মুজিবুর রহমানের সাথে তেরাে ঘণ্টা – শশাঙ্ক ব্যানার্জী
৯ জানুয়ারী ১৯৭২ সকাল ৬ টায় আন্তরিক স্বাগতমের মাধ্যমে শেখ মুজিব লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরের VIP লাউঞ্জের ‘এলিয়ক এ্যান্ড ব্রাউন স্যুইট এ এসে পৌছান। ব্রিটিশ ফরেন এ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের হেড অফ ইন্ডিয়ান ডেস্ক-এর Ian Sutherland ছাড়া লন্ডন ভারতীয় হাই কমিশনের আপা বি পন্ত এয়ারপাের্টে উপস্থিত ছিলেন। সাদারল্যান্ড অত্যন্ত দ্রুত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এর সাথে শেখ মুজিবের একটি মিটিং এর ব্যবস্থা করে ফেললেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। মুজিব পরবর্তীতে বলেছিলেন যে মিটিংটি অত্যন্ত কার্যকরী ও প্রতিশ্রুতিশীল ছিল। এ সম্পর্কে পরবর্তীতে বলা হবে।
আপা বি পন্ত’ও যথাযথ ভাবে ফোনে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে শেখ মুজিবের আলাপ করিয়ে দেন। গান্ধী মুজিব আলােচনা আধ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মুজিবের জীবনের স্বপ্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম উপলক্ষে তাকে অভিনন্দন জানানাে ছাড়াও ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা যাবার পথে মুজিবকে নয়াদিল্লী ঘুরে যাবার আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান। মুজিব তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। মিসেস গান্ধী মুজিবকে আরাে জানান যে তিনি তার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ভিআইপি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছেন। মুজিবের ফ্লাইটটি যখন প্রস্তুত করা হচ্ছে তখন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে দ্বিতীয়বার কল করে বলেন তিনি এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটটির বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এর সাথে কথা বলে মুজিবের লন্ডন থেকে দিল্লী আসার ব্যবস্থা করেছেন রয়্যাল এয়ারফোর্সের একটি মিলিটারী জেট-এ। এই ফ্লাইট বদলের উদ্দেশ্য
১৭০
তিনি গােপনে শেখ মুজিবকে জানান।
মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ভীত ছিলেন যে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটিতে শত্রুপক্ষের কোনাে এজেন্ট কোনাে নির্বোধ ফাঁদ পাতার চেষ্টা করতে পারে। সাবধানতা অবলম্বনের প্রেক্ষিতে তার সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে তিনি মত পরিবর্তন করলেন এবং এডওয়ার্ড হীথ এর কাছে রয়্যাল এয়ারফোর্সের এর একটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে অনুরােধ করলেন । একটি ভিআইপি জেট যা বাংলাদেশী নেতাকে প্রথমে দিল্লী ও পরবর্তীতে কলকাতায় যাত্রা বিরতি দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। তিনি বাংলাদেশের নেতার ওপর তার ইচ্ছামত এই পরিকল্পনা রদবদলের অধিকারও ন্যস্ত করেন।
এটি একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অনুরােধের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সাথে ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা কারণ তখনও পর্যন্ত এই দুই পক্ষের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলাে না। প্রােটোকলের শর্ত অনুযায়ী এডওয়ার্ড হীথ এই অনুরােধ গ্রহণ করেন। তার জায়গা থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই সুযােগ চলে যেতে দেননি। যদিও তিনি মিসেস গান্ধীর আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন যে তিনি চাইছেন ব্রিটেন বাংলাদেশকে যেন স্বীকৃতি দেয়। সব মিলিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও এডওয়ার্ড হীথ দুজনেরই ইচ্ছে ছিল শেখ মুজিবকে তার ঘর গােছাতে সাহায্য করার এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত নতুন দেশটির প্রশাসন ব্যবস্থার প্রক্রিয়া চালু করে দেবার।
