You dont have javascript enabled! Please enable it!

শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে বেছে নিলেন বন্ধু হিসেবে।  – শশাঙ্ক ব্যানার্জী

২৫ ডিসেম্বর ১৯৬২, বড়দিন।

মুজিবুর রহমান বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থনের জন্য ভারতের কাছে আবেদন জানালেন। গােপনীয়তার বেড়াজালে এই দিনটি হয়ে উঠলাে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস পাল্টে দেবার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ।

মুজিবুর রহমান ভারতের সাথে প্রথম পর্যায়ের যােগাযােগ শুরু করার জন্য বেছে নিলেন ১৯৬২ সালের বড়দিনটি। সহজভাবে বলতে গেলে এটি একজন নিবেদিত মুসলিম এর ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে এগিয়ে যাবার প্রতীক।

আমি তখন পুরােনাে ঢাকার চক্রবর্তী ভীলায় থাকি। আমি সেখানে ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের একজন রাজনেতিক কর্মকর্তা হিসেবে। আমার বাসাটি একটি দেয়ালে ঘেরা ছিল যা সেই বাসাটিকে ঠিক পাশের বাংলা সংবাদপত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এর অফিস থেকে আলাদা। করে রেখেছিলাে।

তখন মধ্যরাত পার হয়েছে মাত্র। আমি এবং আমার সহধর্মিনী এক সহকর্মীর বাসায় বড়দিনের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরেছি। বাসার দরজা বন্ধ করার পর আমি কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলাম। সাথে সাথেই জমে গেলাম, নিশ্চিত হতে পারছিলাম না রাতের এই সময় কে এলাে! ভাবছিলাম, কেউ কি আমাকে অনুসরণ করছিলাে? আমিতাে পাকিস্তানে কর্মরত! আমাকে নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছিল। যাইহােক, নিজেকে সামলে আমি দরজা খােলার। সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে, বয়স ১৪ বছরের বেশি হবে না। সে একটা খবর নিয়ে এসেছে। আমাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সম্ভাষণ

জানালাে সে। জবাবে আমি বললাম- ওয়ালাইকুম সালাম। কিছুটা সন্ত্রস্তভাবে ছেলেটা আমাকে জানালাে, যদি আমার খুব সমস্যা না হয় তবে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিঞা আমার সাথে তার অফিসে দেখা করতে চান। ছেলেটাকে আমার তার বয়সের তুলনায় ভীষণ বিনয়ী মনে হল। যাবার আগে ছেলেটা আমাকে আর একটা ছােট্ট তথ্য দিয়ে গেলাে তার সাথে আরেকজন ভদ্রলােক আছেন। ছেলেটা আমাকে বললাে না ভদ্রলােকটি কে? আমি সেই ধাধার মতাে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম যা সঙ্গতভাবেই প্রথাবিরােধী ছিলাে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যাই ঘটুক না কেন আমি সেই অজানার উদ্দেশ্যে যাবাে। আমি ছেলেটিকে বললাম, মানিক মিঞাকে জানাতে যে আমি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সাথে দেখা করতে আসছি। বলা যায় মানিক মিঞার সাথে এই আমার প্রথম দেখা। আমি জানতাম তিনি প্রভাবশালী দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক, যা ঠিক পাশের অফিস থেকেই প্রকাশিত হয়।

আমার অন্য চিন্তা ছিল যে আমি এমন একটি সাক্ষাতের জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুত নই! যদিও আমি জানতাম এটি একটি রাজনৈতিক সাক্ষাতকার হবে। আমি খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমি পৌছবার সাথে সাথেই মানিক মিঞা তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাঁর সাথে দেখা করতে আসার জন্য ধন্যবাদ। জানালেন। তিনি আমাকে নাম ধরে সম্বােধন করলেন এবং করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি তাঁর পাশে দাঁড়ানাে ভদ্রলােকের দিকে ফিরলেন, হাতের ইশারায় তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তাঁর ছবি পত্রিকায় দেখেছি। তার চেহারা খুবই পরিচিত এবং আমার মনে হল এই ভদ্রলােকের পরিচয়ের প্রয়ােজন নেই!

আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেবার পর এই প্রথম আমার শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা হল। আমাকে বলতেই হবে এতটা কাছ থেকে তাঁকে দেখার পর তিনি প্রায় সাথে সাথেই তার উপস্থিতি দিয়ে। আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। Cyril Dunn নামে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক যিনি এর আগে মুজিবের সাথে দেখা করেছিলেন, মুজিব সম্পর্কে বলেছিলেন“মুজিব সুপুরুষ ছিলেন এবং তার ছিলাে দারুণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ঠিক কথাই বলেছিলেন। আমি দূর থেকে মুজিবকে পল্টন ময়দানে গণসমাবেশে বক্তব্য দিতে শুনেছি। আমি জানতাম শক্তিশালী বক্তব্যে তিনি কেমন করে শ্রোতাদের বেঁধে রাখেন। তিনি শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সাথে করমর্দন

৪৭

শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে বেছে নিলেন বন্ধু হিসেবে করলেন এবং সরাসরি আমার চোখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন ভীষণ জরুরী একটা কিছু আমাকে বলার জন্য তিনি উশখুশ করছেন। হাসিমুখে চোখ পিটপিট করে আমি তাকে বললাম যে, তাঁর সাথে পরিচিত হয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত হয়েছি! আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এটি কি একটি ঐতিহাসিক করমর্দন? তার জবাব ছিল- “কেন নয়?

যেটুকু অব্যক্ত ছিলাে তা হল আমার মনে গােপনে দানা বেঁধে ওঠা আবেগ যার সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের একটি বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিখাইল গর্বাচেভ-এর সাথে দেখা হবার পর তিনি বলেছিলেন, এই সােভিয়েত নেতার সাথে পশ্চিমের লেনদেন সম্ভব। একথা সত্যি যে থ্যাচার-গর্বাচেভ সাক্ষাৎ হয়েছিলাে পরাশক্তিদের বৈশ্বিক সম্মেলনের অংশ হিসেবে যা পৃথিবীটাকে বদলে দেয়। একথাও সত্যি যে আমিও সবিনয়ে মনে করেছিলাম ‘মুজিবের সাথে ভারতের লেনদেন সম্ভব’ যদি তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার মিশনে সমর্থনের জন্য আবেদন করেন। এই ঘটনাটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস পাল্টে দেবার যােগ্যতা রাখে।

যদিও ব্যক্তিগতভাবে এর আগে আমার মানিক মিঞার সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। তবে তাঁর নাম আমার কাছে অপরিচিত ছিলাে না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে লেখা তাঁর বিচক্ষণ তর্কমূলক কলামগুলি আমি কখনও না পড়ে থাকতাম না। আমি বুঝতে পারতাম তার চাতুর্যে ভরা ‘স্বায়ত্বশাসন’ শব্দটির আড়ালে আসলে স্বাধীনতা’ আছে। আশ্চর্যের বিষয় হল পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাগুলি আসলে বুঝতেই পারেনি মানিক মিঞা কোনদিকে যাচ্ছেন। গণবিক্ষোভমূলক কলামগুলি লেখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কখনও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনও অনেক কলাম ছিলাে উস্কানিমূলক হবার জন্য যার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমার মনে হয়, হয়তাে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলির বাংলা অনুবাদকগণ মানিক মিঞার কলামের সঠিক চিত্রটি কর্তাব্যক্তিদের কাছে তুলে ধরেননি।

অনেকে মনে করে নিতে পারেন এইসব তাত্ত্বিক বিষয়গুলি আওয়ামী নেতারা পড়েছিলেন এবং পাঞ্জাবীদের দমনের বিরুদ্ধে সমর্থন খুঁজে পেয়েছিলেন। সামরিক বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলি পাঞ্জাবীদের দিয়ে পরিপূর্ণ ছিলাে অন্যদিকে সংখ্যালঘু প্রদেশ যেমন বাঙালী, বেলুচী, সিন্ধি এবং পশতুরা সেই পাঞ্জাবীদের হাতে শােষণ ও দমনের শিকার হয়েছে।

৪৮

সামরিক বাহিনী কেন তাঁর স্বায়ত্তশাসন’ নিয়ে লেখা কলামগুলির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি জানতে চাইলে তিনি তাঁর উত্তরে বলেন তিনি কোন সুযােগ নেননি বা স্কুলবয়ের মতাে উস্কানিমূলক কিছু বলেননি। কিছুটা রেখে ঢেকে নিজের মতামত জানানােটাই তাঁর স্টাইল। আমার মনে হয়েছিলাে একজন একগুঁয়ে দেশপ্রেমিক হিসেবে এবং সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অসাধারণ। দ্ব্যর্থবােধক শব্দ ও পরিমিত ব্যঙ্গ প্রকাশের তিনি একজন ওস্তাদ। তাঁর শক্তিশালী বাংলা গদ্যশৈলির এক অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল গীতিময়তা। ষাটের দশকে ভারতকে লক্ষ্য করে বাক্যবাণ ব্যবহারকারী পত্রিকাগুলাের মধ্যে মানিক মিঞার সাবধানী লেখাগুলাে ছিল নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা ও মন্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আদর্শ।

একজন বিজ্ঞ-আলােকিত চিন্তাবিদ হিসেবে মানিক মিঞার পৃথিবীটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। আল্লামা মােহাম্মদ ইকবালের সাথে তার তুলনা। দেয়া যায়। ইকবাল ছিলেন বিখ্যাত উর্দু কবিতা সংকলন ‘বাং-ই-দারা’র লেখক। এছাড়াও তিনি বিখ্যাত একটি উর্দু গানেরও গীতিকার- ‘সারে জাঁহা ছে আচ্ছা… হিন্দুস্তা হামারা’। এই গানের কথা একরকম জাতীয় সঙ্গীতের মত হয়ে যায় যা সারাদেশের স্কুল শিক্ষার্থীরা এখনও গেয়ে থাকে, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ব্যান্ড পার্টিতেও গানটি বাজানাে হয়। ইকবাল নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ সাহিত্যিক ছিলেন।

যাই হােক, মানিক মিঞা ও আল্লামা মােহাম্মদ ইকবাল এই দুই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলাে আল্লামা ইকবাল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিস্তৃত কাঠামাের বাইরে একটি ইসলামিক পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করে ছিলেন। অন্যদিকে উদারপন্থি ইংরেজি দার্শনিক “John Stuart Mill” এবং “Jean Jacques Rousseau”-এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত মানিক মিঞা হয়ে ওঠেন মুক্তি ও গণতন্ত্রের আদর্শ কণ্ঠ।

ইকবাল ছিলেন রহস্যের মতাে, হয়তাে একটি রহস্যের মধ্যে আরেকটি রহস্যের মতাে। তিনি ভারতকে ভালােবাসতেন, তার কবিতা তাই বলে, আবার তিনি উপমহাদেশে মুসলমানদের বাসভূমি হিসেবে পাকিস্তানও চাইতেন যা সংজ্ঞাগতভাবেই হবে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র।
মুজিবের সাথে প্রথম দেখার পরেই আমার অনেকটা প্রথম দর্শনেই

৪৯

শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে বেছে নিলেন বন্ধু হিসেবে ভালােবাসার মতাে হয়েছিলাে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে শেখ মুজিবের মতাে একজন বাকপটু গণনেতা এবং মানিক মিঞার মতাে রাজনৈতিক চিন্তাবিদ দু’জনে মিলে একটি বিপ্লব তৈরি করতে পারেন ও নেতৃত্ব দিতে পারেন। আমাকে কি কারণে তলব করা হয়েছে এবং তারা আমাকে কি প্রস্তাব দিতে পারেন সে রকম একটি ছবি আমি আমার মনের চোখে এঁকে ফেলেছিলাম। আমি ইতােমধ্যেই চিন্তা করছিলাম তাদের একটি প্রতিশ্রুতিশীল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বস্তুগত সমর্থন প্রয়ােজন হলে, সে ক্ষেত্রে তাে ভারত ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের দুঃসাহসিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই সাহস তাঁদের প্রয়ােজন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যদিও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নেবেন।

সেই রাতে আমাদের মিটিং দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। আমরা রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছিলাম যার মধ্যে ছিলাে কিউবায় মিসাইল সংকট, কিভাবে চীন চতুরতার সাথে ভারত দখলের সুযােগ নিয়েছে, তার কৌশলগত নির্দেশক গুলাে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মতাে- ‘সম্মিলিত নিরাপত্তা জোট’ CENTO এবং SEATO যা সােভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারতের গলায় কাঁটার মালার মতাে। সামরিক একনায়কের পক্ষে আমেরিকার মদদ এবং এই অঞ্চলের কৌশলগত চিত্রে তার প্রভাব, সােভিয়েত ইউনিয়নের উপনিবেশিকতা বিরােধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কি আশা করতে পারে, আওয়ামী লীগ ও ভারতের রাজনৈতিক দলগুলােকে ঐক্যবদ্ধ করে কিভাবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিষয়ে পরিবর্তন আনা যায় এবং সেই সাথে আরাে অনেক কিছু। এই আলােচনার মাধ্যমে আমার এক অভিনব সৌভাগ্য হয়েছিলাে পূর্ব পাকিস্তানের দুই শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তির মনােভাব বুঝে নেয়ার। ততক্ষণে রাত প্রায় শেষ, বড়দিনের ভাের সমাগত। আলােচনা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বাঙলাদেশের এই দুই নেতা তাদের কথায় বেশ পরিণত ও হিসেবি। পরাশক্তিগুলাের কাছে তাদের অবস্থানে কিছুটা দূরত্ব রাখতে চাইছেন তাঁরা।

আলােচনা যতই শেষের দিকে যাচ্ছিল আমি বুঝতে পারছিলাম মুজিব ও মানিক মিঞা দুজনেই কিছুটা উশখুশ করছেন যেন তারা আরাে কিছু বলতে চান। আমিই কিছুটা স্বপ্রণােদিত হয়ে বললাম উপরের মহলে আমাকে পৌছে

