You dont have javascript enabled! Please enable it!

হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব : রাজনৈতিক জীবনের সূচনার কথা।

হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব, চারজনেরই রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল ‘ব্রিটিশ-ভারত’এর অবিভক্ত বাংলায়। অতঃপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে চারজনই অনস্বীকার্য গুরুত্বের অধিকারী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, পাকিস্তান। আমলের মতই নানা সংশয়-প্রশ্নের জন্ম দিলেও, এ কথা সত্য যে, রাজনীতির প্রায় সকল দৃশ্যপটেই মৃত্যুর (১৯৭৬) পূর্ব পর্যন্তই মওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষ উপস্থিতি ছিল অবধারিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আততায়ীদের হাতে নিহত (১৯৭৫) হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং রাজনীতির প্রধানতম পুরুষ। এখানেই বলে রাখা যেতে পারে, রাজনৈতিক ঘটনাক্রম এবং বাস্তবতার কারণেই বর্তমান আলােচনার সুবৃহৎ অংশ জুড়ে থাকবে বঙ্গবন্ধু মুজিবের কথা।

শেরে বাংলা ফজলুল হক রাজনৈতিক জীবনের সূচনাতেই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত (১৯১৩) হয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে যােগ দিয়েছিলেন মওলানা মুহম্মদ আলী এবং মওলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের আহ্বানে। তিনি “খিলাফত আন্দোলন ও স্বরাজ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯২১ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন”(৮(৫)/৩৪০)। তাঁরা উভয়েই নিজ নিজ পছন্দ এবং পরিবেশ-প্রয়ােজনমত দল পরিবর্তন করেছেন, তবে অনস্বীকার্য যে, তাঁদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের বিষয়টি যতটা ব্যক্তিগত অবস্থান-মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে ছিল, আদর্শের প্রশ্ন ততটা জড়িত ছিল না। তাঁরা। উভয়েই আজীবন পাশ্চাত্যধারার গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন। শেরে বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন হয়তাে নানা পর্বেই সংশয়-বিতর্কের কারণ হয়েছে কিন্তু তিনি কখনাে সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন যােগাননি। কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন এদিক থেকেও সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কদাগ-মুক্ত নয়।
আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্যের কারণেই ভাসানী-মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনাতে ছিল লক্ষণীয় ভিন্নতা। প্রকৃতপক্ষেই ভাসানী-মুজিব কারাে সমর্থনসহযােগিতায় নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উপলব্ধি আর প্রেরণা থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী প্রথম জীবনে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। সেখানে সাধারণ কৃষকদের ওপর জমিদার এবং মহাজনদের শােষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু করায় তাকে কাগমারি ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন তিনি আসাম প্রদেশে চলে যান। পরবর্তী সময়ে (১৯০২) আসামেই মাত্র ২২ বছর বয়সে সন্ত্রাসবাদী (স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চরমপন্থী অংশ কর্তৃক পরিচালিত) আন্দোলনে যােগদানের মধ্য দিয়ে ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়” (৭(৪)/২৪১)। বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন রাজনীতির দর্শক-সারি থেকে : “চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে (১৯৩৭) ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই।…শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ।…স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গােপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বােসের দলই শক্তিশালী ছিল ।…আমাকে রােজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের সম্পর্কে আমার মনেও বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এ দেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম” (৯/৯)। বঙ্গবন্ধু আরাে উল্লেখ করেছেন : “শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সােহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তারা গােপালগঞ্জে (১৯৩৮) আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলােড়নের সৃষ্টি হল।…আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর । আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল ।…এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম…সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যােগদান করতে। যাতে বিরূপ সম্বর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে।…আমি এখবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিলনা।…আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব (কৃষক-প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা) মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এটা আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল।…হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল।…শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল ।…শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে ।…তাঁকে সম্বর্ধনা দিলাম।…তিনি (ফেরার পথে) ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।…আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তােমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই’? বললাম, কোনাে প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই। তিনি…নােটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তার সঙ্গে দেখা করি। আমিও তার চিঠির উত্তর দিলাম । এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম” (৯/১০-১১)। হক-সােহরাওয়ার্দীর গােপালগঞ্জ পরিভ্রমণের পরে শহরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান আড়াআড়ি একদিন মারামারিতে রূপ নেয়। “দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙ্গে মালেককে (মুজিবের বন্ধু, একটি হিন্দু বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল) কেড়ে নিয়ে চলে আসি।…হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল।…খন্দকার শামসুল হক মােক্তার সাহেব হুকুমের আসামি। আমি খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি।…আমাদের জেল হাজতে পাঠানাের হুকুম হল। এসডিও হিন্দু, জামিন দিল না ।…সাত দিন পরে আমি প্রথম জামিন পেলাম।…আমার জীবনে প্রথম জেল”(৯/১২-১৩)। আজ ভাবতেও বিস্ময় জাগে, একটা চরম সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত-ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাজনৈতিক জীবনের। সূচনা হলেও মুজিব পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির উজ্জ্বল উদাহরণ, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠাতা। প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন একটি লেখায় বলেছিলেন : “ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা থেকে ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তার যে ঐতিহাসিক রূপান্তর তার প্রধান সূত্রধর ও মধ্য-শিরােমণি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান”(১০/১০)। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন ভাসানী-মুজিব উভয়েই। কিন্তু ফারাকও ছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বর্ণনায় : “মওলানার একটা। সীমাবদ্ধতা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি যে সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন, তাকে তিনি ভাবতেই পারতেন না ধর্মকে বাদ দিয়ে। পরিচ্ছন্ন সমাজতন্ত্র নয়, তার লক্ষ্য ছিল ইসলামি সমাজতন্ত্র যার দরুন সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়ােজিত হয়েও তিনি (ভাসানী) সামন্তবাদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন, এমনটা বলা যাবে না।…মওলানার সমাজতন্ত্রের তুলনায় (শেখ মুজিবের) বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল অধিকতর ধর্মনিরপেক্ষ। ছিল তা ভাষাভিত্তিক, যে-ভাষা কোনাে সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নয়, সব বাঙালির মানসিক ও ব্যবহারিক সম্পদ বটে। এবং ওই জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করেছিল ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে বেশ প্রবলভাবে” (১(২)/৭৮১)।
২১
আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন, “সােহরাওয়ার্দী সাহেবের…ব্যক্তিগত সাহস, ব্যক্তিত্ব, একই সঙ্গে অর্থের প্রতি আসক্তি ও অবহেলা, অর্থ সঞ্চয়ে অবিশ্বাস, অনুসারীদেরকে পুত্রবৎ প্রতিপালন, পরিশ্রম করার অসাধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।…সােহরাওয়ার্দী তেমন বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলেও তার মধ্যে একটা যুদ্ধংদেহি মনােভাব ছিল ।…মনে হয়, সােহরাওয়ার্দী ছিলেন নিঃসঙ্গ মানুষ। বহু লােকের সঙ্গে তিনি মিশতেন, বহু রকমের রাজনীতি করেছেন – প্রথমে ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহকারী হিসেবে তাঁর জীবনারম্ভ, জীবন শেষ হলাে আওয়ামী লীগে – কিন্তু তাঁর কোনাে পরমাত্মীয়। বন্ধু ছিল না। তিনি সর্বদা লােক পরিবৃত থাকতেন…কিন্তু তবু তিনি ছিলেন তাঁদের থেকে আলাদা। আচার-আচরণ জীবনযাপন প্রণালীতে তিনি ছিলেন পুরােপুরি পশ্চিমী, রাজনীতি করতেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিরক্ষর জনসাধারণের।…ব্যক্তিগত জীবনে তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্রও ছিল না” (৮/৩৮০-৩৮১)। সাহিত্যিক-সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, “হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে আমি কাছে এবং দূরে থেকে বহুবার দেখেছি। যতবার দেখেছি, ততবারই মনে হয়েছে, তিনি গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক। ভুল করে এযুগের বাংলাদেশে (অবিভক্ত বাংলা) জন্মেছেন। আপােষের রাজনীতির পরিণাম কী মর্মান্তিক হতে পারে, শহীদ সােরাওয়ার্দীর জীবন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ” (১১/১৩১)। সােহরাওয়ার্দী ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও তাঁর নানাবিধ রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত কন্ট্রাডিকশন’এর কারণেই সম্ভবত তিনি কোনাে মহলেরই নিঃসংশয় আস্থাভাজন হতে পারেননি। ১৯৪৭ খ্রি. ভারত-ভাগের প্রাক্কালে “বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বাধীন ও সার্বভৌম এক নতুন রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা করেছিলেন তিন নেতা – শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম (তদানীন্তন বাংলার মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাবিদ) এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। প্রথম দু’জনের আন্তরিকতা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তােলেননি ঐতিহাসিক ও রাজনীতির গবেষকেরা। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী প্রসঙ্গে অনেকেই সন্দেহ পােষণ করেছেন। কারাে কাছেই তাঁর বিশ্বাসযােগ্যতা ছিল না।
না তাঁর নিজের দল মুসলিম লীগের সহকর্মীদের কাছে না বাঙালি হিন্দুদের কাছে। মাউন্টব্যাটেন ও বরােজও তাকে সন্দেহ করতেন”(১২/৯)। উল্লেখ্য যে, “যুক্ত বাংলা গঠনের আন্দোলনে তিনি (সােহরাওয়ার্দী) শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেননি। দিল্লিতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় (মতান্তরে কনভেনশন’, ১৯৪৬) জিন্নাহর প্রতি আপসমূলক নীতি গ্রহণ করে বাংলা-ভাগের প্রস্তাবে সমর্থন করেন। যে কারণে শহীদ সাহেবের এই আপস – অর্থাৎ বাংলাদেশে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও সভাপতির পদ – এ দু’টিই রক্ষা করা, তার কোনটিই
২২
শেষ পর্যন্ত হল না। বাংলাদেশ (অবিভক্ত বাংলা প্রদেশ) ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহর ইঙ্গিতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্টির নেতৃত্ব থেকে শহীদ সাহেব অপসারিত হলেন। নতুন নেতা নির্বাচিত হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ গেল প্রতিক্রিয়াশীল খাজা নাজিমুদ্দিন ও তার গ্রুপের দখলে” (১১/১৩১)। “১৯৪৬-‘৪৭-এ শেখ মুজিব ছিলেন মুসলিম লীগের পতাকাবহনকারী তরুণ ছাত্রনেতা। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু।…সােহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের ধারণাকে কখনাে রাষ্ট্রপরিচালনায় স্বাগত জানাননি। মাঝে মাঝে এর পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছেন, তা ক্ষমতার আসনকে ধরে রাখতে। রাজনৈতিক গুরুর প্রভাবকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করেছিলেন শেখ মুজিব উত্তরকালে । কি ভাবে শেখ মুজিবের মুসলিম লীগের আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উত্তরণ ঘটেছিল” (১২/১৪) তার বর্ণনা এখানে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়। তবে, অনেক পর্যবেক্ষক এবং রাজনীতি বিশ্লেষকেরই অভিমত হচ্ছে, সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক স্ববিরােধিতা এবং আপষকামিতার পথ-পরিণাম থেকেই স্থির-লক্ষ্য রাজনীতির শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্যক্তিগত অসাম্প্রদায়িকতা আর রাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িকতা আদৌ সমার্থক নয়, তবে অনস্বীকার্য যে, ব্যক্তিজীবনে অসাম্প্রদায়িক না হলে কিছুতেই রাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাশীল হওয়া অসম্ভব। “শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন।…মুসলিম লীগের বিপরীতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলায় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে এসেছিলেন।….ব্যক্তি শ্যামাপ্রসাদ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন সে ব্যাপারে কোনাে দ্বিমত নেই। কিন্তু রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদকে আমরা অস্বীকার করি কি করে?”(১২/৯)। অপরদিকে স্মরণ করা যেতে পারে এ. কে ফজলুল হকের কথাও। তিনি একবার মুসলিম লীগের সাথে (১৯৩৭ খ্রি.) আরেকবার হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদের সাথে (১৯৪১ খ্রি.) কোয়ালিশন করে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেও কখনাে কোনাে মহল থেকেই তাঁকে সাম্প্রদায়িকতাবাদী বলে অভিযােগ করা হয়নি।
২৩
চার প্রধানের রাজনৈতিক জীবনের আদি পর্ব : ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলায়

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিবের জন্ম এবং রাজনৈতিক জীবনের সূচনাও ব্রিটিশ-ভারতের অবিভক্ত বাংলায়। ঐ পর্বে এ. কে. ফজলুল হক বাংলা এবং সর্বভারতীয় পর্যায়েও বিপুল বৈচিত্র্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকার অধিকারী হয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী সর্বভারতীয় পর্যায়ে পরিচিতি অর্জন করলেও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মােটামুটি বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মওলানা ভাসানী আসাম প্রদেশে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। অপরদিকে শেখ মুজিব তখন ছিলেন কোলকাতা-ভিত্তিক মুসলিম লীগের সক্রিয় ছাত্রকর্মী। এ. কে. ফজলুল হক “১৯১৩ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫সালে তিনি কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯১৮ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি এবং ১৯১৯ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সালে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তিনি স্বরাজ্য পার্টির নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক চুক্তিটি সম্পাদন করেন” (৭(৪)/২)। সােহরাওয়ার্দীও এ চুক্তি সম্পাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সারা ভারতেই, বিশেষত বাংলায় “হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি (সােহরাওয়ার্দী) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহযােগিতায় ‘বেঙ্গল প্যাক্ট নামে হিন্দু-মুসলিম চুক্তি সম্পাদনের পক্ষে কাজ করেন” (৭(৫)/৩৪০)। আলােচনার প্রাসঙ্গিকতায় ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’এর মূল প্রতিপাদ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “স্যার আব্দুর রহিম, মৌলবী আব্দুল করিম, মৌলবী মুজিবুর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রভৃতি মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং মিঃ জে. এম. সেনগুপ্ত, মি. শরৎচন্দ্র
২৪

বসু, মি. জে. এম. দাশগুপ্ত ও ডা. বিধান চন্দ্র রায় প্রভৃতি হিন্দু নেতার সহযােগিতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন…(১৯২৩, এপ্রিল) ঐতিহাসিক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক হিন্দু-মুসলিম চুক্তিনামা রচনা করেন। তিনি স্বরাজ্য পার্টি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিকে দিয়া ঐ প্যাক্ট মনযুর করাইলেন”(৪/৪৯)। প্যাক্টের শর্ত হিসেবে স্বীকার করা হয়েছিল যে, “সরকারি চাকরিতে মুসলমানরা জনসংখ্যানুপাতে চাকরি পাইবে এবং যতদিন ঐ সংখ্যানুপাতে (তৎকালে ৫৪%) না পৌঁছিবে ততদিন নতুন নিয়ােগের শতকরা ৮০টি মুসলমানদেরে দেওয়া হইবে। সরকারি চাকরি ছাড়াও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে, যথা কলিকাতা কর্পোরেশন, সমস্ত মিউনিসিপ্যালিটি এবং ডিস্ট্রিক্ট ও লােকাল বাের্ডসমূহে মুসলমানরা ঐ হারে চাকরি পাইবে”(প্রাগুক্ত)। প্যাক্ট-বিরােধী হিন্দু নেতাদের বক্তব্য ছিল, “দেশবন্ধু বাংলাদেশ মুসলমানের কাছে বেচিয়া দিযাছেন। তারা আশা করছিলেন, প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রকাশ্য অধিবেশনে এটি অনুমােদিত হবে না। কিন্তু দেশবন্ধু সিরাজগঞ্জে মওলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে (১৯২৪) সফলতার সাথেই চুক্তিটি অনুমােদন করাতে পেরেছিলেন। ‘বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞজন এবং কংগ্রেসী রাজনীতিবিদ মৌলানা আবুল কালাম আযাদের একটি পর্যবেক্ষণমূলক মন্তব্য উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য একান্তই গুরুত্বপূর্ণ : “His (Chittaranjan Das) attitude made a great impression on the Muslims of Bengal and outside. I am convinced that if he had not died a premature death, he would have created a new atmosphere in the country. It is a matter for regret that after he died, some of his followers assailed his position and his declaration was repudiated. The result was that the Muslims of Bengal moved away from the Congress and the first seed of partition was sown” (১৩/২৪)। ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ সম্পাদনের পরেই কোলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে (১৯২৪) দেশবন্ধু “নিজে মেয়র নির্বাচিত হইয়াছেন। জনপ্রিয় তরুণ মুসলিম নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ডিপুটি মেয়র করিয়াছেন”(৪/৫০)। এ তথ্যটি ‘বেঙ্গল প্যাক্ট প্রণয়নের ব্যাপারে দেশবন্ধুর সাথে সােহরাওয়ার্দীর সংযােগ-সহযােগিতার বিষয়টি সপ্রমাণ করে। সােহরাওয়ার্দীই ছিলেন “কলিকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মুসলমান ডেপুটি মেয়র” (৭(৫)/৩৪০)। প্রসঙ্গতই উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে “১৯৩৫ সালে ফজলুল হক কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন”(৭(৪)/৩)। দেশবন্ধুর মৃত্যুর (১৯২৫) পরে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বাতিল হয়ে গেলে “সােহরাওয়ার্দী কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৩৬ সালে মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে তিনি কলিকাতার দু’টি আসনে নির্বাচিত হন” (৭(৫)/৩৪০)। পরবর্তী সময়ে, ১৯৪০ সালে সুভাষ বসুর উদ্যোগে-প্রস্তাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুর রহমান সিদ্দিকী। নেতাজী সুভাষ বসু আরাে বিধান করেছিলেন যে, “পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন বছরে মুসলিম মেয়র হইবেন”(৪/১৯৪)। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৩৭ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অল্পকাল পূর্বে ফজলুল হক সাহেব তাঁর সহযােগী…সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিশেষ লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক দল কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন” (৫/১৫৮)। কৃষক-প্রজা পার্টির লক্ষ্য ছিল মুসলিম আসনে সংখ্যাধিক্য অর্জন। বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে মােট আসনসংখ্যা ছিল ২৫০টি, যার মধ্যে ১২২টি ছিল সংরক্ষিত মুসলিম আসন। বর্ণহিন্দুদের আসন ছিল ৬৪, তফশিলী হিন্দু ৩৫, ইউরােপিয়ান ২৫ এবং অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান ৪টি আসন। স্বাভাবিকভাবেই প্রাদেশিক সরকার গঠনের জন্য কমপক্ষে ১২৬টি আসন পাওয়ার দরকার ছিল। ঐ সময় বাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন নাজিমউদ্দিন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের তীব্র ভােটযুদ্ধে পটুয়াখালি আসনে শেরে বাংলার কাছে নাজিমুদ্দিন শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, “ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য…স্যার নাজিমুদ্দিন…‘মােহাম্মদী’র মওলানা আকরম খাঁ এবং ইস্পাহানি-ভ্রাতাগণসহ বাংলার প্রায় সকল মুসলিম জমিদার তালুকদার নওয়াব নাইট খান বাহাদুর এবং কলকাতার অবাঙালি মুসলিম ব্যবসায়ী সমাজ। ওরা (জিন্নাহর উদ্যোগে-পরামর্শে) গঠন করেন ‘ইউনাইটেড মুসলিম প্রগ্রেসিভ পার্টি (কার্যত বেনামী মুসলিম লীগ)। শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঐ দলেই ছিলেন। মুসলিম লীগ কাগজে-কলমে ছিল ।…বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম শ্ৰেণী মুসলিম লীগের নামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহস পায়নি। ওরা সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ সৃষ্টি করে বাজিমাৎ করতে চেয়েছিল, মি. জিন্নাহ আড়াল থেকে ইউনাইটেড মুসলিম প্রগ্রেসিভ পার্টিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছিলেন। এ দলের টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। মুখপত্ররূপে ছিল দৈনিক ‘স্টার অব ইন্ডিয়া এবং সাপ্তাহিক ‘মােহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকা” (৮/১৫৮-১৫৯)। তথাপি ১৯৩৭-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি : “নাজিমুদ্দিন সাহেব পটুয়াখালী থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসলেন। তার রাজনীতি থেকে সরে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। শহীদ সাহেব হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন,
আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে কলকাতা থেকে বাই-ইলেকশনে পাস করিয়ে নেব। যদি হক সাহেব পারেন, তাঁর প্রতিনিধি দিয়ে মােকাবিলা করতে পারেন। হক সাহেবও লােক দাঁড় করিয়েছিলেন নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে। নাজিমুদ্দিন সাহেবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন, শহীদ সাহেবের দয়ায়। সেই নাজিমুদ্দিন সাহেব শহীদ সাহেবকে অপমানই করলেন”(৯/৪২)। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা দরকার, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টি ৫৯টি, কংগ্রেস ৫৪টি, মুসলিম লীগ ৩৯টি আসন লাভ করেছিল, অর্থাৎ কারাে পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না। প্রয়ােজন পড়েছিল ‘কোয়ালিশন’ সরকার গঠনের। কিন্ত কংগ্রেসের সহযােগিতা না পেয়ে শেরে বাংলা বাধ্য হয়েই মুসলিম লীগ, তফশিলী এবং অপরাপর ছােটো ছােটো দলের সহযােগিতায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন (১এপ্রিল, ১৯৩৭) করেছিলেন। সােহরাওয়ার্দী কোলকাতায় বিজিত দু’টি আসনের একটি নাজিমউদ্দিনের অনুকূলে ছেড়ে দেয়াতে উভয়েই সেই কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন।

শেরে বাংলার মন্ত্রিসভায় নাজিমউদ্দিন হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর সােহরাওয়ার্দী বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে নাজিমুদ্দিন চরম অপমান-শত্রুতা করেছেন শেরে বাংলার প্রতিও। “১৯৩৭এ ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলার শাসনক্ষমতায় শরিক হওয়া উচিত ছিল।…তা না করে সেসময় অসাম্প্রদায়িক ফজলুল হককে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। ক্ষমতার প্রতি দুর্বলতা ছিল ফজলুল হকের। কংগ্রেসকে কোনােভাবেই সাথে না পেয়ে বাধ্য হয়ে তিনি মুসলিম লীগের সাথে মিলে কোয়ালিশন গঠন করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। মুসলিম লীগ এই সুযােগই খুঁজছিল। ফজলুল হকের হাত ধরেই তাদের বাংলার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠান।…এর পরের ইতিহাস…১৯৪৭’র বাংলা বিভাগ পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাংলার শাসনক্ষমতা নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়েছিল” (১২/২৬-২৭)। “ফজলুল হক সাহেবের ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’ নামে হলেও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ছিল। তাছাড়া এ দলের পক্ষে একটি চৌদ্দ-দফা কর্মসূচিও প্রচারিত হয়। ঐ কর্মসূচিতে বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বাংলাদেশের জন্য স্বায়তুশাসন প্রভৃতি প্রতিশ্রুতি ছিল।…কৃষক-প্রজা। পার্টির আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পল্লীর সাধারণ মুসলিম সমাজের সমর্থন লাভ করে। নিম্নবেতনের চাকরিজীবী এবং মুসলিম ছাত্র সমাজের সমর্থনও ছিল। ফজলুল হক সাহেবের দলের প্রতি।…হক সাহেব জিতলেন। তাঁর দলও মুসলিম আসনে সংখ্যাধিক্য লাভ করল।…ইউনাইটেড মুসলিম প্রগ্রেসিভ পার্টি রাতারাতি নাম পরিবর্তন করে মুসলিম লীগ হয়ে গেল। ফজলুল হক সাহেব নিজেই (কয়েক মাস পরে) মুসলিম লীগে যােগ দিলেন; হলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি” (৮/১৫৯-১৬০)। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে ফজলুল হক “যােগ দেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লক্ষৌ অধিবেশনে। তিনি পেয়ে যান বাংলার মুসলিম লীগের সভাপতির পদ” (১২/৩০)। উক্ত সম্মেলনে “ফজলুল হকের অনলবর্ষী ও বীরত্বব্যঞ্জক বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়ে লক্ষৌবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে ‘শের-এ-বাংলা বা শেরে বাংলা উপাধিতে ভূষিত করে” (৭(৪)/৩)। “১৯৪০-এ…শেরে বাংলা ফজলুল হকই উত্থাপন করেছিলেন মুসলিম লীগের বিখ্যাত লাহাের প্রস্তাব। এত করেও ফজলুল হক মুসলিম লীগে লীন হয়ে যেতে পারলেন না। মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগের সহকর্মীদের সাথে তাঁর বনিবনা হচ্ছিল না। দলের ‘Sole spokesman জিন্নাহও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ফজলুল হককে। মতভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন ১৯৪১-এ (১২/৩০)। মুসলিম লীগ সমর্থন প্রত্যাহার করায় তাঁর মন্ত্রিসভারও পতন হয় । মন্ত্রিসভার পতনের পর “ক্ষমতার প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে…ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদ (হিন্দু মহাসভার নেতা) এবং কংগ্রেসের একাংশকে নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বাংলার প্রধানমন্ত্রী রূপে দ্বিতীয়বার শপথ নেন ১২ ডিসেম্বর, ১৯৪১-এ। মন্ত্রিসভায় যােগ দেওয়ার কথা ছিল শরৎচন্দ্র বসুর, কিন্তু বাংলার ছােটলাট (গভর্নর) স্যার জন হারবার্ট (মন্ত্রিসভার) শপথ গ্রহণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভারত-রক্ষা আইনে শরৎ বসুকে গ্রেফতার করেন,…ব্রিটিশরাজ…চাননি শরৎ বসুর সাথে ফজলুল হকের কোনাে রাজনৈতিক মিলন ।…শরৎ বসুর অনুপস্থিতিতে মন্ত্রিসভায় (অর্থ দপ্তরসহ) দ্বিতীয় স্থান পান শ্যামাপ্রসাদ।…শ্যামাপ্রসাদকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ার ব্যাপারে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির সহকর্মীদের আপত্তি ছিল” (১২/৩০-৩১)। এ আপত্তি একান্ত সঙ্গত ছিল বলেই মানতে হয়। “শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাকে শান্তিতে থাকতে দেননি গভর্নর হারবার্ট। মুসলিম লীগের সাথে ষড়যন্ত্র করেই…২৮মার্চ ১৯৪৩-এ তিনি বাধ্য করেন ফজলুল হককে পদত্যাগ করতে।… শেরে বাংলা এর পরে আর কখনাে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে তার যােগ্য অবস্থান নিতে পারেননি। বলা যায় তাকে চলে যেতে হয়েছিল রাজনীতির অন্তরালে ।… ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৩ খাজা নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় স্থানে থাকেন সােহরাওয়ার্দী, তাঁকে দেওয়া হয় বেসামরিক সরবরাহ (খাদ্য) দপ্তরের ভার। ১৯৪৫’র ২৮ মার্চ এক অনাস্থা ভােটে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে ।…১৯৪৬’র ফেব্রুয়ারিতে… অনুষ্ঠিত…নির্বাচনে মুসলিম লীগ…নির্ধারিত মুসলিম আসনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়।
হিন্দু আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস।…কৃষক-প্রজা পার্টি পায় ৫টি আসন, …ফজলুল হকেরই ছিল ২টি আসন। ১৯৪৬’র নির্বাচন মুসলিম লীগকে বাংলার মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার সময় ও একক ক্ষমতা প্রদান করে।…২৪ এপ্রিল মুসলিম লীগের নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে” (১২/৩২-৩৩)। মন্ত্রিসভায় বগুড়ার মােহাম্মদ আলী যােগ দেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে। আবু জাফর শামসুদ্দিনের মন্তব্য, বাংলা ছাড়া ভারতের অন্য সবকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম লীগের অবস্থা ছিল শােচনীয়। মুসলিম লীগের এই দুরবস্থার সময়ে মি. জিন্নাহর পাশে এসে দাঁড়ান কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা এ. কে. ফজলুল হক ।…স্বপ্রতিষ্ঠিত কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফজলুল হক সাহেব মুসলিম লীগে যােগ দেন । হন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট; নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য।…বাংলার দুর্ভাগ্যের সূচনা সেদিন থেকে।…তিনি মি. জিন্নাহর মাকড়সা রাজনীতির জালে নিজেকে জড়িয়ে না ফেললে তখন দ্বিতীয় এমন কোনাে বাঙালি মুসলমান নেতা ছিলেন না যিনি মুসলিম লীগকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন।…মি. জিন্নাহ…ইসলাম ধর্মকে তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সিদ্ধির হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছিলেন ।…অসংখ্য মুসলিম নেতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিদে স্বাধীনতা সগ্রামে যােগ দিয়ে জেল খেটেছেন। মি. জিন্নাহ এবং মিঃ এ. কে, ফজলুল দু’জনই কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দুই করেছেন। কিন্তু …জেলে যাওয়ার মত হঠকারিতার রাজনীতি করেননি।…ফজলুল হক সাহেবের গণ-সংযােগ এবং গণ-বক্তৃতার ক্ষমতাকে (Mass demagogy) কাজে লাগিয়ে দেয়াটা,…জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় সাফল্য। ফজলুল হক সাহেবকে দিয়ে ১৯৪০ সালে লাহােরে তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করানাে হয়। চারিদিকে বাহবা ধ্বনি উঠল ।…প্রশংসা ও স্তুতির মধ্যগগনে তিনি ভারসাম্য হারান।…সাম্প্রদায়িকতা তুঙ্গে তােলার জন্যে যা কিছু করা আবশ্যক ছিল, মুসলিম লীগ ফজলুল হক সাহেবকে দিয়ে সে কাজগুলাে করিয়ে নেয়। এরপর প্রয়ােজন হলাে ফজলুল হক সাহেবকে বর্জন করার ।…ফজলুল হককে মুসলিম লীগ হতে বহিষ্কার (১৯৪২) করা হলাে” (৮/১৮৫-১৮৭)। তখনকার সময়ে পল্লী-বাংলার রাজনীতিতে শেরে বাংলার অনন্য গুরুত্ব এবং সাধারণ মানুষের মনে তার অবস্থান-সম্মানের দিকটি চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লেখায়। “একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা…বললেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা’ও আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলিও । শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালােবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন…একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলােচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লােক…দাড়িয়ে বললেন, যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাইনা। জিন্নাহ কে? তার নামও শুনি নাই । আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব ।…শুধু এটুকুই না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালাে পতাকা দেখাতে গিয়েছি জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি”(৯/২২)। আলােচনার প্রাসঙ্গিকতায় এখানে কিছুটা দীর্ঘ উদ্ধৃতি উপস্থাপন করছি কামরুদ্দীন আহমদের বাংলার মধ্যবিত্তের বিকাশ’ বইটির ১ম খণ্ড থেকে, যাতে শেরে বাংলা, সােহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবকেও রাজনৈতিক আদর্শ-বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অবস্থানের নিরিখে উপলব্ধি করা যেতে পারে । “ফজলুল হক কোন সংগঠনকেই সহ্য করতে পারতেন না – কৃষক-প্রজা পার্টিকে ১৯৩৮সনে কবর দিতে যেমন ইতস্তত করেননি তেমনি করেননি মুসলিম লীগকে দূরে ফেলে দিতে -১৯৪২ সালে (মতান্তরে ১৯৪১)। বাংলার রাজনীতিতে ইতিমধ্যে যে পরিবর্তন এসেছিল সেটি তিনি বুঝতে পারেননি। …তিনি নিজেকে ‘ইনস্টিটিউশন’ বলে মনে করতেন। এ দুর্বলতাই তাঁর পতনের মূল কারণ হয়েছিল।…এ ব্যাপারে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পথ ছিল ভিন্ন। রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেই তিনি বুঝলেন যে কলকাতার উপর সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য তা যথেষ্ট নয়। পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারলে তাকে সারা জীবন মন্ত্রিসভার একজন সাধারণ সদস্য হয়েই থাকতে হবে।…অসুবিধা তার ছিল অনেক। প্রথমত পূর্ব বাংলায় তাঁর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না, দ্বিতীয়ত, তাঁর বাংলা ভাষা জানা ছিল না। …প্রথমে দৃষ্টি পড়ল ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার (অতি দূর সম্পর্কের) বন্ধন ঝালাই করা। …ঐ আত্মীয়তার সূত্রেই প্রথম সােহরাওয়ার্দী সাহেব পূর্ব বাংলায় ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রী হিসেবে ঘুরতেন। বাংলায় বক্তৃতা অভ্যাস করার জন্য ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখে তাই সভায় বলতেন বা পড়তেন। বছর দুয়েক তিনি ঐভাবে…ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং ইংরেজি জানা লােকদের সঙ্গে যােগাযােগ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন”। “এ পথে যখন খুব বেশি দূর এগােনাে গেল না, তখন শহীদ সাহেব খুঁজে বেড়াতে লাগলেন কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে এমন একজন যুবক যাকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন নিজের বলে এবং যার মধ্যে রাজনীতির নেশা আছে, যে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে তাঁর সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপােষকতা পেলে ।…১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত অনেককে তিনি পরীক্ষা করেছেন কিন্তু তিনি যেমনটি চেয়েছিলে তেমনটি পাননি…।…১৯৪৩ সালে আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীতে ভাগ হ’ল । …শহীদ সাহেব বুর্জোয়া কিন্তু তিনি শিল্পপতিও নন জমিদারীর মালিকও নন। …কলকাতার সাধারণ মানুষের সঙ্গেই ছিল তাঁর উঠা-বসা…১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর …অনেক লােক সংসদে প্রবেশ করলেন যারা তাঁদের জেলার অভিজাতদের প্রতি ঘৃণা পােষণ করতেন। তাঁরা শহীদ সাহেবকে জননেতা হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ ছিলেন না। এমনি পরিস্থিতিতে শহীদ সাহেবকে প্রতিক্রিয়াশীল দলের মধ্যে ধরা হ’ল না। ফলে আবুল হাশিমের আন্দোলনের পূর্ণ সুযােগ সংসদীয় রাজনীতিতে শহীদ সাহেবই গ্রহণ করেছিলেন। “যখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল সভা ডাকা (১৯৪৪) হ’ল তখন সােহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন ও মওলানা আক্রাম খান একত্রে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, আবুল হাশিম সাম্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত সুতরাং মুসলিম লীগের সম্পাদক পদে তাঁকে রাখা যায় না।…আবুল হাশিমের অনুরাগীদের মধ্যে একটা ভয়ানক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল। নির্বাচনের পূর্বের দিন…সন্ধ্যার দিকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সম্মুখে ফজলুল কাদেরের (চৌধুরী) নেতৃেত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন আরম্ভ হ’ল – বক্তৃতা করল প্রথম নুরুদ্দীন তারপর (শেখ) মুজিবুর রহমান। …মুজিবের বক্তৃতা জোরালাে হয়েছিল এবং যুক্তিপূর্ণও, ফলে সােহরাওয়ার্দী সাহেব কাউন্সিলের ওপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিতে রাজি হলেন।…সে মুহূর্তেই শহীদ সাহেব বেছে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে ।…এতদিনে যেন শহীদ সাহেব সন্ধান পেলেন তিনি যাকে খুঁজছিলেন তাকে” (১৪(১)১১৩-১১৬)।

২২-২৪ মার্চ, ১৯৪০ সালে লাহােরের মিন্টো পার্কে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের পক্ষে যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, সেটিই ‘লাহাের প্রস্তাব’ হিসেবে উল্লিখিত হয় এবং তাকে পরের দিন থেকেই সংবাদপত্রে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত করে তােলা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, প্রস্তাবটিতে ‘পাকিস্তান’ শব্দটিও ছিল না, ছিল না একক রাষ্ট্রের কথাও। প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো : “No constitutional plan would be workable or acceptable to the Muslims unless geographical contiguous units are demarkated into regions which should be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary. That the areas in which the Muslims are numerically in majority as in the North-Western and Eastern zones of India should be grouped to constitute independent states in which the constituent units shall be autonomous and soverign”
শেরে বাংলার ‘লাহাের প্রস্তাব’ (১৯৪০ খ্রি.) ভারতীয় ইতিহাসে বহুল আলােচিত। তবে কমই আলােচিত হয় যে, কূট-কৌশলী জিন্নাহ সেই লাহাের প্রস্তাবটি অবিকৃত রাখেননি। দিল্লিতে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ‘কনভেনশন’এ ‘লাহাের প্রস্তাব’এর মূল লক্ষ্য-ভিত্তিটাকেই বদলে ফেলা হয়েছিল। দিল্লি কনভেনশন’এর অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা করলেন, …মনে হচ্ছিল সকলের মনেই একই কথা, পাকিস্তান কায়েম করতে হবে ।…সাবজেক্ট কমিটির …প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহাের প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছােট কিন্তু মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে ‘স্টেটস্’ লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট লেখা হয়, তার প্রতিবাদ করলেন, তবু তা পাস হয়ে গেল । ১৯৪০ সালে লাহােরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে, সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশন পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটি পরিবর্তন করার অধিকার আছে কি না, এটা চিন্তাবিদরা ভেবে দেখবেন। কাউন্সিলই মুসলিম লীগের সুপ্রিম ক্ষমতার মালিক” (৯/৫২)। জিন্নাহর ইচ্ছায় বাংলার এবং তখন সারা ভারতে একমাত্র মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর উত্থাপিত ‘কনভেনশন প্রস্তাব’এর মূল কথা ছিল : “The Muslims are convinced that with a view to saving Muslim India from the domination of the Hindus and in order to afford them full scope to develop themselves….it is necessary to constitute a soverign, independent state comprising Bengal and Assam in the North-East zone and in Punjab, NW Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North-West Zone.” সােহরাওয়ার্দীর কনভেনশন প্রস্তাব’এ পাকিস্তান নামক একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যটি আরাে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছিল, “The Zones comprising Bengal and Assam in the North-East and in Punjab, NW Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North-West of India, namely Pakistan Zones, where the Muslims are in a dominant majority, be constituted into one soverign independent state and an unequivocal undertaking be given to implement the establishment of Pakistan…”(৯/৫৩-৫৪)। মুসলিম লীগের ১৯৪০ খ্রি. লাহাের প্রস্তাব’এর কথা বলা হােক কিংবা ১৯৪৬ খ্রি. ‘দিল্লি কনভেনশন’এর প্রস্তাব, দু’টিই জিন্নাহর অভিপ্রায়ে-নির্দেশে উপস্থাপিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে জিন্নাহ তাঁর কুশলী চালে, হক-সােহরাওয়ার্দীকে পরস্পর বিপরীত অবস্থানে ঠেলে দিয়ে দুর্বল করে দিতে পেরেছিলেন। লাহাের প্রস্তাব উপস্থাপনের পরে জিন্নাহ-নাজিমুদ্দিন অক্ষের অভিপ্রায় অনুসারে শেরে বাংলাকে মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। এবার ‘দিল্লি কনভেনশন’এর প্রস্তাব উপস্থাপনের পরে এল সােহরাওয়ার্দীর পালা। ইতিহাস সাক্ষী, বিলম্ব হয়নি এক্ষেত্রেও। “প্রতিভা, জ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি, বাগ্মিতা ও জনপ্রিয়তায় ফজলুল হকের কাছে জিন্নাহ কিছুই ছিলেন না”, আবদুল গাফফার চৌধুরীর এমন বক্তব্যকে যদি নিতান্তই বাঙালি-প্রীতির লক্ষণ বলা হয়, পরবর্তী তথ্যটিকে কী বলা হবে? “ঐতিহাসিক লাহাের সম্মেলনে জিন্নাহ যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন ফজলুল হক এসে সভামণ্ডপে পৌঁছেন।…হাজার জনতা উঠে দাঁড়িয়ে জিন্নাহর বক্তৃতা উপেক্ষা করে ‘শেরে বাংলা জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে শুরু করে। শেরে বাংলার উপস্থিতিতে আর বক্তৃতা দেওয়া সম্ভব নয় দেখে জিন্নাহ বলে ওঠেন ‘শের যখন এসে গেছেন তখন আমার পথ ছেড়ে দেওয়াই ভালাে। বলে বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখে তিনি বসে পড়েন। সম্ভবত তখনই জিন্নাহ এবং অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলিম লীগ নেতারা বুঝেছিলেন যে, সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বাঙালি ফজলুল হক তাদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ”(১১/১৫৮)। এই ফজলুল হকই রাজনীতির ঘুরপাকে জড়িয়ে পরবর্তী সময়ে জিন্নাহর কাছে চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় মুসলিম লীগের সদস্য হয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে আবারও দলটি ছাড়তে হয়েছিল, সে-কথা যথাস্থানে আলােচনায় আসবে। ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতনের (১৯৪৩) জন্য মুসলিম লীগ তথা জিন্নাহর বিরােধিতা এবং কূট-কৌশল অবশ্যই বহুলাংশে দায়ী ছিল। “এ হচ্ছে ঘটনার একদিক। অপরদিকে ব্রিটিশ সরকারও যুদ্ধকালে (২য় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) ফজলুল হককে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছিল না। জাপানিদের ভয়ে বাংলাদেশে ‘পােড়ামাটি নীতি’ (ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পিত) অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না ফজলুল হক। এই পােড়ামাটি নীতিই ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য প্রধানত দায়ী। ব্রিটিশ সরকার ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে বিতাড়িত করতে চাইছিল” (৮/১৮৭)। এমন সব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিরােধিতার কারণে “ফজলুল হক সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অবসান হলাে বটে কিন্তু অন্য দিক থেকে তাঁর জন্য এটা শাপে বর হলাে। তেতাল্লিশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং সে সময়ের ব্যাপক দুর্নীতির দায়-দায়িত্ব থেকে ফজলুল হক সাহেব নিস্কৃতি পেলেন” (৮/১৯৬)। ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলার সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য জমিদারি
উচ্ছেদ, মহাজনী আইন, ঋণ-সালিশী বাের্ড, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি সুদূরপ্রসারী আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ-প্রবর্তন করার জন্যই বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। যুক্তবাংলার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও তিনি বিপুল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এসময় কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে পরবর্তীকালে কলিকাতা লেডি ব্রাবাের্ন কলেজ, ঢাকার…বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (বর্তমান শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), চাখার কলেজ, ইডেন গার্লস কলেজ ছাত্রীনিবাস (এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লা মুসলিম হল) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া তিনি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলিম এডুকেশন্যাল ফান্ডও গঠন করেন” (১৩(৪)/২-৩)। শেরে বাংলা যতবার মন্ত্রী হয়েছেন, ততবারই শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাতে রেখে শিক্ষা বিস্তার এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে যথাসম্ভব কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ১৯৩৭-১৯৪৭ পর্যন্ত দশ বছর বাংলার তিনজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং শহীদ সােহরাওয়ার্দী। ২৯ মার্চ, ১৯৪৩-এ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতনের পরে বাংলায় খাজা নাজিমুদ্দিনেরর মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন বেসামরিক সরবরাহ তথা খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী। “১৯৪৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ধ্বংসকারী দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল ।…এই দুর্ভিক্ষের দায়িত্ব ও অপরাধ গিয়ে বর্তে নাযিম মন্ত্রিসভার ঘাড়ে।…এই দুর্ভিক্ষে অনুমান পঞ্চাশ লক্ষ লােক মারা গিয়াছে”। তদানীন্তন ‘প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “ঐ আকালের জন্য… উভয় মন্ত্রিসভাই (হক-মন্ত্রিসভা এবং পরবর্তী নাজিমুদ্দিন-মন্ত্রিসভা) অংশত দায়ী ছিলেন। আসলে আকালের কারণ ঘটাইয়াছিলেন ভারত-সরকার।…পঞ্চাশ সালের ঐ নজিরবিহীন আকালে মুসলিম বাংলা…কিছু-কিছু মানব-সেবীর সন্ধান পাইয়াছিল। এঁদের মধ্যে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নাম সকলের আগে নিতে হয়। অত অভাবের মধ্যেও ধৈর্য ও সাহসে বুক বাধিয়া গ্রুয়েল কিচেন ও লঙ্গরখানা খুলিয়া…আর্ত ও ক্ষুধার্তের সেবা করিয়াছিলেন,…আহার-নিদ্রা ভুলিয়া দিনরাত চড়কির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেন(৪/২৩৪-২৩৭)। অথচ সেই দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদই তাঁর “ফুড কনফারেন্স’ পুস্তকে স্যার নাজিমুদ্দিনকে ‘মহিষে বাংলা’; শহীদ সাহেবকে ‘কুত্তায়ে বাংলা’ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন।…অন্যদিকে মুসলিম লীগ কাগজ ‘আজাদ’ও শহীদ সাহেবের পক্ষে ওকালতি করার জন্য ব্যস্ততা দেখায়নি ঘরােয়া দলাদলির কারণে। …মুসলিম লীগের অনেকেই মানুষের দুর্দশার জন্য শহীদ সাহেবকেই দায়ী (escape goat) করতে সচেষ্ট ছিলেন। পরিষদ সদস্য আবুল হাশিম সাহেবও বেসরকারি সরবরাহ মন্ত্রীর বেশ কড়া সমালােচনা করেন”(১৪(২)/২০-২১)। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে ।… এমন দিন নাই রাস্তায় লােক মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। আমরা কয়েকজন ছাত্র শহীদ সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম, কিছুতেই জনসাধারণকে বাঁচাতে পারবেন না, মিছামিছি বদনাম নেবেন। তিনি বললেন, দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কিনা, কিছু লােক তাে বাঁচাতে চেষ্টা করব’। তিনি রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুললেন। কন্ট্রোল’ (রেশন ব্যবস্থা) দোকান খােলার ব্যবস্থা করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খােলার হুকুম দিলেন।…কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন…চাল, আটা ও গম বজরায় করে আনতে শুরু করলেন”(৯/১৭-১৮)। “শহীদ সাহেবের প্রথম কাজ হ’ল কলকাতা শহরে রেশনের ব্যবস্থা করা। এ সম্বন্ধে কারাে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরােধ করে দু’জন দক্ষ লােক নিয়ে কলকাতার জন্য রেশনের একটি পরিকল্পনা তৈরি হ’ল তারপর ঢাকা, চিটাগাং-এর পরিকল্পনা। রেশন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বিপদ সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা। যেখানে সব জিনিসের অভাব সেখানে এ সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা খুবই শক্ত। ঐ সময় আমি দেখেছি শহীদ সাহেবকে দিনে আঠার ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে। তাঁর যেন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য … মানুষকে বাঁচাতে হবে” (১৪(২)/২০)।

উপরোল্লিখিত কয়েকটি সূত্রে সােহরাওয়ার্দীর সপ্রশংস উল্লেখ করা হলেও আরাে বিভিন্ন সূত্রেই তার বিরূপ সমালােচনাও করা হয়েছে। নােবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রমাণ করেছেন যে, “১৯৪৩ খ্রি. দুর্ভিক্ষ খাদ্যঘাটতির জন্য হয়নি।
পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার এবং একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মানুষের মুখ (থেকে খাদ্য ছিনিয়ে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিল অবশ্যই ব্রিটিশরাজ এবং সেই সাথে …. শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতি এবং ইতিহাসের গবেষকরাও দায়ী করেন নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভাকে… বিশেষ উল্লেখ করেন বেসামরিক সরবরাহ (খাদ্য) দপ্তরের মন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী এবং বাংলার মুসলিম লীগের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইস্পাহানির নাম”(১২/৩৩-৩৪)। জহুর হােসেন চৌধুরীর মন্তব্য : “একটি লােককেও অনাহারে মরতে দেব না, প্রয়ােজন হলে প্রত্যেকটি বাড়ির তক্তপােশের নিচে সার্চ করে মজুদকৃত চাউল বার করব’ – সে সময় খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর এ ঘােষণা…নির্মম পরিহাস হিসেবে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। বস্তুত মজুদদার ও কালােবাজারীদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। একটি উল্লেখযােগ্য মামলা দায়ের করা হয়নি…। চালের কালােবাজারী ও মজুদদারির ব্যাপারে সে যুগে দুই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যুক্তভাবে সর্বাপেক্ষা কুখ্যাতি অর্জন করে তাদের একটি ছিল মাড়ােয়ারী আর একটি পশ্চিমা মুসলমান। এই মুসলমান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিখিল বঙ্গ…ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কর্ণধারদের অন্যতম ছিলেন”(১৫/১২)। একই সূত্রে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলগুলি মুসলিম প্রধান ছিল, যে লক্ষ লক্ষ কৃষক মারা গিয়েছিল, তাদের “শতকরা সত্তরজনই মুসলমান”। ২৪ এপ্রিল ১৯৪৬ থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তানের জন্ম বা দেশভাগের আগে পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাসীন ছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। এসময়ের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য এবং কলঙ্কজনক ঘটনা ছিল ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ মুসলিম লীগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’। এ ঘটনাটির জন্যও সােহরাওয়ার্দী সম্যকরূপেই নন্দিত এবং নিন্দিত হয়েছিলেন। বােম্বাইতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কার্যকরী অধিবেশনেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল যে, পরবর্তী ১৬ আগস্ট ভারতজুড়ে মুসলমানদের ‘Direct Action Day. ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করা হবে। মৌলানা আজাদের বর্ণনায় সেই দিনটির বাস্তবতা ঃ “16 August was a black day in the history of India. Mob violence unprecendented in the history of India plunged the great city of Calcutta into an orgy of bloodshed, murder and terror. Hundredas of lives were lost. Thousands were injured….. Processions were brought by the League which began to loot and commit acts of arson. Soon the whole city was in the grip of goondas of both the communities” (১৩/১৬৯)। জিন্নাহ বুঝতে পারছিলেন, ব্রিটিশদের চলে যাবার সময় এসেছে, তারা ভারতের শাসন-ক্ষমতা হস্তান্তর করতেও আগ্রহী। অথচ ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পাকিস্তান। সৃষ্টি করে দিচ্ছে না। এমন হতাশার চাপ কাটানােই ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’এর প্রধান লক্ষ্য। তাহলে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’এর সংগ্রাম’ তাে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আদৌ তা হয়নি। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ অথবা অঘােষিত ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ – যা-ই বলা হােক না কেন, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে, এ কথাটা কিন্তু ভারত সরকার বা বড়লাট ওয়াভেলের অজানা ছিল না। কিন্তু সংঘাত আটকানাের জন্য সরকার কার্যকর কিছু করেনি বরং করেছিল উল্টোটাই, দাঙ্গদমনে পুলিশ-মিলিটারিকে সরকারি নির্দেশেই কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। ১৬ই আগস্ট জিন্নাহর ঘােষিত প্রত্যক্ষ ‘সংগ্রাম দিবস’সহ তিনচারদিনব্যাপী কোলকাতায় সংগঠিত একান্ত অযৌক্তিক এবং চরম অমানবিক বর্ণনা এড়িয়ে যাওয়াই ভালাে। কারণ, মানুষ হিসেবে মানুষের, হিন্দু-মুসলমান যেপরিচয়েই হােক না কেন, পাশবিক বর্বরতা মানবিক চিত্তকে আহত এবং কলুষিত করে। এ কথাও অজানা নয় যে, এমন ঘটনায় বিধ্বস্ত-বিপন্ন হয় সাধারণ মানুষ,
আর অসাধারণ-মানুষ’, যারা কলকাঠি নাড়েন, তারা ভালই থাকেন, ফায়দাও হয় তাদেরই। তবে ইতিহাসের মােড়-ফেরানাে ঘটনাটির পেছনের রাজনীতির কথা কিছুটা হলেও আলােচনা করা প্রয়ােজন।

সেদিন মুসলিম লীগ রাজনীতির দাবার বোড়ে হয়েছিল বাংলা, বাংলার ভােট এবং রক্তের মূল্যেই কেনা হয়েছিল পাকিস্তান। বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং তখন কোলকাতায় কর্মরত সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের প্রণিধানযােগ্য মন্তব্যে : “১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলিকাতায় কেয়ামত নামিয়া আসিল।… প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমার নিজের বিবেচনায় এর প্রাথমিক দায়িত্ব মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ।…কায়েদে-আযম ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-দিবস ঘােষণা করিয়া দিলেন । কিন্তু কোনও কার্যক্রম ঘােষণা করিলেন না। তবে এ কথা তিনি বলিয়াছিলেন : আজ হইতে মুসলিম লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ত্যাগ করিল। আমরা ধরিয়া নিলাম সভা-সমিতিতে হুমকি দিয়া উত্তেজনাপূর্ণ প্রস্তাবাদি পাস হইবে। আমার অনেক হিন্দু বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়া বুঝিলাম হিন্দুরাও তাই ধরিয়া নিয়াছিল।…প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের নির্দেশে বাংলা সরকার ১৬ই আগস্ট সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করিলেন ।…মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা হইলেই লীগের পার্টি-প্রােগ্রামকে সরকারি ছুটির দিন গণ্য করা হইবে, এটা কোনও যুক্তির কথা নয়। কংগ্রেস মন্ত্রিসভারা তা করেনও নাই” (৪/২৫১-২৫৩)। জিন্নাহর প্রত্যক্ষ অগ্রামের ডাকের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার মুসলিম লীগ নেতা, প্রাক্তন ধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন “কলিকাতা মুসলিম ইনিস্টিটিউটের এক সভায় ঘােষণা করিলেন : ‘আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরাজের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুর বিরুদ্ধে। হিন্দুরা সন্ত্রস্ত এবং শেষ পর্যন্ত এগ্রেসিভ হইয়া উঠিল” (৪/২৫১)। শুধু খাজা নাজিমুদ্দিনই নন, আরাে কিছু প্রােপাগান্ডার তথ্য মেলে। জিন্নাহ বলেছিলেন, “আমি নীতি-নৈতিকতার কথা বলতে রাজি নই। এখন আমরা পিস্তল পেয়ে গিয়েছি এবং তাকে ব্যবহার করার অবস্থায় রয়েছি”(৮/৩৬)। লীগপন্থী মর্নিং নিউজ’ লিখেছিল, “কোন নাগরিক অথবা সেনার দ্বারা কোন ব্রিটিশ পুরুষ বা নারীকে উৎপীড়ন করা কেবল বােম্বাইতে গৃহীত প্রস্তাবের বিরােধিতা করা নয়, উপরন্তু তা হল ইসলাম গর্মের তত্ত্ব ও বক্তব্যের পরিপন্থী।…হিন্দুদের মত ব্রিটিশরাও ছিল মুসলমানদের কাছে বিধর্মী। কিন্তু স্পষ্টতই বলা হয়েছিল যে ব্রিটিশদের উৎপীড়ন করা ইসলাম ধর্মবিরােধী।…এর পরিণামে যা হওয়ার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনে তাই হয়েছিল” (১৬/৮৬)। উল্লেখ্য যে, তখন স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর হাতেই। ৫ আগস্ট স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে সােহরাওয়ার্দী লিখেছিলেন : “আজ মুসলমানদের কাছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনাে উদ্দেশ্যই প্রিয় অথবা মহান নয়”। আর ১৬ আগস্ট কোলকাতা ময়দানের জনসভায় সােহরাওয়ার্দী বলেছিলেন “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে” (১২/৪১)। মৌলানা আজাদ লিখেছেন, কোলকাতা থেকে দিল্লি যাবার জন্য অনেক কষ্টে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছানাে সম্ভব হয়েছিল। বিমানবন্দরের কাছে বিরাট একদল মিলিটারিকে অবস্থানরত দেখে আজাদ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “Why they were not helping in resorting order, they replied that their orders were to stand ready but not to take action. Throughout Calcutta, the military and the police were standing by but remained inactive while innocent men and women were being killed চ (১৩/১৬৯)। কোলকাতা শহরে চারদিনব্যাপী মারাত্মক সাম্প্রদায়িক সংঘাতে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না, তবে বড়লাট ওয়াভেল বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের দাঙ্গায় কোলকাতায় যত মানুষ মারা পড়েছিল, পলাশীর যুদ্ধেও তত মানুষ মারা যায়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, “১৯৪৬-এ কলকাতায় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২৬ শতাংশ, হিন্দু জনসংখ্যা ৬৬ শতাংশ। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রথম দিন পার হতেই হিন্দুরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন শিখরা” (১২/৪৭)। “কলিকাতায় স্বভাবতই হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের জান-মালের ক্ষতি হইয়াছিল অনেক বেশি। এই খবর অতিরঞ্জিত আকারে পূর্ব বাংলায় পৌঁছিলে নােয়াখালি জেলায় হিন্দুরা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় বিহারের হিন্দুরা তথাকার মুসলমানদিগকে অধিকতর নৃশংসতার সাথে পাইকারিভাবে হত্যা করে।…দেশভাগের…আগে পর্যন্ত বাংলা-বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই নৃশংস অমানুষিকতার সর্বাপেক্ষা লজ্জাকর নিদর্শন। অনেক অতি-সাম্প্রদায়িক মুসলমান আজও সগর্বে বলিয়া থাকে কলিকাতা দাঙ্গাই পাকিস্তান আনিয়াছিল। এ কথা নিতান্ত মিথ্যা নয়। এই দাঙ্গার পরে ইংরাজ-হিন্দু-মুসলিম তিনপক্ষই বুঝিতে পারেন, দেশ বিভাগ ছাড়া উপায়ন্তর নাই” (৪/২৫৪-২৫৫)। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের আহ্বান ছিল সারা ভারতেই, কিন্তু অন্য কোথাও নয়, কোলকাতাতেই অমন নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল কেন? অনেকে বলেন, বাংলায় মুসলিম লীগ শাসন বলবৎ ছিল। অনেকেই আবার ভিন্নমত পােষণ করেন, “পাকিস্তান গঠন সম্পর্কে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর মনােভাব কেমন, তা নিয়ে জিন্নার মনে সংশয় ছিল। সােহরাওয়ার্দী চেষ্টা করেও জিন্নার কাছের মানুষ হয়ে যেতে পারেননি। সেজন্য বাংলার মুসলমানদের ওপর তার প্রভাব কত তা দেখাবার সুযােগ সােহরাওয়ার্দী খুঁজছিলেন। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান তাঁর কাছে সেই সুযােগ এনে দেয়।…সেনাবাহিনীকে দূরে সরিয়ে রেখে এবং পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে তিনি দেখাতে পেরেছিলেন যে তাঁর ডাকে মুসলমানদের একটি অংশ পাকিস্তানের দাবি নিয়ে কী বর্বরােচিত ঘটনা সংঘটিত করতে পারে” (১৬/৮৭)।
অসংখ্য মানুষ মারা পড়েছিল কোলকাতার দাঙ্গায়, এ কথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য, মনুষ্যত্বের সবটুকু মেরে ফেলা সম্ভব হয়নি, কখনাে সম্ভব হয় না। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “সামগ্রিক উন্মত্ততার মধ্যেও দু’একটা সাহসিক মানবিকতার দৃষ্টান্ত মহত্ত্বের উজ্জ্বলতায় ঝলমল করিতেছে। হিন্দুএলাকায় উন্মত্ত জনতা বেষ্টিত মুসলমান পরিবারকে রক্ষার জন্য হিন্দু নারী-পুরুষের বীরত্ব এবং মুসলিম এলাকায় ঐ অবস্থায় পতিত হিন্দু পরিবার রক্ষায় মুসলিম নারীপুরুষের বীরত্ব ইতিহাসে সােনার হরফে লেখা থাকার যােগ্য” (৪/২৫২)। এ বক্তব্য। থেকে আমরা অবশ্যই লক্ষ্য করবাে যে, হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়ের জন্য কেউ মনুষ্যত্ব হারায় না, মনুষ্যত্ব হরাবার কারণটা মানুষের ধর্ম-পরিচয়ে নয়, খুঁজতে হবে অন্যত্র । কোলকাতায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের চরম অমানবিকতার মাঝেও ‘সাহসী মানবিকতা এবং মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেও সামনে চলে আসে সােহরাওয়ারদির নাম। হতে পারে, ইতােমধ্যে যা বলা হয়েছে এবং অতঃপর যা বলা হবে, তার মাঝেই নির্দেশিত হয় তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের দ্বিমুখিতা। ওপরের কথাগুলি যদি সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক চারিত্র্য-লক্ষণ হয়, তাহলে পরের কথাগুলি অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের অনুষঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন : “ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামার পর যখন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং শুরু হলাে তখনও একমাত্র শহীদ সােহরাওয়ার্দীই জীবন বিপন্ন করে মারমুখী হিন্দু মহল্লায় যাচ্ছিলেন। অন্য মুসলিম লীগ নেতাদের নাম তখন শােনা যায়নি”(৮/২৩০)। প্রসঙ্গতই মুজিব লিখেছেনঃ “সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে ধরতে পারছি না। ফোন করলেই খবর পাই লালবাজার আছেন। লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার ।…শহীদ সাহেব রাতদিন পরিশ্রম করেছেন, শান্তি রক্ষা করবার জন্য” (৯/৬৫-৬৬)। অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক মুজিবকে চিনবার জন্যই এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইসলামিয়া কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক, পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতােষ দত্তের আট দশক’ নামক স্মৃতিকথা থেকে বিবরণটি উদ্ধৃত করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : “ছাত্ররা আমাদের অত্যন্ত সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন।…প্রায় সব ছাত্রই অবশ্য লীগ-পন্থী। পাকিস্তান-কামী। মুসলমান শিক্ষকেরাও তাই।…বাংলাভাষীদের (ছাত্র) সংখ্যা ছিল বেশি। এই বাংলাভাষী দলের নেতা ছিল একটি কৃশকায় ছেলে – নাম শেখ মুজিবুর রহমান।…ছাত্ররা যে আমাদের জন্য কতটা করতে পারত তার প্রমাণ পেলাম ১৯৪৬-এর রক্তাক্ত দাঙ্গার সময়। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তায় পদে পদে বিপদ। এই রাস্তা আমাদের ছাত্ররা পার করে দিত।…কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি ইসলামিয়া কলেজের সেইসব মুসলমান ছাত্রদের যারা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে বিপজ্জনক এলাকাটা পার করে দিতেন। এই-সব ছাত্রদের একজনের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান”(১(১)/২৪১) ।
উপরের উদ্ধৃতি থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় একজন হিন্দু শিক্ষকের চোখে মানবিক মুজিবের কথা জানা গেল। এবার সেই মুজিবের চোখে একজন হিন্দুশিক্ষককে দেখা যাক। “ইসলামিয়া কলেজে গরীব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশােনার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি (মুজিব) আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলেই এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে কমই পড়েছে” (৯/৩৭-৩৮)। কোলকাতায় ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’এর অমানবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত হয়ে আসার সময়, “পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সালে শেরে বাংলা জিন্নাহকে এক চিঠি লেখেন তাঁর অতীতের দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে – এবং অদ্ভুত ব্যাপার জিন্নাহও এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করলেন এবং তাকে আবার মুসলিম লীগের সদস্য হবার অধিকার দিলেন।…ফজলুল হক মনে করেছেন, এমনি বিপদের দিনে মুসলমানদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত, হয়ত জিন্নাহও তাই ভেবে এবার আর তার সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেননি। অন্যদিকে কেউ কেউ ভাবলেন এটা খাজা। সাহেবদের চাল। আবুল হাশিমকে শেষ আঘাত হানবার কৌশল মাত্র” (১৪(২)/৭৭)। কয়েক বছর পরে (১৯৫৩) ফজলুল হক আবার মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছিলেন এবং আবারও তাকে মুসলিম লীগ ছেড়ে যেতে হয়েছিল। ১৯৪৭-এ বাংলা-ভাগ (ভারত-ভাগের সাথেই) এবং কোলকাতাসহ পশ্চিম বাংলা ভারতের ভাগে পড়ার বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে যাওয়াতে মুসলিম লীগে সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের রাজনৈতিক অবস্থান বােধগম্য কারণেই নাজুক হয়ে পড়েছিল। তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্পাদক লিয়াকত আলী খান। স্বভাবতই জনপ্রিয় মুসলিম লীগ নেতা এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী, কোলকাতাবাসী সােহরাওয়ার্দীকে আরাে হীনবল করে দিতে চাইলেন। আর তাই, লিয়াকত আলী পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। আবুল মনসুর আহমদ এটাকে মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘নৈতিক মরাল ও এথিক্যাল অপরাধ’ বলে বর্ণনা করেছেন। লিয়াকত আলীর পরিকল্পনা এবং পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগে নবাগত সিলেট জেলা মুসলিম লীগারদের সমর্থনে। “Nazimuddin was elected as the leader of the pariamentary party and became the Chief Minister-designate of East Bengal. Suhrawardy decided to stay on in Calcutta for the time being and joined Gandhi in his peace mission to restore communal harmony there. Abul Hashim also decided to remain in India” (১৭/৩০-৩১)। “নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই…দলবলসহ ঢাকা চলে গেলেন। একবারও চিন্তা করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা ।…নাজিমুদ্দিন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারাের সাথে পরামর্শ না করেই ঘােষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার উপর আর কোনাে দাবি রইল না।…নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়।…কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লােক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয় ।…সােহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হত তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল”(৯/৭৮-৭৯)। তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, আবুল হাশিম, সােহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর নতুন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা জানাজানি হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের কর্ণধারদের মধ্যে এক আশঙ্কা জেগে উঠে। তারা ধরে নেয় যে, বাংলা অবিভক্ত থাকলে আবার আবুল হাশিম ও সােহরাওয়ার্দীর রাজত্ব কায়েম হবে। এদিকে শরৎ বাবুর ‘ইচ্ছা শহীদ সাহেবকে একটু পেছনে রেখে আবুল হাশিম সাহেবকে সম্মুখে রাখা – কারণ, শহীদ সাহেবের প্রতি হিন্দুদের চরম বিরূপ মনােভাব ছিল” (১৪(২)/৮৪)। জিন্নাহ ও অবাঙালি লীগ কোটারির দুশ্চিন্তা ছিল, “সােহরাওয়ার্দী যদি নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের লীগ নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী হন, তাহলে তিনি তার শক্তির ও নেতৃত্বের ভিত্তি খুঁজবেন…বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এবং তাদের তিনি সমর্থন ও শক্তি যােগাবেন। তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামােতেও অবাঙালি পুঁজি ও নেতৃত্ব বাঙালি পুঁজি ও নেতৃত্বের হাতে মার খাবে। সুতরাং তাদের জন্য সবচাইতে নিরাপদ হচ্ছে অবাঙালি ও উর্দুভাষী…নাজিমুদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা মুখ্যমন্ত্রী বানানাে ।…ফলে…দেশভাগের সময় সােহরাওয়ার্দী বাংলাদেশে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ও পার্লামেন্টারি দলের নেতৃত্ব হারালেন ।…পূর্ব বাংলায় কিছুদিনের জন্য গণতান্ত্রিক কণ্ঠ, বিরােধী কণ্ঠ একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়” (১১/১৫৯-১৬০)। জহুর হােসেন চৌধুরীর মন্তব্য : “বাঙালি মুসলমান লীগে যােগদান করলেও এর নেতৃত্বের কোন অংশ তারা পায়নি। উর্দুভাষী হওয়া ও বাংলাদেশে চিফ মিনিস্টার হওয়া সত্ত্বেও জনাব সােহরাওয়ার্দীকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়” (১৫/১৮)। অতঃপর তাঁকে অপসারণ করা হয়েছিল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব এবং পার্লামেন্টারি পার্টির নেতৃত্ব থেকেও।

“পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যার অবদান ছিল সবচাইতে বেশি তিনি শহীদ সােহরাওয়ার্দী । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান ইস্যুতে গণভােট। বঙ্গ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্ণধার শহীদ সােহরাওয়ার্দী নির্বাচনে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন, ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিজয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন, …জিন্নাহর প্রতারণা এখানেই শুরু; তাই পুণরায় মুসলিম লীগের কাউন্সিল ডাকেন (দিল্লিতে) ১৯৪৬ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল এবং সােহরাওয়ার্দীকে দিয়ে…লাহাের প্রস্তাবের ‘States’ শব্দটির পরিবর্তে ‘State’ সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন ও গ্রহণ করে এক পাকিস্তানের পটভূমি সৃষ্টি করেন। ইতিপূর্বে ৩ এপ্রিল (১৯৪৬) শহীদ সােহরাওয়ার্দী বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত (হন) এবং ২৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করেন।…জিন্নাহর ষড়যন্ত্রে ৫/৮/৪৭ তারিখে…সােহরাওয়ার্দীকে ৭৫:৩৯ ভােটে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট শহীদ সােহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গের ক্ষমতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং ইতিপূর্বে ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘােষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন” (সরদার সিরাজুল ইসলাম :‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন’; দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬-০২-‘১৩ খ্রি.)। তৎকালে বাংলার মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিত্বের সংঘাত প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ পার্টির ‘পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচনের বিষয়টিও “পাকিস্তান হবার আগেই ঠিক হয়ে যাবে। শহীদ সাহেব (বাংলার প্রধানমন্ত্রী) আমাদের বললেন যে, তিনি ঐ গুজবে বিশ্বাস করেন না। তবু আমরা হাশিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘লিডার’ নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হয় তবে আমাদের করণীয় কি? তিনি বললেন, “আমাদের কিছু করার নেই ।…আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখব। আমার মনে হয়, আবুল হাশিম সাহেবের ঐ সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও তােফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) মেনে নেননি – আর সেদিন থেকেই তাঁদের সঙ্গে আবুল হাশিম সাহেবের সকল সম্পর্ক… শেষ পর্যন্ত তিক্ততায় পৌঁছেছিল।…শহীদ সাহেব অনেক ভােটের ব্যবধানে ( নাজিমুদ্দিনের কাছে) হেরে গেলেন।…শহীদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন…তিনি হিন্দুস্তানেই থেকে যাবেন। সেজন্য তিনি পশ্চিমবাংলার মুসলিম লীগ দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পরিষদে বিরােধী দলের আসনে বসার ব্যবস্থা করলেন” (১৪(২)/৮৮)। বঙ্গবন্ধুর কথা :“আমাদের পক্ষে কলকাতা থাকা সম্ভবপর না, কারণ অনেককে গ্রেফতার করেছে।…শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তাঁকে রেখে চলে আসতে আমার মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার মন বলছিল, কতদিন মহাত্মাজী শহীদ সাহেবকে রক্ষা করতে পারবেন? কয়েকবার তার উপর আক্রমণ হয়েছে।…শহীদ সাহেবকে বললাম, চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন?’ বললেন ‘যেতে তাে হবেই, তবে এখানে এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে?…সমস্ত নেতা চলে গেছে, আমি চলে গেলে এদের আর উপায় নাই। তােমরা একটা কাজ কর, দেশে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক গােলমাল যাতে না হয়, তার চেষ্টা কর।…চেষ্টা কর, যাতে হিন্দুরা চলে না আসে। ওরা এদিকে এলেই গােলমাল করবে, তাতে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে পূর্ব বাংলায় ছুটবে। যদি পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের মুসলমান একবার পূর্ব বাংলার দিকে রওনা হয়, তবে পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা রক্ষা করা কষ্টকর হবে।…পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (পূর্ব বাংলায়) হতে দিও না”(৯/৮২)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হক-ভাসানী-মুজিব ফিরে এলেন তাঁদের জন্মভূমি পূর্ববঙ্গে, সােহরাওয়ার্দী কিছুকালের জন্য পশ্চিমবঙ্গে রয়ে গেলেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সােহরাওয়ার্দীকে অপসারণের পর, তাঁকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের অনুরােধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী এবং গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ স্বয়ং লিয়াকত আলীকে সােহরাওয়ার্দী জানিয়েছিলেন, “ভারতীয় মুসলমানদের একটা হিল্লা না করিয়া তিনি ভারত ছাড়িতে পারেন না”(৪/২৬৮)। কামরুদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেছেন : ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ স্বল্পকালীন ঢাকা সফর শেষে “শহীদ সাহেব কলকাতা ফিরে যাবার কিছুদিন পরেই জিন্নাহ সাহেব তাঁকে পাকিস্তানের পুনর্বাসন ময়ী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যােগদিতে অনুরােধ করেন। শহীদ সাহেব জিন্নাহ সাহেবকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি যে কাজের ভার নিয়েছেন (কোলকাতার মুসলমানদের শান্তি ও পুনর্বাসন) তা ছেড়ে তখন তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে পারেন না।” (১৮/১১১)। সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়ে নিজের সুস্পষ্ট অভিমত সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন সােহরাওয়ার্দী। বিষয় দু’টি ছিল : “এক, পাকিস্তান হাসিল হওয়ার পর পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নাম আর মুসলিম লীগ থাকা উচিত নয়। দুই, পাকিস্তানের হিন্দুদের রাজনৈতিক আনুগত্য বিচারে উদার বাস্তব দৃষ্টি অবলম্বন করা উচিত।…গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উভয় রাষ্ট্রেই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকার করিতে গেলেই জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক হইতেই হইবে। ভারতের যেমন ন্যাশনাল কংগ্রেস আছে, পাকিস্তানেরও তেমনি ন্যাশন্যাল লীগ করিতে হইবে। কথাটা যুক্তিসঙ্গত এবং কায়েদে-আযমের মতও তাই; এই ধারণায় আরাে অনেক মুসলিম নেতা শহীদ সাহেবের এই মত সমর্থন করেন”(৪/২৭৩)। কিন্তু এসব কারণেই তিনি পাকিস্তান সরকার তথা মুসলিম লীগের কায়েমি স্বার্থবাদী নেতৃবৃন্দের চরম বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
অতঃপর আলােচ্য অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে ভাসানী-মুজিব প্রসঙ্গ। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই ১৯০২ সালে ইংরেজ-বিরােধী স্বদেশী আন্দোলনের সন্ত্রাসবাদী ধারায় যুক্ত হওয়াতে দশ মাস কারাবন্দি ছিলেন। দেশবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাসানী ১৯১৯-এ কংগ্রেস দলে যােগ দিয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জে (১৯২৪)অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের যে অধিবেশনে দেশবন্ধুর ‘বেঙ্গল প্যাক্ট অনুমােদিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী সেখানে কৃষক-প্রজাদের ওপর জমিদার-মহাজনের নির্যাতনের প্রাণস্পর্শী বিবরণ উপস্থাপন করেছিলেন। ফলে আবার তাকে (বাংলা) দেশ ছেড়ে আসামে পাড়ি জমাতে হয়। আসামের ধুবড়ি জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে বসবাসরত বাঙালি কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে তিনি এক বিশাল সম্মেলনের আয়ােজন করেন। পরে তাঁর কর্মস্থল হয় আসামের ঘাগমারি অঞ্চল। সেখানে তিনি বাঙালি কৃষকদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, স্কুল, মাদ্রাসা ইত্যাদি স্থাপন করেন।…১৯৩৫ সালে আসামের স্থানীয় লােকরা আসাম থেকে বাঙালিদের বহিষ্কার করার জন্য বাঙালখেদা’ আন্দোলনের ডাক দিলে তিনি এর বিরুদ্ধে পাল্টা আন্দোলন গড়ে তােলেন”(৭(৪)/২৪১)। উল্লেখ্য যে, “১৯৩০ সালের পূর্ব পর্যন্ত আসামে বহিরাগতদের (প্রধানত ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আগত মুসলমান কৃষক) বসবাস একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখার জন্য সরকার কর্তৃক টেনে দেওয়া ভৌগােলিক সীমারেখাই ইতিহাসে ‘লাইন প্রথা’ নামে পরিচিত।…পূর্ববঙ্গের ভূমিহীন…ও জমিদার-মহাজনদের দ্বারা লাঞ্ছিত নিপীড়িত বহু মানুষ আসামের দুর্গম অরণ্যভূমি পরিষ্কার করে আবাদ শুরু করলে সরকার প্রথম দিকে তাদের স্বাগত জানায় এবং…উৎসাহিত করে।…অল্পদিনের মধ্যে তারা কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলাে…বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে এবং…সরকার লাইন প্রথা প্রবর্তন করে (গােপীনাথ বড়দলৈ-এর কংগ্রেসী সরকার পুলিশ ও হাতি নিয়ােগ করে উদ্বাস্তু কৃষকদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে উৎখাত করে দিচ্ছিল) ..মওলানা ভাসানী আসামে পূর্ববঙ্গের হতভাগ্য কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য…‘লাইন প্রথা’ ও ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলনের তীব্র বিরােধিতা করে নতুনভাবে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। এই আন্দোলনের চাপে ১৯৪০ সালের শেষভাগে আসামের অ্যাডভােকেট জেনারেল লাইন প্রথার কার্যকারিতা স্থগিত করতে বাধ্য হন।…পর্যায়ক্রমে…বিভিন্ন এলাকা থেকে লাইন প্রথা প্রত্যাহার করা হয় ….লাইন প্রথা-বিরােধী আন্দোলনের সাফল্য আসামে পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল (৭(৫)/৯০-৯১)। তবে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সিলেট জেলা তখন আসাম প্রদেশের অন্তর্গত ছিল, ১৯৪৭ জুন মাসে সিলেট জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে ‘রেফারেন্ডাম’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত দশ বছর আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি থাকা সত্ত্বেও “মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রেফারেন্ডামে কোন সাহায্যই করেননি” (১৪(২)/১৪১)। জহুর হােসেন চৌধুরী লিখেছেন :“মওলানা ভাসানীকে আমি প্রথম দেখি ১৯৪৫-৪৬ সালে কলকাতায়…‘লাইন প্রথা বিরােধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানী তখন খ্যাতির উচ্চতম শিখরে। প্রথম দর্শনেই মওলানা ভাসানীকে আমার অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতৃবর্গের চেয়ে ভিন্ন ধরনের বলে মনে হলাে। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও, কংগ্রেসী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তীব্র কথাবার্তা বললেও একবারও তাকে ‘হিন্দু’ শব্দটি উচ্চারণ করতে শুনলাম না।…তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য -…তিনি কেবল যে মুখে চাষী-জনতার সুখ-দুঃখের কথা বলছেন তা নয়, তাদের সঙ্গে একাত্মবােধ করার সাধনায়ও সিদ্ধিলাভ করেছেন ।…দেশবিভাগের পরে …মওলানা সাহেবের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আসাম থেকে সদ্য-আগত। বড়দলৈর জেল থেকে বেরােবার পর তিনি দেশে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মারফতে স্বদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু মওলানাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য তদানীন্তন… মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। … একটি প্রচারপত্রও দেখলাম যে, সর্দার প্যাটোই মওলানা সাহেবকে পাঠিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানকে ধ্বংস করে। ভারতের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার জন্য।…শহীদ সাহেবের ভাগ্যেও একই লাঞ্ছনা জুটল।… রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত জনতা…পাকিস্তান আন্দোলনের এ দুই পরীক্ষিত অগ্রনায়ক সম্বন্ধে ক্ষমতাসীনদের অপপ্রচারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে নাই”(১৫/৩৯-৪০)। মওলানা ভাসানী ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবন মিলিয়ে যথার্থই ‘ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। একদিকে তিনি সমাজতন্ত্রী-বামপন্থী, অপরদিকে ‘পীরালী’ প্রথা-আচরণে অভ্যস্থ ছিলেন। ভাসানীর আদর্শে আস্থাশীল আবু জাফর শামসুদ্দিনের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি : “খুব সম্ভব ১৯৪৫ সালের। শেষদিকে…মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঐ সম্মেলন (বাহাদুরাবাদ ঘাটে) আহ্বান করেছিলেন। আসাম মন্ত্রিসভার বাঙ্গাল-খেদা নীতি ছিল আলােচ্য বিষয় ।…তিনি (ভাসানী) ছিলেন ময়মনসিংহ, রংপুর এবং আসামের ধুবড়ি জেলা। এবং ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলের পীর। গিয়ে দেখি…কম করেও লক্ষাধিক। লােক ।…গরু-খাসি-বকরি বে-এন্তেহা জবাই হচ্ছে। ভাত গােশত ডাল রান্না চলছে। সবাই ফ্রি আহার করছেন।…বলাবলি হতে শুনেছি, জিনেরা মওলানা ভাসানীর। তাঁবে। খাওয়া-খাদ্য ওরাই যােগায়। চেয়ে দেখলাম, জিন্নাত নয় মওলানা ভাসানীর মুরিদরাই যার যেমন আওকাত কিছু না কিছু নিয়ে আসছে, চাল ডাল গরু, খাসি সমানে আসছে; মাতবর শ্রেণীর মুরিদগণ সেগুলি জমা নিচ্ছেন এবং প্রয়ােজন মতাে খরচ করছেন” (৮/২২০-২২১)।

আরেকদিন একটি সভা থেকে মওলানা ভাসানীর ফেরার পথে, “কিছু দূর অন্তর অন্তর লােকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে তেলের শিশি, পানির ঘটি, মাটির ঢেলা প্রভৃতি। গাড়ি থামিয়ে মওলানা ভাসানী ফু দিচ্ছেন আর ওরা দু’চারটা করে পয়সা পীরের হাতে দিচ্ছে। মওলানা পকেটে পুরছেন এবং পথিমধ্যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন।…পথিমধ্যে প্রাপ্ত একটি পয়সাও মওলানা…নিয়ে আসেননি”(৮/২২৬)। দেশের নিরক্ষর জনসাধারণের মধ্যে মওলানা ভাসানীর জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দিন এ কথাও লিখেছেন যে, “শুধু পীর-মুরিদী এই জনপ্রিয়তার কারণ ছিল না। তিনি জনসাধারণের একজন রূপে তাদের পরম আত্মীয়রূপে মিশতে পারতেন। তাঁর মার্কিনের লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি তালের আঁশের টুপি অথবা সাদা টুপি ছিল সাধারণের সঙ্গে আত্মীয়তার প্রতীক” (৮/২২১)। দেশ-বিভাগের পরে তিনি টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে বসবাস শুরু করেন এবং মত-পথ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমৃত্যু (১৭ নভেম্বর, ১৯৭৬) রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৩০-এ মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছিলেন, ১৯৩৬-এ সােহরাওয়ার্দী, ১৯৩৭-এ ফজলুল হক আর শেখ মুজিব যােগ দিয়েছিলেন ১৯৩৯-এ। শেখ মুজিব নিজেই জানিয়েছেন, “১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে ।…শহীদ সাহেবকে বললাম, গােপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব । খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যােগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মােক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হল। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম” (৯/১৩-১৪)। তবে এ কথা সবারই জানা, সরাসরি মুসলিম লীগে যােগ না দিলেও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র জীবনের শুরু (১৯৪২) থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন সােহরাওয়ার্দীর অনুসারী সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। দুর্ভিক্ষ (১৯৪৩) পরবর্তী মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন : “তখন নেতৃত্ব নিয়ে লড়াই চলছে।…বামপথ ও ডানপথের নামে ।…একপক্ষে ছিলেন…মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ ( ঢাকায় ‘আজাদ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা; জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গীয়),…খাজা নাজিমুদ্দীন…ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া) প্রমুখ ।…অপরপক্ষে বৈপ্লবিক ইসলাম এবং রাব্বানিয়াত তত্ত্ব নিয়ে মাঠে অবতীর্ণ হন বর্ধমানের জমিদার…আলীগড়ের এম.এ আবুল হাশেম (হাশিম) সাহেব ।…সােহরাওয়ার্দী সাহেবও এ উপদলে ছিলেন।…সােহরাওয়ার্দীআবুল হাশেম উপদলের প্রধান প্রধান ছাত্রকর্মীদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকার শামসুদ্দীন আহমদ, টাঙ্গাইলের শামসুল হক প্রমুখ”(৮/১৯৫-১৯৬)। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একটা নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং নতুনভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে বােঝাতে চেষ্টা করতেন যে, পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু-মুসলমানদের মিলানাের জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বসবাস করতে পারে তারই জন্য। তিনি আমাদের কিছুসংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে রাতে আলােচনা সভা করতেন মুসলিম লীগ অফিসে।…হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা লাইব্রেরি করতে হবে, তােমাদের লেখাপড়া করতে হবে। শুধু হিন্দুদের গালাগালি করলে পাকিস্তান আসবে না। আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলে আমিও তাকে (হাশিম সাহেবকে) শ্রদ্ধা করতাম,…হাশিম সাহেব বলতেন, মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। গ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে”(৯/২৪)। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রজীবনেই (১৯৪২-৪৭) সােহরাওয়ার্দীর অনুসারী তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সকলেরই প্রশংসা-মনােযােগ আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বেকার হােস্টেল এবং ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। হােস্টেল বা কলেজ সংসদ নির্বাচনে তার মনােনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনাে প্রার্থী দাঁড়াতাে না। কোনাে সময় বিভিন্ন ছাত্র-গ্রুপের মতান্তর-বিভেদ ঘটলে সকল পক্ষই তাঁকে মেনে নিত । তিনি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে গােপালগঞ্জের মুসলিম। লীগের সংগঠক-সমন্বয়কের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। সবিশেষ উল্লেখযােগ্য যে, দেশভাগের আগে সিলেটের পাকিস্তানে যােগদানের প্রশ্নে যে ‘রেফারেন্ডাম’ (জুন, ১৯৪৭) হয়েছিল, সেখানে সােহরাওয়ার্দী পাঁচ শত স্বেচ্ছাসবক পাঠিয়েছিলেন। মুজিব লিখেছেন : “মওলানা তর্কবাগীশ, মানিক ভাই ( তােফাজ্জল হােসেন, পরবর্তী সময়ে ইত্তেফাকের সম্পাদক), ফজলুল হক ও আমি পাঁচশত কর্মী নিয়ে একদিন সিলেটে পৌঁছি। আমাদের জন্য সিলেটের গণভােট কমিটির…শুধু কোন এলাকায় কাজ করতে হবে, …সেখানে পৌঁছে দিতে হয়েছে। যাবতীয় খরচপত্রের ব্যবস্থা শহীদ সাহেব করে দিয়েছিলেন” (৯/৭৫-৭৬)। এ তথ্য থেকে লক্ষণীয় যে, শেখ মুজিব তখনই কর্মী পর্যায় থেকে নেতৃত্বে উঠে আসছেন।

রেফারেন্স – হক – ভাসানী – সোহরাওয়ার্দী – মুজিব – রামেন্দ্র চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!