You dont have javascript enabled! Please enable it!

হক – ভাসানী – সোহরাওয়ার্দী – মুজিব – চার প্রধানের উৎস সন্ধান : জন্ম, পারিবারিক পরিচয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ এবং কর্মজীবনের শুরু।

এক নিঃশ্বাসে যখন হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব বলা হয়, তখন তাঁদের পর্যায়ক্রমিক প্রবীণতার দিকটিও জানা হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) ছিলেন প্রবীণতম আর বঙ্গবন্ধু মুজিব (১৯২০-১৯৭৫) কনিষ্ঠতম। শেরে বাংলা বিভিন্ন উপলক্ষেই মুজিবকে ‘নাতি’ বলে উল্লেখ করেছেন আর ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬ খ্রি.) ‘পুত্রসম’ বিবেচনা করতেন মুজিবকে। সােহরাওয়ার্দীর (১৮৯২-১৯৬৩) বিবেচনায় ‘One of my star organisers’ ছিলেন মুজিব। তারা তিনজনই ছিলেন মুজিবের নেতা এবং রাজনৈতিক গুরু। প্রসঙ্গতই উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে গুরু-শিষ্যে মতান্তর হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণেই, কিন্তু কেউ কখনাে মুজিবকে সরাসরি পরিত্যাগ করেননি। অপরদিকে মুজিব তাঁর নেতা বা গুরুদের সাথে বিভিন্ন সময়ে প্রবল মতভিন্নতার কারণে আপত্তি-অভিমান প্রকাশ করলেও অভিযােগ-বিরােধিতা করেননি কখনাে, সতত সম্মান প্রদর্শন করেছেন যথােচিতভাবেই । লেখক, সংস্কৃতিজন মফিদুল হক উল্লেখ করেছেন, কোলকাতায় ছাত্রজীবনে (১৯৪২-‘৪৭) “ফজলুল হকের সান্নিধ্যে এলেও শেখ মুজিব অধিকতর আকৃষ্ট হয়েছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দ্বারা। ফজলুল হকের রাজনীতির তখন এক অস্থির পর্ব চলছে। কৃষক-প্রজা পার্টি গঠন করে বাংলার প্রজাকুলের মধ্যে আলােড়ন তুললেও ফজলুল হক রাজনীতিতে স্থিরপ্রত্যয়ী ছিলেন না।…পক্ষান্তরে সােহরাওয়ার্দী বৈপ্লবিক না হলেও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিলেন স্থিতধী এবং …মুসলিম অভিজাতগােষ্ঠী তথা নবাব পরিবারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিরােধী। শেখ মুজিবকে বিশেষ স্নেহ দিয়েই বরণ করেছিলেন সােহরাওয়ার্দী এবং তাঁর কাছেই শুরু হয় মুজিবের রাজনীতির পাঠ”(১(৩)/১৫১৮-১৫১৯)। ব্রিটিশভারতে কোলকাতা-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার ধারাবাহিকতায় হক সােহরাওয়ার্দীর পরে আসে ভাসানী-মুজিবের নাম। ব্রিটিশ-ভারতে রাজনীতিতে যুক্ত হলেও ভাসানী-মুজিব গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন দেশ-বিভাগের পরে ঢাকা-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে। আলােচ্য চার-প্রধানের প্রবীণতম আবুল কাসেম ফজলুল হকের জন্ম বরিশাল। (বর্তমান ঝালকাটি) জেলার সাতুরিয়া গ্রামে। তাঁর পৈতৃক নিবাস বরিশাল জেলার চাখার গ্রামে। শেরে বাংলার পিতা মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ছিলেন বরিশাল জেলার একজন খ্যাতনামা উকিল। মেধাবী ছাত্র ফজলুল হক বরিশাল জেলা স্কুল এবং কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে লেখাপড়ার পর ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯৭ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এল. পাস করে স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে কলিকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসা শুরু করেন। তারপর কিছুকাল কলেজে অধ্যাপনা এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করে ১৯১১ সালে আবার হাইকোর্টের আইন ব্যবসায়ে ফিরে আসেন” (৭(৪)/২)। “ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত ফজলুল হক সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। কিন্তু মত ও পথ, লক্ষ্যাদর্শ…সম্পর্কে তার কখনও কোন সুস্পষ্ট ধারণা অথবা আস্থা ছিল বলে মনে হয় না। একাধিকবার তিনি ক্ষমতা ও সুনামের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছেন; কিন্তু কোনােটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবু পল্লীবাংলার মানুষ তাকে ভালােবেসেছে, মনে করেছে, তিনি এক বটবৃক্ষ যার ছায়া তাদের জন্য বরাভয়। ফজলুল হক পল্লীবাংলার দুঃখী মানুষের আপদে বিপদে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেনও।…ফজলুল হক সাহেবকে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম সমাজের নির্মাতা বললে অত্যুক্তি হয় না।
…সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের অভাব এবং সুবিধাবাদী রাজনীতি সত্ত্বেও ফজলুল হক সাহেব বাঙালির ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ব্যক্তি”(৮/১৯১-১৯২)। কৃষক-দরদী নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম “সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে…পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। অল্প বয়সে পিতামাতার মৃত্যু হলে…এক চাচার আশ্রয়ে থেকে মাদ্রাসায় পড়াশােনা করেন। মাদ্রাসা-শিক্ষার শেষে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারির এক প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যােগ দেন। এখানে কৃষকদের ওপর জমিদার-মহাজনদের শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। এজন্য তাঁকে কাগমারি ত্যাগ করতে হয়। তিনি আসামের জলেশ্বর চলে যান। সেখানে সুফী সাধক শাহ নাসিরউদ্দিন বােগদাদীর ইসলাম প্রচার মিশনে তিন বছর কাজ করেন। তারপর বােগদাদীর উৎসাহে উত্তর ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন” (৭(৪)/২৪০-২৪১)। উল্লেখ্য যে, “আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসানচরে
১৬
বাঙালি কৃষকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করার সময় সেখানকার কৃষকসমাজ তাঁকে ‘ভাসানীর মওলানা’ বলে ডাকতে শুরু করলে তিনি ‘ভাসানী’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন। মওলানা ভাসানী ‘মজলুম জননেতা পরিচয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন।। শহীদ সােহরাওয়ার্দী “১৮৯২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর কলিকাতা মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্যার জেহাদুর রহিম জাহিদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি।…তিনি কলিকাতা মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা করেন। ১৯২০ সালে দেশে ফিরে তিনি কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন” (৭(৫)/৩৪০) । ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছেন, “সােহরাওয়ার্দী বাঙালি নন, যদিও একসময় আলাদা বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছিলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে গুরু মানতেন, সেজন্যই হয়তাে অনেকের ধারণা তিনি বাঙালি” (১(১)/২৯২)। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে তাঁর যতটা গ্রহণযােগ্যতা ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে আদৌ ততটা ছিল না।
বৈরুতের হােটেলে মৃত্যুর পরে, স্বজন-পরিজনের সম্মতিতেই তাকে ঢাকায় সমাহিত করা হয়। সুতরাং জন্মসূত্রে যা-ই হােক, বাংলা এবং বাঙালির রাজনীতিবিদ হিসেবেই সােহরাওয়ার্দী স্মরণীয়। তিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ পরিচয়ে উল্লিখিত হয়ে থাকেন। “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুর (বর্তমান গােপালগঞ্জ) জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সাহেরা খাতুন। তিনি গােপালগঞ্জ থেকে স্কুলের পড়াশােনা সমাপ্ত করে কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে…১৯৪৭ সালে বি.এ. …পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন”(৭(৫)/২০৪)। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার আন্দোলনে (১৯৪৯) জড়িয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটেছিল। পারিবারিক পরিচয় প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই উল্লেখ করেছেন : “টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের নাম কিছুটা এতদঞ্চলে পরিচিত। শেখ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে ।…শেখ বােরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গােড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ মােগল আমলের ছােট ছােট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে।…এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরেই জন্মগ্রহণ করি ।…শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল” (৯/১-৫)।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, “রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাই বলে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জন্মান না। বংশ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিত্তের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকখানি নির্ভর করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এসবের কোনােটারই বিশেষ ভূমিকা ছিল না ।…শেখ মুজিবকে কর্মী হিসেবে অন্যদের প্রশংসা কুড়াতে হয়েছে।…কর্মী থেকে আঞ্চলিক নেতা এবং আঞ্চলিক বা গােষ্ঠী নেতা থেকে সারা দেশের নেতা হতে শেখ মুজিবকে নিরলস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হয়েছে”(১(১)/৮৯)। সােহরাওয়ার্দীর জন্ম কোলকাতা মহানগরের সমৃদ্ধ চাকরিজীবী পরিবারে। সােহরাওয়ার্দীর পিতৃপরিবারে দৃশ্যমান স্বাচ্ছল্য থাকলেও স্থায়ী সম্পদ-ভিত্তি ছিল না। বাকি তিনজনেরই জন্ম পূর্ব বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে। অর্থনৈতিকভাবে ফজলুল হক ছিলেন উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবেরের সন্তান। ভাসানী এসেছিলেন বিত্তহীন পরিবার থেকে। শেখ মুজিবের জন্ম নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। পারিবারিক আর্থিক অবস্থান এবং স্থানীয় পরিবেশের সুস্পষ্ট ভিন্নতাই তাঁদের রাজনৈতিক জীবনেও ভিন্নতার সূচনা করেছিল। হক-সােহরাওয়ার্দীর রাজনীতির শুরু ‘ওপরতলা’য় নেতার পরিচয়ে, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের (প্রাদেশিক পরিষদ) নির্বাচিত সদস্য হিসেবে। অপরদিকে ভাসানী-মুজিব রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী হিসেবে। কর্মজীবনে হক-সােহরাওয়ার্দী ছিলেন আইনজীবী এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত রাজনীতির পাশাপাশি সেই পেশা-পরিচয় গুরুত্বের সাথেই অব্যাহত রেখেছিলেন। ভাসানী-মুজিবের কার্যত কোনাে পেশা-পরিচয় ছিল না। তারা দু’জনেই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। বলা চলে, জন্মসূত্রে যে পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছিলেন, সেটিই হক-সােহরাওয়ার্দীর কর্মজীবনের গতিমুখ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও জমিদার-মহাজনদের বিরূপতার কারণে তিনি চাকরি ছেড়ে স্থানান্তরে | (আসামে) চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুজিবের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণই প্রতিকূলে, তিনি আইনের ছাত্র হিসেবে পরিকল্পিত শিক্ষাজীবন সমাপ্তই করতে পারেননি। ছাত্রজীবনজুড়েই মুজিব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করার পর থেকেই তিনি সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু পরিচয়ে উল্লিখিত শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতিরজনক এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে (বিবিসি জরিপ, ২০০৪) স্বীকৃত-সম্মানিত। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব-আদর্শের বিরােধী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে স্ত্রী-পুত্রপরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ঘটনাক্রমে তখন বিদেশে থাকায় বেঁচে রয়েছেন কেবল তাঁর দু’কন্যা – শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
রেফারেন্স – হক – ভাসানী – সোহরাওয়ার্দী – মুজিব – রামেন্দ্র চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!