সিরাজ শিকদার | রক্ষীবাহিনী | শেখ মণি-তোফায়েল | বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ও আরও কিছু বিতর্কিত ইস্যু
আনোয়ার উল আলম
সিরাজ শিকদার পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা ছিলেন। তার নেতৃত্বে ‘শ্রেণীশত্রু খতম’ করার অভিযানে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে সর্বহারা দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্থানীয় জোতদার ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে হত্যা১ করতে শুরু করে। তারা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রক্ষীবাহিনীর লিডার ফারুক হােসেনকে প্রকাশ্য হাটে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাড়িতে গেরিলা হামলা করে অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করতে থাকে এবং দেশের কয়েকটি বিশেষ জায়গায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তা মােহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ (তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল) চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা দলে যােগ দেন। ১৯৭৪ সালে সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীরা নলছিটির সাংসদ আবদুল মুকিমকে এবং ১৯৫ সালে নেত্রকোনার সাংসদ আবদুল মালেক ও মনােহরদীর সাংসগাজী ফজলুর রহমানসহ বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করে। ১৯৭৪ সালেই বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতীয় রক্ষীবাহিনী কখনাে যৌথভাবে, কখনাে আলাদাভাবে সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে সারা দেশে কোণঠাসা হয়ে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র ক্যাডাররা পার্বত্য চট্টগ্রামের (বর্তমান খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা সমন্বয়ে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম) দুর্গম স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে। বাংলাদেশ পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর এই অভিযান ১৯৭৫ সালেও অব্যাহত ছিল।
১৯৭৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সিরাজ শিকদার গ্রেপ্তার এবং কয়েক দিন পর নিহত হন। বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন, সিরাজ শিকদারকে রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদ। এ ঘটনার সঙ্গে রক্ষীবাহিনী কোনােভাবেই জড়িত ছিল না। শুধু কিছু সময়ের জন্য তাকে রক্ষীবাহিনীর শেরেবাংলা নগরের কার্যালয়ে রাখা হয়েছিল। তাঁর ব্যাপারে রক্ষীবাহিনীর আর কোনাে সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কিন্তু এর সম্পূর্ণ দায় চাপানাে হয়েছে রক্ষীবাহিনীর ওপর।
পুলিশ সিরাজ শিকদারকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে তাদের তত্ত্বাবধানে তাকে ঢাকায় আনা হয় এবং পুলিশ হেফাজতে হােয়াইট হলে২ রাখা হয়। ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি সকালবেলা শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত আমাদের অফিসে এসে জানতে পারি, মধ্যরাতে সিরাজ শিকদারকে আমাদের অফিসার্স মেসে আনা হয়েছে। খবরটা পেয়েই আমি সহকর্মী সরােয়ার হােসেন মােল্লার সঙ্গে ঘটনাটি নিয়ে কথা বলি। আলােচনার পর দুজন একমত হই, সিরাজ শিকদারকে রক্ষীবাহিনীর অফিসার্স মেসে রাখা ঠিক হবে না। আমরা দুজন একসঙ্গে আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের অফিসকক্ষে যাই। পরিচালককে আমরা বলি, সিরাজ শিকদারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, সে জন্য তাকে পুলিশের হেফাজতেই রাখা হােক। আমাদের এখানে নয়। রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে এমনিতেই সমালােচনার শেষ নেই। তার ওপর যাকে আমরা গ্রেপ্তার করিনি, তার দায়িত্ব কেন নেব। উত্তরে পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান বলেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীর অনুরােধে তিনি সিরাজ শিকদারকে এখানে রাখার অনুমতি দিয়েছেন। কারণ, সিরাজ শিকদারের মতাে সর্বহারা পার্টির একজন দুর্ধর্ষ নেতাকে হােয়াইট হলে রাখা নিরাপদ নয়।
পুলিশের বেশির ভাগ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাই তখন পুলিশের চেয়ে রক্ষীবাহিনীর ওপর বেশি ভরসা করতেন, বিশেষ করে সিরাজ শিকদারের মতাে বড় সর্বহারা নেতাকে নিরাপদে রাখার ব্যাপারে। সরােয়ার ও আমি দুজনই জোর দিয়ে পরিচালককে বলি, সিরাজ শিকদারকে রক্ষীবাহিনীর অফিসার্স মেসে রাখা ঠিক হবে না। এ এন এম নূরুজ্জামান আমাদের কথা দেন, তিনি ই এ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলবেন এবং সিরাজ শিকদারকে অন্য কোথাও স্থানান্তরের অনুরােধ করবেন।
পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে সরােয়ার ও আমি রক্ষীবাহিনীর অফিসার্স মেসে সিরাজ শিকদারকে দেখতে যাই। সেখানে তিনি পুলিশের পাহারাতেই ছিলেন। নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে দেখি, সিরাজ শিকদার মাটিতে বসে আছেন। একটা টেবিলে তাকে সকালের নাশতা দেওয়া হয়েছে। তিনি খাননি। কক্ষের ভেতরে একটা বিছানা ও একটা ছােট টেবিল। কোনাে চেয়ার নেই। আমরা তিনটি চেয়ার আনার ব্যবস্থা করি। তার একটিতে বসতে দিই সিরাজ শিকদারকে। সরােয়ার তাকে জিজ্ঞেস করে সিগারেট খাবেন কি না। তিনি হাঁ-সূচক উত্তর দিলে সরােয়ার তাকে একটা সিগারেট ও ম্যাচ দেয়। সিরাজ শিকদার দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরান। কয়েকবার টান দিয়ে একটু স্বাভাবিক হন। এর আগে বসে ছিলেন বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে। আমরা তাকে নাশতা খেতে বলি। তিনি নাশতা খেতে শুরু করেন।
একপর্যায়ে আমরা তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। আমরা দুজন যে তার সঙ্গে এত ভালাে আচরণ করছি, তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার কথায় বােঝা গেল, তিনি নিশ্চিত, তার অনুপস্থিতিতে তার সহকর্মীরা বাংলাদেশে বুর্জোয়া সরকারকে উৎখাত করে সর্বহারাদের সরকার গঠন করতে পারবে। তিনি বারবার একটা কথাই বলছিলেন, ‘I know my fate is decided’.
সিরাজ শিকদারের সঙ্গে ১৪-১৫ মিনিট কথা বলে আমরা বেরিয়ে আসি। এ সময় আমাদের একজন কর্মকর্তা জানান যে পাশের ঘরে সর্বহারা পার্টির আরেক নেতা আছেন। তাকে না দেখেই আমরা দুজন অফিসকক্ষে ফিরে আসি। তিনি আসলে কে ছিলেন, নানা ব্যস্ততায় আর জানা হয়নি। এখন আমার অনুমান ওই নেতা হয়তাে কুরিয়ার অর্থাৎ যে সিরাজ শিকদারের পথপ্রদর্শক ছিল। রবিন নামে যে নেতা সিরজ শিকদারকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনিও হতে পারেন। রবিন প্রসঙ্গ পরে বলছি।
বিকেলবেলা জানতে পারি যে সিরাজ শিকদারকে আমাদের অফিসার্স মেস থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এতে আমরা একটু স্বস্তি পাই। সন্ধ্যায় ই এ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলে অভিযােগ করি, কেন তিনি সিরাজ শিকদারকে আমাদের অফিসার্স মেসে রেখেছিলেন। তাকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে রক্ষীবাহিনী বিন্দুমাত্র জড়িত নয়, অথচ তাকে এক রাত আমাদের মেসে রাখার ফলে অনেকেই আমাদের সম্পৃক্ততার কথা ভাবতে পারে। ই এ চৌধুরী একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি আমাদের স্নেহও করতে। আমাদের অভিযোগের জবাবে শুধু বললেন, ‘কেন তাকে ওখানে রাখা হয়েছিল পরে তােমাদের জানাব।’
দুদিন পর সকালে পত্রিকা খুলেই দেখি সিরাজ শিকদার নিহত। সরকারি এক প্রেসনােটে বলা হয়, সিরাজ শিকদার মানিকগঞ্জের দিকে তার এক ‘হাইড আউট’ দেখিয়ে দেবেন, সেই কারণে পুলিশ তাকে নিয়ে সেদিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু পথে সাভারের কাছে তিনি পালাতে চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। বিষয়টা নিয়ে আমার একটু খটকা লাগে। কারণ, আমি ভেবেছিলাম, বিভিন্ন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
তার মৃত্যু নিয়ে তখন বিভিন্ন পত্রিকায় সত্য-মিথ আলােচনা-সমালােচনা শুরু হয়। অনেকে হত্যার সঙ্গে রক্ষীবাহিনীকে জড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ ব্যাপারে রক্ষীবাহিনীর বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
ওই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর ই এ চৌধুরীর কাছ থেকে আমি সিরাজ শিকদারের গ্রেপ্তারের কাহিনি জানতে পারি। আসলে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কিছুটা নারীঘটিত কারণে সিরাজ শিকদার ধরা পড়েন। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন রবিন নামের একজন প্রকৌশলী। তার আসল নাম জানা হয়নি। তার একজন প্রেমিকা ছিল। সিরাজ শিকদারের দুজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার দৃষ্টি পড়ে রবিনের ওই প্রেমিকার ওপর। এ নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে মনােমালিন্য হয়। তারা তখন সিলেটে ছিলেন। এরপর তারা দুজন সিলেট থেকে আলাদাভাবে চট্টগ্রামে রওনা হন। কিন্তু রবিন সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পথে ঢাকায় আসেন এবং তার এক বিশ্বস্ত বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। রবিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সাদা পােশাকে কুমিল্লা থেকেই সিরাজ শিকদার ও তার কুরিয়ারকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা তার হদিস পায়নি। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ গােয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা সিরাজ শিকদার ও তার কুরিয়ারকে সন্দেহ করে। সিরাজ শিকদার স্টেশন থেকে একটা স্কুটার নিলে সাদা পােশাকের পুলিশ কর্মকর্তারা তার পিছু নেয় এবং একপর্যায়ে তাকে সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে গ্রেপ্তার করে। তখনাে কিন্তু পুলিশ নিশ্চিত ছিল না যে, তারা সত্যিই সিরাজ শিকদারকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে রবিনই নিশ্চিত করেন, পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে, তিনি-ই সিরাজ শিকদার। সিরাজ শিকদারের সিলেট থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সঠিক তথ্য দেওয়ায় সরকার কয়েক দিন পর পুরস্কারস্বরূপ রবিনকে তার স্ত্রী বা প্রেমিকাসহ কানাডায় পাঠিয়ে দেয়।