এখন প্রশ্ন ছিল ফ্লাইটে মুজিবের সঙ্গী হবেন কে? মিনিষ্ট্রি অফ এক্সটারনাল এফেয়ার্স এর পলিসি প্ল্যানিং মিনিষ্টার দুর্গাপ্রসাদ ধর ইন্টেলিজেন্স চিফ রাম নাথ কাও, ফরেন সেক্রেটারী টি এন কাউল এবং ‘র’-এর দ্বিতীয় প্রধান কে শংকরন নায়ার এর সাথে আলাপ করে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন যে রয়্যাল এয়ারফোর্সের ফ্লাইটে মুজিবের সঙ্গী হিসেবে আমার সফর করা উচিত। কারণ আমি মুজিবকে চিনতাম অনেকদিন ধরে। তাঁর রাজনীতির প্রথম বছরগুলি থেকে। এবং আমি এই মুক্তির সংগ্রামে ঢাকা ও লন্ডনের সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে একাত্ম হয়েছিলাম। ইন্দিরা গান্ধী এই বিচক্ষণ প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সফর করার অধিকার প্রদান করেন। আমার কাছে প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশ আসে যে সফরকালীন সময়ে মুজিবকে আমার কি বলতে হবে। মুজিবের সাথে রয়্যাল এয়ারফোর্সের এর কমেট জেট-এ সফর করার সুযােগ ছিল ১৩ ঘণ্টার
১৭১
যাত্রা, আর পথে দু’বার রিফুয়েলিং এর জন্য থামা। সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিশনে পরিণত হয়।
আয়ান সাদারল্যান্ড আমাকে মুজিবের ঠিক পাশের আসনটি গ্রহণ করতে বলেন। ভিআইপি ফ্লাইটে টুইন সীট দুটি একটি ওয়ার্কিং ডেস্ক এর পেছনে। অবস্থিত ছিল । ডেস্কটি অত্যন্ত উপযােগী ছিল কারণ এর ওপর গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স কাগজপত্র ছড়িয়ে রাখা যেত। বাংলাদেশের নেতা এই ডেস্কটি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ধুমপানের পাইপটি রাখার কাজে। তার প্রিয় তামাক ছিল সুগন্ধী ব্র্যান্ড ‘Erinmore’। উড্ডয়নের প্রাক্কালে বিমান থেকে নেমে যাবার আগে সাদারল্যান্ড আমার কাছে জানতে চাইলেন যে মুজিবের সাথে। ফোটোগ্রাফ তুলতে আমার কোন আপত্তি আছে কি না। আমি তার জবাবে বললাম না, নিশ্চয়ই কোন আপত্তি নেই। তিনি আমাকে বললেন ফ্লাইট চলাকালীন সময়ে পাইলট আমার এবং মুজিবের দুইটি ছবি তুলবেন যার কপি দিল্লীতে ল্যান্ড করার আগেই আমাকে দেয়া হবে। তার মধ্যে একটি ফোটোগ্রাফ এই বইয়ে প্রকাশিত হল। আমার প্রতি সব রকম খেয়াল রাখার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
বিমান উড্ডয়নের ঠিক আগে একটা মজার ঘটনা ঘটল। আয়ান সাদারল্যান্ড বিমানের দরজায় আমার কাছে এলেন এবং বললেন ‘যাত্রা আনন্দময় হােক’ কোন শব্দ ব্যবহার না করে ইশারায় তিনি আমাকে বললেন। অতিথির দিকে খেয়াল রাখতে। আমিও ইশারায় তাকে নিশ্চিত করলাম যে তাঁর চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি তার সাথে করমর্দন করে তাঁর শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ জানালাম।
কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা ও অরেঞ্জ জুস পানের পর মুজিব বেশ গােপনীয়ভাবে ফিসফিস করে আমাকে একটা বিষয়ে সহযােগিতার জন্য বললেন। তাঁর কথায় কোন দ্বিধা ছিল না। আমি আমার ক্ষমতায় থাকলে করবাে বলে তাকে জানালাম ।
এবার তিনি কথাটা বললেন। তিনি চাইছেন দিল্লী পৌছানাের সাথে সাথেই আমি যেন তাঁর একটি ব্যক্তিগত বার্তা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। পৌছে দেই। রাষ্ট্রপতি ভবনে মিসেস গান্ধীর সাথে তার মিটিং-এ তিনি একটি অনুরােধ করবেন, তার আগেই আমাকে বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে।
১৭২
প্রথম কয়েক সেকেন্ড আমি নার্ভাস ছিলাম। মিশনটি আসলে কি? দিল্লীর উৎসবমুখর পরিবেশে আমি কি প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবাে? মুজিবের ভাষায় তিনি চাইছিলেন এই ব্যক্তিগত অনুরােধটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌছে দিয়ে আমি যেন কিছু আগাম খোঁড়াখুড়ি করে রাখি যে তিনি সৈন্য ফিরিয়ে আনার সময়সূচী সংক্রান্ত তার সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করবেন কি না!