৫০

দিতে হবে এমন কোন কথা আছে কিনা? মুজিব সাথে সাথে মুখ খুললেন।

মুজিবুর রহমান এবার তাঁর স্বরূপে। তিনি বললেন এই মিটিং তলবের উদ্দেশ্য আমার হাতে একটি অতি গােপনীয় চিঠি দেয়া যা কূটনৈতিক ব্যাগে পুরে আমাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে হবে। আমার হাতে চিঠি তুলে দেবার সময় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বেশ তাড়াহুড়াের মধ্যে আছেন। আমি তাকে বললাম যে আমি ছাড়া এই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর হাতে যাবার আগে পর্যন্ত ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের আরাে দুটি ভিন্ন অফিস ঘুরে যাবে। তারপর এটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে যাবে যার সাথে পররাষ্ট্র সচিব ও নয়াদিল্লীর ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাের পরিচালকের কপি এনডাের্স থাকবে। প্রথম ধাপে এই চিঠির সম্পূর্ণ লেখাটি ট্রিপল কোডেড সাইফার মেসেজ হিসেবে পাঠানাে হবে। আসল চিঠি একটি কূটনৈতিক ব্যাগে সেই সাইফার মেসেজের সাথে যাবে। মুজিব জানতে চাইলেন ঢাকা হাই কমিশনে ঐ দুইজন অফিসার কে হতে পারেন? কিছুটা দ্বিধা থাকলেও তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আমি মুজিব ও মানিক মিঞাকে নামগুলাে বললাম শ্রী সৌর্য কুমার চৌধুরী, ডেপুটি কমিশনার, যিনি ঢাকাস্থ মিশনের হেড এবং কর্ণেল এস.সি. ঘােষ যিনি পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স এর স্টেশন চিফ। সেই রাতে ইতিহাসের পাতা ওল্টানাের সাথে সাথে আমরা বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় কিছু বিষয় গােপন রাখার প্রতিজ্ঞা করি।

মুজিবের অতি গােপনীয় চিঠিটি ব্যক্তিগতভাবে ভারতের পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নামে লেখা ছিল। একটি ছােট্ট সূচনা প্যারাগ্রাফের পরে সেখানে সরাসরি পরবর্তী কর্মপরিকল্পনার কথা লেখা যা মুজিবের ইচ্ছানুসারে তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু মানিক মিঞা লিখেছিলেন। যেখানে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম শুরুর কথা লেখা ছিল।

মনে হতে পারে চিঠির বিষয়বস্তু একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কিন্তু তাতে জোর দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী মুসলমানদের সামরিক দমন, নিপীড়ন, বৈষম্য ও শােষণের ওপর। আর এভাবেই আসে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা-ভাষী মানুষগুলাের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরির কথা।

চিঠির ভাষ্যমতে মুজিবের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানীদের দমন ও নিপীড়নের মুখে খােলাখুলিভাবে যে কোনাে ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানাে সমস্যা

৫১

বলে মুজিব তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কেন্দ্রভূমি ঢাকা থেকে লন্ডনে স্থানান্তর করতে চান এবং সেখান থেকেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করবেন। তিনি চিঠিটি শেষ করেছিলেন একটি রােডম্যাপ ও সময়সূচি দিয়ে। তিনি যতদ্রুত সম্ভব তার বেস ঢাকা থেকে লন্ডনে স্থানান্তর করতে চাইছিলেন। মানিক মিঞার ঢাকাতেই থেকে যাবার কথা ছিল। সেখানে থেকেই তিনি তাঁর সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় তিনি সার্বভৌমত্বের দাবীতে তার নিয়মিত কলাম লিখে যাবেন। মুজিব ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩ বা খুব বেশি হলে ১ মার্চ ১৯৬৩ তারিখে লন্ডন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার লন্ডনে নির্বাসিত অবস্থাতেই গঠিত হবে।

চিঠির শেষ প্যারাগ্রাফে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে একটি ব্যক্তিগত অনুরােধ ছিল যাতে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের আত্মিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, মাঠপর্যায়ে সব ধরনের নিঃশর্ত সমর্থন আশা করেন। আরাে বিস্তারিত আলােচনার জন্য মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে গােপনে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের ব্যাপারে খুশিমনে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
এতে কি কোন সন্দেহ আছে যে জওহরলাল নেহেরুকে লেখা মুজিবের গােপনীয় চিঠিটি একটি খাঁটি ডিনামাইট ছিল? প্রধানমন্ত্রী কি সিদ্ধান্ত নেন সেটা এক কথা কিন্ত অন্যদিকে এই পরিকল্পনা সত্যি সত্যি বাস্তবায়নের জটিলতা ছিল হিমালয়ের সমান উঁচু। সব মিলিয়ে এই চিঠি ভারতের সরকারকে শেকড়সহ কাপিয়ে দেবার ক্ষমতা বহন করছিল।

