বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড | রক্ষীবাহিনীর ভাষ্য
আনোয়ার উল আলম
[Intro: ৭২ সালে দেশের আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রক্ষীবাহিনী গঠিত হয় যা মুজিব হত্যার পরে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের ধারণা কী সেটা জানতে এর সাথে সংশ্লিষ্ট আনোয়ার-উল আলমের এই লেখা।
RakkhiBahini was formed in 1972 in order to reinstall discipline in the country which was absorbed by the Army after the Mujib-killing. The force was criticized for several reasons since its creation, however, the role and responsibility of this force to prevent the Mujib-killing carries much importance which the writer – a person directly related to the force since its installment – stated in this article.]
কলঙ্কজনক অধ্যায়
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেলবেলা আমি বঙ্গভবনে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির শেষ ক্লাসটি নিই। ক্লাস শেষে জেলা গভর্নররা আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের প্রায় সবাই একযােগে প্রতি জেলায় রক্ষীবাহিনীর একটি করে ইউনিট নিয়ােগ করার জন্য আমাকে অনুরােধ করেন। আমি তাদের বলি, রক্ষীবাহিনীর এত সদস্য আমাদের নেই। যা আছে ইতিমধ্যেই তাদের প্রয়ােজনীয় স্থানে নিয়ােগ করা হয়েছে। এর পরও তারা আমাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে থাকেন। কারণ, বেশির ভাগ জেলায় তখন সন্ত্রাসী তৎপরতা আবার বেড়ে গিয়েছিল । বাকশালের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন। এতে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। তখনই সর্বত্র রক্ষীবাহিনী নিয়ােগ করা সম্ভব নয়-এ কথা দের বােঝাতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তারপর সন্ধ্যাবেলা আমি অফিসে চলে আসি। ইতিমধ্যে সাভার রক্ষী প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে লিডার এ কে এম নুরুল হোসেন, মঈন উদ্দিন চৌধুরী, দীপককুমার হালদার, সিরাজুল হক দেওয়ান ও সাহেব আলী মিয়া তাদের অধীন রক্ষী সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে টহল দেওয়ার জন্য পাঠানাে হয়। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরকালে যাতে কোনাে ধরনের অঘটন না ঘটে, সব অনুষ্ঠান যাতে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়।
রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আমি অফিসে ছিলাম। এরপর আমি অফিস থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাই। সেখানে টহলরত রক্ষী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। কোথাও কোনাে গন্ডগােলের আভাস না পেয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত আমার স্ত্রী ডা. সাঈদা খানকে সঙ্গে নিয়ে আসাদ গেট এলাকায় বাসায় ফিরি। তারপর রাতের খাবার খেয়ে দ্রুত ঘুমাতে যাই। কারণ অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য পরদিন সকালে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কর্মসূচি ছিল।
সকাল সাড়ে পাঁচটা বা পৌনে ছয়টা হবে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দ্রুত টেলিফোন ধরি। টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনে আমি তাে হতভম্ব। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শহীদ, মনির (শেখ মনি) বাসায় কালাে পােশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। দেখ তো, কী করা যায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, “স্যার, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু লাইন কেটে দেওয়ামাত্র আমি আমাদের ডিউটি রুমে ফোন করি। ডিউটি রুমে কর্তব্যরত রক্ষী কর্মকর্তার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাদের যারা প্যাট্রোল ডিউটিতে ছিলেন তাদের তাড়াতাড়ি ধানমন্ডি এলাকায় শেখ মনির বাসায় যেতে বলি। আমার সরকারি গাড়ি থাকত আমাদের যানবাহন শাখায়। আমাদের যানবাহন শাখা ছিল সংসদ সদস্যদের বাসস্থান এলাকায়। সেখানে ফোন করে কাউকে না পেয়ে আমি ডিউটি রুমে বলি তাড়াতাড়ি আমার জন্য একটা গাড়ি পাঠাতে। এর মধ্যে আমি অফিসে যাওয়ার জন্য কোনাে রকমে তৈরি হয়ে নিই। কারণ, বাসা থেকে সরাসরি যােগাযােগ করার কোনাে সুবিধা ছিল না।
এ সময় আবার আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে। আমি দ্রুত টেলিফোন ধরি। এবার বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সহকারী তােফায়েল আহমেদ আমাকে ফোন করে বলেন, রক্ষীবাহিনীর লােকেরা নাকি মনি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, তাড়াতাড়ি দেখাে। আমি তাকে বলি, ‘রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা কেন মনি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করবে। আমি দেখছি’ বা ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি’- এ রকম কিছু বলেই ফোনটা রেখে আবার ডিউটি রুমে ফোন করি। ডিউটি রুমে কর্তব্যরত কর্মকর্তার কাছে আমি জানতে চাই প্যাট্রোল ডিউটিতে যারা আছেন, তাঁদের শেখ মনির বাড়ি যেতে বলা হয়েছে কি না। উত্তরে তিনি জানান যে, মন্ত্রিপাড়ায়ও গােলাগুলি হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি, ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটেছে। তাই আর দেরি না করে উপপরিচালক (অপারেশন) সরােয়ার হােসেন মােল্লাকে ফোন করি। তাকে অফিসে আসতে বলে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঠিক তখনই পর পর দুটি আর্টিলারি শেল আমার বাসার পাশে সেন্ট যােসেফ স্কুলের দেয়ালে পড়ে। দেয়ালটি ধসে যায়। সেখানে কয়েকজন হতাহত হন। আমার বাসার কাচের জানালায় ফাটল ধরে। ভাগ্যক্রমে আমার কোনাে ক্ষতি হয়নি। আমার মনে হলাে, হয়তাে মিলিটারি ক্যু হয়েছে।
আর্টিলারি গােলাগুলাে হয়তো আমার বাড়ি লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পাশে পড়েছে। তাই স্ত্রীকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলে আমি প্রায় দৌড়ে যাই অফিসের দিকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি অফিসে পৌছাই। আমাদের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে টেলিফোনে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে আমি তাড়াতাড়ি অফিসে আসতে বলি এবং সরােয়ারের বাসায় আবার ফোন করি। এবার তাকে পাইনি। পরে জেনেছিলাম, সরােয়ারও আমার মতো গাড়ি না পেয়ে দৌড়ে অফিসের দিকে রওনা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে তখন মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা এবং এক কোম্পানি রক্ষী সদস্য ছিলেন। তাঁরা প্রধান কার্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতেন। লিডারদের মধ্যে আলিমুজ্জামান জোয়ারদার এবং এ কে নুরুল বাহারকে দ্রুত তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিই। আরও দুজন লিডার এন এ রফিকুল হােসেন এবং এম এম ইকবাল আলম প্রশিক্ষণের জন্য প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। তারাও প্রস্তুত থাকলেন।
প্যাট্রোল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী মিয়া ধানমন্ডিতে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে গিয়ে আমাকে জানান যে, সেনা পােশাক পরিহিত একদল আক্রমণকারী শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে আক্রমণ করে তাকে ও তাঁর স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে সেখান থেকে চলে গেছে। সাহেব আলী আরও জানান, তিনি শুনেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও নাকি হামলা হয়েছে। আমি সাহেব আলীকে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বলি, যাতে ওই বাড়িতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নূরুজ্জামান ১২ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার আগে বড় ধরনের কোনাে সমস্যা হলে সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে যােগাযােগ করতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, জরুরি প্রয়ােজনে সফিউল্লাহকে টেলিফোন করতে। তখন কথাটা আমার মনে পড়ে। আমি পরিচালকের লাল টেলিফোনে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোন করি এবং ঘটনা জানাই। তিনি আমাকে বলেন যে বঙ্গবন্ধু তাকেও ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বলেছেন। কারণ, সেনা পােশাক পরিহিত কে বা কারা তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করেছে। আমি তার কাছে আমরা কী করব জানতে চাই এবং তাঁকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাতে অনুরােধ করি। সফিউল্লাহ আমাকে বললেন, তিনি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে পাচ্ছেন না। তারপর তিনি ফোন রেখে দিলেন।
এ সময় আমাদের উপপরিচালক (অপারেশন) সরােয়ার হােসেন মােল্লা অফিসে উপস্থিত হন। তার মাধ্যমে জানতে পারি, ঢাকা বিমানবন্দরের দেয়াল ভেঙে কয়েকটি ট্যাংক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছে। আমরা বুঝতে পারি, সেনাবাহিনীর একটা অংশ বিদ্রোহ করেছে এবং তারাই অভ্যুত্থান সংগঠিত করছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিই। সরােয়ার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তৈরি থাকতে বলেন। আমরা যখন এসব করছি তখন লিডার আলিমুজ্জামান জোয়ারদার দৌড়ে এসে জানান যে রেডিও থেকে ঘােষণা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। বুঝতে পারি, আমাদের সামনে মহাসংকট। দেরি না করে আমি সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে আবার ফোন করি। তিনি আমাকে বললেন, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মােশাররফ এবং ডিজিএফআই-প্রধান আবদুর রউফ তার সঙ্গে আছেন । আরও বললেন, ‘We are going to do something, তােমরা অপেক্ষা করাে এবং তৈরি থাকো।’ সরােয়ার ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা অ্যাকশনে যাব। সেনাবাহিনী-প্রধান যদি সঙ্গে থাকেন তাহলে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে আমরা বিদ্রোহীদের দমন করতে পারব। বিমানবাহিনী কী ভাবছে জানার জন্য আমি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে১ ফোন করি। তিনি জানান, তিনি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর কাছে যাচ্ছেন। আমরা ভাবলাম, তাঁরা একটা পদক্ষেপ নেবেন।