তিনি আমাকে বােঝালেন যে তাঁর অনুরােধের পেছনে আছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এর একটি আকাঙ্ক্ষা। ভারত যদি ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তার সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, যে তারিখটি ইন্দিরা গান্ধী ঘােষিত ৩০ জুন ১৯৭২ এর তিন মাস আগে, তাহলে বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেবার পথ ব্রিটেনের জন্য সুগম হবে। উপরােক্ত অনুরােধের সাথে মুজিব তাঁর নিজের ইচ্ছার কথাই জানালেন। তিনি আসন্ন ইন্দিরা গান্ধী-মুজিবুর রহমান বৈঠকে এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখতে চেয়েছিলেন।
দিল্লী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছানাের পর আমরা যখন সিঁড়ি বেয়ে বিমান থেকে নেমে আসছিলাম তখন আমি দেখলাম স্বস্ত্রীক ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি. ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ফরেন মিনিষ্টার ডিপি ধর অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশের নেতাকে স্বাগতম জানানাের জন্য। আবেগময় কুশল বিনিময়ের পর মুজিবকে ভেন্যুতে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী, ভারতীয় নৌবাহিনী ও ভারতীয় বিমান বাহিনীর যৌথ সমন্বয়ে গার্ড অফ অনার প্রদান করা হবে। রৌদ্রজ্বল শীতের সকালে এসব দেখতে দারুণ লাগছিল।
ডিপি ধরের মনােযােগ অন্য কোথাও ছিল। কমেট জেট এর দোরগােড়ায় থাকতেই তিনি আমাকে একপাশে নিয়ে গেলেন এবং কাজের কথা বলার ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন বাঙলাদেশের নেতার সাথে আমার কোনরকম আলােচনা হয়েছে কি না।
বাঙলাদেশকে ব্রিটেন এর স্বীকৃতির বিষয়টি নয়া দিল্লী এবং ঢাকা দু’দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। মুজিবের সাথে ফ্লাইটে যে সব কথা হয়েছে আমি সরাসরি সে সব তাঁকে জানালাম । আমি এ রকমটি বলেছিলাম যে “এডওয়ার্ড হীথ মুজিবকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন যে
১৭৩
পাকিস্তানী সামরিক বন্দীশালা থেকে মুজিবুর রহমানের মুক্তিলাভ ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলে ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা যায় কি না। তার অর্থ দাঁড়াবে এর আগে প্রস্তাবিত ৩০ জুন ১৯৭২ থেকে তারিখটি প্রায় তিন মাস এগিয়ে আনা। এটি বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি ত্বরান্বিত করবে। কিছুক্ষণ পর ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সম্মেলনে মুজিব ঐ বিষয়টি তুলবেন।” আমি বেশ জোর দিয়ে ধরকে জানালাম যে মুজিব প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনায় সবচেয়ে গুরুত্ব দেবেন এ বিষয়টিতে এবং এই বিষয়টিকে তিনি লিটমাস টেস্ট হিসেবে দেখছেন। এই বিষয়ে ভারতের প্রতিশ্রুতি তাঁর দেশের মানুষের কাছে তাঁর অবস্থানকে নিশ্চিত করবে।
আমি ডিপি ধরকে আরাে জানালাম যে বাঙলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে নতুন দেশের পরিচালনায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। গ্রহণের বিষয়ে রাজী করানাের চেষ্টা করা হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্টপতি নির্বাচন করা হবে এবং তিনি (মুজিব) নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ঐ অনুষ্ঠান ১২ জানুয়ারী ১৯৭২ অনুষ্ঠিত হবে।
এয়ারপাের্ট থেকে ঘড়ির কাঁটা ধরে রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌছানাের পর ডিপি ধর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্রুত একটি মিটিং এর অনুরােধ করলেন এবং আমার কথার ওপর ভিত্তি করে তাকে রিপাের্ট করলেন যে মুজিব বাঙলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের তারিখটি ৩ মাস এগিয়ে ৩০ জুন ১৯৭২ তারিখের বদলে ৩১ মার্চ ১৯৭২ নির্ধারণ করার বিষয়টি সম্মেলনে উত্থাপন করবেন। এই অনুরােধ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত নিরাপত্তা বিশ্লেষণ করতে হবে কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে একটি জবাব চান।