ঢাকার কাজ খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসে। এই বিস্ফোরক চিঠিটি হেড অফ মিশন ও ইন্টেলিজেন্স এর স্টেশন চিফের কাছে জমা দেয়া হয়। এর মধ্যে আমরা পাঁচ জন, অর্থাৎ হেড অফ মিশন, ইন্টেলিজেন্স চিফ, মুজিবুর রহমান, মানিক মিঞা এবং আমি, খুব অল্প সময়ে অতি গােপনে আরাে অন্তত দুটো মিটিং করে ফেলি। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের নেতা ভারতের কাছ থেকে কি আশা করেন সে বিষয়ে ভালােমত বােঝা। তারা আসলে বস্তুগত সমর্থন বলতে কি বােঝাচ্ছেন? তাঁদের প্রস্তাবে কোনাে নমনীয় জায়গা আছে কি-না?

এরই মধ্যে নয়াদিল্লীর রাইসিনা হিল, দক্ষিণ ব্লকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ট্রিপল কোডেড সাইফার টেলিগ্রামের মাধ্যমে চিঠিটি পাঠানাে

৫২

হয়েছিল। আসল চিঠিটিও একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর মনােযােগ আকর্ষণ করে পাঠানাে হয়। আমরা সবাই জানতাম প্রধানমন্ত্রী তখনও চীনা দখলদারিত্বের কারণে ব্যক্তিগত শােকের মধ্যে আছেন। তারপরেও তিনি বিষয়টি ভালােমত খতিয়ে দেখলেন এবং দ্রুত তিনি তার নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে একটি মিটিং-এ বসলেন। তিনি তাঁর বিশেষজ্ঞদের সাথে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করতে চাইছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের। আবেদনে সাড়া দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে দীর্ঘস্থায়ী সাহায্যের হাত বাড়াবেন কি-না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সবাই স্টেশনে ছিলেন না। কেউ ছিলেন যাত্রাপথে, কেউ বা বিদেশে। তাই এই উচ্চ পর্যায়ের মিটিংটি অনুষ্ঠিত হতে কিছুটা সময় লেগেছিলাে। নয়াদিল্লী থেকে আমাদের বলা হয়েছিলাে শেখ মুজিবকে জানাতে যে তার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছে এবং তিনি খুব দ্রুত এর জবাব দেবেন।

নয়াদিল্লীর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছিল- যা আমার মনে হয় কূটনৈতিক জটিলতার কারণে নয় বরং বাঙলাদেশকে সমর্থন করলে ভারতকে যে সব বিষয়ের মুখােমুখি হতে হবে, ভারত সম্ভাব্য সব ধরনের চ্যালেঞ্জগুলাে খুব সাবধানে পর্যালােচনা করছিলাে। আর এই অপেক্ষা মুজিবকে অধৈর্য করে তুলছিলাে।

মুজিব অনুভব করছিলেন যে ঢাকার কূটনীতিবিদদের সাথে তাঁর কার্যক্রম তাঁকে আসলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে না। তিনি তাঁর পথ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি গােপনে সীমান্তবর্তী ভারতের আগরতলায় উপস্থিত হলেন। তিনি সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন গােপনে, পাসপাের্ট ছাড়া। আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিং এর সাথে তিনি কয়েকটি মিটিং করলেন এবং বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের রাজনৈতিক সমর্থনের আবেদন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে অনুরােধ করলেন। মুজিব আগরতলার প্রধানমন্ত্রীকে এইকথা জানাতে ভুললেন না যে তিনি ঢাকাস্থ ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের সাথেও যােগাযােগ করেছেন কিন্তু তারা সাড়া দিতে অনেক বেশি দেরী করছে। তাঁর হাতে খুব বেশি সময় নেই।

আমার মনে হয় মুজিব মনে করেছিলেন শচীন সিংহ এর মতাে একজন রাজনীতিবিদ হয়তাে কূটনীতিবিদের চেয়ে তার কথা ভালােমতাে বুঝতে

৫৩

পারবেন এবং সমব্যথী হবেন। আগরতলায় অল্প সময় অপেক্ষা করার পরেই মুজিব দিল্লী থেকে সাড়া পেলেন। তাঁকে বলা হল সাড়া দিতে দেরি হওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী দুঃখিত। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আরাে পরামর্শ দিলেন যে মুজিবের জন্য একটিমাত্র চ্যানেল ব্যবহার করে কাজ করাটা ভালাে হবে আর তা হল ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশন, আগরতলা নয়। মুজিবকে আরাে জানানাে হলাে তিনি যখন আগরতলায় অবস্থান করছেন ঠিক তখন তাকে সব ধরনের সমর্থনের সিদ্ধান্ত ঢাকায় পৌঁছে গেছে।

