০-এর ফেব্রুয়ারীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আজিজ আহমেদ এই নরমেধযজ্ঞের হােতা পুরুষ। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-নিধনের যে * মহড়া চলেছিল এই দাঙ্গাই ছিল যেন তার শেষ অঙ্ক ! (৪৭)
১৯৪৯ এর অগাষ্ট থেকে ১৯৫০ এর জানুয়ারী—এই সময়ের মধ্যে আনসার, পুলিশ, ধর্মান্ধ মুসলিম, সমাজবিরােধী এবং সামরিকবাহিনীর ঘাতকদের হাতে এবং উচ্চপদস্থ প্রশাসকদের নির্দেশে অথবা উপস্থিতিতে একের পর এক হত্যালীলা এবং আনুষঙ্গিক নারীধর্ষণের মাধ্যমে এক জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হয় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। শ্রীহট্টের হিন্দুসম্প্রদায়, বরিশালের সংখ্যালঘু, রাজসাহীর পুঁটিয়া রাজবাড়ি, খুলনার বাগেরহাটের অন্ততঃ কুড়িটি গ্রামের সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ, রাজশাহীর সাঁওতাল সম্প্রদায় এবং তাদের ঘরবাড়ি—এই নরপিশাচদের পৈশাচিক তাণ্ডবে পর্যুদস্ত হয়। খুলনার কালশিরার বিভিন্ন গ্রামের নমঃশূদ্রদের উপর পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, মিলিটারি, আনসার এবং মুসলিম দাঙ্গাকারীরা বর্বরতম আক্রমণ চালায়। শ্রীহট্টের হবিগঞ্জের তফশীল সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলিটারির জিঘাংসার শিকার হন। তাঁদের নারীদের মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। পুরুষদের বাধ্য করা হয় পরিবারের নারীদের ঐ কাম্পের পশুদের লালসার বলি হবার জন্য প্রেরণ করতে। (৪৮) যােগেন মন্ডল কিছু অভিযোেগ করেছিলেন আইনমন্ত্রী হিসাবে। প্রধান মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন এ সম্পর্কে তদন্ত রিপাের্ট প্রকাশের। আশ্বাসটা ছিল ভূয়া। (৪৯) বাগেরহাটের ঘটনায় জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করাও হয়েছিল। সংবাদপত্রে এই সব কুকর্মে উস্কানি দেওয়া হয়। আইন সভায় হিন্দু সদস্যদের পঞ্চমবাহিনী বলা হয় কারণ তাঁরা এই পৈশাচিকতার অবসান চেয়ে। ছিলেন। সংবাদপত্রে গুজব ছড়ানাে হয় । কলকাতায় মসজিদ চূর্ণ হয়েছে, মুসলিমদের জোর করে হিন্দু করা হচ্ছে।”(৫০) | পাকিস্তানের ইউনাইটেড প্রেসের আবদুল মতিনকে খবরের কাগজের পাতায় মেরে ফেলা হয়। বলা হয় কলকাতায় ওঁকে হত্যা করা হয়েছে। কাগুজে মৃত্যুর কিছুদিন পরে মতিন ঢাকায় এলে তাঁকে চাপ দেওয়া হয় কলকাতার অলীক দাঙ্গা সম্বন্ধে গল্প ফাঁদার জন্য। এই চাপ দেন ঐ মুখ্যসচিব স্বয়ং। আসলে তাে মতিন কলকাতায় কোনাে দাঙ্গাই দেখেন নি। (৫১)
১৯৫০ এর ৬ এবং ৭ই ফেব্রুয়ারী অস্ত্রধারণ করে হিন্দুদের নিধন করতে উস্কানি ,
দিল ঢাকা রেড়িও। ১০ তারিখে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারের মুখ্য সচিবরা দাঙ্গা নিরােধকল্পে বৈঠক করছিলেন। ঠিক সেই সময় রক্তমাখা শাড়ি পরে কপালে সিন্দুর হাতে শাখা পরে কিছু স্ত্রীলােক সচিবালয়ে এসে অভিযােগ করে, তাদের জোর করে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করে হিন্দুর সঙ্গে বিবাহে বাধ্য করা হয়েছে। সচিবালয় ভেঙে পড়লাে গর্জন করে। ভিক্টোরিয়া পার্কে বেলা একটায় সভা ডেকে হিন্দুদের খতম করার ডাক দেওয়া হ’ল। বিদ্যুৎবেগে হিন্দুনিধনের ঢেউ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, বরিশাল, শ্রীহট্টে ছড়িয়ে