রাষ্ট্রপতি ভবনে যখন কলকাতার বিখ্যাত সুস্বাদু বাঙালী মিষ্টি নতুন গুড়ের সন্দেশ, মশলাদার সিঙ্গাড়া ও সেরা দার্জিলিং চায়ের মাধ্যমে অতিথি অভ্যর্থনা চলছে, মিসেস গান্ধী তখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে বিষয় ভিত্তিক আলােচনা সেরে নিতে । তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইন্টেলিজেন্স চিফ রাম নাথ কাও, ফরেন সেক্রেটারী টিএন কাউল, রাজনৈতিক উপদেষ্টা পিএন হাকসার, ডিপি ধর এবং চিফ অফ আর্মি স্টাফ। জেনারেল শ্যাম মানেকশ’ । প্রধানমন্ত্রী তার জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন যদি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার সাথে সাক্ষাতের সময় মুজিব এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। তবে তিনি ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করায়।
১৭৪
সম্মত হবেন। এর আগে কখনও ভারতের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে এত গুরুত্বের সাথে এত দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
সম্মেলনে শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর সামনে ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করেন। দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্দিরা গান্ধী-শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনের পর একটি যৌথ সিদ্ধান্তমালা ইস্যু করা হয় যেখানে নয়া দিল্লীতে শেখ মুজিবের পরামর্শের ভিত্তিতে ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাঙলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত বাঙলাদেশের প্রতি ভারতের নিঃশর্ত বন্ধুত্বের বিষয়টি প্রমাণ করে।
মুজিব ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে বেশ আনন্দিত ছিলেন। তাঁর আর কোন সন্দেহ ছিল না যে বাঙলাদেশকে ব্রিটিশ স্বীকৃতি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভারতের সাথে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের স্বীকৃতি বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।
মুজিবের সৌজন্যবােধ তাকে কখনাে ছেড়ে যায়নি। সম্মেলনের পরে সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম সুযােগ পাওয়া মাত্র তিনি আমার দিকে ছুটে এলেন এবং এই ‘আগাম খোঁড়াখুড়ির জন্য আমার দুই হাত ধরে ধন্যবাদ জানালেন। অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাঙলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি জানিয়েছিলাম বলে।
দিল্লীর কূটনৈতিক সাফল্যের অজেয় শক্তিতে বলীয়ান মুজিব দেশে ফিরলেন বীরের অভর্থনার মধ্য দিয়ে। আমি এর আগে কখনও এমন ফুটন্ত গনগনে গণজমায়েত দেখিনি। হিসাবে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়ে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘জয় ইন্দিরা গান্ধী’, ‘জয় স্বাধীন বাঙলাদেশ’ শ্লোগানে মেতে তাদের প্রিয় জাতির পিতার নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের উৎসব পালন করছিল।
এই বিপুল গণজমায়েতের মাধ্যমে শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিশালত্বের সাথে তুলনা করা যেতে পারে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরে আয়াতুল্লাহ রহুল্লা খােমেনির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে, যদিও মূলগত পার্থক্য আছে। মুজিব উদারপন্থি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তুরস্কে মৃতপ্রায় অটোমান সাম্রাজ্য সরিয়ে কামাল আতাতুর্ক
১৭৫
এর ধর্ম নিরপেক্ষ বিপ্লবের আদলে। মুজিব এক্ষেত্রে নিপীড়নকারী সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আদর্শগত জয়লাভ করেছিলেন। অন্যদিকে খােমেনির শিয়া বিপ্লব ইসলামিক চরমপন্থা ও সহিংসতার বার্তা দিয়েছিল যা পৃথিবীতে অস্থিরতা ও রক্তপাতের উৎস হয়ে দেখা দেয়।