তাঁর ফেরার পথেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ মুজিবের গােপন আগরতলা সফরের খবর পেয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে এ্যারেস্ট করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, যার নাম ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য। এটি ‘আগরতলা মামলা নামে পরিচিত। পূর্ব পাকিস্তানের কোর্টে এই মামলার বিচার চলে যা বিভিন্ন সংবাদের শিরােনাম হতে থাকে। এই মামলাটি আস্তে আস্তে সরকারপন্থী মিডিয়ার অপপ্রচার ও কোর্ট থেকে কোর্টে অত্যাচারে রূপ নেয়। এই মামলায়। মুজিবকে অনেকখানি ভুগতে হয়। যাইহােক, সুস্পষ্ট প্রমাণের অভাবে, একথা আসলেই প্রমাণ করা যায়নি যে মুজিব ভারতে গিয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে ছিলাে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাে (আইবি) যার হেডকোয়ার্টার ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেলেও মুজিব যে নিরপরাধ একথা তারা মেনে নেয়নি। তারা ইঁদুরের গন্ধ পেয়েছিলাে এবং এই ঘটনার জবাব দিতে তারা ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মিজোদের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা শুরু করে। পরের অধ্যায়গুলিতে আমি এই ঘটনার আরাে বিস্তারিত বর্ণনা দেবাে।

স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচী

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানী নিরাপত্তা বাহিনীর থার্ড ডিগ্রি টর্চারের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা মুজিবকে পরিণত করেছিলাে এক বিপ্লবী নেতা হিসেবে। কিন্তু তাঁকে শাস্তি দেবার পেছনে পাকিস্তানী পুলিশ এবং ইন্টেলিজেন্স-এর শুধু প্রমাণহীন গােপন আগরতলা ভ্রমণ ছিল না, ছিল তাঁর ছয় দফা কর্মসূচী যার মাধ্যমে মুজিব পরিস্কারভাবেই স্বায়ত্তশাসনের ডাক

৫৪

দিয়েছিলেন। পাকিস্তানী জেনারেলরা ধরে নিয়েছিলেন যে এই ৬ দফা দাবী আসলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামাে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হবার কর্মসূচী। এই ভয় বাইরে বেরিয়ে আসে যখন পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক জেনারেল আইয়ুব খান ২৫ মার্চ ১৯৬৯ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন- “আমাদের দেশের এই ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে এর তত্ত্বাবধান করা আমার পক্ষে অসম্ভব।” তিনি একই সাথে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত জানান। সেই একই দিনে জেনারেল ইয়াহিয়া খান চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ৩১ মার্চ ১৯৬৯ নিজেকে পাকিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়ােগ দেন।

শেখ মুজিবের ছয়-দফা দাবী কি ছিলাে? কখন জাতির সামনে মুজিব এই ছয়-দফা দাবীর কথা প্রকাশ করেছিলেন? ১৯৬৬ সালে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবী দিয়েই প্রধানত পরিচালিত হত।

ছয় দফা দাবীগুলাে ছিলাে
১.পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামাের সরকার হবে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির। থাকবে সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ।
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়, অন্য বিষয়গুলাে ফেডারেশনের ইউনিটগুলাের হাতে থাকবে।
৩. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা ব্যঙ্কিং ব্যবস্থাসহ দেশের দুই অংশের জন্য দুটি পরস্পর বিনিময়যােগ্য মুদ্রা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. করারােপ এবং লেভি করার বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলাের হাতে থাকবে। একাংশের বরাদ্দ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা মেটানাের জন্য
৫. প্রতিটি প্রদেশের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি করে পৃথক হিসাব খােলা হবে। তারা যে পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে তার ওপর তাদের নিজ নিজ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এর একাংশের বরাদ্দ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা মেটানাের জন্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যাদির আন্তঃপ্রদেশ চলাচল ও পরিবহনের বেলায় অভিশুল্কমুক্ত সুযােগ সুবিধা থাকতে হবে। প্রদেশগুলাের বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি পাঠানাের এবং সংশ্লিষ্ট প্রদেশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকতে হবে।
৬. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকতে হবে।

ছয় দফা দাবীর প্রধান উদ্দেশ্য যা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা হল- এর ফলে সংবিধান অনুযায়ী সবার জন্য ন্যায় ও সমতা

৫৫

শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে বেছে নিলেন বন্ধু হিসেবে নিশ্চিত হবে। এটি স্বায়ত্তশাসনের ডাক, স্বাধীনতার জন্য নয়। এই ছয় দফা দাবী ম্লান হয়ে যায় যখন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন। পরবর্তীতে এই সম্পর্কে আরাে আলােচনা করা হবে।