পড়লাে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দুরা প্রাণে বাঁচেন। নিখুঁতভাবে সময়সূচি মেনে এত ব্যাপক এলাকায় এই নরমেধ যজ্ঞ প্রশাসনিক স্তরের দক্ষ পরিকল্পনা ভিন্ন অসম্ভব ছিল। (৫২) ঢাকায় গণহত্যার তাণ্ডব ছিল বীভৎস। তার পরােক্ষহিসাব নিম্নোক্ত পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে ঢাকা শহরের ৫৯ শতাংশ অধিবাসী ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদেরই ছিল শহরের মােট সম্পত্তির ৮৫ শতাংশ। ঐ হিন্দুজনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ‘ ৫০-এর হাঙ্গামার পরে ভারতে চলে আসেন। ঢাকা শহরে হিন্দুসম্পত্তির পরিমাণ হয় ১২.৭ শতাংশ। এই নরহত্যালীলার ফলে ঢাকা শহরে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত স্কুল ছাত্রের সংখ্যা হয় একশ’চল্লিশ। হাঙ্গামার পূর্বে এই সংখ্যা ছিল দু’হাজার। ছাত্রীসংখ্যা বারাে শত থেকে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৫। ১৯৫০ এর ১০ ই ফ্রেব্রুয়ারী হিন্দুদের দোকানগুলির ৯০ শতাংশতে লুণ্ঠন চলে। অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিসংযােগও করা হয়। ঐ একটি দিনেই ঢাকা শহরে ৫০ হাজার হিন্দু গৃহহীন হন। ফেব্রুয়ারীর তাণ্ডবে পূর্ববঙ্গে ১০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল। (৫৩) ১৯৫০ এর ১৭ই মার্চ পূর্ববঙ্গীয় সংসদ সদস্য মৌলবী ইব্রাহিম খান গণপরিষদে তাঁর ভাষণে হিন্দুদের জীবন এবং সম্পত্তিহানির উল্লেখ করে বলেন, হিন্দুরা কোনাে প্ররােচনা সৃষ্টি করেন নি একথা সত্য ; আমার ভ্রাতৃপ্রতিম একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি জানাতেও যা কিছু ঘটেছে। সে সবের জন্য আমার হৃদয়ে রক্ত ঝরে, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়।
১৯৫০ এর গণহত্যার পুচ্ছপট হিসাবে উল্লেখ্য, বরিশালের তাণ্ডবের অধিকর্তা জেলাশাসক ফারুকি খােলাখুলি হিন্দুহত্যায় ইন্ধন জোগানাের জন্য অবিভক্ত ভারতের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীন সেন কর্তৃক অভিযুক্ত হন। সতীন সেনের মৃত্যু হয়। কারারুদ্ধ দশায়, ফারুকির পদোন্নতি ঘটে। হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার অভিসন্ধিতে সংগঠিত এই ভয়ঙ্কর পাশবিকতায় দুস্তর মরুতেও মরুদ্যানের সাক্ষাৎ মিলেছে। ক্ষেত্র বিশেষে মুসলমান প্রতিবেশী তাঁর পরিচিত হিন্দুবাড়িতে পূর্বাহেই হামলাকারীর তাণ্ডব শুরুর পূর্বনিদিষ্ট লগ্ন জানিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট হিন্দু পরিবারের প্রাণ বাঁচাবার জন্য নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নেবার সুযােগ করে দিয়েছেন। এই ধরণের ঘটনা মানবিক মূল্যবােধের উত্তম নিদর্শন হলেও এ থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, দাঙ্গার গােটা ব্যাপারটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। (৫৪)
।
১৫