মুজিবুর রহমানের স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে ফিরে আসাকে অভর্থনা জানানাে হয়েছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নতুন যুগের সূচনার উচ্চাশা নিয়ে।
***
ভিআইপি ফ্লাইটে ফিরে আসা যাক। সাইপ্রাসের আক্রোতিরিতে রয়েল এয়ার ফোর্সের কমেট জেটটি জ্বালানী নেবার পর ফের যাত্রা শুরু করলাে ওমানের দিকে। দিল্লী যাবার পথে সেখানে দ্বিতীয়বার জ্বালানী নেবার কথা ছিল। আমি মুজিবকে বেশ খােশ মেজাজে দেখলাম। তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ভারতের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জনপ্রিয় দেশাত্ববােধক গান ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি’ গাইতে শুরু করলেন। এবং আমাকে তার সাথে অংশগ্রহণ করতে অনুরােধ করলেন। প্রথমবার ছিল। অনেকটা রিহার্সেল এর মতাে, তিনি যখন দ্বিতীয়বার গাইতে শুরু করলেন, তখন তা আরাে বলিষ্ঠ ও আবেগী মনে হচ্ছিল। আমি এক ঝলকের জন্য তার। আবেগে অশ্রুসিক্ত চোখ দেখতে পেলাম। আমি এতদিন তাকে উত্যু মানুষ হিসেবে জানতাম, কিন্তু এখন আমার কোন সন্দেহ রইল না তার চোখের জল তার সত্যিকারের ভেতরের মানুষটাকে বাইরে এনে দিয়েছে, যে একজন আপসহীন দেশপ্রেমিক। তখনকার দিনের রাজনীতিবীদদের মধ্যে যা খুব অল্পই দেখা যেত।
তিনি যখন বসলেন তখন আমাকে বেশ অবাক করে দিলেন। আমার কানে ফিসফিস করে বললেন যে “আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায়। ভালােবাসি” গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত। তিনি আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার
১৭৬
মানবতার সীমা ছিল না, তাঁর গান ব্যবহার করা, এটি দারুণ একটি চিন্তা যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী সেতু তৈরী করবে। চিরদিনের জন্য এই বাঁধন শক্ত করতে এর চেয়ে বেশি আর কি লাগতে পারে? এরকম ইতিহাসে কখনই হয়নি যে দু’টি দেশের জাতীয় সংগীত একটি মানুষের লেখা। এটাও আসলে মুজিবের উফুল্ল আবেগের পরিচায়ক যখন তিনি আমাকে বললেন, যদিও ইতিহাসের কোথাও লিখিত রেকর্ড থাকবে না কিন্তু ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমি যেন জেনে রাখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করার সিদ্ধান্ত দুই পুরােনাে বন্ধুর নেয়া, ‘আপনি এবং আমি’- রয়েল এয়ার ফোর্সের লন্ডন। থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটে। এবার আমার আবেগী হয়ে ওঠার পালা।
আবেগ সরিয়ে রেখে ভাবলে, মুজিব খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন এবং তার উদ্দেশ্য সাধনে কোন সুযােগ নিতে চাচ্ছিলেন না যখন ‘জাতীয় সঙ্গীত কূটনীতি’ বিষয়টি তিনি আমার সাথে ঘটান। তিনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছিলেন যাতে আমাকে দেয়া ‘আগাম খোড়াখুড়ি’র কাজটি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমি ভালােমত সম্পন্ন করি, যাতে ইন্দিরা গান্ধী ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে সম্মত হন । এটি ভারত ও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে বিষয়ে আমি বেশ ভালােমতই অবগত ছিলাম। (যার ফলাফল আমি পূর্ববর্তী প্যারাগ্রাফগুলিতে বলেছি।)
***
আমার ওপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তখনও পালন করতে বাকি। এটি একটি কঠিন মিশন ছিল। খুব সাবধানে কাজটি করতে হত এবং হাতে সময়ও খুব কম ছিল। যে কাজটি আমার হাতে ছিল তা হল মুজিবকে মুগ্ধ করা, সন্তুষ্ট করা এবং আমার বােঝাতে পারার সবটুকু ক্ষমতা ব্যবহার করে তাকে ভারতীয় অভিজ্ঞতার মডেলে নতুন দেশ পরিচালনায় সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তাঁকে রাজি করা। মিসেস গান্ধী হয়তাে ভেবেছিলেন সংসদীয়
১৭৭
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দু’টি দেশের দীর্ঘস্থায়ী টেকসই বন্ধুত্ব তৈরী করবে। রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থায় যা সম্ভব না এবং এটি উপমহাদেশে একনায়কতন্ত্রের কাছাকাছি।