ভারতের কাছে সমর্থনের জন্য মুজিবের আবেদন এবং নয়াদিল্লীর জবাব

মুক্তির পথে মুজিবের আঁকা রােডম্যাপের জবাবে নেহেরু বাংলাদেশী নেতাকে যা বলেছিলেন তা আপাতদৃষ্টিতে হতাশাব্যাঞ্জক মনে হতে পারে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ঠিক ঐ সময়ে স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য অনুকূল নয়। চীনের কাছে অপমানিত হবার পর ঠিক ঐ মুহূর্তে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করাও ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। মুজিব যদি আসলেই কার্যকরীভাবে ভারতের সাহায্য চান তবে তাঁকে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এরই মধ্যে নেহেরু মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে তাতে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত সমর্থন দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুজিবুর রহমান একজন জাদুকরী গণনেতা এবং তুরস্কের কামাল আতার্তুকের মতাে তার গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শও আছে। নেহেরু বিশ্বাস করেছিলেন যে মুজিব সনাতন ডানপন্থি পাকিস্তানী ধর্মীয় চরমপন্থা ও হিংসাত্মক মৌলবাদ বয়ে নিয়ে বেড়ান না।

এরই মাঝে ঢাকায় ভারত ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরীর একটি প্যাকেজ অপেক্ষা করছিল। প্যাকেজটির ভিত্তি ছিল বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দুই দেশের সমমূল্যবােধ ও পারস্পরিক বিশ্বস্ততা। চুক্তিটি একটি রাজনৈতিক নিয়মনীতির মতাে দেখাচ্ছিল। এখানে আমাকে বলতেই হবে যে চুক্তির শর্তগুলি বুঝতে সেগুলাে শুধুমাত্র গােপনীয় সরকারী দলিল হিসেবে বিচার করলে হবে না। এর কোন কপি আমার কাছে নেই কিন্তু আমার স্মৃতি থেকে যতটা বিশ্বাসযােগ্যভাবে সম্ভব এগুলি বের করে আনছি। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ মনে রাখার স্মৃতিশক্তির ওপর বিশ্বাস রাখি। ভুলের কোন অবকাশ নেই।

সংবিধান ও ঐতিহ্যে লালিত নিজস্ব মূল্যবােধের ওপর ভিত্তি করে ভারত সব সময় সেই সব উপনিবেশিকতা-বিরােধী জাতিগুলাের সংগ্রামে সাহায্যের

৫৬

হাত বাড়িয়েছে যারা জনসম্মুখে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যাদের পারস্পরিক বিস্তৃত সভ্যতার পরিণতির প্রতি শ্রদ্ধা আছে, যেমন বাঙলাদেশ। একই মূল্যবােধে লালিত হবার কারণে ভারত বাঙলাদেশকে বিভিন্ন স্তরে আত্মিক, রাজনৈতিক ও বস্তুগত সাহায্য দেবার জন্য তৈরী হয়। নেতৃত্বের নিরাপত্তার জন্য এই কৌশলগত বন্ধুত্ব একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামাে অনুসারে চলতে হবে এবং সর্বাত্মকভাবে গােপন রাখতে হবে। যদি প্রয়ােজন হয় তবে অস্বীকার করার অধিকারও থাকতে হবে।

ভারত জানায় মুজিবকে তার মুক্তির রােডম্যাপ বাস্তবায়নে কোন তাড়াহুড়াে করা চলবে না। ব্যর্থতা এড়াতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতেই হবে। লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা কোন উদ্দেশ্যই সাধন করবে না। কার্যকরী পর্যায়ে নেতৃত্বের অভাব কোন সুফল বয়ে আনে না। মুজিবকে সবসময় নেতৃত্বের সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ে রুখে দাঁড়াবার জন্য উপস্থিত থাকতে হবে। মুজিবকে পরামর্শ দেয়া হয় যে তিনি যখন গণতন্ত্রের কথা বলছেন তখন তার কয়েক বছর গণমানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মুক্তির পথে অসংখ্য চড়াই উত্রাই থাকবে। সেই সব বাধা অতিক্রম করে রাজনৈতিক পদক্ষেপের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারলেই মুজিব নিজেকে মুক্তির যােদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন।

মুজিবকে বলা হয় সমাবেশে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়ে তাঁর কথা শুনতে আসে তখনই বিশ্ব তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সত্যিকারের জননেতা বলে মেনে নেবে। এই কারণে তাকে তার বাক্য বিন্যাসের ক্ষমতার। সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজের দলের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতির জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি সৌভাগ্যবান যে তার হাতে একটি বিশ্বস্ত সংবাদপত্র ও সম্পাদক আছেন, তিনি একজন শক্তিমান মুখপাত্র যিনি ইতােমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে ‘স্বায়ত্তশাসনের সচেতনতা তৈরীতে কাজ করছেন।