১৯৫০ এর ৮ই এপ্রিল নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি সম্পাদিত হয়। ফেব্রুয়ারীর গণহত্যা এবং হিন্দুদের উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পুনরাবৃত্তি রােধে এই চুক্তি। প্রথমে রাজী না হলেও শেষ পর্যন্ত লিয়াক, দিল্লিতে এসে এই চুক্তি সম্পাদনে অংশগ্রহণ করেন। এই দিল্লিচুক্তির পরে জে, এন, মন্ডল পূর্ববঙ্গের সেই সব তফশীল শ্রেণী অধ্যুষিত অঞ্চল সফর করেন, যেখানে বিগত ফেব্রুয়ারী দাঙ্গার প্রকোপ তুলনামূলক বিচারে কম তীব্র ছিল। সশস্ত্র আনসারদের অত্যাচার, ঘনঘন ডাকাতি এবং নারী ধর্ষণ, ইউনিয়ন বাের্ড এবং জেলা বাের্ড নির্বাচনে দুই মুসলিম প্রার্থীর মধ্যে অসমর্থিত জনের রােষ—এ সবের সঙ্গে ছিল ভারতের চর অভিযােগে মামলায় জড়িয়ে উৎকোচ গ্রহণ বা ব্ল্যাকমেল করা। অর্থাৎ পুলিশ, আনসার এবং গুণ্ডাদের এই সাজানাে মামলা থেকে ত্রাণ পেতে অর্থদণ্ড বরদাস্ত করতে হত অমুসলিমদের। উদ্ধৃত অংশ জে. এন, মণ্ডলের তদন্ত রিপাের্টের সামান্য অংশমাত্র। এই রিপাের্টে আনসারদের নিরস্ত্র করা এবং অমুসলিম পুলিশ অফিসার নিয়ােগ করার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের কথঞ্চিৎ নিরাপত্তার ব্যবস্থার যে পরামর্শ ছিল তার কণামাত্র সরকার গ্রহণ করে নি। (৫৫) | এত শত তদন্ত করে যােগেন মণ্ডলের কোন্ মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হ’ল? ৮ই সেপ্টেম্বর লিয়াকৎ তাঁর মন্ত্রিসভার আইন এবং শ্রম দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে যেআচরণ করলেন তা ঐ আনসারবাহিনীর ‘ব্ল্যাকমেল’ কৌশলেরই একরূপ। একদা এই ভদ্রলােক মুসমিল লীগের পক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিত্ব করে গেছেন অবিভক্ত ভারতে। এ-হেন যােগেন মন্ডলকে এর পরেই দেখা গেল পাকিস্তান থেকে পলায়ন করে ভারতে আশ্রয় নিতে। উনি, ১৯৫০ এর অক্টোবরের প্রথম দিকেই লিয়াকতের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র প্রেরণ করলেও কীথ ক্যালার্ড না জেনে, না শুনে ঐ মর্মে ভুল অভিযােগ করেন, ‘পদত্যাগপত্র পাঠানাে হয় নি। সরকার প্রদত্ত তথ্যনির্ভর কাহিনী, কাহিনী-ই। ইতিহাস হয় না। (৫৬) ঐ পদত্যাগপত্র জুড়ে তাঁর অতীত এবং বর্তমান নানা অভিজ্ঞতার কথা ছিল। তাঁর পত্রে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট আক্রাম খানের সর্বনাশা লেখার উল্লেখ ছিল। সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ এ, এম, মালিক বেতারভাষণে বলেছিলেন, ‘পয়গম্বর ইহুদীদের আরবে থেকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ধর্মমত পােষণের অধিকার স্বীকার করেছিলেন। তারই জবাবে ‘মােহম্মদী’ পত্রিকায় আক্রাম খান লেখেন, ‘ইহুদিদের আরব থেকে বিতাড়নের যে নির্দেশ পরবর্তীকালে পয়গম্বর দিয়েছিলেন মালিক সেকথা গ্রাহ্যই করেন নি। সংখ্যালঘুদের বিপদসঙ্কেত এই লেখার মধ্যেই জে, এন, মন্ডল দেখেছিলেন। তা ছাড়া হিন্দু বহিষ্কার নীতি পূর্ববৎ চালু ছিল বলেই সার্কেল অফিসাররা কোনাে ইউনিয়ন বাের্ডে হিন্দু সভাপতি বরদাস্ত করেন নি। তাঁকে সরিয়ে মুসলিম কাউকে সভাপতি করা হ’ত। কোনাে স্কুলে কোনাে হিন্দুকে প্রধান শিক্ষক বা স্কুল কমিটির সম্পাদক রাখা হয় নি। ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে, ১৫০০ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫০০ স্কুলেই ।