এর মধ্যে টহল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে ফিরে আসেন। সাহেব আলী সেখানকার যে মর্মস্পর্শী ও রােমহর্ষক চিত্র তুলে ধরলেন, তা বিশ্বাস করা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। আরেক টহলদারি দলের লিডার দীপককুমার হালদার প্রধান কার্যালয়ে এসে আমাদের জানালেন, মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও আক্রমণ হয়েছে এবং সেখানে অনেকেই হতাহত। এ সময় আমি উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কী অবস্থা জানতে তাকে ফোন করি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফোন ধরার পর তিনি কোনাে কথা বললেন না। আমার মনে হলাে, বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে তিনি যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। আমি সাহস করে তাকে বললাম, স্যার, রাষ্ট্রপতি নিহত, এখন উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনার ওপরই সব দায়িত্ব। আপনি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়ে সব বাহিনী প্রধানকে ফোন করে বিদ্রোহী সেনাদের প্রতিহত করার আদেশ দিন। উত্তরে তিনি জানান, তার ওখানে কোনাে স্টাফ নেই। আমি বললাম, ‘আমি তাহলে আপনাকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসি।’ তিনি বললেন, ‘আসাে।’ এরপর আমি প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে ফোন করে একই কথা বললাম । তার কণ্ঠে একটু দৃঢ়তা ছিল । খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মনােভাবও ছিল তার মধ্যে। তিনি আমাকে তার বাড়িতে যেতে বললেন।
আমি মনে মনে ভাবলাম, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে যখন পেয়েছি, দেরি না করে তাদের কাছে আমার যাওয়া প্রয়োজন। আমি একটি গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। বেরােনাের সময় দেখলাম রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংক। জীবনের ভয় না করে আমি ট্যাংকের সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলাম। তখন সময় আনুমানিক সকাল সােয়া ছয়টা। ফার্মগেট হয়ে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পতাকা উড়িয়ে হােটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে দুটি পতাকা থাকে। একটি জাতীয় এবং অপরটি তিনি সে অঙ্গরাজ্যের নাগরিক সেই রাজ্যের পতাকা। এটা আমি জানতাম। ওই গাড়িতে দুটি পতাকাই ছিল। দুটি পতাকা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বােস্টারের গাড়ি। ভেতরে কে ছিল দেখতে পাইনি। আমার মনে খটকা এবং সন্দেহ হলে যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে হয়তাে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। কিছুদিন আগে চিলির প্রেসিডেন্ট সালভেদর আয়েন্দে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার কথা তখন বেশ আলােচিত বিষয় ছিল। আয়েন্দে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে আমরা অনেকেই ধারণা করেছিলাম, এখানেও এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রসঙ্গে এর আগে এ কথা বলেছি। সেদিন রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংকবহর আর অত সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের গাড়ি হােটেল থেকে বের হওয়ার ঘটনা আমাকে ধারণা দিল যে আমরা এক বিরাট ষড়যন্ত্রের শিকার। তখন অবশ্য এর বেশি আর কিছু ভাবার সময় ছিল না।
আমি ফাকা রাস্তায় দ্রুত গাড়ি চালিয়ে উপরাষ্ট্রপতির বাড়িতে গেলাম। বাড়ির গেটে পাহারারত পুলিশ জানাল যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে। এ পরিস্থিতিতে কী করব বুঝতে না পেরে আমি উপরাষ্ট্রপতির সরকারি বাড়ির উল্টো দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নানের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি ড্রয়িংরুমে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় তিনিও অনেকটা নির্বাক হয়ে গেছেন বলে আমার মনে হলাে। সময় নষ্ট না করে আমি ওই বাড়ি থেকে লাল টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু তাকে পাইনি। তবে একজন ফোন ধরেছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর আমি চিনতে পারিনি। তিনি জানালেন, এম মনসুর আলী তার একান্ত সচিবের সঙ্গে বাইরে চলে গেছেন। সরকারকে সংগঠিত করে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশা নিয়ে আমি উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের কথামতাে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের না পেয়ে আমি অনেকটা আশাহত ও হতােদ্যম হয়ে পড়ি।
এদিকে আমি যখন মন্ত্রী আবদুল মান্নানের বাসায় তখনি জাতীয় সংসদের হুইপ রাফিয়া আখতার ডলি সেখানে আসেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এই সংবাদ পেয়েই তিনি ওই বাসায় এসেছিলেন। এসেই তিনি কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়েন। আমার কাছে বারবার জানতে চাইলেন, কীভাবে ঘটনাটা ঘটল, কে ঘটাল, বেগম মুজিব ও রাসেলের কী অবস্থা ইত্যাদি। আবদুল মান্মান ও রাফিয়া আখতার ডলি দুজনই বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ট ছিলেন। তাদের সব কথার জবাব আমার কাছে তখন ছিল না এবং আমার হাতে কোনাে সময়ও ছিল না। ভগ্নহৃদয়ে আমি অতি দ্রুত আমার অফিসে ফিরে আসি।
ইতিমধ্যে আমাদের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান অফিসে এসে গেছেন। সরােয়ার আর আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। অর্থাৎ এখন আমাদের কী করণীয়। কারণ, সরকার ভেঙে পড়েছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আত্মগােপনে গেছেন এবং সেনাবাহিনী-প্রধান কোনাে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না। আমরা এসব বিষয়ে কয়েক মিনিট আলােচনা করলাম। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা (সরােয়ার ও আমি) প্রতিরােধ ব্যবস্থা নিতে সাভার চলে যাব। যদি প্রয়ােজন হয়, যমুনা নদী পার হয়ে রংপুরের দিকে যাব। কারণ, রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা প্রতিরােধ গড়তে আমাদের সহায়তা করবেন- এই বিশ্বাস আমাদের ছিল । ইতিমধ্যে সরােয়ার টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলে পুরােপুরি না হলেও কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। খন্দকার নাজমুল হুদা আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নাজমুল হুদাও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন।
ঢাকায় প্রতিরােধ গড়ার মতাে কোনাে শক্তি রক্ষীবাহিনীর ছিল না। কারণ, তখনাে রক্ষী সদস্যদের ঢাকায় রাখার কোনাে ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। মিরপুরে জমি অধিগ্রহণ করে রক্ষীবাহিনীর স্থায়ী প্রধান কার্যালয় স্থাপন ও রক্ষী সদস্যদের থাকার ব্যাবস্থা করার কাজ চলছিল। রক্ষীবাহিনীর যা অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিল, নিজেদের কাছে রাখার কোনাে সুবিধা না থাকায় সেসব অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছিল পিলখানায় বিডিআর অস্ত্রাগারে।
সাভারে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দুটি রিক্রুট বা প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়ন ছিল। প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ছিল বলে এসব সদস্য কোনাে দায়িত্ব পালনের উপযােগী ছিলেন না। শুধু ৪ নম্বর ব্যাটালিয়ন ছিল নিয়মিত। এই ব্যাটালিয়নের বেশির ভাগ কোম্পানি বিভিন্ন জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে মােতায়েন ছিল। ১৩ নম্বর প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়নের কয়েকটি কোম্পানি ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত । তারা ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালন করত। রক্ষীবাহিনীর অন্য নিয়মিত ব্যাটালিয়নগুলাে সারা দেশে মােতায়েন ছিল বিভিন্ন দায়িত্বে। ১৪ নম্বর ব্যাটালিয়ন ছিল সাভারে। কিন্তু মাত্র কয়দিন আগে লিডার আনােয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে তাদের খুলনায় পাঠানাে হয়েছিল।
ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর কোনাে ব্যাটালিয়ন ছিল না। সাভার থেকে ১৩ নম্বর ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি এনে ঢাকায় রাখা হয়েছিল। এ কোম্পানি প্রধান কার্যালয়ের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করত। এই ব্যাটালিয়নের চারটি টহলদল নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অ্যাডজুট্যান্ট লিডার তায়েব উদ্দিন খান ও ডিউটি অফিসার লিডার এ টি এম হালিমকে আমি জানাই যে আমরা দুজন সাভারে আসছি। তারাও যেন তৈরি হতে থাকেন।
সরােয়ার আর আমি বুঝতে পারি, ঢাকা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তােলা সম্ভব হবে না। আমরা ক্রমেই আটকা পড়ে যাচ্ছি এবং আমাদের পর্যাপ্ত ট্রুপস ও অস্ত্র-গােলাবারুদ নেই। তাই কিছুক্ষণ পর সিদ্ধান্তমতো আমরা দুজন একটা জিপ নিয়ে সাভারের দিকে রওনা হই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের মনে হলাে, প্রধান কার্যালয় অরক্ষিত রেখে এবং কয়েকজন কর্মকর্তা ও কিছু রক্ষীকে বিপদের মধ্যে ফেলে কাপুরুষের মতাে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা দুজনই আবার ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ সিদ্ধান্ত নিলাম এই ভেবে যে মরি আর বাঁচি আমরা ঢাকাতেই থাকব এবং একটা ব্যবস্থা করবই। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তা তাে করা যাবে না। প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য প্রয়ােজন অস্ত্রশস্ত্র। আগেই বলেছি, সেগুলাে ছিল পিলখানায়।
প্রধান কার্যালয়ে ফিরেই আমরা সিনিয়র ডেপুটি লিড়ার হাফিজ উদ্দিনকে রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ একটা ট্রাক দিয়ে পিলখানায় পাঠাই অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ নিয়ে আসতে। এর আগে আমাদের অনুরােধে রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ফোন করে জানান, পিলখানায় মজুত রাখা রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র-গােলাবারুদ নেওয়ার জন্য হাফিজ উদ্দিনকে পাঠানাে হচ্ছে। অস্ত্র ও গােলাবারুদ হাফিজ উদ্দিনের কাছে দেওয়ার জন্য খলিলুর রহমানকে তিনি অনুরােধ করেন। কিন্তু খলিলুর রহমান অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া দূরের কথা, তার নির্দেশে হাফিজ উদ্দিনকে পিলখানায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। গেট থেকেই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রক্ষীবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র সেখানে পড়ে থাকে। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, বিডিআর মহাপরিচালক খলিলুর রহমান আমাদের সহায়তা করবেন না। ফলে, আমাদের এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্রমে আমাদের জন্য পরিস্থিতি ধোয়াটে হয়ে আসে। আমাদের সাংগঠনিক শক্তি তেমন ছিল না। কোনো দিকেই আমরা আশার আলাে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে আমি বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর এক খুনি মেজর ফারুক২ একদল সেনা নিয়ে আমার বাসায় যান। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান টাঙ্গাইলে আমাদের প্রতিবেশি ও ফারুকের অধীনস্থ সেনা কর্মকর্তা নুরুল হক। ফারুক হয়তাে আমাকে হত্যা অথবা গ্রেপ্তার করতে আমার বাসায় গিয়েছিলেন। আমাকে বাসায় না পেয়ে আমার বাসা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে৩ ফোন করে জানান, ‘অপারেশন সাকসেসফুল’। আমার বাসায় যাওয়ার আগে ফারুক রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নূরুজ্জামানের বাসাতেও গিয়েছিলেন। আগেই বলেছি নূরুজ্জামান তখন বিদেশে ছিলেন। তাকে না পেয়ে তিনি হয়তাে আমার বাসায় যান।
নূরুজ্জামান ও আমার বাসায় ফারুকের যাওয়ার বিষয়টি আমি সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারিনি, পরে জেনেছি। আরও জেনেছি, সরােয়ার আর আমি যখন সাভারের পথে বেরিয়েছিলাম, তখন ফারুক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসেন। পরিচালকের কক্ষে ঢুকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলতে বলেন। আবুল হাসান খান তাকে বলেন, সরকারি আদেশ না এলে তিনি ছবি নামাতে পারবেন না। এ নিয়ে ফারুক আর কিছু না বলে চলে যান। তবে যাওয়ার আগে বলে যান, তাদের ট্যাংকের নলগুলাে রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তরের দিকে তাক করা আছে। কোনাে মুভমেন্ট নেওয়া হলে সদর দপ্তর গুড়িয়ে দেওয়া হবে। এ সময় পরিচালকের কক্ষের বাইরে উপস্থিত ছিলেন লিডার আলিমুজ্জামান জোয়ারদার। তিনি ফারুককে আগে থেকেই চিনতেন। ফারুককে দেখামাত্র আলিমুজ্জামান তাকে বলেন, “আপনি যা করেছেন ঠিক করেন নাই।” ফারুক উত্তর দেন, “তােকে আমি পরে বলব, কেন করেছি।”
পরিস্থিতি আস্তে আস্তে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণহীন দেহ তার বাড়িতে পড়ে আছে চরম অবহেলায় । আর আমরা কোনাে কিছু করতে পারছি না। এটা যে আমাদের জন্য কতটা কষ্টকর ও বেদনাদায়ক ছিল, তা এখন বােঝানাের ভাষা আমার নেই। আমি শুধু ভাবছি, আমাকে যেভাবেই হােক একটা কিছু করতেই হবে। এ সময় মনে পড়ল তাজউদ্দীন আহমদের কথা। তার কথা আমার আগে মনে পড়েনি। কারণ, তিনি সরকারি দায়িত্বে ছিলেন না। বলা যায়, তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। মনে হলাে, এই চরম সংকটময় মুহূর্তে তিনি হয়তাে আমাদের কোনাে বুদ্ধি দিতে পারবেন। আমি তাকে ফোন করি। ইতিমধ্যে তিনি ঘটনার কথা শুনেছেন। আমার মনে হলাে, তিনিও ভীষণ ব্যথিত। আমরা কী করতে পারি বা আমাদের কী করা উচিত, এ বিষয়ে আমি তার পরামর্শ চাইলাম। তিনি আমাকে উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যােগাযােগ করে কথা বলতে বললেন। আমি তাকে জানালাম, ইতিমধ্যে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি তাদের কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তারা বাসা থেকে চলে গেছে। এটা শুনে তিনি আমাকে বললেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি আমাকে আরও বললেন, ঘাতকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনাে পদক্ষেপ নিতে হলে সেনাপ্রধানকে প্রয়ােজন।
আমি আবার সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে ফোন করলাম। কিন্তু পেলাম না। সরােয়ার ও আমি তার খোজে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে বারবার ফোন করি, কিন্তু তাকে পাইনি। এর মধ্যে সরােয়ার ছুটিতে থাকা আমাদের উপপরিচালক (সিগন্যাল) সাবিহ উদ্দিন আহমেদকে তাড়াতাড়ি সদর দপ্তরে চলে আসতে বলেন।
সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছিল। অনেক খােজাখুঁজির পর জানা গেল, সেনাপ্রধান প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে আছেন। আমরা সেখানে ফোন করি। বহু কষ্টে এবার আমরা কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে যােগাযােগ করতে সক্ষম হই। তিনি সরােয়ার আর আমাকে ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সে যেতে বলেন। আরও জানালেন, তিনিও সেখানে যাচ্ছেন। আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে, হয়তো কোনাে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম, আমরা সাদা পােশাকে কীভাবে সেনানিবাসে যাব, আমাদের তো ঢুকতে দেবে না। তখন তিনি বললেন, তোমরা অপেক্ষা করো, আমি একজন অফিসার পাঠাচ্ছি। আমরা ধারণা করলাম, ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকেই অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর ডিজিএফআইয়ের ঢাকা ডিটাচমেন্টের অফিসার-ইন-চার্জ মেজর জিয়াউদ্দিন আহমদ৪ রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসেন। তিনি আমাদের বলেন যে, সেনাবাহিনীর চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) খালেদ মােশাররফ আমাদের সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে পাঠিয়েছেন। তখন সকাল সাড়ে আটটার মতাে হবে। আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। জিয়াউদ্দিন আহমদের গাড়িতে চড়ে আমরা তখনই ৪৬ ব্রিগেড় সদর দপ্তরে রওনা হলাম। রাস্তা ফাকা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ৪৬ ব্রিগেড় সদর দপ্তরে পৌছালাম ।
ব্রিগেড কমান্ডারের কক্ষে ঢুকেই দেখি একটা টেবিল ঘিরে খালেদ মােশাররফ, শাফায়াত জামিলসহ দু- তিন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা বসে আছেন। ৩০-৩৫ জন সেনা কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চেহারা দেখে আমরা বুঝতে পারলাম না, তারা অভ্যুত্থানের পক্ষে, না বিপক্ষে। তবে একটা রহস্যজনক নীরবতা লক্ষ করা গেল। ব্রিগেড কমান্ডারের নির্ধারিত চেয়ারে বসে ছিলেন খালেদ মােশাররফ। তার পাশে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল। টেবিলের অপর পাশে চেয়ার খালি ছিল। তারা সেখানে আমাদের বসতে বললেন। প্রথমেই খালেদ মােশাররফ যা বললেন তা শুনে তাে আমাদের চোখ ছানাবড়া। তিনি ইংরেজিতে বললেন, “Shaheed-Sarwar, I know you are patriots but we had do it because we do not want this country to be a Kingdom.” তারপর বাংলায় বললেন, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে ইত্যাদি। আমরা শুধু জানতে চাইলাম, ‘সেনাপ্রধান কোথায়’? খালেদ মােশাররফ জানালেন, ‘তিনি রেডিও স্টেশনে গেছেন’।
যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে গিয়েছিলাম, তা সফল হবে না ভেবে কথা আর বাড়ালাম না। কিছুক্ষণ পর সীমাহীন হতাশা নিয়ে আমরা রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে ফিরে আসি। জিয়াউদ্দিন আহমদই গাড়িতে করে আমাদের পৌছে দেন। ফেরার পথে ভাবতে থাকি, খালেদ মােশাররফ আমাদের কী শােনালেন। একবার মনে হলাে, হয়তাে তার সামনে ঘাতক দলের অনেকে উপস্থিত ছিল, যাদের আমরা চিনতে পারিনি। এ কারণে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তিনি হয়তাে ওই কথাগুলাে বলেছিলেন। এমনও তাে হতে পারে, তিনি যা বলেছেন তা তিনি সত্যিকার অর্থে বলেননি। তবে এটা ঠিক, দেশের ভয়ানক সন্ধিক্ষণে খালেদ মােশাররফের ওই বক্তব্য আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছিল।
রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে ফিরে সরােয়ার ও আমি চিন্তা করতে থাকলাম কী করা যায়। পরিস্থিতি দ্রুত পর্যালােচনা করে আমরা বুঝতে পারলাম, সরকার এবং সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি পুরােপুরি ভেঙে পড়েছে। উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই তাদের প্রিয় নেতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছেন জেনে বিস্মিত, ব্যথিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। তাদের বেশির ভাগই দেশের এই চরম মুহুর্তে নিজেদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার নিজেরাই ত্যাগ করে জীবন বাঁচানাের তাগিদে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। অথচ তাদের, বিশেষত উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সরকার ও দলের হাল ধরে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেমনটা ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদ সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে শোকে মুহ্যমান জাতীয় নেতারা (রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত) জাতির এই কঠিন সময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। আমাদের মনে হলাে, এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে পরীক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে ১৯৭১ সালের মতাে আবারও সরকারের হাল ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। আমরাও পেতাম দিকনির্দেশনা।
এদিকে সারা দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা ও কর্মী নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন; প্রতিবাদে কেউ একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলেন না। প্রকাশ্যে কোথাও কোনাে প্রতিবাদ হলাে না। এমন তাে হওয়ার কথা ছিল না। আমি ভাবতে থাকি, বাঙালি জাতি কি এতই অকৃতজ্ঞ যে তাদের মুক্তিদাতা জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলাে অথচ একজন বাঙালিও প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এল না। ১৯৭১ সালের বীর বাঙালি ১৯৭৫ সালে এসেই ভীরু জাতিতে পরিণত হলাে। এ তাে বিশ্বাস করার মতাে নয়। কোথাও কোনাে প্রতিবাদ হয়েছে কি না জানার জন্য বিভিন্ন জেলার রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলােতে আমরা ফোন করতে থাকি। কিন্তু এমন কোনাে খবর পাওয়া গেল না। অথচ জনগণের সমর্থন ছাড়া কোথাও কোনাে প্রতিরােধ সফল হয়নি, সফল করা যায় না।
অল্প কিছুসংখ্যক ছাড়া সাধারণ জনগণ এ ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মতাে একজন মানুষকে বাংলাদেশে কেউ হত্যা করতে পারে, এটা তারা কল্পনাও করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হতভম্ব ও ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে। তাদের সংগঠিত করে প্রতিবাদ বা প্রতিরােধ করার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কিন্তু তারা তা করেননি।
তখন সেনানিবাসের ভেতরে কী অবস্থা, তা-ও স্পষ্ট বােঝা যায়নি। ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে যেসব সেনা কর্মকর্তাকে দেখেছিলাম, তারা আমাদের কোনাে উদ্যোগে সাড়া দেবেন বলে মনে হয়নি। বরং ফলাফল উল্টো হতে পারে বলেই আমাদের মনে হয়েছে। আমরা প্রতিরােধের উদ্যোগ নিলেই সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেনাবাহিনী পক্ষে থাকলে সেনাপ্রধান নিজেই সেদিন ব্যবস্থা নিতে পারতেন।
বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই বাংলাদেশের বিরােধিতা করে এসেছে। আমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের সামনে দিয়ে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সরকারি বাসায় যাওয়ার সময় দেখেছিলাম, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়ি হােটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত সারা রাত হােটেলে কী করছিলেন, তা রহস্যাবৃত। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা সম্প্রতি আমাকে বলেছেন, তিনিও ধানমন্ডি এলাকায় ওই দিন সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বােস্টারকে গাড়িতে দেখেছেন।
আমাদের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংক। আমাদের কিছু রক্ষী সদস্য আছেন সাভারে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ অস্ত্রশস্ত্র পিলখানায়। আমাদের নিজস্ব শক্তি ও প্রতিরােধক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ল। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে করণীয় বিষয়গুলাে নিম্নরূপ ছিল বলে আমাদের মনে হয়েছে :
১. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল এই যে, রক্ষীবাহিনীর যেকোনাে পদক্ষেপই সেনাবাহিনীকে নাড়া দিত। সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের প্রশ্নে মুক্তিযােদ্ধা, পাকিস্তান-প্রত্যাগত ও অমুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে একত্র হয়ে রক্ষীবাহিনীকে মােকাবিলা করত। কারণ, সেনাবাহিনীর ভেতরে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল। তখন সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়ানাের ক্ষমতা রক্ষীবাহিনীর হতাে না। সব মহল থেকে বলা হতাে, রক্ষীবাহিনী ভারতের হয়ে কাজ করছে। জনগণও তা বিশ্বাস করত। যদি সেনাবাহিনীর একটা উল্লেখযােগ্য অংশ রক্ষীবাহিনীর পদক্ষেপকে সমর্থন করে সক্রিয় হতাে, তাহলে দেশে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এটা কারও জন্য মঙ্গলজনক হতাে না।
২. সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ যদি সেনাবাহিনীর ওপর তার নেতৃত্ব ও কমান্ড অক্ষুন্ন রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন, তাহলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যােগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নিতে পারতাম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনীর কমান্ডের ওপর সফিউল্লাহ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কারণ, তাঁর সহকর্মী সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান ও চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ খালেদ মােশাররফকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাদের তিনজনের মধ্যে গােপনে দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি আমাদের বারবার বলেছিলেন, ‘We are going to do something’। কিন্তু তিনি দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনাে পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
৩. আমরা আরেকটা কাজ করতে পারতাম, তা হলাে, রক্ষীবাহিনীর সবাইকে নিয়ে যমুনা নদীর ওপারে গিয়ে প্রতিরােধ সৃষ্টি করা। নদীর ওপারে আমরা হয়তাে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রংপুর ব্রিগেডের সহায়তা পেতাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্রিগেড কমান্ডার মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর যশাের ব্রিগেড আমাদের বিরােধিতা করত। আমার এ অনুমানের কারণ হলাে, ১৫ আগস্টের ঘটনার পর খুলনার রক্ষীবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট লিডার মােজাফফর হােসেনকে সব রক্ষীসহ নিরস্ত্র করার একটা ফন্দি এটেছিলেন মীর শওকত আলী। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের পূর্ণ প্রস্তুতি থাকায় এবং শৃঙ্খলার কারণে তিনি তা করতে পারেননি।
ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিরে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আমরা কয়েকজন যখন কথা বলছি, তখন খালেদ মােশাররফ আমাদের ফোন করেন। তিনি জানালেন যে রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে একজনকে রেডিও স্টেশনে যেতে হবে। আমরা বুদ্ধি করে খালেদ মােশাররফকে জানাই, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পরিচালকের, কিন্তু তিনি দেশে নেই।
ঐ সময় খালেদ মােশাররফ আমাদের জানালেন, সেনাবাহিনী-প্রধান কে এম সফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী-প্রধান এ কে খন্দকার, নৌবাহিনী-প্রধান এম এইচ খান, পুলিশ বাহিনী-প্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও বিডিআর-প্রধান খলিলুর রহমান রেডিও স্টেশনে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ঘােষণা দিয়েছেন। তাঁদের ঘােষণা রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। তার কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে যাই, এটা কীভাবে সম্ভব?
কিছুক্ষণ পর খালেদ মােশাররফ আবার আমাদের কার্যালয়ে ফোন করেন। এবার বলেন, পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে সরােয়ার ও আমি রেডিও স্টেশনে গেলেই হবে। আমাদের পাল্টা কিছু বলার সুযােগ না দিয়ে তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। সরােয়ার ও আমি আলােচনা করে ঠিক করলাম, আমরা দুজন যাব না। পরিস্থিতিদৃষ্টে তখন আমাদের মনে হয়েছিল, সব বাহিনীপ্রধান যেহেতু নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, সেহেতু রক্ষীবাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ না করে উপায় নেই। ভাই আমরা ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে রেডিও স্টেশনে পাঠাই। তিনি রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন।
কিন্তু সরােয়ার আর আমার ওপর চাপ আসতেই থাকে। আমাদের দু’জনকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য কয়েকবার বলা হয়। প্রতিবারই আমরা বলি, সব বাহিনীপ্রধান আনুগত্য স্বীকার করেছেন। আমাদের বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধানও করেছেন। তাহলে আমাদের কেন আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে? সেনাবাহিনী-প্রধান আনুগত্য ঘোষণা করার পর উপপ্রধানকে তাে তা করতে হয়নি। মনে হলাে, আড়াল থেকে খন্দকার মােশতাক আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছেন। কারণ, আমাদের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক খুব পরিচিত ছিলেন না। সবার ধারণা ছিল, পরিচালকের অবর্তমানে সরােয়ার আর আমি রক্ষীবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করি।
চারদিক থেকে উপর্যুপরি সুপারিশের কারণে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তখন আমাদের দুজনকেও রেডিও স্টেশনে যেতে হয়। এ ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। যাওয়ার পর দেখি, খন্দকার মােশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও খুনিরা কয়েকজন তখনাে রেডিও স্টেশনে বসে আছে। তাদের উপস্থিতিতে আমাদের ঘােষণা রেকর্ড করা হয়। অবশেষে ইতিহাসের এই কালাে অধ্যায়ের সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীপ্রধানের পাশাপাশি জামাদের দুজনের নাম যুক্ত হয়।
রেডিও স্টেশন থেকে অফিসে ফিরে এসে আমরা ঠিক করি আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যম পর্যায়ের বিশেষত যুব নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা দরকার। এ চিন্তা থেকে আমরা প্রথমে আবদুর রাজ্জাককে ফোন করি। কিন্তু জানতে পারি তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে গছেন। ফোন করি আরও কয়েকজনকে। শুধু তােফায়েল আহমেদকে বাড়িতে পাওয়া গেল। তিনি আমাদের আহ্বানে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তখন আমরা লিডার দীপককুমার হালদারকে কয়েকজন রক্ষী সদস্যসহ তার বাড়িতে পাঠাই। তােফায়েল আহমেদ তার সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসেন।