চাইলে ভারত পরামর্শ দেবার জন্য তৈরী ছিলাে যে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতি বিপুল জনসমর্থন নিশ্চিত করা যায় এবং কিভাবে পার্টির খরচ চালাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছােট বড় অনুদান সংগ্রহ করতে হয়। গণ সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলি খুবই জরুরি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাদের সারাদেশে জনসমাবেশ করার জন্য তৈরী থাকতে হবে।

৫৭

বিপুল সংখ্যক গণসমর্থন তৈরী হবার পর ভারত পূর্ণাঙ্গ কৌশলগত সমর্থন দেবার জন্য তৈরী থাকবে কিন্তু বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরীর দায়িত্ব শেখ মুজিব ও তাঁর আওয়ামী লীগের, অন্য কারাে নয়।

এটি একটি অভূতপূর্ব বিষয় যে ভারত প্রণীত পরামর্শগুলি শেখ মুজিব মানতে রাজি হয়েছিলেন। ধারণাগত পর্যায় থেকে লক্ষ্য অর্জন পর্যন্ত দুই পক্ষই চতুরতার সাথে কাজ করছিল এবং সাত বছরের একটু বেশি সময় পরেই মুক্তির আন্দোলন প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছিল-১৯৬৩ থেকে ১৯৭১।

***

ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাথায় এক দারুণ চিন্তা ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় তা সশব্দে চিন্তা করার মতাে। সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে বলা যেতে পারে ৬০ এর দশকে প্রশ্ন ছিলাে মুজিবের পক্ষে কি রাজনৈতিক কর্মসূচীর গান্ধীবাদী পদ্ধতি যেমন অসহযােগ ও নাগরিক অনানুগত্য গ্রহণ করা সম্ভব? চিন্তার বিষয় ছিল পাকিস্তানের চরমপন্থি আদর্শের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন শুরুতেই আন্তর্জাতিক গােষ্ঠীর কাছে সংগ্রামকে গ্রহণযােগ্য করে তুলবে কিনা। যদিও মুজিব খুব বেশি নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বেশ জোর দিয়েই আমাকে বলেছিলেন যে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে তাঁর খুব পছন্দ। যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় নায়ক ছিলেন। যিনি গান্ধীজীর অহিংস নীতি যে একগালে চড় খেলে অন্য গাল এগিয়ে দেয়ার সাথে একমত ছিলেন না। মুজিব নিশ্চিত ছিলেন যে বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই অহিংসনীতিতে কোন কাজ হবে না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ঘৃণ্য পাকিস্তানি সামরিক একনায়কতন্ত্রের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। তিনি বিস্ফোরণমুখ হলেও জনপ্রিয়তার হিসেবে যুক্তির পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ব্রিটিশরা মুক্তি সংগ্রামে অহিংস নীতির শক্তির কথা ভালােভাবেই বুঝতে পেরেছিল এবং তারা মােহনদাস করমচাদ গান্ধীকে সম্মানও করতাে কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী, যারা গােড়ামী দ্বারা পরিচালিত মানুষ মারার মেশিন, এই সম্পর্কে তারা কোন ধারণাই রাখে না। যাইহােক, বাঙলাদেশের

৫৮

নেতা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে একটা কৌশলগত আপােষে আসতেই হবে যখন তিনি বিশ্বাসে গান্ধীবাদী নেহেরুর সাথে কাজ করছেন।

১৯৪৩-৪৪ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাধীন সিংগাপুর থেকে সুভাষ চন্দ্র বসুর দেয়া ভাষণগুলি সম্পর্কে মুজিব অবগত ছিলেন। নেতাজি ভারতের স্বাধীনতার জন্য গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস নাগরিক অসহযােগের প্রশংসা করেছিলেন। মুজিব জানতেন সুভাষ চন্দ্রের এই প্রশংসা আদতে কৌশলগত। অহিংস আন্দোলনকে সামনে রেখে তার তৈরি মুক্তিবাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।

মুজিব নেতাজির পন্থা অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যখনই সুযােগ পাওয়া যেত তিনি তার বক্তৃতায় পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের ‘অসহযােগ আন্দোলন’-এর উপকারিতার কথা বলতেন। এই অহিংস নীতি ছিল আন্দোলনে ভারতীয় প্রভাবের মতাে। মুজিব এই নতুন কৌশলগত পরিবর্তন গ্রহণ করতে খুব বেশি সময় নেননি। সাত বছরের গণসচেতনামূলক সভায় তাঁকে সবসময় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলনের কথা বলতে শােনা গেছে।

১৯৭১-এ এসে মুজিবের সামনে অনেকগুলি সুযােগ তৈরী হয় পাকিস্তানী একনায়কদের বিরুদ্ধে ‘শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনা করার। যদিও তিনি মনে মনে জানতেন যে মুক্তির সংগ্রাম সফল করতে চূড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র আন্দোলন দরকার হবে।

***

রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!