লন্ডনের গুপ্তসভা, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ – শশাঙ্ক ব্যানার্জী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ঢাকায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আত্ম সমর্পণের পরে উদ্ভুত কৌশলগত পরিস্থিতিতে, নিরাপত্তাজনিত গােপনীয়তায়। বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর অজ্ঞাতে নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ লন্ডনে এসে পৌঁছান।
লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারের কাছে চ্যারিং ক্রস হােটেলে আব্দুস সামাদ আজাদ-এর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের আদি সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর সিনিয়র নেতাদের সাথে পূর্বনির্ধারিত রুদ্ধ দ্বার বৈঠক হবার কথা ছিল। পূর্ব পাকিস্তনের মত তাদের স্ব স্ব প্রদেশে সামরিক হামলার ভয়ে তারা লন্ডনে এসে আশ্রয়। নিয়েছিলেন।
সেই গুপ্তসভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ায় প্রভিন্স (NWFP) এর জাঁদরেল পাখতুন নেতা খান আব্দুল ওয়ালী খান। তিনি ছিলেন অহিংসা আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ খান আব্দুল গাফফার খান। এর ছেলে। বুগতি সম্প্রদায়ের মহান বেলুচী জাতীয়তাবাদী নেতা নওয়াব আকবার খান বুগতি, মাররি সম্প্রদায়ের জাতীয়তাবাদী বেলুচ গেরিলা নেতা খায়ের বক্স মাররি, মেনগাল সম্প্রদায়ের জাতীয়তাবাদী নেতা আতাউল্লাহ। মেনগাল, জি এম সাইদের একজন নাম না জানা প্রতিনিধি, জিয়ে সিন্ধ মাহাজের একজন জাতীয়তাবাদী সিন্ধ নেতা (যিনি ঘােষণা করেছিলেন। সিন্ধ এর স্বাধীনতা অর্জন না করে থামবেন না এবং তিনি অস্থিরতা তৈরীর। দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন)। আলােচনার বিষয়বস্তু ছিল অসাধারণ স্পর্শকাতর একটি বিষয়।
উপস্থিত নেতারা আব্দুস সামাদ আজাদ, তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁদের দল আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন উপনিবেশিকতা
১৪৩
বিরােধী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙলাদেশের জন্ম দেবার জন্য।
আজাদ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহমর্মিতার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলাের নেতাদের বােঝাতে চাইছিলেন যে বাংলাদেশের মতাে একইভাবে বেলুচ, সিন্ধি এবং পাখতুনরাও পাকিস্তান বাহিনীর অবিশ্বাস এবং ক্রোধের শিকার হতে পারে। পর্যায়ক্রমে সামরিক অভিযান চালানাে হতে পারে তাদের ওপর। রাজনৈতিক। দমন, অর্থনৈতিক শােষন এবং সংখ্যালঘু প্রদেশগুলােতে সামাজিক বৈষম্য। এবং বঞ্চনা সহ্যাতীত হয়ে উঠতে পারে। তিনি জানতে চাইলেন সমবেত নেতারা তাঁর বিশ্লেষনের সাথে একমত কি না। বিষয়টি অনুমােদন করে। সবাই গলা মেলালেন এক সাথে । আজাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, বেলুচ, সিন্ধি এবং পাখতুনদেরও পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রয়ােজন, তারা সেটা অনুমােদন করেন কি না। পরাজয় বরণের ফলে সেই সময়টাতে পাকিস্তানের অবস্থা খুব নাজুক ছিল, আঘাত হানার সুবর্ণ সুযােগ ছিল তখনই। তিনি জানিয়েছিলেন যে তারা যদি সম্মত হন তবে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও বস্তুগত সব ধরণের সহযােগিতা করার জন্য প্রস্তুত।
