This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
স্মৃতি ও কথা-১৯৭১
অঞ্জলী লাহীড়ি
মুখবন্ধ
এই শতকে দুটি ভয়ঙ্কর বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্রের অভূতপূর্ব অভুদয় ও পরবর্তীকালে সােভিয়েত ইউনিয়নের অপ্রত্যাশিত ভাঙন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পরাধীন দেশগুলাের সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধ এবং একের পর এক দেশের স্বাধীনতা অর্জন- এতাে সবকিছুর মধ্যে একটি ঘটনা, যা বিশ্বকে চমকৃত করেছিল, সেটি হলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অযৌক্তিক অগণতান্ত্রিক সামরিক ষড়যন্ত্রের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির যুদ্ধ, যে যুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিল বাংলাদেশের আপামর জনগােষ্ঠী। এ যুদ্ধ ছিল যুদ্ধবাজ এবং প্রশিক্ষিত একটি সংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, নিরস্ত্র একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধ। বাংলাদেশের জনগণ এ যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও সামরিক শাসন পদ্ধতিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে রায় দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির পক্ষে।
উল্লেখ্য, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি একনায়ক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। পতন হয় আইয়ুব সরকারের । জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল করে দেয়। তারা তখন সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়। সে অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কথা ছিল পাকিস্তানে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সে লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক সংবিধানও রচিত হবে। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা মেনে নিতে পারেনি। এ অবস্থা মােকাবেলায় শাসনতান্ত্রিক পথে না গিয়ে ধ্বংসাত্মক পথে তারা অগ্রসর হয়। ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তারা।
এ মুক্তিযুদ্ধ বিশেষ কতগুলাে মাত্রার সমন্বয়ে বৈশিষ্ট্যময় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিবেক প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছিল এই কারণে যে, এরকম নৃশংস গণহত্যার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাত্র নয় মাসের সময়সীমায় পাকিস্তানি
হানাদার সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইটের নামে হত্যা করে লাখ লাখ বাঙালিকে। নারী, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ নির্বিশেষে গণহত্যার শিকার হয়েছে এ দেশের মানুষ। নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়েছে দু’লাখ নারীকে। নাৎসি কর্তৃক ইহুদি হত্যাযজ্ঞ, বসনিয়ার মুসলিম নিধন, আফ্রিকার রুয়ান্ডার গােষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব এসব ঘটনার পাশাপাশি বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা এখনাে ইতিহাসে বীভৎসতম। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযােগিতায় দেশকে দখলদার সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে একই বছর ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাস হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে অত্যাচার চালাতে থাকে তাতে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লােক দেশের মাটি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেনি এবং ভারত ব্যতীত আর কোনাে দেশ আজ পর্যন্ত বিনাশর্তে একই সাথে এতসংখ্যক লােককে আশ্রয় দিয়েছে বলে জানা যায় না। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, আরব দেশগুলােসহ বিশ্বের বেশ কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধিতা করেছে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র এবং নৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরও বাংলাদেশের মানুষকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকার করেনি। এমতাবস্থায় ভারতের জনগণ তাদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, ট্রাম-বাসট্রেনভাড়া, ডাকটিকিটের ওপর ধার্য করা অতিরিক্ত কর দিয়ে শরণার্থী শিবিরের খরচ যুগিয়েছেন। বাস্তুহারা, দেশত্যাগে বাধ্য নিঃস্ব মানুষগুলােকে সব রকম সহযােগিতা প্রদানের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারতের সচেতন সমাজকর্মীরা। ন্যূনতম সুযােগসুবিধার অভাবের মধ্যে থেকেও শুধু সহমর্মিতা আর মানবতাবােধ-তাড়িত হয়ে অগণিত মানুষ এই নিরাশ্রয়, বিপর্যস্ত, লাঞ্ছিত, যাদের অনেকেই সদ্য স্বজনহারা সেসব শরণার্থীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রয়ােজনের তুলনায় যে সাহায্য সরবরাহ করা সম্ভব হতাে তা ছিল নেহাতই অপ্রতুল। বিশাল ভারতের পূর্বাঞ্চল, সীমান্ত ঘেঁষা প্রদেশগুলাে যােগাযােগ ব্যবস্থার দিক থেকে বেশ অনুন্নত। অন্যান্য সুযােগ-সুবিধাও এখানে সীমিত। অত্যাচারে জর্জরিত প্রাণভয়ে ভীত মানুষগুলাে যখন আশ্রয়ের জন্য, একটু নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে, তখন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যেই তাদের জন্য কোনাে রকমে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়ার দায়িত্ব বর্তায় এদের ওপর। ভারত সরকার তখনাে নির্দিষ্ট কোনাে নীতি গ্রহণ করতে পারেনি। প্রশাসনিক সমর্থন ও সহযােগিতা তখনাে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। শিলং, করিমগঞ্জ, শিলচর ও আগরতলার মধ্যে যােগাযােগ এক দুরূহ ব্যাপার। সমস্ত মেঘালয় সীমান্তজুড়ে এক অবর্ণনীয় অবস্থা। ত্রিশ লাখ অসহায়, গৃহহারা অভুক্ত আশ্রয়প্রার্থী।
ব্যক্তির ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জাতির ইতিহাসকে বুঝে নিতে হবে। সমন্বিত ইতিহাসে অন্তর্হিত ব্যক্তিক প্রয়াস ও কর্মোদ্যমকে দৃশ্যমানতায় উত্তীর্ণ করতে হবে। আমাদের বর্তমান কাজের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীর আত্মকথন সংগ্রহের কাজটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীদের অদৃশ্যমানতা এতাে ব্যাপক ও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনাে ক্ষেত্রেই তাদের অবদানের কোনাে উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যায় না। নারীদের শুধু বীরাঙ্গনা বা নির্যাতিত বলেই দেখানাে হতে থাকে, অথচ যুদ্ধাপরাধ বলে যে অপরাধগুলােকে চিহ্নিত করা হলাে, সেখানে পর্যন্ত নারীর ওপর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যে অত্যাচার করেছিল, তা অন্তর্ভুক্ত করা হলাে না এবং তার বিরুদ্ধে বিচারের কোনাে প্রশ্ন তােলা হলাে না। প্রধানত সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আইন ও সালিশ কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। যদিও এর মূল লক্ষ্য ছিল নির্যাতিত নারীদের জবানবন্দি ধারণ করা, যা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আইনগত সমর্থন যােগাবে। নানা বিচারবিশ্লেষণ করে এই প্রকল্পের কাজ এককেন্দ্রিক না রেখে ভিন্নমুখী করার প্রয়াস নেয়া হয়। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন ও সালিশ কেন্দ্র খুঁজে দেখতে চেয়েছে নারীর কার্যক্রম, অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা এবং এই অন্বেষার মূল জনগােষ্ঠী হচ্ছে সাধারণ নারী, কোনাে সামনের সারির রাজনৈতিক দল বা নেতা নয়। এ গবেষণার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল সংঘাতময় পরিস্থিতিকে নারী কীভাবে ধারণ করে এবং তা অতিক্রম করার চেষ্টায় কী ভূমিকা রাখতে পারে তার সূত্র খুঁজে পাওয়া। স্মৃতি ও কথা- ১৯৭১’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মুক্তিযুদ্ধে তারাও ছিলেন সিরিজের প্রথম প্রকাশনা, যাতে আছে অঞ্জলি লাহিড়ীর নিজের লেখা স্মৃতিচারণ এবং তার কাজ ও অভিজ্ঞতা বিষয়ক একটি দীর্ঘ সাক্ষাঙ্কার। শরণার্থীদের একেবারে কাছে থেকে তিনি নানা ধরনের সহযােগিতা ও সেবা দিয়ে গেছেন। এই প্রকাশনার মাধ্যমে পাঠক যদি মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকার নতুন একটি মাত্রা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন, আমাদের প্রয়াস সার্থক বিবেচিত হবে ।
সুলতানা কামাল
পাণ্ডুলিপি পাবার পর
অঞ্জলি লাহিড়ীর লেখা পাণ্ডুলিপি আমাদের হাতে আসে বছর দেড়েক আগে। সােহিনী ঘােষ’ দিল্লি থেকে এটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কর্মশালা করার সূত্রে বেশ ক’বছর ধরে ঢাকায় ওর আসা-যাওয়া। আর প্রতিবার ফেরার সময় ও মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু বই বয়ে নিয়ে যায় দিল্লিতে। অঞ্জলি লাহিড়ী গৌহাটি থেকে একবার দিল্লি বেড়াতে এলেন। সে সময় সােহিনীদের বাড়িতে, নীলিমা ইব্রাহীমসহ আরাে অনেকের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বই পড়ার সুযােগ হয় তাঁর। বইগুলাে পড়তে পড়তে’, পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার তখন মনে হয়েছিল, এরকম কিছু অভিজ্ঞতা আমার জীবনেও আছে। আমিও তাে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করতাম। শরণার্থী শিবিরের বহু মানুষের সংস্পর্শে আমি তখন এসেছিলাম।
সেদিন সােহিনী আর তার মা নমিতা ঘােষের সাথে এ নিয়ে অঞ্জলি লাহিড়ীর বেশ কথাবার্তাও হয়। তিনি বলেন, সােহিনী তখন আমাকে বলেছিল, মাসি তুমি এক্ষুণি এগুলাে লিখে ফেললা। বাংলাদেশে আমি প্রায়ই যাই। তাদের আমি দেখাবাে। তুমি যা হয় লেখাে লিখে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
সেই লেখা, মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ২৬ বছর পর অঞ্জলি লাহিড়ী গৌহাটিতে ফিরে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে তৈরি করে পাঠালেন। তার সাথে শরণার্থী ক্যাম্পের একগুচ্ছ দুর্লভ আলােকচিত্রও গৌহাটি থেকে দিল্লি হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে গেল।
তারপর প্রথমেই দেখা গেল, আমাদের মধ্যে শামীম আখতার অঞ্জলি লাহিড়ীর নাম জানেন। তাঁর যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা আছে, শামীম ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ ছবির কাজ করতে গিয়ে সিলেটের এক বৃদ্ধার কাছে শুনেছিলেন। সংবাদ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক লেখায় তিনি সে কথা উল্লেখও করেছেন।
তার মানে অঞ্জলি লাহিড়ী বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া কোনাে নাম নয় । আমাদের ভেতরেও কেউ না কেউ তাঁকে চেনে। সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বেশ কিছু বইয়েও দেখা গেল অঞ্জলি লাহিড়ীর কথা আছে। সিলেট-মেঘালয় সীমান্তের শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে সেসব বইয়ের লেখকেরা একাত্তরে তাঁকে দেখেছেন। যাদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তাঁর কথা শুনেছেন। সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় অঞ্জলি লাহিড়ীর নাম কোনাে না কোনােভাবে উঠে এসেছেই। একে তাে তাঁর
পাণ্ডুলিপির মর্মস্পর্শী কাব্যময়তা আমাদের আপুত করেছিল, তদুপরি নয় মাসব্যাপী তাঁর কাজের যে বিপুল বিস্তৃতি, আমাদের সেটাও তখন উদ্বুদ্ধ করে। আমরা সিলেটের গণ্ডি থেকে বের করে তাঁকে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করানাের কথা ভাবতে লাগলাম।
প্রথমে পাণ্ডুলিপির ছােট্ট কলেবর আমাদের সমস্যায় ফেলে দেয়। সবক’টা ছবি দিয়ে একে সাজালেও কোনােভাবে দুই-তিন ফর্মার বই হয় না। অবশ্য তার সঙ্গে যুৎসই একটা ভূমিকা যদি জুড়ে দেয়া যায়, তাহলে হয়তাে একটা বইয়ের নূ্যনতম আকার পেলেও পেয়ে যেতে পারে। তবে সেই ভূমিকাটি হতে হবে মেঘালয়ের শরণার্থী ক্যাম্প আর অঞ্জলি লাহিড়ীকে নিয়ে। কোনাে মুক্তিযােদ্ধা বা কর্নেল-মেজরের যুদ্ধকাহিনী, আমাদের মনে হয়েছে, এক্ষেত্রে মােটেও প্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা, এই পাণ্ডুলিপির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে সেসব মানুষ, পাকিস্তানি সৈন্য যাদের ভিটে-মাটি ছাড়া করেছিল, যারা শরণার্থী ক্যাম্পের ঘেঁড়া পলিথিনের সঁতসেঁতে ছাউনিতে অনাহারে, কলেরায় ধুকে ধুকে মরেছে। মরেও যারা মাটি কিংবা আগুন পায়নি। কুকুরে-শকুনে যাদের নাড়ি-ভুড়ি-মাংস, উৎসব করে ছিড়ে-ফেঁড়ে খেয়েছে।
সে সময় একজন ভূমিকা লেখকের খোঁজে আমি সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল ভাইয়ের শরণাপন্ন হই। তিনি আমাকে জাফলং টি-স্টেটের প্রাক্তন ম্যানেজার কয়েস আহমেদ চৌধুরীর কথা বললেন। চৌধুরী সাহেবের কাছ থেকে তখন মুক্তিযুদ্ধের ওপর বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য জানা গেল। অঞ্জলি লাহিড়ীর নাম বলতেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিনে ফেললেন। আমাদের পাণ্ডুলিপি রচয়িতী মেঘালয়ের অ্যাডভােকেট জেনারেল নীরেন লাহিড়ীর স্ত্রী কয়েস চৌধুরী জানান। এছাড়া বেশ কিছু শরণার্থী ক্যাম্প আর মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির যে বাংলাদেশের মধ্যেই তখন ছিল, কয়েস চৌধুরী বলার আগে তা আমরা ভাবতেও পারিনি। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘ঐ সব এলাকায় পশ্চিমা সৈন্যদের আসা খুব ডিফিকাল্ট ছিল। কারণ এটা নদী এলাকা, হাওর এলাকা। …মেঘালয়ের পাহাড়ের মধ্যে ক্যাম্প করলে পানির সমস্যা হতাে। এজন্য ক্যাম্পগুলাে করা হয়েছিল হাওরের পাড়ে, নদীর চরায়, যাতে পানির সমস্যা না হয়। তাছাড়া খাসিয়াদের কো-অপারেশন তেমন একটা ছিল না। ওরা চাইতাে না যে বাঙালিরা জয়ী হােক ।
একজন মােক্ষম ভূমিকা লেখক দরকার, অথচ তাকে খুঁজে পাচ্ছি না কোনােভাবেই- এই যখন অবস্থা, তখন মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পের পরিচালক হামিদা হােসেন আমাকে অঞ্জলি লাহিড়ীর সাক্ষাঙ্কার নিতে বললেন। এবং কাজটা আমি শিলং, গৌহাটি বা কলকাতা, যেখানে সুবিধা সেখানে গিয়েই করতে পারি। তবে ১৯৯৯-এর একুশের বইমেলা শুরু হওয়ার আগে কাজ আমাকে শেষ করতে হবে- বললেন তিনি।
১০
আমারও মনে হলাে, অনেকদিন পর, পথের নিশানা কিছুটা হলেও এখন দেখতে পাচ্ছি ।
বলাবাহুল্য, সেদিন থেকে আমার অনুসন্ধানের স্রোত সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করলাে।
অঞ্জলি লাহিড়ীর সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে আমি ভাবলাম, সিলেটের যারা লেখিকার সাথে ১৯৭১-এ কাজ করেছিলেন, খুঁজে পেতে তাদের বের করা দরকার। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমার হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের নাম মনে পড়লাে। তিনি তাে সেই বৃদ্ধ দ্রলােক, অঞ্জলি লাহিড়ীর লেখার শুরুর দিকে আছে- শরণার্থী ক্যাম্পে ঢুকতেই যিনি হেসে এগিয়ে এসেছিলেন। যার পরনের আধ ময়লা ধুতি ছিল হাঁটুর ওপর তােলা। আমি তখন মহিলা পরিষদের নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থের সঙ্গে ফোনে যােগাযােগ করলাম। একে তাে তারা দুজনেই দাশ পুরকায়স্থ, তার ওপর তাদের বাড়িও সিলেট- রাখীদি কি আর বুড়াে ভদ্রলােককে চিনবেন না? প্রায় মাস খানেক পর তিনি আমাকে যােগাড় করে দিলেন হিতেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের ফোন নম্বর।
তিনি আবার কে? রাখীদি বললেন, ‘হেমেন্দ্র বাবুর ছেলে বােধহয়, তার ডাকনাম মিন্টু।
এখন ভাবতে বেশ অবাক লাগে, একাত্তরে যিনি বৃদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ২৭ বছর পর আমি সেই হেমেন্দ্র বাবুকেই খুঁজেছিলাম, তার সঙ্গে কথা বলবাে বলে। সিলেটে ফোন করতেই হিতেন্দ্র বাবু বললেন, ‘আমার বয়স এখন চৌষট্টি। আমি হেমেন্দ্র বাবুর ছেলে।’ আমি যেন বড় রকমের একটা হোঁচট খেলাম। তারপরও আমতা আমতা করে আমাকে তখন বলতে হলাে, তিনি বেঁচে আছেন তাে?
‘না। ১৯৯০-এ মারা গেছেন বাবা। আমার মা প্রীতিরানী বেঁচে আছেন।’
আর তাে দেরি করা চলে না। প্রীতিরানী দাশ পুরকায়স্থ, আমি ততােদিনে জেনে গেছি, ১৯৭১-এ সেলা সাব-সেক্টরের মহিলা মুক্তিফৌজের সভানেত্রী ছিলেন। অঞ্জলি লাহিড়ীর লেখার তিন-চার পাতা জুড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি যে একজন মাসিমার অপত্য স্নেহের কথা বিস্তারিতভাবে আছে, তিনিই সেই প্রীতিরানী দাশ পুরকায়স্থ। হেমেন্দ্র বাবুর স্ত্রী।
সিলেটে যাওয়ার পরদিন, হিতেন্দ্র বাবু বিশ্বনাথ থানার দিঘলী গায়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেই গাঁয়ে অঞ্জলি লাহিড়ীর পৈতৃক ভিটেবাড়ি। তাঁর ঠাকুরদা ডা. সুন্দরীমােহনের নামে প্রতিষ্ঠিত দিঘলীর দাতব্য চিকিৎসালয়, পাঠশালা সিলেটসুনামগঞ্জ পাকা সড়ক থেকে দেখা যায়। তারপর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আলপথের পাশে পারিবারিক শ্মশান । যে হেমেন্দ্র বাবুকে গত এক মাস ধরে আমি খুঁজেছি, বাড়িতে ঢােকার মুখে, তাঁর আট বছরের পুরনাে সমাধি আমাকে পেরিয়ে যেতে হলাে।
অন্যদিকে মহিলা মুক্তিফৌজের সম্পাদিকা নিবেদিতা দাশের কাছে সেলার স্মৃতি বড় ভয়ের। বড় বেশি আতঙ্ক ধরে যায় সেদিনের কথা ভাবতে গেলে। একাত্তরে উনিশ-কুড়ি বছর বয়সী এক সন্তানের মা নিবেদিতার মনে হয়েছিল, যুদ্ধ তাদের ভিখিরি বানিয়ে দিয়েছে। ভারত সরকার কদিন আর শরণার্থী ক্যাম্পে রেখে খাওয়াবে, পরাবে, সারাজীবন বুঝি পথে পথে ভিক্ষা করে খেতে হবে তাদের। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, মুক্তিযুদ্ধে কী করেছেন না করেছেন- সেসব কথা মনে পড়ক, তিনি চাননি। প্রাণপণে দুঃস্বপ্নের মতাে কেবল ভুলতে চেয়েছেন সেসব কথা। নিবেদিতার কথা হলাে, ‘যেতা গ্যাছে তাে গ্যাছেই, বাড়ি ফিরা দেখি ভাঙা বেড়া আর মাটি, বইবার একটা চেয়ার পর্যন্ত নাই।’
ঘরের যা একটা চাল অবশিষ্ট ছিল, তা-ই দিয়ে আবার সংসার গড়ার কাজ শুরু হলাে। তার প্রথম সন্তান, যে একাত্তরে বাড়ি-ছাড়ার সময় ছিল এক মাসের শিশু, এখন কানাডায় থাকে। ইঞ্জিনিয়ার স্বামী আর পুত্রদের নিয়ে নিবেদিতার সচ্ছল সংসার। সময়ের এতােখানি ব্যবধানে, আজকে যখন তার পথের ভিখিরি হওয়ার ভয়ও বিশেষ নেই, আশ্চর্য যে নিবেদিতা দাশ চাইলেও এখন আর সে সময়কার পরিচিতজনদের মুখ মনে করতে পারেন না। তারা যেন চিরতরে হারিয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি থেকে। তবে টী বর্ণনা তিনি এখনাে নিখুঁতভাবে দিতে পারেন। নিবেদিতার মনে পড়ে, সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল । কোলে এক মাসের শিশু। স্বামী ও শাশুড়ি ছিলেন সঙ্গে। বাচ্চার জন্য ফ্লাস্কে করে সাগু আর চিনি নিয়েছিলেন ছােট্ট একটা কৌটোতে ভরে। অনেক মানুষ সেদিন একসঙ্গে সুরমা নদী পার হয়েছিল। নদীর ওপারে টেকনিক্যাল স্কুল। রাতে স্কুলে থাকলেন সবাই। তারপর ছাতকে উনিশ দিন কাটলাে একটা ফ্যাক্টরিতে। ব্রিজ ভেঙে ফেলার পর পাকিস্তানি আর্মি ছাতক আক্রমণ করে। সেদিন তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন ছন্দিপুর গ্রামে। ওখানে দুদিন যেতে না যেতে, গায়ের লােক দু’ভাগ হয়ে গেল । একদল উদ্বাস্তুদের সাথে যা কিছু আছে, লুট করে নেবে। আরেক দল তাদের বাঁচাতে চাইলেন। তারপর ভালাে মানুষদের সাহায্য-সহযােগিতায় চৌদ্দ মাইল হেঁটে সেলা ক্যাম্পে গিয়ে উঠেছিলেন তাঁরা।
দিঘলী গায়ের কাজ সেরে হিতেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের সঙ্গে সিলেট ফিরছি। দুদিন ধরে দ্রলােক মানচিত্র, পেপার কাটিং, বই-পত্র দেখিয়ে আর নানা গল্প বলে আমার চোখের সামনে একাত্তরের সিলেটের অবস্থা বেশ খানিকটা জীবন্ত করে তুলেছেন। তারপর সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক থেকে তিনি যখন মেঘালয়ের ছাইরঙা, ঢেউ খেলানাে এক গুচ্ছ পাহাড় তর্জনী তুলে দেখালেন, আমার তখন মনে হলাে, এই পাহাড়গুচ্ছ তেমন আর দূরে কি, আমি চাইলেই তাে ছুঁতে পারছি, হােক না তারা সীমান্তের ওপারে।
অঞ্জলি লাহিড়ীর সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ ঠিক করে আমি এ বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় গেলাম। তিনি এলেন গৌহাটি থেকে। তার আগে ফোনে বার কয়েক আমাদের কথাবার্তা হয়েছিল। কলকাতায় প্রথম দু’দিন সাক্ষাৎকার নিতে আমি অঞ্জলি লাহিড়ীর দাদা রঞ্জিত দাসের নিউ বাড়িতে যাই। ওখানে তিনি ছেলে রাহুলকে নিয়ে উঠেছিলেন ।
কথা বলতে বলতে আমার এক সময় মনে হলাে, অঞ্জলি লাহিড়ীর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার কানায় কানায় ভরা। একাত্তর কেবল নয়, তার গােটা জীবনটাই ক্যাসেটবন্দি হওয়ার যােগ্যতা রাখে। এমন হাতের লক্ষ্মী আমি পায়ে তাে আর ঠেলতে পারি না! কিন্তু আমাকে যে আবার সাত-আট দিনের ভেতর সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরতে হবে। এছাড়া বইয়ের জন্য যেসব তথ্য দরকার, তার ভেতর থেকে ছিটেফোঁটাও যদি বাদ যায়, ফিরে গিয়ে মাথা কুটলেও আমার পক্ষে জানা সম্ভব হবে
সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে দরকার নিরিবিলি একটা জায়গা আর অখণ্ড সময়। অঞ্জলি লাহিড়ী সেই বুঝে, আমার থাকার জায়গা গােল-পার্ক গেস্ট হাউসে রােজ সকালে আসতে রাজি হলেন।
তিনি কথা বলেন, টেপরেকর্ডারের ভেতর ক্যাসেটের ফিতা ঘুরতে থাকে। গেস্ট হাউসের বাইরে এক পা ফেললেই গড়িয়াহাট বাজার। কখনাে-সখনাে আমরা সেখানে যাই চা কিংবা কফি খেতে । কথার পিঠে নানা কথা চলে আসে। বয়সের ফারাক তখন আর বাধা মনে হয় না। আমরা জমজমাট আড্ডায় মেতে উঠি। আর তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মূল্যবান কথা ছিটকে বেরিয়ে আসে হঠাৎ হঠাৎ, যা কিনা আমার জন্য অপ্রত্যাশিত। এমনকি অঞ্জলি লাহিড়ীও বলার আগে ভাবেননি, এ কথা তিনি বলবেন এবং এটা আমার কাজেও লেগে যাবে। যেমন আঙ্কেল জেথ্রোর কাহিনী এমন এক বেহিসেবি আড্ডারই ফসল। এই একটা উদাহরণ থেকে যে কারাে মনে হতে পারে যে, এ ধরনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ অনাবিষ্কৃত খনি খোড়াখুঁড়ির মতাে। যতাে বেশি খোঁড়া হবে, তত বেশি সােনাদানা বেরিয়ে আসবে অন্ধকার গহ্বর থেকে। আমারও তখন তাই মনে হয়েছিল।
প্রতি সন্ধ্যায় অঞ্জলি লাহিড়ী চলে যাওয়ার পর, আমি আবার ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করে শুনতে বসতাম। দেখা যাক, কথার মাঝখানে কোনাে কিছু বাদ পড়ে গেছে কিনা, পরদিন আবার সেই মতাে প্রশ্ন করা যাবে। এদিকে বেচারা টেপরেকর্ডারেরও তাে সহ্য ক্ষমতার শেষ আছে। একদিন খুব জরুরি কথার মাঝখানে বিগড়ে গেল। প্লে করলে ঘােরে কিন্তু লাল রেকর্ড বােতাম টিপলে এক চুলও নড়ে না। আমি ভর দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম। অঞ্জলি লাহিড়ী একা চুপটি করে ঘরে বসে থাকার মেয়ে নন। ছিয়াত্তর বছর বয়সেও তার কর্মস্পৃহা অফুরন্ত। তিনি আমার সঙ্গে পথে নামলেন। মােটে দুটি
রেকর্ডার সারানাের দোকান, তা-ও আবার গড়িয়াহাটের এমাথায়-ওমাথায়। দুপুরবেলা। এক দোকানে টেকনিশিয়ান নেই, খেতে গেছেন। আরেক দোকানে একজন শিক্ষানবিশ বসে খুঁচখচ করছে। তাকে নিয়ে আমরা উঠেপড়ে লাগলাম। সময় গড়িয়ে যায়, সে কিছুতেই পেরে উঠছে না। আর মাত্র একদিন, তারপরই আমাকে ঢাকা ফিরতে হবে। যান্ত্রিক গােলযােগ এ অবস্থায় কাহাতক সহ্য হয় । আমি শিক্ষানবিশ ছােকড়াকে ক্ষণে ক্ষণে ধমক দিচ্ছিলাম। সে তখন দিশেহারা। উঠে পাশের ঘড়ির দোকানে যায়, আবার ওস্তাদের পথ চেয়ে বসে থাকে। এক সময় অবাধ্য যন্ত্রটা কিঞ্চিৎ চালু হলাে। আমি ওকে পারিশ্রমিক দিতে চাইলাম। বাংলাদেশের একটা টেপরেকর্ডার যে তার কাছে সারাতে যাওয়া হয়েছে, সে তাতেই ধন্য। টাকা কিছুতেই নেবে না। মাঝখানে যে বকাঝকা করলাম? সেগুলাে ফাউ। শিক্ষানবিশের বকা খাওয়া তার শিক্ষালাভেরই অঙ্গ।
সাতদিন পর, নব্বই মিনিটের পাঁচটা ক্যাসেটে অঞ্জলি লাহিড়ীর কথা তুলে নিয়ে আমি ঢাকা ফিরলাম। বিদায় নেয়ার সময় বলেছিলাম, ফেব্রুয়ারির বইমেলায় সম্ভব না হলেও ২৬ মার্চের আগে আমি বইয়ের কাজ শেষ করবাে। তিনি যেন তখন ঢাকায় আসেন ।
প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পরিধির গােলকধাধা থেকে ক্ষুদ্র একটা অংশ তুলে নিয়ে সাজানাে হলাে ‘স্মৃতি ও কথা- ১৯৭১’-এর ‘কথা’ শিরােনামের পর্বটি । আমাকে বইটি গুছিয়ে তােলার কাজে সাহায্য করেছেন আসক-এর কমিউনিকেশন ইউনিটের রহিমা খাতুন জুলি, কম্পিউটার সেকশনের রেহানা সুলতানা। অনিল মণ্ডল ডামি থেকে বইয়ের মূর্তরূপ দিয়েছেন কম্পিউটারে। তথ্যসূত্র আর জরুরি কিছু ছবির ‘স্মৃতি ও কথা১৯৭১’ হিতেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। পঁচাশি বছর বয়সের কর্মযােগী মানুষ রঞ্জিত দাসকে এ মুহূর্তে স্মরণ করছি- নিউ আলীপুরের বাড়িতে আমার আর অঞ্জলি লাহিড়ীর কথার ফাঁকে ফাঁকে যিনি হাজির হতেন সিলেটের ওপর লেখা নানা বই-পত্রিকা নিয়ে। সবশেষে বলতে চাই, অঞ্জলি লাহিড়ীর সান্নিধ্যে কলকাতার সেই সাতটি দিন আমার জীবনের এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। লেখিকাকে তারই বইয়ের পাতায় ধন্যবাদ জানানাের স্পর্ধা এখন না-ই-বা করলাম।
শাহীন আখতার
স্মৃতি ও কথা ১৯৭১
পাদটীকা
১. সােহিনী ঘােষ-রিডার, ভিডিও প্রােডাকশন ডিপার্টমেন্ট, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়,
নয়াদিল্লি।
২. সিলেটের যুদ্ধকথা, তাজুল মােহাম্মদ, প্রকাশক সাহিত্য প্রকাশ ।
মুক্তিযুদ্ধে উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গন, মেজর এম এ মুত্তালিব, প্রকাশক সিলেট প্রেস ক্লাব।
৩. মহিলা মুক্তিফৌজ- মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর সেলায় ‘৭১-এর কোনাে এক সময় মহিলা মুক্তিফৌজ গঠন করা হয়েছিল।
৪. ডা. সুন্দরীমােহন- বিখ্যাত চিকিৎসক। তিনি ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন এবং বিধবা বিয়ে করেছিলেন।
৫. মেজর মুত্তালিব- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন। ১৯৭১-এ কিছু সময়ের জন্য বালাট সাব-সেক্টরের দায়িত্ব নেন। মারা যান ১৯৯১ সালে।
৬. হক সাহেব- অ্যাডভােকেট আবদুল হক আওয়ামী লীগের নেতা। সাবেক সংসদ সদস্য। দেশ
স্বাধীন হওয়ার সময় রহস্যজনক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।
৭. ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন- সেলা সাব-সেক্টরের অধিনায়ক, পরে লে. কর্নেল হন। সামরিক
বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এখন ব্যবসা করছেন।
৮. হিতেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থ- হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের ছেলে। কলাম লেখক। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন।
৯. রঞ্জিত দাস- অঞ্জলি লাহিড়ীর দাদা। যাদবপুর থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। ‘ইউনিভার্সেল ড্রাগ হাউজ’ নামে একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।
সেলা শরণার্থী শিবির
ইতিহাস কত দ্রুত তার পটপরিবর্তন করে। পাহাড়ের পাদদেশে সুবিস্তৃত এলাকাজুড়ে কমলা, মধু, ঝরনা আর পাখি, এমনি এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যময়ী সেলার বুকে কত রক্তের প্রলেপই-না পড়েছে।
চেরাপুঞ্জির পাদদেশে সেলা বাজার । বাংলাদেশের সীমান্তে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সিলেট, সেলা, চেরাপুঞ্জির এই পায়ে চলা পথে গড়ে উঠেছিল অনেক বিচিত্র ইতিহাস।
এ সেই পায়ে চলার পথ, যেখান দিয়ে একদিন ব্রিটিশ ধুরন্ধর রাজনৈতিক সচিব (Political agent) ডেভিড স্কট ক্রমবর্ধমান বর্মি আক্রমণের বিরুদ্ধে সিলেটের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ডাক ও যােগাযােগ ব্যবস্থা পাকাপাকি করার জন্য সেলা চেরাপুঞ্জি এবং নংখলাও স্টেটের ভেতর দিয়ে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে একটা পাকা রাস্তা তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। তারপর নানা ঘটনা চক্রে নংখলাও স্টেটের রাজা তিরতসিং ব্রিটিশের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। দীর্ঘ চার বছর সে যুদ্ধ চলেছিল। স্কট সাহেব ‘সিলেট লাইট ইনফেন্ট্রি’ বাহিনীকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান চেরাপুঞ্জির পথে। সেলা এবং চেরাপুঞ্জিকে ঘিরে ‘শা-বার’ এলাকায় খাসিয়া রাজশক্তি তিরতের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল। পাহাড়ের আনাচেকানাচে গড়ে উঠেছিল তীব্র প্রতিরােধ । পুরাে এলাকায় এই গণবিক্ষোভকে পর্যুদস্ত করতে ব্রিটিশের রাজশক্তিকে সেদিন রীতিমতাে হিমশিম খেতে হয়েছিল। তার পরের ইতিহাস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস।
এই সেই সেলা, যার বুকের ওপর দিয়ে নিরবধি বয়ে চলে ‘উমইয়াম’ নদী, তার অগভীর নীল জলে আকাশের প্রতিবিম্বকে বুকে ধরে নিয়ে। এ নদী মেঘালয়ের সীমান্ত দেশে ধমনির মতাে প্রাণ সঞ্চারিণী। শীতের ঠাণ্ডা দিনগুলােতে নীল নদীর এপারে পাহাড়ের মতাে জমা হয় চেরাপুঞ্জির রসে টুসটুসে কমলা। ছােট ছােট ডিঙি তরতর করে বয়ে চলে ওপার বাংলায়। এরা পাঠায় কমলা, তেজপাতা, চুনাপাথর, পান-সুপারি,
ওরা পাঠায় ধান, চাল, মাছ। সীমান্তজুড়ে অচলায়তনের প্রাচীর । তবু সে প্রাচীর কেউ মানে না। সাধারণ মানুষ সেই প্রাচীর ডিঙিয়ে পরস্পর পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখে।
১৯৭১ সাল। সীমান্তজুড়ে কী প্রচণ্ড বিপর্যয়। বাংলাভাষা স্বীকৃতির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে যে আন্দোলন একদিন দানা বেঁধে উঠেছিল, একাত্তরে তা ফেটে পড়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজশক্তি কোনােমতেই সে বিক্ষোভকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। নিরস্ত্র জনতার ওপর সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশবিক প্রতিহিংসার ঘৃণ্য চক্রান্ত নিয়ে। ইয়াহিয়া খার নির্দেশে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের ওপর চালানাে হয় অত্যাচারের স্টিমরােলার। সমস্ত জাতির বিরুদ্ধে শুরু হয় এক অঘােষিত সর্বাত্মক যুদ্ধ। সে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ে মেঘালয়ের সীমান্তজুড়ে।
ঘুমন্ত সেলা আবার জেগে ওঠে। জেগে ওঠে বিগত শতাব্দীর রণক্লান্ত সেলা। মর্টার আর সেলের শব্দে, বারুদের গন্ধে তার ঘুম ভেঙে যায়। এবারকার নায়ক ডেভিড স্কট আর তিরতসিং নয়। আজকের নায়ক একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাতক রাজশক্তি, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমগ্র মুক্তিকামী জনসাধারণ।
সেলা নদীর চরার ওপর পিঁপড়ার সারির মতাে গজিয়ে উঠেছে ব্যারাকের সারি। উলুখাগড়ার বন। গ্রানাইট পাথরের ছড়ানাে বােল্ডার, তপ্ত বালুচরের ওপর পূর্ববাংলার অগণিত শরণার্থী মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের মতাে উত্তাল জনস্রোত । মাথায় ছােট ছােট পুটলি, কাঁধে-পিঠে বাঁধা বুভুক্ষু বাচ্চার দল নিয়ে নিত্য চলেছে ওদের প্রব্রাজন । ইতিমধ্যে বিশ হাজার মানুষ এসে গেছে। আরাে আসছে। চারটা বাঁশের খুঁটির ওপর ভেঁড়া পলিথিনের টুকরাে বেঁধে গড়ে তুলেছে আস্তানা । একনাগাড়ে চলেছে বৃষ্টি, ছেড়া পলিথিনের ফুটো দিয়ে জলে-কাদায় ভরে গেছে মাথা গোঁজার জায়গাগুলাে। খিদেয়, বৃষ্টিতে, কলেরায় মানুষগুলাে যেন তালগােল পাকিয়ে গেছে। চোখগুলাে পাথরের মতাে নিষ্প্রভ, মুখে আতঙ্কের ছাপ। খালি পেটের কাপড় তুলে তুলে দেখাচ্ছে, অনেকদিন সেখানে একটা দানাও পড়েনি। মানুষকে মানুষই কেমন জন্তুর স্তরে নামিয়ে দিতে পারে। চারদিকে কলেরা, আমাশয় আর পচা মাংসের উৎকট গন্ধ। দাহ করার খড়ি ফুরিয়ে গেছে। শকুন ঘুরছে মরা মানুষের শবের ওপর, বালির তলা থেকে টেনে টেনে কুকুরে-শকুনে খুবলে খাচ্ছে মানুষের মাংস। সেলার নীল জলে যে রুপােলি মাছগুলাে এতােদিন আপন মনে খেলে বেড়াতাে তারা অদৃশ্য হয়েছে, জলে ভাসছে শিশুর শবদেহ।
শুধু সেলা নয়, বালাট, মাইলাম, ডাউকি, আমলারেং-মেঘালয়ের সীমান্তের জনমানবহীন রুক্ষ প্রান্তরে ব্যাঙের ছাতার মতাে সর্বত্র গজিয়ে উঠেছে এমনি অসংখ্য শরণার্থী শিবির। মানুষ হারিয়ে ফেলেছে আপন পরিজনকে, স্বামী-পুত্র এক শিবিরে, স্ত্রী-কন্যা অন্য কোথাও, কেউ কারাে খোঁজ পায় না।
২০
প্রায় তিরিশ লাখ শরণার্থী ভিড় করেছে শুধু মেঘালয়ের সীমান্ত শিবিরে। ওপারে পাকসেনাদের নরমেধযজ্ঞের সংবাদে বিচলিত হয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী খুলে দিয়েছেন সীমান্তের প্রাচীর । বুভুক্ষু মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দশ কোটি টাকা। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় তা সমুদ্রে বিন্দুবৎ। চিরকালই, সর্বত্র দুস্থের অসহায়তার সুযােগ নিয়ে কিছু সুযােগ সন্ধানী মানুষ তাদের মুখের অন্ন কেড়ে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তােলে, এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সরকারি অনুদান, বিদেশি দানসামগ্রী হাওয়া হয়ে গেছে। আহত মুক্তিফৌজের ছেলেরা যানবাহনের অভাবে খােলা প্রান্তরে পড়ে আর্তনাদ করে, রেডক্রসের গাড়ি ছুটে বেড়ায় ফুটবল মাঠে, প্রমােদ ভ্রমণে। কারাে পৌষ মাস, কারাে সর্বনাশ।
ছাউনিগুলাের ভেতরে ভেতরে ব্যক্তিজীবনের অসংখ্য কাহিনী আর জমাট বাঁধা অজস্র কান্না। কোনাে ব্যতিক্রম নেই। একটানা কান্না, আর ঘরভাঙার বিচিত্র অভিজ্ঞতা, শুধু একটি জায়গায় সবাই এক। ওরা চরম মূল্য দিয়ে এসেছে। মৃত, গুলিবিদ্ধ অথবা বন্দি অবস্থায় কাউকে না কাউকে ওরা পেছনে ফেলে এসেছে। ভীত-আতঙ্কিত মানুষ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে ওপারে রাজাকার আর খানসেনাদের হাতে বাংলার মেয়েদের চরম লাঞ্ছনার কথা বলতে থাকে। হা-হুতাশ করে আর চোখের জল মােছে । ক্যাম্পের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে মাইলখানেক হেঁটে এসে পৌছলাম সেলার শরণার্থী শিবিরের সাত নম্বর ব্যারাকে। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। পরনে আধময়লা হাঁটুর ওপর তােলা ধুতি। পিঠটা বেঁকে গেছে, অপুষ্টির ছাপ সমস্ত দেহ ঘিরে। তবু প্রতিজ্ঞায় বাঅয় দুখানি চোখ । বয়স সত্তর উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। এসাে মা এসাে। ভাবছিলাম কবে এসে স্বচক্ষে দেখে যাবে এখানকার অবস্থা। ছেলেরা বলছিল এই বয়সে ক্যাম্পের থাকা-খাওয়া শরীরে সইবে না। কলকাতায় এক আত্মীয় আছেন, সেখানে একটা ছাড়পত্রও যােগাড় হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু আজ আমার ক্যাম্পটাই মুক্তিবাহিনীর ছােট দুর্গ হয়ে উঠেছে। এই মুক্তিপাগল ছেলেগুলােকে ছেড়ে এই সময় নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে আমার বিবেক সায় দিল না। লড়তে হবে। মরতে হয় এখানেই মরবাে। তবু পালিয়ে যাবাে না।’ বৃদ্ধ উত্তেজনায় টগবগ করছেন।
ছােট ব্যারাকে বাঁশের মাচার ওপর লাইন করে শােবার ব্যবস্থা। প্রয়ােজন হলে জনাপঞ্চাশেক ছেলে রাত কাটিয়ে যায় এখানে।
একটু তফাতেই আস্তানা গেড়েছেন ময়মনসিংহের এক নামকরা উকিল, তার স্ত্রীছেলেমেয়ে, দাসদাসী নিয়ে। বস্তাবাধা কাঁসার বাসন, যাবতীয় ঘরগেরস্তালি। পাতার ছাউনির ঢাল দিয়ে জল পড়ে চলেছে। আমাদের খবর পেয়ে তিনিও ছুটে এলেন।
সাহেবের মতাে একসেন্ট দিয়ে ইংরেজি বলেন। কেতাদুরস্ত মানুষ, অবস্থা বিপর্যয়ে আজ সবার সঙ্গে অন্ন ভাগ করে খাচ্ছেন। সমাজের যে বিধান থেকে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের অন্ন স্পর্শ করে না, আজ অচলায়তনের সব গণ্ডি আপনিই ধসে পড়েছে। একই লঙ্গরখানায়, একই হেঁসেলে হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, অচ্ছুত সবাই একই অন্ন ভাগ করে খাচ্ছে।
কলেরার মড়ক লাগাতে যেসব লােক বাসন-কোসন, ঘরের টিনের চাল, সােনাদানা আনতে পেরেছিল এক একটা স্যালাইন ইনজেকশন ব্ল্যাক থেকে কিনতে তারা সর্বস্বান্ত পথের ভিখারি হয়ে যায়।
বৃদ্ধ হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের আদিবাড়ি বিশ্বনাথ থানার দিঘলী গ্রামে। সাত দেওয়ানের গা দিঘলী, যে দেওয়ানের ঘরে বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. সুন্দরীমােহন দাসের জন্ম হয়েছিল, দূর সম্পর্কে হেমেন্দ্র বাবু তাঁর আত্মীয়। পাকিস্তানি দস্যুরা যখন দেশময় হিন্দু দুশমন খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন ‘সুন্দরীমােহনের নামে তৈরি দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল, পাঠাগার সবকিছু পেছনে ফেলে কোনােমতে প্রাণটি সম্বল করে সপরিবারে ওরা ওপারে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিনকার বিত্তবান সমাজসেবী হেমেন্দ্র বাবুকেও গায়ে ‘রিফিউজি’ নামের লেবেল আঁটতে হলাে। যে লেবেল গায়ে আঁটলে রাতারাতি মানুষ অছুত হয়ে যায় । সভ্যজগতের ঘৃণা ও অনুকম্পার পাত্র হয়ে যায়। হেমেন্দ্র বাবু কিন্তু স্বেচ্ছায় সে লেবেল গায়ে এঁটে নিয়ে বৃদ্ধ স্ত্রীকেও জড়িয়ে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধের এই সামগ্রিক প্রস্তুতির মধ্যে। বৃদ্ধা তাই নিজের সন্তানদের পাশে ঠাঁই করে দিয়েছেন ঐ মুক্তিপাগল ছেলেগুলােকে। বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে দেহ, সাদা চুল, দাঁত পড়ে গেছে। রেশনের পুষ্টিহীন খাদ্যে তাঁরও দেহে ভাঙন ধরেছে। তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের পেয়ে বড় খুশি হলেন। বললেন, ‘মা দেখেছ একবার ছেলেগুলাের দিকে? এদের বয়স কত জান? ষােল থেকে পঁচিশ-তিরিশের মধ্যে। ওদের দেখি আর চোখের জলে বুক ভেসে যায়। কত মায়ের বুক খালি করে ওরা লড়তে নেমেছে। ক্যাম্পের বাচ্চাগুলাে তাে পুষ্টি আর কাপড়ের অভাবে জলে ভিজে, রােগে ধুকে এই শীতের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। স্কুল-কলেজে পড়া যে কয়েকটা জোয়ান ছেলে ছিল সব ক্ষেপেছে মুক্তিযুদ্ধে যাবে। আর তিনিও দিনরাত ওদের কানে ঐ মন্ত্রণাই দিচ্ছেন। দেশ যদি কোনােদিন স্বাধীন হয় তবে বলাে তাে মা আমরা কোন্ শ্মশানে গিয়ে আবার ঘর বাঁধবাে?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বেরিয়ে আসে তার বুকের ভেতর থেকে। একটু থেমে আবার শুরু করেন, এক কিস্তিতে তাে জোয়ান ছেলেগুলাে ওপারে প্রাণ দিয়ে এসেছে। আজ আবার নতুন করে এই মরণযজ্ঞে প্রাণ দেয়ার জন্য ওরা ক্ষেপেছে, কোথায় তিনি বাধা দেবেন, না বুড়াে বয়সে নিজেই মেতে উঠেছেন ওদের সঙ্গে।’ আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখটা মুছে নিলেন। হেমেন্দ্র বাবু স্ত্রীর কথায় বিরক্ত হয়ে বললেন, আজকের দিনে চোখের জল ফেলে মনটাকে দুর্বল করতে নেই। ছেলেদের ক্ষতি হয় তাতে।
২২
ইতিমধ্যে আরেকটি ছেলে এসে ঘরে ঢুকলাে। কদর অবাক হয়ে তাকাল ওর মুখের দিকে। “আরে সিরাজ তুই তাে ভেতরে ছিলি, কবে এলি আবার।
সিরাজ মাটিতে বসে পড়লাে। শুধু আমি নই তাহেরপুর, সাচনা থেকে বিরাট একটা দল আজ বালাটের ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে। যখন আসি আমাদের গ্রাম তখন শাশান। চারদিকে আগুন জ্বলছে। একটা জনপ্রাণী নেই। একটা ঘরে ঢুকে দেখি ভাঙা পাতিলে অল্প ভাত পড়ে আছে। কুকুরে চেটে চেটে ভাত খাচ্ছে। সারা গ্রাম সুনসান, শুধু শিয়াল-কুকুরের ডাক। আমাদের সােনার দেশটাকে ওরা শ্মশান বানিয়ে দিল রে।’
লম্বা ব্যারাকের ফাটা বাঁশের ভেতর দিয়ে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রােদুর ঘরের ভেতরটা তাতিয়ে তুলেছে। দম যেন বেরিয়ে আসার যােগাড়। মাচার এককোণে গােটা তিন ছােট ছােট শিশু (ওঁদের নাতি, নাতনি) একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। গত এক মাসের ওপর থেকে ওরা আমাশয় কাহিল, হাড়ি জিরজিরে শরীর। ক্যাম্পের চতুর্দিকে কলেরা আর আমাশয় । পুরাে ঘরটা মাছিতে হেঁকে ধরেছে। বাচ্চাগুলাের চোখ-মুখ মাছিতে ঢাকা। বেড়ার ওপাশে একপাল ছােট ছােট ছেলেমেয়ে। তারাও তারস্বরে চিৎকার করে বিচিত্র ঐকতানের সৃষ্টি করেছে। সবাই পেটের ব্যথায় ভুগছে। চারদিকে প্রচণ্ড শব্দ, মানুষের কাতরানি আর কান্নার আওয়াজ। এই দুস্থ রােগজীর্ণ মানুষগুলাে যেন একলা আবর্জনার মতােই অর্থহীন। এরা কি সেই একই মানুষ, যারা কোনােদিন শিল্পকলা সৃষ্টি করতাে, গান গাইতাে, লােকনৃত্যের নানা ভঙ্গিমায় জীবনটাকে সরস করে তুলতাে! কোন অশুভশক্তির পাপস্পর্শে মানুষ আজ মানুষের অপভ্রংশে পরিণত হয়েছে!
মাসিমার পাশের ব্যারাকের একটিতে থাকে এক মুচি পরিবার, অন্যটিতে এক মেথর পরিবার। তাদের প্রতিটি খুপরিতে দশ-বারােটি করে বাচ্চা। সবাই যেন কমপিটিশন দিয়ে চিৎকার করে চলেছে।
ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবাই আজ মিলেমিশে একাকার। এই বিপর্যয়ের দিনে মনুষে মানুষে যে মিলন ঘটলাে এটা কি স্থায়ী রূপ নেবে?
মাসিমার সঙ্গে আরেকটি খুপরিতে গিয়ে চমকে উঠলাম। ষােলাে-সতেরাে বছরের একটি মেয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বসে আছে। দু’তিনটি ছেড়া গেঞ্জি যােগাড় করে তালি লাগিয়ে একটা আচ্ছাদন তৈরি করার চেষ্টা। আমাকে দেখেই গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই প্রথম কথা, ‘দিদি একটা শাড়ি দেবেন?’ মাথায় জট পড়ে গেছে, শরীরের রুক্ষ চামড়া যেন ফেটে পড়বে। লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললাে, “দু’সপ্তাহ স্নান করিনি, পরনে শাড়ি নেই, নদীতে যাই কেমন করে, লজ্জা করে।’
হঠাৎ পা দুটি জড়িয়ে ধরে আমার । ঘর-গেরস্তালির দিকে তাকানাে যায় না, যেন এক আঁস্তাকুড় ।
বেড়ার ওদিক থেকে মাসিমা ডাক দিলেন, আর কত দেখবে মা। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্যাম্পের মানুষগুলাের তদারক করি, কে রেশন পেল, কে পেল না। ওঁর কড়া হুকুম দুপুরে শুয়ে-বসে সময় যেন নষ্ট না করি । এই শরণার্থী মেয়েদের নিয়ে সমিতি একটা খুলেছি। তােমরা শহর থেকে যদি কিছু কাপড়, সুতাে, প্লাস্টিকের ফিতা, কাগজ যােগাড় করে দিতে পারাে, তবে এই গরিব মেয়েগুলাে দু’পয়সা রােজগারের একটা পথ পায়, সবার হাতই শূন্য।
মনে মনে শ্রদ্ধা জানাই। এমন অসহনীয় পরিবেশে সবাইকে নিয়ে একটু গুছিয়ে বসার চেষ্টা। কোনাে আলস্য নেই, হতাশা নেই, নিজে বাঁচা ও অন্যকে বাঁচানাের তাগিদ।
ব্যারাকে নিজের ডেরাটা লেপাপােছা করে, ভাঙা চালার নিচে একটি পরিপাটি গেরস্তালির পরিবেশ তৈরি করার কী অক্লান্ত প্রচেষ্টা।
এঁরা সেই মানুষ যারা পরাজয়ের কাছে নতি স্বীকার করেন না, বাধাকে অতিক্রম, করে জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন।
উনুনের মধ্যে দুটি ভেজা খড়ি ঢােকানাে আছে। সমানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানাের চেষ্টা করছেন। ধোয়ায় ঘর আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, চোখ লাল হয়ে জ্বলতে শুরু করেছে সবার! কিন্তু আগুন আর জ্বলছে না। | ‘কী বলবাে মা, মেঘালয়ের এক মিনিস্টার এসেছিলেন। বলে গেলেন জ্বালানির জন্য একটা খড়িও জঙ্গল থেকে কাটা চলবে না। ঠিক আছে, তবে অন্য কিছু জ্বালানির ব্যবস্থা করে দাও। রাঁধবাে কেমন করে? সেদিন ক্যাম্পের দুটি ছেলে কাঠের সন্ধানে জঙ্গলে গিয়েছিল, কয়েকটি খাসি ছেলে মেরে তাদের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। যারা শিলংয়ে কোনাে আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নিতে যেতে চায়, মাঝ রাস্তায় তীর ধনুক লােহার রড নিয়ে ওরা মারধর করে। বলে, ক্যাম্পের কলেরা শহরে চলে যাবে। আমাদের হয়েছে মরণ। ওপারে পাকসৈন্য মারে। এপারে আমরা গলগ্রহ, অবাঞ্ছিত, এমন কপাল না হলে কি আর বাঙালি হয়? পুল থেকে যেসব কাঠ ভেসে আসে সেগুলাে ভেজা, তাতে কি রান্না করা চলে? খালি ফু দেয়াই সার। সকালে হাঁড়িতে ভাত চড়াই, সন্ধ্যা হয়ে আসে, ভাত আর ফোটে না। আশপাশে ঝােপঝাড়, লতাপাতা, উলুখাগড়ার বন তাে সব সাফ । মেয়েদের এখন আব্রু বলতে কিছু নেই। এসব স্কুল-কলেজে পড়া মেয়েগুলাে কোথায়-বা যায় পায়খানায়, কোথায়-বা যায় বাইরে। চারদিকে ধু-ধু বালির চর খালি খাখা করছে।’
ছােট মিক্সচারের বােতলে বরাদ্দ রেশনের শর্ষের তেল কড়াইয়ে ঢালতেই পাত্রখানি ফেনায় ভরে উঠলাে। হােয়াইট অয়েল না মবিল, কী যে সব ভেজাল মিশিয়েছে তেলে ভাবা যায় না।
মনে পড়লাে গত সপ্তাহে আমলারেং ক্যাম্পে গিয়ে দেখি, এক সপ্তাহে আশিজন লােক উদরিতে মারা গেছে। অন্যদের অনেকেই রােগাক্রান্ত। পেস্টার ইনস্টিটিউটে
পরীক্ষা করে দেখা গেল, মানুষের খাওয়ার অযােগ্য ভেজাল তেল মেশানাে হয়েছে। তেলের যােগানদাররা মাটির বাড়ি ভেঙে আরসিসি বিল্ডিং তুলছে। মরলােই- বা কিছু মানুষ, তারা তাে মানুষ না, রিফিউজি ।
বহু পরিশ্রম করে দু’খানা ডিম ফেটিয়ে মাসিমা ডিম অমলেট করে কদরকে সিঁড়ি পেতে যত্ন করে খেতে দিলেন। | ‘ছেলেরা ওঁকে ভালােবাসে তাই ভেতরে গেলে ডিমটিম ভালােমন্দ কিছু পেলে আমার জন্য নিয়ে আসে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একসঙ্গে জনাতিরিশেক ছেলে এসে হাজির হয়, ‘মাসিমা খেতে দিন, ভেতরে যেতে হবে। সরকারি কাকরভরা চাল। তাই সবার কাছ থেকে ভিক্ষা করে একমুঠো একমুঠো ঘরে এনে রাখি, কখন কে এসে হাজির হয় ঠিক নেই তাে। এই বুড়াে বয়সে শরীরে কি অত ধকল সয়? তা তােমাদের ঐ মেশাে । কোনাে কিছু বলার জো আছে? ঐ এক কথা, পেটের ছেলেরা লড়তে যাচ্ছে, তাদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। এর ওপর তাে আর কোনাে কথা বলা চলে না।’
কদর গােগ্রাসে অমলেটের সদ্ব্যবহার করছে, তার কিছু শােনার কথা বলার সময় নেই। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে অতিথি সত্ত্বারের পুরনাে অভ্যাসটি মনে পড়ে যায় মাসিমার ।
ওমা, তােমরা আবার উঠছাে কোথায়। এটা কি একটা কথা হলাে? গরিবের ঘরে আজ যখন অতিথি হয়ে এসেই পড়েছ তখন দুটি সেবা করে না গেলে ছাড়ছি না মােটে ।
তেলের গন্ধে তখন বিলক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছি, পেট গুলােতে শুরু করেছে। মাছি ভনভন করছে বাসনে কাপে প্লেটে।
মুখে বললাম, ‘এই তাে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি। আপনাদের অভাবের দিন, তার ওপর অত ক’টা ছেলের মুখের অন্ন যােগাতে হচ্ছে। তার ওপর আবার এ হাঙ্গামা কেন? দেশ স্বাধীন হােক তখন প্রাণভরে খাওয়াবেন, কোনাে আপত্তি করবাে না।’ পেছন থেকে মাসিমার ছােট ছেলে টিপ্পনী কেটে ওঠে, | ‘মিছেমিছি সাধছাে কেন মা? ওঁদের কি আর রিফিউজিদের খাওয়া মুখে রুচবে? মনে মনে ভাবলাম সত্যিই তাে, প্রতিকূল অবস্থাই মানুষকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করে। আমায় যদি রিফিউজি হয়ে ক্যাম্পে বাস করতে হয় তবে নিরুপায় হয়ে মবিল তেলের রান্না খেয়ে আমাকেও অকালে মৃত্যুর দিন গুনতে হতাে।
মাসিমা মনে মনে খুবই ক্ষুন্ন হলেন। ছেলেটি ব্যঙ্গের হাসি হাসলাে।
২৬
ইতিমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ছাতা বগলে, হাঁটুর উপর তােলা ধুতি পরা হেমেন্দ্র বাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। কোনােদিকে না তাকিয়ে ধপ করে মাটির ওপর বসে আর্তনাদ করে উঠলেন। মাসিমা উদ্বেগে উঠে দাঁড়ালেন। ‘কী হয়েছে গাে? অত উতলা হচ্ছে কেন?
বৃদ্ধের গলা দিয়ে ভাঙা ভাঙা আর্তনাদ বেরিয়ে এলাে। দুহাতে মাথা চেপে ডুকরে ডুকরে উঠলেন, বড় খারাপ খবর। খানসেনারা গ্রামের যেসব মুসলমান পরিবার পালিয়ে আসতে পারেনি তাদের মেয়েদের আর ভিড় করা শরণার্থীদের দল থেকে হিন্দু যুবতী মেয়েদের ধরে মিলিটারি ছাউনিতে নিয়ে গেছে। তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চলছে। খবর এসেছে শাড়ির খুঁটে দড়ি বানিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করার পর ওরা শিবিরে মেয়েদের এখন উলঙ্গ করে রেখেছে। লম্বা চুল ছিল যাদের তা হেঁটে দিয়েছে।’
মাসিমা কপাল থাবড়ে কেঁদে উঠলেন। কদর রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়াল। ‘আশীর্বাদ রাখবেন দাদু। এর বদলা আমরা নেবােই।’
ইতিমধ্যে রাইফেল কাঁধে আরেকটি ছেলে এসে দাঁড়ায় দরজায় । কদর চেঁচিয়ে ওঠে, এসে গেছিস নিরঞ্জন! আর দেরি নয়, চল।’
শরণার্থী শিবিরের ঘিঞ্জি জোড়াতালি দিয়ে ঠেকানাে আস্তানা ঝড়ের বেগে নিষ্ক্রান্ত হলাে কদর আর নিরঞ্জন। মুখে বিড়বিড় করা কী এক ভয়ঙ্কর শপথ উচ্চারিত হলাে ওদের কণ্ঠ থেকে ।
কাদায়, মাটিতে, হাওরের কোমর জল ভেঙে অন্ধকার রাতের গভীরে কোথায় মিলিয়ে গেল ওরা।
২৭
বাঁশতলা
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মারফত বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে পাকবাহিনীর পশ্চাদপসরণের সংবাদ এসে পৌছুচ্ছে। মেঘালয়ের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম বাঁশতলা। সেখানে মুক্তিবাহিনীর আর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মেঘালয় পাহাড়ের গায়ে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ জমা হতে থাকে। তারপর খরধারায় জলের স্রোত নেমে আসে বাংলাদেশের খালে, বিলে, নদীতে, হাওরে ।
এমনি একটি খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর ওপর দু’খানি বাঁশ ফেলে তৈরি করা হয়েছে একটি সাঁকো। বর্ষার জল পড়ে পড়ে একেবারে পিছল হয়ে আছে। মুষলধারে বৃষ্টি। মাথায় ছাতা, হাতে বাঁশতলা হাসপাতালের জন্য কিছু ওষুধপত্র ও সামান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। ওপারে দাঁড়িয়ে মুক্তিবাহিনীর কিছু ছেলে আমাদের এস্ত পায়ে পুল পেরােনাে দেখে একটু কৌতুকের হাসি হাসলাে। অতি সন্তর্পণে ভারসাম্য রক্ষা করে সার্কাসের রােপ ডান্সারদের মতাে পায়ে পায়ে এগােচ্ছি। সঙ্গে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের এই অঞ্চলের নেতা হক সাহেব । দৈবাৎ এই রকম একজন নিঃস্বার্থ, দরদি মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। অনেকের মতাে শিলংয়ের রেস্ট ক্যাম্পের বিলাসবহুল জীবন তিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ান। মুক্তিবাহিনীর ছেলেগুলাের প্রয়ােজনের তদারকি করেন, তাদের চাহিদা তুলে ধরেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দপ্তরে । শরণার্থীদের বরাদ্দ রেশন ঠিকমতাে পেঁৗছুচ্ছে কিনাএসব দায়িত্ব নিয়ে উদয়াস্ত শিবির থেকে খোঁজখবর নেয়া তাঁর প্রাত্যহিক রুটিন।
শিলংয়ের রেস্ট ক্যাম্পে বাংলাদেশের নেতাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। সেখানে এক সাহেব, ব্যারিস্টার মােমতাহিন সাহেব, আওয়ামী লীগ নেতা কামারুজ্জামান সাহেব, সুরঞ্জিত সেন, বিধু দাস গুপ্ত, মােয়াজ্জেম আহমেদ, ডা. চঞ্চল দেওয়ান, রওনক চৌধুরী, সৈয়দ রশীদুন নবী এবং বেশ কিছু আর্মি অফিসারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে।
সাঁকো পেরিয়ে ওপারে পৌছে থমকে দাঁড়ালাম। আকাশ-ছোঁয়া বাঁশের প্রাচীর । চারদিক গােল করে ঘেরা, শুধু সামনে একটি প্রবেশের পথ। সেখানে রাইফেল কাঁধে মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে দু’জন প্রহরী। হক সাহেবকে দেখেই স্যালুট করে আমাদের
২৮
ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিল। প্রাচীর পেরিয়ে আবার একটি প্রাচীর। সেখানেও ছাড়পত্র পাওয়ার পর ভেতরে ঢুকে দেখি জনাপঞ্চাশেক ছেলে কুচকাওয়াজ করছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, খালি পা, মুক্তিবাহিনীর ছেলে। কিছুক্ষণ কুচকাওয়াজের পর আমাদের সম্মানে তাদের ছুটি দেয়া হলাে। ওরা মাটিতে গােল হয়ে ঘিরে বসলাে। ছেলেদের চোখ আমাদের ঝােলার দিকে। এতগুলাে ছেলে আর অতি সামান্য কিছু খাবার- সবাই পরম আনন্দে ভাগ করে খেল। এবার বক্তৃতার পালা। ভারতের লােক হিসেবে তাদের নেতা আমাকে কিছু বলার জন্য অনুরােধ করলেন। মনে মনে আমি যেন বলিভিয়ার জঙ্গলে চলে গেছি- সেই চে গুয়েভারা। সেই অধভুক্ত গেরিলা সৈনিকের দল। আমি দেশপ্রেমের ওপর একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করলাম। ইতােমধ্যে খবর এলাে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর ছেলেভর্তি একটি বাস লড়াইয়ের ময়দানে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিল। হঠাৎ ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, বাসভর্তি ছেলেরা পাহাড়ের ওপর থেকে খাদে পড়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। হক সাহেবকে সেখানে যেতে হবে । হক সাহেব আমাদেরও সঙ্গে নিতে চাইলেন। | গিয়ে দেখি অস্থায়ীভাবে মাথার ওপর একটি চালা তুলে মাচাংয়ের ওপর সারিবদ্ধভাবে তাদের শুইয়ে রাখা হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার কোনাে ব্যবস্থা হয়নি, কোনাে ডাক্তার এখন পর্যন্ত এসে পৌছাননি। ছেলেগুলাে প্রচণ্ডভাবে কাতরাচ্ছে। ফাটা মাথা, শরীরের হাড়গােড় ভাঙা, এক অসহনীয় দৃশ্য। তারই মধ্যে জাফরি কাটা বাঁশের দেয়ালে কিছু উৎসাহী ছেলে পাক আর্মির অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু পােস্টার এঁকে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমাদের দেখেই অল্প বয়সী কয়েকটি ছেলে হাতজোড় করে এসে দাঁড়ায় ।
‘দিদি যে করেই হােক ওষুধ আর ডাক্তার পাঠান, এদের কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না।’
ওদের ওষুধ আর ডাক্তারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম ।
পরে গুরুতরভাবে যারা জখম হয়েছিল তাদের শিলং মিলিটারি হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাদের জন্য হরলিক্স, কমলা, কলা ইত্যাদি নিয়ে আমরা যখন মিলিটারি হাসপাতালে যাই, তখন গিয়ে দেখি বহু ভারতীয় সৈন্য কারাে-বা পা উড়ে গেছে, কারাে চোয়ালের হাড় ভাঙা, মুখে জল দিলে তা গড়িয়ে বাইরে পড়ে যায়, কারাে বুকে-পেটে বুলেট। এমনি বহু ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের হয়ে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে বা পঙ্গু হয়ে গেছে। এদের নাম কোনােদিন কেউ জানবে না, শহীদ ফলকে এদের নামও কোনােদিন উঠবে না।
দোয়ারাবাজার
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে চলেছি। বিধ্বস্ত গ্রাম, আধপােড়া ভিটেমাটি, গােড়া থেকে কেটে ফেলা লকলকে লাউয়ের ডগা। ভাঙা হাঁড়ি, ভাঙা উনুন, জনমানবহীন শ্মশানের স্তব্ধতা। এ যেন তৈমুর লঙের পুনরাগমন।
কিছু পথ হাঁটার পর দেখা গেল কিছু মানুষ দল বেঁধে ভাঙা টুকরি মাথায়, কাঁখেকোলে বাচ্চা নিয়ে চলেছে। জিগ্যেস করলাম, কোথায় চলেছ?’ বলে, ‘খবর আইছে পাঞ্জাবিরা আমাগাে গ্রাম ছাইড়া পলাইছে। আবার ভিটামাটি বানাইতে হইবাে। কদ্দিন আর গাছতলায় থাকতাম।’
জীবন্ত কঙ্কাল সব হেঁটে হেঁটে চলেছে ভিটের টানে, মাটির টানে। কিছুদূর চলার পর কয়েকটি মুক্তিবাহিনীর ছেলে এসে আমাদের সঙ্গ নিল । সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। কাঠফাটা রােদুর। ছেলেরা বললাে, “দিদি সাবধানে যাবেন, ক্ষেতে-খামারে, পথে-ঘাটে ওরা মাইন পুঁতে গেছে। কখন যে কার হাত-পা উড়ে যায় তার ঠিক নেই। সেদিন এক ভারতীয় মেজর সাহেবের পা উড়ে গেছে। আমাদের কিছু ছেলেও গরু চড়াতে গিয়ে মরেছে।’
বেরিয়েছি যখন, আর ফেরার পথ নেই। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কানে ভেসে এলাে মানুষের গুঞ্জন। তাকিয়ে দেখি পুরাে গ্রাম দা, কোদাল, কুড়াল হাতে জোর কদমে মাটি কেটে চলেছে। নালাখন্দ মাটি দিয়ে ভরাট করে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে পুল বানাচ্ছে। জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার? ওরা মুখ তুলে তাকাল। কাদায় মাটিতে ঘামে পরিশ্রমে বিধ্বস্ত চেহারা। একজন হক সাহেবকে দেখে এগিয়ে এলাে, ‘মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ এসেছে, একদিনের মধ্যে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে গর্তটর্ত ভরাট করে রাস্তা বানিয়ে দিতে হবে। মুক্তিবাহিনীর জিপ গাড়ি, সামরিক অস্ত্রসম্ভার নিয়ে এই পথ দিয়ে ছাতকের দিকে এগােবে।
মনে পড়লাে মাওয়ের আমলে ইয়াংসি নদী কেটে লালফৌজের খাল বানানাের সেই রােমাঞ্চকর কাহিনী । আদর্শ আর বিশ্বাস যখন সম্পূরক হয় তখন কত অসাধ্য সাধনই ঘটে যায়। ওদের বুকেও আজ তেমনি উদ্দীপনা। ওরা স্বপ্ন দেখছে এক স্বাধীন শৃঙ্খলমুক্ত বাংলাদেশের।
৩০
হক সাহেব ওদের বললেন, ‘খুব খিদে পেয়েছে, সকাল থেকে এক পেয়ালা চা ছাড়া কিছু জোটে নি। ছেলেগুলাে উৎসাহে আঙুল উঁচিয়ে দেখালাে পান, সুপুরি, নারকেল গাছে ঘেরা একটা দোতলা বাড়ির দিকে। বললাে, “চলুন আমাদের সঙ্গে।’
লুঙ্গিপরা মাঝবয়সী মােটাসােটা একটি লােক, গায়ে গােলাপি রঙের ডােরাকাটা হাফ শার্ট পরে বেশ ভােস মেজাজে দাওয়ায় বসে মৌজ করে হুঁকো টানছে। এবড়ােখেবড়াে দাঁতগুলাে পান খেয়ে লাল। পেটে জমা চর্বি লুঙ্গির ওপর দিয়ে যেন ঠেলে বেরুচ্ছে। গ্রামের ছেলে কুদ্স এগিয়ে গেল ।।
‘ও লালু মিঞা, বহুত মেহমান আনছি, একটু ভাত-মাছের ব্যবস্থা করতা হইব।’ লালু মিঞা পান খাওয়া বিবর্ণ দাঁতগুলাে বিস্ফোরিত করে আকর্ণ হেসে বললাে,
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, এ তাে আমার সৌভাগ্য। হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান মিঞা সাহেব, ছুটে যান অন্দর মহলের দিকে।
‘বুঝলেন মাসিমা, এ মানুষটি এ অঞ্চলের জমিদার । পান, সুপুরি, নারকেল বেচে বহুত আয়। তাছাড়া বর্ডার থেকে ইন্ডিয়ায় চোরাকারবারও করে। এ অঞ্চলের অর্ধেক ধানের জমি তাে ওরই দখলে। তিন তিনটা বিবি। দুটি এই গ্রামের নিজের জাতের, আরেকটা গারাে। গারাে বৌটারও বহুত জমিজমা। মিঞার তাই আহ্লাদ ধরে না। তার সঙ্গেই থাকে বেশি। এতদিন পাকিদের পক্ষ নিয়ে গ্রামে দাপিয়ে বেড়াতাে। এখন ওদের পিছুহটা দেখে আমাদের খাতির করছে।’ | মিঞা অন্দর থেকে বেরিয়ে এলাে। মুখে বিনয়ের বিগলিত হাসি।
বসেন সকলে মেহেরবানি কইরা। ওরে জব্বর মেহমান আইছেন চৌকি কুরশি লইয়া আয়। হুক্কাটায় আগুন দিয়া যা জলদি। আরে, হালার বেটা পান-তামুল এখনাে দিসস না? বেয়াকুফ।
কুদ্স গ্রামের মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়েছে। পিঠে বন্দুক, মনে বল। এতদিন লালু মিঞার ত্রিসীমানায় মুখােমুখি হওয়ার সাহস এদের ছিল না। গ্রামজীবনের এই সার্বিক দখলদারির বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ জানালে লালু মিঞার লেঠেল বাহিনী তেড়ে এসে প্রতিবাদীর মাথা ফাটিয়ে ভিটে জ্বালিয়ে দিত। আজ জাগ্রত যুবশক্তির সংহতির সামনে লালু মিঞাদের পিছু হটতে হয়েছে।
‘মিঞা, বিলের বড় সাইয়া কৈ মাছ গুলান উঠাইন যেন।’ আরেকটা ছেলে ফোড়ন কাটে।
মিঞা হেসে বলে, ‘হইব, হইব। রুই-কাতলা পাবি। জাল ফেলতা কইসি না?
‘হ, মিঞা সাহেব সবাই কয় হাদিন বাঙলায় বলে সমাজবাদী দ্যাশ হইব। ধনীগরিবের হমান অধিকার। আগের জামানা আর চলতাে না। হলে ভাগ কইরা একই অন্ন খাইতে হইব।’ মিঞা সাহেবের মুখটা থমথম করে। বুকে জ্বালা ধরে। দু’দিন
আগেও যে ছােড়াগুলাে পায়ের নিচে নুইয়ে থাকতাে, চোখের দিকে মুখ তুলে তাকাতে সাহস করতাে না, আজ তাদের কী আস্ফালন। কিন্তু নিরুপায়, সময়ের সঙ্গে ভােল না পাল্টালে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। মুখে কাষ্ট হাসি টেনে বলে, ‘হইব, হইব। অখন তুরা একটু চুপ কর । হক সাহেবের লগে দুটা কথা কইতে দে।’
হক সাহেব বলেন, “মিঞা দেশের পরিস্থিতি বদলেছে, পাকসৈন্য বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হতে আর বেশি দিন বাকি নেই। ছাতকের পর সিলেটের খাদিমনগরে আমাদের শেষ যুদ্ধ । তারপর নতুন দেশের জন্ম হবে। আমরা স্বাধীন হবাে । পাকিস্তানের গােলামি করে আর থাকতে হবে না। বাংলা হবে মাতৃভাষা, উর্দু মেশানাে খিচুড়ি ভাষা বন্ধ হবে। বাংলাদেশ হবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশ। মানে গরিব মানুষ জমির মালিক হবে। নিজেদের খেটে ভােলা ধান জমিদারের গােলায় না তুলে এবার নিজের গােলাতেও তুলতে পারবে।’
ছেলেগুলাের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মিঞা ম্রিয়মাণ। বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস ওঠে কিন্তু চেপে যায় মনের কথা।
মনে পড়লাে শিলং মিলিটারি ক্যাম্পের বড় আর্মি অফিসারদের বৌদের কথা। ট্রাঙ্কভর্তি বেনারসি, সােনা-রুপাের জরিকাজের শাড়ি দেখিয়ে বলেছিলেন, বাচ্চাগুলাের জন্য দুধ কেনার পয়সা নেই, সবই তাে ওপারে ফেলে এসেছি। দিদি এই শাড়িগুলাে বিক্রি করে দিতে পারবেন? শুনেছি এই যুদ্ধের শেষে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে। আমরা আর ক্লাবে যেতে পারবাে না। পার্টি থ্রো করা চলবে না। ডান্স নাইট বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সাজগােজ করলে অন্যদের চোখ টাটাবে। কী হবে আর এসব শাড়ি নিয়ে। ওরা তাে এসব আর পরতে দেবে না। দিন না ভাই এগুলাে বিক্রি করে, বেশিরভাগই নতুন।’
হেসে বলেছিলাম, যাদের এসব দামি শাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে তারা সেকেন্ড হ্যান্ড কিনবে কেন?’
আর্মির মধ্যে, মুক্তিবাহিনীর মধ্যে, শরণার্থীদের মধ্যে, গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখেছি একই প্রত্যয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পরিকাঠামাে হবে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ।
মাইলাম ক্যাম্প
খাওয়া-দাওয়ার পর হক সাহেব জরুরি তলবে অন্যত্র চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, আর বেশি দিন নয় । দাওয়াত রইলাে দিদি, স্বাধীন বাংলায় আসবেন আমাদের দেশে, আপনাদের জন্য কিছু করতে পারলে আমরা ধন্য হবাে।’ বাঁশতলার পর এবার আমাদের গন্তব্যস্থল বালাটের মাইলাম ক্যাম্প। এখান থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব দশ-পনেরাে মাইলের বেশি নয়। মাইলাম ক্যাম্প থেকে রাকেশ দাস বারবার অনুরােধ করে পাঠাচ্ছেন আমরা যেন সরেজমিনে গিয়ে সেখানকার অবস্থা দেখে আসি। রাকেশ বাবু সুনামগঞ্জ অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী। পাক হানাদারদের আক্রমণের মুখে গ্রামসুদ্ধ লােকের সঙ্গে তিনিও প্রাণরক্ষা করে চলে এসেছেন মাইলামের শরণার্থী শিবিরে ।।
বাংলাদেশের জিপে চড়ে রওনা হলাম মাইলামে। ধারালাে বর্শার ফলার মতাে বৃষ্টির ধারা। জিপের উইন্ড স্ক্রিন জলে ঝাপসা, কুয়াশায় চারদিক আচ্ছন্ন। নিজের হাতও যেন দেখা যায় না, পথের কোনাে চিহ্ন নেই। পাহাড়ে ধস নেমে কাদা আর কাঁচা মাটিতে জিপের চাকা বারবার ডেবে যায়, জিপ কাত হয়ে পড়ে, কোনােমতে ঠেলেঠুলে আবার যাত্রা। চালক মুয়াজ্জেম চৌধুরী একসময় আমাদের সঙ্গে স্টুডেন্ট ফেডারেশনে কাজ করতাে।
কপালে মরণ না থাকলে মানুষ মরে না। আমরা এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা গেল ক্যাম্পের মিটিমিটি আলাে। এক অনন্ত শূন্য থেকে যেন শুনতে পেলাম মাটি থেকে পাক দিয়ে দিয়ে উঠে আসা জমাট বাঁধা এক কান্নার সুর, যার কোনাে ভাষা নেই। দূর থেকে কানে ভেসে আসে খােল আর কীর্তনের সুরের বিষন্ন আকুতি। মানুষ তবে এখনাে গান গায়?
ক্যাম্পের সামনে জিপ দাঁড়াতেই একগাদা বাচ্চাকে দিতে দিতে ছুটে এলেন মাঝবয়সী, বেশ মজবুত কাঠামাের কৃষ্ণকায় এক ভদ্রলােক। বড় বড় দুটি চোখে গভীরতা এবং সংবেদনশীলতার ছাপ। একগাল হেসে নমস্কার করে বললেন, ‘দিদি আমিই রাকেশ দাস। কতদিন ধরে পথ চেয়ে আছি, কবে এসে স্বচক্ষে দেখে যাবেন কোন্ নরকে বাস করছি আমরা। দিদি, সমুদ্রের ঢেউ কখনাে দেখিনি, এবার দেখলাম
মানুষের ঢেউ। ঢেউয়ের মতাে দলে দলে মানুষ এসে আছড়ে পড়ছে শরণার্থী শিবিরে। সাড়ে তিন লাখের ওপর মানুষ এসে গেছে। এদিকে মেঘালয় বর্ডারে আমরা এখন সাত লাখে দাঁড়িয়েছি। ইন্দিরাজি আজ বর্ডার খুলে না দিলে পাক আর্মির হাতে আমরা কচুকাটা হতাম। ওদের অস্ত্র আছে, আমরা নিরস্ত্র । ওরা প্রথমত হিন্দু খুঁজে খুঁজে মেরেছে। তারপর রাজাকার বাহিনী মুসলমানদের ভেতর কারা ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়েছে, কারা মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলার ডাক দিয়েছিল, তাদের চিহ্নিত করে ওদের জানিয়েছে। ফলে কত যুবক, কত বুদ্ধিজীবী আর শিক্ষকদের ওরা গুলি করে মেরেছে!
এখন এক নরক থেকে আরেক নরকে এসে পড়েছি। চারদিন হলাে রেশন এসে পৌছয়নি অথচ ভারত সরকার দশ কোটি টাকা শরণার্থীদের রেশনের জন্য বরাদ্দ করেছেন। রােজ দু’বেলা বালাট নদী সাঁতরে এপারে আসি রেশনের তদারকি করতে, বাচ্চাদের তাে খিদে মানে না। মানুষগুলাে খিদেয় পাগল হয়েছে, জল খেয়ে তাে খিদে মেটে না। রেশন আসে ঠিকই কিন্তু মাঝপথে সব হাওয়া হয়ে যায়। অধিকাংশই নিরক্ষর মানুষ, নাম লিখতেও জানে না। চাল, তেল, চিনি না পেয়েও রেশন পেয়েছে। বলে টিপসই দিয়ে দেয়। সারাদিন রােদে দাঁড়িয়ে, নিরাশ হয়ে ফিরে আসে বলে, রেশন নেই। দিনরাত লাইনে দাঁড়িয়ে আছি আমিও ওদের সঙ্গে। শঙ্খ ঘােষের কবিতার লাইনটা মনে পড়ে গেল
‘লাইনেই তাে ছিলাম বাবা।’
আমাদের ছনের ছাউনি এই নিয়ে তিনবার কারা আগুনে পুড়িয়ে দিল। বােধহয় দপ্তরের হিসাবের খাতাগুলাে পােড়ানােই ওদের লক্ষ্য ছিল। আবার কোনােমতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছি।
দূরে কীর্তনের সমবেত কণ্ঠস্বর তখন সমে এসে ঠেকেছে। আকাশে গােধূলির শেষ আলাের রেখা। এরই মধ্যে বালাটের জলে সেই আলাে পড়ে অসুন্দরকেও যেন সুন্দর করে তুলেছে।
রাকেশ বাবুকে প্রশ্ন করলাম, এরই মধ্যে কারা কীর্তন করছে রাকেশ বাবু?’
‘বােঝেন না দিদি, মৃত্যুর পাশে দাঁড়িয়ে একটু অমৃতের স্বাদ পাওয়া। কী আছে আমাদের সামনে? পেছনে ফেলে আসা দুঃস্বপ্নের স্মৃতি, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাই লােকে নিজেকে ভুলে থাকতে গান গায়, তুলসী তলায় সন্ধ্যাবাতি দেয়, ছেড়া শেওলা ভরা পলিথিনের চালায় লাউ-কুমড়াের ডগা তুলে দেয়। বিপদনাশিনীর পুজো করে। অঘটনের হাত থেকে রক্ষার জন্য যুবতী মেয়েদের বিয়ে দিতে বাঁশের ছাদনাতলায় নিয়ে আসে। বুড়িরা বিয়ের গীত গায়, এরই মধ্যে চার চক্ষের মিলনও ঘটে। আমিও বলি ওদের, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ- ভেঙে পড়লে চলবে না।
৩৪
রাকেশ বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি। এখনাে শিরদাঁড়া কেমন খাড়া করে রেখেছেন। এ রকম মৃত্যুহীন প্রাণ দু’চারটি না থাকলে কারা মূঢ় মূক মুখে ভাষা যােগাবে? প্রাপ্য অধিকারের জন্য দাবি জানাবে?
ওঁকে সঙ্গে নিয়ে চললাম ছাউনি থেকে ছাউনিতে। সেদিন সকালের মধ্যে দুশাে লােক কলেরায় মারা গেছে। মহামারী দেখা দিয়েছে মাইলামে। স্যালাইন নেই, রেডক্রস যে ডাক্তার পাঠিয়েছে তা সমুদ্রে বিন্দুবৎ। ওরা হিমশিম খাচ্ছে। একটা ছাউনিতে ঢুকে দেখি এক সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ এক বদনা জল নিয়ে মাটিতে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছেন। জিগ্যেস করতে বললেন, ‘আল্লা আমারে না লইয়া এসব কচি ছাওয়ালগুলারে নেয় ক্যান? কাল বৌ গেছে, বড় পুলা দুটা, নাতি-নাতনি গেছে।’ আঙুল দিয়ে দেখালেন, ঐ যে বড় নাতনি আমিনা, আজথনে তারও দাস্ত বমি।’
দেখি বাঁশের চাঙের উপর শুয়ে আছে এক পরমা সুন্দরী কিশােরী। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে অজানুলম্বিত একমাথা ঘন কালাে চুল। টিকলাে নাকে একটা সাদা পাথরের নাকছাবি আলাে পড়ে চকচক করছে । আয়ত ডাগর দু’খানি চোখ। আমাকে দেখেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাে, ‘মাসিমা আমারে বাঁচান। আমি মরতে চাই না।’ দু’চোখের সেই করুণ আকুতি আমার স্মৃতিপটে চিরদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে। কিন্তু না, স্যালাইন ছিল না। তাকে বাঁচাতে পারিনি। তার ডাগর দু’খানি চোখ বােধহয় শেষ পর্যন্ত শকুনেই খুবলে খেয়েছিল। | বাতাসে গন্ধ। মহামারীর গন্ধ। ক্ষুধার গন্ধ, অনিঃশেষ বেদনার জমাট বাঁধা নােনা চোখের জলের গন্ধ। অজস্র বুকফাটা কান্নার নাগপাশ থেকে কানে আঙুল চেপে পালাতে চাইলাম ।
‘রাকেশ বাবু অনেক হয়েছে আজকের মতাে। আর পারছি না।’ তিনি একটু অনুকম্পার হাসি হাসলেন। | ‘দিদি এত রাত্তিরে তাে শিলং ফিরে যেতে পারবেন না। সারাদিন পেটেও কিছু পড়েনি। খালি পেটে কলেরা রােগীর মধ্যে ঘােরা ঠিক না। ক্যাম্পের ছেলেগুলাের চোখ উঠেছে। সমানে জল পড়ে আর অসহ্য ব্যথা। এখানকার লােকেরা এই রােগের নাম দিয়েছে ‘জয় বাংলা’। রাকেশ বাৰু হাসলেন।
হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে গেলেন এক মুসলমান পরিবারের শিবিরে। তাদের কিছু বর্ধিষ্ণু . অবস্থা। তিনদিন আগে একটা মুরগার গােস্ত পাকিয়েছিল, তা শেষ। আজ পায়ের পাতা আর নখের এক গড়গড়ে কালিয়া। একটা হাঁড়িতে ভাত। সবাই হাত দিয়ে একেক মুঠো তুলে ঝােলের সঙ্গে পরম তৃপ্তিতে ভােজন করছে। সবার শেষে গেরস্তের দাসীটি এক থালা ভাত বেড়ে একটা মুরগার আঙুল তুলে নিয়ে গােগ্রাসে মুখে ঢােকাচ্ছে। তারপর হঠাৎ তার কী খেয়াল হলাে, ঢেকুর তুলে বললাে, “ছি ভাতে কোনাে সােয়দ নাই।’ কত্রী
৩৫
বললেন, ‘ফ্যালাইস না, সে ভাতটুকুন আবার হাঁড়িত থুইয়া দে।’ তার অর্ধভুক্ত ভাত আবার হাঁড়িতে ফিরে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, ‘দিদি অল্প নাস্তা করেন। আমি ঢােক গিলে বললাম, “খেয়ে এসেছি, পেটে জায়গা নেই।’ মনে ভাবলাম, দশ বছর আগে হলে চেষ্টা করে দেখতাম, এখন ঠিক পেরে উঠবাে না ।
যাই হােক এ-শিবির ও-শিবিরে ঘুরে রাতটা কোনােমতে কেটে গেল । এক শিবিরে পরিচয় হলাে হবিগঞ্জের বিধু দাস গুপ্তের সঙ্গে। সেখানে মস্ত জমিদারি ছিল। কিন্তু এখন সব পুড়ে ছাই। পাকবাহিনীর মােসাহেবরা যখন তাঁকে মারতে আসে তখন গ্রামের দুটি ছেলে তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। দুর্ধর্ষ সাহসী মানুষ বিধু বাবু, আপাতত মুক্তিফৌজ এবং ভারতীয় সেনাদপ্তরে নানা কাজে লিপ্ত হয়ে আছেন। তাঁর গ্রামের লােমহর্ষক কাহিনী শুনে শুনে রাত কখন ভাের হয়ে গেল টের পাই নি । | এবার আবার ঘরে ফেরার পালা। শিলং আসার দিন দুয়েকের মধ্যেই আবার মাইলামের টেলিফোন। রাকেশ বাবুর অনুরােধ, মুহূর্ত দেরি না করে যেন চলে আসি। ছেলেটি ফোনে বললাে খুবই জরুরি।
আবার যাত্রা মাইলামের পথে। সঙ্গে অবিশ্রান্ত বর্ষণধারা। সত্যি এ বছর এত জল কেন? বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের বুকফাটা হাহাকার কি জল হয়ে ঝরে পড়ছে? কবে এ জল শুকোবে?
যখন ক্যাম্পে পৌছলাম চারদিকে শ্মশানের নীরবতা। যুদ্ধক্ষেত্রের পােড়ামাটির নীতি কারা যেন প্রয়ােগ করেছে সমস্ত এলাকাজুড়ে। বসতির চিহ্ন নেই। হাওয়ায় উড়ছে কালাে কালাে ছাই। যেন এক বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্র। সারি সারি পুড়ে-যাওয়া মানুষের মৃতদেহ। কাল রাত্তিরে কারা যেন পুরাে ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। লাউ-কুমড়াের ডগা মাটির উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তুলসী গাছ পােড়া কাঠের মতাে কালাে । বাউল আর কীর্তনের সুর চিরকালের মতাে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ছেলেরা নিয়ে গেল রাকেশ বাবুর অস্থায়ী ডেরায়। তাঁর নিজের আস্তানা পুড়ে ছাই। বাঁশের মাচাংয়ের ওপর নিথর পড়ে আছেন তিনি। দু’চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে, বিকৃত মুখমণ্ডল, ছাল-চামড়া জ্বলে গেছে। দু’হাতের চামড়া জলে মাংস থেকে আলগা হয়ে লতপত করে কনুইয়ের কাছে দলা হয়ে ঝুলছে। ঝলসানাে দেহের রক্ত, জল টপটপ করে ঝরে পড়ছে মাটির মেঝের ওপর। তাকানাে যায় না তার মুখের দিকে। আমাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন । আমার হাতখানা ওর হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে মিনতি করা সুরে বললেন,
‘দিদি আমাকে বাঁচান। আমি মরতে চাই না।’ ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে তবু যেতে হয় তবু চলে যায়।
আমি শুধু মৃত্যুর নির্বাক সাক্ষী। এতদূর পথে অক্সিজেন স্যালাইন আনা সময়সাপেক্ষ অথচ এই মুহূর্তে এসবেরই প্রয়ােজন।
ভূতগ্রস্তের মতাে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, চোখের সামনে ধীরে ধীরে অস্তমিত হলাে একটি ভােরের সূর্য। ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এলাম ক্যাম্প থেকে।
কাজল, অনিরুদ্ধ গােপনে এসে দাঁড়াল সামনে। পায়ের ধুলাে নিয়ে বললাে, ‘মাসিমা, আশীর্বাদ রাখবেন কলেরায় ধুকে ধুকে মরার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেয়া অনেক সম্মানের। | দুয়ারে দাঁড়িয়ে হেঁড়া কাপড়ের খুঁটে মায়েরা চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘দিদি ওদের মানা করুন। কাজলের বয়স পনেরাে পেরােয়নি এখনাে। ও কেমন করে যুদ্ধ করবে বলুন তাে? নিজের হাতে এক কাপ চা বানিয়েও খেতে জানে না ছেলে। মনে মনে ভাবলাম, ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাজলের মতাে কিশােররা। কলেরায়, ক্ষুধায় তিলে তিলে মরার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেয়া অনেক সম্মানের। ওদের না করতে পারলাম না। কাজলের মা মাটিতে পড়ে কপাল চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
৩৭
টেংরাটিলা
দিনান্তের শেষ সূর্য পশ্চিম দিগন্তে বিদায় নেয়ার আগে মুঠো মুঠো আবির-গােলা রঙ ছিটিয়ে দেয় হাওরের নীলাম্বরী জলের বুকে। সবুজে, সুনীলে, লালে একাকার হয়ে ফুটে ওঠে এক অপার্থিব স্বপ্নালােক। হােক না বাতাসে বারুদের গন্ধ, মৃত সৈনিকের শিয়ালকুকুরে খাওয়া অর্ধভুক্ত গলিত শব, রক্তস্নান আর যুদ্ধের বর্বরতা, তবু প্রকৃতি কি নির্বিকার।
তমালের কালাে ছায়ার নিচে, হাওরের কোলঘেঁষে অচেনা গাছ, অচেনা ফুলের গন্ধ। কত স্নিগ্ধ, কত শান্ত নিসর্গের এই ভুবনমােহিনী রূপ। মনে পড়লাে ঋষি বাক্য
‘আকাশ আনন্দপূর্ণ না রহিত যদি। জড়তার নাগপাশে দেহমন হইত বিকল…।’
নিসর্গের এই অপরূপ লীলাক্ষেত্র দেখেই কি একদিন কবিগুরু এই ভূখণ্ডের নামকরণ করেছিলেন শ্রীভূমি?’
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল ঠিক দু’দিন আগে পাকবাহিনীর সমস্ত অবরােধ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে ‘টেংরাটিলায়’। স্বাধীন মুক্ত বাংলাদেশের একটি ঘাঁটি। দাঁড়িয়ে আছি গ্যাস ফ্যাক্টরির উঁচু টিলার মাথায়। ফ্যাক্টরির ওপর ‘জয় বাংলার’ গাঢ় সবুজ পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ছে। টেংরাটিলা। পাকিস্তানি পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীনে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল এখানে। আজ পি.পি.এল-এর ‘পি’ মুছে বড় বড় হরফে বাংলাদেশের ‘বি’ বসানাে হয়েছে।
টেংরাটিলা বিজয়ের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মহসীন। কৃশকায়, গৌরবর্ণ মানুষটি। পড়ন্ত রােদের এক ফালি সােনালি আভা মুখের ওপর পড়ে মুখমণ্ডলকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
রণাঙ্গনের দুর্ধর্ষ হিংস্রতার কোনাে ছাপ সেখানে নেই। যুদ্ধ শেষের স্বস্তি এবং বিশ্রামে তাকে সাধারণ নাগরিক বলেই মনে হচ্ছে। সহাস্য বিনয়ে আমাদের নমস্কার জানালেন।
৩৮
পােস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্র ক্যাপ্টেন রউফ স্যালুট করে এটেনশনে এসে দাঁড়াল।
‘স্যার, পুরাে সুরমা নদী এখন আমাদের কবজায়। কাল রাতে আমাদের ব্রিগেড ‘ঝাওয়ার পুল’ উড়িয়ে দিয়ে এসেছে। এপারে আসার পথ ওদের বন্ধ হলাে। এখন অবশিষ্ট সৈন্যসামন্ত নিয়ে ওরা ছাতকে অবরুদ্ধ। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, কালাে, মজবুত চেহারার শর্টস পরা ক্যাপ্টেন রউফ, তার সাদা চকচকে দাত বের করে গর্বের হাসি হাসলাে। হাসিটি মনােরম। মাত্র পাঁচ মাসের ট্রেনিং পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র রউফকে দেখে মনে হলাে, সৈনিক জীবনেই বহুদিন যেন সে অভ্যস্ত। রউফ কিছুক্ষণ নীরব থেকে শুরু করলাে, স্যার এই লড়াইয়ে আমাদের ক্রেডিট কিন্তু অস্ত্রের জোরে ততটা নয়, যতটা স্রেফ বুদ্ধি খাটিয়ে। আমাদের প্লাটুনে আমরা জনাপঞ্চাশেক ছিলাম, ওদের পরিত্যক্ত একটা মাত্র কামান ছিল আমাদের দখলে। আমরা যেদিক থেকে কামান দাগালাম, তার উল্টো দিকে ছেলেদের দাঁড় করিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে খুব উঁচু গলায় চিল্কার করতে বললাম, লােকেরা খুব উৎসাহী, সবাই লড়াইয়ে অংশ নিতে চায়। পাকিস্তানিরা গােলার আওয়াজ অনুসরণ করে পাল্টা গােলা ছুড়লাে। আমরা ঐ একটা কামানই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনটা পজিশন থেকে গােলা ছুড়লাম। ওরা ভাবলাে, আমাদের অনেক অস্ত্রশস্ত্র । ছেলেগুলাের ‘জয় বাংলার আওয়াজ শুনে ভাবলাে আমাদের লােকবলও অনেক । ওরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাে, ভাবলাে তিনদিক দিয়েই ওরা অবরুদ্ধ। কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর ওরা ওদের পজিশন ছেড়ে পালিয়ে গেল। আমাদের কিছু অসামরিক লােক আহত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা খুবই কম। স্যার বলতে পারেন একরকম বিনাযুদ্ধেই আমরা ঝাওয়ার পুল’ উড়িয়ে এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি।’ রউফের মুখে বিজয়ের গর্বিত হাসি। উপস্থিত সবাই উচ্চগ্রামে হেসে উঠলাে।
কর্নেল শওকতের সঙ্গে আমার শিলংয়ে পরিচয়। প্রায় সর্বস্বান্ত অবস্থায়, এক শিশু পুত্র এবং তিনটি বাচ্চা-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে শিলং স্যানিটোরিয়ামের একটি পুরনাে ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পূর্ব রণাঙ্গনে খাসি জয়ন্তিয়া সেক্টরের সর্বোচ্চ অধিনায়ক কর্নেল শওকত। সুশ্রী পৌরুষদৃপ্ত চেহারা, মিলিটারি কায়দায় হাঁটা সযত্নে লালিত গোঁফ জোড়া, ছােট করে ছাঁটা মাথার চুল, মুখে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। পাকিস্তান আমলের ক্যাডার সুতরাং মনে মনে ভারতবিদ্বেষী হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। তবে অবস্থার বিপাকে পড়ে এবং ভারত সরকারের সীমান্ত খুলে দেয়ার বদান্যতায় মত পাল্টেছে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে।
সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ে মুক্তিফৌজ বিশৃঙ্খল নেতৃত্বহীন। লড়বার ইচ্ছা আছে কিন্তু তাদের সংগ্রামী মনােভাবকে সংহত করার নেতৃত্ব নেই। সবাই অনুভব করছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের সাযুজ্যের কথা। কিন্তু
নেতা কোথায়। অধিকাংশই আটকা পড়ে গেছেন পশ্চিম পাকিস্তানে। যারা আছেন তাদের মধ্যে অনেকে বন্দি অথবা মৃত।
কর্নেল শওকত চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আটকা পড়ে যান। কর্ণফুলী নদীর উপর এবং চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে মুষ্টিমেয় সেনাবাহিনী নিয়ে যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে একদিন গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে হটে আসতে বাধ্য হন। খাসি জয়ন্তিয়া সেক্টরে বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের তখন খুবই প্রয়ােজন। কর্নেল শওকতকে এই নেতৃত্ব দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব অফিসার পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন ভারতীয় সেনা ব্যারাকে তাঁদের ঠাই হলাে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। মেঘালয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম ও গভীর জঙ্গলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে বাংলাদেশের আনকোরা যুবকদের যুদ্ধের ন্যূনতম কায়দা এবং অস্ত্র চালনা শেখানাের কাজ শুরু হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনী একটি সংগঠিত রূপ নিল। বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্ব ফিরে পেয়ে ই.পি.আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা কোমরে অনেকখানি জোর পেল যেন।
আমরা অবাক বিস্ময়ে রউফের কাহিনী শুনছিলাম। কর্নেল শওকত আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এই যেসব ভেটারেন মুক্তিফৌজ দেখছেন এরা আদতে কেউই প্রফেশনাল নয়, বেশিরভাগই স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলের দল।’ ইতিমধ্যে ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছােটখাটো ছিপছিপে চৌকস ছেলে ক্যাপ্টেন হেলালের আবির্ভাব। তাকে মােতায়েন করা হয়েছিল ‘সেলা সেক্টরে’। অসীম সাহসী দুর্ধর্ষ হেলালের নেতৃত্বে ততদিনে মজবুত বাহিনী গড়ে উঠেছে বাঁশতলা ক্যান্টনমেন্টে। যুদ্ধক্ষেত্রের প্রচণ্ড শৃঙ্খলা, ইস্পাতের মতাে ধারালাে নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে ক্যাপ্টেন হেলাল আনকোরা মুক্তিফৌজের সামনে তুলে ধরলেন দৃষ্টান্ত আর এগিয়ে চলার প্রচণ্ড প্রেরণা।
আজ ‘টেংরাটিলা বিজয়ের আনন্দে সকলের মুখই প্রদীপ্ত। ক্যাপ্টেন হেলাল আমাশয় আর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুবই কাহিল, দু’চারদিন বিশ্রামের প্রয়ােজন তার । এখান থেকেই তাঁকে সাত মাইল দূরে ছাতক দখলের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সুনামগঞ্জ প্রায় অবরােধমুক্ত। সবার মুখে এক কথা, চলাে, চলাে ছাতক চলাে। তারপর শেষ লড়াই সিলেটের খাদিমনগর’ আর সালুটিকরে ।
আঠারাে বছরের ক্যাডেট যােদ্ধা ক্যাপ্টেন হারুন থেকে শুরু করে একে একে সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন কর্নেল শওকত । মুখে সবার খুশির আমেজ। কর্নেল শওকত হঠাৎ ঘােষণা করলেন, আজ সব প্রােগ্রাম ক্যানসেল্ড । ভালাে দিনে এসেছেন, আমাদের এখানেই দাওয়াত রইলাে।
৪০
ইতিমধ্যে গ্রামের এক চাষী নতুন বিজয়ের আনন্দে সদ্য নদী থেকে তােলা প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের এক গােলাপি চকচকে আড় মাছ এনে হাজির করলেন কর্নেল সাহেবের পায়ের কাছে। গােধূলির আলােয় মাছের রঙ আর আকাশের রঙ যেন। মিলেমিশে একাকার। কর্নেল সাহেব খুশির হাসি হেসে বললেন, ‘একেই বলে বরাত । দেখলেন তাে ডিনারের উপকরণও কেমন জুটে গেল।’
রাতের অন্ধকার চুপিসারে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। কর্নেল সাহেব বাবুর্চিকে অর্ডার দিলেন পাঞ্জাবিদের ছেড়ে যাওয়া বাঙ্কার থেকে চাল-ডালগুলাে নিয়ে আসতে। তেল-মসলা ফেলে দেয়াই ভালাে। যাওয়ার আগে ওরা বিষটিষ কিছু যদি মিশিয়ে দিয়ে যায়। অদূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে খােদাই করা অজস্র পাঞ্জাবি বাঙ্কার । অস্ত্রশস্ত্র-গােলাবারুদ, রেশন, খাদ্যসামগ্রী সবকিছু ফেলে ওরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গেছে দোয়ারাবাজারের পথে। ওরা ছিল একশ’ একাশিজন রেগুলার আর্মি আর জনপঞ্চাশেক রাজাকার। বাঙ্কারের লুটের মালের মধ্যে ছিল গ্রাম থেকে খুঁজে আনা কৃষক এবং মধ্যবিত্ত ঘরের স্বাস্থ্যবতী, সুশ্রী, বাছাই করা চব্বিশজন সুন্দরী জায়া ও জননী। ক্ষমতার অহমিকায় এই মানুষরূপী দেহধারী পশুরা ওদের ধরে নিয়ে যায় ছাউনিতে, বাঙ্কারে। দিনের পর দিন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাধারণ জোয়ান থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ অফিসাররাও এদের ওপর নিজেদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে । তিলে তিলে আত্মদহনের এই দিনপঞ্জি হয়তাে অলিখিতই থেকে যাবে। রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা, লােকনিন্দা-ভীত কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারগুলাে কি কোনাে দিন খােলা মনে এদের গ্রহণ করতে পারবে?
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা মরে ‘শহীদ হয়েছে, কিন্তু পাক অত্যাচারের যূপকাষ্ঠে যারা দৈহিক নির্যাতনের বলি হলাে তাদের কি কেউ শহীদ বলবে? যারা ধর্ষিতা হলাে সমাজ কি তাদের সম্মান দিয়ে ঘরে ফিরিয়ে নেবে? কেউ কি ভালােবেসে কোনােদিন তাদের সুমঙ্গলা বধূ বলে বরণ করে নেবে? আপন সংসারের অনাগত দিনের ইতিহাসই তার জবাব দেবে।
যাই হােক ক্ষমতা পুনর্দখলের পর কর্নেল শওকত গ্রামের অসংখ্য কৌতূহলী দৃষ্টির আড়ালে রাতের অন্ধকারে চালান করে দিয়েছেন ওদের নিজের নিজের বাড়িতে। বাড়ির প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল তখন আর জানা যায়নি।
শীতের হাওয়ায় কাঁপন ধরেছে হাড়ে হাড়ে। হঠাৎ নাটকীয়ভাবে পাকিস্তান অবজারভারের সাংবাদিক জালালুদ্দিন সাহেব আর ঢাকা টেলিভিশনের কর্মী বাদল চৌধুরীর আবির্ভাব। শিলংয়ে রেস্ট ক্যাম্পে ওঁদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। গত পনেরাে দিন ওঁরা নিখোঁজ ছিলেন। ধারণা হয়েছিল, ওঁরা বােধহয় আর বেঁচে নেই। এ ক’দিনেই চেহারা, পােশাক-আশাক বিলকুল বদলে গেছে। খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়িতে মুখ ঢাকা।
৪১
চুল লম্বা হয়ে ঘাড় ছাপিয়ে নিচে নেমেছে। বাদল চৌধুরী ছিপছিপে পাতলা চেহারার স্বল্পভাষী মানুষ। ঢাকার অধিকৃত এলাকায় পাঞ্জাবি সন্ত্রাসের দিনে ‘হােটেল ইন্টার কনটিনেন্টাল’ ও ঢাকা টেলিভিশনে যাঁরা গ্রেনেড চার্জ করেন তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। সঙ্গীটি ধরা পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বাদল চৌধুরীর তেরাে বছরের বােনকে অত্যাচার করার পর গুলি করে হত্যা করে। স্ত্রী-পুত্র পেছনে রেখে বাদল চৌধুরী আত্মগােপন করে পালিয়ে আসেন। তারপর বিভিন্ন রণাঙ্গনে, বাঙ্কার থেকে বাঙ্কারে গুলিবৃষ্টির মধ্যেই যুদ্ধের ছবি তুলতে থাকেন। ত্রিপুরা সীমান্তের রণাঙ্গনে ছবি তােলার সময় বাঙ্কারের ওপর শেল এসে পড়ে। সঙ্গের বন্ধুটি মারা যায়। ক্যামেরা রিল সব পুড়ে ছাই। মাটির নিচে চাপা পড়ে দু’দিন আহত অবস্থায় কাটাতে হয়। এখন রণাঙ্গনের সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য আবার ঘােরাঘুরি শুরু করছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ ভারি হয়ে উঠেছে। এঁদের মুখেই শুনলাম দোয়ারাবাজারের খাসিয়া মহিলা ‘কাকেটের কাহিনী। স্বামী মুসলমান। কাকেটের কাপড়ের ব্যবসা। তিনি এপারে থাকেন; কাপড়ের ব্যবসা করতে অধিকৃত এলাকাতেও যান। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বলে, ‘দিদি আমাদের তাে ভেতরে গেলেই ধরে ফেলবে, তুমি আমাদের ভেতরের খবর একটু একটু করে এনে দাও। ওরা কোথায় ছাউনি গেড়েছে। ওদের গতিবিধি, রাজাকারদের কাজকর্ম, বুদ্ধি করে সবকিছু নজর করবে । ওরা তােমাকে সন্দেহ করবে । তারপর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হবে তখন অনেক ইনাম পাবে।’
পাকিস্তানিদের অত্যাচার কাকেট দেখেছেন, সুতরাং তাদের ওপর এমনিতেই তিনি বিরূপ । তিনি তার স্বভাবসুলভ প্রগলভতা আর হাসিখুশি মেজাজ নিয়ে সদরে যান, আডডা জমান, পান-তাম্বুল খাওয়ায়, হাসে, গল্প করে, মুক্তিফৌজের মুণ্ডুপাত করে । বন্ধু জুটে যায় অনেক, কাজও হাসিল হতে থাকে। দোয়ারাবাজারের ‘মাতাহারি’ কাকেট। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাও খুব খাতির করে ওকে। ওরই খবরের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা একটা সামরিক অভিযানে শত্রুপক্ষের একটা ব্যুহ ভেঙে দেয়। রাজাকার লােকগুলাের সন্দেহ হয়, ওরা খবর দেয় পাকসৈন্য বাহিনীকে। কাকেট ধরা পড়েন। কিন্তু স্বীকার করেন না কিছু। শেষ পর্যন্ত অত্যাচার করে ওরা মেরে ফেলে কাকেটকে।
‘কাকেট মরে গেছে। ইতিহাসের পাতায় সেও এক বিস্মৃত কাহিনী। নবী, ইয়াকুব আরাে ওদের মতােই বাচ্চা ছেলেগুলাে যারা গরু চরানাের নাম করে ভেতরের খবর এনে দিত আজ তাদের কথা কেইবা মনে রেখেছে?
তাজমহল গড়তে যে বিশ হাজার শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল, যেসব স্থপতি সৌধের নকশা করেছিলেন ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম কি খুঁজে পাওয়া যায়? আমরা জানি শাহজাহান আর তার মমতাজ বিবিকে।
৪২
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেল । গ্যাস ফ্যাক্টরির গেস্ট হাউসের ঘােট কামরায় আমার আর জ্যোৎস্না বিশ্বাসের, অন্যদিকে হেমেন্দ্র পুরকায়স্থের শােবার ব্যবস্থা হলাে। ঘুম এলাে না। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাত পার করে দিলাম।
এবার আমাদের ফেরার পালা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে নেমে এলাম টিলার মাথা থেকে। পথে চলতে চলতে দেখি পাক অধিকৃত বাঙ্কারগুলােতে এখন অতন্দ্র প্রহরীর মতাে মুক্তিফৌজ আর ‘বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছেলেরা সঙিন উঁচিয়ে পাহারায় মােতায়েন রয়েছে। চলার পথে প্রতিটি বাঙ্কার থেকে ছেলেরা ‘জয় বাংলা’ বলে আমাদের সম্বােধন জানাল। ওদের একান্ত অনুরােধে লঙ্গরখানার সকালের নাশতা, কড়া মিঠে চা আর চাপাটি খেয়ে আমাদের আপ্যায়িত হতে হলাে। বড় আন্তরিকভাবে বললাে, “দিদি বহুদিন পর ভালাে নাশতা করছি। ওরা পালাবার সময় আটার বস্তা, চিনি তাড়াহুড়ােতে নিতে পারেনি। আমাদের কপাল খুললাে। আমাদের তাে কিছু নেই, আছে শুধু বিশ্বাস, আর নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন। ঘরবাড়ি, আত্মীয়-পরিজন কাউকে গিয়ে ফিরে পাবাে কিনা তার ঠিক নেই। আশীর্বাদ রাখবেন আমাদের জন্য।’ | কোনােদিন বাঙ্কার দেখি নি। বললাম, ভেতরটা দেখাবে ভাই একবার?’ একগাল হেসে ভেতরে নিয়ে গেল। দেয়ালে সিমেন্ট কংক্রিটের আস্তরণ, ছাদে তাই। দেয়ালের ভেতর দিকে একপ্রস্থ কলাগাছের সারি। ছাদের কংক্রিটের ওপরটা পাথর, মাটি, বালি দিয়ে ঢাকা। সুরক্ষিত বাঙ্কার । ওরা বললাে, আমাদের বাঙ্কার দেখেছেন দিদি? মাটির দেয়াল, ভেতরে বাঁশের ঘেরাও, ছাদে বাঁশের ওপর মাটি ফেলা। একটা গােলা পড়লেই সব খতম। কী করবাে? আমাদের তাে ওদের মতাে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেই। দিদি, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আসবেন কিন্তু আমাদের দেশে। দাওয়াত রইল। দুর্দিনে আপনারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এ ঋণ কি কোনাে দিন শােধ করতে পারবাে?’
মনে মনে হাসলাম। স্মৃতি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতাে আসে আবার তরঙ্গ তুলে মিলিয়ে যায় মহাসাগরে। তবু আজকের পাওয়াটাকেই পরম পাওয়া বলে স্বীকার করে নিতে ক্ষতি কি? সত্যি কি বিচিত্র মানুষের মন। এই অতিথিবৎসল সাধারণ ঘরােয়া মানুষগুলােই সময়বিশেষে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ধানক্ষেতের মধ্যে মধ্যে পাকসেনাদের গেঁথে রাখা ধারালাে স্পাইক আর মাইনের বিস্ফোরণ উপেক্ষা করে এরাই রাতের অন্ধকারে একবুক জলকাদা ভেঙে, সাপজোকের ছােবল খেয়ে, বুকে হেঁটে শক্রর সুরক্ষিত বাঙ্কারে গ্রেনেড হাতে ঝাপিয়ে পড়ে। তখন পােয়া করে না জীবনের। ভুলে যায় ঘরবাড়ি, মা-বােন, স্ত্রী-পুত্রের কথা। স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে যায়। সেই একই মানুষ এমনি মমতা মাখানাে সুরে, নিতান্ত আপনজনের মতাে আবার
৪৩
লতেও পারে, ‘দিদি আর কি দেখা হবে! কে কোথায় চলে যাবাে। সাবধানে হাঁটবেন, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় মাইন পোঁতা আছে। স্বাধীন বাংলায় যেন আবার দেখা পাই।’
নানা কথা ভাবতে ভাবতে বাঁশতলার পথ ধরে আবার ঘরের পথে রওনা দিলাম। সবাই দিন গুনছে, যুদ্ধশেষের ঘণ্টা কবে বেজে উঠবে ।
খাদিমনগরে শেষ যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। আত্মসমর্পণের আগে পৈশাচিক বর্বরতায় ওরা মানুষ হত্যা করেছে, মানুষের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে। ছেড়ে যাওয়ার আগে বাঙ্কারের বন্দিনী মেয়েদের পেটে ছুরি চালিয়েছে। খাদিমনগরে গিয়ে দেখেছি মেয়েদের বন্দি নিবাসে লম্বা চুলের গােছা, ছেড়া কাপড়ের টুকরাে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় পাথরের দেয়ালে গেঁথে যাওয়া নখের দাগ ! আধপচা মানুষের হাঁ করা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ । দেখেছি জঙ্গলে স্থূপীকৃত অগণিত নরমুণ্ডু।
একটি ছেলে এসে দাঁড়াল সামনে- ‘দিদি খুব খারাপ খবর। খারাপের আরাে কিছু বাকি আছে কি! তাকালাম ওর মুখের দিকে। ‘দিদি হক সাহেব কাল মারা গেছেন ছাতকের পথে।’
১৫ ডিসেম্বর। খাদিমনগরে পাকসৈন্যদের আত্মসমর্পণের কাহিনী শুনে দিগ্বিদিগশূন্য হয়ে হক সাহেব ছুটেছিলেন নিজের গ্রামে। সেখানকার নির্বাচিত এম.এল.এ. তিনি।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর আঁকাবাঁকা কাঁচা পথ দিয়ে চলেছেন ঘরের পথে, দেশের পথে। তর আর সয় না। ড্রাইভারকে তাড়া দেন, ‘ভাই জলদি চালাও, আরাে স্পিড দাও। না জানি গ্রামের কী হাল হয়েছে।’ দেশের মাটি স্পর্শ করবেন, উত্তেজনায় মন টানটান। একটা গাছের গুঁড়িতে জিপ ধাক্কা খেল । ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাে। জিপ উল্টে হক সাহেব চাপা পড়লেন জিপের চাকার নিচে।
ভাের হয়ে এসেছিল, তবু সূর্যোদয় দেখা হলাে না আর ।
মনে পড়লাে রাকেশ বাবুকে। স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা দেয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তারও আর সূর্যোদয় দেখা হলাে না। | সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র বিশ বছরের জগৎজ্যোতি সতেরােটা গুলির স্প্রিন্টার গায়ে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তার সতেরােতম অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে। বলেছিলাম কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে যেতে, শােনেনি। শেষ লড়াইয়ের ময়দানে ধরা পড়ে গেল। তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে হাটের পথে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দিয়েছিল কয়েকদিন। তারও সেই ঈপ্সিত সূর্যোদয় আর দেখা হলাে না।
মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল । মনে রাখবে তাে এদের বাংলার আগামী প্রজন্মের মানুষ?
৪৪
জন্ম নিল রক্তস্নাত এক নতুন সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ। সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামাের যে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের অঙ্গীকার ছিল আপামর জনসাধারণের কাছে। | সন্ধ্যা নেমে এসেছে বাঁশতলার জারুল গাছের ফাঁক দিয়ে। জারুলের বেগুনি ফুলগুলাে হাওয়ায় দুলছে। বাতাসে কেমন একটা খুশির আমেজ। বাঁশতলা থেকে ফিরছি সেলা ক্যাম্পে। বনভূমি সচকিত করে দূর থেকে ভেসে এলাে জয়ধ্বনির সুর। বাতাসে ধুলাের ঝড় । অন্ধকারে চোখে পড়লাে সারি সারি শীর্ণ নগ্নপদ…ওরা চলেছে, ক্ষীণ দুর্বলকণ্ঠ থেকে নিঃসরিত হচ্ছে উল্লসিত ধ্বনি
তােমার দেশ আমার দেশ
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
জয় বাংলা জয় ভারত
জয় ইন্দিরা জয় মুজিব।
সংবাদ এসে পৌছেছে ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকসৈন্য বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে।
পথ চলতে চলতে একটা ক্ষীণকণ্ঠ যেন ভেসে এলাে বহুদূরের ওপার থেকে
‘দিদি দাওয়াত রইলাে আপনাদের স্বাধীন বাংলায় আসবেন কিন্তু আমাদের দেশে।
নিজের অজান্তে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লাে চোখ থেকে। কেমন করে আসবাে? আমরা যে সীমান্তের এ পারের ।
আবার একদিন তােমাদের-আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই গড়ে উঠবে অচলায়তনের অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর । কাছের মানুষ যাবে অনেক দূরে সরে। দেশের রাজনীতিবিদদের ওপর সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু?
তবু ‘উমইয়াম’ নদী বয়ে চলবে অনন্তকাল ধরে। আমরা পাহাড়ের ওপর থেকে দেখবাে শ্যামলী শ্রীভূমির রুপােলি জল আর সােনালি আকাশ। ওরা হাতছানি দিয়ে ডাকবে। কিন্তু নিরুপায়।…মাঝখানে দেয়াল। …মাথার উপর অচেনা পাখির ডানার ঝাপটা স্মরণ করিয়ে দিল রাত্রি সমাগত, ওপারে সূর্য উঠতে আর বেশি দেরি নেই।
৪৫
পাদটীকা
১. মহিলা মুক্তিফৌজ
২. শিলং পেস্টাল ইনস্টিটিউটে গিয়ে অঞ্জলি লাহিড়ীর দিদি কল্যাণী দাস শরণার্থী ক্যাম্পে
বিতরণ করা তেল পরীক্ষা করিয়েছিলেন।
৩. প্রাগুক্ত
৪. আবদুল মােমতাকিন- প্রাক্তন সংসদ সদস্য।
৫. কামারুজ্জামান প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৭৫-এর জেলহত্যা ঘটনায় শহীদ হন।
৬. সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত- এম.পি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা।
রওনক চৌধুরী- তৎকালীন ন্যাপ নেতা।
৮. ক্যাপ্টেন মহসীন- পরে ব্রিগেডিয়ার হয়েছিলেন। এই মুক্তিযােদ্ধাকে জিয়া হত্যা মামলায়
জড়িয়ে ১৯৮১ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
৯. কর্নেল শওকত- পরে লে. জেনারেল হন। বিএনপির খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন।
৪৬
শাহীন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এতাে কাজ করেছেন, কাছ থেকে এতাে কিছু দেখেছেন, আপনার লেখাটা আরাে বড় হতে পারতাে। অঞ্জলি: আমার মাথায় সেটা ঢােকেনি। দেরি হয়ে গেছে। শা: প্রায় প্রতিদিন শরণার্থী ক্যাম্পে যেতেন?
অ: নেশা ধরে গিয়েছিল।
শা: যেতে ভয় লাগেনি, কলেরার মধ্যে?
অ: এমনিতে আমার টিবি, কলেরা, কুষ্ঠতে ভয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে মানুষ নিজের কথা ভাবে না। মানুষের একটা পরিবর্তন ঘটে যায়, যেমন- জয় বাংলা চোখের রােগ বলতে গেলে তখন পুরাে ক্যাম্পে। চোখের দিকে তাকালেই হয়ে যায়। এরা তাে দিন-রাত আমার মুখের ওপর কথা বলতাে। আমার তাে হয়নি। আমার ছেলের যখন বসন্ত হয় তখন আমার ছেলের সাথে বিছানায় শুয়েছি। মনের ওপর ডিপেন্ড করে।
শা: আপনার লেখা পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়- হক সাহেব, রাকেশ বাবুর এভাবে মারা যাওয়াটা!
অ: রাকেশ বাবুর মারা যাওয়াটা আমার খারাপ লেগেছে। ওর প্রত্যেকটি চিঠি আমি রেখে দিয়েছিলাম। প্রায় চিঠি দিতেন আর লিখতেন, ‘দিদি আপনি ক্যাম্পে আসিয়া নিজের চোখে ক্যাম্পের অবস্থা দেখিয়া যান। রােজ রােজ শয়ে শয়ে মানুষ মরিতেছে।
শা: কোনাে চিঠি নেই না, এখন আর?
অ: একটাও পাচ্ছি না, কোথায় গেল, দেখতে হবে। অনেকদিন হয়ে গেল। একাত্তর থেকে নিরানব্বই এতােদিন পর কেন এসে যে ধরলে ।
শা: আগে এলে অনেক জিনিস পেতাম?
অ: আগে এলে চিঠিপত্রগুলাে অন্তত তােমাকে দিতে পারতাম। রাকেশ বাবুর ওপর লেখাটা খুব টাচি হয়েছিল। আমি যাদের যাদের পড়ে শুনিয়েছি, তাদের অনেকেরই চোখে জল এসেছে, আমি দেখেছি। সব হারিয়ে গেল। রাকেশ বাবু প্রতিদিন নদী
সাঁতরে এপারে আসতেন, রেশন এলাে কিনা দেখতে। তিনি সুনামগঞ্জে কৃষক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গি একটু বামপন্থি ছিল। সাধারণ মানুষের জন্য দরদবােধ ছিল ওর, সবার জন্য করতেন। টিপসই রেখে রিলিফ অন্যেরা নিয়ে যাচ্ছে- এটা বােঝাতেন, প্রতিবাদ করতেন। ছয়-সাতবার ওখানকার ছাউনি পুড়িয়েছে কন্ট্রাকটররা। এই কন্ট্রাকটর যারা খাসি, যারা ছাউনি পুড়িয়েছে, একাত্তরে ক্যাম্পে চাল সাপ্লাই দিতাে তারা।
শা: ছাউনি পুড়িয়েছিল কেন?
অ: বাংলাদেশিদের ওপর রাগ ছিল। ওরা কলেরা আনছে, লােক বেড়ে গেছে। শরণার্থীদের সর্বস্ব এরা লুটে-পুটে নিয়েছে শরণার্থীদের খাবার, চালও। স্যালাইনের জন্য অনেকে চাল বিক্রি করেছে, পুরাে বান্ডিল টিন বিক্রি করেছে- একমাত্র বাচ্চার একটা স্যালাইনের জন্য সােনাদানা যা ছিল তা বেচে দিল । স্যালাইন তাে ডিস্টিল ওয়াটার । মানুষ মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে ব্যবসা যা করেছে না, সে বলে কাজ নেই। কেন যে বাংলাদেশের প্রতি আমার টানটা এতাে বেশি। ক্যাম্পে গিয়ে সব দেখেছিলাম নিজের চোখে ! এর আগেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রিফিউজি দেখেছি। তখন আমি কমিউনিস্ট পার্টি করি । পিলপিল করে অজস্র মানুষ বার্মা থেকে হেঁটে আসছে। রাস্তায় রাস্তায় মরছে কলেরায়। তারপর দেখলাম ছয়টা দাঙ্গা, আমাদের আসামে। বাংলাদেশ থেকে বাস্তুহারা হয়ে এলাে ইন্ডিয়ায়। অহম জাতীয়তাবাদীরা তাদের দু’বার-তিনবার করে ঘর পুড়িয়ে দিল । ভাঙলাে। সে সময় একটা ডেলিগেশন নিয়ে আমি জওহরলাল নেহরুর কাছে গিয়েছিলাম।
শা: নেহরুর কাছে কবে গিয়েছিলেন?
অ: নেহরুর কাছে গিয়েছিলাম ষাটের দশকে। ইন্দিরার কাছে গিয়েছি পরে। তখন আমাদের বাড়িতে মার খাওয়া রিফিউজিদের বিরাট মিটিং। আমার স্বামী অ্যাডভােকেট । তিনি তাদের জন্য লিগ্যালি অনেক করেছিলেন।
শা: ষাটের দশকে?
অ: ‘৫০-৬০-৭০-৮০ ক্রনিক পেট খারাপের মতাে, আমাশয়ের মতাে রিল্যান্স করে দাঙ্গাটা। কিছুদিন বিহারির বিরুদ্ধে, মাড়ােয়ারির বিরুদ্ধে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ বাঙালির বিরুদ্ধে। বাঙালি খেদাও আন্দোলন আর কি। ওরা বললাে, বাঙালিরা আমাদের অস্তিত্বকে নষ্ট করে দিচ্ছে। শা: জগৎজ্যোতির সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলবেন?
৫৪
অ: বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। জুলাই-আগস্ট হবে। হঠাৎ বাড়িতে ৮-১০ জন ছেলে এসেছে। পরনে লুঙ্গি, ভেজা গেঞ্জি, হাতে একটা করে বন্দুক নিয়ে এসে বসলাে। তখন ওদের একজন বললাে যে, মাসিমা এর গায়ে বুলেটের ৮-৯টি স্প্রিন্টার লেগে রয়েছে। এখানে সবাই বলছে, ওর বিশ্রাম নেয়া দরকার । কিন্তু ও তখন বললাে, মাসিমা আমি পাক সৈন্যদের সতেরােটা বার্জ দখল করেছি। ভীষণ ইন্টারেস্টিং।
শা: হাওরের মধ্যে ছিল?
অ: না নদীতে ছিল। তারপর ও একে একে কোথায় কী করেছে বললাে। তারপর বললাে, মাসিমা আমাদের ভীষণ খিদে পেয়েছে, খেতে দিন। সেদিন ঘরে সেরকম কিছু ছিল না। একটু চা করে, মিষ্টি, শিঙ্গাড়া আনালাম। খেতে খেতে বললাম, দেখাে এখানকার মিলিটারি হাসপাতালের সঙ্গে আমার যােগাযােগ আছে। তুমি এখানে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে যাও। তারপর তুমি আবার যেও। সে বললাে, কী যে বলেন মাসিমা, এখন যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবার খবর পেয়েছি একটা বড় জাহাজ আসবে। অনেক মালপত্তর নিয়ে। সুতরাং আমার যেতেই হবে। তারপর আর্মি ক্যাম্পে গেল, কি করলাে ।
শা: কতক্ষণ ছিল আপনার বাড়িতে?
অ: অন্তত ঘণ্টা দু’এক ছিল।
শা: জগৎজ্যোতির মৃত্যুর সংবাদটা আপনি কবে পান?
অ: সেটা বােধহয় শেষ হওয়ার পর কোনাে এক ছেলে এসে খবর দিয়েছিল। আমি শুনেছিলাম ওকে জীবন্ত ধরে নিয়ে যায়। তারপর মেরে ফেলে। কিন্তু আমাকে সাচনা মিলিটারি ক্যাম্পে সংবর্ধনা দেয়ার সময় মেজর মুসলিমউদ্দিন তখন পুরাে কমান্ডে, তিনি বললেন জগৎজ্যোতির একটা ছবি আছে। পাক আর্মি তাকে মেরেছিল। এখন তাে শুনছি আর্মির গুলিতে মারা যায় সে। তারপর ওর ডেডবডিটা নিয়ে গিয়ে সুনামগঞ্জ বাজারে রেখে দিয়েছিল। আমি তখন শুনেছিলাম যে ওকে ধরে পেটের মধ্যে বেয়নেট ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে । দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে লোেকদের দেখানাের জন্য আধামৃত অবস্থায় বাজারে নিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। ওরকম একজন হিরাে ধরা পড়েছে। ওর মাথার ওপর কিছু টাকা ঘােষণা করেছিল। মহাউল্লাস আর্মি ক্যাম্পে হয়েছিল, ওকে ধরতে পারার জন্য। আমার মনে মনে প্রতিজ্ঞা ছিল। আমি দায়বদ্ধ ওদের কাছে। ওদের জন্য, ওদের স্মৃতির জন্য কিছু একটা লিখবাে। তারপর তিনবার লিখেছি। প্রথমবারেরটা হারিয়ে গেছে। দ্বিতীয়টা বিলেতে কয়েকজন বাংলাদেশিকে শুনিয়েছিলাম। ওরা বললাে, আমাদের ধারণা ছিল শুধু মুসলমানরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছে।
হিন্দুদের কোনাে পার্টিসিপেশন ছিল না। পরে দেখলাম হিন্দু ছেলেরাও কিছু যােগ দিয়েছিল। দীর্ঘদিন চলে গেছে। হঠাৎ তােমরা কী আবিষ্কার করলে । এটার যে দাম আছে তা তখন জানতাম না।
শা: লেখাটা কোথায় গেল?
অ: পুরাে খাতা হারিয়ে গেছে। লেখা, ছবি আমি খুব যত্ন করেই রেখেছিলাম। আমার বাড়ির কিছু লােক ওরকমভাবে কাগজ দেখলেই বিক্রি করে দুই-চার টাকার জন্য। জগৎজ্যোতি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বিধু দাস গুপ্ত, রশিদুন নবী, মুক্তিযুদ্ধের বহু ছেলে আসতাে আমার কাছে। আমি তখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরতাম। ওদের ক্যাম্পে, হাসপাতালে যেতাম। আমি এমন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম যে ওদের ওপর আমার একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আফটার অল বাংলাদেশ না! যেসব ছেলে বাংলাদেশ থেকে আসতাে তারা মাথায় আর কপালে মাটি ঠেকাতাে, বর্ডারে গিয়ে দেখতাম। চেরাপুঞ্জি গিয়ে মমলু নামে একটা পাথরের ওপর বসতাম, দূরে বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল নদী, হাওর, বিল, সােনালি নদী। সূর্যাস্ত দেখতাম। এত সুন্দর সূর্যাস্ত পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। আকাশে একটা সূর্য। হাওরে একটা সূর্য। দুটি সূর্য। অপূর্ব সূর্যাস্ত মমলু থেকে দেখা যেতাে। ম হচ্ছে পাথর । আর মলু হচ্ছে লবণ। মমলু হচ্ছে যে পাথরের ওপর তিরতসিং তলােয়ারের মুখে লবণ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ওরা লড়বে। ওখান থেকেই বাংলাদেশকে চিরকাল দেখতাম, জানতাম, ওখানেই আমার পূর্বপুরুষের দেশ। অবশ্য সারা পৃথিবীই আমার দেশ মনে হয়। শিলংয়ে যখন থাকি। এত পাহাড়, নদী, ঝরনা মনে হয় এটাই আমার দেশ। মনে হতাে বিরাট ব্রহ্মপুত্র। তখন অসমীয়রা বাঙালিদের মারতাে বলে একটা বিদ্বেষ ছিল । কিন্তু ওখানে গিয়ে যখন বসবাস শুরু করলাম, ঐ নদী, জনজাতি, সাহিত্য পড়তে শুরু করলাম, সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে তখন একটা একাত্মতা তৈরি হলাে। বিশেষ কোনাে জায়গার প্রতি তাই আমার সেভাবে কোনাে আকর্ষণ নেই। পৃথিবীর সব জায়গাই আমার কাছে সুন্দর মনে হয়েছে। আমি উমইয়াম ক্রন্দসী নদীর কথা লিখেছিলাম না! উম হচ্ছে জল। আর ইয়াম হচ্ছে কান্না । শিলং পিক পাহাড় থেকে এই নদীর জন্ম হয়েছিল। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। তার দুই মেয়ে। উমঙগত এবং উমইয়াম । দুই বােন বললাে, কে আগে প্লেন ল্যান্ডে পৌছতে পারি। একটা সােজা রাস্তা চুজ করে ডাক দিয়ে চলে গেল একজন। উমইয়াম পাহাড়ি রাস্তাটা চুজ করলাে। সে চেরাপুঞ্জি থেকে যখন ঝাঁপিয়ে পড়লাে বাংলাদেশে, তখন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখলাে ওর দিদি পৌছেছে কিনা। এই যে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একটা গােলমতাে নদী তৈরি হয়ে গেল। তার থেকে সাতটা উপনদী সৃষ্টি হলাে। সেই থেকে খাসিয়ারা ওকে
বলে রুপাতল্লী। এর মানে হলাে রুপাের মালা। গলা থেকে সাতটা লকেটের মতাে ঝুলে বেরিয়েছে।
শা: বিধু দাস গুপ্তের ব্যাপারটা বলবেন? আপনার লেখার একটা অংশে ওর কথা আছে।
অ: বিধু বাবু প্রায়ই আসতেন আমার বাড়িতে। ওদের মধ্যে প্রায়ই একটা ভীষণ নিরাশা । কিছু হবে না। ক্যাম্পের এরকম অবস্থা। আর্মস নেই। এরকম আরেকজন ছিলেন ব্যারিস্টার মােমতাকিন সাহেব। সব মইরা যাইবাে, মিসেস লাহিড়ী সব মইরা যাইবাে। আমাদের কিছু হইবাে না, তিনি বলতেন। ভীষণ একটা হতাশা তাদের মধ্যে ছিল। এতাে লােক মরছে। মানে বিধু দাস গুপ্ত প্রায়ই আসতেন আমার কাছে। কিছুটা হয়তাে সাইকোলজিক্যাল। কিছু বলে নিজেকে হয়তাে রিলিফ করতে পারতেন, হয়তাে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারতেন না। যে জন্য পরে কলকাতায়ও এসেছেন। ওদের প্রায়ই নানা প্রবলেম নিয়ে আসতেন। অমুকের মেয়ের রিহেবিলিটিশন দরকার । অমুকের অমুক দরকার তাে সেগুলাে আমাকে দিয়ে করাতেন। বলতেন যে দিদি যদি হেল্প করেন । এমনি মনটা খুব জেনারেস ছিল। ওনার সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের যােগাযােগ ছিল। ভেতর থেকেও লড়াই করেছেন। উনি খুব কনসার্ন ছিলেন। উনি তাে বেঁচে আছেন, ক্যান্সার হয়েছে, উনি আর কতদিন বাঁচবেন জানি না। ওর কাছ থেকে অনেক কিছু পেতে পারাে। ওকে বলাে, খুকুদি আপনার কথা একটু লিখেছে। মরবার আগে জানুক যে একদম ভুলে যায়নি লােকে। বিধু বাবু সম্পর্কে যতটুকু লিখেছি, সবটাই তার মুখ থেকে শােনা। তাছাড়া আরেকজন হবিগঞ্জের লােকের নাম আমি এখন মনে করতে পারছি না, মুসলিম ভদ্রলােক আওয়ামী লীগের, তিনি একজন নেতা ছিলেন। তিনিও বলেছিলেন যে, হঁা প্রথম তাে পাকবাহিনী বিধু বাবুকে অ্যারেস্ট করার অর্ডার দিয়েছিল। তারপর গ্রেফতারি পরােয়ানা নিয়ে আসে যখন, তখন তিনি প্রটেস্ট করেন। তখন ঐ পুলিশের অফিসার ওকে গুলি করতে যায় । তাে যেই গুলি ওর দিকে তাক করেছে সেই সময় দুটি ছেলে ছুটে এসে বিধু বাবুর সামনে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন গুলি খায়। সেখানে সুরঞ্জিত ছিলেন, তারপরে কর্নেল দত্ত ছিলেন, এদের কাছে তিনি বললেন, অস্ত্র দাও, আমি ভেতরে থেকে কমান্ডাে বাহিনী করে ওখানে লড়বাে।
শা: শিলংয়ে কোথায় থাকতেন ওরা?
অ: ক্যাম্পে থাকতেন, দূরে ঘােরাঘুরির মধ্যে থাকতেন। আর আমাকে সমানে সব খবর পাঠাতেন যে এরকম অবস্থা, আপনি এটা করেন, ওটা করেন। এ ক্যাম্পে আপনি কথা বলুন। আমাকে কেউকেটা ভেবেছিল, অনেক ক্ষমতা আমার ।
শা: আপনার সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা হয়েছে ওঁর?
অ: হ্যা। বােনের বাড়িতে, দিদির বাড়িতে, কলকাতায় দেখা হয়েছে। শা: উনি আর আসেননি শিলং?
অ: না, আসেননি। শা: আচ্ছা শরণার্থী ক্যাম্পে যখন যেতেন, দু’তিন জন আপনার সঙ্গে থাকতাে? নাকি প্রায়ই একা যাওয়া-আসা করতেন?
অ: কেউ না কেউ থাকতাে হয়তাে, অত আমার মনে নেই। কখনও আমি একলা গেছি, কখনও জ্যোৎস্না বা আশরাফি।
শা: ওরা এখন কোথায় আছেন, জানেন? অ: জ্যোৎস্না এখন রিটায়ার্ড করে বাড়িতেই আছে। এক বােন মারা গেছে। আশরাফিরা এখন খুব ধর্মপ্রাণ, কোরান পড়ছে ওজু করে। শা: কোথায় থাকেন? অ: শিলংয়ে থাকে। প্রফেসর ইকোনমিক্সের। শা; আর একদিন তাে আপনার দিদি, কল্যাণী দাস গেলেন আপনার সঙ্গে। অ: দিদি আরও গেছেন, যখনই আসতেন যেতেন । শা: কোথায় আসতেন, শিলংয়ে? থাকতেন কোথায়? অ: ও থাকতাে তাে শিলচরে, ওর হাসপাতালে। শা: শিলচর কি বাংলাদেশ বর্ডারের আরাে কাছে?
অ: হঁ্যা। লুসাই পাহাড়, এদিক দিয়ে ত্রিপুরা। দিদির সঙ্গে আমি বাংলাদেশেও গেছি। পরে। কারণ ওর স্বামী বীরেশ মিশ্র, তার তাে ঢাকা দক্ষিণে বাড়ি। শা: আপনার ছােট বােন ‘৭১-এ কোথায় ছিলেন? কলকাতায় না গৌহাটিতে? অ: শিলংয়ে ছিল। ওর নাম আরতি দত্ত । ও তখন শিলংয়ে ছিল। ও এতাে ক্যাম্পে ট্যাম্পে যায়নি। কিন্তু ওর ঘাড়ে আমি আমার সংসার অনেক সময় চাপিয়ে দিয়ে গেছি। আমি চিরকালই বাউণ্ডুলেপনা করে ঘুরতাম। আমার এই অবাধ্য ছেলেমেয়েকে ওকে সামাল দিতে হতাে। ও আমাকে অনেক সাপাের্ট দিয়েছে আমার জীবনে। ও একটু
ঘরােয়ামতাে। এককালে আইপিটিএ করতাে, নাচতাে, গাইতাে, থিয়েটার করতাে। কিন্তু এরকম ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ানাে, ওরকম পারে নি।
শা: এটা আপনারই লাইন। অ: হ্যা। সুনামগঞ্জের একটা পরিবারকে পেয়েছিলাম। তাদের মেয়ে, আমরা তখন ঐ শিলংয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। বীরেন রক্ষিত বলে একজন অধ্যাপক এবং কবি, তিনি একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছিলেন। তার ওপরে গান ও পাঠ এবং বহু গান হয়েছিল সেখানে। তখন আমার গলাটা এরকম ভাঙা ভাঙা ছিল না। সুতরাং সেই পাঠে আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং টিকিট বিক্রি করেছিলাম। বাংলাদেশের দু’তিনটি ছেলেমেয়ে এসে সেখানে গান গেয়েছিল। প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ সেই গান। তারপর বাংলাদেশের ওপরে স্পেশালি লেখা গান হলাে, ওরা তখন বাংলাদেশ থেকে এসেছে, ওরা গান নিয়ে এসেছে। সে একেবারে প্যাক্ট-আপ হলাে, বেশ টাকা উঠলাে। সে টাকা আমরা বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের তহবিলে দিলাম ।।
শা: খুব ইন্টারেস্টিং, আচ্ছা এই অধ্যাপক কি বাঙালি?
অ: হঁ্যা। উনি তখন শিলংয়ে অধ্যাপনা করতেন বাংলায়। তারপর উনি গৌহাটি ইউনিভার্সিটির বাংলার হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট হলেন। ওর কবিতা একটু দুর্বোধ্য। কিন্তু উনি খুব সংবেদনশীল কবি। এখন উনি কল্যাণীতে অবসর জীবনযাপন করছেন।
শা: এরকম কয়টা প্রােগ্রাম করেছিলেন আপনারা?
অ: ঐ একটাই করেছিলাম তখন । আর টাকাটা ঐ বাংলাদেশ তহবিলে যায়।
শা: শরণার্থী ক্যাম্পে কি রান্না হতাে?
অ: ঐ ভাত আর ডাল একসঙ্গে মিশিয়ে একটা ঘ্যাট তৈরি করা হতাে। ঐ হাতে করে তুলে তুলে দিতে সবাইকে। আর সে পলিথিনের যে ছেড়া মাথার ছাদ তার ওপর সবুজ শ্যাওলা ধরে গিয়েছিল। সে বছর যেরকম বৃষ্টি, এরকম বৃষ্টি আমি আর কখনাে দেখিনি। প্রতিদিনই বৃষ্টি, খালি বৃষ্টি।
শা: এই যে সারাদিন থাকতেন, খেতেন কোথায়? অ সঙ্গে কিছু খাবার নিয়ে যেতাম। একটু পাউরুটি স্যান্ডউইচ বানিয়ে, ঐ খেতাম। আর ঘুরতে ঘুরতে অত খিদে পেতাে না। আর চারধারে কলেরা-টলেরা এসব দেখে খাবার ইচ্ছা হতাে না। ঐ সঙ্গে এক বােতল জল নিতাম, ও দিয়ে হয়ে যেতাে। শিলংয়ের পথে পাহাড়ের ওপর উঠে, কোনাে চায়ের দোকানে, খাসিয়ার দোকান থেকে চা খেয়ে নিতাম।
৫৯
শা: লঙ্গরখানায় কোনাে চায়ের ব্যাপার ছিলই না?
অ: না না। লঙ্গরখানায় কোনাে চায়ের ব্যাপার তাে ছিল না; এমনকি কোনাে দোকানটোকানও ছিল না। আর খাসিয়ারা খুবই ব্যবসায়ী, প্রত্যেকটা ব্যাপারে নাচেগানে-মিটিংয়ে, সভায়, সর্বত্র ওদের একেবারে মােবাইল একটা দোকান চলতে থাকে। তার মধ্যে ভাত, শুয়ােরের মাংস, পােলাও, ডিম সিদ্ধ সবই চলে। কিন্তু শরণার্থী ক্যাম্পের ধারে-পাশে, ওরা জানে যে রিফিউজিরা এতাে গরিব এখানে দোকান দিলেও চলবে না। সব প্রায় ভিখিরি । সেজন্য দোকানটোকান ওখানে কেউ করেনি কখনাে।
শা: লঙ্গরখানার খিচুড়ি খাননি কখনাে?
আ: না। আমাকে দেবেই-বা কেন। ওখানকার শরণার্থী যারা, খালি তাদের জন্য। আর কাপড় নিয়ে গেলে একেবারে হুলস্থুল পড়ে যেতাে, এ বলে আমার নেই, ও বলে আমার নেই, কেউ কাপড় তুলে পেট দেখায় যে, দেখ কতদিন দানা পড়েনি। সে ভীষণ অবস্থা। মানে কিছু নিলেও এ অবস্থা। মানে তুমি হাজার লােকের মধ্যে যদি দুশােটা কাপড় নিয়ে যাও নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগে যাবে না।
শা: একবার তাে আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অ: শিলং থেকে মেয়েকে নিয়ে টেকেরঘাট হয়ে এক জিপভর্তি ওষুধ, জিনিসপত্তর নিয়ে যাচ্ছি, এই সময় রাস্তায় একটা পুরাে পাহাড় ধসে পড়লাে।
শা: বর্ষাকাল ছিল? অ: হ্যা, প্রায় ঐ সমস্ত জায়গায় ল্যান্ডস্লাইড হয় বর্ষায়। তাে সেটা হওয়ার হবে, এখন কী করে মালপত্র নেবাে। সেই গ্রাম থেকে টেকেরঘাট থেকে মাল বইবার জন্য লােক নিয়ে এলাে। মাল বইয়ে স্টোন স্কোয়াডে একজনের বাড়িতে আমরা গিয়ে উঠলাম। তার বাড়িতে গিয়ে রাতে খাবার পর ভােরবেলা একটা ছেলে এলাে- ডাক্তার নজরুল ইসলাম, ঢাকা থেকে পাস করেছে। সে বললাে যে, মাসিমা আমি স্পিডবােটের ব্যবস্থা করেছি। স্পিডবােটে করে সব ওষুধ আমরা সাচনায় নিয়ে যাবাে। সেখানে একটা মিলিটারি বেজ ক্যাম্প আছে, সেখানে অনেক রােগী আছে। তখন আমরা ঐ সকালবেলা উঠলাম, স্পিডবােটে করে রাত্রিবেলা গিয়ে পৌছলাম, মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে।
শা: আপনি, আপনার মেয়ে, নাকি আরাে অনেকেই ছিল? অ: আমি, আমার মেয়ে।
শা: আর কেউ নেই? জিপেও দু’জন ছিলেন?
অ: না, ঐ নজরুল ইসলাম ছিল । ডাক্তার।
শা: শিলং থেকে সেও আপনাদের সাথে আসছিল?
অ: হ্যা, তাকে আমি চিনি না, কিন্তু ওখানেই পরিচয় হয়েছিল । ছেলেটিকে দেখে খুব ভালাে লাগলাে। খুবই দ্র।
শা: সাচনা তাে বাংলাদেশে?
অ: হ্যা, ঐসব সুনামগঞ্জ ঐ এরিয়ায় আর কি। আজমিরীগঞ্জ, সাচনা হাওর এলাকা।
শা: তারপর ওখানে চলে এলেন?
অ: স্পিডবােটে করে এলাম, এসে রাতের বেলা পৌছলাম । পৌছানাের পর দেখলাম, আমার সৌজন্যে একটা ডিনারের ব্যবস্থা হয়েছে এবং মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা নাচ-গান দিয়ে এন্টারটেন করলাে আমাদের। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা মেয়ে হয়ে নাচলাে, অভিনয় করলাে।
শা: তারপর গিয়েছিলেন কোথাও! নাকি এটাই শেষ যাওয়া ছিল আপনার?
অ: কোথায় গিয়েছি আর, বাংলাদেশে? তারপর ২১ ফেব্রুয়ারি সিলেট নিয়ে গেল, মঞ্চে উঠিয়ে দিলাে। বলির পাঁঠার মতাে ভয়ে পা কাঁপছে। কারণ তােমাদের ডিসি-ফিসি কারা কারা বড় কর্মকর্তারা বক্তৃতা দিচ্ছেন এত চোস্ত বাংলায় একটা ইংরেজি শব্দ নেই। তার মধ্যে আমাকে। ভাবছি ধরণী দ্বিধা হও, কী করে কী বাবাে। রীতিমতাে ভয়ে পা দুটি কাঁপছে তখন।
শা: তখন কি আপনি ঢাকা হয়ে গিয়েছিলেন? অ: না, ঢাকা হয়ে যাই নি। শা: সেটা ১৯৭২-এ ছিল?
অ: হা, হা ।
শা: কিন্তু যুদ্ধের সময় এমনিতে আপনি বাশতলা যেতেন?
অ: এগুলােতে প্রত্যেক সপ্তাহেই যেতাম।
শা: মিয়ার বাড়িতে যে দাওয়াতটা খেলেন, সেটা তাে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আগে। তারপর সাচনার সেই যাওয়ার পর আবার গিয়েছিলেন?
অ: প্রত্যেক সপ্তাহে যেতাম এই এলাকায়, হয় বালাট, নয় সেলা, নয় পনটুং। লােকের কাছ থেকে টাকা তুলি, দোকান থেকে এই করি, নীরেনকে দিয়ে টাকা ওঠাই। গৌহাটি থেকে ওদের আত্মীয়-স্বজন চাঁদাটাদা দিলাে। আত্মীয়ের কাছে টাকা চেয়ে পাঠাই। নিজেও কিছু, যাই হােক করেটরে। দিল্লি থেকে তাে ভালােই টাকা দিয়েছিল।
শা: কত টাকা যেন?
অ: ১০,০০০ টাকা। শা: আপনি আর আপনার দিদি, দু’জনে গিয়েছিলেন?
অ: আমি আর নীরেন লাহিড়ী। শা: বাড়িটাকে তাে শরণার্থী ক্যাম্প বানিয়ে ফেলেছিলেন।
অ: হঁ্যা। ওরা থাকতাে, মানে এরা কখনও কখনও থাকতাে। অন্যরা, সুরঞ্জিত, নবী থাকতাে, আসতাে-যেতাে, খেতাে, প্রত্যেকেরই থাকার ব্যবস্থা একটা মােটামুটি হয়েছিল। সেই লেপ-কম্বল দেয়া থেকে শুরু করে জামা-কাপড়। প্রফেসর রঙ্গলাল সেনের স্ত্রী কমলার যে চিঠি কাল তােমাকে দেখিয়েছিলাম, এদের তাে কিছু তখন নেই। এরা তাে শিক্ষিত মানুষ, ধরাে কলেজের প্রফেসর, কিন্তু মানুষ যখন রিফিউজি হয়ে যায় তখন সে সম্মান আর পায় না তাে। সেই রঙ্গলাল বাবুকে তখন আমি সেন্ট্রাল উইমেন কলেজে মাত্র ৭৫ টাকায় সপ্তাহে একদিন একটা লেকচারশিপের ব্যবস্থা করে দিলাম। আর কমলাকে চার-পাঁচটা টিউশনি। আমার মেয়েরা কমলার কাছে কিছুতেই বাংলা শিখবে না। আমি জোর করে খুব বক্তৃতা দিলাম যে তােমাদের ইয়ে এরকম ভালাে না। উচিত এর কাছে পড়া। তাকে টিউটর করলাম। পাড়ায় সেই বেচারা ভাের থেকে রাত, এখানে-ওখানে টিউশনি করতাে। বৃষ্টিতে ভিজতে আর খালি এসে বলতাে, আমার ইচ্ছে করে দিদি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলি। কারণ একটা ঘরে যেটা গুদাম ঘর ছিল, কয়লা রাখতাে ভদ্রলােকেরা সেই কয়লার ঘরে, ওরা কোনােমতে বাস করতাে। চানের পরে কাপড় ওরা মেলতে পারতাে না, তােমরা তাে অনেক নিকৃষ্ট জাতের লােক, তােমরা রিফিউজি। তাে তারই মধ্যে ওর মা এলাে, বােন এলাে, আর এক বােন এলাে, কোনােমতে থাকা আর কি। প্রত্যেকদিনই আমার মেয়েকে পড়ার নাম করে আমার কাছে আসতাে সে।
শা: কার বাড়িতে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন?
অ: বাঙালি বাড়ি, বেশ বড়লােকের বাড়ি। তাে তাদের বাড়ির পেছনে যেখানে ওরা বর্ষা-ঠাণ্ডার দিনে জ্বালাবার জন্য কাঠ-কয়লা, পাথুরে কয়লা এসব রাখতাে, সেই ঘরটা খালি করে দিয়েছিল। গ্যারেজের মতাে ছােট্ট ঘর।
শা: মেঘালয়ের বাঙালিদের মনােভাব কী রকম ছিল মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে। অ: প্রথম দিকে খুব উৎসাহ। দেশে ফিরে বড় বড় রুই মাছ, ইলিশ মাছ খেতে পারবে। মেয়েরা জামদানি শাড়ি কিনবে।
শা: যুদ্ধ লাগার পরপর এরকম ভাবতে পারলাে?
অ: না, ওরা ভেবেছে আর কতদিন পরেই যুদ্ধ শেষ হবে। দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে । পুরনাে বাড়ি দখল নিতে ফিরে যাবে। বাঙালিরা বিশেষ করে মাছ পছন্দ করে। তাছাড়া শােনা যায়, সুনামগঞ্জে এক হাত লম্বা বড় বড় কই মাছ পাওয়া যায়। তারপর দেখা গেল মাছটাছ তাে দূরে থাক, সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আবার রিফিউজি আসতে শুরু করেছে। মাছটাছ তাে দূরস্থান বরং আমাদের জিনিসের ওপর ট্যাক্স বসতে শুরু করলাে। স্ট্যাম্পে ট্যাক্স বেড়ে গেল । অনেক মধ্যবিত্ত, যাদের আত্মীয়-স্বজন ছিল শিলংয়ে তারা আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাে। তখন সেসব বাড়িতে অনেক আত্মীয় এসে ঢুকলাে। সুতরাং সেই যে স্বপ্ন দেখেছিল দেশে ফিরে যাবে, মাছ খাবে, জামদানি শাড়ি পরবে, সেই স্বপ্ন বাস্তবে তাে রূপান্তরিত হচ্ছে না বরং তাদের অর্থনীতিতে একটা চাপ পড়ছে। সেজন্য শেষের দিকে এমন হলাে, দেখা গেল যে, ক্যাম্প হলাে টাকা রােজগারের একটা জায়গা। বেশিরভাগ মানুষ যারা বর্ডারে ছিল তারা অনেকে আরসিসি টিন, কাসার বাসন নিয়ে আসতাে। দু-একটি গরু এনেছিল। তারপর যখন মড়ক শুরু হলাে, তখন একটা স্যালাইনের জন্য পুরাে টিন বিক্রি করে দিলাে, কাসার বাসন বিক্রি করে দিলাে। যার যা ছিল তা জলের দরে বিক্রি করে দিলাে। তখন প্রাণ বাঁচানাের ব্যাপারে একজনের চোখের জলের মধ্য দিয়ে অন্যজন সমৃদ্ধশালী হলাে।
শা: এরকম ব্যবসার সাথে বাঙালিরা কি জড়িত ছিল?
অ: না। বাঙালিরা ছিল না, আমার জানামতে। যদি থাকে তবে খুব অল্প, স্থানীয় লােকেরাই ছিল।
শা: খাসিয়ারা?
উ: ওরে বাবা বর্ডারে ওরাই তাে চিরকাল বাংলাদেশের সঙ্গে জিনিসপত্র আনা-নেয়া করেছে। যদিও নামে মাত্র একটি সীমান্ত আছে বা ছিল। বাংলাদেশ থেকে ধান, চাল, নুন, মাছ বরাবর বর্ডার দিয়ে আসতাে। এদিক থেকে পান, চুন, তেজপাতা, কমলালেবু যেতাে। সব জায়গার সবচেয়ে ভালাে কোয়ালিটির পান, চুন পাওয়া যেতাে চেরাপুঞ্জিতে। ওগুলাে বরাবর বাংলাদেশে যেতাে। পরিবর্তে ওরা ধান, মাছ এসব আনতে। সুতরাং ওটা একটা আর্টিফিসিয়াল বাউন্ডারি ছিল। বর্ডারের কিছু লােক
বিনিময়ের ভেতর দিয়ে বেঁচে ছিল এতােদিন। বিএসএফের লােকও কম রােজগার করতাে না। সােনাদানা এসবও আসতাে।
শা: যাতায়াতের জন্য নদী ছিল?
অ: নদী, তামাবিল দিয়ে রাস্তা আছে। তবে এই এলাকায় নদী ।
শা: শিলংয়ের ডাউকি বর্ডারে কাজ করেননি, না? ওখানে ক্যাম্প ছিল? অ: প্রথম দিকে ছিল, পরে উঠিয়ে দিলাে ওরা। দিয়ে আর একটু ইন্টেরিয়রে নিয়ে গেল । আমলারেং এবং পনটুং বলে একটা জায়গায় শিবিরগুলাে নিয়ে গেল। একটু রিমােট জায়গায়। কিন্তু সেগুলাে পাথরের ওপর। দিনে-রাতে বৃষ্টি পড়ে। ওখানে গিয়ে দেখি কোথায় বাবা, স্ত্রী, কোথায় ছেলে, কে কোথায়, কোন্ ক্যাম্পে চলে গেছে, ঠিক নেই । এরকম বহু লােক পেতাম যাদের নাম লিখে রাখতাম। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী সবার নাম।
শা: প্রথম কোন্ ক্যাম্পে গিয়েছিলেন?
অ: সবার আগে তামাবিল গিয়েছিলাম। আচ্ছা আরেকটা কথা বলি, বলা উচিত কিনা?
শা: বলেন।
অ: প্রথম যেদিন তামাবিল ক্যাম্পে গিয়েছিলাম তখন বেশ কয়েকটা আনারস নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন সিলেটের তামাবিলের ঐ দিকে বাংলাদেশ বর্ডার। হঠাৎ দেখি চারটা বুড়াে মৌলবিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে মুক্তিফৌজের ছেলেরা। তারা বিড়বিড় করে দোয়া-মন্ত্র পড়ছে। আমি বললাম, কোথায় নিচ্ছাে। ওরা একটা গাছ দেখালাে। গুলি করে মেরে ফেলবে। আমি বললাম, বুড়াে মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলবে? ওরা বললাে, হঁ্যা, ওরা আমাদের বহু ছেলে ধরিয়ে দিয়েছে। আমি বললাম, মরে যাবে, ওদের আনারস দুটি খেতে দাও। কী বকুনি আমায় দিল জানাে।
ওখানে একজন মেজর মুত্তালিব ছিলেন। লুঙ্গি পরে অতি সাধারণভাবে থাকতেন। কেউ লুঙ্গি পরা, কেউ ধুতি পরা। তাে তিনি বললেন, দিদি আপনি কিছু বলুন। ওদের সবাইকে দাঁড় করিয়ে কুচকাওয়াজ করানাে হচ্ছে। তখন দেখলাম, বেশ কিছু ছেলে। ওরা কেউ কিশােরগঞ্জের, কেউ সিলেটের। তখন থেকে আমার বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস হলাে। সে যে কী বক্তৃতা!
শা: কী রকম বক্তৃতা?
অ: কী আর বলবাে। এই যে তােমাদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, এখন তাে দেশ রক্ষা করতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে। দেশকে যদি ভালােবাস, তাহলে দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। এই।
শা: তাহলে প্রথমে আপনি গেলেন তামাবিল ক্যাম্পে?
অ: প্রথমে যাই ডাউকি ক্যাম্পে। আমি এবং দিল্লি থেকে একটি মেয়ে এসেছিল রানী দাসগুপ্ত, সিপিআইর। ও শরণার্থীদের দেখতে চেয়েছিল কিন্তু কোনাে সুযােগ পায়নি। পার্টি তখনাে কোনাে ডিসিশন নেয় নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সহায়তা করবে কিনা। বললাে, আমি সবার কাছে গিয়েছিলাম। সবাই খুব ইনডিফারেন্ট, কেউ কোনাে ইন্টারেস্ট দেখালাে না। তাই আমার বাড়িতে এসে উঠলাে। বললাে, দেখ না তুই যদি কিছুটিছু করতে পারিস। ডিসির কাছে ফোনটোন কর। ডিসিকে বললাম, আমরা একটু দেখতে চাই ওখানে কী অবস্থা। ডিসি পারমিশন দিলেন। সেই যে প্রথম ঢুকলাম তারপর থেকে আমি ইনভলভ হয়ে গেলাম আর কি।
শা: সেদিন কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
অ: গিয়ে দেখলাম, নদীর ধারে পাথরের ওপর, ছড়ানাে-ভরানাে, মাথায় কোননা আচ্ছাদন নেই। লােকগুলাে হাহাকার করছে, ওখানে বসে।
শা: তখন বাড়িঘর তেমন ওঠেনি সেখানে, না?
অ: ঘরবাড়ি ওঠেনি। একেবারে চরম অবস্থা। কোনাে রকমে পালিয়ে এসেছে।
শা: কী ধরনের মানুষ এরা?
অ: কৃষিজীবী মানুষ বেশিরভাগ। মধ্যবিত্তরা ক্যাম্পে-ট্যাম্পে, কিছু টাকা নিয়ে হােটেলে বা আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে। এরা বেশিরভাগই কৃষিজীবী মানুষ বা জেলে। মাছ-টাছ ধরতাে যারা, এরকম একটা বিরাটসংখ্যক লােক পালিয়ে এসেছিল। সবার ওপর আক্রমণ হয়েছে এবং মারতে শুরু করেছে। প্রথম কিস্তিতেই বেছে বেছে হিন্দু মারছিল । সুতরাং হিন্দু বেশি এসেছিল তখন। শা: হিন্দু হলেই মেরে ফেলতাে, প্রথম কিস্তিতেই না, শেষ পর্যন্তও।
অ: তারপর আমার বন্ধু হেনা দত্ত, সে আমার দিদির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। শুনেছি, সে যখন আসে তখন তাকে তাে মারার জন্য অস্থির। তখন এক মুসলমান পরিবারই বােরকা দেয়। সেই বােরকা পরে কোনােমতে হেঁটে পালিয়ে আসে। পরে শােনা যায়,
৬৫
যারা আশ্রয় দিয়েছিল তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। দিল্লিতে রেডক্রসের সঙ্গে আমাদের প্রচুর ঝগড়া হয়েছিল।
শা: কী নিয়ে?
অ: ওরা বিশ্বাস করে না যে, ওদের জিনিসপত্রগুলাে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। শরণার্থীরা কেউ পাচ্ছে না। যতটুকু সার্ভিস পাওয়ার কথা ছিল তা পাচ্ছে না।
শা: আপনার মতাে আর কোনাে বাঙালি মহিলা এ রকমভাবে কাজ করেনি?
অ: ঐ যে আশরাফির কথা বলেছিলাম। খ্রিস্টান কয়েকজন মহিলা ছিল।
শা: তারা ছাড়া আর কেউ?
অ: এরকম করে কার বাড়ি মেয়েদের ছাড়বে । মিলিটারি লােকের জিপে চড়ে কোনাে অজানা জায়গায় কি রিস্ক, তখন তুমি নিজের দুই হাত দেখতে পাচ্ছে না। চেরাপুঞ্জির দুই ধারে ফগ। কোথায় রাস্তা, কোথায় কি, সমস্ত একাকার। কিছুদূর গিয়ে ল্যান্ডস্লাইড। কাদা। কাদার মধ্য দিয়ে জিপ ঠেলে নিয়ে যাওয়া, জীবন হাতে করে । কিন্তু তখন এমন একটা নেশা ধরে গেছে যে মরার কথা ভাবিনি।
শা: আর কারা কাজ করতাে?
অ: আমার সংযােগ ছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে বা ক্যাম্পে যারা কাজ করতাে তাদের। সঙ্গে। কিন্তু শহরের মধ্যে যেমন স্টেটম্যানের করেসপনডেন্ট ছিলেন নীল কমল দত্ত বা সেই সময় আরেকজন ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কান্তি দাস। যিনি মাঝে মধ্যে বাংলাদেশেও যেতেন এবং এই নীল কমলের বাড়িতে মিজানুর রহমান, তিনি তখন মন্ত্রী-ফন্ত্রী ছিলেন, তিনি প্রায়ই আসতেন। ওদের বাড়িতে প্রায়ই পার্টি-টার্টি হতাে এবং বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় যারা আর কি ক্যাম্পে থাকতেন না, তাদের সবার একটা গেট টুগেদার হতাে ঐ বাড়িতে। তাে সেখানে আমি মাঝে মধ্যে গেছি। কিন্তু আমি ঐ উপরতলার সঙ্গে অত যােগাযোেগ রাখিনি বা আমার ছিল না। নীল কমল দত্ত মাত্র কয়েক মাস হলাে মারা গেছেন। তিনি ঐ টপের কথা অনেক জানতেন।
শা: ওদের এমনি কী ধরনের কাজ ছিল বাংলাদেশ নিয়ে?
অ: ওরা বাংলাদেশের সমর্থক ছিলেন । ঠিক এই সময় কাঠগুদাম থেকে আলমােরার কাছ থেকে আঙ্কেল জেথ্রো বলে একজন হাজির হলেন। খ্রিস্টান ভদ্রলােক। তিনি এলেন অক্সফাম থেকে। হঠাৎ কী করে সন্ধান পেলেন যে, সব মাল চুরি হয়ে যাচ্ছে এবং একজন আছে ভদ্রমহিলা নাম অঞ্জলি লাহিড়ী, সে এখনও চুরি করতে অতটা শেখেনি। সুতরাং তিনি একদিন গাড়িভর্তি কম্বল নিয়ে এসে আমার বাড়ি হাজির। যে
৬৬
চলাে, এগুলাে সমস্ত শরণার্থীর মধ্যে বিলি করা হবে। তাকে নিয়ে আমি, জ্যোৎস্না রওনা দিলাম ডাউকির রাস্তায়। যে ওখানে শরণার্থী শিবিরে কম্বলগুলাে বিলােবাে । হঠাৎ রাস্তায় একটা মিলিটারি ট্রাক এসে আমাদের এমন ধাক্কা মারলাে যে পুরাে ট্যাক্সি ভেঙে গেল । আর আঙ্কেল জেথ্রো এতাে নার্ভাস হয়ে পড়লেন যে কী করে ফিরবেন বয়স্ক ভদ্রলােক। তাে যাই হােক শেষ পর্যন্ত আমরা অক্ষত অবস্থায় রইলাম। আমাদের কিছুই হলাে না, গাড়িটা কেবল ভাঙলাে ।
শা: ভদ্রলােক কি ভারতীয়?
অ: হঁ্যা, ভারতীয়। ইউপি অক্সফামের লােক। বিদেশি ফার্মটার্মও এসেছিল হেলপ করবে। আমি দ্রলােকের সংস্পর্শে এসে প্রচুর কম্বল বিলি করার সুযােগ পেলাম আর কি। তারপর দেখলাম, শিলংয়ের উঁচু একটা নির্জন পাহাড়ে, বাংলােবাড়িতে তাদের হেডকোয়ার্টার। একবার গেলামও তাদের বাংলােবাড়িতে, সব মিটিং-ফিটিং হচ্ছে আরও যদি কিছু পাওয়া যায়। এভাবে বহু কম্বল-টম্বল পেয়েছিলাম এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে আমাকে বিশ্বাস করে আমার ওপরে সব ছেড়ে দিয়েছিলেন। শা: এগুলাে আপনি কীভাবে বিলি করলেন?
অ: রেডক্রসের গাড়ির সঙ্গেও আমরা কখনাে কখনাে বলেছি, যাবাে। একবারই পেয়েছিলাম রেডক্রসের গাড়ি। ঐসব বাংলাদেশের জিপ-টিপ। আর্মি জিপে করেই বেশিরভাগ নিয়ে গেছি। কখনাে দিদির জিপে গেছি। একবার কলকাতা থেকে আসা আমার এক এফ আর সি এস ভাই ডাক্তার, তাকে দেখাতে নিয়ে গেলাম। তাে সেদিন আমিনা বলে মেয়েটি মারা গেছে। গিয়ে দেখি একজন সুপুরুষ ভদ্রলােক বুড়াে, সে বদনা নিয়ে কানতে বসেছে। তার সব মরে গেছে আগের দিন। ঐ নাতনিটা খালি রয়েছে, আমিনা। আমিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, দিদি আমাকে বাঁচান। এতে সুন্দর মেয়ে আমি দেখিনি সত্যি। খাট থেকে তার লম্বা চুল ঝুলে পড়েছে মাটিতে, নাকে একটা ছােট সাদা পাথরের নাকফুল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, দিদি আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচান। কিন্তু পরের দিন খবর পেয়েছি, সে মারা গেছে। তাে আমার এই ভাই যে ডাক্তার, সে বললাে, এখন যদি একটা স্যালাইন পেতাম, এই মেয়ে বেঁচে যেতাে। তারপর আর কোথায় স্যালাইন, শিলং থেকে কতদূর এই সব বালাট-ফালাট। ফিরে যখন এলাম, খুব একটা ছাপ পড়লাে ওর মনের ওপর। তারপর কলকাতা থেকে আমাকে চাঁদা পাঠিয়ে দিলাে আর কি। আর আমার দাদা, তিনিও প্রচুর ওষুধ দিয়েছিলেন আমাকে। নিউ আলিপুরের দাদা সেও শরণার্থী শিবিরের জন্য অনেক ওষুধ দিয়েছিলেন।
৬৭
শা: অন্যান্য জায়গা থেকে কোনাে টিম আসেনি, সাহায্য বা ভলানটিয়ার?
অ: বাইরে থেকে পাঞ্জাব, দিল্লি না পাঞ্জাব না। দিল্লি, তারপর ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে যারা জাস্ট ডাক্তারি পাস করেছে, এরকম ইয়াং ছেলে কিছু কিছু এসেছিল ।
শা: থেকে গেছিল, নাকি তারা আসততা-যেতে? অ: ক্যাম্পের কাছে ওদের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা হতাে। হয়তাে ডাকবাংলােয় বা এরকম জায়গায় তারা থাকতাে আর কাজ করতাে শরণার্থীদের মধ্যে। ওখানে একটি পাঞ্জাবি ছেলে পেয়েছিলাম দিল্লির, খুব ভালাে ছেলেটা। আহুজা নাকি নামটা।
শা: সে কি শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করেছে?
অ: হ্যা। ঐ কলেরার মধ্যে কাজ করতাে। তারপর তার সঙ্গে আমি দিল্লিতে দেখা করেছি, তাদের বাড়িতে গেছি। এখন হারিয়ে গেছে তারা। শা: ভারতীয় মেজর জেনারেলদের বেশ নাম শােনা যায়, ঐ এলাকায় যেমন মেজর জেনারেল গিল ছিলেন। তার সঙ্গে আপনার যােগাযােগ ছিল? অ: ওরা হচ্ছে একদম টপে, আর্মি যারা সলাপরামর্শ করতাে যুদ্ধের ম্যাপ-ট্যাপ নিয়ে। কোথায় কীভাবে অ্যাকশন নেয়া হবে। অত হায়ার লেভেলে যাইনি। তবে মিলিটারি হাসপাতালগুলােতে যেখানে মুক্তিফৌজরা আহত হয়ে থাকতাে, সেখানে আমরা হরলিকস নিয়ে গেছি। সেই সময়ই, আহত অবস্থায় হাত-পা নেই, কাতরাচ্ছে, এই রকম অনেক ভারতীয় সৈন্য পেয়েছি। তাে সেটা খুব খারাপ লেগেছে যে মুক্তিফৌজের ধরাে মােটামুটি শহীদ হিসেবে বা যােদ্ধা হিসেবে নাম বা স্বীকৃতি আছে। কিন্তু সেই হিসেবে ভারতীয় সৈন্যরা একদম সম্পূর্ণ অলিখিত চাপ্টারে রয়ে গেল। তাদের নাম কেউ জানে না। বাংলাদেশের মিলিটারি নেতৃত্ব সংখ্যায় অতি কম। তারা বেশিরভাগই থাকতেন বিধান রায়ের বাবার বাড়িতে, গভর্নমেন্ট থেকে দেয়া হয়েছিল তাদের থাকার জন্য। ওখানে কামারুজ্জামান সাহেবকে দেখি। সেখানে বেশ ক’জন সেই সময় বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় লােক এসেছিলেন। মিজানুর রহমান, আরও কারা কারা সব ছিলেন এবং ওরা খুব ব্যস্ত তখন। ভারতবর্ষের কূটনৈতিক, সামরিক, বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে ওদের যােগাযােগ, নানা রকম ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলােচনা চলছে। আমি আসা-যাওয়া করছি। ঐ মােমতাকিন সাহেব ব্যারিস্টার ছিলেন ওখানে। এদের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছিল। ওখানে মাঝে মধ্যে গিয়েছি, খবর নিয়েছি, ঠিক সেই সময় কামারুজ্জামানের সাথে আলাপ হয়। তাে ওঁর কি মনে হয়েছিল, তিনি আমাকে হঠাৎ
৬৮
একটা কাগজ-পেন্সিল এনে বললেন, আপনি কয়েকটি লাইন লিখুন তাে এখানে। আমি বুঝতে পারলাম না, তিনি কেন লিখতে বলছেন। তারপর তখন আমার হাতের লেখাটা এখনকার চেয়ে একটু ভালাে ছিল। দেখে বললেন, বেশ পাকা হাতের লেখা।
শা: কী লিখেছিলেন?
অ: মনে নেই, কিছু লিখতে বললেন আর কি। কয়েকটা শব্দ। তারপর এর-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাে। তা ভাবলাম, এরা আমাকে কি কোনাে গুপ্তচর ভেবেছে নাকি। তাে যাই হােক পরে
শা: আপনার পরিচয় উনি জানতেন না? অ: তারপরও তাে অনেকেই, অনেক কিছু হতে পারে। পরিচয় তাে হা, মেঘালয়ের অ্যাডভােকেট জেনারেলের স্ত্রী আমি। কিন্তু এরকম ওপর মহলের লােকেরাও তাে স্পায়িং করে। সেই জন্য আসলে তিনি কী ভেবেছিলেন তা আমি জানি না। মােট কথা, কেন-বা বললেন লিখতে। একবার যখন আমি পুলিশে ধরা পড়েছিলাম, আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে যখন ধরে এনেছিল, তখন ঐ আই বি অফিসার আমাকে লিখতে বলেছিল, যে কয়েকটা লাইন লেখাে। যখন ইন্টারােগেশন করছিল সি আই ডি। বােধহয় দেখে যে মিল আছে কিনা, অন্য কোনাে হাতের লেখার সাথে বা অন্য কিছু।
শা: কাজে গিয়েছিলেন ওখানে?
অ: আমি তাে অহরহ, সর্বত্র তখন বিরাজমান।
শা: ঘরের কাজটাজ আর সে সময় করা হতাে না?
অ: স্বামী থাকতেন তখন গৌহাটিতে। একজন বুড়াে লােক ছিল, রান্না করতাে। ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতাে, সারাদিন আমি টইটই করে বেড়াতাম। সন্ধ্যাবেলায় ফিরতাম । না, এক বছর আমি সংসার সম্পূর্ণভাবে নেগলেক্ট করেছি। ‘৭১-এ মায়ের বাড়িতে থাকতেন আমাদের স্কুলের টিচার, আমরা মাসি বলে ডাকতাম। তাকে এনে রাখলাম। আমাদের বাড়িতে। তিনি ছেলেমেয়ের সঙ্গে থাকতেন। আচ্ছা আমি যখন রণাঙ্গনে যেতাম বা ক্যাম্পে যেতাম, বাড়ি ফিরে এসে আমি ছােট ছােট ডায়েরি রাখতাম। তারপর ছবিও বেশ কিছু তুলেছি। ক্যাম্পে ম্যালেরিয়ায় যারা মরতে, যাদের কুকুরে-শকুনে খেতে বা ঐ সমস্ত শরণার্থীদের অনেক ছবি আমি তুলেছিলাম। তারপর বাংলাদেশ হয়ে গেল। ‘৭০ গেল, ‘৮০ গেল, আস্তে আস্তে বিস্মৃতির অতলে চলে গেল সব। তারপর আমি যখন একবার বিদেশে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি, আমার যা কিছু ছবি, যা কিছু ম্যানুস্ক্রিপ্ট, সমস্ত হারিয়ে গেছে।
আমাদের শিলংয়ে একটা সাংস্কৃতিক চক্র আছে, ওরা প্রত্যেকের গল্প-কবিতা এসব নেয়। তাে আমি আবার সেই স্মৃতি থেকে খুঁজে খুঁজে এই ডায়েরির স্মৃতিচারণ যেটা লিখেছি সেলা বা বালাট ক্যাম্পের ওপর, সেটা আমাকে আমার ওখানকার কিছু বন্ধুও বলেছিল যে আপনি কোথাও ছাপাতে দেন না কেন। তারপর গৌহাটির সবচেয়ে নামকরা সাহিত্যিক তিনি তার একটা সাপ্তাহিক কাগজে অসমীয়তে আমার জগৎজ্যোতির ওপর লেখাটা কিস্তিতে কিস্তিতে ছাপাচ্ছিলেন। পরে ওর কাগজটা উঠে যায়। সুতরাং এটা সম্পূর্ণ হয়নি।
শা: পেপার কাটিংও নেই?
অ: মাত্র দু’তিন কিস্তিতে ছাপানাে হয়েছিল।
শা: সেগুলাে কোথায়?
অ: খুঁজে পেতে দেখতে হবে।
শা: মেজর মুত্তালিবের বইয়ে পেয়েছি, তখন শিলং থেকে সপ্তাহে দু’দিন বাস যেতে সেলায়।
অ: রাস্তাঘাট খুব খারাপ ছিল, সুতরাং খুব বেশি বাসে আমরা ঘুরিনি। আর বাসে করে যাওয়া অত বেশি হয়নি । আমি সাধারণত ওদের জিপে করেই গেছি।
শা: কিন্তু বাস চলাচল ছিল?
অ: খুবই কম। যেত কিন্তু এতাে ভিড় থাকতাে! বিশেষ করে শরণার্থীরা, যারা পারতাে শহরে আসতাে, মাঝে মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকতাে। এরা তাে জিপের সুযােগ পেতাে না। জিপের সুযােগ অবশ্য আমি পেয়েছি। কারণ ওরা যখন জানলাে আমি শরণার্থী শিবিরে কাজ করি, তখন যখনি ওরা যেত মােটামুটি আমাকে খবর দিত যে দিদি আপনি যাবেন নাকি । আমার যদি হাতে কিছু জিনিস মজুদ থাকতাে, কাপড় বা ওষুধ বা কিছু বা পুরাে সপ্তাহ এদিক-ওদিক তুলতামও, আবার কখনাে-বা জিনিসপত্র ছাড়াও খাবার-দাবার নিয়ে যেতাম। তবে যেতাম সমানে এটা ঠিকই, সপ্তাহে দু’দিন তিনদিন, হয় বালাট, নয় সেলা ।।
শা: চল্লিশ মাইল রাস্তা যেতে বারাে ঘণ্টা লেগেছিল মেজর মুত্তালিবের।
অ: হ্যা, হতে পারে। ৪০ মাইল রাস্তায় একেক সময় ল্যান্ডস্লাইড হয়ে যেতাে, পুরাে রাস্তায় ধস নামতাে। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির বড় পাহাড়গুলাে খুব সলিড নয়, একটু বালি পাথরে তৈরি, ওগুলাে জোরে বৃষ্টি পড়লে ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়লে রাস্তা বন্ধ । আর রাস্তার দু’ধারে গভীর গর্তগুলাে আর ঐ গর্তের মধ্যে বৃষ্টির কণাটনা মিশে একটা দারুণ কুয়াশা তৈরি হয়। সেই কুয়াশা যখন রাস্তার সঙ্গে মিশে যেতাে তখন কোনটা
গর্ত, কোনটা রাস্তা বােঝা যেতাে না। মানে তখন এক হাত সামনের জায়গাও দেখা যায় না। এরই মধ্যে জিপে করে যেতে হতাে আমাদের । যেতে হতাে এবং বেশিরভাগ লােকই ওইরকম রিস্ক নিতাে না। আমি নিয়েছি বােধহয় মূখ বলে । বুঝিনি যে কতটা বিপদ হতে পারে। একটা থ্রিল, যাচ্ছি।
শা: খারাপ যােগাযােগ ব্যবস্থার জন্যই কি শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরায় এতাে মানুষ মারা গেল?
অ: না না। প্রথমে তাে জলের খুব অভাব। পরিষ্কার জল নেই, নদীর জল খায়। তারপর ধরাে সেরকম স্যানিটারির ব্যবস্থা নেই। কখনাে কখনাে ব্লিচিং পাউডার শেষের দিকে ছড়াতাে। কিন্তু তখন ঐ একজনের থেকে আরেকজনের হয়ে যেতাে। মড়ক হয়ে গেল প্রায়।
শা: তখন তাে স্যালাইন যায়নি?
অ: স্যালাইন তাে একবারে ছিল না। সবই ব্ল্যাকে বিক্রি হতাে। ১৫ টাকার স্যালাইন ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তখন মানুষগুলাে সর্বস্বান্ত হয়ে নিজেদের বাসন-কোসন, গয়নাগাটি বা আরসিসি টিন সব বিক্রি করেছে একটা স্যালাইনের জন্য। আর ডাক্তারও খুব অপর্যাপ্ত। রেডক্রস থেকে দু’চারজন ডাক্তার যেতাে। তারা দিনে-রাতে কত কাজ করবে? আর সকলে সেরকম ডিভােটেডও ছিল না। সুতরাং ডাক্তারের অভাব, ওষুধের অভাব, স্যানিটেশনের অভাব।
শা: শরণার্থী ক্যাম্পে বাংলাদেশি ডাক্তার ছিল?
অ: খুব কম, তাদের তাে আমি খুবই কম দেখেছি। খুবই কম।
শা: আমি সেলার শরণার্থী ক্যাম্পের দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, প্রীতি রানী দাশ পুরকায়স্থ আর নিবেদিতা দাশ, ঐ যে মহিলা মুক্তিফৌজের সেক্রেটারি ছিল যে। তাে ওদের কাজকর্ম, মহিলা মুক্তিফৌজ একটা করেছিল ওরা সমিতির মতাে, ওইটার ব্যাপারে একটু বলবেন।
অ: হঁ্যা, আচ্ছা মহিলা মুক্তিফৌজ যারা, প্রীতি রানী যিনি, তিনি ওখানে ওর বাড়িতে সাধারণত মুক্তিফৌজের ছেলেদের খাওয়াতেন এবং ওরা শরণার্থীদের থেকে মুষ্টিভিক্ষা তুলতেন, ক্যাম্প থেকে একটু একটু করে চাল। কারণ কেউ ভেতরে অপারেশনে যাওয়ার আগে হয়তাে ওর কাছে এসে বলতাে, খেতে দিন। এই সমস্ত মেয়েরা ওরা একটা এরকম সমিতির মতাে করে, যারা একটু শিক্ষিত তাদের মধ্যে একটু এই সেবার কাজ করার আগ্রহ। মানে কতখানি ওরা গিয়ে ক্যাম্পে, হাসপাতালে কাজ করেছে, আমি জানি না। কিন্তু ভেতর থেকে বােধহয় জিনিস কালেক্ট করতে আর কি।
তবে তারা সাহায্য করতে রান্নাবাড়া করে খাইয়ে। তারপর আমাকে বললাে যে, তােমরা যদি একটু জিনিস এনে দাও, কাপড়-চোপড়-সুতা, প্লাস্টিকের সুতা, তাহলে আমরা কিছু জিনিস তৈরি করতে পারি। ওগুলাে যদি বিক্রি করে দাও, তাহলে সেই টাকা দিয়ে আমরা মুক্তিফৌজের জন্য তহবিল করতে পারি। তখন আমি ওদের জন্য অনেক প্লাস্টিকের সুতা, কাপড় এসব নিয়ে গেছি। শা: কী ধরনের সেলাইয়ের কাজ?
অ: এই টেবিল ক্লথ, চারধারে জয় বাংলা লেখা, পদ্ম আঁকা, ঐ ধরনের আর কি। অনেক টেবিল ক্লথ, রুমাল তারপর প্লাস্টিকের ব্যাগ। ওগুলাে আমরা শহরে বিক্রি করতাম। জবরদস্তি বিক্রি, মানে নিতেই হবে। সেটা বিশেষ করে নীরেন লাহিড়ী খুব করেছে। ওর হাইকোর্টের উকিলদের কাছ থেকে অনেক টাকা তুলেছে।
শা: শেষের দিকে বােধহয় ক্যাম্পের অবস্থা একটু ভালাে হয়েছিল?
অ: ক্যাম্পের অবস্থা ভালােটালাে না। ভালাে না। কিন্তু অনেক টাকা তাে ইন্দিরা গান্ধী বরাদ্দ করেছিল। সেগুলাে যদি ঠিকমতাে দেয়া হতাে মানুষকে বা সেখান থেকে চুরি-চামারি যদি না হতাে, মাঝখানে মিডলম্যানরা যদি না আসতাে, তাহলে মােটামুটি ওরা খেয়ে-বেঁচে থাকতে পারতাে। আমি ফিল্ডে কাজ করতে দেখেছি একজন পীর সাহেবকে।
শা: ন্যাপ নেতা পীর হাবিবুর রহমান?
অ: হঁ্যা। তাকে দেখেছি। আরও অনেককে দেখেছি। নাম জানি না। যারা একেবারে সেই লঙ্গরখানায় খিচুড়ি রান্না করেছে। লােকদের পরিবেশন করেছে। তখন চোখ উঠেছে সবার, কলেরা, কি গরম আবার রােদ, আবার বৃষ্টি সমস্ত পলিথিনের ওপর শ্যাওলা ধরে গেছে। ফুটো হয়ে ঘরে জল পড়ছে। লাখ লাখ মাছি। নরক, নরক, জল দিয়ে ভাসছে মরা বাচ্চা। শা: ‘৭২-এ একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোন দিক দিয়ে সিলেট গিয়েছিলেন?
অ: তামাবিল দিয়ে। তখন মণিপুরের রাজকুমারী বিনােদিনীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কলকাতার আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল, আশরাফি, আশরাফির দিদি ছিল।
শা: কতজন গিয়েছিলেন?
অ: এই চার-পাঁচজন ছিলাম । বাসে করে গেছি। সেই যে বললাম না। বক্তৃতা দেয়ার সময় হাত-পা কাঁপছিল। তারপর যখন আমি ক্যাম্পের কথা বলতে আরম্ভ করলাম। খুব ইমােশােনাল ব্যাপার । পরে ওরা সবাই এসে বললাে, দিদি আপনার বক্তৃতা সবচেয়ে ভালাে হয়েছে। কারণ আমার বক্তৃতায় তাে কোনাে সাবজেক্ট নেই বলার। ক্যাম্পের কথাই বলেছি।
৭২
শা: কী বলেছিলেন মনে আছে?
অ: না, মােটেই মনে নেই। সেই ভালাে ছেলেরা কীভাবে মরলাে। তখন অনেকের মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। সেটা আমি খুব লক্ষ্য করেছি। প্রত্যেকের ভেতর একটা বিশ্বাস, হিন্দু-মুসলমানের প্রতি এই যে পারস্পরিক ঘৃণা-সন্দেহ, একই হেঁসেলে কিন্তু খাচ্ছে। ব্রাহ্মণ খাচ্ছে, মুসলমানও খাচ্ছে। মুচিও খাচ্ছে আবার ইয়েও খাচ্ছে। সুতরাং তার ভেতর দিয়ে তাে একটি সাময়িক একতা গড়ে উঠেছিল। একটা কমন এনিমির বিরুদ্ধে। তারপর দেশ যখন স্বাধীন হবে, মুজিবুর বলেছেন, একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ হবে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে। সুতরাং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাট একটা আশা-প্রত্যাশা দেখেছিলাম। তারপর আমি যখন বাংলাদেশে ঢুকলাম, তখন সুনামগঞ্জে আমায় কয়েকজন বললাে, দিদি যে লােকগুলাে একদিন মাথা নিচু করে বসে থাকতাে, এখন দেখি তারা আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরতে আরম্ভ করছে। আমরা আবার দরজা বন্ধ করতে আরম্ভ করছি। ওরা রাস্তায়।
শা: কবে সেটা?
অ: ঐ যে ‘৭২-এ গিয়েছিলাম। ঐ ফেব্রুয়ারি মাসেই। তার আগে ছাতকে একটা মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়েছিলাম।
শা: কখন?
অ: ‘৭১ সালেই, যুদ্ধের সময়।
শা: ছাতক পর্যন্ত গেলেন?
অ: সেই ছাতকের বর্ডারে একটা আর্মি ক্যাম্প ছিল। ভেতর দিয়ে কোথা থেকে কোথায় ছেলেরা নিয়ে গিয়েছিল। গিয়ে দেখি একজন ফর্সামততা খুব সুন্দর দেখতে বুড়াে মানুষ। সাদা দাড়ি, সাদা চুল, মাথায় ক্যাপ পরা, মুখে দোয়া পড়ে চলেছে। আমি বললাম, কী হয়েছে আপনার? উর্দুতে উত্তর দিল, ওরা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওখানে ছেলেগুলাে বললাে, দেখলেন তাে দিদি, বাঙালি হয়ে উর্দুতে কথা কয়। এ আমাদের ছেলেদের ধরিয়ে দিত, শান্তি কমিটির লােক। তারপর আমি বললাম, আর যাই হােক বুড়াে মানুষটাকে মেরাে না। হাবিলদার এলে দেখেন কী করে, ছেলেরা বললাে। তারপর দেখি রােগা রােগা দশবারােটা ছেলে দিয়ে বিরাট একটা কবর, মাটি খোঁড়ানাে হচ্ছে। বললাম, কী হবে রে, এখানে কেন মাটি খোঁড়া হচ্ছে। ওরা বললাে, বলতে তাে পারি না। কারণ ছাতকের কাছে ১৭ জন মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে জ্যান্ত মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিয়েছিল। এটা একটা
৭৩
প্রতিশােধ নেয়ার ব্যাপার আর কি। তবে এগুলাে আমার ভালাে লাগতাে না। ওরা যদি ছােট হয়, নীচ হয়, তাহলে আমরা কেন এতােটা হবাে । জ্যান্ত মানুষকে পুঁতে ফেলবাে?
শা: ওসব জায়গা থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে পারতেন?
অ: একবার দুবার ক্যাম্পে থেকেছি, মাচায় আমি ঐ ওদের সঙ্গে। ঐ যে যেবার মুরগির পা, নখ খেতে দিল। বেশিরভাগ সময়ই ফিরতাম। কোনাে কোনােবার থেকে গেছি। বেশি রাত হয়ে গেছে। সারাদিন এই ক্যাম্পে ঘুরতে ঘুরতে, দেখতে দেখতে, কোনাে সময় দিদির কাছেও গিয়েছি। অ্যাম্বুলেন্সে, সুন্দরীমােহন হসপিটালের । ওদের জিপে করেও গেছি। আমার দিদিরও খুব অ্যাকটিভ পার্টিসিপেশন ছিল।
শা: ডাক্তার হিসেবে?
অ: ডাক্তার এবং সােশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেয়েদের ব্যাপারে সিলেটে গিয়ে ডি.সি.র সাথে ঝগড়াটগরা করেছিল । আপনারা কী করছেন? ওর একটা চিঠি ছিল । ওখানে গিয়ে আমায় লিখে পাঠিয়েছিল। ওখানে দু’তিন দিন বসে রইলাে। কেউ আসে না, পাত্তাই দেয় না। তারপর ডি.সি.র কাছে গেল, এসব মেয়ের মেডিক্যালি এক্সামিন করা হয়েছে কিনা। ওরা কেমন আছে। ওদের পুনর্বাসন করা হবে কিনা। কীভাবে করা হবে । ও আর দু’তিনটা মেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের পার্টির ।
শা: এই চিঠিগুলাে আর পাওয়া যাবে না?
অ: দেখি, এসব তাে আবার শিলংয়ে ।
শা: ‘৭১-এ আপনার দিদির হাসপাতালে কোনাে বাংলাদেশি মেয়েকে অ্যাবরশন করানাে বা এরকম কিছু করা হয়েছিল?
অ: ওরা আসেনি ওরকম । শিলংয়ে খুব সুন্দরমতাে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিল তার বাবা মিলিটারি হসপিটালে অ্যাবরশন করানাের জন্য। কিন্তু তখন তাে তার অ্যাডভান্স স্টেজ ।
শা: তারপর?
অ; তারপর আর কি। শা: তারপর বলেন, আপনার সে সময়টা নিয়ে।
অ: আর কোনাে বক্তব্য তাে নেই।
৭৪
শা: কেন, আট নয় মাসের কথা ফুরিয়ে গেল?
অ: এতাে কী কথা থাকে। এখানে তাে কাজ হয়েছে। কথা বেশি হয়নি তাে ।
শা: এই তাে কাজের কথাগুলােই বলেন।
অ: কাজ তাে কি, ঐ একই কাজ। ওষুধ নাও, কাপড় নাও । অসুস্থ মানুষ সেখানে পড়ে আছে, তাদের খোজ দাও, হাসপাতালে নাও। বা বাংলাদেশের ভেতরের খবর নেয়া, এই তাে কাজ।
শা: ভেতরের কী খবর নেয়ার ছিল?
অ: ভেতরের মানে, কী অবস্থা চলছে, কী রকমভাবে মেয়েদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। এসব ঘটনা সত্যি কিনা।
শা: গিয়েছিলেন এরকম গ্রামে?
অ: না না, আমি শুনেছিলাম যে রােকেয়া হােস্টেল থেকে মেয়েরা লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। একেবারে ছাদের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে কঁপিয়ে পড়ে মরেছে। আমরা তাই নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত। সব জায়গায় মিটিংয়ে এসব বলি ।
শা: আচ্ছা আপনার লেখার এক জায়গায় আছে যে খাদিমনগরে গিয়েছিলেন।
অ: হঁ্যা। খাদিমনগরটা যখন স্বাধীন হলাে, প্রথম যখন স্বাধীন বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হলাে, ওরা আমায় নিয়ে গেল। ঐ ২১ ফেব্রুয়ারির মিটিংয়ের পরে আমরা খাদিমনগরে এলাম। এসেই একেবারে বীভৎস দৃশ্য। যে ঘরে মেয়েদের রাখা হতাে ঘরের দেয়ালে এরকম নখের আঁচড়ের দাগ । ছােট চুল, লম্বা লম্বা চুলের টুকরাে পড়ে আছে। তারপরে গিয়ে দেখি ঐ সালুটিকর টিলার কাছে মানে বাক্স, ভাঙা ট্রাঙ্ক, ছেড়া কাপড়, লুঙ্গি আর একটা জায়গায় হাঁ করে রয়েছে একটা বীভৎস মুখ। তার মুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন, হাঁ করা দাঁতটা বের হয়ে রয়েছে। তখনও পুরাে মাংস পচেনি, মুঠোর মধ্যে আধা মাংস লেগে রয়েছে, যন্ত্রণায় আঙুল এরকম করে ইয়ে করা তার। মেয়ে না, পুরুষ।
শা: তখনাে কবর দেয়া হয়নি?
অ: না, তখনও কবর-টবর না, তখন গর্তের মধ্যেই সব ঢােকানাে, কবর-টবর না । ওখানে গিয়ে ওটা দেখেছিলাম। তারপর শুনলাম, ঐ টিলার ওপর থেকে ওদের গুলি করে করে ওখানে নিয়ে ফেলতাে। ওখান থেকে পরে আমি একটা ছবি পেলাম, অন্তত সত্তরটা মানুষের মাথার কঙ্কাল। সেই ছবিটা হারিয়ে গেছে ।।
৭৫
শা: কে দিয়েছিল এই ছবিগুলাে?
অ: সেটা আমি বলতে পারবাে না। আমার হাতে এসেছিল কয়েকটা ছবি ওরকম।
শা: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শরণার্থীরা তাে সব দেশে ফিরে গেল।
অ: তারপর ওদিকে আরও একবার গিয়েছিলাম। শা: সেইবার কীভাবে গেলেন?
অ: নদী পেরােলেই তাে বাঁশতলা। বােধহয় মিন্টুর বাবার সঙ্গেই গিয়েছিলাম। নদী পার হওয়ার পর, ওপারে যেখানে সব রিফিউজি থাকতাে, চলে যাওয়ার পরে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম, ওহ, ডা. মােছাব্বির আমাকে বাঁশতলায় ডেকেছিল। ওর হাসপাতালে। হাসপাতালে রিলিফ নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় ডাকতাে ভাে। তখন গিয়ে দেখলাম, সব ক্যাম্প খালি পড়ে আছে, কিছু স্মৃতিচিহ্ন এদিক-ওদিক। তারপর একটা টিলার মধ্যে দেখলাম তিনজন মুক্তিযােদ্ধার কবর, মানে একটু ঢিবি হয়ে পড়ে রয়েছে আর কি। সেভাবে কিছু করা হয়নি। এরই মধ্যে যে কত শহীদের কবর আছে বা তাদের পােড়ানাে হয়েছে। শা: এটা বােধহয় সেলা ক্যাম্পে, তাই না?
অ: হ্যা।
শা: সে সময় কি বাসে করে গেলেন? গিয়ে নদী পার হলেন?
অ: মানে তােমার সেলা পর্যন্ত তাে বাস যায়। তারপর তুমি নদীটা হেঁটে পার হলে বা নৌকাতে পার হলে। আমরা বেশিরভাগই হেঁটে পার হতাম আর কি। ঐ পাথরটাথর পেরিয়ে, শীতকাল তাে, তখন জল কম। আর জলের দিনে নৌকা করে পার হতে হয়। পেরিয়ে তারপর অনেকখানি পথ, দারুণ সুন্দর, আরম্ভ হয়ে গেল জঙ্গল তখন। মানে ঐ নদীর পারে যেখানে ক্যাম্প ছিল, সেগুলাে বালি আর পাথর। সেগুলাে পেরিয়ে একটু হাঁটলে পরেই তােমার ঐ বাঁশতলা জঙ্গল শুরু হলাে। দু’ধারে বন, জারুল গাছ, আরও অজানা কিসব গাছ, চিনি না। তখন ঐ আরেকটা জায়গায় গিয়েছিলাম। এক রাত্তিরে টেকেরঘাটে। সেখানেও গিয়ে দেখি ওরকম তিনটি কবর পড়ে আছে। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। কোনাে মানুষ নেই, তাদের কথা কে-বা বলবে। একদম পড়ে আছে তিনটা কবর ওরকম। রাত্তির হয়ে আসছিল, চারধারে এবড়ােখেবড়াে পাথর আর বালি, তারই মধ্যে তিনটা কবর, নাম জানি না তাদের, তবে মুক্তিফৌজের তারা।
শা: এটা কি টেকেরঘাটে?
অ: টেকেরঘাটে, এটা বাংলাদেশের ভেতরে।
শা: টেকেরঘাটে কি শরণার্থী ছিল?
অ: না। আসলে ওখানে শরণার্থী ক্যাম্প ছিল না। আশপাশে আমরা ওখানে কখনাে দেখিনি। বেশিরভাগই ছিল ঐ বালাটে। বালাট আর সেলাতেই সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প। বালাটে তাে প্রায় দু’লাখ, তিন লাখ মতাে লােক শরণার্থী হয়ে এসেছিল। আর মিলিটারি ক্যাম্প ছিল এদের। তারপর ওখান থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে ছেলেদের । সেই ভেতরে গিয়েছিলাম, যেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে জঙ্গলের মধ্যে, যেটা আমার বইয়ে লিখেছি। সেই ভীষণ দুর্গম জায়গা, ছেলেরা বলতাে যে মাথার ওপরে টুকটুক করে জোক এসে পড়ে। আর সেই একসঙ্গে ছােট জায়গায় বাঁশের ওপর সব ছেলে কষ্ট করে পড়ে থাকে। খুব কষ্ট করে ওখানে ওরা প্রশিক্ষণ নিতাে। আর হাওয়া যে-ই দেয় , একেবারে সাগরের মতাে বড় ঢেউ ওঠে। সেটা বােধহয় স্পিডবােটের জন্য।
শা: ‘৭১-এ প্রথম স্পিডবােটে চড়লেন?
অ: হ্যা, হাওর সেই প্রথম দেখলাম। অপূর্ব জায়গা সুনামগঞ্জ। দু’ধারে এরকম একটুএকটু জল আর ঐ নানা রকমের ঘাস। বড় বড় ঘাস, ছােট ছােট ঘাস। তার মধ্যে মাথায় ছােট ছােট ফুল ফড়িং। বড় সুন্দর জায়গা। তমাল গাছ এ প্রথম দেখলাম। তমাল গাছ তাে খালি সাহিত্যে পড়েছি। ঝাকড়া মাথায় যেন এমনি করে মায়ের মতাে ডাল মেলে। বড় সুন্দর দেশ। শ্রীভূমি এমনি নাম দেয়নি। শ্ৰী আছে।
সবাই চলে যাওয়ার পর আমি মাঝে মধ্যে যেতাম চেরাপুঞ্জি বা মমলুর কথা বলেছিলাম না, সেখানে। সেই মমলু পাহাড়ে বসে দেখতাম, একদিকে বাংলাদেশের ঐ বিরাট হাওর আর পেছনে আমাদের মেঘালয়ের পাহাড়। তখন বেশ কিছুদিন একটা দুঃখবােধ ছিল যে, সব যেন চলে গেল, কিরকম একটা ফাঁকাভাব মনে হলাে। কারণ ওদের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম যে মনে হচ্ছিল, আবার ওদের সঙ্গে গিয়ে কোনাে একটা জায়গায় একটা স্কুল করে বা একটা কিছু করে মেয়েদের মধ্যে যদি বসে পড়তে পারতাম। কিন্তু নিজের সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, ঘরবাড়ি আছে। সেটা ততা সম্ভব নয়। কিছুদিন খুব নিঃসঙ্গ লাগতাে। তখন একটি দুটি কবিতা লিখেছিলাম আর কি। ঐ দূর থেকে যেন বাংলাদেশ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু আর যেতে পারবাে
মাঝখানে একটা বিরাট অচলায়তনের পাহাড় খাড়া হয়ে গেছে। তারপর তাে শুনলাম বহু বুদ্ধিজীবীর হত্যা, তারপর শুনলাম যে, মুজিবের হত্যা, তারপরে শুনলাম একবার মাঝখানে যখন গিয়েছিলাম যে মুক্তিযোেদ্ধারা লুকিয়ে আছে, রাজাকাররা বুক ফুলিয়ে সুনামগঞ্জের রাস্তায় ঘুরছে। তারপর বাংলাদেশ থেকে কিছু চিঠিপত্র আসততা যে ঠিক
৭৭
যেভাবে আমরা আশা করেছিলাম ঠিক সে জিনিসটা হয়ে ওঠেনি। আবার সেখানে যারা একটু প্রতিক্রিয়াশীল সেসব মানুষের হাতেই আস্তে আস্তে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। কারণ যেসব রাজকর্মচারী পাকিস্তান আমলে ছিল, তারাই রয়ে গেছে বাংলাদেশ গভর্নমেন্টের মধ্যেও এবং মুজিবুর রহমান ঠিক অতটা সচেতন হতে পারেনি শেষের দিকে। যার জন্য এই প্রতিক্রিয়াশীল আবার মাথা তুলে দাঁড়ালাে। তারপর তাে একে হত্যা, ওকে হত্যা, মিলিটারিদের মধ্যেও ইয়ে, জিয়াউর রহমানকে মারলাে। তারপরে যা হয় আর কি। জনগণ যে প্রতিজ্ঞা বা যে আদর্শ নিয়ে লড়েছিল, সেটা অনেকখানি পিছিয়ে গেল ।
শা: আপনি তাে ওদেরকে যুদ্ধ করতে দেখেছেন, ওদের এতাে ত্যাগ স্বীকার করতে দেখেছেন, এসব কথা শােনার পর আপনার মন খারাপ হয়নি?
অ: সেটা তাে তুমি কী করবে। রাজনীতিই তাে এরকম । এ দেশেও যখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লােকে লড়েছিল, তারপর ক্ষমতায় যখন এলাে জওহরলাল নেহরু, তিনি তখন বলেছিলেন, এ দেশে যারা দুর্নীতি করবে ল্যাম্পপােস্টে তাদের বেঁধে, গুলি করে মারা হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল যে রাজশক্তি একটা কিরকম চক্রের মধ্যে পড়ে। তারপর মানুষের কাছে তাদের যে অঙ্গীকার, সেটা আস্তে আস্তে তারা ভুলে যায়। কারণ তারা তখন অনেকটা সহজ জীবন, অনেকটা বিলাসবহুল জীবনে এসে পড়ে। যারা পায়ে হাঁটতাে, তারা গাড়ি ছাড়া ঘােরে না। এভাবে তাদের মানসিকতাটাই আস্তে আস্তে বদলে যায় ক্ষমতায় এলে । তাে এ দেশে যা হয়েছে, ও দেশেও তা হয়েছে। তবে এ দেশে আরেকটু রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি বলে বা বামপন্থি আন্দোলন আরেকটু শক্তিশালী বলে, এখানে একটা বিরুদ্ধ মতামত সবসময়ই আছে। আর বাংলাদেশের অত ভেতরের গভীরের কথা তাে আমি জানি না, যে ওখানে কী হচ্ছে। তবে হ্যা এটুকু বুঝি যে, একদল বুদ্ধিজীবী ওখানে আছেন বা একদল সমাজ-সচেতন মানুষ আছে, না হলে পুরাে দেশটাই তাে আবার সম্পূর্ণ ধর্মান্ধ লােকদের হাতেই চলে যেতাে। কিন্তু তা যখন যায়নি, তখন বােঝা যাচ্ছে, একটা সুস্থ চিন্তাশক্তি বা রাজনৈতিক বােধ এখনও বেঁচে আছে।
৭৮
‘৭১ থেকে ‘৭২-এই দুই বছরে অঞ্জলি লাহিড়ীকে লেখা কয়েকটা চিঠি ‘চিঠিপত্র’ পর্বে ছাপানাে হলাে। তার মধ্যে দুটি চিঠির লেখক তিনি নিজে হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থকে লিখেছিলেন। এই চিঠি দুটি আমরা পেয়েছি হিতেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থের কাছ থেকে। বাকি পাঁচটা চিঠি অঞ্জলি লাহিড়ী আমাদের দিয়েছেন। চিঠির বানান মূলানুগ রাখার চেষ্টা আমরা করেছি।
(১)
সৈয়দ রশিদুন নবী
স্টোরস অফিসার
ট্যাকেরঘাট লাইম স্টোন
মাইনিং-সুনামগঞ্জ সিলেট
৯/৪/৭২ ইং
শ্রদ্ধেয়া খুকুদি আপনি ও দাদা আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন এবং বুলবুলি ও রাহুলের জন্য রইল আমার অনেক স্নেহ-ভালােবাসা। এসে অবধি আপনাদেরকে লিখব লিখব করেও হয়ে ওঠেনি । শ্বিলংশিলং ছেড়ে আসার আগে আপনার ওখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনি গৌহাটি গিয়েছিলেন। দেশে ফেরার আগেই শুনেছিলাম বাবা মারা গেছেন দেশে ফিরে শুনলাম শুধু বাবা নয় মা, বড় ভাইয়ের এক ছেলে ও আরও নিকট অনেক আত্মীয়-স্বজন মারা গেছেন। পাক দস্যুরা আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। দেশের বাড়িতে এখন নিজেদের মাথা গোঁজবার মত ঠাই নেই বললেই চলে। যা এর জন্য বিশেষ দুঃখ করি না। এই সমস্যা এখন প্রায় সমস্ত বাঙালি জাতিরই সমস্যা।
একবার দাদা, বুলবুলি ও রাহুলকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে আসেন না কেন দিদি। আপনারা যেমন আদর যত্ন করেছেন আমাদের, আমরা অবশ্য অতটুকু করতে পারব না। বিশেষ করে এখন। কিন্তু ঢাকায় আসলে অত্যন্ত আনন্দিত হতাম। আমার বােন ভাগ্নীদেরকে আপনার ও আপনাদের কথা বলেছি। ওরা আপনাদের দেখা পেতে অত্যন্ত আগ্রহী । জানি না কবে সে দেখা হবে। আপনার সেই প্রিয় গান “প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য” এর সুরকার দোদুল আহমদ আপনাকে দেখার জন্য এবং আপনার সঙ্গে আলাপ করার জন্য অত্যন্ত উৎসুক। এখন চাকরিতে জয়েন করেছি এবং নানাবিধ অসুবিধা থাকার দরুন ঠিক এই মুহূর্তে শ্বিলং [শিলং যাওয়ারও কোনাে ব্যবস্থা করতে পারছি না। যদিও আপনাদের কাছে আবার যাওয়ার জন্য মনটা বড় আনচান করে। আশা করি আমাদের ভুলে যান নি। আমি অবশ্য এখনও ট্যাকের [টেকের ঘাটে আছি। কিন্তু আমার খুলনায়
বদলীর আদেশ এসেছে। আপনি হয়ত শুনে সুখী হবেন যে সগ্রামের শুরু থেকে আমার নিঃস্বার্থ কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকার সরকারি ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে একটা সনদপত্রও দিয়েছে। যাই হােক, আপনার চিঠি পেলে সুখী হব। দাদা, বুলবুলি ও রাহুলকে চিঠি লিখতে বলবেন।
ইতি
নবী
বি:দ্র: সকল দুঃখের মাঝেও আনন্দের সহিত আপনাকে জানাচ্ছি ঐ মেয়েটা ভাল আছে। আশীর্বাদ করবেন ।
(২)
৪-৯-৭২
শ্রদ্ধেয় শ্রী যুক্তা জগৎ মা,
আজ আপনাকে স্মরণ হচ্ছে। পত্রে আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা আপনার ছেলে মেয়ের প্রতি রহিল । আমি শুধু আপনাদের অক্লান্ত পরিশ্রমকে স্মরণ করছি। প্রথম মুক্তি ফৌজ সংগঠন করার সময় আপনার দেওয়া মশারী, চাদর, ছত্রঞ্চি (সতরঞ্জি মগ, প্লেইট, হানডি ইত্যাদি পাইয়া আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝপায়ে পড়েছিলাম। আপনার উৎসাহ উদ্দিপনায় [উদ্দীপনায় এবং আমাদের ক্যাম্পে আসিয়া সংগ্রামী অভিবাদন জানাইলে আমরাও উৎসাহী হয়ে মরণ পণ সংগ্রাম চালাইয়া ছিলাম- ঐ মেঘালয় এর গুহায় থেকে থেকে। যাক আপনার অবদান বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অতি স্মরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বটে। আমি সাবেক মুক্তি ফৌজ M.E.(R) ক্যাম্প ইনচার্জ হকনগরের, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনার বিগত দিনের সাহায্য সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি এবং সর্বদা আপনাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন চীর (চির] অমর হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালটা আপনার সাহায্যকৃত ডাক্তারী দ্রব্যাদি আপনাকে স্মরণ করছে।
আপনারই
ডা, মুছাব্বির
৮২
(৩)
শ্রী হেমেন্দ্র দাস পুরকায়স্থ
শ্রদ্ধাস্পদেষু আপনাদের খবর অনেকদিন পাইনি। বাশতলা ক্যাম্প দেখার পর সেই ছেলেদের মুখগুলাে সমানেই চোখের উপর ভাসছে। তাদের মধ্যে যে সাহস, শৃঙ্খলা ও উদ্দীপনা দেখেছি তা আমার জীবনে এক নতুন ইঙ্গিত বয়ে এনেছে। কতলােকের কাছে যে সে কাহিনী বলেছি তা বলার নয়। তাদের কিছু জিনিস দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু শুনছি তারা শীঘ্রই youth camp এ চলে আসবে এবং সেখানে তাদের প্রয়ােজনীয় সব কিছু সরবরাহ করা হবে তাই আমাকে সেগুলাে জোগাড় করতে মানা করা হলাে।
আমি ক্যাম্পের মেয়েদের জন্য কিছু শাড়ি সংগ্রহ করেছি- আপনি প্রয়ােজন মত তা বিলি করার ব্যবস্থা করে দেবেন। কাকীমার জন্য একখানা লালপাড় শাড়ি পাঠালামতিনি যেন তা ব্যবহার করেন। বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু কাপড় জামা পাঠালাম। অল্প ওষুধ ও ফিনাইল পাঠালাম আশা করি কাজে লাগবে। আমি সেলা ক্যাম্পে যাবার পর বালাট, ডাউকী, উমলারেম আমলারেং প্রভৃতি ক্যাম্পে ঘুরছি।
অবস্থা দুর্দশার চরমসীমায়, খালি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাই অন্ধকারে আশার আলাে বয়ে আনে। ভগবান তাদের স্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন দিন- এই প্রার্থনা জানাই।
আপনার শরীর কেমন আছে? কাকীমা কেমন আছেন? ক্যাম্পের ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা কেমন আছে? আজ এইখানে শেষ করি।
আপনারা আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নেবেন।
ইতি
অঞ্জলি
৭/৭/৭১
(৪)
Balat
19/12/71
My Dear sister, I started for Barsara with medicine and other articles from lowbah on 18/12/71 but jeep went out of order, so I could not go. I halted at Balat.
Capt. Chakrobarty of BSF Balat is pleased to arrange a Jeep for me so I am waiting at Balat. Mr. Chakrobarty is not only an officer but a social worker too. He feels very much for our people. When you come to Balat, please inforin him. He wants to meet you. His conveyance always run to Shillong. If you like, you may inform him. He may even arrange lift for you.
With regards
MA Quddus. M.P.R.
(৫)
Balat
11/9/71
My dear Khukudi,
I am sorry I could not ring you up before I left. But I talked (to) Mr. Aziz to arrange for conveyance for your coming to Balat. But now I know that could not be done. You will hear in details the condition of Mailam Camp from Mr. Aziz. Something has to be done about it. I feel, the higher-ups are not fully aware of the conditions now prevailing at Balat. The press is not also giving it much importance. Could we not arrange to send in some foreign journalist (Tiine or News week) to come and look at appaling conditions & give proper coverage. I feel inore horible things are ahead. After the cholera would come the small-pox. No arrangement has yet been made for vaccination.
We will be shocked to see that despair has made a very large chunk of populace into a very indifferent, self-centred, selfish lot with best civic scense- from a hard working, religious, proud & good healthy citizens. And also nobody is here with them to boost up their morale & tell them of certain message of hope.
Now as to the MF officer- I now see some silver lining in dark horizon. If you come to Balat-please meet maj. De Souza. I think you will be happy to meet him.
Trust you all are keeping well.
With sincere good wishes.
Affectionately yours
B. Das Gupta To Anjali Lahiri Jonson Road Shillong.
15th June, 1972.
My dear Khukudi, I ain sorry to know that you had almost met with an accident on your way at Sarighat. I do hope you had no further trouble in reaching Shillong. I regret so much-and I feel so ashamed too- that we failed to provide you with a car for going back to Shillong.
I have distributed all the relief articles you gave me-except the tooth-brush, paste & bed cover. I kept these for inyself. I have given another bed cover instead. I have given the medicines to a local reliable doctor for free distribution. You are well known to most of the Balat returnees. People I met was so happy to hear about you-and especially because you still care so much for them all. I have been told to convey to you their thanks & gratitude for your kind concern.
I ain refraining from giving you any news of our country-lest you would think ine a cynic and pesimist. However, I shall try to send you some interesting Newspaper cuttings.
How you all are keeping? What about Bordha? Please convey my Nomaskar to Mr. Lahiri & love to the children.
With all best wishes
Affectionately
B Das Gupta
PS
I have ordered your Records & hope to get them within a month. You will be glad to know I have been able to recover some of our looted articles & papers.
মুক্তিযুদ্ধের পর লেখা অঞ্জলি লাহিড়ীর চিঠি
শ্রীচরণেষু কাকাবাবু ও কাকীমা আপনারা প্রথমেই আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানবেন। দিঘলী যাবার জন্য আমার মনটা খুবই ব্যাকুল ছিল কিন্তু কোনাে সুযােগ সুবিধা করে উঠতে পারছি না। আগে বাংলাদেশের গাড়ির সুযােগ নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে কাজ করেছি, এখন গাড়ি ঘােড়ার কোন সুবিধে নেই। ১লা বৈশাখ কোনমতে সেলা পর্যন্ত যাই, তারপর সেখানে থেকে হেঁটে বাঁশতলার হাসপাতালে যাই। সঙ্গে শচারেক টাকার মত চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ও ওষুধ কিনে ওদের দিয়ে আসি।
আমার একবার দিঘলী, সুনামগঞ্জ ও নবীগঞ্জ যাবার ভীষণ ইচ্ছা, আজমিরিগঞ্জেও। কিন্তু কিভাবে সে সুযােগ করতে পারব জানি না । শুনলাম এখন ঢাকা থেকে ছাড়পত্র অনুমােদন করিয়ে আনতে হয়। আপনি মিডওয়াইফ ট্রেনিং নেওয়া যে মেয়েটির কথা বলেছিলেন Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee, Dacca (BRAC) এই ঠিকানায় যােগাযােগ করতে পারেন। মিজানুর রহমান (মােয়াজ্জেম চৌধুরী) বা বিধুবাবু সম্ভবত আপনাদের এ সম্পর্কে পুরাে তথ্য দিতে পারেন। ওরা আমাকে ওদের সাল্লার হাসপাতালের জন্য তিনজন নার্সের কথা বলেছিলেন। বা হাতের কাজ জানে এরকম ৩ জন মেয়ে ওদের দরকার যারা অন্য মেয়েদের এব্যাপারে শিক্ষা দিতে পারবে ।
ঢাকা থেকে কিভাবে অনুমােদন পত্র জোগাড় করা যায় তাই ভাবছি। কাকাবাবু যে মুক্তিবাহিনীর মতান্তরের কথা বলেছিলেন, আশা করি তার সফল মীমাংসা হয়েছে। আপনার চিঠি পাবার পর আমার খুবই. দুশ্চিন্তা হয়। কি নিয়ে মতবিরােধ এত চরমে উঠলাে একটু জানাবেন। আপনাদের বাঁশতলা ক্যান্টনমেন্টে সাদা দাড়ি বুড়ােমতাে শান্তিকমিটির যে চেয়ারম্যানকে বন্দী অবস্থায় পেয়েছিলাম, জোস্না বিশ্বাস তাকে ঢাকায় পায়। চট্টগ্রামের সঙ্গে সম্ভবত ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখছেন বলে ওর ধারণা। একসঙ্গে ওরা সিলেট থেকে ঢাকায় যায়। ওরা খ্রীস্টান কনফারেন্সে ঢাকায় গিয়েছিল। কাকীমার শরীর কেমন আছে? ওঁর শরীর খুব খারাপ হয়েছে লিখেছিলেন। | ধারাই, আজমিরিগঞ্জ, সাল্লা, বানিয়াচঙ্গের অবস্থা শুনলাম খুব খারাপ। পুরন [পুরনাে] কাপড় চোপড় যদি কিছু জোগাড় করতে পারি আবার তাই চেষ্টা করছি। জগৎজ্যোতি দাসের উপর ছােট্ট একটা গল্প লিখেছি, ইচ্ছে আছে সেইটে ছাপিয়ে তার যা দাম উঠবে তা ওখানে পুনর্বাসনের কাজে দেবাে।
আপনারা কিভাবে আমাকে একবার ওদেশে নিয়ে যেতে পারেন তার চেষ্টা করবেন, আমার এ তরফ থেকে কোনাে সুবিধা নেই। ছাড়তেও চায়না কেউ । আমার কৰ্ত্তা আমায় ছাড়তে খুব ভয় পায়। বলছে পুজোর ছুটিতে যখন ওর হাইকোর্ট বন্ধ থাকবে তখন ও বাংলাদেশে যাবে সেই সাথে আমাকে নিবে। আমার কিন্তু তার আগেই একবার যাবার ইচ্ছে । (অসমাপ্ত)
৮৭