ঠিক যেমনটি ভেবেছিলাম এই আলােচনাটিও বেশ জমে উঠলাে। যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমি তাঁর বেশ কাছাকাছি ছিলাম তাই আমার চেয়ে কেউ বেশি জানতাে না যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর জন্মভূমির মানুষের ন্যায় বিচার লাভ এবং স্বাধীনতার জন্য কতখানি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাঁর কোন চাকরি ছিল না বা পারিবারিক আয় ছিল না যার ওপর নির্ভর করা যায়, তবুও আমি তাঁকে নিঃস্বার্থভাবে দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যেতে দেখেছি। তিনি অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানাের ক্ষেত্রে তাঁর দান ছিল অসীম। আমার মনে হয়েছিল তাঁর কাজের যােগ্য স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।
আমি আমার নিজের পদ্ধতিতে ইস্যুটি নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। প্রথমে আমরা আমাদের পরিচিত বিভিন্ন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করলাম। আমরা নিজেদেরকেই প্রশ্ন করছিলাম যে উন্নয়নশীল দেশগুলাের জন্য কোন ধরনের গণতন্ত্র সবচেয়ে উপযােগী, বিশেষ করে সেই দেশগুলি যারা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অভিনব আত্মপ্রকাশ করেছে। আমরা রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা নিয়েই কথা বললাম। আমরা তর্ক করছিলাম যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল পরিণত গণতন্ত্রের জন্যে হয়তাে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা সবচেয়ে উপযােগী।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা তার পথ হারিয়ে ফেলছে বলে মনে হচ্ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, পাকিস্তানের মতাে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা সামরিক একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। তারপর এলাে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা। এই পদ্ধতি যা ওয়েস্ট মিনিষ্টার মডেল নামে পরিচিত। সবচেয়ে পুরাতন অনুশীলনকারী ব্রিটেন কিন্তু অনেক বছর ধরে ভারতে এর চর্চা অব্যাহত থাকায় ভারত এখন বিশ্বাস করে এটি তাদেরই পদ্ধতি যা ভারত থেকে আমদানী করা হয়েছিল। লক্ষাধিক কারণ ছিল কেন এই পদ্ধতিটি ভারতের জন্য উপযােগী হয়েছিলাে। ভারতীয় অভিজ্ঞতা বাদ দিলেও ওয়েষ্ট মিনিষ্টার মডেলটি আমার মতে বাঙলাদেশের জন্য সবচেয়ে
১৭৮
উপযােগী হবে। ভারত সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করছিল এবং সন্তুষ্ট ছিল। আমি ভেবেছিলাম ভারতের মত গণতন্ত্র বাঙলাদেশ গ্রহণ করবে। আমাদের শিরায় একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। আমার এই তত্ত্ব শুনে মুজিব বেশ হেসেছিলেন।
আমি মুজিবকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওয়েষ্ট মিনিষ্টার মডেলটি বাংলাদেশের জন্য উপযােগী হবার অনেকগুলি কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর মতাে একজনকে খুঁজে বের করা যিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জুরিস্ট ও যােগ্য শিক্ষাবিদ। একজন উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রনায়ক যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে অক্লান্ত এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন। যিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মুজিবের প্রতি অটল আনুগত্যের জন্য পরিচিত ছিলেন। আমি এই প্রসঙ্গে মুজিবের সর্বোচ্চ মনােযােগ ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম।
আমি মুজিবকে আরাে বলেছিলাম যে বিচারপতি চৌধুরীর মতাে একজন বিদ্বান মানুষকে যদি স্বাধীনতার প্রারম্ভিক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হয় তবে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাঙলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত করবে। আর এদিকে মুজিব নিজে জাতির পিতা, রাষ্ট্রের প্রধান কার্যকরী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিস হবে দেশের সব ক্ষমতার কেন্দ্র।