নিয়মিত কাজ হত । হিন্দু অফিসারদের পদোন্নতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাঁদের যে-কোনাে সময় ছাঁটাই করা যেত। চট্টগ্রামে হিন্দু পাবলিকি প্রসিকিউটার কে অকারণে সরিয়ে দিলে নেলী সেনগুপ্তার প্রতিবাদেও কোন কাজ হয় নি। অনভিজ্ঞ মুসলিম কর্মচারীদের ঠেলে অভিজ্ঞ হিন্দু অফিসারের উপরওয়ালা করে দেওয়া ইচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, ক্রীত পণ্যের মূল্য না দেওয়া বা ইচ্ছামতাে স্বল্পমূল্য দেওয়া এসবের সঙ্গে নারীহরণ, ধর্ষণ এসবও চলেছে। (৫৭) কোনাে অন্যায়ের কোনাে প্রতিকার নেই। আইনের আশ্রয়ে গিয়েও ফল নেই। যােগেন মন্ডলের পত্র সম্পর্কে প্রভাস লাহিড়ী মন্তব্য করেন, নিজ আত্মীয়পরিজনের দুর্দশায় উনি বিহবল বােধ করেন এবং পাকিস্তান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। করেন। (৫৮)
এই দীর্ঘ পত্রের শেষ অনুচ্ছেদের পূর্বেরটিতে তিনি উল্লেখ করেন, মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তির কথা স্বতন্ত্র। অপর মুসলিম নাগরিকদেরও পূর্ব, পশ্চিম কোনাে অঞ্চলেই নাগরিক স্বাধীনতা নেই। খান আবদুল গফফর খান এবং তাঁরই ভ্রাতা ডঃ খান সাহিব যেমন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অন্যায় এবং অবিচারের শিকার হয়েছেন, পূর্ববাংলার সােহরাবর্দি এবং ফজলুল হকের ক্ষেত্রেও অবস্থা অন্যরূপ নয়। বাঙলায় লীগদলের সাফল্যের অনেকখানি কৃতিত্ব যাঁর সেই সােহরাবর্দি এবং লাহাের প্রস্তারের উত্থাপক হিসাবে যিনি একদা সর্বজনপ্রিয় ছিলেন সেই ফজলুল হকের আজ কী দশা ? সােহরাবর্দি কার্যতঃ বন্দীর জীবন যাপন করছেন। আর ফজলুল হক ঢাকা হাইকোর্টের নিঃসঙ্গ প্রাঙ্গণে আইনজীবীর সকরুণ বৃত্তিতে মগ্ন আছেন। জনসংখ্যার প্রাধান্য সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গকে পরিণত করা হয়েছে পাকিস্তানের পশ্চিম খন্ডের উপনিবেশে। করাচির আজ্ঞাবহ পূর্ববঙ্গ আজ বড়ই ম্লান। বড়ই গুরুত্বহীন তার অস্তিত্ব।
পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানের অবহেলিত অংশ – ১৯৪৮ সালের ১লা মার্চ তারিখেই গণপরিষদের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত অধিবেশনে এই অভিযােগ করেছিলেন পূর্ববঙ্গীয় সদস্য আজিজউদ্দিন আহমেদ। পরবর্তী দিবস পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পূর্ববঙ্গের নানা দাবির সঙ্গে সেনাবিভাগে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে অংশগ্রহণের অধিকারও দাবি করে কেন্দ্রীয় শাসকদের গােচরে ঐ অবহেলার প্রসঙ্গটি আনলেন। এই সব দাবি প্রাদেশিকতা মাত্র। প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ফারাক নেই’—এই সব ফাঁকা কথার আড়ালে মূল সমস্যাটি চাপা দিতে চেষ্টা করলেন লিয়াকৎ। যে কারসাজি করে মুসলিম লীগ কাউনসিলে জনসংখ্যার কারণে পূর্ববঙ্গের স্বাভাবিক আধিপত্য ক্ষুন্ন করেছিলেন ঐ প্রধান মন্ত্রী লিয়াকাৎ স্বয়ং তা থেকে আশঙ্কা জাগলাে সর্বত্র এই কৌশলই অবলম্বন করা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিকে একত্র করে এক অখন্ড পশ্চিমাঞ্চল সৃষ্টির চেষ্টা লিয়াকৎ যে করছিলেন, তারও মূলে ছিলপূর্ববাঙলার তুল্যমূল্য এক শিবির রচনা। পাঞ্জাবকে কৃত্রিম উপায়ে বাঙলার সমকক্ষ করে তুলতে লিয়াকৎ পাঁচজন পাঞ্জাবীকে এবং করদ মিত্র রাজ্যের প্রধানদের
গণপরিষদে তাঁর পদাধিকার বলে সদস্য করে নিয়েছিলেন। (৫৯)