সম্মিলিত কণ্ঠে দ্রুত প্রশ্ন এল, ভারতের অবস্থান কী হবে? আজাদ তাদের নিশ্চিত করেন যে তারা যদি ভারতের সাহায্য চান তাহলে আওয়ামী লীগের নেতারা নয়া দিল্লীর সাথে বিষয়টি নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে আলােচনা করবে। তবে ভারতের সমর্থন পেতে হলে তাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে গনতন্ত্র, বহুজাতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে।
সভায় উপস্থিত সব নেতারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও গনতান্ত্রিক মূল্যবােধের ওপর ভিত্তি করে তাদের সংগ্রামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
আজাদ আমাকে পরে বলেন যে, এই সব ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠির নেতারা তাঁর কাছে মত প্রকাশ করে বলেছেন যে, বিষয়টা নিয়ে অনেক আগেই কাজ শুরু করা উচিত ছিল। তাহলে তারা ‘ইতিবাচক উত্তর নিয়ে প্রস্তুত থাকতে পারতেন। এখন সময় অনেক কম। তারা প্রস্তুত নন। প্রয়ােজনীয় অবকাঠামাে। প্রস্তুত নেই।
নওয়াব আকবার বুগতি তার গাম্ভীর্য ভেঙ্গে বেশ আবেগের সাথে বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে ভারতকে আর একটি বার পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।
১৪৪
তাদের কিছু নির্দিষ্ট দাবী দাওয়ার প্রেক্ষিতে আলােচনাটি ব্যর্থ হয়। বােঝা যায় এই গােপন আলােচনার আয়ােজন খুব তাড়াহুড়াে করে তৈরী করা হয়েছে। এ নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠির নেতাদের সাথে পূর্বাহ্নে কোনাে পরামর্শ করা হয়নি। যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তার ফলেই এমনটি ঘটেছিল। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ তান্ডবের ফলে তাদের বিরুদ্ধে জমে ওঠা তিক্ততা এই বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তার উদ্রেকে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। যুদ্ধের ডামাডােল এবং বাঙলাদেশের জন্মের ঘটনাটিও বিষয়টি উত্থাপনের সুযােগ তৈরী করে দিয়েছিল।
আলােচনার বিষয়বস্তুর একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক, ভৌগলিক উদ্যোগ ছিল। যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতাে তবে তা পকিস্তানকে টুকরাে টুকরাে করে ফেলত। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে বাঙলাদেশের জন্ম। একদিনে হয়নি।
লন্ডনের এই গুপ্তসভার রিপাের্ট কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছে যায়। যার একটি অনুলিপি আমাকে দেখানাে হয়।
এটা ধারনা করা অবাস্তব হবে যে এই আলােচনার সারবস্তু নয়া দিল্লী পৌঁছায়নি এবং পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধবিরতি ঘােষনার সিদ্ধান্তে এটি কোনাে প্রভাব ফেলেনি। এর ফলেই ১৯৭১ সনের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এটি কোনাে হটকারী সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং চিন্তা ভাবনা করে নেয়া।
অন্যান্য যে বিষয়গুলাে ইন্দিরা গান্ধীকে যুদ্ধ বিরতি ঘােষনার জন্য প্রভাবিত করেছিল তার একটি হলাে সামরিক কৌশলপত্র। যদি ভারতীয়। বাহিনীকে লাহাের পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা হতাে, তাহলে সে রকম একটি চরম অসম্মান এবং জীবন ঝুঁকির ভেতরে পড়ে গিয়ে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মানসিকতা কী হতাে?