এদিকে সিরাজ শিকদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর, খবর পেয়ে বাংলাদেশে গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে তৎপর হয়ে ওঠে। হােয়াইট হলে সিরাজ শিকদারকে রাখা নিরাপদ হবে না-এই মর্মে গােয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারের কাছে তথ্য সরবরাহ করে। কারণ দেখায়, যেকোনাে সময় সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র ক্যাডাররা হােয়াইট হল থেকে সিরাজ শিকদারকে ছিনিয়ে নিতে পারে । আর না হলে সর্বহারারা ভারতীয় হাইকমিশনার অথবা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা চালাতে পারে। এই তথ্যগুলাে কতটুকু সত্য ছিল, কেউ পরখ করে দেখেছে কি না, জানা নেই। ঠিক এ কারণেই সে রাতে সিরাজ শিকদারকে রক্ষীবাহিনীর অফিসার্স মেসে নিয়ে আসা হয় এবং ভারতীয় হাইকমিশনার ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
১৯৭৫ সালের পরও সিরাজ শিকদারের হত্যার প্রসঙ্গ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক কিছু লেখা হয়েছে। এর কিছুটা ছিল আংশিক সত্য বা অর্ধসত্য। বাকিটা ছিল মিথ্যা ও কল্পনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সরকারি বাবস্থাপনায় পরিচালিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ব্যাপক সমালােচনা করে। বিচিত্রার ১৯৭৮ সালের ১৯ মে-র সংখ্যায় সিরাজ শিকদারের গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয়। শিরােনাম ছিল ‘সিরাজ শিকদার হত্যার নেপথ্য কাহিনী’। বিচিত্রা ছিল রক্ষীবাহিনীর কঠোর সমালােচক। ওই প্রতিবেদন পড়লেই বােঝা যাবে, রবািহিনী এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।
আরও কিছু অভিযোেগ
রক্ষীবাহিনীতে কর্মরত থাকার সুবাদে এই বাহিনীর অপারেশন-সংক্রান্ত সব ঘটনাই যে আমার জানা ছিল, এমন নয়। কিছু ঘটনা হয়তাে আমার জানা। অনেক ঘটনা আমি নিজেও জানি না। আবার জানা অনেক ঘটনা এত দিনে আমি ভুলে গেছি। উল্লেখযােগ্য কিছু ঘটনা হয়তো আমার মনে আছে। এ জন্য রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে লেখার আগে আমি কয়েক দিন গণগ্রন্থাগারে গিয়ে ১৯৭২-৭৫ সালের পত্রপত্রিকা দেখি। পুরােনাে পত্র পত্রিকা দেখার সময় রক্ষীবাহিনীর অপারেশন-সংক্রান্ত কিছু ঘটনা আমার নজরে পড়ে। এসব ঘটনার বেশির ভাগ সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম না। কয়েকটি সম্পর্কে হয়তো অবহিত ছিলাম, কিন্তু সেগুলাে তেমন উল্লেখযােগ্য নয়। পুরােনাে পত্রিকা দেখার সময় একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা আমার নজর পড়ে। তখন আমি প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাইরে ছিলাম । দেশে ফিরেও এ সম্পর্কে কিছু শুনিনি।
ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এ সময় শরীয়তপুরের বামপন্থী নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী অরুণা সেন রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হন। এ নিয়ে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। বেশ সমালােচনাও হয় পত্রপত্রিকায়। এ ছাড়া চীনপন্থী বাম দলের মুখপত্র সংস্কৃতি (প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, মে-জুন ১৯৭৪) পত্রিকায় অরুণা সেনের একটি বিবৃতিও ছাপা হয়। পুরােনাে পত্রিকা দেখার সময় সংস্কৃতি পত্রিকার ওই সংখ্যাও আমার নজরে পড়ে। তার বিবৃতিটি আমি পড়ি। ড. মুহম্মন্দ জাফর ইকবালের লেখা পড়ে আমার যেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়। এ কারণেই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম। পরে ওই ঘটনার বিষয়ে আমি জানার চেষ্টা করি। কিন্তু এত বছর পর প্রকৃত ঘটনা আমি বিস্তারিত জানতে পারিনি।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললেই নয়। ১৯৭২-৭৫ সালে রাজনৈতিক মহলে, বিশেষত চীনপন্থী চরম বাম দলগুলাে রক্ষীবাহিনীর সমালােচনায় সবচেয়ে মুখর ছিল । তারা তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার অভিযানে অভ্যস্ত ছিল । একবার শুনেছিলাম, নরসিংদী জেলার জনৈক মজিবুর রহমানকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ১৯৭৪ সালে গ্রপ্তার করেছিল। পরে তিনি মুক্তি পান। এ ঘটনা নিয়ে তখন চীনপন্থী রাজনৈতিক দল মিথ্যা ও অর্ধসত্য মিলিয়ে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযােগ তােলে। বেশ কয়েক বছর আগে তদানীন্তন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এমদার আকবর খান রনাে (বর্তমানে দল পরিবর্তন করে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টিতে আছেন) একটি লেখায় পুনরায় ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে প্রকারান্তরে রক্ষীবাহিনীর ওপর এর দায় চাপানাের চেষ্টা করেছেন। এ রকম আরও কিছু ঘটনা আছে, যা আমার সব জানা নেই। যা-ও জেনেছি, এত বছর পর সব আমার মনে থাকার কথা নয়। আর এখন জানার পর প্রকৃত তথ্য আমার পক্ষে উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়।
এসব ঘটনা কিছুটা সত্য, অর্ধসত্য বা আংশিক সত্য। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা ছিলেন তখন নবীন। এ কারণে এবং পেশাগত অভিজ্ঞতার অভাবে কয়েকজন লিডার, ডেপুটি লিভার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট লিডার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে অপারেশন করেন। এ রকম কয়েকটি ঘটনার পর পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান সতর্ক হন। সরকারদলীয় স্থানীয় নেতারা যাতে রক্ষীবাহিনীর সদস্য, বিশেষত নেতৃত্ব পর্যায়ে কাউকে প্রভাবিত করতে না পারেন, সে ব্যাপারে তিনি সজাগ থাকতেন। এ ব্যাপারে লিডারদের কঠোর নির্দেশ দিতেন তিনি। এর ফলে রক্ষীবাহিনীর জেলা ও মহকুমা পর্যায়ের কমান্ডাররা দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালনে সাহস সঞ্চয় করেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দায়িত্ব পালন এবং অপরাধীদের ওপর নির্যাতন করার জন্য কয়েকজন লিভার, ডেপুটি লিডার, আসিস্ট্যান্ট লিডারসহ রক্ষীবাহিনীর অনেক সদস্যকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়। অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং অনেককে কারাগারে পাঠানাে হয়। এর ফলে ১৯৭৪ সালের প্রথমার্ধ থেকেই রক্ষীবাহিনী একটি সুশৃঙখল বাহিনীতে পরিণত হয় এবং রক্ষী সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনেক উপযােগী হয়ে ওঠেন।
প্রকৃতপক্ষে রক্ষীবাহিনীতে আমার মুখ্য দায়িত্ব ছিল বাহিনীর সব স্তরের সদসাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখা। ফলে সাপ্তাহিক হলিডে, সাপ্তাহিক হক কথা, দৈনিক গণকণ্ঠ সহ কয়েকটি পত্রপত্রিকায় রক্ষীবাহিনীর বিভিন্ন অপারেশনের এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার বিষয়ে যেসব সত্য-মিথ্যা কাহিনি ছাপা হয়েছে, তার সব বিবরণ আমার জানা হয়নি। সে জন্য সেগুলাের সত্যিকার বিবরণ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
রক্ষীবাহিনী পরিচালিত অপারেশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যেসব অভিযােগ উঠেছিল, সেগুলােকে কেন্দ্র করে তখন অনেক মামলাও হয়েছিল। এসব মামলাসহ রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে আনা অভিযােগের আইনি দিকটা দেখতেন আমাদের উপপরিচালক (প্রশাসন) আবুল হাসান খান। তিনি খুব অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে তিনি পরলােকে। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এস এম নূরুজ্জামানও মারা গেছেন। ফলে রক্ষীবাহিনীর অনেক তথ্যই অজানা থেকে গেল।
বিরাগভাজন হওয়ার কয়েকটি ঘটনা
কোনাে বাহিনীর হয়ে দেশে আইনশৃংখলা ও শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে ওই বাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেক সময় সরকারি দলের নেতা, কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরাগভাজন হতে হয়। এ বিষয়ে অবশ্যই পুলিশ বাহিনীর অভিজ্ঞতা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের চেয়ে বেশি। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর একজন উপপরিচালক হিসেবে আমি নিজেও কয়েকজন জনপ্রতিনিধির বিরাগভাজন হয়েছিলাম।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর কাজে যােগ দিয়ে আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে থাকি। কিছুদিন পর, একদিন সন্ধ্যায় আমি অফিসে কাজ করছি। আমাদের বাহিনীর পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান আমাকে ডেকে পাঠান। তার কাছে যাওয়ার পর তিনি আমাকে দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি সাঙ্গে সঙ্গে শেরে বাংলা নগরের নতুন গণভবনে যাই। গণভবন ও আমাদের সদর দপ্তরের মধ্যে তেমন দূরত্ব ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি গণভবনে পৌছাই । প্রধানমন্ত্রীর সচিবের কাছে যাওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে আমার উপস্থিতির কথা জানান। বঙ্গবন্ধু সচিবের মাধ্যমে আমাকে তার কক্ষে যেতে বলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসকক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সােফায় বশে আছেন।৪
বঙ্গবন্ধুর চেহারা দেখে আমার মনে হলাে, তিনি খুব রাগান্বিত। এতে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ভাবলাম, আমি কি কোনাে ভুল করে ফেলেছি? আমি বঙ্গবন্ধুর সামনে যেতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘শােন, চৌধুরী সাহেবের পৈতৃক বাড়ি লতিফ দখল করেছে। এই বাড়ি আজ রাতের মধ্যেই খালি করতে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা বুঝে গেলাম। এ লতিফ টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানা থেকে নির্বাচিত সাংসদ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী৫। একই থানার নাগবাড়ী গ্রামে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিশাল পৈতৃক বাড়ি। লতিফ সিদ্দিকী এই বাড়ি দখল করেছেন। আমি কোনাে কিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বললাম, খালি হয়ে যাবে, স্যার’।’ এরপর বঙ্গবন্ধু আমাকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে সব জেনে কাজ করতে বললেন। নির্দেশ দিলেন বাড়ি খালি করে পরদিন সকালে যেন তাকে রিপাের্ট করি। তারপর আমাকে সাবেক রাষ্ট্রপতির কাছে রেখে বঙ্গবন্ধু পাশের ঘরে গেলেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এমনিতেই খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং গম্ভীর মানুষ ছিলেন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। এ সুবাদে তিনি আমাকে ভালাে করেই চিনতেন। তখন থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যখন তাকে রাষ্ট্রপতি করবেন বলে মনস্থ করেন, তখন আমাকেই তার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