| অবশ্য মুসলিম লীগ পার্টি যন্ত্রের উপরে লিয়াকতের যে-প্রভাব ছিল শুধু তার জোরেই তিনি গণপরিষদে পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের আধিপত্য প্রতিহত করতে পারতেন। ঐ প্রভাব খাটিয়েই বি, পি, সিতে পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। (বেসিক প্রিনসিপিলস কমিটি কে সংক্ষেপে বি, পি, সি বলা হ’ত।) বি, পি, সি-র তিনটি উপসমিতির-ও প্রত্যেকটিতে ঐ বিষয়ে লিয়াকতের ইচ্ছারই জয় হয়। পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত হন। উপসমিতি তিনটির একটির ক্ষেত্র অন্যান্য বিষয়ের সংগে কেন্দ্র-প্রদেশ ক্ষমতা বিভাজনও ছিল। প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা ভবিষ্যতের ফেডারেল সরকারে বাড়ানাের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন পূর্ববঙ্গীয়রা। ১৯৪৯ এর ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গীয় পরিষদীয় দল একটি অলঙ্খনীয় আদেশ জারী করলাে এই মর্মে যে, প্রত্যেক পূর্ববঙ্গীয় গণপরিষদ সদস্য পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হতে বাধ্য থাকবেন। বলা হ’ল কেন্দ্রের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দপ্তর। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার খর্ব করেছিল পাকিস্তান সরকার দেশ জুড়ে। রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করেছিল সরকার। যার ফলে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেল। সাধারণের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মালাে, পূর্ববঙ্গ সরকার যেন কেন্দ্রের সম্পূর্ণ বশংবদ। লােক্যাল বাের্ডের নির্বাচনে দলনিরপেক্ষ মুসলিম প্রার্থীদের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই পরাজিত হলেন মুসলিম লীগ প্রার্থী। নির্বাচনী রায়ে ভীত হয়ে তড়িঘড়ি পূর্ববাঙলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে হ’ল লীগ দলকে এই সময়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র এবং আমলাতন্ত্র ১৯৫০ এর দাঙ্গার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মুসলিমের নজর স্বায়ত্তশাসন থেকে ঘুরিয়ে দিল ঐ সাম্প্রদায়িকতার দিকে। (৬০)
References:
- Speeches and Statements of Iqbal, Complied by SHAMLOO (AlManar Academy, Lahore, 1948), pp. 9-36.
- C. RAHMAT ALI, The Millat of Islam And the Menace of Indianism (Cambridge, England, 1940), pp. 5-16. Also see C. RAHMAT ALI, “Menace of Indianism,” in Pakistan (Adabistan, Delhi, 1940), pp. 32, 33, 36.
- R. W. SORENSEN, My Impression of India (Meridian Books, London, 1946), p. 110. TIRTHANKAR, “Where Will they Lead Us ?” (Ora Amader Kothay Niye Jaben ?) Janamat (Bengali Weekly, Dacca), 27 September 1949, p.9.
- EL HAMZA, Pakistan : A Nation (Muhammad Ashraf, Lahore, 1944), p. 33.
- Ibid., p. 60. Also see pp. 7-8, 32-34, 47, 60, 77, 131-32. 6. Ibid., pp. 7, 150-51.
- M.R.T., Nationalism in Conflict in India (Home Study Circle, Bombay, 1942), and Pakistan and Muslim India (Home Study Circle, Bombay, 1942).
- M.R.T., Nationalism in Conflict in India, pp. 26, 93, 100, 113, 179, 181, 203-4, 219, 222, 225-26, 235.
- M.R.T., Pakistan and Muslim India, pp. 1-2, 9, 13-14, 59, 61-63, 103-7, 118-20, 126. Also see RAHMAT ALI, n. 2, p. 16.
- ZIAUDDIN AHMAD SULERI, The Road to Peace and Pakistan (Muhamad Ashraf, Lahore, 1944), pp. 51, 66, 112. Also see K. M. Husain in Dawn (Karachi), 16 May 1944.