বলা বাহুল্য যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানী আদিবাসীদের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আদিবাসীদের কাছ থেকে কাশ্মির উদ্ধারের প্রস্তাব ভারতীয় রাজনীতিবিদরা ফিরিয়ে দেন। এ বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর যুদ্ধমন্ত্রণালয় মনােযােগ দিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন।
অনেক আলােচনার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, পাকিস্তানের জাতীয় চরিত্রের মূল কাঠামাে হলে লাহাের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পাঞ্জাবী
১৪৫
প্রভাব সম্পৃক্ত। সেই শহরের ওপর আক্রমন ও দখল করতে গেলে ভয়ঙ্কর প্রতিরােধ গড়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লেনিনগ্রাদ শহর প্রতিরােধ যুদ্ধে নায়কোচিত গল্পগুলাে নিয়েও আলােচনা করা হয়। হিসেব করে দেখা হয় যে লাহাের আক্রমন করলে ভারতের কম পক্ষে ১০ হাজার সৈন্য হারানাের ঝুঁকি আছে। এত মূল্যের বিনিময়ে কয়েক মাসের জন্য শহরটি ভারতীয় দখলে রাখা কতটা যৌক্তিক হবে? পাকিস্তানকে লাহাের ফিরিয়ে দেবার জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক চাপ আসবে। এই স্বল্পস্থায়ী বিজয়ের প্রেক্ষিতে এত গুলাে প্রাণ হারানাের ঝুঁকি নেবার কোনাে অর্থ হয় না। ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধবিরতি ঘােষনার পেছনে এটি সব চেয়ে বড় কারণ ছিল।
তাছাড়া ভারতীয় সীমান্তে সিন্ধ-এর কর্ম-পরিকল্পনার বিষয়টিও আলােচনায় এসেছিল। এর ফলে করাচীর সাগরতট এলাকা পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব হতাে। রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে সে পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়। মনে করা হয় যে সিন্ধি আর বেলুচরা স্বাধীনতার জন্য তখনও প্রস্তুত নয়।
***
যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই ভারতের পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ বিরতি সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব নেবার চেষ্টা করছিল। তাদের দাবী ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়ােগের ফলেই যুদ্ধবিরতির এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলে যে তারা ইন্দিরা গান্ধীকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ‘অভিযান’ তারা সহ্য করবে না। উদাহরণ স্বরূপ বঙ্গোপসাগরে তাদের নৌবহর পাঠানাের কথা বলা হয়।
এটা হতে পারে যে ওয়াশিংটন এবং মস্কো পরস্পর আলােচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে ভারতের আর এগুনাে ঠিক হবে না। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বলছি না যে যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। এ বক্তব্যের কোনাে ভিত্তি নেই। আমি। নিশ্চিত যে ইন্দিরা গান্ধী বাইরের কারাে চাপে দমে যাবার পাত্রী ছিলেন না। ওই পরিস্থিতিতে দেশের ভালাের জন্য যা করার দরকার ছিল, তিনি তাই করেছিলেন।
যদিও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, লন্ডনের গুপ্ত সভাটি ব্যর্থতায় সমাপ্ত হয়, ঢাকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিন্তু বিষয়টা থামতে দেননি। পাকিস্তানের প্রতি
১৪৬
জমে ওঠা তিক্ততা এত সহজে ফুরিয়ে যায় না। বিষয়টি শীর্ষ নেতা আবারও উত্থাপন করেছিলেন ১৯৭৩ সনে যখন মুজিব তার গল-ব্লাডার অপরেশনের জন্য লন্ডন আসেন। তখন তিনি পাখতুন জাতীয়তাবাদী নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান এবং বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা আকবার খান বুগতীকে গােপন আলােচনায় আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা তখন লন্ডনেই ছিলেন। তারা তিনজন প্রায় এক ঘন্টা ধরে হৃদয় উজাড় করে কথা বলেছিলেন। সভার পরে মুজিব আমাকে হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে বলেন। তিনি আমাকে বলেন। যে, বেলুচিস্তান, সিন্ধ ও পাখতুনের মানুষদের জন্য তিনি যৌথ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি নিয়ে আবার আলােচনা শুরু করেছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম যে বিষয়টি আরও অনেকদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে কোনাে। দৃঢ় ফলাফল শেষাবধি আসেনি। আমার মনে হয়েছিল ফাঁস হয়ে যাবার ভয়। না করে ওই দুই নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মুজিব পৃথিবীকে তাঁর পাকিস্তান সম্পর্কে পরিকল্পনা জানান দিতে যাচ্ছেন। যদিও পাকিস্তানের আদালতে তাঁর নামে বিশ্বাসঘাতকতার মামলা আছে কিন্তু এখন বাঙলাদেশ স্বাধীন, তার আর পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে ভয় কী?