মুজিব খুব দ্রুত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পক্ষে কথা বলার জন্য আমাকে সাধুবাদ জানান। চোখের ঝলক নিয়ে মুজিব জানতে চান বাঙলাদেশের জন্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারের আইডিয়াটা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কি না। মুজিবের ছেলেমানুষি দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। হয়তাে, আমার মনে হচ্ছিল যে তিনি নিশ্চিত হতে চান আমি এমনি এমনি কথাগুলাে বলছি কিনা। আমি মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালাম এবং আরাে যােগ করলাম। যে বিশ্বের নেতাদের মধ্যে মিসেস গান্ধী হচ্ছেন সেই জন, বাঙলাদেশের জন্য যার শুভ কামনা অভিনব এবং অতুলনীয়। আমি আমার ভাবনা যে শব্দে সাজালাম তা হল ঃ “হ্যা, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী আমাকে আপনার বিবেচনার জন্য এই পরামর্শ দিতে বলেছেন। সিদ্ধান্ত নেবার ভার আপনার।”
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে তিনি স্বীকার করেন বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার নবগঠিত বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযােগী
১৭৯
হবে। তিনি আরাে যােগ করেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়ােগ দেবার চিন্তা খুবই বিচক্ষণ চিন্তা যা তিনি অনুমােদন করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে সম্মত হলেন যা কেবল ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরে কার্যকরী হতে পারে। এটা অবশ্য নিশ্চিত যে। দিল্লী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রধান হিসাবে অভ্যর্থনা জানানাে হয় এবং ভারতীয় সম্মিলিত বাহিনীর গার্ড অফ অনার প্রদান করা হয়।
***
অপেক্ষমান রয়েল এয়ার ফোর্সের কমেট জেট-এ ভারতে ফিরে আসার আগে আমি মুজিবের সাথে একটি বিদায়ী মিটিং-এ বসি তাঁর বাসায়। আমি তার মুখ থেকেই জানতে পারি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর মিটিং সন্তোষজনক ছিল এবং তিনি তাঁর কাছ থেকে যা চাইছিলেন বাস্তবিক অর্থে তার সবটুকু পেয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের তারিখ পরিবর্তন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ‘আগাম খোড়াখুড়ি’র জন্য তিনি আমাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম এখনই সুবর্ণ সময় মুজিবকে জিজ্ঞেস করার যে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার যে কথা হয়েছে সেটা তিনি এডওয়ার্ড হীথকে জানিয়েছেন কি না। তিনি বললেন এখনও তিনি সেটা করে উঠতে পারেননি যদিও তিনি মনে করেন না যে হীথ দিল্লী থেকে ইস্যু হওয়া যৌথ সিদ্ধান্তমালা পড়েননি। সাথে সাথেই আমার উপস্থিতিতেই মুজিব তার সেক্রেটারিকে বললেন লন্ডনে। এডওয়ার্ড হীথকে কল দিতে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় তিনি জানতে চাইলেন যে হীথ যৌথ সিদ্ধান্তমালাটি পড়েছেন কি-না যেখানে ভারত নিশ্চিত করেছে যে ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। তাঁর নিজের মত করে মুজিব আসলে হীথকে টোকা দিলেন তাঁদের লন্ডনে নেয়া চুক্তি যে ব্রিটেন বাঙলাদেশকে একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেবে, সে বিষয়ে। যখন আমি তার মুখে বেশ বড় একটি হাসি দেখলাম তখন বুঝলাম যে ভালাে খবর আছে। ভারতের সাথে সাথে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটিশ স্বীকৃতি এই সূর্যের নীচে
১৮০
বাঙলাদেশ, ঢাকার ন্যায্য স্থান সুরক্ষিত করবে।
এখন যেহেতু ঢাকা জাতিসংঘের তিনটি প্রধান সদস্য দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে, অন্যান্য দেশগুলি থেকে স্বীকৃতি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মুজিবের দ্রুত চলমান কূটনীতির মাধ্যমে ব্রিটেন-এর কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় ছিল বিচক্ষণ ও মুগ্ধকর।