- JAMIL-UD-DIN AHMAD, The Indian Constitutional Tangle (Muhammad Ashraf, Lahore, 1941), pp.87, 88.
- M. K. GANDHI, “It’s Baffling”, in Pakistan, n. 2, p. 79. M.R.T., n. 9. p. 120. MOHAMMAD AHMAD, My Chief (Longmans, Lahore, 1960), pp. 8, 87. KEITH CALLARD, Pakistan : A Political Study (Allen and Unwin, London, 1958). p. 68. L. F. RUSHBROOK WILLIAMS, The State of Pakistan (Faber, London, 1962), pp. 138-39. RICHARD SYMONDS, The Making of Pakistan (Faber, London, 1949), p. 98.
- Testimony of DR. CHARLES B. MARSHALL, Adviser to the Prime Ministers of Pakistan during 1955-57, before a Sub-Committee of the Committee on Foreign Affairs, the United States House of Representatives-Review of Mutual Security Program : Development and Implementation : Pakistan, January 21 and 22, 1959 (Wash. D.C., 1959, p. 4.
- ABDUL MAJEED KHAN, “Research about Muslim Aristocracy in East Pakistan”, in Pierre Bessaignet (ed.), Social Research in East Pakistan (Asiatic Society of Pakistan, Dacca, 1960), pp. 23-24. RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, pp. 38-39. CALLARD, n. 12, p. 157. SYMONDS, n. 12, p. 152.
- LEONARD BINDER, Religion and Politics in Pakistan (University of California, Berkeley, 1963), pp. 120-23, 129-33. CALLARD, n. 12, pp. 19-21, 131-32. SYMONDS, n. 12, p. 93. Dawn, 13 July 1947.
- See, for instance, M.R.T., n. 9, pp. 96-97.
- CALLARD, n. 12, pp. 5, 184. BINDER, n. 15, pp. 119, 205. SAMAR GUHA, Swadhin Purva Bangla (in Bengali ; Calcutta, 1965), pp. 8-9. JYOTI SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan (Renco, Calcutta, 1963), pp. 21, 22, 27.
- RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, pp. 38-39. SYMONDS, n. 12, p. 151. SENGUPTA, n. 17, pp. 30-31, 35. GUHA, n. 17, pp. 12-14.
- Census of Pakistan, 1951, Vol. 1, p. 71. Constituent Assembly of Pakistan, Debates, Vol. II, 25 February 1948, pp. 15, 17.
- AHMAD, n. 12, p. 8. Italics added.
- CALLARD, n. 12, pp. 94, 182. Ittefaq (Dacca), 14 August 1949 (Editorial). 22. Janamat, 23 August 1949, pp. 1-2. 23. lbid., 13 September 1949, pp. 5-6.
- MUHAMMAD SHAHIDULLAH, Amader Samasya (in Bengali: Renaissance Publications, Dacca, 1949).
- SAROJENDRANATH RAY, “Bengali Language in Arabic Script”, Janamat, 6 December 1949, pp. 5-6. Ibid., 13 December 1949, pp. 3-4. Also see ibid., p. 1.
- Ibid., 20 September 1949, p. 3. 27. Cited in Janamat, 19 September 1950, p. 9.
- For these and other excerpts, Ibid., pp. 9, 11.
- Ibid., 20 December 1949, p. 5. AHMAD SHARIF, “Bhashar Kotha”, (i.e., Thoughts on Language), in Hasan Hafizur Rahman (ed.), Ekushe February (i.e., Twenty-first February), Punthipatro Prokashoni, Dacca, 1965, pp. 73-74 ; in Bengali.
- SENGUPTA, n. 17, p. 68. 31. Ibid., pp. 66-67.
- NIRAD C. CHAUDHURI, “East Pakistan in Ferment–1″, The Statesman (Delhi), 3 August 1966.
- MICHAEL BRECHER, Nehru : A Political Biography (Abridged Edition, Oxford University Press, London, 1961), pp. 121-22. TAYA ZINKIN, India (Thames & Hudson, London, 1965), pp. 74-5. Recurrent Exodus of Minorities from East Pakistan and Disturbances in India : A Report to the Indian Commission of Jurists by its Committee of Enquiry (New Delhi, 1965), p. 2; MR. PURSHOTTAM TRIKAMDAS was the Chairman of this Committee.
- M.R.T., n. 8, pp. 46, 169, 173, 178-9, 180, 185-89. SULERI, n. 10, pp. 85-88, 101-5. SYMONDS, n. 12, pp 144-45. WILFRED C. SMITH, Modern Islam in India (Gollancz, London, 1946), p. 264. WILFRED C. SMITH, Islam in Modern History (Mentor Books, New York, 1959), p. 244. MURRAY T. TITUS, Islam in India and Pakistan (Y.M.C.A., Calcutta, 1959), p. 216. CALLARD, n. 12, p. 259. SAMAR GUHA, Non-Muslims Behind the Curtain of East Pakistan (Dacca, 1950), pp. 21, 83.
- RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, p. 38. LIAQUAT ALI KHAN, Pakistan : The Heart of Asia (Harvard University Press, Cambridge, Mass., 1950), pp. 34-35,44-45. Ian Stephens, Pakistan (Ernest Benn, London, 1963), p. 224. Quaid-i-Azam Speaks (Karachi, 1949), p. 33.
- For a thought-provoking analysis of factors inhibiting objective reporting these days, see NIRAD C. CHAUDHURI, The Continent of Circe (Chatto and Windus, London, 1965), pp. 22-30.
- CALLARD, n. 12, p. 237.
- SENGUPTA, n. 17, pp. 7, 68. GUHA, n. 17, p. 9. P. C. LAHIRY, Letter to this author dated 27 July 1966.
- P. C. LAHIRY, India Partitioned and Minorities in Pakistan (Writers’ Forum, Calcutta, 1964), pp. 9-10.
- Ibid., pp. 17-22.
- GUHA, n. 34, p. 69. 42. The Foreign Relations Society of India, Genesis of Communal Violence in East Pakistan (New Delhi, 1950), pp. 11-21. GUHA, n. 34, pp. 21-22. The Hindusthan Standard (Calcutta), 3 April 1949.
- The Foreign Relations Society of India, n. 42, p. 22. 44. SYMONDS, n. 12, p. 146. 45. The Foreign Relations Society of India, n. 42, pp. 33-39. Ian Stephens, n. 35, p. 224. RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, p. 38.
- For a summary of this memorandum, see TRIKAMDAS, n. 33, p. 5. GUHA, n. 34, pp. 72-75. Also see SAMAR GUHA, East Bengal Minorities Since Delhi Pact (Calcutta, 1953).
- P. C. LAHIRY, letter to this author dated 27 July 1966. GUHA, n. 34, pp. 82-84. GUHA, n. 46, pp. 4-5. LAHIRY, n. 39, p. 26. SENGUPTA, n. 17, p. 100.
- Memorandum, 20 March 1950, submitted before the Hon’ble Prime Minister of Pakistan by Members of the opposition party (Assembly), East Bengal-in TRIKAMADAS, n. 33, Appendix II, p. 333.
- J. N. MANDAL, Letter of Resignation to the Prime Minister of Pakistan, 9 October 1950-in Genesis of Communal Violence in East Pakistan, n. 42, Appendix A, p. 62.
- See, for instance, The Morning news (Dacca), 30 January, 5, 10 February 1950. 51. SENGUPTA, n. 17, pp. 95-96.
- Memorandum, 20 March 1950, n. 48, p. 336. Also see GUHA, n. 34, pp. 80-81.
53 TRIKAMDAS, n. 33, p. 4. Memorandum, 20 March 1950, n. 48, p. 335.J. N. MANDAL, n. 49, p. 67.
- LAHIRY, n. 39, pp. 26-27.
- J. N. MANDAL, Report (June 1950) to the Prime Minister of Pakistan, in Genesis of Communal Violence in East Pakistan, n. 42, Appendix B.
- CALLARD, n. 12, pp. 81, 246-47. 57. J. N. MANDAL, n. 49, pp. 68-74. 58. LAHIRY, n. 39, p. 27.
- BINDER, n. 15, pp. 126-28, 203-5. Constituent Assembly of Pakistan (Legislature) Debates, Vol. I, pp. 82, 127, 140-41.
- Janamat, 27 December 1949, p. 1 ; 3 January 1950, p. 1. GUHA, n. 34, pp. 76-77. CALLARD, n. 12, p. 177.
Source: গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা, জয়ন্তকুমার রায়, pp 1-18