একান্ত ব্যাক্তিগত এবং প্রাসঙ্গিক না হলেও উল্লেখযােগ্য বলে ঘটনাটির অবতারণা করছি। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ রাতে আমরা কয়েকজন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টা। ভেতরে প্রবেশ করেই জানতে পারলাম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ উর্ধ্বতন নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দোতলায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করছেন। আমরা নিচতলায় বসতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি, বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন। আমরা উঠে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুসহ তাদের সবাইকে সালাম দিলাম। বঙ্গবন্ধু নেতাদের বিদায় দিয়ে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। মনে হলাে, আমাদের পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। আমাদের কাছে নানা বিষয়ে জানতে চাইলেন। তবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মনে হলো, তিনি বেশ ক্লান্ত। তাই বেশিক্ষণ কথা না বলে আমি তাকে বললাম, ‘আপনাকে শুধু দেখতে এসেছি।’ এ কথা বলে সবাই বিদায় নিচ্ছি, বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বললেন, ‘তাের ভিসিকে তাড়াতাড়ি এ খানে নিয়ে আয়।’
উল্লেখ্য, আবু সাঈদ চৌধুরী ৭ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরেন। সেদিন আমি তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমার কাছে টাঙ্গাইলের খবর জানতে চান। আমি সংক্ষেপে কিছু ঘটনা জানাই।
১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে বেরিয়ে আমার সহযােদ্ধা নূরুন্নবী ছাড়া সবাই টাঙ্গাইলে রওনা হলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাতেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাসায় হাজির হলাম। সঙ্গে নূরুন্নবী। তাঁর বাসায় গিয়ে জানতে পারি, তিনি শহীদ মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী ও সন্তানদের সমবেদনা জানাতে তার বাসায় গেছেন। কখন ফিরবেন, ঠিক নেই। এ অবস্থায় আমি শহীদ মুনীর চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তার বাসা ছিল ভূতের গলিতে। এটা অবশ্য আমি জানতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে আমি ওই বাসায় যাই। সেখানে আমি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। বিনীতভাবে তাকে জানাই, বঙ্গবন্ধু আমাকে পাঠিয়েছেন। আমরা আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। না পেয়ে এখানে এসেছি। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা এসেছি। এরপর তিনি মুনীর চৌধুরীর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে রওনা হন।
আমরা যখন সেখানে পৌছাই, তখন রাত প্রায় ১১টা। বঙ্গবন্ধু সবে রাতের খাবার সেরে উঠেছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু তাকে সঙ্গে নিয়ে তার শয়নকক্ষে যান। নুরুন্নবী আর আমি নিচে অপেক্ষা করতে থাকি। একটু পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিচে নেমে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তখন কারণ বুঝতে পারিনি। পরদিন রেডিওতে খবর শুনে কারণটা বুঝতে পারি। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন।
যা হােক, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বাড়ি দখলের বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে একটু বিব্রত বােধ করছিলেন। তা করারই কথা। কারণ, কোনাে দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ি বেদখল হওয়ার ঘটনা একটা অচিন্তনীয় বিষয়। আমি নিজেও বেশ লজ্জা বােধ করছিলাম। আমি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে সব শুনে তাকে আশ্বাস দিলাম যে রাতের মধ্যেই তার বাড়ি খালি হয়ে যাবে। এরপর আমি অফিসে ফিরে আনি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বাসভবনে ফিরে যান। এখানে উল্লেখযােগা যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আবু সাঈদ চৌধুরীর পৈতৃক বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তার পারিবারিক বিষয়সম্পত্তি দেখাশােনার জন্য সামসুদ্দিন (মুচু মিয়া) নামের একজন ম্যানেজার হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, সাবেক রাষ্ট্রপতির পৈতৃক বাড়ি দখলদার সাংসদদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাই আমি কৌশল ঠিক করলাম, উদ্ধার অভিযানটা পরিচালনা করতে হবে সুজাপথে। টাঙ্গাইল জেলায় কোনাে দিন কোনাে অভিযানে রক্ষীবাহিনী পাঠানাে হয়নি। আশপাশে রক্ষীবাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না। কাছাকাছি ময়মনসিংহে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেখানে বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন লিডার সরােয়ার হােসেন। তাঁর বাড়ি ছিল কালিহাতী থানার পাশেই বাসাইল থানায়। মুক্তিযুদ্ধকালে সরােয়ার কালিহাতী এলাকায় যুদ্ধ করেন। ফোন করে তাকে নির্দেশ দিলাম দুই ট্রাক রক্ষী সদস্য প্রস্তুত করে রাত একটার মধ্যে নাগবাড়ী পৌছাতে এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ি ঘেরাও করে ভেতরে যাকেই পাওয়া যাবে তাদের সবাইকে ট্রাকে উঠিয়ে সরাসরি ময়মনসিংহে নিয়ে যেতে। আরও নির্দেশ দিলাম গভীর রাতে অপারেশন করার জন্য। গ্রামের লােকজন যাতে এ অপারেশনের বিষয়ে জানতে না পারে, তার জন্য নীরবে কাজ করতে হবে। কোনো গুলি করা যাবে না। তারপর ময়মনসিংহে ফিরে সকালেই আমাকে জানাতে হবে।
যে রকম নির্দেশ, সে রকম কাজ। সকাল ছয়টার দিকে ময়মনসিংহে ফিরে লিডার সরােয়ার হােসেন আমাকে ফোন করে জানালেন, অপারেশন সফল। তারা নাগবাড়ীতে গিয়ে দেখেন গ্রামটি নীরব, নিস্তব্ধ । লােকজন সবাই ঘুমে, এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ি যারা দখল করে আছে, তারাও ঘুমে। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে তাদের সবাইকে যত দূর মনে পড়ে ১৫-১৬ জন ধরে কোনাে হট্টগােল ছাড়াই রক্ষী সদস্যরা ফিরে আসেন। আমি সরােয়ারকে দুপুরের আগেই একটা রিপাের্ট লিখে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার জন্য বলি।
এরপর অফিসে গিয়েই আমি সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ফোন করে জানাই, তার বাড়ি খালি হয়ে গেছে। সেখানে তার লােকজন যেতে পারে। তারপর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে রিপাের্ট করতে গণভবনে যাই। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি দখলমুক্ত হয়েছে জেনে তিনি খুব খুশি হন এবং নিজেই তাকে ফোন করেন।
এদিকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সকালেই খবর পেয়ে যান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি থেকে তার লোকজনকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে গেছে। এ খবর পেয়ে লতিফ সিদ্দিকী এদিক-সেদিক খোঁজ নিতে থাকেন, কিন্তু কোনাে খবর পান না। কারণ, টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) বা কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেউই বিষয়টি জানতেন না। দু-তিন দিন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ না পেয়ে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলীর সঙ্গে দেখা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে জানান, তিনিও এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে তাঁর কাছ থেকেই হয়তাে লতিফ সিদ্দিকী খবর পান, বিষয়টা আমি জানি।
দু-তিন দিন পর একদিন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আমার বাসায় আসেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। আমি তাকে বলি যে ব্যাপারটা ঘটেছে অনেক উচু পর্যায়ের সিদ্ধান্তে। এর বেশি আমি জানি না। এটা জানতে হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হবে। আমার কাছে সদুত্তর না পেয়ে লতিফ সিদ্দিকী অত্যন্ত রাগান্বিত হন। তারপর চলে যান আমার বাসা থেকে। আর কোনাে দিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সম্পত্তির ধারেকাছে যাননি তিনি।
আরেকটি ঘটনা। একবার বরিশাল থেকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে খবর এল, শহরের তিন-চার মাইল দূরে কোনাে এক গ্রামে নামটা আমার মনে নেই। শুধু ঘটনাটা মনে আছে সন্ত্রাসীরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা রেখেছে। আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান তথ্যটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাকে ওই অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালাতে বরিশালে পাঠান। আমি লঞ্চযােগে বরিশালে গিয়ে সার্কিট হাউসে উঠি। বরিশালে আগে থেকেই রক্ষীবাহিনীর এক কোম্পানি রক্ষী সদস্য ছিল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন লিডার আলমগীর হাওলাদার। তাকে ও ডেপুটি লিডারদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, তাদের কাছে এমন কোনাে তথ্য নেই যে ওই গ্রামের কোথাও অস্ত্র জমা আছে। আমার একটু খটকা লাগল। ভাবলাম, পরিচালক তাহলে কোথা থেকে তথ্যটা পেলেন। যা হােক, আমি লিডারকে দুই প্লাটুন রক্ষী তৈরি রাখতে বলি। কারণ, যেকোনাে সময় অপারেশনে যেতে হতে পারে।
সন্ধ্যার পর আমির হােসেন আমু ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ (বর্তমানে তারা দুজনই আওয়ামী লীগের নেতা) আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাদের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন। তাকে আমি চিনতাম না। তারা দুজন তাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ক্যাপ্টেন বেগ৬ নামে। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, ওই গ্রামে অস্ত্রশস্ত্র জমা থাকার বিষয়টি তারাই আমাদের পরিচালককে দিয়েছেন। কোথা থেকে তথ্য পেয়েছেন, সে সম্পর্কে আমার প্রশ্নের জবাব তারা ঠিকমতাে দিতে পারলেন না। কিন্তু তারা নিশ্চিত ছিলেন, ওই গ্রামে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা আছে। পরিচালকের নির্দেশ, তাই আমি ঠিক করলাম, দুই প্লাটুন রক্ষী নিয়ে রাত দুইটা আমি অপারেশনে যাব। সঙ্গে থাকবেন লিডার আলমগীর হাওলাদার। ঠিক হলাে, গ্রামের যে বাড়িতে অস্ত্র আছে, সেই বাড়ি চিনিয়ে দিতে ক্যাপ্টেন বেগ আমার সঙ্গে যাবেন।
যথাসময়ে গ্রামে গিয়ে চিনিয়ে দেওয়া বাড়িটি আমরা ঘেরাও করি। চারদিকে পাহারা লাগিয়ে তল্লাশি শুরু হলো। বাড়ির প্রতিটি ঘর তল্লাশি করে কোনাে কিছু পাওয়া গেল না তখন বেগ বলে উঠলেন, বাড়ির পুকুরে পাওয়া যেতে পারে। ইতিমধ্যে গ্রামের কয়েকজন মুরব্বি এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা নামাজের জন্য উঠে হইচই শুনে দেখতে এসেছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, যাদের বাড়ি আমরা তল্লাশি করছি, তারা একেবারে নিরীহ লােক। সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে তাদের কোনাে সম্পর্ক নেই। আরও জানতে পারলাম, জমিজমা-সংক্রান্ত বিরােধ বা অন্য কোনাে কারণে হয়তো তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযােগ তােলা হয়েছে।
এদিকে বেগকে আমার কেন যেন সন্দেহ হতে লাগল। লিডার আলমগীর হাওলাদারও তাকে পছন্দ করলেন না। কারণ, তিনি তল্লাশি অভিযানে অতি উৎসাহী ছিলেন। আমি যখন কয়েকজন রক্ষীকে পুকুরে নেমে তল্লাশি করতে বলি, পারলে তিনি নিজেই তখন পুকুরে নামেন। অনেকক্ষণ তল্লাশি করে যখন কিছুই পাওয়া গেল না, তখন বাড়ির একটা ছেলেকে ধরে বেগ নির্যাতন শুরু করেন। এ সময় আমি অপারেশন বন্ধ করার নির্দেশ দিলাম। একপর্যায়ে বেগকে ধমক দিয়ে বললাম, অপারেশনে এসেছি আমরা, সে কেন ছেলেটাকে নির্যাতন করছে। ছেলেটাকে বেগের কাছ থেকে উদ্ধার করে ছেড়ে দিয়ে আমরা ফিরে আসি। বুঝতে আমার একটুও সময় লাগল না যে, রক্ষীবাহিনীর অল্পবয়সী সদস্যদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় অসৎ নেতারা গ্রামের মানুষের মধ্যকার বিবাদ থেকে ফায়দা লুটতে চায়। এতে দুর্নাম হয় রক্ষীবাহিনীর।
সকালে পরিচালককে ফোনে জানাই, আমি নিজে অপারেশনে গিয়ে দেখেছি যে অস্ত্র মজুত থাকার খবর সত্য নয়। সম্ভবত গ্রামের শত্রুতার জের ধরে এক পক্ষের সমর্থনে অস্ত্র মজুতের বিষয়টি এসেছে। আমি বেগের বিষয়টিও তাকে জানাই এবং অভিযােগ করি কীভাবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা আর্থিক ফায়দা নিতে রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করছেন। এরপর বরিশালের স্থানীয় প্রশাসনের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বেগ ও তার প্রশ্রয়দাতা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অত্যাচারে বরিশালের জনগণ, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের অনেকে অতিষ্ট।
বিকেলবেলা আমি বরিশালে নিয়ােজিত রক্ষী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। রাতের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের কথায় বা তথ্যের ভিত্তিতে কোনাে অপারেশনে না যাওয়ার জন্য আমি তাদের কড়া নির্দেশ দিই, তাদের আরও বলি, তারা কেবল জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতেই অপারেশনে যাবেন। ঢাকায় ফিরে পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানকে আমি বিস্তারিত রিপাের্ট প্রদান করি । এরপর তিনি প্রতিটি জেলায় নির্দেশ পাঠান যে প্রশাসনের সঠিক তথ্যের ভিত্তিতেই শুধু রক্ষীবাহিনী অভিযান পরিচালনা করাবে, এর অন্যথা হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাতীয় রক্ষীবাহিনীর লিডার, উপলিডার, সহকারী লিডারসহ রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যের বয়স ছিল ২৫ বছরের নিচে। সে জন্য পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান সব সময়ই উদ্বিগ্ন থাকতেন। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে সহায়তা করার জন্য রক্ষীবাহিনী মােতায়েন করা হয়েছিল। যথাযথ যােগাযােগ মাধ্যমের অভাবে সবার সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হতাে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টেলিফোনে নির্দেশ দেওয়া হতাে। পরিচালক প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বিভিন্ন স্থানে নিয়ােজিত লিডার ও ডেপুটি লিডারদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং আদেশ-উপদেশ দিতেন।
আমার বরিশাল সফরের কয়েক দিন পর পরিচালক কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেন, ‘তুমি কী করে এসেছ, বরিশালের নেতারা তােমার ওপর খেপে আছেন।’ উত্তরে আমি বললাম, “স্যার, চিন্তা করবেন না। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বলার সাহস ওদের হবে না। এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় না লিখে পারছি না। এ কথায় নতুন করে আবার বিরাগভাজন হব, তার পরও লিখছি। বরিশালের সাধারণ মানুষের ওপর, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর কী পরিমাণ নির্যাতন হয়েছিল তা বােঝা গিয়েছিল যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয় সেদিন। সারা বাংলাদেশের মানুষ সেদিন শােকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল, অনেকে ঘটনাটা বিশ্বাসই করতে পারেনি। দেশটা ছিল নীরব, নিথর, স্তব্ধবাক। কিন্তু বরিশাল শহরে কয়েক হাজার লােকের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ মিছিল বের হয়েছিল। তবে সেটা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বলে নয়, তাঁরা আনন্দ মিছিল বের করেছিলেন বরিশালের নির্যাতনকারীদের হাত থেকে তারা রক্ষা পেয়েছেন ভেবে।
রক্ষীবাহিনীর লিডাররা ছিলেন নবীন, এ কারণে এবং পেশাগত অভিজ্ঞতার অভাবে তাদের কয়েকজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে অপারেশন করেন। এ রকম কয়েকটি ঘটনার পর পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান সতর্ক হন। তিনি সজাগ থাকতেন, সরকারদলীয় স্থানীয় নেতারা যাতে রক্ষীবাহিনীর অভিযানে হস্তক্ষেপ বা প্রভাবিত করতে না পারেন। তিনি এ ব্যাপারে লিডারদের কঠোর নির্দেশ দিতেন। এর ফলে রক্ষীবাহিনীর জেলা ও মহকুমা পর্যায়ের কমান্ডাররা দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালনের সাহস সঞ্চয় করেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দায়িত্ব পালন করার জন্য এবং অপরাধীদের ওপর নির্যাতন করার জন্য কয়েকজন লিডার, ডেপুটি লিডার, সহকারী লিডারসহ রক্ষীবাহিনীর অনেক সদস্যকে বিচারের মুখােমুখি হতে হয়। অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং অনেককে পাঠানাে হয় কারাগারে।
অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ কাজে লিপ্ত স্থানীয় নেতা, এমনকি সাংসদদের গ্রেপ্তার করতেও রক্ষীবাহিনী দ্বিধা করেনি। নওগাঁ ও নাটোর এলাকায় অপারেশন চালাতে গিয়ে লিডার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে রক্ষী সদস্যরা সাংসদ মাে. জাহাঙ্গীর আলমকে গাঁজা পাচারকালে এবং সাংসদ আশরাফ হােসেনকে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। ফলে সরকারের একটি অংশেও রক্ষীবাহিনী-বিরােধী প্রচারণা শুরু হয়।
তােফায়েল আহমেদ প্রসঙ্গ
স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন ছাত্রনেতাদের মধ্যে তােফায়েল আহমেদকে তাঁর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে বেছে নেন। এর মুখ্য কারণ, ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে তােফায়েল আহমেদ অসাধারণ সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তা ছাড়া যুবসমাজের মধ্য থেকে দেশ পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে জন্য ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রায় প্রত্যেক জেলা থেকে ছাত্র ও যুবসমাজের অনেককে মনােনয়ন দেন। তাঁরা কেউ কেউ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ও কেউ কেউ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। শুধু তােফায়েল আহমেদ নন, যুবসমাজের মধ্য থেকে অনেককেই বঙ্গবন্ধু প্রতিমন্ত্রী ও সমতুল্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব রুহুল কুদুস রক্ষীবাহিনী-সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁকে সাচিবিক সহায়তা করতেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব মনােয়ারুল ইসলাম। অফিসের কাজে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যেতে হলে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান সব সময়ই যুগ্ম সচিব মনােয়ারুল ইসলামের কামরায় অথবা তার সহপাঠী নুরুল ইসলাম অনুর কামরায় যেতেন। নুরুল ইসলাম অনু ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব। সরােয়ার ও আমি একসঙ্গে বা আলাদাভাবে কোনাে কাজে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে গেলে সাধারণত তাদের কাছেই যেতাম। কিন্তু জাতীয় রক্ষীবাহিনী-সম্পর্কিত কোনাে নথি বা ফাইল প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব৭ তােফায়েল আহমেদের কাছে যেতে দেখিনি। কোনাে দিন কোনাে নথি বা ফাইলে তার স্বাক্ষর দেখিনি।
আসলে তােফায়েল আহমেদের অসাধারণ জনপ্রিয়তা এবং প্রধানমন্ত্রীর নৈকট্য ক্ষমতাসীন অনেকের কাছেই ঈর্ষার কারণ ছিল। সে কারণে এই সময় অনেকে তােফায়েল আহমেদের জনপ্রিয়তায় ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কে ফাটল ধরাতে সচেষ্ট ছিলেন। তখন নানা ধরনের গুজব ছড়ানাে হতো। এমন গুজবও ছড়ানাে হয় যে তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। এটা একেবারেই মিথ্যা। তবে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে সরকারের সব দায়িত্বের দায়ভার মন্ত্রিসভার ছােট-বড় সব সদস্যের মতো তোফায়েল আহমেদেরও ছিল। এ জন্য রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা দেখানাের সুযােগ নেই।
তবে একবার তিনি রক্ষীবাহিনীর কার্যালয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর দেশের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ত্যাগ করে আত্মগোপন করেন; সরকারকে সংগঠিত করে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের উদ্যোগ বার্থ হয়— এ রকম এক কঠিন মুহূর্তে আমরা শুধু তোফায়েল আহমেদকে কাছে পেয়েছিলাম যিনি আত্মগােপন না করে বা পালিয়ে না গিয়ে স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে এসেছিলেন। তিনি এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এ ঘটনা থেকেই অনেকে ধারণা করেন, তােফায়েল আহমেদ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্তে দেশের সর্বোচ্চ পদে যারা ছিলেন, তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। ব্যতিক্রম ছিলেন তােফায়েল আহমেদ।
.
রক্ষীবাহিনীতে প্রথম দুই ব্যাচের কর্মকর্তাদের অবদান
জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে একটা সফল ও কার্যকর বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধান কার্যালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও মাঠপর্যায়ে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে অত্যন্ত সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। রক্ষীবাহিনীর প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের কর্মকর্তা অর্থাৎ লিডারদের অবদান ছিল উল্লেখ করার মতাে। লিডার মােজাফফর হােসেন খুলনা ও বরিশাল এলাকায়; লুৎফর রহমান রাজশাহী, বিশেষ করে নওগাঁ ও নাটোর এলাকায়; আকরাম হােষেন চট্টগ্রাম এলাকায়; তায়েব উদ্দিন খান পাবনা এলাকায় রাখালচন্দ্র সাহা রংপুর এলাকায়; আলমগীর হাওলাদার বরিশাল ও সিলেট এলাকায়; শেখ দলিল উদ্দিন চট্টগ্রাম ও ঢাকা এলাকায়; আখতারুজ্জামান ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায়; সর্দার মিজানুর রহমান যশাের ও কুষ্টিয়া এলাকায়; শরীফ ওয়ালিউর রহমান পাবনা ও বরিশাল এলাকায়; সৈয়দ রফিকুল ইসলাম (বীর প্রতীক) চট্টগ্রামের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, উখিয়া এলাকায়; গাজী বেলায়েত হােসেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এলাকায় এবং নুরুল হক তালুকদার বগুড়া, চট্টগ্রাম ও রংপুর এলাকায় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের কার্যদক্ষতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, বিশেষ করে কর্নেল শাফায়াত জামিল ও কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা। এ ছাড়া রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে লিডার আবদুর রাজ্জাক, আলাউদ্দিন, লিয়াকত আলী, সাখাওয়াত হােসেন, আনােয়ারুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, সৈয়দ মনজুরুল আলম, আইনুল কামাল আবদুল হাকিম তালুকদার, এ টি এম এ হালিমসহ অন্য লিডাররা দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের পেশাগত কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। লিডার আশরাফুল হাফিজ খান ও ফারুক হােসেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেন । লিডার হাবিবুর রহমান একবার আরিচা ফেরিঘাটে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান, যদিও তার ডেপুটি লিডার গুলজার হােসেন ও অন্য দুই রক্ষী সদস্য শহীদ হন।
ভুট্টোর সফর ও পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী কিছু বাঙালির কাণ্ড
১৯৭৪ সালের ২৭ জুন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো দুই দিনের সফরে ঢাকা সফরে আসেন। এর আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যােগ দিতে লাহাের সফর করেন। বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলনে যােগ দিতে প্রথমে রাজি ছিলেন না। কারণ, পাকিস্তান তখনাে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। এ সময় কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ সাবাহ আল আহমদ আল জারের নেতৃত্বে ইসলামি সম্মেলন সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) সাতটি দেশের এক যৌথ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। সম্মেলনে যােগদানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে রাজি করাতে তারা বাংলাদেশে আসেন। অনেক আলাপ-আলােচনার পর বঙ্গবন্ধু লাহাের যান। বঙ্গবন্ধু যেদিন পাকিস্তান যান সেদিন এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। বিমানবন্দরে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় লাহাের বিমানবন্দর, আশপাশের এলাকা ও রাস্তার দুপাশে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভ্যর্থনা জানাতে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু নিজেও বুঝতে পারেননি তাকে লাহােরের জনগণ এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানাবে। এ রকম ঘটনা ঘটবে ভুট্টোও ধারণা করেননি। এ ছাড়া পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থাগুলােও বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে সেদিন এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন ভুট্টো।
এর কিছুদিন পর জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফর করেন। চতুর ভুট্টো এ সময় সম্ভবত ওই ঘটনার প্রতিশােধ নেন। তার সফরের সময় ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা ও তাকে যে পথ দিয়ে হােটেলে নেওয়া হবে সে পথে যাতে লাহােরের মতাে লােকসমাগম হয়, তার জন্য তিনি গােপনে ব্যবস্থা নেন। পরে ঘটনাটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশ সফরের আগেই ভুট্টো একটা অগ্রগামী দল ঢাকায় পাঠান। বঙ্গবন্ধু সরকার সরল মনেই পাকিস্তানের অগ্রগামী দলকে বাংলাদেশ সফরের অনুমতি দেয়। ওই দলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রতিনিধিসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী ছিলেন। সফর ব্যবস্থাপনা ছাড়াও ওই দল যে তথাকথিত পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন বাঙালিদের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ করে ভুট্টোর সংবর্ধনার জন্য জনসমাগম করার ব্যবস্থা করেছিল, পরে সেটা বােঝা গিয়েছিল। দেখা গেল, ভুট্টোর আগমনের দিন তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল১০ পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে দল বেঁধে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র এবং পাকিস্তানি ভাবধারার একশ্রেণীর বাঙালি দাড়িয়ে আছে। ভুট্টোর গাড়িবহর যখন তাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা ‘ভুট্টো জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেয়। একজন মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে আমার এবং প্রতিটি দেশপ্রেমিকের জন্য এই দৃশ্য দেখা মােটেই সুখকর ছিল না; বরং বলা যেতে পারে, লজ্জাজনকই ছিল। আর এটা যে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, সেটাও আমরা অনেকে বুঝতে পারি।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর সফরের প্রথম কর্মসূচিতে ছিল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন বাঙালিদের সংবর্ধনায় ভুট্টো বেঁকে বসেন এবং জানান যে, তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাবেন না। তার এবং সফরসঙ্গীদের ভাবখানা এমন যে বাংলাদেশের অনেক বাঙালিই অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করে। তাহলে বাংলাদেশের জন্য যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতির প্রতি তিনি সম্মান জানাবেন কেন? এ ঘটনা এখনকার প্রজন্ম দূরের কথা, আমাদের বয়সী যারা বেঁচে আছেন, তাদের অনেকে জানেন না। আমিও সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারিনি, পরে জেনেছি। বিষয়টি জানতে পেরে বঙ্গবন্ধু হন অত্যন্ত দৃঢ় একটা অবস্থান নেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন ভুট্টো সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা না জানালে তাকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে হবে এবং দুই দেশের মধ্যে কোনাে সরকারি আলােচনা হবে না।
ঢাকায় যখন ভুট্টোর সফরসঙ্গী দলের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের আলােচনা হচ্ছে, তখন আমি সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যস্ত। এ সময় দেখি, বেশ কিছু লােক দল বেঁধে সেখানে আসছে। অথচ স্মৃতিসৌধ কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের কোনাে সুযােগ ছিল না। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা এম এম মজুমদার ও আবদুস সালামের সঙ্গে আলােচনা করে আমি উপস্থিত পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের স্মৃতিসৌধসংলগ্ন সড়কে মােতায়েন করি, যাতে সমবেত কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে; ভুট্টোর গাড়িবহর যাতে বাধা না পায়।
এদিকে লােকসমাগম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমার মনে হলাে, ঢাকার মতাে এখানেও হয়তো ওই লােকগুলাে ভুট্টোকে সংবর্ধনা জানাতে এসেছে। আমি কয়েকজন সদস্যকে সমবেতদের পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দিলাম। জানতে পারলাম, সমবেত লােকজনের মধ্যে মাদ্রাসা ছাত্রের সংখ্যাই বেশি।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভুট্টোর স্মৃতিসৌধে আর কোনাে খবর নেই। একপর্যায়ে পুলিশের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানতে পারি ভুট্টো ঢাকা থেকে রওনাই হননি। অন্যদিকে সমবেতদের দেখে আমাদের, বিশেষত আমার, সন্দেহ হলাে স্মৃতিসৌধে যাতে বেশি লােকজন হয়, সে জন্যই ভুট্টো ইচ্ছে করে দেরি করছেন। ভুট্টো আসার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত লােকজন ঢাকার মতাে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে পারে। এ অবস্থায় আমি তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নিই। আমি রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দ্রুত খবর পাঠালাম। সাদা পােশাকে রক্ষীবাহিনীর আরও কিছু সদস্যকে যত দ্রুত সম্ভব স্মৃতিসৌধে পাঠাতে বললাম। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তারা চলে আসেন। তাদের আমি সমবেত লােকজনের মধ্যে মিশে যাওয়ার নির্দেশ দিই। কেউ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিলে তাকে ধরে সঙ্গে সঙ্গেই রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলি। যারা পােশাক পরে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাদেরও নির্দেশ দিলাম, যারা শ্লোগান দেবে তাদের যেন ঘিরে ফেলা হয় এবং স্লোগানদাতাদের যেন গ্রেপ্তার করা হয়।
ভুট্টার সফরসঙ্গীদের কয়েকজন সকাল থেকেই স্মৃতিসৌধে ছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন এয়ার মার্শাল নূর খান১১। জুন মাসের প্রখর রোদ আর তাপে তিনি দাড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘাসের ওপর বসে পড়েন। কারণ, নির্মাণাধীন স্মৃতিসৌধ এলাকায় বসার তেমন কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। তখন প্রায় দুপুর, সূর্য মাথার ওপর কিন্তু ভুট্টো আসছেন না। আমি নূর খানের পাশে বসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভুট্টো আসছেন না কেন? বললেন, তিনি জানেন না। বসে থাকতে থাকতে একসময় খবর এল, ভুট্টো আসছেন। তবে গাড়িতে নয়, হেলিকপ্টারে।
বাংলাদেশ সরকারের চাপে এবং দৃঢ়তায় ভুট্টোকে মাথা নত করতেই হয়। দেরিতে হলেও তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসতে বাধ্য হন। ভুট্টোকে আমি আগেও দেখেছি কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলাে, তার চোখ-মুখ লাল, গম্ভীর ও বিরক্ত। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে এসেছেন, তা স্পষ্ট বােঝা গেল তার মুখমণ্ডল ও পােশাকের দিকে তাকিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নির্মম নির্যাতন আর নিষ্ঠুরতায় যে ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণহানি হয়েছিল, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভুট্টোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনি একটা সাধারণ বেশে, মাথায় গলফ টুপি পরে এসেছিলেন।
জুলফিকার আলী ভুট্টো স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক দেওয়ার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ লােকজনের মধ্যে কেউ কেউ ‘ভুট্টো জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ধ্বনি ভূট্টোর কানে পৌছেনি। এর আগেই লিডার মােজাফফর হােসেনের নেতৃত্বে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাদের ধরে ট্রাকে উঠিয়ে রক্ষীবাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। ভুট্টো শহীদ বেদিতে ফুলের স্তবক অর্পণ করে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরে যান।
বাংলাদেশ সফর শেষে ভুট্টোর পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার দিন আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে হােটেল থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তায় কোনাে লােক থাকবে না। সে অনুযায়ী রাস্তায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যথা বাংলামােটর মােড়, ফার্মগেট এলাকায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের মােতায়েন করা হয়। তার পরও ভুট্টোর যাওয়ার সময় দেখা গেল মগবাজার থেকে বাংলামােটরের দিকে একদল লােক আসছে। সাভারের মতাে এরাও ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের যথাসময়ে প্রতিহত করা হয়।
তেজগাঁও বিমানবন্দরের উল্টো দিকে বিমানবাহিনীর বর্তমান অফিসার্স মেসের ফ্যালকন হলের পাশে একদল লােক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সরে যেতে বললে তারা সরে যায়। কিন্তু একজন মধ্যবয়সী লােক সেখান থেকে কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। দিদারুল আলম নামের রক্ষীবাহিনীর একজন ডেপুটি লিডার সেখানে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, দু একজন পথচারী থাকলে তো কোনাে ক্ষতি নেই। কিন্তু ভুট্টোর গাড়িবহর যাওয়ার সময় ওই লােক উচ্ছ্বসিত হয়ে দুহাত নেড়ে ভুট্টোকে বিদায় জানাতে থাকে। একপর্যায়ে লােকটি ভুট্টোর গাড়ির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। দিদারুল আলম এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে তার পিঠে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে। লােকটা মাটিতে পড়ে যায়।
পরদিন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অভিযােগ আসে যে রক্ষীবাহিনী তাদের অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার শামিম আহমেদকে নির্যাতন করেছে। আমরা বিমানবাহিনীকে জানাই যে রক্ষীবাহিনী কাজটা ঠিক করেনি। কিন্তু স্কোয়াড্রন লিডার শামিম আহমেদ সাদা পােশাকে ছিলেন। তার পােশাকে বিমানবাহিনী লেখা ছিল না। আমরা আরও জানাই যে সেখানে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের কথায় অন্যরা সবাই চলে যান। কিন্তু স্কোয়াড্রন লিডার শামিম জায়গা ছেড়ে যাননি। তাঁর এত ভুট্টো-প্রেম কেন তদন্ত করে দেখা উচিত। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এরকম কিছু ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
আরও কয়েকটি ঘটনা: বঙ্গবন্ধু–সাভার–শেখ মনি
খুব প্রাসঙ্গিক না হলেও সে সময়ের অবস্থা বােঝার জন্য কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। এই কাজে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমি ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতাম এবং সময় সময় পরিচালককে অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতাম। একদিন বিকেলবেলা আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান আমাকে তার অফিসকক্ষে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর কাছে গেলে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে দ্রুত গণভবনে যেতে বলেছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে শেরেবাংলা নগরের নতুন গণভবনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ কমরেড় মণি সিংহের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁদের পাশে আছেন আরেকজন মধ্যবয়সী ভদ্রলােক। তার নামটা এখন মনে পড়ছে না। তবে এটুকু মনে আছে, তিনি পেশায় প্রকৌশলী এবং কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য বা শুভানুধ্যায়ী ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে দেখেই তার কাছে বসতে বললেন। আমি তার পাশে বসলে তিনি আমাকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকার হাতে আঁকা একটা ম্যাপ দিয়ে বললেন, ‘শহীদ (আমার ডাক নাম), স্মৃতিসৌধের পাশে একটা জমি আছে। সেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। জমিটা এই ভদ্রলোকের অর্থাৎ সেখানে যিনি উপস্থিত ছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটা বিক্রি করে ওই জমিটা কিনতে চান। বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে আমি চমকে উঠি এবং তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। বঙ্গবন্ধু বলতে থাকেন, তিনি মনে মনে ঠিক করেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে অবসরে যাবেন এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশে ওই জমিতে বাড়ি করে বাকি জীবনটা সেখানে কাটাবেন। ওই বাড়িতে একটা সমৃদ্ধ পাঠাগার থাকবে। সেখানে তিনি লেখাপড়া করবেন এবং সরকার কোনাে ভুল করলে মাঝেমধ্যে হুংকার ছাড়বেন। আরও বলেছিলেন, বিদেশ থেকে কোনাে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান এলে ওই বাড়িতেই তিনি তাকে বা তাদের অভ্যর্থনা জানাবেন। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাে শুনতে আমার খুবই ভালাে লাগছিল। কারণ, বঙ্গবন্ধু যে শীর্ষে উঠেছিলেন, সেই শীর্ষেই তাকে চিরকাল আমি দেখতে চেয়েছিলাম।
ঠিক হলাে, পরদিন আমি আর ওই ভদ্রলােক সাভারে জমিটা কী অবস্থায় আছে এবং সেখানে যাওয়ার রাস্তা করা যাবে কি না ইত্যাদি দেখতে যাব। পরদিন যথাসময়ে ওই ভদ্রলােকের সঙ্গে আমি সাভারে যাই। তখন জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ চলছিল । আমরা হেঁটে জমিতে যাই। জায়গাটি থেকে চারদিকে তাকিয়ে আমার খুব ভালাে লাগল। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজু। দেখা গেল, ওই জমি ও স্মৃতিসৌধ এলাকার মাঝখানে কিছুটা নামা জমি। সঠিক পরিকল্পনা করে যদি বাড়িটি তৈরি করা হয় তাহলে বঙ্গবন্ধু ওই বাড়িতে বসেই প্রতিদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধ আর চারদিকে সবুজের সমারােহ দেখতে পাবেন। জমিতে দাড়িয়ে সেদিন আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা বাংলাদেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের পুণ্য স্মৃতির পাশেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যদি থাকেন, তাহলে সেটা হবে এক অনন্য ঘটনা। বহু বছর পর এখন মনে হচ্ছে, হয়তো তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশেই সমাহিত হবেন, এমনটাও ভেবেছিলেন।
সেদিন জমিটা দেখে আমি ঢাকায় ফিরে আসি। প্রথমেই বিষয়টি এ এন এম নূরুজ্জামানের কাছে রিপাের্ট করি। তারপর সহকর্মী সরােয়ার হােসেন মােল্লা ও আবুল হাসান খানকে বলি। সবাই বিষয়টি জেনে খুব আনন্দিত হন । সন্ধ্যার পর রাত আনুমানিক নয়টার দিকে আমি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। বাসার দোতলায় ব্ঙ্গবন্ধুর শােবার ঘরে একটা টুলে বসে বঙ্গবন্ধুকে জমি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিবরণ দিই। এই সময় বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ার জন্য ডাকেন। বঙ্গবন্ধু আমাকেও তার সঙ্গে খেতে বলেন। খাওয়ার সময়ও বঙ্গবন্ধু জায়গাটার কথা, আশপাশে রাস্তার অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চান। এমন সময় তার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি সেখানে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকেও খেতে বলেন। কিন্তু তিনি খেতে তেমন আগ্রহ দেখালেন না, তবে খাওয়ার টেবিলে বসলেন।
খাওয়ার সময়ও জমি নিয়ে কথা হয়। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথাও ওঠে। সে প্রসঙ্গে শেখ মনি বলে ওঠেন, মামা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকার ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত। এ ধরনের সরকারের রাষ্ট্রপতিই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি হয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাজউদ্দীন সাহেবও উপপ্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। অর্থাৎ শেখ মনি বলতে চাচ্ছিলেন, এ ধরনের সরকারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এক ব্যক্তিই হন। স্পষ্টতই আমি লক্ষ করলাম, শেখ মনির কণ্ঠে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাপারে অভিযােগের সুর। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে কোনাে কথা বললেন না। তবে শেখ মনি যে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটা দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইছেন, তা মােটামুটি বােঝা গেল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নভেম্বর মাসে আমি টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। তখন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সব মন্ত্রী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে আমি দুটো তথ্য জেনেছিলাম এবং আমার দুটো ধরণী হয়েছিল। প্রথমটি ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদের ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে খন্দকার মােশতাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরােধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কুচক্রে পা দিয়েছিলেন। মােশতাক মুজিবনগর সরকারের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা বােঝাপড়া করার অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি কাজী জহুরুল কাইয়ুম ও কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটের কর্মকর্তা জর্জ জি বি গ্লিফিনের মাধ্যমে এ অপচেষ্টা চালান। বিষয়টি টের পেয়ে মুজিবনগর সরকার খন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। সেই থেকে খন্দকার মােশতাকও তাজউদ্দীন আহমদের পেছনে লেগেছিলেন।
দ্বিতীয়টি ছিল শেখ ফজলুল হক মনিকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শেখ ফজলুল হক মনি ভারতে গিয়ে সেখানকার সরকারের কাছে এই মর্মে দাবি উপস্থাপন করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর ভাগনে হিসেবে তাঁর অনুপস্থিতিতে তিনিই বিপ্লবী সরকার গঠন করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু ভারত সরকার ঠিকই জানত যে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদই তার প্রতিনিধিত্ব করবেন। এতে মনঃক্ষুন্ন হয়ে শেখ মনি ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করেন। সেদিন বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘােষণা করেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মুজিবনগরই বাংলাদেশের রাজধানী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম দেশে-প্রবাসে যেখানেই পরিচালিত হােক না কেন, সরকারের নাম হবে ‘মুজিবনগর সরকার’। মুজিবনগর সরকারে শেখ মনির কোনাে অবস্থান না থাকলেও মুজিব বাহিনী গঠনে ভারত সরকার তাকে সহযােগিতা করে। তখন থেকেই শেখ মনি তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। আমার ধারণা, হয়তো তার পরিকল্পনায় ছিল যে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব বিষয়ে অবহিত ছিলেন কি না আমি জানি না। তবে একপর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদের মতাে একটা শক্ত খুঁটিকে সরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজের ঘরের ভিত্তিই দুর্বল করে ফেলেছিলেন বলে আমার মনে হয়। অথচ আমি ভেবেছিলাম, তাজউদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সাভারের স্মৃতিসৌধের পাশে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হিসেবে বাকি জীবন কাটাবেন।
বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ৩০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠান এবং কিছু ঘটনা
১৯৭৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ৩০ তম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরােপের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত যৌথভাবে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন। সেখানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিত হয়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে এ এন এম নূরুজ্জামান, সরােয়ার হােসেন মােল্লা ও আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে আবু তাহেরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি তখন ড্রেজার সংস্থার পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৪ ব্রিগেড অধিনায়ক থাকাকালে সেনাসদর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করায় ১৯৭২ সালের জুন মাসে তাঁকে অবসরে যেতে হয়েছিল। এ ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষুগ্ন ছিলেন। সেদিন ওই অনুষ্ঠানে তাকে একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি একটা মন্তব্য করেন, এভাবে দেশ চলতে পারে না। তার ক্ষোভ যে সরকারের বিরুদ্ধে ছিল, সেটা স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছিল।
পরদিন অফিসে গিয়ে পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানকে আমি বিষয়টি জানাই। তিনি আমাকে বলেন, আবু তাহেরের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ সবাই জানে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এত বড় অবদান ও ত্যাগ থাকা সত্ত্বেও তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করা হয়েছে। যদিও বঙ্গবন্ধু তাকে একটা চাকরি দিয়েছেন, কিন্তু তাতে তিনি খুশি ছিলেন না।
বাকশাল গঠন, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা এবং ই এ চৌধুরী
১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সরকার সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। ধর্মঘট, লকআউট নিষিদ্ধ ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়। সরকারি প্রেসনােটে বলা হয়, সমাজবিরােধীদের কার্যকলাপের কারণে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এরপর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। তখনই দেশে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে সব দলের সমন্বয়ে একটি দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এক মাস পর ২৪ ফেব্রুয়ারি তা শেষ হয়। এ সময় রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সমীকরণ এত দ্রুত হতে থাকে যে মধ্যস্তরের একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আমাদের পক্ষে উদ্ভূত পরিস্থিতি পুরােপুরি অনুধাবন করা সহজ ছিল না। তবে আমরা- সরােয়ার হােসেন মােল্লা ও আমি-পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ছিল, দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরপরই যা করার দরকার ছিল, তা করা হলাে অনেক দেরিতে। যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্য আকার ধারণ করেছে। আমাদের শঙ্কার প্রধান কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা।
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিলির রাষ্ট্রপ্রধান সমাজবাদী সালভেদর আয়েন্দেকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআই এর জড়িত থাকার বিষয়টি আলােচনায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের সঙ্গে আমরা অনেকবার কথা বলেছি। তাকে অনুরােধ করেছি, যাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও কার্যালয়ে অন্যদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদেরও পাহারায় মােতায়েন করা হয়। কিন্তু সরকারের নীতিমালায় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা দলে বা তার অফিস ও বাসভবনের নিরাপত্তার জন্য রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের রাখার বিধান না থাকায় রক্ষীবাহিনীর সদসাদের কখনাে পাহারায় রাখা হয়নি।
এ সময় একদিন পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান আমাদের জানালেন যে, সরকার রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য ‘প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আমরা কিছুটা চিন্তামুক্ত হই। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টে থাকবে কি না জানতে চাইলে নূরুজ্জামান আমাদের জানান, এ বিষয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি ও উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে কথা বলে দেখবেন।
এর কিছুদিন পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হারুন আহমেদ চৌধুরীকে১২ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। এটাও আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় ছিল। কারণ তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযােদ্ধা। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রথষ দিকে কালুরঘাট যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলে আমার স্ত্রী ডা. সাঈদা খান ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন। সে জন্য তিনি আমার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু সহসাই সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে হারুন আহমেদ চৌধুরী ‘প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের’ অধিনায়ক হবেন এবং তিনিই রেজিমেন্টটি গঠন করবেন। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বাছাই করা চৌকস সেনাদের দিয়ে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট গঠন করার প্রক্রিয়া। এ এন এম নূরুজ্জামান রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আলােচনা করে রক্ষীবাহিনীর কিছু চৌকস সদস্যকে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সাল বাংলাদেশের জন্য অনেক অশুভ সংকেত নিয়ে এসেছিল। কিছু সংকেত আঁচ করা গিয়েছিল, কিছু যায়নি। যেগুলাে আঁচ করা গিয়েছিল সেগুলাে সঠিক তথ্যনির্ভর ছিল না। আর যেগুলাে সম্পর্কে আঁচ করা যায়নি, সেগুলােই দেখা গেল ঠিক। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব কোনাে গােয়েন্দা বিভাগ ছিল না। আইন মােতাবেক বাহিনীর দায়িত্বই ছিল বেসামরিক প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী তাদের সহযােগিতা করা। সুতরাং এ বাহিনীর নিজস্ব কোনাে গােয়েন্দা বিভাগের প্রয়ােজনও ছিল না।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের (এনএসআই) প্রধান ছিলেন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এ বি এম সফদার। তার সহকারী ছিলেন পুলিশের ডিআইজি এস এ হাকিম। আমরা আমাদের ব্যস্ততার মধ্যেও বিভিন্ন সময় কানাঘুষা শুনতাম যে এ বি এম সফদার পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি অত্যন্ত অনুগত অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়েও বেশি পাকিস্তানি ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের তথাকথিত নিয়ন্ত্রক পাঞ্জাবিদের সঙ্গে তাঁর ছিল দারুণ হৃদ্যতা। তাদের হয়ে আগ বাড়িয়ে বাঙালি ধ্যানধারণা ও আদর্শের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি দ্বিধা করতেন না। মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সঙ্গেও তার নাকি ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ঢাকায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ছিলেন। বাংলাদেশ নামক, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশটির প্রতি তার কতটুকু আনুগত্য ছিল, সেটাও একটা ভাবনার বিষয় ছিল । এনএসআই-প্রধান ও পরে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভিজিলেন্স টিমের প্রধান হিসেবে তিনি কতটুকু তৎপর ছিলেন, সেটা জানার আমাদের কোনাে উপায় ছিল না। তার সঙ্গে আমাদের কখনাে যােগাযােগ হয়নি । তাকে এনএসআইয়ের প্রধান করার বিষয়টি আমাদের বােধগম্য ছিল না। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেই যেহেতু তাকে এনএসআইয়ের প্রধান করেন, সেহেতু এ নিয়ে আমরা তেমন আলােচনা করতাম না । তবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় এ বি এম সফদারের কার্যক্রম আমাদের কাছে সব সময় রহস্যাবৃত ছিল।
অপর গােয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ই এ চৌধুরী। তিনিও মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ছিলেন। জীবন বাঁচানাের জন্য চাকরি করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনাে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হননি। পাকিস্তান সরকারের অনুগত হিসেবে চাকরি করেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বাস্তবতা দ্রুত আত্মস্থ করেছেন। পেশাদার ও একজন বিচক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। তার সঙ্গে নিয়মিত আমাদের দেখা হতাে।
স্পষ্টতই তার তৎপরতা আমরা দেখতে পেতাম। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে তিনি সব সময়ই চিন্তিত থাকতেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যেসব কথা তিনি রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি বলতে পারতেন না, সে কথা রাষ্ট্রপতিকে বলার জন্য প্রায়ই সরােয়ার আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতেন। আমাদের মতো তিনিও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে থাকা কোনােভাবেই বঙ্গবন্ধুর জন্য নিরাপদ নয়। ই এ চৌধুরী ছিলেন এ বি এম সফদারের বিপরীত। তিনি আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।
অন্যদিকে ডাইরেক্টর জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ভিজিএফআই) ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গােয়েন্দা সংস্থা। ১৯৭৫ সালে এই সংস্থার মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত সামরিক কর্মকর্তা। তার সম্পর্কেও আমাদের তেমন কিছু জানা ছিল না। কখনাে তার সংস্পর্শে যাওয়ার সুযােগ হয়নি আমাদের।
দেশের নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত গােয়েন্দা সংস্থাগুলাের প্রধানদের বিষয়ে এই কথাগুলাে বলার উদ্দেশ্য হলাে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আমাদের তখনকার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেওয়া। কারণ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও পুলিশে খুব বেশি জ্যেষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তা ছিলেন না যাদের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ দেওয়া যায় । সেনাবাহিনী থেকে হয়তাে একজন মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তাকে ডিজিএফআই প্রধান করা যেত, কিন্তু পুলিশ বাহিনী থেকে কাউকে এনএসআই বা স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান করার মতাে মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তা পাওয়া যেত না। কারণ পুলিশ বাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল খুবই কম।
১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের দিকে একদিন সন্ধ্যার পর ই এ চৌধুরী শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঢাকার পুলিশপ্রধান মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। আমরা সাধারণত সন্ধ্যার পরও অফিস করতাম। কারণ আমাদের পরিচালক রাত ১০টার আগে বাড়ি যেতেন না। তিনি ছিলেন অসাধারণ কর্মযােগী। তাঁর কক্ষেই আমরা সবাই বসলাম। ই এ চৌধুরী আমাদের জানালেন, তিনি নির্ভরযােগ্য সূত্রে খবর পেয়েছেন, ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুর ওপর হামলা আসতে পারে । বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করলেন না। তবে তিনি রক্ষীবাহিনীর সাহায্য চাইলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারিভাবে তাে বটেই বেসরকারিভাবেও রক্ষীবাহিনীর ওপর ছিল না। ই এ চৌধুরীর অনুরােধে আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করলেন, সরােয়ার আর আমি সারা রাত বঙ্গবন্ধু ভবনের আশপাশেই থাকব এবং আমাদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সদস্যও থাকবেন।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, সরােয়ার হােসেন মােল্লা ও আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের উল্টো দিকে লেকের ওপারে মিলিত হই । আমাদের সঙ্গে ছিল সাদা পাশাকে এক কোম্পানি রক্ষী সদস্য, কিছুসংখ্যক পুলিশ ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের কয়েকজন গােয়েন্দা। ৩২ নম্বর সড়কের প্রতিটি প্রবেশপথ এবং আশপাশের এলাকায় যথাযথভাবে সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন কিছু পুলিশ ও রক্ষী সদস্য নিয়ে লেকের ওপারে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ি লাগােয়া পার্কে অবস্থান নিই। সেখানে আমরা থাকি সারা রাত। মাঝেমধ্যে তিনজন চারদিক ঘুরে আসি। রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাদা পােশাকে এমনভাবে রাখা হয়েছিল যে সাধারণ মানুষ কিছুই বুঝতে পারেনি। অবশ্য তখনকার দিনে রাতের বেলায় শহরে বেশি মানুষ চলাচল করত না। গাড়িঘােড়াও ছিল না বেশি। সারা রাত দায়িত্ব পালন করেও বঙ্গবন্ধুর ওপর বা তার বাড়িতে আঘাত হানার কোনাে আলামত দেখতে পাওয়া গেল না। খুব সকালে পুলিশ ও রক্ষী সদস্যদের প্রত্যাহার করে আমরা চলে যাই।
বিকেলবেলা জানতে পারি শেখ ফজলুল হক মনি আমাদের ওপর খুব ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। কে বা কারা তাকে জানিয়েছেন যে গভীর রাতে সরােয়ার আর আমাকে তার বাড়ির আশপাশে ঘােরাফেরা করতে দেখা গেছে। তাকে বোঝানাে হয়েছে যে, তােফায়েল আহমেদের নির্দেশে আমরা রক্ষী সদস্যদের নিয়ে তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছি। সরােয়ার আর আমি দেখলাম মহা বিপদ, কী করতে গিয়ে কী হলাে। এ সময় চট করে আমাদের মাথায় বুদ্ধি এল, এই ভুল-বােঝাবুঝির অবসান ঘটাতে আমরা শেখ মনির সঙ্গে দেখা করব এবং প্রকৃত ঘটনা তাকে জানাব। কারণ, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে কোনাে সমস্যাও হতে পারে। আমাদের পরিচালকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করি। তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হন।
সরােয়ার ও আমি সন্ধ্যার দিকে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে দেখা করতে তার বাংলার বাণী অফিসে যাই । আমরা তাকে বিস্তারিত ঘটনা জানাই, অর্থাৎ কী কারণে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, সে ব্যাপারে তাকে অবহিত করি । সব জেনে তিনি আশ্বস্ত হন। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
এর মাস দেড়েক পর স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা অন্য কোনাে সূত্রে আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান ধারণ করেন যে বঙ্গবন্ধুর ওপর রাতের বেল আঘাত্র আসতে পারে। তিনি সরােয়ার এবং আমাকে নির্দেশ দেশ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর নজর রাখতে । বিস্তারিত আর কিছু বললেন না। তবে আমাদের চিন্তার মধ্যে ছিল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের গণবাহিনী অথবা সেনাবাহিনীর কোনাে অংশ এই কাজটা করতে পারে। এবারও সাদা পােশাকে রক্ষীবাহিনীর এক দল সদস্য নিয়ে সরােয়ার ও আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে যাই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অদূরেই শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ি। রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশে রেখে, অল্প কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে আমরা দুজন শেখ মন্দির বাড়ির ড্রয়িংরুমে অবস্থান নিই। তখন শেখ মনি বাড়িতেই ছিলেন। তাতে আমাদের সুবিধা হলাে। রাতে মাঝে মাঝে চা-কফি আসতে থাকল। শেখ মনি নিজে ও তার স্ত্রী আরজু মনি গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকলেন।
আমরা রক্ষীদের মিরপুর রােড, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সাত মসজিদ রােড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক, নিউ মার্কেট এলাকাসহ ধানমন্ডির চারদিকে টহল দিতে বলি। শেষ রাতের দিকে একটা জিপ নিয়ে আমরাও চারদিকে ঘুরে আসি। কিন্তু সন্দেহজনক কোনো কিছুর লক্ষণ দেখিনি। সকালবেলা সবাইকে গুটিয়ে নিয়ে আমরা ফিরে যাই।
আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রদানের বা তার বাড়িতে দায়িত্ব পালনের কোনাে সুযােগ আমাদের ছিল না। নিয়মমাফিক প্রথমে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সেই দায়িত্ব পালন করত। পরে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট গঠিত হওয়ার পর তারা সেই দায়িত্ব পালন করতে থাকে। সে জন্য বঙ্গবন্ধুকে না জানিয়ে গােপনে আমাদের এই দায়িত্ব কয়েকবার পালন করতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে আলােচনায় ই এ চৌধুরীর প্রসঙ্গে কিছু বলতেই হয়। রক্ষীবাহিনী নিয়ে আলােচনায় তার নামটি হয়তাে অতটা প্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনায় প্রাসঙ্গিক। তখন রক্ষীবাহিনীর চাকরির সুবাদে অনেকবার দেখা ও কথা হয়েছে ই এ চৌধুরীর সঙ্গে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করলে তার নিরাপত্তা বিষয়ে ই এ চৌধুরী বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি অনেকবার এবং আমরাও কয়েকবার বঙ্গবন্ধুকে বলেছি তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবন অর্থাৎ বঙ্গভবনে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই বলতেন তিনি চিন্তা করে দেখবেন। ওই বছরের মে অথবা জুন মাসের একদিন–সঠিক তারিখ আমার মনে নেই, ঘটনাটা মনে আছে শুধু, সরােয়ার ও আমি কোনাে এক কারণে সেদিন তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। এমন সময় ই এ চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হন। আমাদের দেখে তিনি বললেন, আপনারা আছেন, খুব ভালাে হলাে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে জুরুরি কথা আছে তার নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে। আপনারা আমার সঙ্গে চলেন। তার আহ্বানে সম্মত হয়ে আমরা তার সঙ্গে তখনই বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম।
বঙ্গবন্ধু এ সময় তার স্টাডিরুমে ছিলেন। সেটা ছিল বাড়ির নিচতলায়। ই এ চৌধুরী আমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই কক্ষে ঢুকেই সেখানে যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, তাদের তিনি বিনয়ের সঙ্গে বাইরে যেতে বলেন। তাঁরা বেরিয়ে গেলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি বললেন, ‘স্যার, এ বাড়িতে আপনি থাকতে পারবেন না, আপনাকে বঙ্গভবনে থাকতে হবে।’ ই এ চৌধুরী বিস্তারিতভাবে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে বললেন। তিনি আরও বললেন, ‘একজন রাষ্ট্রপতির জন্য এ বাড়ি (৩২ নম্বরের বাড়ি) মােটেই নিরাপদ নয়। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে কেউ যদি একটা গ্রেনেও ছুড়ে মারে, তাহলে আপনার বেডরুমে গিয়ে পড়বে।’
আমরা দুজনও ই এ চৌধুরীর বৃক্তব্যকে সমর্থন করি। সরােয়ার আর আমি জোর দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলি যে তার বঙ্গভবনেই যাওয়া দরকার। তিনি আমাদের কথায় তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলাে না। কিন্তু সরােয়ার ও আমি সেদিন নাছােড়বান্দার মতাে বঙ্গবন্ধুকে বােঝাতে চেষ্টা করি যে এই বাড়িতে তার থাকা নিরাপদ নয়। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের দুজনকে বললেন, “আমি তো যেতে পারি, কিন্তু তােদর ভাবি তাে যেতে চায় না”। আমরা বলি যে ভাবিকে তো আপনাকেই বােঝাতে হবে। কারণ, প্রতিদিন শহরের মাঝখান দিয়ে আপনাকে বঙ্গভবনে যেতে হবে, আবার ফিরে আসতে হবে। প্রতিদিন একই সময় এ যাতায়াত বিপদ ঘটাতে পারে। কাজেই বঙ্গভবনে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ সেনা পাহারায় থাকতে পারবেন।
আমাদের অনেক চেষ্টার পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখি কী করি।’
তথ্যনির্দেশ
১. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩।
২. শান্তিনগরে চৌরাস্তা থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যাওয়ার পথে বাঁ পাশে হােয়াইট হল নামের একটি ভবনে সিআইডি পুলিশের কার্যালয় ছিল। ভবনটি এখন নেই ।
৩. দূরবর্তী গােপন শিবির বা আস্তানা।
৪. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বিশের দূত হিসেবে নিয়ােগ দেন।
৫. আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী : বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও নির্বাচিত সাংসদ।
৬. মাহফুজ আলম বেগ। পাকিস্তান নৌবাহিনীর কর্মকর্তা এবং স্পেশাল কমান্ডাে সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে যােগ দেন। জুলাই মাসের পর ৯ নম্বর সেক্টরের শমশেরনগর সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্বাধীনতার পর কিছু ঘটনায় তিনি বিতর্কিত হয়ে পড়েন।
৭. এ পদটি তখন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
৮. শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। ২৫ মার্চ তিনি তার ইউনিটের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মােতায়েন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মার্চ তার নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহ সংগঠনে ও মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত পর্যায়ে সিলেটের রাধানগরে আহত হন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে। পরে পর্যায়ক্রমে কর্নেল।
৯. খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম: ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত থাকাকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে তাকে আটক করা হয়। তিনি ছিলেন ২৭ নম্বর আসামি। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তি পান। কিন্তু তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর জীবনের প্রয়ােজনে তিনি ও আগরতলা মামলার অপর আসামি এ এন এম নূরুজ্জামান একত্রে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা দুজনই ঝাপিয়ে পড়েন। খন্দকার নাজমুল হুদা ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালেই তাকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পর নিয়মিত মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে রূপাস্তুরিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় নিহত। তখন কর্নেল ছিলেন।
১০. হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল : পরে ঢাকা শেরাটন হােটেল, বর্তমানে হােটেল রূপসী বাংলা।
১১. এয়ার মার্শাল নূর খান : পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান। পরে পিআই এর প্রধান এবং ভুট্টোর শাসনামলে তার উপদেষ্টা।
১২. লেফটেন্যান্ট কর্নেল হারুন আহমেদ চৌধী বীর উত্তম: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এবং পরে ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তাতে ; প্রতিরােধযুদ্ধে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কালুরঘাট যুদ্ধে তিনি আহত হন। পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত।
Ref: রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা আনোয়ার উল আলম, pp 99-132