মুক্তিযুদ্ধের পর সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগে কী সমস্যা হয়?
স্বাধীনতার পর জ্যেষ্ঠ, যােগ্য, দক্ষ, ত্যাগী ও শক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তােলার প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু সুদীর্ঘ সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশে তখন যে পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, তাতে সরকারের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। এম এ জি ওসমানীকে এক আদেশে জেনারেল করা হয়। তার সুপারিশে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক করেছিলেন যে খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান নিয়ােগ করবেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর একজন অমুক্তিযােদ্ধাকে সেনাপ্রধান করার চিন্তা যুক্তিযুক্ত বা গ্রহণযােগ্য ছিল না। ওসমানীরও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান থাকা আইনসম্মত ছিল না। কারণ, তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও নির্বাচিত সাংসদ। ফলে সরকারের সামনে ছিল মুক্তিযুদ্ধের তিনজন ফোর্স কমান্ডার, যাদের একজনকে সেনাপ্রধান করা যায়। যদিও তারা সেনাপ্রধান হওয়ার মতাে জ্যেষ্ঠ ছিলেন না এবং তাদের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট ছিল না। সেনাবাহিনী যতই ছােট হােক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, মেজর জেনারেল বা তদূর্ব পদের অধিকারীরা সাধারণত সেনাপ্রধান হন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে উপযুক্ত তিনজন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর। এর পরবর্তী র্যাংক লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে যারা পদোন্নতি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হলে তাঁরা হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে ওই পদে পদোন্নতি পেতেন। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার তাদের লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়। তিনজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন জিয়াউর রহমান । কিন্তু এম এ জি ওসমানী তাকে মােটেই পছন্দ করতেন না; মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তাঁকে একবার মুক্তিবাহিনী থেকে অব্যাহতি দিতে চেয়েছিলেন। ফলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কে এম সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান এবং জিয়াউর রহমানকে উপ সেনাপ্রধান করা হয়। দুজনকেই কর্নেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে জিয়া ও তার সমর্থিত একটি অংশ অসন্তুষ্ট ছিল। ১৯৭৩ সালের ৬ জুন তাদের দুজন একসঙ্গে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। এর কিছুদিন পর তাদের দুজনকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ থেকেই যায়। কয়েকজন মেজরও দ্রুত গতিতে কর্নেল ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হন। অন্যদিকে বীর সিপাহি সিপাহিই থেকে যান। এতে তাদের মধ্যেও দেখা দেয় চাপা অসন্তোষ।
সেনাবাহিনীর ভেতরে পুঞ্জীভূত এসব চাপা অসন্তোষ প্রকাশ করার তেমন সুযােগ ছিল না। ফলে অসন্তোষ প্রকাশের একটা নতুন পথ বের হয় এবং সেটা হচ্ছে জাতীয় রক্ষীবাহিনী। সেনাবাহিনীতে নিম্নমানের ব্যারাক সে দোষ রক্ষীবাহিনীর নিম্নমানের খাবার, সে দোষও রক্ষীবাহিনীর; পােশাক নিম্নমানের, সে জন্যও রক্ষীবাহিনী দায়ী এবং বেতন কম, সে জন্যও দায়ী রক্ষীবাহিনী। অথচ রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বেতনের স্কেল এবং খাবার ও পােশাকের সুবিধা ছিল পুলিশের মতে, সেনাবাহিনীর চেয়ে অনেক কম। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের থাকার ব্যারাক ছিল না। সাভার ট্রেনিং সেন্টারে ছাপরাঘর তৈরি করে গাদাগাদিভাবে তাদের খাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নতুন দেশে সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে ভারত থেকে। কারণ, অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করার অর্থ সরকারের ছিল না। পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর জন্য ভারত থেকে আমদানি করা সরঞ্জাম নিম্নমানের ছিল না। কিন্তু সেনাবাহিনী মনে করত, তাদেরগুলাে নিম্নমানের। এর কারণ দুটি। প্রথমত, সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরঞ্জামের বেশির ভাগ আমদানি করা হতাে আমেরিকা থেকে। সেগুলাের মান ভারতীয় সরঞ্জামের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। ফলে তাদের কাছে ভারতীয় সরঞ্জাম, পােশাক-আশাক নিম্নমানের মনে হতে পারে । দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, যারা ভারত থেকে আমদানির দায়িত্বে ছিলেন, তারা দুর্নীতি করে নিম্নমানের সরঞ্জাম কিনেছিলেন। এ কথা অনেকের হয়তাে জানা যে, টিসিবির ক্ষেত্রে ঘটেছিল এমন ঘটনা ।
Ref: রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, pp 82-83