ওয়ালী খান এবং আকবর বুগতীকে রাজি করাতে না পারাটা মুজিবের মুখে তিতে স্বাদের মত লেগে ছিল। সেদিনের আলােচনার কথা আমাকে জানান তিনি। তারপর বেপরােয়া ভাবে বলেন, আমরা বাঙ্গালীরা পাকিস্তানের ওই যােদ্ধা জাতির চেয়ে অনেক বেশী সাহসী। আমরা লড়াই করেছি এবং জিতেছি। আমি বেলুচ এবং পশতুনদের একটা আলাদা কাঠামাে দিতে চাই। যার একটা অংশ সিন্ধিরাও। তারা মনে করছে তারা এখনও তৈরী না, এখনই উপযুক্ত সময় না। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আঘাতের মােক্ষম সময় এখনই। ওরা আসলে জানে না, আমি এবং বাঙলাদেশের সবাই গণহত্যা, এবং গণধর্ষণের ঘটনায় পাকিস্তান আর্মির প্রতি কতখানি তিক্ত হয়ে আছি।
এই পর্যায়ে তার কাছে আমার চিন্তা জানানাের অনুমতি চাইলাম আমি। তিনি আমার বক্তব্য শুনতে রাজি হলেন। আমি বললাম যে ঘটনাক্রমে খান আবদুল ওয়ালী খান এবং আকবার খান বুগতী, দুজনকেই ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি। তাদের সাথে আমার মেলামেশার কারণে তাদের মধ্যে কী চলছে আমি জানি। তারা দুজনেই একমত যে পাকিস্তানী পাখতুন আর পাকিস্তানী বেলুচরা একদিন দমনকারী সামরিক শাসিত পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। অঞ্চলের দাবীতে এই দুই আদি জনগােষ্ঠীর সংস্কৃতির
১৪৭
পার্থক্যও প্রবল। সত্তরের দশকে দাঁড়িয়েও এ সবের কোনাে সমাধান হয়নি। বিবাদের কারণ দেশ নিয়ে তাদের নিজ নিজ মতবিরােধ। কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ ঠিকানা? তারা কি যার যার মত থাকবে, নাকি একতাবদ্ধ হবে?
খান আবদুল ওয়ালী খান একটি বৃহৎ পাখতুনিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার মধ্যে থাকবে ১. আফগানিস্তানের পশতুন অংশটি। ২. NWFP- এর। পাকিস্তান অংশটি (সম্প্রতি যার নাম দেয়া হয়েছে খাইবার পাখতুনখৌয়া)। ৩. বেলুচিস্তানের পাকিস্তানী প্রদেশ। খান আবদুল ওয়ালী খান, যিনি বামপন্থী। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ডুরান্ড লাইন, যা পাকিস্তান আর আফগানিস্তানকে আলাদা করেছে, তাকে অস্বীকার করতেন। তার মতানুসারে পশতুরা এক জাতি। সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের টানা কোনাে লাইনে তাদের আলাদা করা যাবে না। (ঘটনাচক্রে নব্বই-এর। দশকের শেষ প্রান্তে এসে তালিবানরাও ডুরান্ড লাইনের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা চায় আফগানিস্তান পাকিস্তানের অংশ হবে ।) ওয়ালী খানের। স্বপ্ননুসারে NWFP পাকিস্তান থেকে ভেঙ্গে আফগানিস্তানের অংশ হবে। সব চেয়ে বিতর্কের বিষয় ছিল বেলুচিস্তানকে তিনি ‘জুনুবি পশতুনিস্তান’ অথবা ‘দক্ষিন পশতুনিস্তান বলতেন। পশতুন আর বেলুচরা ছিল ভাই-এর মত। তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ও ছিল অভিন্ন। বৃহৎ পশতুনিস্তানের স্বপ্ন সার্থক। করতে হলে ‘হরমুজ উপসাগরের উষ্ণ জল’-এর নাগাল পেতে হবে,-এই নামটি সােভিয়েত ইউনিয়নের রাখা। কৌশলগতভাবে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে নামটি দেয়া। বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নকরণে সােভিয়েত মদদ কি তবে পরবর্তীতে পরােক্ষভাবে জাতিসত্বর ভিত্তিতে পশতু ও বেলুচিদের আলাদা হয়ে যাবার পথ ত্বরান্বিত করা? তবে কি মস্কো তার ‘ডােমিনাে তত্ব’ বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছিল? হয়তাে, কিন্তু এ ধরণের তত্ব ইতিহাসে একটা বড় যদি হয়ে থেকে যাবে, যার কোনাে উত্তর নেই।
ওয়ালী খানের তত্ব বেলুচরা গ্রহন করেনি। বেলুচ নেতারা নিজেদের আলাদা জাতীয় পরিচয় তৈরীতে দৃঢ় অবস্থান নেন। তাদের অবশ্যই। পশতুদের সংগ্রামে সহানুভূতি ছিল, তাই বলে নিজেদের জাতীয় পরিচয়। হারিয়ে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না তারা। বিতর্ক চলছিল যখন আমি আর মুজিব মধ্য ও দক্ষিন এশিয়ার ভৌগলিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলাে নিয়ে আলােচনা করছিলাম। ১৯৮৯ সনে সােভিয়েত ইউনিয়নের পতন এই বিতর্ক স্তিমিত করে দিলেও শেষ করেনি।
১৪৮
জিএম সাইয়েদ পরিচালিত ‘জিয়ে সিন্ধ মাহাজ’ সিন্ধিদের হাতে নেতৃত্ব। চেয়েছিল। জিএম সাইয়েদ ঘােষনা দিয়েছিলেন যে তিনি স্বাধীনতার কম আর কিছু গ্রহন করবেন না। এই কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। তিনি বন্দীদশায় প্রাণত্যাগ করেন। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন জেল থেকেই তিনি সিন্ধিদের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। তাঁর একটা লক্ষ্য ছিল ভুট্টো পরিবারকে সংগ্রামের অংশ করা । কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর অন্য উচ্চাকাঙ্খ ছিল। জিএম সাইয়েদ বিশ্বাস করতেন ভুট্টোদের সিন্ধি মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকবে। তাঁর মৃত্যুর আগে জিএম সাইয়েদ পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে (২০১১’র শাসক দল) অনুপ্রবেশ করে গােপন সেল তৈরীর এক পরিকল্পনা করেছিলেন। যা ভবিষ্যতে কোনাে এক সময় কাজে আসবে।
আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম যে মুজিব ধৈর্য্য ধরে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের নিয়ে আমার বিশ্লেষন শুনলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম যে মুজিব মনে করেন পাকিস্তানের সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এ গল্পের শেষ নয়। পুরাে গল্প জানার এখনও অনেক বাকি। মুজিব হেসেছিলেন আমি যখন বলেছিলাম বাঙলাদেশের জন্ম মিলিটারী শাসিত পাকিস্তানে প্যান্ডােরার বাক্স খুলে দিয়েছে।
***
১৫ অগাষ্ট, ১৯৭৫ ঢাকায় এক রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও ১৯৭১, ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে লন্ডনের গুপ্ত সভাগুলির সম্ভাব্য সম্পর্ক সহজেই স্থাপন করা যায়। বেলুচ, পাখতুন এবং সিন্ধিদের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগের সহযােগিতার প্রভাব নিশ্চিতভাবে ফাস হয়ে। গিয়েছিল। নেতাদের অনভিজ্ঞ রাজনৈতিক খেলার ভুল পদক্ষেপ পাকিস্তানের শক্তিশালী গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে এই সব রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে টেনে এনেছিল, যারা দূর থেকে সব নিয়ন্ত্রিত করেছে।
রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী