যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে রাজনীতি – শশাঙ্ক ব্যানার্জী
২ জুলাই ১৯৭২- সিমলা কনফারেন্স
কঠিন দরকষাকষিতে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে
মধ্যস্থতায় ব্যর্থ ভারত
ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধে জয়ী কিন্তু শান্তিতে পরাজিত
পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে বেছে নেবার জন্য মিসেস গান্ধীর সামনে দুইটি উপায় ছিল।
প্রথম উপায়, তিনি যুদ্ধবন্দী বিষয়টি লেনদেন হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন অথবা শর্ত দিতে পারতেন শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কাস্টডি থেকে মুক্ত করে ঢাকায় ফিরিয়ে দিতে হবে যাতে করে। তিনি বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ন্যায্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। তার বদলে যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হবে যাতে তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারেন। যে বিষয়টি ভয়ঙ্কর চিন্তার ছিল তা হলাে জাতির পিতা শেখ। মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে কি-না! ইতােমধ্যে সামরিক আদালত তাকে দেশদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। যদি তা কার্যকর হতাে তবে ১ম দিন থেকেই নবগঠিত দেশ বাংলাদেশ এতিম অবস্থায় যাত্রা শুরু করতাে। তাই যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির বদলে শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়টি নয়াদিল্লী আলােচনার টেবিলে নিয়ে আসে।
ওদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো যিনি সবে মাত্র পাকিস্তানের চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিসট্রেটর-এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন- এ রকম একটি সুযােগ ছেড়ে দিতে নারাজ ছিলেন যেখানে তিনি ভারতীয় বন্দীদশা থেকে ৯৩,০০০ যুদ্ধবন্দী বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারবেন। ভুট্টোর ক্ষেত্রে ভারত চাইবার আগেই শেখ
১৫০
মুজিবকে মুক্ত করে দেয়াটা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর ওপর নৈতিক চাপের মতাে যাতে যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করা ছাড়া ভারতের আর কোন উপায় না থাকে।
আপাতদৃষ্টিতে ভুট্টো ভারতের জন্য দ্বিতীয় কোন উপায় রাখেননি। ইন্দিরা গান্ধী হয় দয়াপরবশ হয়ে সাড়া দেবেন নয়তাে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দার শিকার হবেন। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনাটা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সবচেয়ে জরুরী ছিলাে। ঢাকায় শেখ মুজিব। সশরীরে ক্ষমতা গ্রহণ না করলে মৌলবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাঙলাদেশের জন্য যে সমর্থন তিনি দিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ হতাে না।
দ্বিতীয় উপায়টি কোন আলােচনার আগেই প্রধানমন্ত্রীর কিচেন ক্যাবিনেটে মৃত্যুবরণ করে। যুদ্ধবন্দী ইস্যুটি ভারতের জন্য একটি সুবর্ণ সুযােগ ছিল সামরিকভাবে পরাজিত দুর্বল পাকিস্তানের ওপর জোর খাটিয়ে কাশ্মির সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান করার। ১৯৭২ সালে সিমলা কনফারেন্সে ভারতের সুযােগ এসেছিল জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেবার। কিন্তু নয়াদিল্লী শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে কাশ্মিরের বিষয়টি পেছনে ঠেলে দিয়ে।
যেভাবেই হােক প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা ভারতের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে। সিদ্ধান্ত নিতে গােটা দেশটা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যারা জরুরী ভিত্তিতে কাশ্মির ইস্যুটির সমাধান চাইছিলেন তারা নিশ্চিত ছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানাে বাঙলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যেই ভীষণ জরুরী । কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে ভয়ঙ্কর গণহত্যা ও নারীদের গণধর্ষণ করেছে তারপর তারা। নিশ্চয়ই জনপ্রিয় বাংলাদেশের নেতাকে ফাঁসিতে ঝােলানাের দুঃসাহস দেখাবে না! এই দলটির মতে যেহেতু পাকিস্তানের মুজিবকে ফাঁসিতে ঝােলানাের প্রশ্ন নেই তাই ভারতের জন্য কাশ্মির সমস্যার সমাধান সবচেয়ে জরুরী।
২ জুলাই ১৯৭২ স্বাক্ষরিত সীমলা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যেহেতু প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির কোর্ট মার্শালের রায় উপেক্ষা করে মিলিটারী তত্বাবধান থেকে মুজিবকে মুক্তি দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ব্যক্তিগত ধন্যবাদ দেবার প্রক্রিয়ায় ৯৩,০০০ যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেন। এই যুদ্ধবন্দীরা প্রায় ৫ মাস ভারতের তত্বাবধানে ছিল।
১৫১
মুজিবকে মুক্ত করতে ভুট্টোর সিদ্ধান্ত ছিল একতরফা। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনুরােধ করার আগেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। স্বভাবতই এর আগে এই বিষয়টি নিয়ে কোন মধ্যস্থতা হয়নি। ভারতের তাই কোন দায় ছিলােনা ভুট্টোর সিদ্ধান্তের জবাবে বিশেষ কোন সুবিধা দেবার। নয়াদিল্লী দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য মুক্ত ছিল। তা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের সাথে ভালাে আচরণের সিদ্ধান্ত নিলেন ভবিষ্যতে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কথা মাথায় রেখে।
মিসেস গান্ধী তার দেশের কৌশল নির্ধারকদের কাছ থেকে প্রবল চাপের মুখে পড়লেন যে কাশ্মির ইস্যুর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতের এই যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়া উচিত হবে না কিন্তু তিনি তাঁর মাটি ছাড়লেন না। একবার সিদ্ধান্ত নেবার পর চাপের মুখে তিনি অতীত বিষয়কে প্রাধান্য দিলেন। যদিও এই ঘটনাটি তাঁর দয়পরবশতা ও স্থিরতার পরিচায়ক কিন্তু ভারত কাশ্মির সমস্যা সমাধানের এক বিরাট সুযােগ হারায়।
কঠোর মনােভাবীদের মতে ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ জয় করলেন কিন্তু শান্তি হারালেন।
দরকষাকষির শক্তি হারানাের পর ভারত চূড়ান্ত সরলতায় পাকিস্তানকে প্রস্তাব দিয়েছিলাে যে কাশ্মির সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানের জন্য দ্বি-পাক্ষিকভাবে দুইটি দেশেরই নিয়ন্ত্রন রেখা (LOC) বাCeasefire লাইনটিকে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে মেনে নেয়া উচিত। মাথামােটা পাকিস্তান ভারতের প্রস্তাবটি অবজ্ঞা করে। সিমলার পরে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে ফিরে এসে নিয়ন্ত্রন রেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বিবেচনা করার আইডিয়াকে কৌতুক করেন এবং ঘােষণা করেন। পাকিস্তান ঘাস খেয়ে থাকবে কিন্তু ‘বিধর্মী ভারতের কবল থেকে দেশ বাঁচাতে ইসলামিক বােমা অর্থাৎ আণবিক বােমা বানাতে সব চেষ্টা করে যাবে। তিনি গােটা বিশ্বকে আরাে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন- ভারতের সাথে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করতেও পাকিস্তান তৈরী।
অনেক বছর পরে নব্বই এর দশকে পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক জেনারেল পারভেজ মােশাররফ ভুট্টোর চেয়েও বেশি রঙ চড়িয়ে নিয়ন্ত্রন রেখা। নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান বর্ণনা করেন। তিনি বলেন LOC অথবা নিয়ন্ত্রন রেখা অবশ্যই একটি সমস্যা, যার কোনাে সমাধান নেই।
১৫২
সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাকিস্তান স্বীকার করে নেয় আগে যে দেশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল এখন তা সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাঙলাদেশ। যে ভাষায় বাংলাদেশকে স্বীকার করা হয় তাতে মাধুর্য ছিল না এবং তা সরল সােজাও ছিল না। সংশ্লিষ্টরা যে কোন ভবিষ্যত সংঘর্ষের ক্ষেত্রে আলােচনার মাধ্যমে সমাধান করে নেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ভবিষ্যতে ভারতের সাথে লেনদেনে পাকিস্তান এই শর্তটির দিকে ফিরেও তাকায়নি। এই চুক্তি অনুসারে ভারত যুদ্ধের সময় দখলকৃত ১৩,০০০ বর্গ কিলােমিটার পাকিস্তানী অঞ্চলও ফিরিয়ে দেয়।
হুসেইন হাক্কানীর বই ‘Pakistan : Between Mosque and Military’র মতে ভারত ভুট্টোর প্রতি ক্ষমাশীল ছিল তারই অনুরােধের ওপর ভিত্তি করে যে ভারত যদি কোমল আচরণ না করে তবে পাকিস্তানীরা তাকে আরও কঠোর চোখে দেখবে। ভুট্টোকেও এই কথা বলতে শােনা গেছে যে ভারত যদি তার প্রতি ক্ষমাশীল না হয় তবে পূর্ব পাকিস্তান হারানাের সাথে সাথে কাশ্মির হারানাের দায়ও তার উপর পড়বে । এটা তার জন্য আত্মহত্যার শামিল।
ঘটনা বহুল সিমলা চুক্তি ভুট্টোর জন্য আরেকটি দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। এটি তার জীবন কেড়ে নেয়। তার সদয় ভাব প্রার্থনা করা উচিত হয়নি, এটি অমর্যাদাকর ছিল। এবং ভারতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে নিয়ন্ত্রন রেখাকে আন্তর্জাতিক সীমানা মেনে নিয়ে কাশ্মির সমস্যার সমাধান করা উচিত ছিল, যে প্রস্তাবটি সিমলা কনফারেন্সে আলােচনার টেবিলেই ছিল । মাথা গরম করে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ঢাকায় প্রাপ্ত শিক্ষার পরেও তার কাশ্মির সমস্যা ঝুলিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত জেনারেলদের রাজনৈতিক মঞ্চের মধ্যমনি হবার সুযােগকে আবারও একবার নিশ্চিত করে। ১৯৭৯ সালে যখন নিষ্ঠুর সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝােলান একমাত্র তার মেয়ে বেনজির ভুট্টো ছাড়া কেউ তার জন্য চোখের পানি ফেলেনি। বেনজির এই মৃত্যুকে রঙচঙ লাগিয়ে এ ভাবে বলেন- “শহীদ জুলফিকার আলি ভুট্টোর আইনি হত্যা।”
ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণে এই ধারণা করা যায় যে ভুট্টো সেনাবাহিনীকে স্থায়ীভাবে ব্যারাকে ফেরত পাঠানাের কাজে ‘সিমলা কনফারেন্স’-কে ব্যবহার করতে পারতেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার কাজে একে
১৫৩
রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেত। ঐ ঘটনার চল্লিশ বছর পরে এসে ২০১১ সালেও তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আসা যাওয়ার অন্তরালে আসল ক্ষমতা চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ-এর হাতে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ডানা আটকাতে এটা ছিল ভুট্টোর কৌশলগত দূরদৃষ্টির অভাব, যা পাকিস্তানের উন্নতির সম্ভাবনাকে একের পর এক সামরিক একনায়কের পায়ের তলায় ঠেলে দেয়। তিনি যদি তা করতেন তাহলে তাঁর প্রাণ হয়ত বাঁচতাে।
রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী