You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.09.03 | ভাসানীর ভুখা মিছিল - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৭২ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু বিদেশে। ২৬ জুলাই তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান এবং প্রায় দুই মাস দেশের বাইরে ছিলেন । তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
৩ সেপ্টেম্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি ভুখামিছিল নিয়ে রমনা পার্কের পাশে তৎকালীন গণভবনে যান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে মওলানা ভাসানীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় গণভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর একদল রক্ষীও মােতায়েন ছিল। আমি নিজেও তখন সেখানে ছিলাম। ভুখামিছিল গণভবনের কাছে পৌছালে মওলানা ভাসানী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনােকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ছিল আমাদের ওপর । সেখানে নিয়ােজিত রক্ষীবাহিনীর একটি দলকে আমি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম, মওলানা ভাসানীকে স্বাগত জানানাের সময় তাকে যেন সামরিক কায়দায় সালাম জানানাে হয়। গণভবনের গেটে তাকে সালাম জানানাের ফলে মওলানা ভাসানী খুব খুশি হন এবং সবার খোজখবর নিতে থাকেন। রক্ষীবাহিনীর প্রায় প্রত্যেক সদস্যকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তােমার বাড়ি কোন জেলায়, কোন গ্রামে, ইত্যাদি। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও জবাব দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর মওলানা ভাসানী তার পাশে থাকা কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেননকে বলেন, ‘তােমরা না কও রক্ষীবাহিনীর সবাই ভারতীয়। আমি তাে দ্যাখতাছি এরা আমাগো পােলা।’ কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন কোনাে কথা না বলে চুপ থাকেন।

ওই ভুখামিছিলের উদ্দেশাই ছিল সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। কারণ, দেশে তখন অনেকটা দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। মওলানা ভাসানী যখন গণভবনের ভেতরে বসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে খাদ্যাভাব আর দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন গণভবনের বাইরে ওই মিছিল থেকে স্লোগান উঠছিল : ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না’। এ সময় হঠাৎ আমার মনে হলাে যে মওলানা ভাসানীকে আপ্যায়ন করা প্রয়ােজন। তিনি খেতে খুব ভালােবাসেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের বলে তার সামনে ভালাে মিষ্টি, স্যান্ডউইচ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। খাবার দেখে মওলানা ভাসানী খুব খুশি হন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা খেতে থাকেন। কাজী জাফর আর রাশেদ খান মেনন অবশ্য তাকে খেতে মানা করছিলেন। এ সময় উপস্থিত ক্যামেরাম্যানরা মওলানা ভাসানীর খাওয়ার ছবি তােলেন। পরদিন এ ছবি ও খবর বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়।
৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়:
গণভবনে ভাসানী-: গতকাল (রবিবার) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পল্টনে আয়ােজিত জনসভা শেষে একটি মিছিল বাহির করা হয়। মিছিলটি বিকাল ৫-৪৫ মিনিটে গণভবনের সামনে উপস্থিত হয় এবং মিছিলের সঙ্গে একখানি খোলা জীপে করিয়া মওলানা ভাসানী কাজী জাফরসহ অন্যান্য স্যাপ নেতা তথায় আগমন করেন। বিকাল ৫-৫০ মিনিটে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিকট একখানি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই সময় গণভবনে অধিকাংশ বিভাগীয় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান, শ্রমমন্ত্রী জনাব জহুর আহম চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দীন আহমদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক এম, সি, এ প্রমুখ।
মুদ্রিত স্মারকলিপিটি পেশ করার পর আলােচনা প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বলেন যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা না হইলে দেশের বর্তমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নহে। তিনি বলেন যে, ভুখা মিছিল নতুন কিছু নয়। ইহা গণতান্ত্রিক অধিকার। তিনি বলেন যে, সারা জীবনই আমি বিরােধী দল করিয়া আসিয়াছি এবং ইহা ছাড়া আমি আর কিছু করিতেও পারি না। মওলানা ভাসানী বলেন যে, নক্সালদের লাইনে যাই নাই আর কোন দিন যাইবও না। যাহাদের একটি হাল ও ২ বিঘা জমি আছে, তাহাদেরকেই শ্রেণীশত্রু বলিয়া নক্সালরা হত্যা করিতেছে। ইহা আমি পছন্দ করি না। আমি কোন কিছুই জালাইব না ও পােড়ইব না। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে মওলানা ভাসানীকে কিছু স্যাণ্ডুইস ও পেপে কাটিয়া পরিবেশন করা হয়।
মওলানা ভাসানী স্যাণ্ডুইস খাইতে খাইতে বলেন, সকলকেই সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করিয়া লইতে হইবে। তিনি আরও বলেন যে, দেশের যত লােকসংখ্যা তত সংখাক রেশন কার্ড বিলি করা দরকার। আলােচনা কালে তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব আর আমি এক সঙ্গে চীনসহ মধ্যপ্রাচ্য সফর করিলে সকল দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। মুজিব দেশে ফিরিয়া আসিলে তাহার সঙ্গে আমি আলােচনা করিব। সৈয়দ নজরুলের সহিত আলােচনার এক পর্যায়ে মওলানা সাহেব দাবী করেন যে, অন্যত্র ৫০ টি লাশ কাপড়ের অভাবে কলাপাতার কাফন দিয়া দাফন করা হইয়াছে বলিয়া তার নিকট প্রমাণ রহিয়াছে।
তিনি আরও বলেন যে, আমাকে সি আই, এর লােক বলিয়া অনেকেই অভিযােগ করে। কিন্তু আমি ইহা কিছুতেই বরদাশত করিতে পারি না।
নিত্যপ্রয়ােজনীয় ও অত্যবশ্যক দ্রব্যের শহর ও গ্রামভিত্তিক পূর্ণ রেশন চালু, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ, মুনাফাখোর, কালােবাজারী ব্যবসায়ীদের শাস্তি দান, দুর্নীতিবাজ এম, সি, এ, আমলা, রাজনৈতিক কর্মীর সম্পত্তির হিসাব নিকাশ, চোরাচালান রােধ প্রভৃতি সম্বলিত মওলানা ভাসানীর পেশকৃত স্মারকলিপির মধ্যে অন্যতম দাবী হিসাবে মুদ্রণ করা হইয়াছে।
মওলানা ভাসানী যখন খাচ্ছেন, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে একটা প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘হুজুর, আমাদের সরকারের প্রতি যদি আপনার এতই অনাস্থা, তাহলে আপনিই সরকারের দায়িত্ব নিন, আমরা চলে যাই।’ এই প্রস্তাব শুনে কাজী জাফর আর রাশেদ খান মেননের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু মওলানা ভাসানী তাে ক্ষমতায় যাওয়ার লােক নন। তিনি তাজউদ্দীনকে বােঝাতে লাগলেন—“ক্ষমতায় তােমরাই থাকে। আমাকে শুধু সমালােচনা করতে দাও আমাকে সমালােচনা করতে না দিলে অন্যরা তাে সমালােচনা বন্ধ রাখবে না।’

Ref: রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, pp 73-74