যে বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ছিল তা হলাে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে ভারতের সহায়তায় মুজিবের স্বীকৃতি। তিনি বারবার মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর নাম উল্লেখ করছিলেন যা নির্দেশ করে যে তিনি তাঁর নৈতিক সাহস ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কতখানি ভক্ত।
এই বিষয়টি আসলেই অকল্পনীয় যে, তিনি বলছিলেন, আরেকটি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে ভারত এতটা দূর। পর্যন্ত আসবে, এর তুলনা হয় না। তিনি আরাে যােগ করেন- বাংলাদেশ তার। স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তার জন্য ভারতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
আমার অবস্থান থেকে আমি তাঁকে বললাম, তাঁর নেতৃত্বে, স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে বাঙলাদেশের মানুষের সাহস ও মনের জোর না থাকলে ভারত যতই বন্ধুত্বের হাত বাড়াক খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হত না। ভারতের সমর্থন ছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে, ধর্ম নিরপেক্ষতায় ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে।
***
ঘটনার ভিড়ে যে বিষয়টিকে বাদ দেয়া যাবে না তা হল বিমানে থাকতেই শেখ মুজিব কলকাতার চিফ মিনিষ্টার সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়-এর একটি মেসেজ পেয়েছিলেন। তার প্রদেশের জনগণের পক্ষ থেকে রায় মুজিবকে অনুরােধ করেছিলেন, দিল্লী হয়ে ঢাকা যাবার পথে কলকাতায় যাত্রাবিরতি নিতে যদি না তার পক্ষে এটা খুব বেশি সমস্যা তৈরী করে। আমি মুজিবের অনুরােধে সেটার একটি উত্তর লিখতে বসি। মুজিব আমাকে বলে দেন কি লিখতে হবে।
১৮১
পাকিস্তানী সামরিক বন্দীশালা থেকে মুজিবুর রহমানের মুক্তিলাভ উত্তরের চূড়ান্ত ড্রাফটে রাজনৈতিক ভাষায় তিনি বলেন এই মুহূর্তে এই অনুরােধ রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দিল্লীর পরে তার ঢাকায় ফেরা উচিত। কলকাতায় যাবার আগে তাঁর ঢাকায় যেতেই হবে নিজের মানুষদের সাথে দেখা করতে। তিনি যত দ্রুত সম্ভব কলকাতায় আসার প্রতিশ্রুতি দেন।
কয়েকদিন পর মুজিবের বহুল প্রতীক্ষিত কলকাতা সফরে মুজিব ঢাকায় ফিরে যে আনন্দ উৎসব দেখেছিলেন ঠিক তেমনটি দেখতে পান। লাখাে মানুষ কলকাতার রাস্তায় নেমে আসে বঙ্গবন্ধুকে একঝলক দেখার জন্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙলাদেশের মানুষের বন্ধু, এই উপাধি এই অঞ্চলের মানুষ মুজিবকে দিয়েছিল। কলকাতার ব্রিগেড মাঠে মুজিবের শক্তিশালী বক্তৃতা লক্ষাধিক মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে যারা তাঁকে দেখতে ও তার কথা শুনতে জমায়েত হয়েছিল। সংবাদপত্র রিপাের্ট করে যে কলকাতায় ঐ দিন ঐ মাঠে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ উপস্থিত ছিল। এই অভিজ্ঞতা কখনাে ভােলা যায় না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লী থেকে কলকাতায় উড়ে এসেছিলেন এবং মুজিব যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি মুজিবের সাথে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মিসেস গান্ধী জনতার উদ্দেশ্যে তার ভাষণে মুজিবকে ধন্যবাদ জানান বাড়ি ফিরে এত দ্রুত কলকাতা সফরে আসার জন্য।
***
২৪ জুলাই ২০১১ বাংলাদেশ সরকার মরণােত্তর ভাবে সেই দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা প্রদান করে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য। ইন্দিরা গান্ধীর ছেলের সহধর্মিনী ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসএর সভাপতি সােনিয়া গান্ধী ঢাকায় এসে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান-এর কাছ থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অংশগ্রহণ করেন।
***
রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী