You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

১৯৭১ সালের জানুয়ারি হতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মাওলানা ভাসানী সারা বাংলাদেশে জনসভা করে জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ২৫ মার্চ তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে অবস্থান  করছিলেন। ৩ এপ্রিল রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনো মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী সন্তোষে তার বাড়িঘরে  আগুন দেয় এবং এলাকার অনেককে হত্যা করে। পাক সেনারা তাকে খোঁজে এবং এলাকার মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে ‘কাফের ভাসানী কোথায়’। নানা কৌশলে পাকবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে কোষা নৌকায় ১০ এপ্রিল তিনি সরাজগঞ্জ পৌছেন। সিরাজগঞ্জের মােজাফফর ন্যাপ সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও মােরাদুজ্জামানসহ তিনি ১৫ এপ্রিল সীমান্ত পেরিয়ে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার শিশুমারীতে আশ্রয় নন এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর  সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ভাসানীর আগমন সম্পর্কে অবহিত করেন। ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য কামনা করেন। ১৭ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সাথীসহ বিমানে আসাম থেকে কলকাতা পৌছেন। তারা কলকাতা পার্ক সার্কাসের পাক স্ট্রীটের কোহিনুর প্যালেসের পঞ্চম তলায় ফ্ল্যাটে অবস্থান করেন। একই ভবনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার বাস করতেন। তাজউদ্দীন আহমেদ স্বয়ং থাকতেন  থিয়েটার রােডে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে। তাজউদ্দীন অঙ্গীকার করেছেলিন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাম্পত্য জীনযাপন করবেন না। কোহিনূর ম্যানসনে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সাথে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারতে ভাসানীর আগমন, সংবাদপত্রে ভারতের সাহায্য কামনা করে বিবৃতি মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করে।

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ভাসানী চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানান। ভারত সরকার তার এই সমস্ত চিঠিপত্র-তারবার্তা যথাস্থানে পাঠাবার জন্য উপযুক্ত  ব্যবস্থা নেন। পত্রপত্রিকাতেও   এসব সংবাদ আসে ফলাও করে। যেমন ‘আর অস্ত্র দিবেন না।’ ‘মওলানা ভাসানীর নিক্সনকে চিঠি’ শিরােনামে আনন্দবাজারের সংবাদ এ রকম:

 ‘চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই শুধু নয় প্রেসিডেন্ট নিক্সনকেও মওলানা ভাসানী এক ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছেন।  

আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কাছে মওলানা ভাসানীর আবেদন: চীনের ও  আপনাদের দেয়া সামরিকসম্ভার দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া ‘বাংলাদেশে’ লক্ষ লক্ষ নিরীহ নর-নারী-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন। আপনার দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যাতে তারা বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করতে পারে তার ব্যবস্থা  করুন। ‘বাংলাদেশ’ প্রজাতন্ত্র অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য  করুন।

বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার বিদেশী সাংবাদিকদের যাতে বাংলাদেশের ভেতর  পরিভ্রমণ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা বাংলাদেশে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, গুণ্ডামি, গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের প্রকৃতি ও বহর স্বচক্ষে দেখে বিশ্ববাসীর  সামনে বাংলাদেশের মর্মন্তুদ কাহিনী প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারেন আপনি তার ব্যবস্থা করলে আমি বাধিত হবে।”১

মাও সেতুঙকে তিনি লেখেন:

প্রেসিডেন্ট মাও সেতুঙ, পিকিং, চীন :

“সমাজতন্ত্রের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা।একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্রের বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর যে বর্বর অত্যাচার চলিতেছে তা থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি। আপনার সরকারের সরবরাহ করা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়ার সামরিক গভর্নমেন্ট নিষ্ঠুর ও  নৃশংসভাবে বাংলাদেশের নিরপরাধ, নিরস্ত্র, অসহায়, কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের সাহায্যে সামরিক চক্র বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের উপর পশুর মতাে যে বীভৎস আক্রমণ চালিয়েছে, আপনার সরকার যদি তার প্রতিবাদ না করে তবে বিশ্ববাসীর এই ধারণাই হবে যে, আপনি অত্যাচারিত জনগণের বন্ধু নন।

বাংলাদেশের নিরপরাধ জনগণের উপর সামরিকচক্র যে নির্যাতন চালিয়েছে তার তুলনা আপনার দেশে চিয়াং কাইশেকের, রাশিয়ার জারের এবং স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনকালেও পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি দুর্ভাগা বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে  যে বর্বরতা ও নৃশংসতা চলছে তার প্রচণ্ডতা ও প্রকৃতির সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র বিবরণ বিভিন্ন ভারতীয় সূত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। যে কোন দেশের, এমনকি ইয়াহিয়া সরকারের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা যদি সরজমিনে সব কিছু দেখে যান, তাহলে বিশ্ববাসী বর্বরতার যথার্থ চিত্র ও যথার্থ প্রকৃতি এবং আমার অভিযোগের সত্যতা জানতে পারেন।

আপনি ভালােভাবেই জানেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের পিছনে যে প্রকাশ্য জনসমর্থন রয়েছে, কম্বােডিয়ার সিহানুক সরকারের পিছনেও ততখানি সমর্থন নেই।  তাই আপনার নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরােধ, বাংলাদেশের স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে আপনি সমর্থন করুন, স্বীকৃতি দিন ও সর্বপ্রকারের সাহায্য করুন।

পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এবং পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আমাকে ৩১ বছর কারাবাস করতে হয়েছে। বর্তমানে আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ। আমার এই বয়সে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা আমার সামান্য বাসগৃহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত আমার মূল্যবান বইগুলিও তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাড়িতে আগুন লাগাবার পর আমার পরিবারবর্গের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমি জানি না।

ইতি

মওলানা ভাসানী।”

২৫ এপ্রিল সােভিয়েত নেতাদের নিকট ধন্যবাদ জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করেন এবং তা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়: ২

“অসহায় মানুষের উপর ইয়াহিয়া খানের ফৌজের বর্বরােচিত অত্যাচার বন্ধের জন্য জাতীয় আওয়ামী দলের নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সােভিয়েত রাশিয়াকে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানিয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পদগনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, মওলানা ভাসানী তাকে স্বাগত জানিয়ে শনিবার একটি বিবৃতিতে বলেন, শুধু ঐ কথাতেই সব হলাে না, অবিলম্বে বসে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

ন্যাপের (ভাসানী) সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতা এসেছেন এবং টাওয়ার হােটেলে অবস্থান করছেন। তিনি মওলানা ভাসানীর সাথে সাক্ষাতপ্রার্থী। ভাসানী যাদু মিয়ার সাথে দেখা করছেন না। তিনি তার ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলামকে বললেন, ওরা আমার হিন্দুস্তানে আসার বিরােধী। তারা চায় ভাসানী দেশে থাকুক। তারা ভাসানীকে চীনে নিয়ে যেতে চায়। চীনা দূতাবাসের লােকজন তাকে চীনে নেয়ার জন্য তিনবার দেখা করেছিল। ২৪ মে যাদু মিয়া পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান এবং পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলান। পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যাসেলের ৫ম তলায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন ছেলেমেয়ে দের নিয়ে থাকতেন৷  এ ভবনে ভাসানীর সাথে তাজউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে একত্রে   আলােচনা হয়। ভাসানী তাকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মে ভাসানী সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। ২১ এপ্রিল তিনি জাতিসংঘ, চীন ও  অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য চেয়ে আবেদন  জানান। ২৪ জুন ভাসানীর বিবৃতি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়।  

মওলানা ভাসানী চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সেতুংকে পত্র লেখেন।  পাকবাহিনীর বাংলাদেশে যে নির্যাচন করছে তা তাকে অবহিত করেন। ২৫ এপ্রিল সােভিয়েত নেতাদের কাছে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র লেখেন। ১৯৭১ সালের ৩০ ও ৩১ মে কলকাতার বেলেঘাটায় প্রবাসী বামপন্থীদের দু’দিন ব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বরদা চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১ জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডা. সাইফ-উদ-দাহার, ডা, মারুফ হোসেন, কাজী জাফর আহমদ, দেবেন সিকদার, আবুল বাশার, অমল সেন, নজরুল ইসলাম , শান্তি ঘােষ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে, মােস্তফা জামাল হায়দার, নাসিম আলী প্রমুখ। সমন্বয় কমিটি মুক্তি সংগ্রামে করণীয় কর্তব্যগুলো জানিয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষে কোহিনূর প্যালেসে মওলানা ভাসানীর কক্ষে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মণি সিংহ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ, শ্রী মনােরঞ্জন ধর উপস্থিত ছিলেন।

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চারটি প্রগতিশীল দলের প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী এবং সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, আওয়ামী লীগ, কমরেড মণি সিংহ, কমিউনিস্ট পার্টি, শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর, কংগ্রেস, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ ন্যাপ (মাে)। ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার পর মুজিবনগর সরকার আওয়ামী লীগের একাংশের তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে যায়।

মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিম্নের সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় :

১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে ক্ষোভ প্রকাশ, বিচার বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল শক্তির প্রতি আহবান।

২. বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ জ্ঞাপন ।

৩. বাংলাদেশ  সরকারকে স্বীকৃতিদান।

৪. মুক্তুযুদ্ধের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য ভারতসহ সারা বিশ্ব শক্তির প্রতি আহবান।  

 ৫. মক্তিযােদ্ধাদের অভিনন্দন।

৬ শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে ভারত সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জ্ঞাপন।

৭. রাজনৈতিক সমাধান বলতে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্যকিছুই গ্রহণযােগ্য নয় বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করা ।

অষ্টবামের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্তির দাবি মন্ত্রিপরিষদ অনুমােদন করেনি। মুজিবনগর ৮টি বামপন্থী দল নিয়ে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে ঐক্যজোট গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যভুক্ত দলগুলাে হলাে :

১. কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি

২. পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি

৩. কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র

৪. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এমএল— আবদুল হক

৫. বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি হাতিয়া গ্রুপ

৬. পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন

৭. ভাসানী ন্যাপ

৮. পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন

এ দলগুলাের সম্মিলিত নামই অষ্টম।

মওলানা ভাসানী ছিলেন অষ্টবাম নিয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি। অষ্টবামের পক্ষে রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনাের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সরকারের কলকাতাস্থ থিয়েটার রােডের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাত করে। সমন্বয় কমিটির প্রতিনিধিদের উপদেষ্টা পরিষদের নেয়ার দাবি জানানাে হয় ।

মওলানা ভাসানী কলকাতায় কিছুদিন থাকার পর আসামে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । পশ্চিমবঙ্গ হতে আসামের পথে তিনি কুচবিহারের পুন্ডিবাড়িতে অবস্থান করেন। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দিল্লীর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অবমেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আরােগ্য লাভের পর তাকে দেরাদুনের শৈলবাসে পাঠানাে হয়। এখানে সুন্দর সার্কিট হাউজে তার ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম ও মােরাদুজ্জামানকে নিয়ে অনেক দিন বাস করেন।

কলকাতায় উপদেষ্টা পরিষদের সভা হবে। ভাসানীকে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার অনুরােধ পাঠিয়েছে। ভাসানী গেলেন না কারণ অনেক বিষয়ে  সরকারের সাথে দ্বিমত পােষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানা  ভাসানীকে ঈদের উপহার পাঠালেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সাথে তিনি দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তার সফদার জং রােডের কার্যালয়ে কক্ষের দরজায়  এসে দু’হাত জোড় করে নমস্কার সম্বােধনে মওলানা ভাসানীকে অভ্যর্থনা জানালেন। ভাসানী ইন্দিরাকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ জানান।  ইন্দিরা উত্তরে বলেন, সময় হলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।

মওলানা ভাসানী আসামে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আসামের ধুবড়ি গ্রামে   ৫ একর জমি বরাদ্দ ও চারটি টিনের ঘর নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পত্র লেখেন। দেরাদুনে এসে মওলানা ভাসানী চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর কাছে নিমের বার্তা প্রেরণ করেন :

‘সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য হলাে শােষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। ইয়াহিয়া খানের  সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি জনগনকে রক্ষার জন্য আপনাকে অনুরােধ করছি। আপনাদের সরকারের দেয়া আধুনিক অস্ত্র দিয়ে  ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার নির্দয়ভাবে বাংলাদেশের নির্দোষী, নিরস্ত্র, অসহায় কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। সামরিক সরকার  বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের প্রতি ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তা যদি আপনার সরকার প্রতিবাদ না করে তাহলে বিশ্ব মনে করবে যে, আপনি নির্যাতিত মানুষের বন্ধু নন।’

মওলানা ভাসানী জাতিসংঘে প্রেরিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা আবু সাঈদ চৌধুরীকে পত্র লেখেন : ‘… এখন একমাত্র দফা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, অন্যথায় মৃত্যুবরণ। ইহা ব্যতীত অন্য কোন রাজনৈতিক মীমাংসা বা আপােস নহে। হিন্দুস্তান নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিত শরণার্থীদের সাহায্য করিতেছে। চিরকাল বাঙালীরা তা স্মরণ রাখিবে।’

১৯৭১ সালের ৩ অক্টোবর দেরাদুন হতে মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এক ঐতিহাসিক পত্র লেখেন। পত্রে তিনি বলেছেন :  ‘আমি পুনরায় ওয়াদা দিচ্ছি আওয়ামী লীগ যতক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়বে আমি তাদের সমর্থন দিয়ে যাব।’ তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং ভারতের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন করার লক্ষ্যে  আমি আমার সংগ্রাম অক্ষুন্ন রাখব।’

 ভারতের প্রধানমন্ত্রী  ইন্দিরা গান্ধীর নিকট থেকে পত্রের উত্তর পেয়ে ভাসানী ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর পুনরায় ইন্দিরা গান্ধীকে পত্র লেখেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও একটি তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তায় তিনি বলেন : ‘ আমার ২৪ বছরের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বলছে পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য অন্য কোনাে রাজনৈতিক সমাধান মুক্তি দিতে পারবে না।  হয় স্বাধীনতা-নয় মৃত্যু।

মওলানা ভাসানী একস্থানে বেশিদিন থাকতেন না। তিনি রানীক্ষেতে কিছুদিন অবস্থান করেন। তিনি রানীক্ষেত থেকে দেরাদুনে গমন করেন। দেরাদুন থেকে বিমানে কলকাতা এলেন। হাজরা স্ট্রিটের বাসভবনে উপদেষ্টা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হলাে। তিনি কলকাতা থেকে আসামের চরভাসানে যান। আসাম থেকে তিনি পুনরায়  দেরাদুনে গমন করেন। তিনি দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট পব মেডিকেল সায়েন্স সংলগ্ন হাসপাতালে ভর্তি হলেন । সুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করে  দিল্লীর যমুনা নদীর তীরে এক বাংলােতে ওঠেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় তার ছেলে নাসের ভাসানী ‘গণমুক্তি’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন৷

১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় শিয়ালদহ রেল স্টেশনের নিকিট টাওয়ার হােটেলে চীনপন্থী বাম দলগুলাে এক প্রাথমিক সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সভায় মওলানা ভাসানীর নেতত্বে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয় এবং একটি খসড়া কর্মসূচী অনুমােদন করা হয়। এ সভায় ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তার সাথে ন্যাপের তরুণ নেতা কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের মতদ্বৈততা দেখা দেয়। কলকাতা অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী মশিউর রহমানকে একবারও সাক্ষাতকার দেননি। ২৪ মে মশিউর রহমান হঠাৎ টাওয়ার ভবন থেকে পালিয়ে যান। পরদিন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে এসেছিল। তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান সামরিক সরকারের নিকট ‘সারেন্ডার’ করেন। এ বিতর্কিত ব্যক্তি পরবর্তীকালে তার দলবল নিয়ে বিএনপিতে যােগ দেন ও জিয়া মন্ত্রিসভার সিনিয়র মন্ত্রী নিযুক্ত হন। চীন সমর্থক বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা বেলেঘাটার একটি স্কুল ভবনে ৩০ মে কমরেড বরদা চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে এক সম্মেলনে মিলিত হন। এ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে সমন্বয় কমিটির পক্ষে রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করে মুক্তিযুদ্ধে শর্তহীন সমর্থন জানান। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী মুক্তি সংগ্রামে সমন্বয় কমিটির সভার আলােচনায় একবারও যোগ দেননি।

আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সেক্ষেত্রে চীনপন্থী  দলগুলাের মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রয়ােজনীয়তা ছিল না৷ এ কারণে ভাসানী কোনােদিন এ কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করেননি। অনেকে বলে থাকেন মওলানা ভাসানীকে ভারত সরকার গৃহবন্দী করে রেখেছিল। কিন্তি এ  অভিযােগ আদৌ সত্য নয়। কিছু পাকিস্তানী চর পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে। তারা নেতাদের হত্যা করতে পারে। এ আশঙ্কায় মওলানা ভাসানীসহ বিশিষ্ট নেতাদের  নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। আসামের ভাসানীরচরে যাওয়া পথে কুচবিহারের  পুন্ডিবাড়িতে একবার ভাসানী অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুচিকিৎসার জন্য ভাসানীকে  বিমানযোগে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হলে তিনি ভারতেত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কোনপ্রকার সহায়তাকারী ব্যতীত দেড় ঘন্টা   আলােচনা করেন। এরপর পূর্ণ সুস্থতার জন্য মওলানা ভাসানীকে দেরাদুনের শৈলাবাসে পাঠানাে হয়। এ সময় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য মুজিবনগর  সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হয়। তাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা   ভাসানীকে কলকাতায় আসার জন্য জরুরী অনুরােধ জানান। মওলানা ভাসানী   কলকাতা চলে আসেন এবং হাজরা স্ট্রিটে ওঠেন। তিনি কয়েক দফা বিভিন্ন দলের সাথে বৈঠকে বসেন। মােজাফফর ন্যাপ, কংগ্রেস মন্ত্রিসভায় যােগদানের জন্য চাপ দেয়। বর্ষীয়ান নেতা ভাসানী এ সকল দলের নেতৃবৃন্দের কঠোর  সমালােচনা করে বলেন যে, তারা বিগত নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। তাদের মন্ত্রিসভায় যােগদানের বৈধতা নেই। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন ও সহযােগিতার আহ্বান জানান। এই বৈঠকে ভাসানীর প্রস্তাব অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার নীতিনির্ধারণ সংক্রান্ত একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে চারটি প্রগতিশীল দলের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠন করা হয় ।

সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী – সভাপতি – ভাসানী ন্যাপ

তাজউদ্দীন আহমেদ – সদস্য – আওয়ামী লীগ

খন্দকার মােশতাক আহমেদ – সদস্য – আওয়ামী লীগ।

কমরেড মণি সিংহ – সদস্য – কমিউনিস্ট পার্টি

শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর – সদস্য – কংগ্রেস

অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ – সদস্য – ন্যাপ (মােজাফফর)

সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের প্রতি তাদের ঘােষিত সমর্থন সক্রিয় করে তােলেন। শেখ মুজিবের অবর্তমানে মওলানা  ভাসানীর এউ সাহসী ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সভার বৈঠক আহবান ও পরিচালনা করবেন। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ফলে মুজিবনগর সরকার ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পায়। খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে  আওয়ামী লীগের একটি উপদল তাজউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ও সঙ্কট সৃষ্টির   ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সুষ্ঠু ভাবে মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন।

উপদেষ্টা কমিটি গঠনের  পর মওলানা ভাসানী আসামের ভাসানীর চরে তার মুরিদদের সাথে দেখা করতে যান। এ ছিল ভাসানীর আসামে শেষ সফর।  আসাম সফরের পর মওলানা ভাসানী পুনরায় দেরাদুনের শৈত্যনিবাসে গমন করেন৷ এবং ৭ সপ্তাহকাল অবস্থানকালে এখান থেকে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও   সেতুঙের নিকট তারবার্তা প্রেরণ করেন। তিনি তারবার্তায় মাও সেতুংকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করার অনুরোধ জানান৷ মাও সেতুং এর নিকট প্রেরিত তারবার্তা দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৪ জুন মওলানা ভাসানী স্বাক্ষরিত একটি লিখিত ভাষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তিনি বিবৃতিতে বলেন, “… মানবতার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী   আমেরিকা চীন জালেম সরকারকে স্বাধীন বাংলায় টিকাইয়া রাখার অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য প্রদান করিলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাহাদিগকে একদিন আসামী হইয়া দাড়াইতে হইবে। তাই আমি দুনিয়ার সকল দেশের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ ও সরকারের নিকট আবেদন করি ইয়াহিয়া সরকারের এই ধরনের মানবতাবিরােধী অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন ও প্রতিরােধ গড়িয়া তুলুন।”

“প্রসঙ্গত আমি উল্লেখ করিতে চাই বাংলার স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাৎ করিবার ষড়যন্ত্র যতই গভীর হােক না কেন, তাহা ব্যর্থ হইবেই। মীমাংসার ধােকাবাজিতে জীবনের সকল সম্পদ হারাইয়া, নারীর ইজ্জত, ঘরবাড়ি হারাইয়া, দেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া এবং দশ লক্ষ অমূল্য প্রাণ দান করিয়া স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনসাধারণ আর কিছুই গ্রহণ করিবে না। তাহাদের একমাত্র পথ পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু। মাঝখানে অবস্থান গ্রহণের কোনাে সুযােগ নাই। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে নস্যাৎ করিয়া গোঁজামিল দিবার জন্য যে কোনাে দল এহিয়া খানের সহিত হাত মিলাইবে, তাহাদের অবস্থা গণবিরােধী মুসলিম লীগের চাইতেও ধিকৃত হইবে৷ তাহাদের রাজনৈতিক মৃত্যু কেহ রােধ করিতে পারিবে না।”৪ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বদলীয়  উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে    যােগদানের জন্য মওলানা ভাসানী মুজিবনগর আগমন  করেন৷ এবারের বৈঠকে  মওলানা ভাসানীর ছবিসহ সর্বদলীয় কমিটির ছবি সরকারি- বেসরকারিভাবে দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় মওলানা ভাসানী সকল সময়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। বৈঠকের পর ভাসানী পুনরায় দেরাদুনে চলে আসেন৷  তিনি আবার অসুস্থ হলে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।  

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীকে ঈদ উপহার পাঠিয়েছিলেন।  ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি দেখা করলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সফদর জং  রােডের কার্যালয়ে কক্ষের দরজায় এসে দু’হাত জোর নমস্কারে মওলানা ভাসানীকে অভ্যর্থনা জানালেন। ভাসানী তাঁকে সালাম জানালেন। তিনি উর্দু ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করেন। আলােচনাকালে তিনি বলেন, পণ্ডিত  জওহরলাল নেহরুর সাথে পরিচয় ছিল। এলাহাবাদ আনন্দ ভবনে তিনি গেছেন  এবং ইন্দিরাকে ছােট দেখেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার সরকারের সাহায্যের জন্য শুকরিয়া জানালেন। বিশেষ করে তাকে মেহমানদারি করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান।

মওলানা ভাসানী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশকে স্বীকতি প্রদানের অনুরোধ জানান। ইন্দিরা উত্তরে বলেন, সময় হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।

ভারত সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর মাওলানা ভাসানীর সাথে আলােচনা করতে চান। বিশেষ কারণে ডিপি ধর  আসেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মি. নাগ্রানী মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি প্রথমে তার ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলামের সাথে আলােচনা করেন। নাগ্ৰানী স্বাধীন বাংলাদেশের সীমারেখা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পরে তিনি ভাসানীর সাথে আলােচনা করেন। আলােচনার এক পর্যায়ে ভাসানী বলেন, …..আমি ১৯৫৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলাম। বলেছিলাম পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ভিত্তিতেই আমি প্রথমে স্নােগান তুলেছিলাম স্বাধীন পূর্ববঙ্গের। পূর্ববঙ্গের সীমারেখা আপনারা জানেন, আমরাও জানি।

প্রকৃতপক্ষে ভারতের ভয় ছিল, ভাসানী ও মুজিবনগর সরকার আসাম ও পশ্চিম বাংলা দাবি করতে পারে । ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি আসামকে পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেন। সে জন্য ভারতের ভয় ছিল যে। আসামের ওপর মওলানার কোন দাবি আছে কি-না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকে সরকারের পতাকা বাংলাদেশ মানচিত্র অঙ্কিত করে যুদ্ধ শুরু করে। সুতরাং  মানচিত্র সম্পর্কে কোন ভুল বােঝাবুঝি থাকতে পারে না।

মওলানা ভাসানী আসামে   স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আসামের ধুবড়ীর গ্রামে ৫ একর জমি বরাদ্ধ ও চার খানা টিনের ঘর নির্মাণের জন্য এক পত্র লেখেন । ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে  পত্রটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট প্রেরণ করা হয়। ভাসানীর নিজ হাতে লেখা চিঠি তুলে ধরা হলো:

“প্রিয় শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী,

প্রধানমন্ত্রী

আমার আন্তরিক আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানিবেন। আমার পত্রের উত্তর মি. কাউলের মেসেজে বিস্তারিত অবগত হইয়া যারপরনাই খুশি হইলাম।

আমার বাল্যজীবনের  আদর্শ ৮৯ বছর যাবত অটুট রাখিয়াছিলাম। স্বৈরাচার ইয়াহিয়া সরকারের অমানুষিক অত্যাচারে উহা লঙ্ঘন করিতে হইল। বর্তমানের রাজনীতিবিদ কংগ্রেসের   কর্মীদিগকে যে যাহাই বলুক কিন্তু তাহাদের মতাে বিলাসিতাশূণ্য জীবনযাপন ও নির্মল চরিত্র অনেকেরই নাই । আমি চিরদিন সাধারণ গৃহে সাধারণভাবে নির্জন পল্লীতে থাকিয়া দেশের সেবা করিয়াছি। কিন্তু এবারই তাহার ব্যতিক্রম হইল। গত ৭ মাসি শহরে প্যালেসেস সার্কিট হাউসে বাস- আহারাদি,  বিলাসপূর্ণ। তাই আমার মৃত্যুকাল পর্যন্ত যাহাতে বাল্যজীবনের আদর্শ হাল থাকে তাহারই জন্য ৫ একর জমি ও সাধারণ ধরনের ৪ খানা ঘরের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ীর গ্রামে। তাই আমার বৃদ্ধা স্বীর আশা তাহার শেষ দাফন ধুবড়ীর কোন গ্রামে হয়। আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভারতের সহিত কনফেডারেশন। এই তিন কাজের সাধন ইনশাল্লাহ আমার জীবিতকালে দেখার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পােষণ করি।

বাধা যতই আসুক, আমর আন্তরিক আশা ও বিশ্বাস আপনাদের আশীর্বাদে অবশ্যই পূর্ণ হইবে । আমার আন্তরিক আশীর্বাদ আপনার আদর্শানুযায়ী সমাজতন্ত্র শুধু ভারতে নহে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হইবে। যখন দরকার মনে করেন দিল্লীতে ডাকাইলেই হাজির হইব।

আপনার বিশ্বস্ত

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী”

এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন :

“মওলানা সাহেবের নিজ হাতে লেখা এই খসড়া বার বার পড়লাম। এই মুহূর্তে মওলানা ভাসানীকে রহস্যময় মনে হলাে। রানীক্ষেতে তিনি নিজ হাতে এই ধরনের আর একটি খসড়া দাঁড় করিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন অনুবাদ করে  ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠিয়ে দিতে। আসামেও আমাকে দিয়ে এ ধরনের  একটা খসড়া দাঁড় করিয়েছিলেন। রানীক্ষেত ও আসামের খসড়ায় তিনি ভারতীয়   প্রধানমন্ত্রীকে এ নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, তাকে আসামে থাকতে দিলে তিনি আসাম   ও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না এবং ভারত সরকারকে    তার খরচ বহন করতে হবে না। অবশ্য এ দুটো চিঠিতে ভারতের সাথে  বাংলাদেশের কনফেডারেশনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।”

দেরাদুনে এসে মওলানা সাহেব চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও জাতিসংঘের   সেক্রেটারি জেনারেল বরাবর বেশ ক’টি টেলিগ্রাফ পাঠিয়েছিলেন।

মওলানা ভাসানী চীনের মাও সেতুঙের নিকট নিমের বার্তা প্রেরণ করেন৷:

Idelogy of Socialism is to fight against oppression.  Appeal to you to save seven and half crores oppressed people of Bangladesh from the atrocities commiting by the military junta of Yahiya Khan. Yahya’s military government, by help of modern war weapons supplied by your government are mercilessly and brutally slaying the innocent unarmed, helpless  peasants, labourers, students, inteligentsia, women, children of Bangladesh. If your government dont protest this brutal atrocites commited on oppressed masses of Bangladesh by the military Janta the world may think that you are not the friends of oppressed people.

তিনি জাতিসংঘে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রেরিত ডেলিগেশন নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লিখলেন :

“প্রিয় আবু সাঈদ চৌধুরী

আমার আন্তরিক দোয়া ও ভালবাসা আপনার সকলে গ্রহণ করিবেন। আমার শেষ জীবনের শেষ কাজ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠাকল্পে যতদূর পারি ক্ষুদ্র শক্তিতে কাজ করিতেছি। হিন্দুস্তান সরকার আমাকে কারাগারে বা অন্তরীণ রাখিয়াছে ইহা মােটেই সত্য নহে আমি যখন যেখানে থাকি খুব গােপনে অবস্থান করি। প্রকাশ্য ঘােরাফেরা বা সাক্ষাত করা আমার পক্ষে এই অবস্থায় মােটেই সম্ভব নহে।

পাকিস্তান হওয়ার প্রাক্কালে যখন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের অস্থায়ী সরকার গঠন হয় তখনই আমি মুসলিম লীগের সকল প্রকার কর্মের প্রতি বিশ্বাস হারাই। কারণ চুন্দ্রিগড়, রাজা গজনফর আলী, নবাবজাদা লিয়াকত আলী নেহরুর সহকারী মন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু বাংলা আসামের খ্যাতনামা একে ফজলুল হক, শহীদ,  স্যার সাদুল্লা, আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রভৃতিকে গ্রহণ না করিয়া একমাত্র যোগেন মন্ডলকে শূদ্র শ্রেণীর  হিন্দু হইতে মন্ত্রিপদে নেওয়া হয়। পশ্চিমা শোষক শ্রেণীর জঘন্য কার্যাবলী ও  পূর্ব বাংলার প্রতি হীন মনােভাব পুরােপুরি কলোনি করিয়া রাখার ষড়যন্ত্র   ভালভাবেই অবগত হইয়াই আমি ১৯৪৮ সালে লীগের সহিত সংস্রব  পরিত্যাগ করি এবং আওয়ামী লীগের জন্ম  দিয়া প্রকাশ্য সংগ্রামে লিপ্ত হই। বাংলা প্রতিষ্ঠা হইবেই। মুক্তিকামী গেরিলাদের জয় অবধারিত। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা নস্যাৎ আর প্রযুক্ত নহে। এখন একমাত্র দফা ১ টি স্বাধীন সার্বভৌম  বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, অন্যথায় মৃত্যুবরণ | ইহা ব্যতীত অন্য কোন রাজনৈতিক মীমাংসা বা আপােস নহে । হিন্দুস্তান নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিত শরণার্থীদের যাহা করিতেছে চিরকাল বাঙালীরা স্মরণ রাখিবে।   

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী”

১৯৭১ সালের ৩ অক্টোবর মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এক ঐতিহাসিক পত্র লেখেন :

আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নিকট হতে :

ক্যাম্প – দেরাদুন

বরাবর

মিসেস ইন্দিরা গান্ধী,

প্রধানমন্ত্রী,

ভারত সরকার,

নতুন দিল্লী।

তারিখ ৩ অক্টোবর ১৯৭১

সম্মানীয়া মহােদয়া,

আপনার জন্য আমার অশেষ ভালবাসা ও আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন। পুনরায় আপনার অমূল্য সময় হতে কয়েক মিনিট অপচয় করার কারণে আশা করি আপনি নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।

আপনার সরকার সাধ্যমতাে উত্তর চিকিৎসা করা সত্ত্বেও পুরােনাে জ্বালাটা অনুভব করছি কয় মাস পেরিয়ে গেছে আমি আমার স্ত্রী এবং নাতনিদের কোন সংবাদ জানি না। তাদের কোন প্রকার খবরাখবর না জানায় আমার বেদনাদায়ক অনুভব আপনি বুঝতে পারছেন— এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।

বাংলাদেশের প্রথম কাতারের নেতারা যারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন তাদেরও সততা সম্পর্কে আল্লাহই জানেন। আমি পুনরায় ওয়াদা দিচ্ছি আওয়ামী লীগ যতক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়বে আমি তাদের সমর্থন দিয়ে যাব।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যখন আমি কলকাতায় ছিলাম তখন কপিতয়  আওয়ামী লীগ নেতা আপনার বরাবরে একটি লেখা টাইপ করে নিয়ে এসেছিলেন। যে, অসুস্থতার দরুন আমি আপনার সাথে দেখা করতে সক্ষম হব না। চিঠির পুঙ্খানুপুঙ্খ না পড়ে কেবলমাত্র বিশ্বাসে তাতে  সই দিয়েছিলাম। ওর পেছনে কি মতলব আছে আমি তা জানি না। তারা ওয়াদা  করেছিলেন যে,   ঐ চিঠির কপি আমাকে দেবেন। কিন্তু তারা কথা রক্ষা করেননি। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি ১১ বছর যাবত আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলাম এবং   স্বাধীনতাউত্তরকালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে ৮ বছর যাবত তার সভাপতি  ছিলাম। এবং আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা  সভাপতি। এই পদে গত ১২ বছর যাবত কাজ করে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন এই রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতির কাজে আমার পরিচালনায় কম হলেও ১৬ জন সেক্রেটারি কাজ করছেন। কিন্তু আমি গ্রামেই বাস করি। ফলে জরুরী রাজনৈতিক চাহিদা মােকাবেলা করার জন্য আমার সাদা প্যাডে বহু সই তাদেরকে দিয়েছি। এসব আমি ভালােভাবে উপলব্ধি করছি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে আমার সরল বিশ্বাসের বহু মওকা গ্রহণ করেছে৷ ফলে আমার রাজনৈতিক সহযােগিতার উপর আমার বিশ্বাস চটে গেছে। এই কারণে আমার মানবিক বেদনার জন্যই এই সব অবান্তর কথা আপনাকে লিখছি।

বিশ্বশান্তি, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি এবং আল্লায় বিশ্বাসীসহ সমাজতন্ত্র  প্রতিষ্ঠায় আপনার মহৎ সংগ্রাম আপনি অব্যাহত রাখবেন বলে আমি আশা ও বিশ্বাস করি। এবং আমি খােলামনে আপনার প্রতি সকল বিশ্বাসের স্বীকারােক্তি করছি। যদি কোন বিষয়ে আমি আপনার সাথে দ্বিমত পােষণ করি তবে ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে সাক্ষাত করে সেই পয়েন্ট আলােচনা করব।

আপনার মূল্যবান উপদেশ ব্যতীত আমি কোন সিদ্ধান্ত নেব না কোন কাজ করব না৷ যদি আমার বিরুদ্ধে আপনার কাছে কোন রিপাের্ট পেশ হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করুন আমি জীবনে কাউকে ঠকাইনি। এবং শেষ জীবনেও ঠকাব না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমি সক্রিয়ভাবে কাজের সাথে জড়িত আছি । আপনি যদি আমাকে সক্রিয়ভাবে কাজের সাথে জড়িত রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন তবে আমি সুখী ও আনন্দিত হব। বৃদ্ধ বয়সের জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে অবহেলা করবেন না। যদি কাজ করার এই আজীবন অভ্যাস হতে দূরে রাখা হয় তবে আশঙ্কা করছি তা আমার স্বাস্থাের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য কিছুদিন পূর্বে মি. ডিপি ধরের নিকিট কিছু লেখা পাঠিয়ে তা ইংরেজি, বাংলায়, চীনা, আরবি, উর্দু, ফরাসি,  রাশিয়ান, জার্মান  প্রভৃতি ভাষায় ছাপিয়ে এ সকল দেশে বিতরণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম। অনুরােধ মােতাবেক কাজ হলে আমি সুখি হবাে। রমজান মাসে আমি পশ্চিমবঙ্গ অথবা অসামের কোন স্থানে থাকতে চাই। পবিত্র মাস শেষ আমি আবার এখানে ফিরে আসতে চাই।

আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং ভারতের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন করার লক্ষ্যে আমি আমার সংগ্রাম অক্ষুন্ন রাখব।

এই বুড়াে বয়সে স্ত্রী ও নাতনিদেরকে নিয়ে আসামের ধুবড়ি মহকুমার যে কোন স্থানে   বাস করার জন্য যদি আপনি পাঁচ একর জমিসহ ক’টি টিনের ঘরের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে এই বদান্যতার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। আসামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না । আপনার এবং  আসাম সরকারের নিকট আমি এই প্রতিষ্ঠা করছি। ছয় মাস যাবত আমার থাকা, খাওয়া, পরার জন্য আপনার উপর নির্ভরশীলতার দরুন অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি। যদি ধুবড়ী থাকতে আমাকে অনুমতি দেয়া হয় তাহলে সরকারী তহবিল হতে আমার জন্য অর্থ খরচের দরকার পড়বে না। যেই আমাকে প্রো চাইনিজ বলে আপনার কাছে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা করুন, ইনশাল্লাহ আমি ভারত ও আপনার অবাধ্য হবাে না ।

সর্বাধিক সম্মান সহকারে,

আপনার বিশ্বস্ত

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী”

ভাসানীর লেখা পত্রখানা তার ব্যক্তিগত সচিব ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করেন।

ভারতে থাকাকালে গুজব ছিল মওলানা ভাসানী ভারতে বন্দী ছিলেন। লন্ডন থেকে ফজলুল হক, মিসেস বারবারা হক এবং দেবী প্রসাদ ভারতে এসে ভাসানীর সাথে সাক্ষাত করতে ব্যর্থ হন। এ কারণে তারা ভাসানীর মুক্তি দাবি করেছিলেন । ভাসানী নিজে বলেছেন তিনি মুক্ত। নিরাপত্তার কারণে তার যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত ছিল। তিনি বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন এবং নিয়মিত বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিতেন ।

ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দিল্লির যমুনা নদীর তীরে বাংলােতে ছিলেন। দেশে ফেরা পর্যন্ত তিনি এ বাংলােতেই থাকতেন। ১৯৭২ সালে ২২ জানুয়ারি তিনি আসাম হয়ে টাঙ্গাইলে পৌছেন।

Ref: প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, pp 351-365

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!