জাতির জনক সপরিবার নিহত হয়েছেন জেনে তােফায়েল আহমেদ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে সেনাবাহিনী প্রধান, সরকারের অন্যান্য নেতাসহ অনেকের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। কিন্তু কারও কাছ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা নিজেরাই অনেকের চেহারা পরিবর্তন হতে দেখেছি। দেখেছি, সরকারের ভেতরের অনেকেই উল্টো পথ ধরেছেন। বুঝতে পারছিলাম না দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে কাকে বিশ্বাস করব, কাকে করব না। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নূরুজ্জামানের অভাব বােধ করছিলাম। কারণ, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানতেন। ফলে তার পক্ষে পরিস্থিতি অনুধাবন করে ব্যবস্থা গ্রহণ অনেক সুবিধাজনক হতাে।
তােফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম । ঠিক হলাে, আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবােধ গড়ে তুলব। তার সঙ্গে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে, সরােয়ার ও আমি সাভারে যাব। লিডার শেখ দলিল উদ্দিনকে সাভারে যাওয়ার পথ রেকি করতে পাঠানাে হয়। শেখ দলিল মিরপুর সেতু পর্যন্ত গিয়ে দেখেন, সেখানে সেনাবাহিনী মােতায়েন করা হয়েছে। এটা দেখে তিনি ফিরে আসেন। তাঁর কাছ থেকে এ তথ্য পেয়ে বুঝতে পারলাম, সরাসরি আমাদের সাভারে যাওয়ার পথ বন্ধু। তখন কেন যেন আরও মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নজরদারিতে রেখে আমাদের, বিশেষত সরােয়ার ও আমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যাতে আমরা কোথাও যেতে না পারি। এটা হয়তাে খালি চোখে আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ, আমাদের কোনাে গােয়েন্দা ইউনিট নেই। এ অবস্থায় উপায় না দেখে আমরা সাভারে যাওয়ার পরিকল্পনাও ত্যাগ করি।
এর মধ্যে রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি ঘটনা ঘটে। আমরা জানতে পারি, সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী৫ একদল সেনা নিয়ে রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যান। তিনি রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অবস্থানরত একজন ভারতীয় প্রশিক্ষককে ঢাকায় আমাদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসেন এবং রেখে চলে যান। ভারতীয় প্রশিক্ষকের নাম ছিল বালা রেড্ডি। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং এনসিও-জেসিও ছিলেন। তারা অনেক আগেই দেশে ফিরে যান। ছিলেন শুধু বালা রেড্ডি।
সেদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট আমীন আহম্মেদ চৌধুরী সাভার থেকে তাকে ঢাকায় আমাদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসায় আমরা কিছুটা অবাক হই। আমরা ভেবেছি, তিনি হয়তাে উর্ধ্বতন কারও নির্দেশে এটা করেছেন। কিন্তু পরে জানতে পারি, এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কেউ তাঁকে নির্দেশ দেননি। আমীন আহম্মেদ চৌধুরী তখন জয়দেবপুরে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্বতঃপ্রণােদিত হয়েই কয়েকজন সেনাসহ তার ইউনিট থেকে সেখানে যান এবং মেজর বালা রেড্ডিকে ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। এ ঘটনা বেশ রহস্যাবৃত। মেজর বালা রেড্ডিকে আমরা ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিই।
বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে সরকারিভাবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস ও প্রধানমন্ত্রীর সচিব আবদুর রহিম। সংকটময় ওই মুহূর্তে পরামর্শের জন্য তাদের আমরা পাইনি। তারাও আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেননি। সরােয়ার ও আমি নিজেদের বুদ্ধিতে যতটুকু কুলিয়েছে, দেশ ও জাতির জন্য যা ভালাে মনে হয়েছে, তা-ই করার চেষ্টা করেছি।
আমরা জানতাম, জাতির জনক নিহত, তাকে আর ফেরত আনতে পারব না। কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান আমাদের ‘বাংলাদেশ’। সেই বাংলাদেশের তো আমরা ক্ষতি করতে পারি না। আমাদের দায়িত্বই হলো বাংলাদেশকে রক্ষা করা। বঙ্গবন্ধু বাঙালি আর বাংলাদেশের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি জীবিত থাকলে বাংলাদেশের কল্যাণকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতেন। বাংলাদেশ রক্ষা পেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকাল বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে থেকে যাবেন।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার দিনটি, অর্থাৎ ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিন হিসেবে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দিনটি কলঙ্কজনক শুধু এই জন্যই নয় যে জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছে । বরং এ জন্যও যে বাঙালি জাতি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রতিহত করতে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আরও কলঙ্কজনক এই জন্য যে বাঙালি জাতির একাংশ পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে রক্ষা করতে চেয়েছিল। যদিও অনেক বছর পর ইনডেমনিটি বাতিলের মাধ্যমে ঘাতকদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘Human psychology is as frail as a drop of dew on the back of a duck.’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরম বেদনাদায়ক প্রয়াণে বাঙালি জাতির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখে আমার এই কথাটাই মনে হয়েছিল। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম বাঙালি জাতির মন ও মানসিকতা। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব ও বহু মানুষের আত্মত্যাগে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই মুক্তিদাতা ও জাতির পিতা যেদিন সদ্য স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, সেদিন তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানে মুগ্ধ লক্ষ-কোটি বাঙালি অফুরন্ত আনন্দে রাজপথে নেমে এসেছিল। তাকে জানিয়েছিল হৃদয় নিংড়ানাে ভালােবাসা আর দিয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা, যা শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও ছিল অভূতপূর্ব।
সেই কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কীভাবে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে কৃতঘ্ন হয়ে গেল, আমি বুঝতে পারি না। যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতায় পরিবারসহ হত্যা করা হয়, সেদিন রাজধানীর রাজপথে একজন বাঙালিকে দেখা যায়নি। পরদিন, বলা যায় ‘He was buried unlanented and aficoffined. তার প্রতিষ্ঠিত দেশের রাজধানীতে তার সমাধি দূরের কথা, জানাজাও হলাে না। বঙ্গবন্ধুর এই পরিণতি কি প্রাপ্য ছিল?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন যেন ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘The Patriot’ কবিতার ভেতর দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, কবি যখন দেশপ্রেমিকের আনন্দঘন স্বাগত সংবধর্না আর বেদনাদায়ক বিদায়ের দৃশ্য চিত্রায়িত করেন-
Thus I entered…, and
Thus I go
অবাক হতে হয় বঙ্গবন্ধু সেই প্যাট্রিয়টের মতাে কীভাবে এসেছিলেন এবং কীভাবে তিরােহিত হলেন।
বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে, ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নিতে চায় না। সে জন্য ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Success has many fathers, failure is an orphan’। আমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছে এই অবস্থা। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সাফল্য কেউ চোখে দেখে না। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় ব্যর্থতার দায়ও এই বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অনেকেই রক্ষীবাহিনীর সমালােচনা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় যে ব্যর্থতা এবং প্রতিরােধ গড়ার যে ব্যর্থতা, তার দায়ভার যতটুকু রক্ষীবাহিনীর ওপর বর্তায়, ঠিক ততটুকু গ্রহণ করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবে আমার ওপর যতটুকু দায়ভার পড়ে, ততটুকু আমি বিনা দ্বিধায় মাথা পেতে নেব। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয়, সেদিন যাদের দায়িত্ব ছিল তথ্য সংগ্রহ ও যথাস্থানে সরবরাহ করা, সেসব গােয়েন্দা সংস্থা যথা ডিজিএফআই, এনএসআই ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের যে ব্যর্থতা, তার দায়ভার কি ওই সংস্থাগুলাে ও তাদের তদানীন্তন কর্তিারা নিয়েছেন? রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার ছিলেন অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে আগেও যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং সেদিনও অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন? তারা তাে দেশের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতার আসনে বসে ছিলেন। জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ে তাদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার দায়ভার কি তারা এড়াতে পারবেন? যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁরা তাে সরাসরি জনগণের কাছে দায়ী। অনেকেই যখন খন্দকার মােশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন, এখন তাদের জবাবদিহি কোথায় থাকল? তাবশ্য যারা প্রতিবাদী ছিলেন তাদের কথা আলাদা। তাদের অনেককেই জীবন দিতে হয়েছিল এবং অনেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কারাগারে।
যাদের ওপর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল, ১৫ আগস্ট তাঁরা যে সীমাহীন ব্যর্থতা দেখালেন, তার জন্য জবাব কে দেবে? যে কজন দেশপ্রেমী বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কর্নেল জামিল উদ্দিন ছাড়া আর কাউকে কি বীরত্বসূচক সম্মান দেওয়া হয়েছে? যারা সরাসরি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের কি শাস্তি দেওয়া হয়েছে?
আর বাকশাল ও আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা ও কর্মীবাহিনী, যারা শ্লোগান দিতেন বঙ্গবন্ধু যেখানে, আমরা আছি সেখানে, তারা কোথায় ছিলেন? সামান্য কারণে তারা রাজপথে নেমে আসেন। অথচ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনার পর, জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর তারা রাজপথে বেরােলেন না কেন? তাদের কি ভয় ছিল? তারা হাজারে হাজারে রাজপথে নামলেই তাে বােঝা যেত জনগণ খুনিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। জনগণের দৃশ্যমান সমর্থন থাকলেই সরকারি বাহিনীগুলাে প্রতিরােধে দাঁড়াতে পারত।
১৫ আগস্ট সারা দিন রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে বসে আমরা পরিস্থিতি পর্যালােচনা এবং সম্ভাব্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তা বিবেচনা করি । রক্ষীবাহিনীর প্রায় প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে যােগাযােগ করে যেকোনাে পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য সবাইকে তৈরি থাকার নির্দেশ দিই। এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি এবং সেনাবাহিনীর ভেতরে কী অবস্থা জানতে চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদে জাতি এমনিতেই শােকাতুর কিন্তু তা প্রকাশ করার কোনাে পথ খােলা ছিল না। কারণ, জাতীয় নেতারা তখন দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন। রেডিও-টেলিভিশন খুনিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল; বিভিন্নভাবে তারা দেশে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। যে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ধ্বনি হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। তার বদলে এল ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। পাকিস্তানি আমল ও ধ্যানধারণা আবার যেন ফিরে আসে। পাকিস্তানই এ সময় সবার আগে খন্দকার মােশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানায়। কিছু লােক পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
সুবিধালােভী ও সুযােগসন্ধানী একদল মানুষ এই সুযােগে ক্ষমতার রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি ভাবধারার লােকেরা স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট মােশতাককে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেনি। বাকশাল ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা, বিশেষ করে তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুর যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা স্পষ্ট হতে থাকে।
বিকেলে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সরােয়ার ও আমাকে বঙ্গভবনে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। কিন্তু আমরা না গিয়ে অফিসে থেকে যাই। খবর পাই, বঙ্গবন্ধুর সরকারের মন্ত্রীদের বেশির ভাগই নতুন মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছেন। খন্দকার মােশতাক তাদের মন্ত্রী করে বিশ্ববাসীকে বােঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তিত হয়নি, কেবল পরিবর্তিত হয়েছে ব্যক্তির।
আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আচরণে। বাকশাল গঠনের পরপরই ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ মওলানা ভাসানীর সাদর আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টাঙ্গাইলের কাগমারী সফরে গিয়েছিলেন। এই সফরে আমিও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। কাগমারীতে লক্ষাধিক মানুষের এক জনসভায় শওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন, তিনি মুজিবের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন যেভাবে সমর্থন করেছিলেন, সেভাবেই তার দ্বিতীয় বিপ্লবকেও সমর্থন করে যাবেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর পা স্পর্শ করে সালাম করেছিলেন আর মওলানা ভাসানী পিতৃস্নেহে বঙ্গবন্ধুকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এ দৃশ্য আমি কৌতূহল নিয়ে দেখেছি। সেই মওলানা ভাসানী মাত্র পাঁচ মাস পর তার অতীত রাজনীতির মতো আবারও ডিগবাজি খেলেন। তাঁর পুত্রতুল্য মজিবরকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছেন, তাঁদের অভিনন্দন জানাতে তাঁর বিবেকে এতটুকুও বাধল না। তা-ও এমন সময় ঘৃণিত ঘাতকদের অভিনন্দন জানালেন, যখন শেখ মুজিবুর রহমানের পবিত্র দেহের রক্তও লুকায়নি এবং তাকে সমাহিত পর্যন্ত করা হয়নি। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে স্বার্থান্বেষী মহলের মন্ত্রণায় মওলানা ভাসানী এই জঘন্য কাজটি করেছিলেন, তারা কিন্তু পরে তার পাশে থাকেননি। এমনকি তার মৃত্যুবার্ষিকীতেও তাদের দেখা যায় না।
১৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ আমাকে ফোন করে জানান যে জরুরী কথা আছে। সরােয়ার ও আমাকে বঙ্গভবনে যেতে হবে। আমরা বঙ্গভবনে গিয়ে দেখি খালেদ মােশাররফ ভীষণ ব্যস্ত। তিনি নিজ উদ্যোগে এক জরুরি ‘অপারেশন রুম’ স্থাপন করেছেন। সেখানে আমাদের সীমান্ত এলাকা থেকে বিদ্যুৎবেগে তথ্য আসছে- ভারতীয়রা কোথায় কোথায় সেনাসমাবেশ ঘটাচ্ছে আর ট্যাংকবহর মােতায়েন করছে ইত্যাদি। তার ও অন্য কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা দেখে মনে হলাে, ভারত যেকোনাে সময় বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে এবং তারা সেই আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যবস্থা করছেন। আমরা বেশ কিছুক্ষণ খালেদ মােশারফের নতুন অপারেশন কক্ষে থাকলাম। কিন্তু ভারত সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মােতায়েনের কোনাে তৎপরতা বা নির্দেশ দেখলাম না। ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমাদের কেন ডেকেছেন, সে সম্পর্কে কিছু বললেন না। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত দেখালেন। তবে আমরা ঠিকই বুঝতে পারলাম যে ভারত বাংলাদেশ আক্রমণের তৎপরতা দেখাচ্ছে, এই মর্মে আমাদের তিনি ধোকা দিতে চাচ্ছেন। আমরা সামরিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও সাধারণ জ্ঞানহীন তাে নই। নয় মাস যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাে আছে আমাদের, হাজার লেখাপড়া করেও যা অর্জন করা যায় না।
বঙ্গভবনে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তাদের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে দেখা গেল তিনি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি বনে গেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ মতিন৬ বীর প্রতীককে দেখা গেল বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে। জিয়াউর রহমান, বিডিআর-প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার মসহুরুল হক একটা কক্ষে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় জিয়াউর রহমান আমার কাছে এসে জানতে চান, তােফায়েল আহমেদ আমাদের ওখানে আছেন কি না। তাঁর এ কথায় আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। অবশ্য সেটা কেটে যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। আমি উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে, রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তােফায়েল আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে নেবেন। এ কথায় আমি কিছুটা আশ্বস্ত হই। তাকে বলি, তোফায়েল আহমেদ আমাদের এখানে আছেন। পরে রাত ১০টায় ঢাকার সিটি এসপি আবদুল সালামকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে পাঠানাে হয়। তিনি তােফায়েল আহমেদকে নিয়ে যান। কিন্তু তােফায়েল আহমেদকে কোথায় নিয়ে যাবেন, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। এ ব্যাপারে তাকে কোনাে নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। তাই তিনি তােফায়েল আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে না নিয়ে বাসায় রেখে আসেন। এটা আমি পরে জানতে পারি। কদিন পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা তাকে বাসা থেকে আটক করে। তাকে নির্যাতনও করে তারা। পুলিশ হেফাজতে থাকলে হত্যাকারীরা এটা হয়তো করতে পারত না।
এদিকে আমাদের কেন বঙ্গভবনে যেতে বলা হয়েছে, তা বুঝতে পারছি না। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর আমরা ফিরে আসতে চাইলে খালেদ মােশাররফ আমাদের বললেন, দেশে সামরিক আইন জারি হতে পারে। সারা দেশে সেনাবাহিনী মােতায়েন করা হবে। এ জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিডিআর এবং রক্ষীবাহিনীর সদস্যদেরও প্রয়ােজন হবে। আমরা দুজনই খালেদ মােশাররফকে বলি, আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান লন্ডন থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এ রাকারে কোনাে সিদ্ধান্ত দিতে পারব না।
এটা বলে আমরা বঙ্গভবন থেকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দিই। এ সময় একটি কক্ষে দেখি সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ আর বিমানবাহিনী-প্রধান এ কে খন্দকার নির্লিপ্তভাবে এক কোনায় বসে আছেন। আমরা তাদের কাছে গেলে সফিউল্লাহ আমাদের খোঁজখবর নেন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্য কিছুই করতে পারলেন না বলে অনুশােচনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘Shaheed, I will go black in the history of Bangladesh.’
সরােয়ার ও আমি রাতে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা বাড়ি যাব না, অফিসেই থাকব। সে মােতাবেক সরােয়ার, সাবিহ উদ্দিন ও আমি আমাদের অফিসার্স মেসে একসঙ্গে রাত কাটাই। পরদিন আমরা রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদার সঙ্গে কথা বলি। বুঝতে চেষ্টা করি আমরা সেদিকে গেলে সহযােগিতা পাওয়া যাবে কি না । নাজমুল হুদা যেসব কথা বললেন তা খুব আশাব্যঞ্জক ছিল না। এমতাবস্থায় আমরা এ এন এম নূরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লন্ডনে ফোন করার চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া গেল না। পরে জানতে পারি, তখন বিদেশের সঙ্গে সব যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। বিমান চলাচল বন্ধ ছিল।
এদিকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর পেয়ে সাভারে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দুজন রক্ষী সদস্য আত্মহত্যা করেন। যে দুজন সদস্য আত্মহত্যা করেন তাদের নাম এখন আমার মনে নেই। অন্যদের মধ্যেও গভীর শােকের ছায়া নেমে আসে। কয়েকজন রক্ষী আবার প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে পালিয়ে যান। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ৪ নম্বর ব্যাটালিয়নকে যেকোনাে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৈরি রাখা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য সীমিত অস্ত্র-গােলাবারুদ যা ছিল তা ইস্যু করা হয়। এ খবর সেনাসদরে পৌঁছালে তারা ধারণা করেন রক্ষীবাহিনী হয়তো সশস্ত্র প্রতিরােধ ও বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মইনুল হােসেন চৌধুরী আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান যে তারা শুনেছেন, সাভারে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাই তিনি রক্ষী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে সাভার যেতে চান। আমি তাকে জানাই, রক্ষীবাহিনী প্রতিটি ক্যাম্পেই উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে আমাদের আদেশ ছাড়া কোনাে ক্যাম্পেই কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। কারণ, আমাদের কমান্ড ও কন্ট্রোল অটুট আছে, তার পরও মইনুল হােসেন চৌধুরী সাভার যেতে চান। আমি তাকে বলি আপনি যেতে পারেন কিন্তু সঙ্গে কোনাে সেনা নিয়ে যাবেন না। সেনা দেখলে রক্ষী সদস্যরা অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়বে। আমিও আপনার সঙ্গে যাব, তাহলে আপনার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে না।
পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৭ আগস্ট সকাল বেলা মইনুল হােসেন চৌধুরী আমাদের প্রধান কার্যালয়ে আসেন। সেখান থেকে আমরা একত্রে সাভার যাই। তিনি লিডার ও রক্ষীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সন্ময় কাটান। এ সময় তিনি সবার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন। সব রক্ষীকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন এবং অর্জিত স্বাধীনতা যাতে বিপন্ন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেন। তারপর আমরা একসঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। সাভারে মইনুল হােসেন চৌধুরী ভালাে ভালাে কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার তার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল, এখন সেটা স্পষ্ট ছিল না। পরে তিনি আমাকে বলেছেন, সেনাপ্রধান ও উপপ্রধানের নির্দেশে তিনি সাভার গিয়েছিলেন।
এদিকে তখন ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর (মােহাম্মদ আবুল মঞ্জুর)। তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরপরই কদিনের জন্য ঢাকা আসেন। কার আদেশে, কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন তা ছিল অনেকটা রহস্যাবৃত। তবে তাকে প্রায় সময়ই জিয়াউর রহমানের আশপাশে দেখা যেত। রক্ষীবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছিলেন। আমাদের সঙ্গে কথা হয় মূলত রক্ষীবাহিনীকে এক রাখা এবং গােটা বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে স্মর্ভুক্ত করার ব্যাপারে । শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁর কথায় রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে একমত হই।
খন্দকার মােশতাক আহমদ ক্ষমতা গ্রহণ এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রেপ্তার করতে থাকেন। ২৩ আগস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যাঁরা তাঁকে সমর্থন করতে এবং তার মন্ত্রিসভায় যােগ দিতে অস্বীকার করেন, তাদের বন্দী করেন। অনেকে আত্মগােপন করেছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ৪ আগস্ট থেকেই তার বাড়িতে নজরবন্দী অবস্থায় ছিলেন। নেতাদের গ্রেপ্তারের ফলে দেশে এক ভয়ংকর ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতাবিরােধী চক্র আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রেডিও টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার ভাব দেখে মনে হয়েছে, ৩০ লাখ মানুষের রক্তে গড়া বাংলাদেশ এখন পুরােপুরি চলছে উল্টো পথে। অনেকের ধারণা হয়, বাংলাদেশই হয়ে গেল পাক বাংলা। এমনকি মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেও যে পাকিস্তানের বহুল আলােচিত গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের এজেন্ট লুকিয়ে ছিল, তা-ও স্পষ্ট দেখা গেল।
তখন আমাদের একটাই চিন্তা, কী করে এই স্বাধীনতাবিরােধী চক্রকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাে সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের সমর্থন দরকার সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে। এর মধ্যে আভাস পাওয়া গেল, খালেদ মােশাররফ ওপরে ওপরে যতই ঘৃণিত ঘাতক আর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মােশতাক গংয়ের পক্ষে থাকুন না কেন, আসলে তিনি সুযােগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারায় হয়তো বিবেকের দংশনে ভুগছেন। সুযােগ পেলে তিনিও ব্যবস্থা নেবেন— এ বিশ্বাস আমাদের ছিল।
ঠিক এই বিশ্বাস থেকে দিন কয়েক পর একদিন আমরা তাকে আমাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আমন্ত্রণ জানাই। ২৪ আগস্ট সকালবেলা কে এম সফিউল্লাহ সাভারে আসেন এবং রক্ষীদের সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি রক্ষী সদস্যদের সতর্ক ও শান্ত থাকতে বলেন। সেদিন আমরা, বিশেষত সরােয়ার ও আমি, আকারে ইঙ্গিতে তাকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, প্রয়ােজনে তার পাশে আমরা থাকব।
কে এম সফিউল্লাহ এটা অনুধাবন করেছিলেন কি না, আমি জানি না। এ নিয়ে সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলার পর্যায়ে আমরা ছিলাম না । প্রকৃতপক্ষে বাহিনীর শৃঙ্খলা অনুযায়ী আমাদের মতাে স্তরের কর্মকর্তাদের সরাসরি সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ কারও সঙ্গে প্রয়ােজন ছাড়া কথা বলার সুযােগ ছিল না। তবে শুরু থেকে সরােয়ার ও আমি রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে তখনকার সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ অনেকের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা হয়। কারও কারও সঙ্গে, বিশেষত মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল । কিন্তু সেটা সীমাবদ্ধ ছিল ব্যক্তিগত কার্যাবলির মধ্যেই।
যা হােক, আমাদের এই প্রচেষ্টাও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কারণ, ওই দিন সন্ধ্যাবেলা বেতার ও টেলিভিশনে ঘোষণা প্রচার করা হলাে যে, কে এম সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। তার পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। ১৫ আগস্ট থেকে আমরা গভীরভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ঘোষণা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের পছন্দ অনুযায়ীই জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খন্দকার মােশতাক ভালাে করেই জানত, জিয়াউর রহমান অনেক উচ্চাভিলাষী। তাকে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সহজ হবে না। সে জন্য তার পরামর্শে জিয়ার বিরােধী এম এ জি ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং তাদের দুজনের সঙ্গে সংযোগ মাধ্যম হিসেবে পাকিস্তান-প্রত্যাগত উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা খলিলুর রহমানকে (তিনি জিয়ার চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন) চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ নিয়োেগ করা হয়। তারা দুজনই আবার খালেদ মােশাররফকে পছন্দ করতেন। এ জন্য খালেদ মােশাররফকে সিজিএস পদেই রাখা হয়। যদিও অনেকে ধারণ করেছিলেন, খালেদকে অপসারণ করে মেজর জেনারেল জিয়ার পছন্দ মতাে এম এ মঞ্জুরকে সিজিএস করা হবে। তা না হওয়ায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হয়েও পুরােপুরি ক্ষমতাবান হতে পারেননি। অন্যদিকে খন্দকার মােশতাক আর এম এ জি ওসমানীর হয়তাে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে সেনাপ্রধান করার ইচ্ছা ছিল।
রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হয়েই এম এ জি ওসমানী সরােয়ার ও আমাকে একদিন বঙ্গভবনে ডাকেন। সেখানে গিয়ে দেখি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিষন্ন মনে এক কোনায় বসে আছেন। আগের দিন তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে। বঙ্গভবনে তখনাে এম এ জি ওসমানীর কোনাে অফিসকক্ষ হয়নি। একটি ছােট ঘরে তিনি আমাদের দুজনকে নিয়ে বসলেন। প্রথমেই তিনি ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “How many Hindus are there in Rakhhi Bahini? প্রশ্নটা অবাক করার মতাে। শুনেই মনে হলাে ‘একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে!’ মাত্র বছর খানেক আগেই তিনি সিলেটের একটি হিন্দু ছেলেকে লিডার পদে নিয়ােগের জন্য আমাদের পরিচালককে অনুরােধ করেছিলেন। আজ তিনি জিজ্ঞাসা করছেন কজন হিন্দু আছে রক্ষীবাহিনীতে? অবাক হওয়ারই কথা। আমরা দুজন বললাম, হিসাব না করে এটা বলা যাবে না। তবে হিন্দুদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
এরপর ওসমানী আমাদের বলেন, রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করা হবে এবং রক্ষীদের ভাগ করে পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে দেওয়া হবে। আমরা বললাম, এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। কথা বলতে হবে আমাদের পরিচালক এ এন নুরুজ্জামানের সঙ্গে। এ জন্য তাকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। আমরা আরও বলি, তার সঙ্গে আমরা টেলিফোনে কথা বলতে চাই।
ওসমানী আমাদের কথায় খুব রাগান্বিত হলেন। ইংরেজিতে বললেন, ‘Nuruzzaman can’t come’. আমরা এবারও দৃঢ়ভাবে তাকে জানালাম, নূরুজ্জামান ছাড়া রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত আপনারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। কারণ, রক্ষী সদস্যরা এটা মানবে না। এ ব্যাপারে আমাদের আরও কিছুক্ষণ কথা হয়। এখন আর সব কথা মনে নেই । কথা বলার পর ওসমানী একটু নরম হন এবং ইংরেজিতে বলেন, “I will talk to the President.”
এদিকে আমরা যখন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন জিয়াউর রহমান এবং এম এ মঞ্জুর আমাদের খুঁজছিলেন । এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে কথা বলে আমরা বের হতেই জিয়া আমাদের দেখতে পান। তিনি আমাদের ডেকে বলেন যে, ‘তােমরা চিন্তা কোরাে না, সরকার যদি ভেঙেও দেয়, তবে রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যকে আমি সরকারিভাবেই সেনাবাহিনীতে নেব।’ আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি। তার কথায় আমরা একটু আশ্বস্ত হয়ে অফিসে ফিরে আসার জন্য বঙ্গভবন থেকে বের হই। তখন এম এ মঞ্জুরও আমাদের সঙ্গে বের হন এবং আমাদের অফিসে আসেন। সেখানে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, সরােয়ার ও আমি তার সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করি। কারণ, আমরা জানতাম, এম এ মঞ্জুরের ওপর জিয়াউর রহমানের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আলােচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে জিয়ার মতো মঞ্জুরও চান রক্ষীবাহিনীর পুরােটাই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হােক। কারণ, রক্ষীবাহিনী সদস্যদের প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতার ওপর তাদের পূর্ণ আস্থা ছিল এবং তারা জেনেছেন, খন্দকার মােশতাক রক্ষীবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেবেন। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর রক্ষীবাহিনী দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অসাধারণ অবদান রেখে যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তা সেনাবাহিনী সম্প্রসারণে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। আমরা বলি যে আমরা বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখব। তবে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই এ এন এম নূরুজ্জামানকে দেশে আসতে দিতে হবে।
এম এ মঞ্জুর পরদিন সকাবেলায় আমাদের নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যেতে অনুরােধ করেন। সরােয়ার, সাবিহ উদ্দিন ও আমি যথাসময়ে তার সেনানিবাসের বাসায় যাই। সেখানে এম এ মঞ্জুরও উপস্থিত ছিলেন। দেশ পরিচালনার বিষয়ে আমাদের মতামত চেয়ে জিয়াউর রহমান আলােচনার সূত্রপাত করেন। আমরা আগেই জেনেছিলাম যে, এম এ মঞ্জুর সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় আকৃষ্ট। এ ভাবধারার প্রতি তাঁর বেশ আকর্ষণ আছে। সম্ভবত জিয়াউর রহমানকেও তিনি এই ভাবধারার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্যই হয়তাে জিয়াউর রহমান সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চান। তিনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন এবং নানা সময়ে তার সঙ্গে আমার দেখা ও কথা হয়েছে। এ কথা আগে বলেছি। আবার চাকরির কারণে আমাদের মধ্যে দূরত্বও ছিল। পদমর্যাদায় তিনি আমার অনেক ওপরে ছিলেন। এ অবস্থায় আমি কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। আমি পক্ষে-বিপক্ষে কিছু না বলে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে উইনস্টন চার্চিলের দুটো মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিই শুধু। মন্তব্যগুলাে ছিল : ১. Socialis is like a hat that has lost its shape because everybody wears it. ২. Capitalism is unequal sharing of wealth and Socialism is equal sharing of misery. আমার মন্তব্য দুটি শুনে জিয়াউর রহমান আমাকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না।
এরপর শুরু হয় আসল বিষয় অর্থাৎ রক্ষীবাহিনী নিয়ে আলােচনা। এবারও জিয়াউর রহমান এ আলােচনার সূত্রপাত করেন এবং আমাদের বক্তব্য জানতে চান। আমরা তাকে সংক্ষেপে এরকম একটা স্পষ্ট ধারণা দিলাম যে, এটা করার জন্য অনতিবিলম্বে আমাদের পরিচালক নুরুজ্জামানের দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বললাম, রক্ষীবাহিনীকে যদি সত্যিই বিলুপ্ত করা হয়, তাহলে বাহিনীর সদস্যদের ভাগাভাগি করে বিভিন্ন বাহিনীতে না দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হলে তারা হয়তাে রাজি হবে। তবে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা যে যে র্যাংকে আছেন, সেনাবাহিনীতেও তাঁদের সেই একই র্যাংকে নিতে হবে। জিয়া আমাদের কথা মনােযােগ দিয়ে শােনেন। আমাদের কথা শেষ হলে তিনি আমাদের উত্থাপিত বিষয়গুলাে তার ওপর ছেড়ে দিতে বলেন। খুব বেশি কথা তিনি বলেননি।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে আমরা বুঝতে পারলাম, তিনি চিন্তা করেছেন রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হলে সেনাবাহিনীই লাভবান হবে। রক্ষীবাহিনীর সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, যথা—মিরপুরে রক্ষীবাহিনীর নির্মাণাধীন হেডকোয়ার্টার্স, সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্র, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র (এখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর জায়গাগুলাে পাবে। এ ছাড়া রক্ষীবাহিনীর ১৬টি ব্যাটালিয়ন পেলে সেনাবাহিনীর পাঁচটি ব্রিগেডকে পাঁচটি ডিভিশনে উন্নীত করা সহজ হবে। এ ছাড়া এম এ মঞ্জুরের আরেকটি যুক্তি ছিল, রক্ষীবাহিনীর মুক্তিযােদ্ধা সদস্যদের পেলে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলােচনার পর আমাদের রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এ এন এম নুরুজ্জামানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে দেওয়া হয়। তাকে আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যা যা করেছি, সবই জানাই। আমরা যা করেছি তার ওপর তিনি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেন এবং সমর্থন জানান। এর কয়েক দিন পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। সরােয়ার ও আমি অনেকটা ভারমূক্ত হই।
এদিকে সরকারের বিভিন্ন সূত্রে খবর পাই যে, জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে বিলুপ্ত করে রক্ষী সদস্যদের আনসার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে ভাগ করে দেওয়ার ব্যাপারে খন্দকার মােশতাক, এম এ জি ওসমানী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান এবং এম এ মঞ্জুর অবস্থান নিয়েছেন এর বিপক্ষে। তাঁদের পরিকল্পনা রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণাধীন সব কর্মকর্তা ও সদস্যকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা। এ ব্যাপারে খালেদ মােশাররফ কোন পক্ষে, সেটা বােঝার উপায় ছিল না। তবে সরকারের মধ্যে দ্বিমতের সুযােগে আমাদের এক পক্ষ নেওয়ার পথ খুলে গেল। সেটা ব্যবহার করে আমাদের পরিচালক লন্ডন থেকে ফিরেই কৌশলগত কারণ ও রক্ষীবাহিনীর স্বার্থে জিয়াউর রহমানের পক্ষ নেন। আত্তীকরণ-প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য তাঁকে সেনাসদরে সংযুক্ত করা হয়।
এ সময় রক্ষীবাহিনীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য বঙ্গভবনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় খন্দকার মােশতাক, এম এ জি ওসমানী, খলিলুর রহমান, জিয়াউর রহমান এবং এ এন এম নূরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
জিয়াউর রহমান দেশের প্রতিরক্ষাশক্তি বাড়ানাের লক্ষ্যে রক্ষীবাহিনীর সকল স্তরের কর্মকর্তা ও রক্ষী সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নেওয়ার জোর দাবি উপস্থাপন করেন। এতে রাগান্বিত হয়ে খন্দকার মােশতাক তার সঙ্গে বেশ রূঢ় আচরণ করেন। তার পরও জিয়া তার দাবিতে অনড় থাকেন এবং যুক্তি দেখান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাঁচটি ব্রিগেডকে পাঁচটি ডিভিশনে উন্নীত করতে বহু বছর প্রায়ােজন হবে। রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ শেষে প্রয়ােজনীয় কর্মকর্তা, জেসিও, এনসিওসহ বিভিন্ন র্যাংকের সেনা তৈরি করতেও অনেক সময় লাগবে। যদি সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনীর ১৬টি ব্যাটালিয়ন নেওয়া যায়, তাহলে অনতিবিলম্বে পাঁচটি ডিভিশন গঠন করা সম্ভব হবে। অনেক আলােচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হয় রক্ষীবাহিনী সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীতে একীভূত হবে।
১৯৭৫ সালের ৫ অক্টোবর সরকার ‘The Jatiya Rakkhi Bahini (Absorption in the Army) Ordinance, 1975 জারি৭ করে। তারপর শুরু হয় আত্তীকরণ-প্রক্রিয়া। এ সময় প্রশ্ন দেখা দেয় যে রক্ষীবাহিনীর সব সদস্য সেনাবাহিনীতে যােগ দিতে চান কি না, তা খতিয়ে দেখা। এ জন্য সরােয়ার ও আমাকে দেশের প্রধান প্রধান রক্ষীবাহিনী-ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার এবং সরকারের সেনা প্লেনে আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পে যাই। রক্ষীবাহিনীর সকল স্তরের সদস্যদের (লিডার, উপ লিডার, সহ-লিভার ও রক্ষী সদস্য) সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের মতামত নিই। প্রায় সবাই সেনাবাহিনীতে যােগ দিতে আগ্রহ দেখান। এরপর ত্বরিত গতিতে রক্ষীবাহিনীর ইউনিটগুলােকে সেনাবাহিনীতে পাঠানাে হয় । হঠাৎ সেনাবাহিনীর আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় সেনাসদস্যরা, বিশেষ করে সেনা কর্মকর্তারা দারুণ খুশি হন। কারণ, রাতারাতি তাদের পদোন্নতির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এই সময় দেশের কোনাে সংবাদমাধ্যমে এবং সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে কোনাে বিরূপ মন্তব্য শােনা যায়নি। রক্ষীবাহিনীর অন্য সমালােচকেরা রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি।
গেজেট প্রকাশের দু-তিন দিন পর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সরােয়ার ও আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠান। তিনি জানতে চান, আমাদের ভবিষৎ পরিকল্পনা কী? আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তখনাে আমরা ভাবিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, রক্ষীবাহিনীর সকল স্তরের সদস্যের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। সরােয়ার ও আমি ঠিক করেছিলাম, আমরা সেনাবাহিনীতে যােগ দেব না। আমাদের পদের সমপর্যায়ে সেনাবাহিনীতে যােগ দিলে অনেক অসুবিধা এবং ব্যতিক্রমধর্মী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়ে আমরা দুজনই সচেতন ছিলাম। তা ছাড়া আমাদের দুজনের অতীত অনেকটা এক রকম। ১৯৬২ সাল থেকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ভূমিকা এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনে আমাদের অভিজ্ঞতা— সব মিলিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম । কিন্তু আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান ও জিয়াউর রহমান কয়েকটি কারণে আমাদের সেনাবাহিনীতে চেয়েছেন। আমরা দুজন সেনাবাহিনীর বাইরে থাকলে রক্ষী কর্মকর্তা ও সদস্যরা কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে এবং তাদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা বিরাজ করবে। কারণ, রক্ষীবাহিনী গঠনের শুরু থেকেই আমরা তাদের পাশে ছিলাম।
সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে সরােয়ার ও আমাকে তার অফিসে আবার ডেকে পাঠান। আমরা দুজন তার সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাদের দুজনকে সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল র্যাংকে যােগ দিতে বলেন। আমরা তার প্রস্তাবে সম্মত হতে সংকোচ বােধ করছিলাম। কারণ, আমরা স্থির করেছিলাম যে আমরা বেসামরিক জীবনে ফিরে যাব। কিন্তু জিয়া ও নূরুজ্জামানের চাপে ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে যেতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের স্বার্থে আমরা দুজন রাজি হই। এরপর প্রায়ােজনীয় আদেশ জারি হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অক্টোবর আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগদান করি। তারপর শুরু হয় আমাদের ওরিয়েন্টেশন কোর্স। কার্যত ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সরােয়ার ও আমি সরাসরি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে যােগদান করেছিলাম।
তথ্যনির্দেশ
১. আবদুল করিম খন্দকার (এ কে খন্দকার বীর উত্তম : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন ও ঢাকার এয়ার বেসের উপপ্রধান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে যুদ্ধে যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে। পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান, এয়ার ভাইস মার্শাল ও রাষ্ট্রদূত। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী।
২. সৈয়দ ফারুকুর রহমান: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ও পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) কর্মরত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধের শেষ দিকে পালিয়ে ভারতে আসে । তাকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে ৮ নম্বর সেক্টরে নিয়ােগ দেওয়া হয়।
৩. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর : বরিশাল থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর যােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী। ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই দুর্নীতির দায়ে পদচ্যুত।
৪. জিয়াউদ্দিন আহমদ : ১৯৭৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তখন তার পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যােগ দেন। ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন সুন্দরবন এলাকার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। পরে তিনি জাসদের গণবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন। সুন্দরবন এলাকায় জাসদ গণবাহিনীর সংগঠন গড়ে তােলেন। বর্তমানে ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।
৫. আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম: পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) কর্মরত ছিলেন। এর কমান্ডেন্ট ছিলেন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ ২৪ মার্চ কৌশলে এম আর আজুমদারকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে যায়। এ সময় আমীন আহম্মেদ চৌধুরী তার সঙ্গে ঢাকায় যান চিকিৎসার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে যান। নানা ঘটনার পর জুন মাসে তাকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্রাভো কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। ৩ আগস্ট শেরপুর জেলার নকশী বিওপির যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন। পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও সামরিক বিষয়ক বিশ্লেষক। মৃত্যু এপ্রিল ২০১৩।
৬. এম এ মতিন বীর প্রতীক : পরে মেজর জেনারেল। ২০০৭-০৮ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
৭. রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আত্তীকরণ-সংক্রান্ত গেজেট। পরিশিষ্ট ১৫ দেখুন।
Ref: রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, pp 139-171